শনিবার, ৪ জুলাই, ২০২০

অতিপ্রাকৃত

একটা ভয়ংকর ঘটনার কথা লিখছি।  ১৯৮৫ সালের কথা। তখন বিয়ে সাদি কিছু করিনি।  এক বাড়িতে একা থাকি। আশেপাশে তেমন বাড়ি ঘর নেই। বাড়ির পাশেই জঙ্গল। বাঁশ ঝাড়ও আছে ঘরের চাল ঘেষে।     

সে বছর একুশের বইমেলা থেকে কোন্ কুক্ষণে কিছু অতিপ্রাকৃত ভূত পেত্নীর বই কিনেছিলাম। তার মধ্যে ছিল বিভূতিভূষণের তারানাথ তান্ত্রিক।  তো কয়দিন সেই বইগুলো পড়লাম। পড়ার সময়ই আমার ভিতর কেমন যেন একটি পরিবর্তন অনুভব করলাম। কেমন অস্বাভাবিক সন্ন্যাস সন্ন্যাস ফকির ফকরান্তি ও পাগল পাগল ভাব। ভাবছিলাম এর কারণ কী?  আমার কাছে মনে হলো যত গন্ডগোলের মূল -- বিভূতিভূষণের এই তারানাথ তান্ত্রিক।  ওকে যে করে হোক ঘর থেকে সরাতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম -- ওকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে একদিন তুরাগ নদীতে ফেলে দিয়ে আসব।          
 
কিন্তু তারানাথ তান্ত্রিককে বিসর্জনে পাঠানোর
আগেই ঘটে গেল এক ভয়ংকর ঘটনা।   

সেদিন সন্ধ্যা থেকেই মেঘ গুরুগম্ভীর বৃষ্টি হচ্ছিল । ঘরে আমার চাল চুলো জ্বলে না।  আজিজ মিয়ার হোটেল থেকে বাজিতপুরের বিলের  ঠ্যাংওয়ালা চিংড়ি মাছের ভুনা তরকারি  দিয়ে ভাত খেয়ে আসি। সাথে আষাঢ়ের ডিমওয়ালা টেংরা মাছের তরকারিও ছিল।       
  
কী করব?  কোনো কাজ কাম নাই। টেবিল থেকে  তারানাথ বের করে  পড়তে থাকি। উইলিয়াম ওয়ার্ডওয়ার্থের লেখা  দুষ্ট কবিতার মতো  বৃষ্টির রাত ছিল। কী চমৎকার ঝরো হাওয়ার সাথে মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে । শীতল হতে লাগল শরীর মন।       

তারানাথ তান্ত্রিক পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই। হঠাৎ একটি শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। শব্দটা বারান্দার দিক থেকে আসছিল। ঘড়িতে চেয়ে দেখি রাত পৌণে তিনটা। তারানাথে পড়েছিলাম -- ভুত পেত্নী দেখে ভয় পেতে নেই। ভয় করলে ওরা নাকি মাথায় ওঠে এবং ঘার মটকিয়ে চিবিয়ে খায়।      

শব্দটা আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছিল।  আমি মনে সাহস আনলাম।  দরজার কাছে এগিয়ে যাই। আল্লাহ রসুলের নাম নিয়ে বুকে ফু দিয়ে বিসমিল্লাহ বলে দরজাটা খুলি। দরজা খুলে আমি তো বিস্ময়েে হতবাক! বাইরে মধ্য আকাশে পূর্ণিমাভূক বিশাল চাঁদ। চন্দ্রদাসী হয়ে  সে আলো ছড়াচ্ছে আঙিনায়। যে মেঘ আর বৃষ্টি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সে মেঘও নেই,  সে বৃষ্টিও নেই। তার পরিবর্তে এই অবিস্মরণীয় চাঁদের আলোয় ভাসছে  ভূবনলোক । সেই চন্দ্রালোকে একটি উপজাতীয় মেয়েকে দেখতে পাই। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটি বলছিল -- আমি টিনটিন।  বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড় থেকে এসেছি । 

ও আরও বলছিল -- আমাকে তোমার মনে আছে? আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতাম।  এবং তুমিও।  তোমার কারণে আমি খুন হয়েছিলাম গাঙুর হাতে। এই দেখো আমার শরীর জুড়ে খুনের রক্ত।       

-- না, আমি তোমাকে চিনিনা। তুমি কে? চলে যাও তুমি ।  

অনেকটা অবজ্ঞা ও ধমক দিয়ে আমি এক নিমিষে ঘরের ভিতর চলে এসে দরজা বন্ধ করে দেই। ভিতর থেকে আবারও শব্দ শুনতে পাই।  আবারও দেখি বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। গুরুগম্ভীর করে মেঘ ডাকছে। কোথাও কোনো চাঁদের আলো নেই। একটু পর শুনতে গাই --  টিনটিন গুমরে গুমরে কাঁদছে। 

তখনও ঘরের চালে এক কোণে বাঁশের  ঘষঘষ শব্দ হচ্ছিল। ভাবলাম, 'টিনটিন কাঁদলে কাঁদুক। আমার কী?  ও আমার কে?' আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি এবং ঘুমিয়ে যাই। 

সকালে ঘুম ভেঙে দরজা খুলে দেখি -- উঠোনে বৃষ্টির জলের সাথে ছোপ ছোপ রক্ত ভাসছে। এবং  বারান্দায় দেখি -- টিনটিনের ফেলে যাওয়া ওর  রক্তমাখা ওড়না পড়ে আছে । 

আমি ঐদিনই দেরি না করে  তারানাথ তান্ত্রিক বইটি ছিঁড়ে কুটিকুটি করে  তুরাগ নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে আসি।                           

      

   

                                                                           

             
                                

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন