বাড়িতে ফিরে আসতে আসতে রিকশায় বসে রোহিত ভাবছিল -- যতক্ষণ মণিকার ওখানে ছিলাম, আর যতবার আমি ওকে তাকিয়ে দেখেছি, ততবার মনে হয়েছে, ও আমারই চির জনমের আপন কোনো জন। কোথায় থেকে একটি স্বর্গীয় আলো ওর মুুখের উপর এসে পড়েছিল। দৈব কণ্ঠে কে যেন বলছিল --- 'তুই ভালো করে চেয়ে দেখ এই মেয়েটিকে। ওর মুখের উপর যে অপার্থিব আলো আমি ফেলেছি, তা শুুুধু ওকে ভালো করে চিনে নেবার জন্য ফেলেছি। '
''নদীর জলে থাকি রে কান পেতে, কাঁপে যে প্রাণ পাতার মর্মরেতে।
মনে হয় যে পাব খুঁজি, ফুলের ভাষা যদি বুঝি,
যে পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পারে......''
-- রবীন্দ্রনাথের গানের কথা।
আসতে আসতে পথে ইছামতী নদীর তীরে সন্ধ্যা নেমে আসে। রোহিত দূরে নদীর কূলে দুচোখ মেলে তাকিয়ে থাকে কাশবনের দিকে। বালির উপরে ঘন কাশবন। থরে থরে সাদা ফুল ফুটে আছে। ধবল শুভ্র সেই কাশফুল দুহাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে একটি কিশোরী বালিকা দৌড়ে দৌড়ে তার দিকে ছুটে আসছে । রোহিত চিনতে পারে এই কিশোরীকে। সে যে অনেক আগের কিশোরী মণিকা। ওকে দেখতে দেখতে চোখে ঘোর লেগে আসে। ঘোর ছাড়ার জন্য সে চোখ বন্ধ করে। আবার যখন চোখ খুলে তাকায় দূরে কাশবনের দিকে। তখন কাশবন সন্ধ্যার অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। সেখানে কোনো কিশোরীকে সে আর দেখতে পায় না ।
রোহিতের বাড়িতে পৌঁছতে পৌছতে রাত্রি হয়ে যায়। ছায়া রাণী অপেক্ষা করছিল তার জন্য। কখন তার দাদা চলে আসবে।
রোহিত সকালে ঘুম থেকে জেগেই দেখতে পায় শহীদুল বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে। রোহিত ওকে দেখেই বলে -- সুপ্রভাত। শহীদুলও বলে -- সুপ্রভাত।
--- কখন এসেছিস?
--- একটু আগে। তা কাল তুই কোথায় গিয়েছিলি?
-- মণিকাকে দেখতে গিয়েছিলাম। খুব দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল মেয়েটাকে।
-- তা দেখেছিস?
-- দেখেছি 'প্রাণ ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে'। কী যে ভালো লেগেছে মেয়েটিকে দেখে । আমার অন্তর গহীনে ওর মায়াময় মুখ, চোখ, চাহনি, হাসি-- সব ছুঁয়ে আছে। যা আমি বয়ে নিয়ে যাব অনেক দূরে। এই মুখ আমার মনে গেঁথে থাকবে।
আর মাত্র দুই একদিন আছি। তারপর চলে যাব। এবার যেয়ে কোথাও গিয়ে নিরিবিলি কিছুদিন কাটাব। আমি জানি মনটা খুব ভঙ্গুর ও বিধ্বস্ত থাকবে। ফিনল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। ওখানে নরওয়ের সীমান্তের কাছাকাছি রয়েছে হাল্টি পর্বত মালা। নির্জন অনেক গুহা আছে সেখানে। সারাদিনে একটুও সূর্যের আলো পড়ে না। আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয় দিনের বেলায়। তা না হলে অন্ধকার! কোনো একটি গুহায় ডেরা পাতব। মাসখানেক থাকব। ওখানে যারা যায় তারা বেশির ভাগই পর্বত প্রস্তুরে কিংবা গুহা গাত্রে বিভিন্ন চিত্র এঁকে রেখে আসে। আমি চিত্রকর নই। তবুও ছবি আঁকব। রং তুলি নিয়ে যাব। আমি আঁকব একটি মেয়ের মুখের ছবি। একটিই মুখ থাকবে , কিন্তু সেই মুখে দুজন প্রকাশিত হবে। মা ও মেয়ে । ছবিটির নাম দেব -- বিশ্ব ভরা প্রাণ।
হয়ত উৎফুল্লতেই কাটবে গুহাবাসের দিনগুলো । দূরে বাল্টিক সাগরের তীর থেকে ভেসে আসবে হিম মাখা শীতল বাতাস। চোখ ও দৃষ্টি ওখান থেকে অনেক দূরের বাংলাদেশের উপর এসে পড়বে। গুহা প্রান্তে দাঁড়িয়ে মন কী উদাস হবে কারোর জন্য? পর্বতেও অস্তমিত হয় সূর্য, ওখানেও চাঁদ ওঠে, জ্যোৎস্নার প্লাবন বয়, তারা জ্বলে। আমি জেগে থাকব, চোখ মেলে কান পেতে শুনব --
'যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে।যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে। সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্ অচিনপুরে।'
-- রবি ঠাকুরের গান।
ছায়া রাণী এসে ওদের দুজনকেই বলে -- দাদা ভাইরা আসুন, নাস্তা করে নিন। নাস্তা খেতে খেতে রোহিত ওদের দুজনকেই বলে -- আমি আজও একটু শহরে যাব। কিছু কাজ বাকী আছে। ওগুলো সেরে বিকালের মধ্যেই চলে আসব। শহীদুলকে বলে -- তুই বাড়িতেই থাকিস। সন্ধ্যায় তোকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হবো।
রোহিত শহরে চলে যায়। এবং সমস্ত কাজ সম্পাদন করে ফেলে। সে কাজ সেরে মণিকার সাথে দেখা করে। আজকে জামাইবাবু নাসির উদ্দীনের সাথেও দেখা হয়। নাসির খুব অমায়িক ছেলে। রোহিত ছেলেটির সাথে কথা বলে খুব ভরসা পেল। ওদের দুজনকেই রোহিত বলে দেয়, 'তোমরা কাল বিকালেই চলে যেও। একটা ছোট্ট পারিবারিক মিলনীর ব্যবস্থা করেছি। সবাই একত্রিত হয়ে আনন্দ করব। গান করব। তাছাড়া আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, যা তোমাদের সবাইকে আমি বলব।
আজও ঐশ্বর্যময়ী রোহিতকে দেখে দৌড়ে কোলের উপর বসে পড়ে। এবং বলে -- 'দাদু,, তুমি আমাকে একটা গল্প শোনাও।'
আচ্ছা শোনাই -- তখন আমি তোমার মতো ছোট। মা আমাকে একদিন পরীর গল্প শোনায়ে ঘুম পারিয়ে দিল। তো আমি ঘুমিয়ে গেছি। দেখি -- একটা সুন্দর রঙবেরঙের পাখাওয়ালা পরী আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে । পাখা দেখতে একদম ময়ুরের মতো। আমাকে সে বলছে -- এই ছেলে তুমি ওঠো। আমি তোমাকে নিতে এসেছি। আমি বললাম -- তোমার নাম কী? পরী বলল -- আমার মাম মেঘবতী।
--- তুমি কোথায় থাকো?
-- আমি মেঘের দেশে থাকি। তুমি আমার একটি ডানা ধরো। আমরা দুজন উড়ে উড়ে চলে যাব মেঘ রাজ্যে।' আমি পরীর একটি ডানা ধরলাম। পরী উড়তে লাগল। দুজনই উড়ে উড়ে যেয়ে দেখি, সত্যিই সে এক অপূর্ব মেঘের দেশ।'
এই টুকু বলে রোহিত একটু থামল।
--- তারপর, থামলে কেন? বলো।
--- বাকিটুকু কাল বলব। তুমি তোমার বাবা মার সাথে কাল দাদু বাড়িতে চলে এস। ওখানে তোমাকে বাকীটুকু শোনাব।
-- আচ্ছা।
রোহিত বিকালেই চলে আসে হরিনা গোপাল গ্রামে। বাড়িতে এসে দেখে -- শহীদুল ওর জন্য অপেক্ষা করছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন