বুধবার, ৩১ মে, ২০১৭

শুক্লা দ্বাদশীর দিনে

অনেক দিন আগের ফাগুনের এক শুক্লা দ্বাদশী রাতের কথা। তখন আমি পরিকল্পনা কমিশননের একজন তরুণ কর্মকতা। কমিশনের একটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন জনাব এম,এ আজিজ। ওনার বাড়ী ছিলো ময়মনসিংহের গফরগাঁও এর নয়াবাড়ী গ্রামে। ব্যক্তিগত জীবনে উনি ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব গিয়াস উদ্দীন খান পাঠানের জামাতা। ওনার বাড়ীটি ছিলো আধুনিক জমিদার বাড়ীর মতো। অনেক কক্ষ বিশিষ্ট্ বড়ো দোতালা বাড়ী। বাড়ীর সামনে ছিলো শান বাঁধানো পুকুর। পুকুরের পাড় আর বাড়ীর সামনে জুড়ে ছিলো ফুলের বাগান। বিভিন্ন রকমের ফুলের সমারোহে পুরো বাড়ীটাই একটা গার্ডেন বলে মনে হতো। তাছাড়া বাড়ীর চারপাশে ফলের গাছও ছিলো।


জনাব এম,এ আজিজ সাহিত্য অনুরাগী, সাংস্কৃতিকমনা, ক্রীড়া অনুরাগী ও ভীষণ রকম আমুদে মানুষ ছিলেন। উনি ছিলেন  স্নেহ বৎসল একজন পিতার মতো। অনেক বড়ো কর্মকতা হয়েও আমাদের মতো জুনিয়র কর্মকর্তাদের উনি আপন করে নিতেন। অফিসিয়াল প্রটোকল অতো মানতেননা।  প্রতি ফালগুনের শুক্লা দ্বাদশীর দিনে ওনার বিভাগের একদল ছেলে মেয়ে কর্মকর্তাকে দাওয়াত করে বাড়ীতে নিয়ে যেতেন। দিনব্যাপী গান বাজনা ও আনন্দ হতো। পুকুরে মাছ ধরা আর খানাপিনা তো থাকতোই।

এমনি এক ফাল্গনের শুক্লা দ্বাদসীর দিনে আমরা ঢাকা থেকে দশ বারো জন ছেলেমেয়ে গিয়েছিলাম ওনার বাগান বাড়ীতে। আমাদের অফিসে একজন মেয়ে কর্মকর্তা ছিলো,ওর ডাক নাম ছিলো জয়িতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বৎসরের জুনিয়র ছিলো। পড়তো আমাদের ডিপার্টমেন্টেই। মাঝে মাঝেই এই মেয়েটিকে কলাভবনের কোরিডরে কিংবা সেমিনার কক্ষে দেখতাম। কিন্তু কোনো দিন ওর সাথে কথা হয় নাই। অনেক মেয়েদের ভীড়ে এই মেয়েটিকে ভালোই লাগতো। কিন্তু ঐ ভালোলাগা পর্যন্তই। কাকতালীয় ভাবে এই মেয়ে আমার সহকর্মী হয়ে এসেছে।

অফিসে জয়িতার সাথে প্রতিদিনই দেখা হয়। এখানেও জয়িতা আমার জুনিয়র। পূর্বের বিশ্ববি্দ্যালয়ের রেশ ধরে সে আমাকে ভাই ডাকতো। এবং আপনি সম্বোধন করতো। জয়িতাকে আমি অফিসে প্রতিদিন দেখি । দেখি ওর টানা টানা চোখ, বাঁকানো ভ্রু। লম্বা স্ট্রেইট চুল, মাঝখানে সিঁথি করে পিছনে খোপা বাঁধতো। সুন্দর বাচনভঙ্গীতে কথা বলতো। হালকা পাতলা স্লীম বডি। ভালোই লাগতো জয়িতাকে।

বাড়ীতে এসে শুয়ে শুয়ে এমনি আলসে করে ভাবতাম। মনে হতো এই মেয়েটি যদি আমাকে প্রেম নিবেদন করতো ! কিংবা যদি ওকে ডেকে  বলতে পারতাম- 'জয়িতা, তোমাকে আমার ভালো লাগে, তুমি কি আমাকে ভালোবাসবে ?' কিন্তু দ্বিধা করতাম। ভাবতাম যদি জয়িতা প্রত্যাখান করে ? যদি মুখের উপর বলে দেয় - 'না'। তাহলে তো আমাকে লজ্জা পেতে হবে। কিন্তু এইটাই মনে হতো আমার, জয়িতাই একদিন আমাকে বলবে- 'আপনাকে আমার ভালোলাগে, আপনাকে আমি ভালোবাসি।'


আজিজ সাহেবের বাগানবাড়ীতে আজ কেবলই আনন্দ। সবাই যে যার মতো আনন্দস্ফূর্তি করছে। কেনো জানি আমার মনটা অতো ভালো লাগছিলো না। পুকুরপাড়ে শান বাঁধানো ঘাটে খুঁজছিলাম জয়িতাকে। একবার মনে হলো জয়িতা গাঁদা ফুলের ঝাঁরে কেচি দিয়ে মালিনীর মতো পাতাগুলো ড্রেসিং করছে। পিছন থেকে আমি ওর সাথে কথা বলি, ওকে বলি- 'ফুল বাগানে তোমাকে মানিয়েছে ভালো।' আজ জয়িতারও কি মন খারাপ ? আমার  সাথে ঠিকমতো কথা বলছেনা যে।

বিকালে আমরা বাড়ীর বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কাজের মানুষেরা নাস্তা আর চা দিয়ে যাচ্ছিলো। এখানেও দেখি জয়িতা নেই। মনে হলো জয়িতা একাকী মন খারাপ করে শুয়ে আছে। একবার মনে হলো ওর রুমে যেয়ে ওকে ডেকে নিয়ে আসি। কিন্তু সবাই আমাকে কি মনে করবে ? এই ভেবে জয়িতাকে আর ডাকা হলোনা।

সন্ধ্যার পর আমাদের সেই কাঙ্খিত সময়টি এলো। আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ উঠলো। পুকুর পারে শান বাঁধানো ঘাটের কাছে বকুলতলায় বেঁতের চেয়ারে আমরা বসে আছি। বাঁশ ঝাঁরের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলো এসে ঝলমলিয়ে পুকুরের জলে পড়ছে। জোনাকীদের আলো ম্লান লাগলেও ভালো লাগছিলো ঝিঁঝিঁ পোকাদের গান। আমাদের অফিসের শর্মিলী দিদি গান গাইলেন-

'আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে বসন্তের এই মাতাল সমীরণে । 
যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে 
এই নিরালায় রব আপন কোণে। যাব না এই মাতাল সমীরণে।' 

আমাকে সবাই বললো কবিতা আবৃতি করতে। আমি আবৃতি করলাম-

'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে. কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
 আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,. আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,. 
এই সংগীত-মুখরিত গগনে. তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো। 
এই বাহির ভুবনে দিশা হারায়ে. দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।'


গানে আর কবিতায় খুঁজছিলাম জয়িতাকে। আজ এই জ্যোৎস্না রাতে এতো সুর এখানে, এতো গান এখানে। এতো আলো ঝরছে ঐ চাঁদ থেকে। এতো তারা জ্বলছে দূরের ঐ আকাশে। আমার মন আকুল হলো জয়িতার কন্ঠে একটি গান শোনার জন্য। আজ এই রাতে, এই বকুলতলায় জয়িতা কোনো গান গাইলোনা। একাকী এক কোনে কোথায় পড়ে রয়েছ সে।

রাতে খেয়ে আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করি, বারোটার দিকে আমরা শুয়ে পড়ি। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম জয়িতার কথা। চোখে ঘুম আসছিলোনা । বাইরে পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছিলো। ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজও কানে আসছে। রাত ক্রমেই নিরব নিঃশব্দ হয়ে উঠছিলো। রুমের ভিতর দেয়াল ঘড়িতে রাত দুটো বাজার ঘন্টা বেজে ওঠে। তারও কিছুক্ষণ পরে বাইরে কার যেনো পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু দরজায় কোনো কড়া নারার শব্দ হলোনা। আমি ভয় পেলামনা, উঠে দরজা খুলে দেই। দেখি বাইরে বারান্দায় জয়িতা দাড়িয়ে আছে । ওর পরনে সিল্কের সাদা সালোয়ার কামিজ। আমি এগিয়ে যেয়ে বলি- 'এতো রাতে তুমি একা, আমার রুমের সামনে। কেউ দেখলে কি মনে করবে ?'

জয়িতা : দেখলে দেখুক,মনে করলে করুক।
আমি :  তুমি তোমার রুমে যাও। কাল ভোরে না হয় আমরা কথা বলবো।
জয়িতা : না আমি যাবোনা। আমার ঘুম আসছেনা। চলো আমরা ঘাটপাড়ে বকুল গাছের তলায় গিয়ে বসি।
আমি : চলো।

জয়িতা আমার হাত ধরলো। আমরা দু'জন হাতধরেই বকুল তলায় যেয়ে বসি। শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ অনেকটাই পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। গফরগাঁও এর এই নয়াবাড়ী গ্রামের সারা প্রান্তর জুড়ে কেবলই জ্যোৎস্নার রোসনাই। জয়িতা আমার পাশে বসে আছে। চাঁদের আলো এসে পড়েছে ওর চোখে মুখে। ওকে দেখতে কিযে ভালো লাগছিলো। জয়িতা আমার কাধে মাথা রেখে বলছিলো- ' জানো আমি এমনি একটি চাঁদের রাতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এই রকম শুক্লা দ্বাদশী চাঁদের রাতে তোমার বুকে মাথা রেখে বলতে চেয়েছিলাম- ভালোবাসি। ওগো, আজ তোমায় সেই কথাটিই বলছি- 'তোমাকে ভালোবাসি।'


পুকুরপাড়ে গাঁদা ফুলের গন্ধে ভরে উঠেছিলো। রাতের বসন্তের  ঝিরিঝিিরি বাতাস বয়ে চলছে, সাথে হাস্নাহেনার সুবাসে আকুল হয়ে উঠেছে পুকুরপারের বকুলতলা। আমি জয়িতাকে বুকে টেনে বলি- 'আমিও তোমাকে ভালাবাসি।'

ঘাট থেকে ঘরে ফেরার সময় কয়েকটি গাঁদা ফুল ছিঁড়ে তোড়া করে জয়িতা আমাকে দেয়। জয়িতা চলে যায় ওর রুমে। আমি চলে আসি আমার রুমে।

সকালে ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরী হয়ে যায়। ঘুম ভেঙ্গে দেখি বিছানার এক পাশে জয়িতার দেয়া রাতের সেই ফুলের তোড়াটি পড়ে আছে। দেখে মনটা বেশ খুশী হলো। ফুলগুলো হাতে নিয়ে সুবাসও নেই। চিত্তটা আনন্দে ভরে উঠলো।

বিছানা থেকে উঠে বাইরে আসি। মনে মনে খুঁজতে থাকি জয়িতাকে। সবাই ঘুম থেকে উঠেছে। ওঠেনি কেবল জয়িতা। আরো কিছুক্ষণ পরে জয়িতাকে না দেখে শর্মিলী দিদিকে বলি- 'জয়িতা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি ?'
শর্মিলী দিদি বিস্ময়ে বলে- ' তুমি এসব কি বলছো ? জয়িতা তো আমাদের সাথে এখানে আসেই নাই।'






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন