রঞ্জিত খেতে চলে আসে। খাবার টেবিলে রঞ্জিতকে রোহিত বলে -- তুমি কী নিয়ে পড়াশোনা করছ?
--- মানবিক নিয়ে পড়ছি।
--- আচ্ছা, খুব ভালো।
--- তা উচ্চতরে যেয়ে কোন্ বিষয় নিয়ে পড়তে চাও?
-- জানি না। ভাবিনি এখনও। আপনি বলেন, কী নিয়ে আমি পড়ব।
-- তুমি সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারো। ভালো রেজাল্ট করতে পারলে বাইরে স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার সুযোগ বেশি পাবে।
-- আচ্ছা মামা। দোয়া করবেন আপনি।
-- আর একটি কাজ করবে। যদি পারো, নিজের প্রতি যদি দায় হয় -- তুমি মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিতা মেয়েদের নিয়ে গবেষণামূলক কিছু কাজ করবে। কাজটি অনেক বড়ো ও কঠিন । তবুও করবে। তুমি শুরু করবে আমাদের এই হরিনা গোপাল গ্রাম থেকে। এই ধরো, তোমার রোহিনী মাসির কথা। তার নাম কিন্তু কোথাও লেখা নেই। এই রকম অনেক ধর্ষিতা মেয়ে আছে, গ্রামে গঞ্জে ও বিভিন্ন জনপদে। জীবিত ও মৃত কিংবা শহীদ হয়েছেন। তাদেরকে তুমি খুঁজে খুঁজে বের করবে। তুমি তরুণ প্রাণ। হাতে অনেক সময়। তুমিই পারবে এই বিশাল কাজটি করতে। আমি এই ব্যাপারে একটি দিকনির্দেশনা দেব পরে একদিন।
খাওয়া শেষ হলে রোহিত ছায়া রাণীকে বলে -- তুই রাতেই আমার সব জমি জমার কাগজগুলো বের করে রাখবি। আমি ওগুলো দেখব, এবং একজন উকিলকে দেখাব। কোনো ভুল ভ্রান্তি থাকলে তা ঠিক করে নেব। তারপর রোহিত বিছানায় চলে যায় ঘুমুতে।
রোহিত চলে যাবার পর জামাই বাবু ছায়া রাণীকে বলছিল, শুনলে তো তোমার দাদার কথাবার্তা। তুমি শুধু শুধু পর মানুষের সম্পত্তি কষ্ট করে দেখে শুনে রাখলে। কী লাভ হলো তোমার? শুধু পাহারাদারনী হয়েই থাকলে। অপেক্ষা করো ক'টা দিন। দেখো কী করে তোমার দাদা? সব বেচে থুইয়ে টাকা নিয়ে পারি জমাবে দূরদেশে । আর আসবে না।
ছায়া রাণী বলে -- 'দাদা যা করার করবে। তোমাকে এই নিয়ে ভাবতে হবে না। ওনার সম্পত্তি উনি যা করার করবে। এ নিয়ে তোমার এত মাথা ব্যথা কেন?
রোহিত সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে নেয়। সে আজ শহরে যাবে। একবার ভেবেছিল -- শহীদুলকে সাথে করে নেবে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল, সে একাই যাবে।
রোহিত জমিজমার কাগজগুলো বের করে দেখল।সে একটি হিসাব করে, কতটুকু জায়গাজমি তার আছে। সে দেখতে পায় -- বাড়ি এবং পুকুরসহ চার বিঘা, আমবাগান কাঁঠালবাগান, সুপারিবাগান ও অন্যান্য ভিটা মিলে ৫ বিঘা, ফসলি জমি ১৫ বিঘা, আর বাজারে দোকানের জায়গা ১ বিঘা। আর অস্থাবর সম্পদ হচ্ছে -- পাকা দালান একটি, ছোট বড়ো টিনের ঘর তিনটি, বাজারে আধা পাকা দোকান চারটি। সব মিলে যার বর্তমান মূল্য দেড় কোটি টাকার উপর হবে।
রোহিত ছায়া রাণীকে বলে -- আমি আজ একটু শহরে যাচ্ছি। আজ যদি না আসতে পারি, কাল চলে আসব।
রোহিত শহরে এসেই প্রথম ভালো একজন উকিলোর সাথে দেখা করে। তাকে তার সমস্ত সম্পত্তির কাগজপত্র দেখায়। এবং তার সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইনগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে। এবং বলে আপনি একটি খসড়া দলিল তৈরি করেন। আগামীকাল এটি সম্পাদন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমি কাল আবার আসব।
রোহিত উকিলের চেম্বার থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে হাঁটতে থাকে। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। একটি রিকশা ডাকে, এবং রিকশাওয়ালাকে বলে - 'তুমি আমলা পাড়া যাবে?' '
-- যাব, ওঠেন আপনি।'
রিকশা একসময় আমলা পাড়ার গলিতে ঢোকে। রিকশাওয়ালা বলে -- এটাই আমলা পাড়া। তা, কোন্ বাড়িতে যাবেন? '
--- যে বাড়িতে যাব, সে বাড়ি আমি চিনিনা।
--- বাড়ির মালিকের নাম কী?
---নাসির উদ্দীন উকিল।
রিকশাওয়ালা দুই একজনকে জিজ্ঞাসা করে বাড়িটি চিনে নেয়। তারপর রোহিতকে সেই বাড়িটির সামনে নামিয়ে দেয়। রিকশাওয়ালা রোহিতকে বাড়িটি দেখিয়ে দিয়ে বলে -- 'এইটি নাসির উকিলের বাড়ি।' রিকশাওলাকে ভাড়া পরিশোধ করে রোহিত বাসার গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। এবং গেট নক করে। ভিতর থেকে একজন তিরিশোর্ধ্ব মেয়ে এসে গেট খুলে দেয়।
মেয়েটিকে দেখে তার শরীরের সমস্ত রক্ত মুহূর্তে হিম শীতল হয়ে ওঠে । আত্মার স্পন্দন ধ্বনি থেমে যায়। কী আশ্চর্য ! সেই আনত মুখ, সেই মায়াভরা চোখ, সেই গ্রীবা, সেই নাক, সেই শরীর গড়ন, মুখ জুড়ে সেই লুকানো হাসি। একদম রেবেকার মতো। আরও আশ্চর্য হয় -- সে এমন কিছু মিল খুঁজে পায় মেয়েটির ভিতর, তা আরও বিস্ময়ের।
মেয়েটি বলে -- আপনি কে? কাকে চান? আপনাকে তো চিনতে পারছি না।
--- আমি রোহিত সেন। এখানে মণিকার সাথে দেখা করতে এসেছি। তুমি কী মণিকা ?
-- জ্বী, আমি মণিকা। কিন্তু রোহিত সেন নামে কাউকে আমি চিনিনা। তা, আপনি কোথায় থেকে এসেছেন?
--- আমি আপাতত হরিনা গোপাল গ্রাম থেকে এসেছি। কিছু মনে করোনা। তুমি কী আমাকে একটু বসতে দেবে?
--- ও দুঃখিত। আপনাকে বসতেই বলিনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। আসুন, ভিতরে চলুন।
মণিকা রোহিতকে ভিতরে নিয়ে বসতে দেয়। একটি পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চা মেয়ে ছুটে কাছে চলে আসে। এবং রোহিতের কোলের উপর এসে বসে পড়ে। বাচ্চাটি রোহিতকে বলে -- 'তুমি আমার কী হও?' রোহিত বলে -- 'আমি তোমার দাদু হই।'
--- এতদিন কোথায় ছিলেন?
-- চাঁদের দেশে।
-- তুমি আমাকে একটা গল্প শোনাও।
-- চাঁদের দেশে এক চাঁদের বুড়ীর সাথে আমার খুব ভাব ছিল। সে আমাকে একদিন একটা সাদা বিড়ালছানা উপহার দেয়। সেই বিড়াল ছানাটির নাক, মুখ, চোখ, গাল একদম তোমার মতো দেখতে খুব সুন্দর। আর শরীরটা ছিল তুলতুলে। আমি সেই নরম বিড়াল ছানাটির গাল আমার গালে লাগিয়ে আদর করতে থাকি। দেখি -- কী সুন্দর শান্ত হয়ে আছে।
--- তারপর?
--- তারপর আর কী? দেখি সে ঘুমিয়ে গেছে।
-- তুমি আমাকে ঐরকম একটা বিড়াল ছানা এনে দিবে?
-- অবশ্যই দেব। আমি আবার যখন চাঁদের দেশে যাব, তখন চাঁদবুড়ীকে বলে তোমার জন্য একটি সুন্দর তুলতুলে বিড়াল ছানা নিয়ে আসব। আচ্ছা, তোমার নাম কী?
--- ঐশ্বর্যময়ী।
মণিকা ওর ঐশ্বর্যময়ীকে বলে -- 'তুমি তোমার দাদুর সাথে পরে কথা বলবে। এখন চলো।'
মণিকা মেয়েকে অন্য রুমের ভিতর রেখে আসে। এবং অনেকটা বিস্মিত হয়ে রোহিতকে বলে --'আজ প্রথম দেখলাম, আমার মেয়েটি কোনো একজন অপরিচিত মানুষের কোলে গিয়ে বসেছে। এবং তাকে আপন করে নিয়েছে।'
রোহিত মনে মনে বলছিল -- 'আমি অপরিচিত মানুষ?' পরক্ষণেই বলে -- ও আমাকে খুব আপন মনে করেছে। তাই এসে কোলে উঠেছে। আচ্ছা, তুমি আমার নাম আগে কারোর কাছে থেকে কখনো শোনোনি?
-- জ্বী , এখন মনে পড়ছে। মতি চাচাসহ গ্রামের অনেকের কাছে থেকে আপনার কথা আমি শুনেছি। আপনি তো নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন সেই কবে। তা এতবছর কোথায় ছিলেন?
-- সে অনেক কথা। এত কথা শোনার তোমার সময় হবে না। বিরক্ত হবে তুমি। আমার জীবন হচ্ছে যাযাবরীয়। একটা গান শুনেছ নিশ্চয়ই -- '' আমি এক যাযাবর, পৃথিবী আমাকে আপন করেছে, ভুলেছি নিজের ঘর। আমি গঙ্গার থেকে মিসিসিপি হয়ে ভলগার রূপ দেখেছি, অটোয়ার থেকে অস্ট্রিয়া হয়ে প্যারিসের ধূলো মেখেছি... '' পৃথিবীর দেশে দেশেই আমার ঘর। গানের ঐ কথার মতোই আমার জীবন।
কত দেশ ঘুরেছি, কত বিচিত্র মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি, কত সরোবরে পদ্মফুল জলে ভাসতে দেখেছ। কত নদীর কূলে একাকী বসে থেকেছি, কত সাগরবেলায় হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে জলের সাথে অন্তরের বেদনার কথা প্রকাশ করতে চেয়েছি।
পরিব্রাজকের মতো ঘুরতে ঘুরতে জীবনের এই প্রান্ত বেলায় এসে মনে হলো -- আর কত অভিমান প্রলম্বিত করব? কার সাথেই অভিমান আমার ! নিজের কাছে থেকে নিজে কখনও জানতে
চাইনি -- 'কোথায় আমার কে আছে?' কখনও খুঁজতেও চাইনি -- 'আপন কেউ কী আছে , যে আমার জন্য সান্ধ্য ধূপগন্ধ প্রদীপ জ্বেলে অপেক্ষা করবে।
মাঝে মাঝে খুব করে মনে হতো -- আমার অমঙ্গলে, আমার অসুখ বিসুখে, আমার রোগ মুক্তির জন্য কোনো আপন মানুষ কী প্রার্থনা করে? কত সময়ে তপ্ত জ্বরে শরীর পুড়ে যেত, প্রবাসে সেই অজ্ঞাতে কেউ কাপড়ে জল ভিজে জলপট্টি দেয়নি কপালে।
মানুষের যখন বয়স বাড়ে, তখন তার বোধের অনেক কিছু দূর্বল হয়ে যায়, এই ধরো -- আমার তারুণ্যে যে অভিমান ছিল, সে অভিমান এখন আর নেই, তা অবদমিত। সবাই আহাম্মক হয় না, কেউ কেউ হয়। আমি ছিলাম সেই আহম্মকের দলে। কত কুসুমাস্তীর্ণ জীবনই না হতে পারত এই জীবন। তার কোনো সুবাসিত ফুলই ফোটাতে পারিনি। তবু জীবন আছে। কেন যে এখনও এই পৃথিবীর মধ্যখানে প্রবল ভাবে বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে। বিধাতা একমাত্র এই পৃথিবীকেই বহু অমূল্য রূপ সৌন্দর্য দিয়ে তৈরি করেছেন।
একটা জিনিস জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে এসে উপলব্ধি করছি -- কারোর প্রতি চির অভিমান করতে নেই। কাপুরুষের মতো সবাইকে ছেড়েছুঁড়ে জনমের তরে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে নেই। তুমি হয়ত বলতে পারো -- 'জীবনটা আবাার সংশোধন করে নিন।' কিন্তু কী লাভ আর সংশোধন করে ? জীবনই তো শেষ ! ভাঙা এই প্রবঞ্চিত জীবনে কেউই তো আর নেই।
-- আপনি বিয়ে করেন নি।
-- না।
রোহিত মণিকাকে বলছিল -- মা, একটা কথা বলব?
-- বলেন।
-- আমার খুব খিদে লেগেছে। একটু খেতে দেবে? আমি দুপুরে এখনও খাইনি।
মণিকা একটু অবাক হয়! স্বগোতক্তি করে বলছিল, লোকটিকে ভালো করে চেনাই হলো না। সে কি না, খেতে চাচ্ছে। আবার ভাবছিল, উনি আমাকে আপন মনে করেই হয়ত খাবার চাইছে। যেমন করে সন্তান খেতে চায় মায়ের কাছে, যেমন করে বাবা খেতে চায় কন্যার কাছে। উনি হয়ত আমার ভিতর একজন কন্যার ছায়া দেখতে পেয়েছে ।
খাবার টেবিলে খেতে বসে রোহিত মণিকাকে বলছিল -- জামাই বাবু কখন আসবে?
-- ও চলে আসবে। ওর চলে আসার সময় হয়েছে।
--- আমি জামাইবাবুকে রেখেই খেতে বসলাম।
-- কোনো অসুবিধা নেই। আপনি বিব্রত হবেন না।
রোহিত খেতে খেতে মণিকাকে বলছিল -- তোমার মা আমার ছাত্রী ছিল। তাকে আমি খুব স্নেহ করতাম। সে আমার মঙ্গল কামনা করত সবসময়। একবার রেবেকা আমার জীবনও বাঁচায়েছিল। কেউ যদি কারোর জীবন বাঁচায়, তখন সে তার কাছে একজন দ্বিতীয় ঈশ্বর বা দেবী হয়ে থাকে চিরকাল। আমি তোমার মায়ের কাছে চিরঋণী হয়ে আছি।
রোহিত আরও বলছিল -- আমি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে তোমার কাছে এসেছি মা। তুমি তিনদিন পর জামাইবাবুকে নিয়ে হরিনা গোপাল গ্রামে চলে আসো, তোমাদের কিছু কাজ দিয়ে যাব। কিছু দায়িত্ব। তুমি আসো, তখন তোমাকে বিস্তারিত সব বলব।
রোহিতের খাওয়া শেষ হয়ে যায়। তখন পর্যন্ত জামাইবাবু আসে নাই। রোহিত বলছিল -- আমি আজ চলে যাই। যদিও কাল আরও একবার আসব শহরে। একটা জরুরি কাজ করা বাকি আছে। কাল এসে সেটা সম্পাদন করব।
--- তাহলে কাল আবার আসবেন।
--- দেখি, যদি সময় পাই আসব। আর না আসতে পারলে তোমরা কিন্তু অবশ্য অবশ্যই গ্রামে যাবে। কোনো কিছুতেই যেন মিস না হয়। জামাইবাবুকে আমার হয়ে সব বলবে।
--- যাব আঙ্কেল।
-- তোমার মেয়ে কই? ডাকো।
মণিকা মেয়েকে নিয়ে আসে। এবারও সে কোলে এসে বসে বলে -- তুমি চলে যেওনা। তুমি চলে গেলে আমাকে গল্প শোনাবে কে?
--- আমি আবার আসব। এসে মেঘের দেশের এক অপূর্ব সুন্দর পরীর গল্প শোনায়ে যাব।
রোহিত ঐশ্বর্যময়ীর হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলে -- তুমি তোমার আব্বু আম্মুকে সাথে করে নিয়ে এই শহর থেকে সবচেয়ে সুন্দর সুন্দর কটি জামা ও খেলনা কিনবে।
ঐশ্বর্যময়ী রোহিতের পাজরের কাছে মাথা রেখে বলে, আচ্ছা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন