রবিবার, ১৪ মে, ২০১৭

শোনাও প্রাণে প্রাণে

সেদিন ছিলো শ্রাবন মাসের এক সকাল। হঠাৎ শোনা গেলো ডিস্ট্র্রিক বোর্ডের রাস্তার পাশে আমাদের বাজারে পাকসেনারা এসে জড়ো হয়েছে। খবর শুনে বেশীর ভাগ তরুণ,তরুণী,যুবক,যুবতী,মধ্যবয়সী মানুষ ও বৌঝিরা নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়। পাকসেনাদের মুল টার্গেট ছিলো হিন্দু পাড়া এবং বেছে বেছে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ী। পাকসেনারা পুরো হিন্দু পাড়া জ্বালিয়ে দেয়। আওয়ামী লীগ সমর্থক ছিলেন আমার এক চাচাতো ভাই, তার বাড়ীটিও জ্বালিয়ে দেয় পাকসেনারা ।

তান্ডব শেষে পাকসেনারা একসময় ফিরে চলে যায়। আস্তে আস্তে ফিরে আসতে থাকে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়া গ্রামের মানুষগুলো। তারা দেখতে পায় অনেক বাড়ীঘর তখনো ধাউ ধাউ করে জ্বলছে। যে যেভাবে পারে আগুন নেভাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু ততোক্ষণে জ্বলে পুড়ে সব ছারখার হয়ে গেছে। পুড়ে ভস্মিভূত হয়ে গেছে ঘরের টিন,কাঠ,আসবাবপত্র ও পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে গোলাঘরে রাখা ধান, চাল অন্যান্য ফসল। বাতাসে তখন পোড়া ধান চাউলের গন্ধে ভাসছে। পোড়া বাড়ীর মানুষদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ওরা যাবার সময় হত্যা করে ফেলে রেখে যায় ময়নাল হক ও  জেলে পাড়ার সন্তোষ মাঝিকেও।

এখন যে ঘটনাটি বলবো সে ঘটনাটি অনেকেই জানেনা। দু'একজন জানলেও মানবিক কারণে তা এখনো গোপন করে রেখেছে। আমার চাচাতো ভাই ছিলেন একজন এলএমএফ ডাক্তার। তার বাড়ীটিও পাকসেনারা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আমার তখন কৈশর বয়স। ঘটনাটি সেদিন জানি নাই। পরে শুনেছি। আসুন,ঘটনাটি না হয় ডাক্তার সাহেবের মুখ থেকেই শোনা যাক-:

''বাইরের একটি অতিথী ঘর পাকসেনারা অক্ষত রেখেছিলো। রাতে সেই ঘরেই আমি শুয়ে আছি। চারদিকে পোড়া সব জিনিষের গন্ধ। চোখে ঘুম আসছিলোনা। রাত তখন এগারোটা হবে। দরজায় আস্তে করে কড়া নারার শব্দ শুনতে পাই। আমি উঠে দরজা খুলে দেই। দেখি দড়জার সামনে আমারই গাঁয়ের এক লোক দাড়িয়ে আছে। তার মুখ অত্যন্ত বিমর্ষ। সে বলে- 'আমার মেয়েটার অবস্থা খুব সংকটাপূর্ণ। তোমাকে একটু যেতে হবে।' আমি আমার ডাক্তারী ব্যাগটা হাতে নিয়ে তার বাড়ীতে চলে যাই। দেখি মেয়েটি অর্ধচৈতন্য অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে। কাঁথা রক্তে ভিজে গেছে। আমি বললাম- কখন থেকে এ অবস্থা ? লোকটি বললো- দুপুর থেকেই। পাকসেনারা চলে যাবার পর থেকেই। প্রথমে রক্ত কম ঝরছিলো, ক্রমেই রক্তপাত বাড়ছে। ভেবেছিলাম, ভালো হয়ে যাবে কিন্তু হয়নাই। লজ্জায় এতো সময় তোমাকে ডাকিনি।'

মেয়েটির বয়স কতোই হবে, তেরো চৌদ্দ বছর। আমি ঐ লোকের স্ত্রীকে বললাম- ' লন্ঠনের আলোটি একটু তুলে ধরো।' ওর কাপড়টি সরাতে হবে। আমার কথা শুনে অর্ধচেতন মেয়েটা নিজেই পায়জামার ফিতা খুলে দেয়। মেয়েটি অনেকটা অবচেতন হয়েই আমাকে ওর ক্ষত জায়গাগুলো দেখাতে থাকে। মেয়েটি এতো বেশী ধর্ষিত হয়েছে যে, আমি দেখে নিজেই শিউরে উঠি। আমি সারারাত জেগে থেকে আমার সকল প্রচেষ্টা দিয়ে ওকে অনেকটা ভালো করে তুলি। সকালবেলায় ঘরের জানালাটা খুলে দিতে বলি। সূর্যের আলো মেয়েটির গায়ে এসে লাগে। ততোক্ষণে ওর রক্তক্ষরণও বন্ধ হয়ে গেছে।''


সবার মনটা কেমন যেনো ভারী করে দিলাম মনে হয়। আসুন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা' র কন্ঠে একটি মঙ্গলের গান শুনি-

'সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, 
শোনো শোনো পিতা
কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে 
মঙ্গলবারতা
ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, 
সদাই ভাবনা
যা-কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা
সুখ-আশে দিশে দিশে বেড়ায় কাতরে–
মরীচিকা ধরিতে চায় এ মরুপ্রান্তরে ।'


_______________________________________________________________________

ডিসক্লেইমার :   অনুগ্রহপূর্বক, কেউ ধর্ষিত সেই মেয়েটির নাম,ধাম,পরিচয় আমার কাছ থেকে জানতে চাইবেন না। এমনকি তার বর্তমানে অবস্থানও। ধন্যবাদ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন