শনিবার, ২০ মে, ২০১৭

সান্তা মনিকা'র তীরে

মেয়েটির নাম কোভা ভেলহস্ট্রম। মা একজন তাইওয়ানিজ, বাবা সুইডিস। ছেলেবেলা কাটিয়েছে সুইডেনের স্টকহোম শহরে। বাবা স্ক্যান্ডিনেভীয় হওয়াতে ওর চোখ ছিলো নীল রংএর আর চুল ছিলো সম্পূর্ণ সফেদ সোনালী। আর মা তাইওয়ানিজ হওয়াতে ওর চেহারা দেখতে লাগতো মঙ্গোলীয় এশিয়ান। দ্বৈত জাতিসত্তার মিশ্রণ হওয়াতে কোভা একধরণের লাবন্যময়ী মেয়ে হয়ে উঠেছিলো।

হাই স্কুলের পড়া শেষ করে কোভা আমেরিকায় পারি জমায়। ওখানে নভোদা'র লাসভেগাস শহরে সে থাকতো। কোভা তখনো বিয়ে করেনি। তবে ওর একজন মেক্সিক্যান বয় ফ্রেন্ড ছিলো। কোভাও এসেছিলো লস এ্যাঞ্জেলসে হলিউড সিনেমা সিটিতে। ওখানে একটি 'হলিউড সিনে মেকআপ আর্টিস্ট্রী'র উপর এক মাসব্যাপি  প্রশিক্ষণ কর্মশালায় যোগ দিতে। আমিও যোগ দিয়েছিলাম সেই প্রশিক্ষণ কর্মশালায়। আর কোভার সাথে আমার পরিচয় সেখানেই।

ওয়ার্কশপে আমার পাশের আসনটি কোভার। প্রথম কথা বলাও সেখানে কোভার সাথে। ইনাস্ট্রাক্টর ছিলো হলিউডের বিখ্যাত মেকআপ আর্টিস্ট নেলী রেচিয়া। হয়তো সৌভাগ্যই বলতে হবে, ভারতীয় উপমহাদেশের বাদামি রঙ্গের কোনো একটি মুখকে খুঁজছিলো নেলীর চোখ।  ডেকে নেয় আমাকে। ত্রিশ মিনিটের একটি ওরিয়েন্টেশন মডেল হতে হলো আমাকে। চারদিকে অনেক স্লাইড স্ক্রীনে আমার মুখ রঙ্গিন আলোতে ঝলমল করছে। নেলীর অনুপম হাতের তুলি আর ব্রাশের ছোঁয়া তখন আমার চোখে মুখে। প্রথমদিনই এই রকম একটি বর্নীল অভিজ্ঞতা আমাকে ভীষনভাবে আপ্লুত করে।

কফি ব্রেকেও আমি আর কোভা পাশাপাশি থাকি। যদিও আমাদের পাশে দাড়িয়েছিলো কোরিয়ার সিউল থেকে আসা ইয়াংজু কিম আর ওয়াসিংটন ডিসি থেকে আসা মিলিশা উইনটার। সিগারেটের ওফারটা করে কোভাই প্রথম। প্রিয় ব্রান্ড মার্লবোরো লাইট। যদিও আমি খেতাম মার্লবোরো হার্ড। শুধু কোভার কারণে আমি পরে মার্লবোরো লাইট কেনা শুরু করি। বিকালে ওয়ার্কশপ শেষে আমরা দুজন এক সাথে উইলটার্ণ থিয়েটার বিল্ডিং-এর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসি। উইলশেয়ার বেল্যুভার্ডের ওয়াকওয়ে ধরে হাটতে হাটতে দু'জন মেট্রো স্টেশনের দিকে চলে যাই। রিফ্রেশ কর্ণারে দাড়িয়ে দুজন আবার সিগারেট খাই। এবার আমি ওকে সিগারেট ওফার করি। সিগারেট টানতে টানতে বলছিলাম- 'তুমি এখন কোন এরিয়ায় যাবে ?

কোভা :  কালভার্ট সিটি , সান্তা মনিকা।
আমি :  ওখানে কার কাছে থাকো ?
কোভা :  একটি ডরমেটরীতে, জাস্ট লাইক এ্য হোস্টল ।
আমি:   ওহ,তাই।
কোভা : তুমি কোথায় উঠেছো ?
আমি :  গ্রামের্সী প্লেস, ওটাও একটি হোস্টেল।
কোভা : খুব সুন্দর, কাল তোমার সাথে আবার দেখা হবে।
আমি :   ইয়েস,গুড ইভেনিং, বাই।
কোভা চলে যায় কালভার্ট সিটি,সান্তা মনিকার দিকে। আমি চলে আসি গ্রামের্সী প্লেসে।

সন্ধ্যায় গ্রামের্সীর খোলা গার্ডেনে রাখা একটি চেয়ারে বসে আছি। ভাবছিলাম আজকের প্রথম ব্যস্ত দিনটির কথা। ভাবছিলাম কোভার কথাও। কতো বন্ধুবৎসল মেয়েটা। কতো ভদ্র এবং বিনয়ী। এতো সুন্দর মেয়ে হয় ! ভাবছিলাম- আমার যদি সেই প্রথম যৌবনের দিনগুলি থাকতো, যদি আামার থাকতো সেই কুমারত্বের তারুণ্যের সময়, তবে সত্যিই এই মেয়ের প্রেমে পড়তাম। কিন্তু তা আর হলোনা, আমার ঘরে যে একজন মায়াবতী স্ত্রী আছে। যদি এই মায়াবতী না থাকতো তাহলে এই মেয়েকে নিয়ে লেখা যেতো এমনই একটি কবিতা-

তোমার ঐ নীলাভ চোখ ডুবে থাকে স্টকহোমের মায়াবী
সান্ডোম হৃদের নীল জলে
মেলোর্নের ঝিরঝির বাতাসে উড়ে তোমার সোনালী চুল
দেখতে তুমিও যদি তিব্বতী,
তোমার নাক আমাদেরই কূষ্ণের বাঁশির মতো
তুমি কথা বলো ভ্রু তুলে শুভ্র মেঘের মতো বাঁকা ঠোঁটে
ছোটো ছোটো হাসি ঝরে পড়ে মুক্তার ন্যায়
হঠাৎই মনে হয় তুমি আমাদেরই যমুনাপারের মেয়ে একজন,
যাকে আজ দেখে এলাম উইলটার্ন থিয়েটারের
আলো ঝলমল হল রুমে।

আমার সাথে কোভার কথা হয় প্রতিদিনই। প্রতিদিনই আমাদের আসন থাকে পাশাপাশি। আলোচনা,ওরিয়েন্টেশন, প্রজেক্টরে হলিউডের বিখ্যাত ছবিগুলোর বিশেষ অংশগুলো দেখা, বিখ্যাত ফ্যাশান ফটোগ্রাফারদের কাজের অভিজ্ঞতার কথা, মডেলস রাম্প মডেলস,আপকামিং মডেলদের ক্যাটওয়াক প্রদর্শনী দেখার ফাঁকে ফাঁকে আমি আর কোভা ছোটো ছোটো করে অনেক কথাই বলতে থাকি। বলি আমাদের এক অপরের অনেক ব্যক্তিগত কথাও।

একদিন  দুপুরে ম্যাকডোনাল্ডে বসে লাঞ্চ করছিলাম। আগেই শর্ত দিয়ে রেখেছিলো কোভা, পেমেন্ট সে করবে। আমরা বসেছিলাম স্বচ্ছ কাঁচের জানালার পাশে। মুখোমুখি নয় পাশাপাশি দুজন বসে আছি। সুপরিসর রাস্তার পাশে দেখছিলাম রোদ্রকরোজ্জ্বল বাইরের আকাশ। অনেক গাড়ী ছুটে চলছে, কোনো হর্ণ বাজছেনা, সব গাড়ী চলছে নৈঃশব্দে। কোভা বলছিলো- 'তোমার বউয়ের ছবি থাকলে আমাকে একটু দেখাও না ?' আমি আমার স্মার্ট ফোন থেকে আমার স্ত্রীর কয়েকটি ছবি বের করে দেখাই। ও খুব বিস্ময় চোখে দেখছিলো ছবিগুলি-
কোভা :  তোমার বউ তো বেশ সুন্দরী।
আমি :  হু
কোভা :  তোমার বউ কি করে ?
আমি :  সেও একজন বিউটি এক্সপার্ট। শি হ্যাজ বীন রানিং এ বিউটি সেলুন।
কোভা : তোমার দেশে আমাকে নিয়ে যাবে ?
আমি : যাবে তুমি ? তুমি যাবে, আর তোমাকে আমি নিবো না ?
কোভা :  তোমার বউকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
আমি : তোমার বয়ফ্রেন্ডকে দেখাও।
কোভা : দেখবে এই মেক্সিক্যান কাউবয়কে ?
আমি :  দেখাও।

কোভা ওর ফোন মিমোরী থেকে ওর ফ্রেন্ডের কয়েকটি ছবি বের করে দেখায় আমাকে । আমি ওকে বললাম- 'তুমি কি তোমার এই বন্ধুটিকে নিয়ে সুখী ? ' কোভা বিষন্ন মুখোয়বে বলেছিলো- 'না'।

রাতে হোস্টেলের বিছানায় শুয়েছিলাম। ঘুম আসছিলোনা চোখে। এর আগে ঢাকায় কথা বলেছিলাম প্রিয়তমা স্ত্রীর
সাথে। ওর সাথে কথা বললে পরের সময়গুলো ভালোলাগার চেয়ে খারাপই বেশী লাগে। পরের সময়গুলো দারুণভাবে ওকে মিস করতে থাকি। হোস্টেলের পিছনে রিক্রিয়েশন এরিয়াতে যেয়ে সিগারেট খাই। পরপর তিনচারটা স্টীক খেয়ে ফেলি। কোভার জন্য কেন জানি একটু মায়া হচ্ছিলো। মনে পড়ছিলো আজকের পড়ন্ত দুপুরে সেই বিষন্ন মুখখানির কথা-

এতো সুন্দর লাবন্যময় মুখে কোনো বিষন্নতা কি মানায় ?
জীবনতো পলে পলে উপভোগ করার কথা-
সব স্বপ্নের পাখীরা ডানা মেলে তোমার ভূবনে আসবে এইটাই সত্য,
কে সেই কাওবয় ? চিনতে পারেনি এই সারল্যে ঢাকা লাস্যময়ীকে-
লাসভেগাসের রাতের পথে পথে জ্বলে ওঠে নীল নীল আলো
তুমিওতো সে আলোয় নীল হয়ে যেতে পারো নিমিষেই
দুঃখও ভুলে থাকতে পারো সেখানে।


সেদিন ছিলো আমাদের হোস্টেলের থ্যাংস্ গিভিং ডে ডিনারপার্টি। হোস্টেলের মালিকান মিসেস সেলিয়া এই ডিনারপার্টির আয়োজন করেছিলো। কোভাও এসেছিলো সেদিন। ডিনারের মেনু ছিলো, Staffed Turkey, Gravy, Mashed Potatoes Cranberry Sauce, Mince Meat Pie, Soft and Hard drinks. আর ছিলো মিউজিকের সুরের মূর্ছনা। অনেক রাত পর্যন্ত কোভা সেখানে ড্যান্স করেছিলো, ঘুমিয়ে পড়েছিলো গ্রামের্সী হোস্টেলেই। হতাশার ছায়ার নীচে কোভার যে কোনো সুখ নেই, তা বুঝতে পেরেছিলাম আমি সেই রাতে।


একসময় আমাদের ট্রেনিং ওয়ার্কশপ প্রোগ্রাম শেষ হয়ে যায়। দেশে ফিরবার দিনও কাছে চলে আসে। যেদিন ঢাকায় ফিরবো, তার আগের দিন বিকেল বেলা আমি আর কোভা সান্তা মনিকা বিচে চলে যাই। বিচ টার্মিনালের দোতালায় একটি মেক্সিক্যান রেস্টুরেন্টে বসে কিছু খেয়ে নেই। তারপর দু'জন সিগারেট ধরাই। পেমেন্ট আমিই করি। এরপর আমরা বালুকাবেলায় হাটতে থাকি। কখন কোভা আমার হাত জড়িয়ে হাটছিলো জানি নাই। তখন সুর্যাস্তের সময়। আমরা দাড়িয়ে আছি প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলের পাশে। সূর্য তখন ডুবে যাচ্ছিলো অসীম জলধি তলে।

আমি কোভাকে বলছিলাম- ' তুমি কি আমাকে ভুলে যাবে ?' কোভা আনত মুখ তুলে বললো- না, চির জনম ধরে 'না'। আমি দেখছিলাম ওর স্ক্যান্ডিনেভীয়ান নীল চোখে প্যাসিফিকের লোনা জল। কোভা আমাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।

Standing here, Starring at the blue.
Thought and memories surfing one after one like waves,
Deeper than the deepest Pacific Ocean, at Santa Monica
In the calm presence of waves around me,
Finally, my heart is at peace.




                                                                                              

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন