মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

মনের মতো বউ

জীবনে কতো সাধ আহলাদ আর স্বপ্ন ছিলো শহরের মেয়েকে বিবাহ করবো। মেয়ে ফ্যাসান করে চলবে। মাধুরী কাট চুল থাকবে। ডায়নার মতো ভ্রু স্টাইল হবে। পোষাক পড়বে 'ববি' ছবির নায়িকা ডিম্পলের মতো। কথা বলবে ইংরেজী বাংলা মিক্স করে।  কিন্তু তা আর কপালে জুটলো না। মা আমাকে বিবাহ করালেন তারই পছন্দ মতো এক মেয়েকে। তার সখ ছিলো ছেলেকে পাল্কি চড়িয়ে বিয়ে করাবে।আমি তাই করলাম। এক হেমন্তের সন্ধ্যায় বাড়ী থেকে তিন মাইল দূরের এক গ্রাম থেকে অচেনা এক মেয়েকে বিবাহ করে পালকিতে চড়িয়ে বাড়ীতে বউ করে নিয়ে আসলাম।

মা তার রূপবান সুন্দরী পুত্রবধুকে লাল শাড়ী পড়ায়ে রাখলেন। গ্রামের বালক বালিকা, বৌঝিরা সব দল বেঁধে দেখতে আসতে লাগলো। বাড়ী ভর্তি আত্মীয় স্বজন। সবাই উৎসব আর আনন্দ করছে। এরই ফাঁকে বিয়ের তিন চলে গেছে। মাকে বললাম- আমার ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছে। ঢাকা যেতে হবে।' মা বললেন- নতুন বৌমাকে রাখিয়া তুমি এতো তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইবে ? তাহা কি করিয়া হয় ? তুমি আর কয়েকটা দিন থাকিয়া যাও ''। আমি বললাম- ''তোমরা আমাকে হঠাৎ করে ধরে এনে বিবাহ করিয়েছো। আমি অফিস থেকে ছুটি আনি নাই। আমাকে চলে যেতে হবে।' মা তখন বললেন,- 'তাহলে বৌমাকেও সাথে করে  তুমি ঢাকা নিয়ে যাও।'  যাহোক, বউকে একদিনের জন্য বাপের বাড়ী ঘুরিয়ে এনে পরের দিনই তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি।

ভালোই লাগছে হঠাৎ শুরু হওয়া সংসার জীবন। ভালোই লাগছে নতুন এই জীবনের শুরু। হঠাৎ করেই যেন জীবনের অনেক বড়ো পাওয়া পেলাম। হঠাৎ করেই জীবনের সব নিয়ম কানুন বদলে গেলো। একজনের জীবন থেকে হঠাৎ করেই দু'জনের জীবনের রুপান্তর হলো। রাতে দু'জন একসাথে ঘুমিয়ে থাকি পাশাপাশি। জীবনের স্বপ্নগুলোও দেখি একসাথে। জীবন হঠাৎ করেই সাজানো গোছানো হয়ে উঠলো। এখন আর আধাঁরে একাকী বসে থাকতে হয়না।  এখন ঠিক সময়েই ঘরে সন্ধ্যা বাতি জ্বলে ওঠে।

চারদিক থেকে সকল আলোর বিচ্ছুরণ যেনো ঘরে এসে পড়ছে
ঘরহীন কোনো শুন্যতা কোথাও নেই
জীবনের সকল সুখ ভরে উঠতে থাকে সকল পূর্ণতা দিয়ে
আমি বিস্ময়ে চেয়ে থাকি এই মেয়ের দিকে
সকল ঐশ্বর্য সকল ভালোবাসা নিয়ে তার এই কাছে আসা
এক জীবনেই যে এতো প্রেম কেউ দিতে পারে- জানি নাই।

আমার এই বউয়ের নাম আনারকলি। আমি তাকে 'কলি' বলে ডাকি, আবার কখনো আনারকলিও বলি। মোঘল হেরেমের আনারকলি সে নয়। সে নেহাত একটি সহজ সরল গ্রামের মেয়ে। আজ অফিস থেকে এসে শুনি- পাশের বাসার এক ভাবীর সাথে রাস্তায় বেড়াতে বের হয়েছিলো সে। ভাবী  বেশ সাজগোজ করে বের হয়েছিলো। পাড়ার ছেলেরা নাকি ভাবীর দিকেই তাকিয়ে থেকেছে। তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় নাই। এজন্য তার মন খারাপ। আমার কাছে আবদার করেছে- মেকআপের সামগ্রী কিনে এনে দিতে । পরের দিন আনারকলিকে ফাউন্ডেশন,কনসিলার, ব্লাসন, আই ভ্রু পেন্সিল, আইল্যাস, কাজল,নেইলপালিশ, লিপস্টিক, ফেসপাউডার,আইস্যাডো,ব্রাশ,প্যানকেক, টিপ, চূড়ি এইসব কিনে এনে দেই। পরের দিন অফিস থেকে এসে দেখি- আনারকলি সুন্দর হয়ে সেজে বসে আছে। বললাম বেড়াতে যাওনি ? কলি তখন বলে- তোমার জন্য সেজে বসে আছি।'

আরেকদিন আনারকলিকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাই। আনন্দ সিনেমা হলে তখন চলছে- 'চাঁপাডাঙ্গার বউ'। চাঁপাডাঙ্গা বউয়ের দুঃখ দুর্দশা দেখে- আনারকলি কাঁদছে। আমি বললাম, 'তুমি কাঁদছো কেনো ? আমার কথা শুনে সে আরো জোড়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।পাশের মানুষরা উৎসুক হয়ে কলির কান্ড দেখতে থাকে। আমি সিনেমার বাকী অংশ আর না দেখে কলিকে নিয়ে সোজা বাসায় ফিরে আসি।

আরেকদিন নতুন বউকে নিয়ে চায়নিজ খাবার খেতে যাই উত্তরার একটি রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের ভিতরে আলো আঁধার তার পছন্দ হয়না। সে বলছিলো- তার নাকি দম বন্ধ হয়ে আসে। এক চামচ স্যুপও সে খেলোনা। ভেজিটেবলও মুখে নেয় নাই। ওর জন্য আলাদা করে বীফ নেই। তাই দিয়ে একটু রাইছ খেয়ে নেয়।  আমি আমার নতুন বউকে চায়নিজ খাওয়ায়ে সেবার খুশী করাতে পারি নাই।

আনারকলিকে নিয়ে কেটে যায় প্রতিদিন ভালোলাগার দিন
ভালোলাগে  সারল্য ভরা খুনসুটি, ভালোলাগে যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি
আমি চেয়ে দেখি ওর মায়াময় চোখ, দেখি ওর হেটে চলা মেঝেতে
ভালো লাগে ভেজা চুলে যখন সিঁথি করে আয়নার সামনে দাড়িয়ে
আমি দেখি কেমন করে সাজাচ্ছে ঘর আলনায় সাজাচ্ছে কাপড়
আর ফুলদানীতে সাজাচ্ছে ফুল
দেখতে দেখতে কখন হয়ে উঠলো সে ঘরের লক্ষ্মী
আমি বিস্ময়ে দেখি তার এই ঘরণী হয়ে ওঠা-
আমার প্রতিটি কর্মে সে হয়ে ওঠে প্রেরণাময়ী ,
সে যেনো আমারই- মনের মতো বউ।


এতো প্রেম আর এতো ভালোবাসার জীবন থেকে কলিকে দূরে রাখতে মন চায় না। তাইতো নতুন বউ আনার পর থেকে ওকে আর বাড়ী পাঠানো হয়নাই। আমার এই ভালোলাগা জীবনের সাথে সে রয়ে গেছে। একদিন সন্ধ্যায় বাসায় এসে দেখি কলি শুয়ে আছে। আমি ওকে বলি- এই অসময়ে কেনো শুয়ে আছো ?
কলি বলে- 'মাথা ঘুরছে। বমি করেছি।'  আমি বুঝতে পারলাম- হয়তো এ কোনো নতুন অতিথীর আগমনী বার্তা হবে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তারের রিপোর্টও- পজেটিভ, আমাদের ঘরে একজন নতুন অতিথী আসছে।


কলির কথামতো  সুন্দর একটি বাচ্চার পোস্টার কিনে এনে ঘরে লাগিয়ে দেই। প্রায়ই এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে ও স্বপ্ন দেখে। কল্পনার জাল বুনে, তারও এই রকম একটি ছেলে সন্তান হবে ।সে আদর করবে। বুকের দুধ খাওয়াবে। একদিন বিকেলবেলা খুব মন খারাপ করে কলি বলছিলো- 'আমার যদি মেয়ে হয়, তুমি রাগ করবেনা তো ?' আমি বলেছিলাম - 'না।'

আস্তে আস্তে আনারকলির ডেলিভারীর ডেট চলে আসে। দেশের বাড়ী থেকে শ্বাশুরী মাকে চাকায় আনা হয়। আনারকলি প্রায়ই মন খারাপ করে থাকে। তখন শ্রাবন মাস ।  সেদিন ছিলো আমার ছুটির দিন। সকাল থেকেই আকাশে কালো মেঘ হয়ে আছে, একটু পর মুশুলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। আনারকলি বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়। আমিও যেয়ে ওর পাশে গিয়ে দাড়াই। বৃষ্টি দেখছিলাম দু'জনই। আনারকলি বলছিলো- শরীরটা ভালো লাগছেনা।
আমি :  বেশী খারাপ লাগছে ?
কলি :   অতো বেশী না।
আমি:   বিছানায় শুয়ে পড়বে।
কলি :  ওগো আমার খুব ভয় হয় !
আমি :  চলো তোমাকে বিছানায় শোয়ায়ে দেই।

আমি আনারকলিকে অনেকটা পাশ জড়িয়ে করে বিছানায় এনে শোয়ায়ে দেই। ভাবছিলাম আর হয়তো দেরী করা ঠিক হবেনা। শ্বাশুরী মার সাথে আলাপ করে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যেই একটি ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসি। ওদিকে ঢাকায় আমার বড়ো বোন ও দুলাভাইকে খবর দেওয়া হয়। তারাও চলে আসে। মুশুলধারে বৃষ্টির মধ্যই আমাদের ট্যাক্সিা হলি ফ্যামেলী হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে গিয়ে পৌঁছে।

অপারেশন রুমের সামনে অপেক্ষা করছিলাম সুসংবাদের জন্য । একটু পর যে সংবাদ আসে- 'অধীক রক্তক্ষরণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে। নবজাতক ছেলে শিশুটিও বেঁচে নেই।' আকাশ তখনও মেঘে ঢাকা ছিলো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো কর্কশ শব্দ করে। বাইরে বৃষ্টি ঝরছিলো অনবরত। জীবনের সব আশা আর স্বপ্নগুলোকে পিছনে ফেলে তখন রাস্তায় নেমে আসি।

তারপর শুধু অসীম শূন্যতার কথা। ঘর আর ভালো লাগে নাই কখনো। ঘর ছেড়ে বেশীর ভাগ সময় মাজার, মসজিদ, পথে, ঘাটে,পার্কে শ্টেশনে পড়ে থাকি। মন চাইলে ঘরে ফিরে যাই। না চাইলে পথে পথেই ঘুরে বেড়াই।

একি শূন্যতা তুমি দিয়ে গেলে আমায়, একি দীর্ঘশ্বাস-
জীবন আর ভরাতে পারিনা কোনো আনন্দে
জীবন আর এগুতে পারেনা সামনে চলতে,
দিনগুলি আর চায়না যে ফুড়োতে...।













কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন