মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৭

কাজল রেখা

আজ আমার এই চিলকোঠার ছোট্ট ঘরে কাজলের বউ হয়ে আসার কথা ছিলো। সজ্জায় বিছিয়ে রাখার কথা ছিলো ফুলের পাঁপড়ি। জ্বালাতে চেয়েছিলো ঘরে আলো। এসব আজ কোনো কিছুই হলোনা। আমি ঘরকে আঁধার করে একাকী বসে আছি। কোনো আলো জ্বালাতে ইচ্ছা করছেনা। সিগারেটের ধূয়ায় রুমটা অন্ধকারে ভরে গেছে।

 কাজল রেখা। আমি ডাকতাম ওকে কাজল বলে। ওর বাবা মা ডাকতো রেখা। ঢাকা শহরের এই জনারণ্যে পথ চলতে চলতেই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। পথের মানুষ পথেই যেন প্রিয় মানুষের দেখা পেয়ে গেলাম। এক বৃষ্টি  ঝুমঝুম সন্ধ্যায় দাড়িয়েছিলাম গুলিস্তান বাস স্টান্ডে রাস্তার উপরে। বৃষ্টিতে ভিজতেছিলো আমার মাথার চুল। পাশে দাড়ানো মেয়েটা ওর ছাতাটা এগিয়ে দিয়েছিলো আমার মাথায় উপর। রাস্তার উপরে এই প্রথম কোনো মেয়ের কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়া, প্রথম কোনো মায়া দিয়েছিলো একজন অপরিচীতা। সে এই কাজল।

মতিঝিল এরিয়ায় কাজল একটি চাকুরী করতো। আমারও চাকুরীস্হল ছিলো মতিঝিলেই।আমি অস্থায়ী ছোটো একটি চাকুরী করি,বেতন ভাতা নগন্য। কাজলের সাথে আমার প্রায়ই দেখা হতো, কথা হতো। কোনো কোনো দিন রাস্তার উপর হোটেলে বসে আমরা লাঞ্চ করতাম। কোনো কোনো দিন পাউরুটী কলা, কোনো কোনো দিন নোনতা বিস্কুট আর চা খেতাম।

এই ভাবেই চলতে চলতে দু'জন দু'জনার প্রতি মায়ায় বেঁধে যাই। দু'জন দু'জনকে ভালোবেসে যাই। জগৎ সংসারে কোনো পাওয়াই মনে হয় মসৃন হয়না। কাজল যখন আমার কথা বলেছিলো ওর মা বাবার কাছে, তখন তারা বলেছিলো 'না'। এ ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হবেনা। আমার মতো চালচুলোহীন ছেলের কাছে কোনো বাবা মা তার আদরের মেয়েকে তুলে দিতে চায় ?  কেমন যেনো মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। মনে হয়েছিলো এ জীবনে কাজলকে আমি আর পাবোনা। যাকে এতো আপন করে কাছে টানতে চাইলাম ,সে তাহলে দূরেই থাকবে।

গতকাল আমরা দুজনই লাঞ্চের পর আর অফিসে যাইনা। একটি রিক্সা নিয়ে বলদা গার্ডেনে চলে যাই। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল হয়েছে। আমরা দু'জন ঝাউবনের পাশে সবুজ ঘাসের উপর যেয়ে বসি। জারুল আর মহুয়াবনে পাখীরা তখন কিচির মিচির করছিলো। কথা বলছি দু'জনে, ভালোবাসছি দু'জনে। যেনো ' বাতাসের কথা সে তো কথা নয় রূপ কথা ঝরে তার বাঁশিতে আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই যেন দুটি আঁখি ভরে রাখে হাসিতে।'  কেনো জানি ভানু চক্রবর্তীর কবিতার এই চরণটি আমার বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলো- 'পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থি।' গার্ডেনের সবুজ ঘাসে বসেই দু'জন সিদ্ধান্ত নেই. আগামীকালই আমরা কোর্ট ম্যারেজ করবো।

সন্ধ্যার পাখীরা সব কলোরব করে উঠলো। বাগানের সব ফুল যেনো ফুটে উঠতে লাগলো। সুবাস ছড়িয়ে পড়তে থাকলো চারদিকে। মৃদুমন্দ বাতাস বইতে লাগলো। কাজল কখন আমার হাত ধরেছিলো,খেয়াল নেই। সন্ধ্যার আলো আধারীতে ওর আনত মুখখানি একবার দেখলাম। জগতের সমস্ত সুখের আভা যেনো ছড়িয়ে আছে ওর চোখে মুখে। '
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হারিয়ে. মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ। তব ভুবনে তব ভবনে. মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান।' গার্ডেন থেকে আমরা বেরিয়ে আসি । কাজল রিক্সায় উঠে বক্সীবাজারে ওদের বাসার দিকে চলে যায়। যাবার বেলায় বলে যায়- কাল তোমার চিলেকোঠায় বউ হয়ে আসছি।
 
চিলেকোঠায় ফিরে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে ভাবছিলাম- এই ছোট্র ঘরে কাল কাজল আসবে। আমার চুলো জ্বালাবে। সন্ধ্যাবাতি জ্বালাবে ঘরে। ছোট সংসার হবে। ঘরবাড়ী গোছাবে লক্ষ্মী ঐ মেয়ে। যে স্বপ্ন দেখেছিলাম,তারুণ্যের প্রথম প্রহরে, তা যেনো কালকেই পূরণ হতে যাচ্ছে। আমার মন প্রাণ উল্লসিত হয়ে উঠলো।


হঠাৎ দরজায় কড়ানাড়ার শব্দ শুনতে পাই। দরজা খুলে দেখি- একটি অপরিচিত লোক দাড়িয়ে। উনি বলছিলো- আমি হাসপাতাল থেকে এসেছি।কাজল নামে একটি মেয়ে আমাকে পাঠিয়েছে। উনি রোড এক্সিডেন্টে আহত হয়ে জরুরী বিভাগে আছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রক্ত দরকার।'


আমি ্দ্রুত হাসপাতালে চলে যাই। হাসপাতালের জরুরী বিভাগের কোরিডোরের সামনে আমি দাড়ানো। ডাক্তারকে বলি- কাজল এখন কেমন আছে ?  
ডাক্তার : আপনি ওনার কি হন ?
আমি :   আমি ওর কিছু হইনা।
ডাক্তার :  ও আচ্ছা।
আমি:  ওর সাথে আমি কি একটু কথা বলতে পারবো ?
ডাক্তার :  উনি এখন জীবনেও নেই, মরনেও নেই। আপনি ভিতরে যান। দেখেন আপনার সাথে উনি কথা বলে কি না ?

কাজল আমার সাথে কথা বলেনি। রুম হতে বের হতেই দেখি- এক পৌঢ় ও একজন বয়স্কা মহিলা বাইরে দাড়ানো। কাজলের বাবা মা হবে হয়তো। তারা কাঁদছে। হাসপাতালের কোরিডোর দিয়ে হাটতে হাটতে আমি রাস্তায় চলে আসি। যে জনারণ্যে একদিন কাজলকে খুঁজে পেয়েছিলাম, সেই জনারণ্যেই আমি হারিয়ে গেলাম।

             

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন