বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৭

পদ্মাবতী

আমি আর আমার স্ত্রী  ২০০৯ সালে ডুয়ার্সের অরণ্য দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের শিলিগুরির বন্ধু শিশির রায় বলেছিলো, এসেছোই যখন, এক ফাঁকে তোমরা কোচবিহারের রাজবাড়ীটাও দেখে নিও, ভালো লাগবে। শিলিগুরির এনজে জংশন থেকে একদিন আমরা কাঞ্চনজঙ্গা এক্সপ্রেসে কোচবিহার চলে যাই। ছিমছাম সুন্দর শহরটির ইলোরা হোটেলে আমরা উঠি। ভখন বিকাল হয়ে গিয়েছে। সেদিন আর রাজবাড়ী দেখতে যাইনা। সন্ধ্যায় রি্ক্সায় মদনমোহন মন্দির দেখতে যাই। সেখানে কৃষ্ণ মূর্তির পাশে বসে অনেকক্ষণ আমরা কীর্তন শুনেছিলাম।

রাতে ক্যাফেতেই খেয়ে নেই। খেয়ে হোটেল রুমে বসে আমরা গল্প করছিলাম।সে সময়ে হোটেল এ্যাটেন্ডেন্ট  রুমে প্রবেশ করে। ও বলছিলো আমাদের সুবিধা অসুবিধার কথা। ওর নাম কৃষ্ণ কুমার। মধ্য বয়সী অসমীয়া লোক।শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে। বাড়ী আসামের ডিব্রুগড়ে। কথায় বুঝতে পারলাম.লোকটা খুবই পরোপকারী এবং ভদ্র। আমরা ওর কাছ থেকেই জানার চেষ্টা করি রাজবাড়ীর কথা। এই রাজবাড়ী সম্পর্কে বলতে গিয়েই কৃষ্ণ কুমার আমাদের একটি কাহিনী শোনায়েছিলো। ও শুনেছিলো নাকি ওর পিতামহের কাছ থেকে, আর পিতামহ শুনেছিলো তারও পিতামহের কাছে। অনেকটা কিংবদন্তীই বলা যায়। শুনুন এবার সেই কাহিনী।


১৬২১ সালে রাজা দীননারায়ণ কোচবিহারের সিংহাসনে বসেন। রাজা ছিলেন প্রবৃত্তির বশবর্তী। তাঁর চরিত্রে ছিল লাম্পট্যের আধিপত্য। যদিও তিনি সংগীতপ্রেমিক  ও সংস্কৃতিমনস্ক ছিলেন, কিন্তু নিজের রাজত্বের বহু উচ্চবংশীয় নারীকে তিনি হরণ করে নিয়ে যেতেন, এবং তাঁদের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হতেন।


চিকনা পাহাড়ের পাদদেশের নিরিবিলি টিলা বেষ্টিত একটি লোকালয়। পাশেই খরস্রোতা কালজানি নদী।এই নৈসর্গিক উপত্যাকার একটি গ্রামে থাকতেন এক পন্ডিত মশায়। আশে পাশের ছেলেরা এসে এই পন্ডিতের কাছে লেখাপড়া করতো। পন্ডিত মশাইয়ের একটি ষোড়সী মেয়ে ছিলো নাম পদ্মাবতী। উদ্ভাসিত নব যৌবনা, টানা টানা পিঙ্গল চোখ, মাথা ভর্তি কালো চুল, মৃগনাভি,চিকন কোমড়, প্রসারিত বক্ষরাজি, তোর্সা নদীর বাঁকের মতো তার উরু। একদিন রাজা দীন নারায়ন তার সঙ্গী নিয়ে ঘোড়ায় চরে উপত্যাকার ঐ পথে যাচ্ছিলো।পদ্মাবতী তখন কালজানি নদীতে স্নানরত। রাজা দীন নারায়ন সেই দৃশ্য দেখে ফেলে। সে তখন সঙ্গীদের প্রাসাদে পাঠিয়ে দেয়। লম্পট দীন নারায়ন তার পৈশাচিক নিবৃতি প্রথম চরিতার্থ করে এই কালজানি নদীর উপকূলে।


এরপর কালজানির নদীর কালো জল অনেক গড়িয়েছে। রাজা দীন নারায়ন এই উপত্যাকায় এসেছে বার বার। একসময় পদ্মাবতী গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এ কথা লোক সমাজের কেঊ জানতোনা। সন্তান জন্ম দেয়ার দুইতিন মাস আগে পদ্মাবতী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। পাশের পরগনা দেওহাটায় ওর এক মাসি থাকতো। সেখানেই পদ্মাবতী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। নাম রাখে ইলা। এই ইলাকে নিঃসন্তান মাসীর কাছে রেখে তার গ্রামে আবার ফিরে আসে। ইলা থেকে যায় মানুষের লোক চক্ষুর আড়ালে।


 কিছু দিন পর রাজা দীন নারায়ন পদ্মাবতীকে বিয়ে করে। তাকে রানীর মর্যাদা দিলেও রাজার লাম্পট্য থেমে থাকেনি। এভাবেই কেটে যায় 
পদ্মাবতীর ষোলোটি বছর। এদিকে ইলা পদ্মাবতীর মাসীর ঘরেই বড়ো হতে থাকে। ইতোমধ্যে সেই মাসীর মৃত্যু হয়। পদ্মাবতী ইলার পরিচয় গোপন রেখে রাজাকে বলে ইলাকে রাজ প্রাসাদে নিয়ে আসে।কিন্তু রাজা জানেনা ইলা তারই ঔরসজাত কন্যা।

ইলা অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে ছিলো। রাজকুমারী হয়েও সে রাজকুমারী নয়। প্রাসাদে তার মর্যাদা অনেকটা বাঈজীদের মতো। ইলা সুন্দর গান গাইতে পারতো, সুন্দর নাচতে পারতো। ওর রূপ পদ্মাবতীর রূপকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। রাজা দীন নারায়নের কুনজরে পড়ে ইলা। রানী পদ্মাবতী এ নিয়ে ভিতরে ভিতরে আশংকা বোধ করতে থাকে।


শরতের এক বিকেলে রাজা দীন নারায়ন কালজানি নদীতে অনেকটা জোড় করেই ইলাকে নিয়ে বজরায় নৌ বিহারে যায়।পদ্মাবতী রাজার কুউদ্দেশ্য বুঝতে পারে। বজরাটি অপরূপ সাজে সাজানো হয়েছিলো। গানের বাদ্যয্ন্ত্র ও নাচের নুপুর, ঘুঙ্গুরও নেয়া হয়েছিলো। ইলার পরনে ছিলো মুক্তাখচিত জয়পুরী চোলী। ইলা সেদিনের সেই বিকেলে রাজা দীন নারায়নকে সব দুঃখের গানগুলি শোনায়েছিলো। নেচেছেও রাজার সামনে একাকী। তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বজরার অন্দরমহলে একসময় ইলার সব গান থেমে যায়। নুপুরের শব্দ আর শোনা যায়না। তখন সূর্য অস্তমিত হয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বক আর গাংচিলরা পাখা ঝাপটে দুর অরণ্যের দিকে উড়ে যাচ্ছে। জলের উপরে ছোটো ছোট পাখীদের কিচির মিচির গানগুলো কান্নার শব্দের মতো মনে হচ্ছেছিলো। 
খরস্রোতা কালজানির জল যেনো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।

তারপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে। বজরা এসে ঘাটে ভেড়ে। মাঝি মাল্লারা পাটাতন ফেলে দেয় কূলে। রাজা দীন নারায়ন নেমে আসে। ইচ্ছাকৃতই হবে হয়তো, নামতে যেয়ে ইলা পা ফসকে অন্ধকারে নদীর গভীরে পড়ে যায়। শুধু টুপ করে একটা শব্দই শোনা গেলো। মুহূর্তেই ইলা জলের তলে হারিয়ে গেলো।


পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার নীচ দিয়ে হেটে হেটে রাজা দীন নারায়ন একাকী প্রাসাদে ফিরে আসে। মুখে তার মগ্ন বিষাদ। নিঃশব্দে শোবার ঘরে ঢুকতেই সে দেখতে পায় রানী পদ্মাবতী ফাঁসিতে আত্মহত্যা করেছে।

_____________________________________________________ 


ডিসক্লেমেয়ার:   এই কাহিনীর কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা যাছাই করা হয় নাই। এটি কৃষ্ণ কুমারের বলা একটি কল্প কাহিনীও হতে পারে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন