সোমবার, ১৫ মে, ২০১৭

কোন্‌ অচিনপুরে

তিন মাস হাসপাতালে থাকার পর আজই বাসায় ফিরেছে নাজমা। বাসায় এসে দেখে সব এলোমেলো। তার সাজানো সংসার যেভাবে সাজিয়ে রেখে গিয়েছিলো, আজ এসে দেখে তা আগের মতো আর নেই। আলনায়  কোনো কাপড় ভাজ করা নেই। ময়লা করে একটার উপর আরেকটি কাপড় এলোমেলো করে রেখে দিয়েছে । বিছানাটাও পরিপাটি নেই। ঘরের মেঝের কোণে কোণে ময়লা জমে আছে। রান্না ঘরের মেঝেতে মাছি উড়ছে। ময়লার ঝুঁরির ভিতর বাসি খাবার পড়ে আছে। হাঁড়ি পাতিলগুলো ঝকঝকে নেই। এলোমেলো এসব জিনিষ দেখতে দেখতে নাজমা কেমন যেনো হাঁপিয়ে উঠছিলো। শরীরটাতে ক্যামো দেওয়ার কারণে এমনিতেই দূর্বল ছিলো। কোনো কিছুই ভালো লাগছিলোনা। হাত পা কাঁপছিলো। ওর এই অবস্থা দেখে ওর স্বামী ওকে হাত ধরে ভিতরে বিছানায় নিয়ে শোয়ায়ে দেয়।

নাজমা'র চার মাসের বাচ্চাটি পাশের রুমে দোলনায় ঘুমাচ্ছে। নাজমা ওর স্বামীকে বলে- 'মর্জিনাকে বলো, বাবুকে একটু আমার কাছে নিয়ে আসতে।' মর্জিনা যখন বাবুকে নিয়ে আসে তখনো ওর ঘুম ভাঙ্গে নাই। বাবু'র জামাটি ফিডারের দুধে ভিজে আছে। ফিডারের নিপলটা পুরোনো দুধের গন্ধে ভরে গেছে। বাবুর চোখে কোনো কাজল নেই। কপালে কোনো কালো টিপ নেই। নাজমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগুলো দেখছিলো , আর বিষাদে ছলো ছলো হয়ে উঠেছিলো ওর চোখ ।

আজ থেকে দেড় বছর আগে এক বসন্ত দিনে নাজমার বিয়ে হয়। মধুরতম এক ভালোবাসায় সাজিয়ে তোলে নিজের ঘর। আহ্লাদের জীবন ছিলো তার প্রতিদিন। বিয়ের পর প্রিয়তম স্বামীর সাথে কতো জায়গায় সে ঘুরেছে। কতো প্রান্তর ,কতো পথ যে দু'জন হাতে ধরে হেটেছে। কতো বনছায়া তলে তারা একান্তে বসে থেকেছে, কতো নদীর কূলে তারা জলের গান শুনেছে। তারা বেড়িয়েছে পার্বত্য শৈল পাহাডে, আবার গিয়েছে কখনো সাগর বালুকাবেলায়।


তারপর একসময় বাবু পেটে এলো। একদিন সন্ধ্যারাতে সিজারে পেট উন্মোচন করে একটি রাজপুত্র এই পৃথিবীতে নিয়ে আসা হয় । ঠিক তারপরেই জানা গেলো মরণ ব্যাধি ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। তারপরেই তার সাজানো ঘর এলোমেলো হতে থাকে। তিনমাস হাসপাতালে থেকে আজই নাজমা তার ঘরে এলো। এসে দেখতে পাচ্ছে বারান্দায় ঝুল জমে আছে। বাড়ীর উঠোনের ঘাসগুলো বড়ো হয়ে গেছে। ঘরের ভেন্টিলেটরের ফাঁকে চঁড়ুই পাখী এসে বাসা বেঁধেছে।


আসলে ডাক্তার তাকে তিন দিনের জন্য হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়েছে। তিনদিন পর তাকে আবার নিয়মিত ক্যামো দেওয়ার জন্য হাসপাতালে ফিরে যেতে হবে। নাজমা একটা ব্যাপার পুরোপুরি জানেনা, সে বাঁচবে মাত্র আর জোর একমাস। ঠিক তিনদিন পর একদিন বিকালে হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স এসে বাড়ীর গেটে থামে। নাজমাকে যখন এ্যাম্বুলেন্সে উঠানো হয়, তখন বাবু তার কোলেই ছিলো। সে দেখছিলো বাবুর মুখ আর ফিরে ফিরে দেখছিলো স্মৃতি বিজড়িত বাড়ীর আঙ্গিনাটি।

একদিন হাসপাতালের বেডে নাজমা শুয়ে আছে। তার শিয়রে স্বামী দাড়ানো।নাজমার প্রাণ নিঃশেষিত প্রায়। শরীরের সব মাধূর্য শুকায়ে গেছে। স্বামীর দিকে নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে নাজমা বলছিলো- 'ওগো আমি চলে গেলে তোমাকে দেখবে কে ? বাবুকে দেখে রাখবে কে ?' স্বামী ওর কপালে হাত বুলিয়ে বলেছিলো - 'তুমি ভালো হয়ে যাবে, তুমিই দেখবে।'

কিন্তু নাজমা আর ভালো হয় নাই। ঠিক একমাস পর একটি লাশবাহি গাড়ি বাড়ীর গেটে এসে থামে। এবার আর ওকে ঘরের ভিতর নেওয়া হলোনা। ঘরের বাইরে থেকেই ওকে সৎকার করে কবরস্থানে মাটির ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

তারপর অনেক দিন চলে গেছে। নাজমার সাজানো সেই ঘর এখনো এলোমেলোই থাকে। এখনো বারান্দায় জমে থাকে ঝুল । এখনো ঘরের আসবাব পত্রে ধুলোবালি পড়ে আছে। আলনায় কাপড় চোপর থাকে এলোমেলো। ঘরের চারদিকে চঁড়ুই পাখীরা এসে আরো বেশী করে বাসা বেঁধেছে।

নাজমার আদরের  খোকনসোনা প্রায় সময় অনাদরে দোলনায় শুয়ে থাকে। প্রায়ই ও কান্না করে। ওর কান্নাভেজা চোখ মাকে খুঁজে বেড়ায়। গৃহকর্মী মর্জিনার আদর অনেক সময় নিতে চায়না। নাজমার স্বামী প্রায়ই একাকী, কখনো বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বাড়ীর আঙ্গিনায় পায়চারী করে। অনেক অন্ধকার রাতে বাড়ীর বারান্দায় ইজি চেয়ারে একাকী বসে থাাকে।  নিঃসঙ্গ চিত্তে  কোনো দিন চাঁদের রাতে দূরে তারার মাঝে খুঁজে বেড়ায় তার প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখখানি। অ্ন্তরের মাঝে তখন বিষাদের সুর বেজে ওঠে । কোথা থেকে এই গানটি যেনো ভেসে আসে -

দূরে কোথায় দূরে দূরে. আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে।
যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে। 
যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে. 
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্‌ অচিনপুরে।


















কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন