বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৭

কালা চোর

ঘটনাটি ঘটেছিলো এক অস্থির সময়ে। ১৯৭৬ সালের মার্চ এপ্রিলের দিকে হবে । গ্রামে গঞ্জে তখনো পুরোপুরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। জাসদের গণ বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির খুন খারাবী, নক্সালদের হাতে গুম খুন লুট - গ্রাম এলাকায় তখন চরম ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু এইসব নৈরা্জ্য দমন শুরু করেছিলেন বটে কিন্তু পঁচাত্তরের আগস্টে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর তা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান অবশ্য এইসব অরাজকতা কঠোর হস্তে দমনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

ছেলেটির নাম কালা। গায়ের রং ছিলো কুঁচকুঁচে কালো। ২১/২২ বছরের সুঠাম যুবক। ওর বাবার নাম ছিলো দানেশ। পেশায় চোর। সিধেল চোর যাকে বলে। দানেশ তার ছেলে কালা'কেও চৌর্য পেশায় নামায়। ওদের একটা নীতি ছিলো-, ওরা কখনো নিজ গ্রামে কিংবা আশে পাশের গ্রামে চুরি চামারী করতোনা। দূর গাঁয়ে সিঁদ কেটে  চুরি করতো। তবে কখনো কাউকে খুন জখম করেনি। চোর হিসাবে ওরা খুবই নিরীহ ও ভদ্র ছিলো।

একদিন আশে পাশের ৩/৪ গ্রামের কিছু মানুষ কালাকে ধরে এনে শালিসে বসায়। শালিসটি বসেছিলো আমাদের পাশের গ্রামের এক স্কুল ঘরে। আর কালাকে শালিস চলাকালীন সময়েই বেদম মারপিট করে আড়মরা করে বেঁধে রেখেছিলো স্কুল মাঠের গাছের সাথে। ওর শরীরের বিভিন্ন জখম থেকে তখন রক্ত ঝরছিলো। ঐ শালিসের অন্যতম বিচারক ছিলো-পাশের গ্রামের এক যুবক। বিচারে রায় হয় কালার মৃত্যদন্ড।

তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। সকাল থেকে কালা অভুক্তই ছিলো। তখনো তাকে গাছের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা ছিলো। ওর অন্তঃস্বত্তা স্ত্রী ওকে দেখতে আসে। কালা তখনো জানেনা তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করা হয়েছে। ওর স্ত্রী ওর পাশে বসে কাঁদতে থাকে। স্ত্রীর এই রকম অঝোর ধারায় কান্না দেখে কালা মনে হয় লজ্জা পাচ্ছিলো। কালা ওর স্ত্রীকে বলে- 'কান্দিতোছো ক্যান,বাইত চইলা যাও।' ওর স্ত্রীর হাত ধরে  ছল ছল চোখে তাকিয়ে থেকে আবার বলে- 'কাইন্দোনা,বাইত যাও।'

স্কুল ঘর থেকে পাশের গ্রামের যুবকটি বের হয়ে আসে। গরুকে যেভাবে মাঠে নিয়ে যায়, ঠিক তেমনি ভাবে ঐ যুবক কালাকে  টেনে বেঁধে দূরে বিরাণ মাঠের দিকে নিয়ে যায় । প্রায় পাঁচশত গজ ফাঁকে শতো শতো মানুষ তখন দর্শক হিসাবে দাড়িয়ে দেখছিলো সব । দূর হতে দেখা গেলো- সেই যুবক কালাকে বেওনেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে মেরে ফেলছে। কালার রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে থাকে নির্জন প্রান্তরে ধানক্ষেতের ভিতর।

ততোক্ষণে পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্তমিত হয়েছে। মসজিদে আযান  হচ্ছে। মন্দিরে শঙ্খধ্বনি বেজে উঠেছে। শতো শতো মানুষ ঘরে ফিরছে। কেউ উল্লাস করছে। কারো চোখে মুখে বিষাদ। হতভাগ্য কালা চোরের লাশটি ধানক্ষেতেই পড়ে থেকেছিলো সারারাত। লাশটি দাফন হয়েছিলো, না শিয়াল কুকুরে খেয়েছিলো,আজ আর তা মনে নেই।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন