শনিবার, ৬ মে, ২০১৭

একজন হেমা মালিনী

হঠাৎ করেই তার প্রেমে পড়ে যাই। হঠাৎ করেই আমার জীবনের রোজকার রোজনামচা পরিবর্তন হয়ে গেলো। এক বিকেলে একে অপরে দেখা না হলে সে বিকেল হয়ে যায় মৌনতার সঙ্গীত। যেনো দুঁহু করে দুঁহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।'

মেয়েটির নাম- হোমায়রা আকতার। পাবলিক লাইব্রেরীতে ওর সাথে আমার পরিচয় । মাঝে মাঝে নোট করতে আসতো এখানে। পড়তো বদরুন্নেসায়। ও পড়তো ওখানে বাংলায়। আমি পড়তাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায়। তাই মনে হয় একে অপরে স্টাডি সহায়কের কারণে সহজেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পাবলিক লাইব্রেরী চত্বরটা আমাদের যেনো প্রেমের বৃন্দাবন হয়ে উঠলো।

এক ফাল্গুনের উদাস দুপুরে লাইব্রেরীর সিঁড়ি সোপানে বসে আছি। এবং ওকে ডাকি :  হোমায়রা ?
হোমায়রা : জ্বী।
আমি :  ভালো লাগেনা।
হোমায়রা:  কি ভালো লাগেনা ?
আমি : তোমার এই নাম !
হোমায়রা: হুম।
আমি : তোমাকে হেমা নামে ডাকবো।
হোমায়রা:   ডাকো ।
আমি : হেমা ?
হেমা :  জ্ব্বী।
আমি:  না এ নামেও ডাকবো না।
হেমা:  পাগল তুমি ! কি নামে ডাকবে ?
আমি:  মালিনী।

আমি মালিনীর কানের কাছে যেয়ে আস্তে আস্তে এই কবিতাটি আবৃতি করতে থাকি-

দেখো তুমি চেয়ে কড়ই গাছের ছায়ায় রোদ্র থেমে গেছে
ঝরা পাতার শব্দে তোমার আগমনের গান শুনি
বেনী খোপায় পড়ো তুমি সাদা সন্ধ্যা মালতী
তোমার বাগানের তুমি যেনো মালিনী একজন
প্রতিদিন জল ঢালো সেখানে, তুমি নিজেই হয়ে যাও সন্ধ্যা মালতী
আজ শাহবাগের মোরে কোনা ফুল নেই, সব ফুল আজ তোমার বাগানে।


একদিন লাইব্রেরীর ভিতরে বসে দু'জন নোট করছিলাম। আমি করছিলাম বৈষ্ণব পদাবলীর জীবাত্মা আর পরমাত্মার প্রেমের উপরে। মালিনী করছিলো রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের প্রকৃতির ভূমিকা। বাইরে তখন মুশুলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো।মালিনী বলে- 'ভালো লাগছেনা'। আমি বলি- 'কেনো ?' মালিনী বলে - চলো বৃষ্টি দেখি।'

বাইরে এসে দু'জনেই দেখছিলাম বৃষ্টি। আমগাছের ডালে জুবুথুবু হয়ে দুইটি কাক ভিজছে। আমি মালিনীকে বলি- চলো কাকের মতো করে অমন করে দু'জনে জলে ভিজি। মালিনী বলে- 'চলো, ভিজতে ভিজতে আমরা রিক্সায় গিয়ে উঠি। তুমি নীল ক্ষেতের মোরে নেমে যাবে, আমি একাকী ওখান থেকে হোস্টেলে চলে যাবো।' রিক্সা চলছে আজিমপুরের দিকে, হুট উঠানো নেই। কাকের মতোই ভিজে দু'জন জুবুথুবু হচ্ছি। আমি মালিনীর কানে কানে বলি- 'তোমাকে রাধিকার মতো লাগছে। শুধু যমুনার তীর এখানে নেই। নেই এখানে সেই  শ্রাবন দুপুর।' মনে মনে ভাবি, আজ এই বাদলমূখর দিনে মালিনী আমারই পাশে। ভিসির বাড়ীর সামনে বড়ো বড়ো কড়ই গাছের ছায়াতল দিয়ে রিক্সা চলছে। পাতা ছুঁয়ে বৃষ্টির জল এসে পড়ছিলো আমাদের গায়ে।


আরেকদিন দু'জনের মন উড়ু উড়ু। লাইব্রেরীর টেবিলে মন বসছেনা। পেটে দুপুরবেলার খিদা। মালিনী বলছে খিদে লেগেছে। লাইব্রেরীর ক্যান্টিনে যেয়ে দু'জন খেয়ে নেই। আমি মালিনীকে বলি- সিনেমা দেখবে ? বলাকায় 'দেবদাস '।মালিনী বলে- 'চলো'। হলের রুম অন্ধকার হলো। সামনের কালো পর্দা সরে গেলো। আমার ডান হাত মালিনীর বাম হাত ছুঁয়ে আছে। পারু দেবদাসের কৈশর প্রেম তখন চলছে। আমি মালিনীকে বললাম- একটু ডার্ক ড্রামা করবো ?' মালিনী আস্তে করে বলে- 'মাইর চিনো, মাইর'?। সিনেমার শেষ দৃশ্যে পারু আর্ত চিৎকার করে যখন বাড়ীর বাইরে আসতে চায়,ততোক্ষণে লোহার সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।'  প্রেক্ষাগৃহের বাতিগুলো তখন জ্বলে উঠেছে। দেখলাম আমার মালিনীর মন খারাপ। ডার্ক ড্রামা আর হলোনা।


আমাদের ভালোবাসা চলছে, ভানু চক্রবর্তীর এই কবিতার মতো- ''পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,. আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী। রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল. পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,. ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে. দিগঙ্গনার নৃত্য,. হঠাৎ-আলোর ঝল্‌কানি লেগে. ঝলমল করে চিত্ত।'' একদিন ঘরে বসে আছি। মনে হলো পূর্বের জানালাটা খুলে বাইরের আকাশটা দেখি। জানালা খুলতেই এক ঝলক পূর্ণিমার আলো এসে চোখে মুখে লাগলো।


তুমি এখন হোস্টলে ব্যালকনীতে একাকী আছো কি বসে ?
উদাস ভাবনায় কাটছে কি প্রহর ?
আজিমপুরের আকাশে উঠেছে কি চাঁদ ? তুমি কি দীপ্তিময় হয়ে উঠেছো ?
তুমি কি অনুভব করতে পারো কোনো উচ্ছসিত তরুণের ভালোবাসার প্রাণ স্পর্শ ? 
আজকের এই জ্যোৎস্না রাতে তুমি বের হয়ে আসো রাধার মতো-
চলো দূর প্রান্তরের দিকে হেটে যাই, ভেসে বেড়াই মেঘের নীচে নীচে।


দেখতে দখভে প্রায় তিন মাস চলে যায়। সামনে গ্রীস্মে কলেজ ইউনিভার্সিটি দুটোই বন্ধ হয়ে যাবে। মালিনীও চলে যাবে দেশের বাড়ী। যেদিন যাবে তার আগের দিন পাবলিক লাইব্রেরী চত্বরে দুজন বসে আছি। কাল মালিনী চলে যাবে।
আজ কেমন যেনো মনমরা হয়ে আছে লাইব্রেরী চত্বরের ঘাস। কোনো পাখী গাইছেনা গান ।  রোগীবাহি এ্যাম্বলেন্সগুলো করুণ হর্ণ বাজিয়ে হাসপাতালে ঢুকছে। মালিনী চুপ হয়ে বসে আছে, কোনো কথা বলছেনা। আমি ওকে ডাকলাম- মালিনী।
মালিনী : জ্বী।
আমি :   ভুমি আসবে ফিরে কবে ?
মালিনী:  এইতো দেড় মাস পর।
আমি : এসে আমার সাথে দেখা করবে না ?
মালিনী:  করবো
আমি:  কেমনে জানতে পারবো তুমি ঢাকা এসেছো ?
মালিনী : তুমি আগামী জুন মাসের ১৭ তারিখে এখানে থাকবে।
আমি :  আচ্ছা।

মালিনী ওর ব্যাগ থেকে একটি ক্যাসেট আমার হাতে দিয়ে বলে- 'এখানে আমার গাওয়া একটি গান আছে। যদি কখনো আমার কথা মনে পড়ে তবে বাজিয়ে শুনো এই গান।' আমি ওকে বললাম- তুমি যে গান জানো এ কথা তো কখনো বলো নাই। মালিনী বললো- তুমিতো জানতে চাও নাই, আর মানুষের কতো কথাইতো অপ্রকাশিত থাকে।' আমি মালিনীকে বলি- 'তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো ?
মালিনী :  না।
আমি :  মালিনী ।
মালিনী : জ্বী।
আমি : তোমার হাতটা একটু ধরি ?
মালিনী : ধরো।
আমি : একটু চুমু দেই হাতে।
মালিনী : দাও।


একদুই করতে করতে দেড়মাস চলে গেলো। আসে ১৭ই জুন। আমি পাবলিক লাইব্রেরীতে চলে যাই। সারাদিন অপেক্ষায় থাকি। মালিনী আর এলোনা। এরপর পরপর আরো দশ দিন যাই। কোনো দিনই মালিনী এলোনা। তারপর প্রতি সপ্তাহেই একদুই দিন করে লাইব্রেরীতে যেয়ে মালিনীকে খুঁজেছি। কিন্তূু মালিনী কে আর পাইনি। মালিনীর দেশের বাড়ী বগুড়ার মহাস্থান গড় এলাকায়। এই টুকু ঠিকানাই জানতাম। এর চেয়ে বেশী ঠিকানা আমার জানা ছিলোনা। ওখানে যেয়ে কোথায় খুঁজবো মালিনীকে ? হোস্টেলেও খোঁজ নিয়েছি,সেখানেও আসেনাই।

আমি মালিনীর জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। তারো দুই বৎসর পরে আমি বিয়ে করি। যেদিন আমার গায়ে হলুদ হবে সেদিন কি মনে করে মালিনীর ক্যাসেটটির কথা মনে পড়ে। যা এতোদিন শোনা হয়নাই। তাছাড়া ওর কথা আজকের এই দিনে মনে পড়ছিলো খুব। আমাদের বাড়ীর মধ্যে তখন উৎসব আনন্দ হচ্ছে। চারিদিকে হাসি আর গান। আমি আমার ঘরে মালিনীর নিজের কণ্ঠে গাওয়া সেই গানটি শুনতে থাকি-

তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি--
তবু মনে রেখো।
যদি  জল আসে আঁখিপাতে,
এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,
তবু মনে রেখো।
এক দিন যদি বাধা পড়ে কাজে শারদ প্রাতে--  মনে রেখো।
যদি পড়িয়া মনে
ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়নকোণে--
তবু মনে রেখো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন