রবিবার, ১২ জুলাই, ২০২০

পরিচ্ছেদ ১৪

রোদ্রকরোজ্জ্বল সুন্দর সকাল আজ। রহিত আজ চলে যাচ্ছে।  মণিকা, ছায়া রাণী, শহীদুল, শেফালী, নাসির, রঞ্জিত, ঐশ্বর্যময়ী সহ সবাই উপস্থিত আছে। রাস্তায় উপর একটি রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। সবাই রোহিতকে বিদায় জানানোর জন্য পাকা রাস্তা পর্যন্ত চলে এসেছে। 

শহীদুল রোহিতকে বলে -- 'আমরা তোকে শহর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি না হয়।'  
 
 -- 'না। আমি একাই চলে যাব।  চারদিকে অপূর্ব  রুপোলী রোদ, মাথার উপর নীল আকাশ, রাস্তার দুপাশে বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠ। বনকূচের লাল ফুল, অনন্ত লতা, সোনালের হলদে ফুলের শোভা, বৈচীর ঝোপ, বাঁশঝাড়, গাঙশালিখদের গর্তে লুকিয়ে যাবার  দৃশ্য  দেখতে দেখতে চলে যাব।  ভালোই লাগবে আমার। পথে চলব আর-- বনে, বাগানে, পাখিদের এলমেল কলকাকলি শুনব। দক্ষিণ হাওয়ায় ভেসে আসবে বুঁনো ভাট ফুলের রোদ্র-স্নিগ্ধ গন্ধ। উদ্দাম আনন্দ উচ্ছাসে ভরে উঠবে 
মন। 

একটু উদাস উদাস লাগছিল রোহিতকে।  রোহিত শহীদুলকে বলে -- চল একটু ওধারে যাই। পুকুর পাড়ে বেলীফুলের ঝাড়ের আড়ালে । 

ওরা দুজন চলে যায় পুকুর পাড়ে।  
  
রোহিত শহীদুলকে বলে -- একটা সিগারেট দে। খাই। 

শহীদুল নিজেই রোহিতের ঠোঁটে  সিগারেট ধরিয়ে দেয়। 
    
রোহিত সিগারেট টানতে থাকে।  কিছুক্ষণ মুখে কোনো কথা নেই।  চোখ ছলছল করছে। রোহিত করুণ চোখে শহীদুলের মুখের দিকে চেয়ে বলে -- এই কাগজটি নে। এখানে আমার কিছু কথা লেখা আছে।  আমি চলে যাবার দু' তিনদিন পরে এই চিঠিটি পড়বি। আমি যখন পৌঁছব তখন। তার আগে নয়। '

শহীদুল বলে -- 'আচ্ছা।'  
 
সিগারেট খেয়ে শেষ করে দুজনেই পুণরায় চলে আসে রাস্তার উপর । 

মণিকা বিষণ্ণ মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। ভিতরে ভিতরে বইছিল কান্নার ধারা। সে রোহিতের কাছে চলে আসে। রোহিতের পাঁজরেে কপাল ঠেকিয়ে অঝোর ধারায় ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। কান্নার ভিতর  কিছু  কথা অস্পস্ট ভাবে  শোনা গেল কেবল -- 'আপনাকে আমার এত আপন লাগছে কেন? কী মায়া রেখে গেলেন ! অন্তর বীণার তার ছিঁড়ে যাচ্ছে যে ! '   

'পরানে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা--

দুখের মাধুরীতে করিল দিশাহারা

সকলই নিবে-কেড়ে,    দিবে না তবু ছেড়ে--

মন সরে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে।'

                                          
সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে রোহিত রিকশার দিকে এগুতে থাকে। ঠিক তখনই পিছন থেকে ঐশ্বর্যময়ী বলে ওঠে --  দাদু, তোমার গল্পটা শেষ করে গেলে না। '

রোহিত ফিরে এসে ঐশ্বর্যকে জড়িয়ে ধরে গল্পের শেষ টুকু শোনায়-- ' 'তারপর কী হলো শোনো -- সেই মেঘের দেশে হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নামতে শুরু করল । বৃষ্টিতে ভিজে আমি  শীতে কাঁপতে থাকি। আমার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখি -- পরীটা নেই। ও চলে গেছে। পড়ে বুঝতে পারলাম, পরীটাকে আমার স্বপ্নের ভিতর পাওয়া ছিল। স্বপ্ন ভেঙে গেছে,  পরীও চলে গেছে।       
                                
রোহিত যেয়ে রিকশায় উঠে।  পিচঢালা পথ ধরে রিকশাটি চলতে থাকে সম্মূখপানে।  পিছনে পড়ে থাকে -- তার দূরন্ত শৈশব, মাটির সোঁদা গন্ধ, মৃত্তিকার নীচে আপন মৃত মানুষের করোটি, বাতাসে রোহিনীর কান্নার ধবনি, চরাচরে দীপ্যমান  দুঃখিনী মায়ের মুখচ্ছবি। আর যে থাকল সে দুজন হতভাগ্য মানুষের  অবিচ্ছেদ্য রক্ত মাংসের তৈরি পিতৃ মাতৃহীন মণিকা। 

উপেক্ষিতা হয়ে আরও একজন থেকে গেল। সে অপার্থিব। দূরালোকে সে চলে গেছে। কেউ জানে না, রোহিত কুমার সেনের সে কী ছিল ? যাকে পায়নি সে এই জীবন কালে। সে যে জনম জনম প্রবঞ্চিতা,  সে যে অপ্রাপণীয়া।  

রোহিতের সামনে কিছুই নেই। সংসার নেই। ঘর নেই। কেউ নেই। সেও অপ্রাপণীয়। দূর প্রবাসে কোনো নিঃসঙ্গ শয্যায়  প্রিয়  মানুষের কোমল হাতের পরশহীন অজ্ঞাত মৃত্যুর জন্য সে অপেক্ষা করবে।  

'আমি তো থাকবই শুধু মাঝে মাঝে পাতা থাকবে সাদা,
এই ইচ্ছামৃত্যু আমি জেনেছি তিথির মতো…
আমি তো থাকবই তোমাদের দুঃখের অতিথি, আমি ছাড়া
দেবতার হাত থেকে কে খুলে পড়বে চিঠি,
কার রক্তের আদেশে মালা হয়ে উঠবে ফুল?
আমি দিয়ে যাব তোমাদের সঙ্গোপন গন্ধর্ব... 
এই স্বেচ্ছামৃত্যু আমি নিজেই চেয়েছি।”

সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর কবিতা।

----- ----- ----- ----- -----

কয়েকদিন পরের কথা। বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে শহীদুল রোহিতের চিঠির কথা ভুলেই গিয়েছিল। আজ হঠাৎ চিঠিটির কথা তার মনে পড়ে। সে প্যান্টের পকেটের  ভিতর চিঠিটি রেখেছিল। প্যান্টটি  খুঁজতে থাকে। আলনায় প্যান্ট নেই। সে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করে। তার স্ত্রী বলে, 'আমি প্যান্টটি ধুয়ে ভাজ করে ওয়ারড্রবের ভিতর রেখে দিয়েছি।' 

শহীদুল প্যান্টের পকেট থেকে চিঠিটি বের করে। পানিতে ভিজে চিঠটি এবড়ো খেবড়ো হয়ে গেছে। কাগজ গলে নরম হয়ে জায়গায় জায়গায় উঠে  গেছে। ছিঁড়েও গেছে খানিক। পানিতে ধুয়ে লেখা গুলো মুছে অস্পষ্ট হয়ে গেছে।        

শহীদুল অনেক কষ্ট করে জোড়াতালি দিয়ে চিঠিটি পড়বার চেষ্টা করে। রোহিত লিখেছে -- 

সুপ্রিয়য়েষু শহীদুল, 

এই পত্রখানি তুই যখন পড়বি তখন আমি তোর থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকব। জীবনের বাঁকে বাঁকে কত বন্ধু আমি পেয়েছি, কিন্তু তোর মতো অকৃত্রিম বন্ধু  আর কাউকে পাইনি। সব মানুষের জীবনে এমন কিছু গোপন কথা থাকে ... 
( অস্পষ্ট ও লেখা পড়া যায় না ).দুই একটি কথা কাউকে না কাউকে বলতে হয়   .. আমার কেউ নেই। কাকে বলব?  ( অস্পষ্ট.,পড়া যায় না....)     
কিছু  কথা তেকে বলছি। আল্লাহর দোহাই লাগে, কাউকে বলবি না। 
মণিকা আমারই মেয়ে...  ( অস্পষ্ট এবং, পড়া যায় না).... 
আমি ধর্মান্তরিত ( অস্পষ্ট)... 
ঘটনাটি বলছি,  সেদিন ছিল কার্তিকের অমাবস্যার পূর্ব রাত্রি। রেবেকা এসেছিল.( অস্পষ্ট)..... অন্ধকারে চোখের জলে .. রুধিরের দাগ.. (অস্পষ্ট, এবং চিঠি ছিন্ন )....... 
    

রোহিতের জীবন ধারা  থেমে থাকবে না ।  তার প্রতিদিনের কর্ম অবসরে, বিনিদ্র রাত্রির অন্ধকারে, রোগ শয্যায়,  কিংবা অপার্থিব কোনো জ্যোতির্ময়  ছায়াপথ থেকে দূর দৃষ্টি মেলে দেখবে -- হরিনা গোপাল গ্রামে তাদের বাড়িটাতে সাঁজ অন্ধকার নামছে। ধীর স্নিগ্ধ হাতে ঘরে সন্ধ্যা বাতি জ্বালাচ্ছে ছায়া রাণী। হয়ত সেই আঁধার রাত্রিতে বাড়ির পিছনে ঝিমঝিম করে ঝিঁ-ঝি পোকা গুঞ্জন করে ডাকবে, ডুমুর গাছে কেঁদে উঠবে লক্ষী পেঁচা। নামহীন অনেক পাখিই হয়ত ডেকে ডেকে ফিরে যাবে অন্যত্র, অন্য কোনও বন নিভৃতে ।        

সে আরও দেখবে -- স্বচ্ছতোয়া পদ্মদিঘি, অরণ্য নিবিড় বাঁশ ঝাড়, ধনিদহ বিলে যেতে বিস্তৃর্ণ মাঠ, দেবী বিশালাক্ষীর পোড়ো মন্দির। এই সবই জলছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠবে। পোড়ো ঐ মন্দির ঘরের পিছনের বাতাবি লেবুর বন থেকে পাখিদের কলকাকলিও শুনতে পাবে। প্রতি বর্ষায় ইছামতী নদী কানায় কানায় বানের জলে ভরে উঠবে । কস্তুরি ফুলগুলি স্রোতে ভেসে চলে যাবে দূর মোহনায় । 

এক হারানো রাত্রির কথা মনে করে আক্ষেপও করবে। পুকুরপাড়ের কাঞ্চন-ফুল তলায় ঘাসের উপরে স্বর্গ পাওয়ার কথা মনে পড়বে। মহাকালের বীথিপথে অনাগত দিনের শত হেমন্ত পাখিরা এসে মুখর করে রাখবে  হরিনা গোপাল গ্রামের বৃক্ষ বৃন্তে।  

রেবেকা চলে গিয়েছে পৃথিবী ছেড়ে কোনও নক্ষত্রের দেশে, সে হয়ে গিয়েছে আর এক নক্ষত্র। দূর্ভাগা  শ্রী রোহিত কুমার সেন মৃত্যুর পর কোনও স্বীকৃত উত্তরসুরী রেখে যেতে পারবে না, যে  তাকে স্মরণ করে তার আত্মার শান্তি চেয়ে ঠাকুর ঘরে প্রদীপ জ্বেলে প্রার্থনা করবে।  দিন চলে যাবে, ফুরাবে আয়ুষ্কাল, মহাকালে নিবর্তিত হবে দিন মাস বর্ষ। জীবনের সব মর্মর স্বপ্ন, বিষাদ বেদনা, মধু কথা, মাধবী রাত্রিও ফুরাবে একদিন। তবুও চলবে জীবন ধারা, আপন উত্তরসুরী থাক বা না থাক, অন্য কেউ তো থাকবে....।                           

আখ্যান শেষ হয় নাই।
          


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন