শনিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৭

নদীর কূলে খুঁজি তারে

অনেক বছর আগের এই কাহিনী । ইছামতি নদীতে তখন হেমন্তেও জল থাকতো। শান্ত সৌম্য স্রোত কার্তিক মাসেও প্রবাহমান থাকতো। এই নদীর তীরেই গারোদহ গ্রাম। গ্রামের উত্তর প্রান্তে খোলা মাঠে ছিলো অনেক জীর্ণ পুরানো একটি মঠ। এর পলেস্তারার ফাঁকে অনেক লতা গুল্ম জন্মেছে। মঠের বয়স কতো শতো বৎসর হবে তা কেউ বলতে পারেনা। এই মঠে কার দেহ ভস্ম রাখা হয়েছিলো, তার কোনো কিংবদন্তীও নেই।

মঠের অদূরে একটি পাকুর গাছতলায় প্রতিবছর ছোট্র আকারে কার্তিক মাসের কৃষ্ণতিথির শেষ তিন দিনে মেলা বসতো। দূর দুরান্ত থেকে কিছু সাধু সন্নাসী আসতো এখানে। সারারাত গান হতো। কীর্তন,ভজন সহ নানান গান গাওয়া হতো। এখানে বিভিন্ন রোগীরাও আসতো। ধর্মীয় অর্চণার মাঝে তারা রোগ মুক্তির প্রার্থনা করতো। দূরের মানুষদের জন্য অস্হায়ী ধর্মশালারও ব্যবস্হা করা থাকতো ।

মঠের পাশে সেবার মেলা শুরু হয়েছে। এই গারোদহ গ্রামেই কানাই দেব বর্মনের বাড়ী। বর্মনরা ছিলো খুব রক্ষণশীল। পরিবারের মেয়েরা খুব বেশী বাইরে বের হওয়ার সুযোগ পেতোনা। এই বর্মণবাড়ির কিশোরী মেয়ে পিয়ালী। বয়স কতোই হবে, এগারো বারো । পিয়ালী মেলা দেখবার অনুমতি পায় বাবার কাছ থেকে। কিন্তু সাথে যাবে ওর দিদিমা।

মেলার শেষ দিনে পিয়ালী ওর দিদিমার সাথে মেলায় যায়। তখন পরন্ত বিকেল। ধানক্ষেতের আলপথ দিয়ে, নদীর তীর ধরে হেটে হেটে মেলার দিকে যাচ্ছিলো। মঠের কাছাকাছি নদীর কুলে বকুলতলায় একাকী এক বালক করুণ সুরে বাঁশি বাজাচ্ছিলো। সুরটি ছিলো রজনীকান্তের একটি গানের। দিদিমা আগে, পিছে পিছে পিয়ালী। ওরা ঐ বালকটির কাছাকাছি যেতেই বালক তার বাঁশি বাজানো বন্ধ করে দেয় এবং মুখ ফিরিয়ে পিয়ালীকে পলকহীন ভাবে দেখতে থাকে। পিয়ালীও বালককে অতিক্রম করার পরও পিছেনে ফিরে বার বার দেখছিলো।

তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পিয়লী আর ওর দিদিমা মেলা থেকে ফিরছিলো ঐ পথ দিয়েই । ছেলেটি তখনো বসেছিলো বকুলতলায়। তখনো সে বাঁশি বাজাচ্ছিলো। পিয়ালীকে দেখে বালক বাঁশি বাজানো বন্ধ করে। এবারো বালক নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে পিয়ালীর দিকে। এবার পিয়ালী ওর হাটা ধীর করে ফেলে। দিদিমা পিছনে না খেয়াল করেই সামনে অনেকদূর পর্যন্ত চলে যায়। তখন সন্ধ্যার আধার বেশ কালো হয়ে উঠেছে। পিয়ালী এগিয়ে বালকটির কাছে যায়। পিয়ালী বলে: 'তুমি কই থেকে এসেছো ?' বালক যে গ্রামের নাম বলে, পিয়ালী তা চিনতে পারেনা।
পিয়ালী:  তুমি অনেক সুন্দর বাঁশি বাজাও।
বালক:   হু।
পিয়ালী:  তুমি আমাকে অমন করে তাকিয়ে দেখছিলে কেন ?
বালক:  আমার চোখে খুব অসুখ। বাবা আমাকে এখানে আজ সকালেই নিয়ে এসেছে। কাল সূর্য ওঠার আগেই আমরা চলে যাবো। আমি যদি অন্ধ হয়ে যাই, তাই তোমাকে দেখছিলাম বেশী করে। অন্ধ হয়ে গেলেও তোমাকে যেনো মনে রাখতে পারি। কিন্তু এই সন্ধ্যা রাতের অন্ধকারে তোমাকে যতোটুকু দেখলাম তা আমার মনে থাকবেনা।

ওর কথা শুনে পিয়ালীর মনটা একটু খারাপ হলো। মেলা থেকে কেনা বাঁশিটি ছেলেটিকে দিয়ে দেয়।আর ছেলের হাতের বাঁশিটি কেড়ে নিয়ে দ্রুত হেটে দিদিমার কাছে চলে যায়।

তারপর সাত বছর চলে গেছে।:পিয়ালী এখন তন্বী তরুণী। বাবা কানাইদেব বর্মন অনেক দেখে শুনে পিয়ালীর বিবাহ ঠিক করলেন। ছেলে এগারো মাইল দূরে কালোকুশি গ্রামের। ছেলে রায় পরিবারের। খুবই ভালো,অমায়িক,ভদ্র,রুচিবান, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক সে।

এক শ্রাবণ বর্ষার দিনে ইছামতি নদী দিয়ে পানসি নৌকায় করে বরযাত্রিরা চলে আসে। চারিদিকে রাশি রাশি আনন্দ বইছে। রাত তখন গভীর, সবাই বলছে- এখন লগ্ন হয়েছে। ব্রাহ্মণ বিবাহের মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন। সানাই বেজে উঠলো। পিয়ালী শ্যামল কৃষ্ণ রায়ের সাথে সাত পাকে বাঁধা পড়লো।

স্বামীর ঘরে যেয়ে পিয়ালী সংসারের প্রতি অমনোযোগী ছিলো। স্বামী শ্যামল কৃষ্ণ রায়কে খুব একটা দেখ্ ভাল্ করতোনা। কালোকুশী গ্রামের পাশ দিয়েও ইছামতি নদী বহমান। ঘরের জানালা খুললেই ইছামতি নদী দেখা যায়। পিয়ালী প্রায়ই জানালার কাছে দাড়িয়ে থাকতো। নদীর দিকে উদাস দূষ্টিতে তাকিয়ে জল দেখতো। কেমন যেনো উদাস সে। কেমন যেনো পাগলিনী সে। পিয়ালী কারো সাথে ভালোভাবে কথা বলতো না। ঠিকমতো নাওয়া খাওয়া করতোনা। স্বামী শ্যামল কৃষ্ণ উজার করে তাকে ভালোবাসা দিয়ে গেছে। কিন্তু কোনো প্রেম,কোনো মায়া মমতা পিয়ালীকে আচ্ছন্ন করতে পারে নাই।

এমনিভাবেই দশ বছর কেটে গেছে। পিয়ালী একসময় কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়। শরীর শুকিয়ে আসে। প্রাণ শক্তি ফুরাতে থাকে। চোখের পাতা কালো হয়ে যায়।  পিয়ালী শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। ঘরের মধ্য তখন কেউ ছিলোনা। পিয়ালী স্বামীকে কাছে ডাকে। বলে- 'আমার হাতটি একটু ধরো,আমাকে বুকে জড়িয়ে ঐ জানালার কাছে নিয়ে যাও।' শ্যামল পিয়ালীকে জানালার কাছে নিয়ে যায়। পিয়ালী মায়াময় চোখের দৃষ্টি মেলে দেখে ইছামতি নদীর শান্ত সৌম্য জল। পিয়ালী শ্যামলকে বলে- 'তুমি কি আমাকে একটু ধরে সিন্ধুকের কাছে নিয়ে যাবে ?'  শ্যামল পিয়ালীকে সিন্ধুকের কাছে নিয়ে যায়। শ্যামলই সিন্ধুকটা খুলে দেয়। পিয়ালী সিন্ধুকের ভিতর থেকে কাপড়ে মোড়ানো কি যেনো একটি জিনিস বের করে।

পিয়ালী খুব হাপাচ্ছিলো। শ্যামলকে বলে 'আমাকে বিছানায় শোয়ায়ে দাও'। পিয়ালীকে শোয়ায়ে দেয়। আবারো শ্যামলের হাত ধরে পিয়ালী বলে- 'আমি তোমাকে কোনোদিন ভালোবাসিতে পারি নাই। তুমি আমাকে কথা দাও, তুমি আর একটি বিয়ে করবে। সংসার করবে। আমি তোমাকে সন্তান সংসার দিতে পারি নাই।' কাপড়ে মোড়ানো জিনিসটা দেখিয়ে বলে- ' এর মধ্যে অমঙ্গলের অভিজ্ঞান আছে। তুমি ইছামতি নদীতে এটি ফেলে দেবে। ঘরে রাখলে,তোমার সংসারে অমঙ্গল হবে।'

তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। শ্যামল নিজেই কেরোসিনের বাতি জালিয়ে আনে। পিয়ালী বলছিলো- 'আমার খুব ঘুম পা্চ্ছে, একটা গান গেয়ে শোনাও না লক্ষ্মীটি !' শ্যামল তখন গায়ছিলো-  'তুমি, নির্মল করমঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে। তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে' । পিয়ালী গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায়। ওর আত্মা বুঝতে পারছিলো, আজ থেকে সতেরো বছর আগে এই গানের সুর তুলেছিলো বাঁশিতে এক বালক, ইছামতির তীরে বকুলতলায়।

শ্যামল কৃষ্ণ রায় পরেরদিন শ্মশাণে স্ত্রীর সৎকার করে বাড়ী ফিরলেন। ইছামতি নদীতে স্নান করবার যাবার সময়,কাপড়ে মোড়ানো জিনিসটা নিয়ে ঘাটে যায়। মোড়ানো কাপড় খুলে সে দেখতে পায়, একটি পুরানো বাঁশি। যে বাঁশিটি এক কিশোরী বালিকা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিলো সতেরো বছর আগে এক সন্ধ্যায়,ইছামতির নদীর তীরে।



   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন