মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৭

নূরী

শেষ পর্যন্ত একজন বালিকাকে আমার বিবাহ করতে হলো।  কোনো এক শীতের সন্ধ্যায় তাকে লাল বেনারশী শাড়ি পড়ানো হলো। মুখে আলপনা আঁকা হলো। হাতে চুড়ি পড়ানো হলো। মেহেদী লাগিয়ে দেয়া হলো দুই হাতে। খুব একটা উৎসব হলোনা। সানাইও বাজেনি। ইচ্ছা ছিলো দুই ঘোড়ার গাড়িতে করে বউ তুলে আনবো, তাও হলোনা। ফুলহীন, সাজসজ্জাহীন একটি সাদা গাড়ীতে করে সেদিন নববধূকে ঘরে তুলে এনেছিলাম।

এ যেনো পুতুলখেলার সংসার শুরু হলো। বাজারে যেয়ে হাঁড়ি পাতিল কিনলাম। বালতি কিনলাম। শীল পাটা কিনলাম। মাদুর,ফুলদানী সব কিনতে হলো। এ এক অত্যশ্চর্য জীবনের শুরু। যা জীবনে কোনোদিন চোখে দেখি নাই। শুনি নাই। বুঝি নাই। এখন আর সকাল বেলা পাখীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষা করতে হয়না। এলার্ম দিয়ে রাখতে হয়না ঘড়িতে।এতো সুুন্দর জীবন আছে জীবনে, আগে বুঝি নাই।

ওর নাম আয়শা নূর। বলেছিলাম তুমি এষা না নুরী। ও বলেছিলো আমি নুরী।
নূরী চঞ্চল হয় সকাল বেলা। রোদ্রের উত্তাপে হয় দহন।
সাওয়ারের নীচে জল ঢালে সারা দুপুর,
সন্ধ্যায় আকুল হয় রবি ঠাকুরের গানে,
মনে পড়ে তার দূর গায়ের কথা
স্টেশনে রেল গাড়ির সেই হুইসেলের শব্দ, মনে পড়ে সেই ঝিকঝিক আওয়াজ।

নুরী ওর বাবার সাথে একদিন বাড়ী চলে যায়। সেখানে ওর ছোটো বোনকে পায় খেলার সাথী করে। দু'জন হেটে হেটে চলে যায় রেল লাইনের ধারে। দূর থেকে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন এসে থামে প্লাটফরমে। হৈ হুল্লর করে যাত্রিরা নেমে আসে কামড়া থেকে।

আমি বুঝতে পারি আমার প্রথম শূণ্যতা।  আলনায় কাপড় হয়ে থাকে এলোমেলো। আবার পাখীর ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ঘুম ভাঙ্গার। জীবনের এতোটা বছর একা লাগেনি। কবিতা লেখার ভাবনা চলে যায় সমান্তরাল রেল লাইনের সেই দূরের প্রান্তে। নিঃসীম শূণ্যতা পড়ে থাকে সেখানে। একদিন ঘুম আসে সন্ধ্যাবেলা, আরেকদিন সারা রাতেও না।

আর একদিন রাতের বেলা ল্যাম্পের আলো জ্বেলে চিঠি লিখতে বসি-
'নূরী, তুমি চলিয়া যাইবার পর হইতে আমার খাওয়ার অরুচি হইয়াছে। প্রত্যহ অফিসে যাইতে লেট হইতেছে। ঘুমও ঠিকমতো হইতেছেনা। অনেক চেষ্টা করিয়াছি,স্বপ্নে তোমাকে কাছে পাইতে। কিন্তু একদিনও তোমাকে পাই নাই। যাহা হোক,পত্র পাঠ তুমি চলিয়া আসিও। ইতি-

উত্তরে নুরী লিখলো-
'প্রিয়তম, তোমার চিঠি পেলাম। আমি এখানে খুব ভালো আছি। আমরা প্রতিদিন রেল লাইনের ধারে বেড়াতে যাই। কাল কাজিপুরা নানী বাড়ী বেডাতে যাবো। উল্লাপাড়া ছোটো ফুপুর বাড়ীতেও যাবো। বেশী খিদা লাগলে তুমি আজিজের হোটেলে খেয়ে নিও। রবীন্দ্রনাথের গান শুনিও। তবেই ঘুম আসবে। ইতি- নুরী।


নুরীতে থাকে মুক্তা, পাথরে ভারী হয়ে থাকে বুক
যমুনার জলে রুপালী মাছের ঝাঁক ঘুরে বেড়ায়
হেমন্তের রাত্রিতে চাঁদ নেমে আসে দুই পাড়ে-
তার চোখ আমাকে বিষন্ন করে, কোথায় পড়ে আছে
বকুল ফুলের মালা খানি। আমি প্রতিদিন চেয়ে থাকি
অন্ধকারে- বালিকা চলে আসছে
রেল লাইনের স্লিপারে হেটে হেটে।.

আমি নিজেই ওকে দেখতে চলে যাই একদিন। রাজশাহী এক্সপ্রেস ট্রেনটি থামলো জামতৈল স্টেশনে। তখন সন্ধ্যা হয়েছে। মুগ্ধতার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম বুকের তল থেকে। রক্তের স্পন্দন বাড়ছিলো তাকে দেখবার আনন্দে। বাড়ী পৌঁছে শুনি- ছোটো ফুফুর বাড়ীতে নুরী বেড়াতে গেছে। আজকেই ওর ফেরার কথা ছিলো।

দূর ভ্রমনে শরীরে ক্লান্তি এসেছিলো। মন খারাপের চোখে খুব ঘুম পায় । শুয়ে পড়ি তাই তাড়াতাড়ি। সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গে- তখন চোখ মেলে দেখি পাশে নুরী শুয়ে আছে। ওর একটি হাত আমার বাহুতে জড়ানো। তখনো তার ঘুম ভাঙ্গেনি।

তারপর পাখী সব কলরব করে ডেকে উঠলো
ভোরের আলো জ্ব্বলে  ওঠে হুরাসাগর নদীর জলে.
দখিনা বাতাস বেগ পায় ধানক্ষেতের পাতায়
স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় রাতের ক্লান্ত ট্রেন খানি
নিঃসঙ্গ পাখিরা উডে উড়ে চলে যায় মেঘে
তখন গান কবিতা হয়,কবিতা হয়ে যায় গান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন