--- না যাসনে, চল পুকুর পাড়ে ঘাসের উপর কিছুক্ষণ বসে থাকি। বিশ্বাস কর শহীদুল, তোকে না পেলে আমি মনে হয় একদিনও এখানে থাকতে পারতাম না। কেমন দম বন্ধ হয়ে যাবার মতো শূন্যতা চারদিকে। সেই শূন্যতার মাঝে তুই আমার ছায়াসঙ্গী।
ওরা দুজন পুকুর পাড়ে খালি জায়গায় ঘাসের উপর যেয়ে বসে। রোহিত শহীদুলকে বলছিল -- একটা সিগারেট দে। ধরাই।
রোহিত আনমনা দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে স্বগোতক্তির মতো বিড়বিড় করে বলছিল -- একটি গ্রাম্য অর্বাচীন ছেলে। যে তার বুকের ভিতর রিমঝিম বৃষ্টি লুকিয়ে রাখত। প্রদীপের আলোর বাইরে যে অনির্বচনীয় জোৎস্না থাকে, তাও সে মুঠোর ভিতর পরম যত্নে ভরে রাখতে চেয়েছিল। সে বুঝতে পারত এ আলোর নীচে কোনও আঁধার নেই। খুব কাছে তারায় তারায় ভরা আকাশ। কত অফুরন্ত আলোর রোসনাই ঐ আকাশের গায় । ঐ আকাশ, ঐ আলো, এই পার্থিব জগত কেবলই মায়ার। এই মায়া থেকে কেউ নিজেকে আলাদা করতে পারে না। কেউ ছাড়তেও পারে না। এই মায়াগুলোই হচ্ছে ভালোবাসা ।
শহীদুল রোহিতের ঘারের উপর একটি হাত রেখে বলে--' তুই কী যেন আমার কাছে লুকাচ্ছিস, কী এক গোপন দুঃখ ব্যথা। আমি একসময় তোর জীবন জুড়ে ছিলাম। আজ মনে হচ্ছে - সেই থাকার মধ্যে অনেক ফাঁক ছিল। কোথায় কোন্ গোপন অন্তর কুঠিরে তোর সুখ দুঃখ বেদনার কথা লুকিয়ে রেখেছিলি। না হলে, কাউকে কিছু না বলে এইভাবে এই শিকড় ছেড়ে চলে যাস্? আজ এই সন্ধ্যার বিষণ্নতা বলে দিচ্ছে -- কী এক অমূল্য জিনিস হারিয়ে ফেলে , চির অভিমান করে তুই সব মায়া ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলি।
শহীদুল আরও বলছিল --
আমার কথা বাদ দে। তুই জানিস, মাসি মা তোর জন্য কত কেঁদেছে। সন্ধ্যায় পূজার ঘরে আলো জ্বালাতে গিয়ে আলো জ্বালাননি তিনি । ঠাকুরের পায়ে কপাল ঠেকিয়ে অন্ধকারে অশ্রুপাত করেছে। রোহিনী সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকত। পরিপাটি করে মাথার বেনী বাঁধতে না। ও ভুলে গিয়েছিল পায়ে নুপুর পরে উঠোনে হাঁটতে । স্কুলেও যেতে চাইত না ঠিকমতো।
--- কী বলব তোকে। শূন্য এই ভরা বুকের মাঝে কেউ আর নেই। তুইও তো আমার অন্তরতলা থেকে বেদনা জাগিয়ে দিয়ে কাঁদাচ্ছিস --
'আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সাঁঝে
আমার দিন ফুরালো
গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে
আমার দিন ফুরালো…'
গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে
আমার দিন ফুরালো…'
চোখের ভিতর অনেক জল ছপ ছৃপ করছে। কিন্তু সব জল স্থির করে রেখেছি। ঝরতে দেই না। কারোর জীবন দীপ নিভে গেছে, এমন কোনো আঁধার হওয়ার করুণ-সুধা রসের কথা তোকে আজ বলতে চাই না।
রাতভোর যদি বৃষ্টি হতো। দরজা জানালা খুলে বৃষ্টির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বৃষ্টির ছাটে ভিজে শীতল করতাম দেহখানি। কী যে ইচ্ছে করে বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ নিতে। যদি তুমুল ঝড় উঠত।
জানিস শহীদুল, কতকাল সাদা টগর ফুল স্পর্শ করিনি। উন্মুখ হয়ে থাকি রাধাচূড়ার তলে যেয়ে একটু হাঁটতে। মৌ মৌ গন্ধ ভাসত বাতাসে। কতদিন চলে গেছে -- ঐ হলুদ ফুলটার পাপড়ি ছুঁয়ে দেখিনি আমি। কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে মন।
'...কেউ দেখুক বা না দেখুক
আমি ঠিক টের পাই
অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও
আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।'
আমি ঠিক টের পাই
অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও
আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।'
--- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
--- দোহাই লাগে, তুই তোর এইসব কথা বন্ধ কর!
রোহিত শহীদুলকে বলে -- আরও একটা সিগারেট দে। এমন চুপ হয়ে আছিস কেন?
-- একটু মন ভালো করে দে। তোর নির্বাসিত প্রবাস জীবনের কোনো সুখ স্মৃতি যদি থাকে, সেই স্মৃতির কথা শোনা আমাকে।
-- ১৯৭০ সালে স্কলারশিপ নিয়ে প্রথম আমি বিলাতে যাই। থাকতাম উইনিভার্সিটির একটি হোস্টেলে। ওখানে যাওয়ার পরপরই শীতকাল শুরু হয়। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি কোনো এক সময় হবে। প্রচুর শীত পড়েছে। আমি তো শীতের তেমন কোনো কাপড় নিয়ে যাইনি। কাছে বাড়তি কোনো টাকাও ছিল না যে, তাই দিয়ে ভারী শীতের কাপড় কিনব।
একদিন সকাল বেলা জানালা খুলে দেখি -- বাইরে প্রচুর সাদা সাদা বরফ পড়ছে। আমি এতদিন শুধু তুষারপাতের কথা শুনেছি। কিন্তু তা স্বচক্ষে কোনোদিন দেখিনি । ঐ দিনই প্রথম তুষারপাত দেখি। মনটা ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। কয়দিন ধরে মনটা এমনই খারাপ লাগছিল। হোম কান্ট্রি সিক যাকে বলে। কিন্তু তুষারপাত দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। মন খুব টানছিল সারা শরীরে তুষার মাখাতে। আমি বোকার মতো একটা হালকা
টি-সার্ট ও প্যান্ট পরে তুষারে ভিজতে বাইরে বের হয়ে পড়ি।
পথে নেমে পা পা করে হাঁটতে থাকি। শিমুল তুলার মতো বরফ উড়ে উড়ে এসে আমার টি-সার্টের উপর পড়ছিল। প্রথম প্রথম নিজেকে খুব দুঃসাহসিক অভিযাত্রী মনে হলো । যেন -- 'আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।' কিন্তু পরক্ষণেই দেখি, হাত পা শরীর বরফে জমেি আসছে। কিন্তু দমে গেলাম না। আমি থাকতাম পশ্চিম লন্ডনের একটি এরিয়ায়। ওখান থেকে ক্যাস্টল বার পার্ক রেল স্টেশন বেশি দূরে নয়। আমি প্রায়ই ঐ রেলস্টেশনে যেয়ে বসে থাকতাম। খুব চমৎকার নিরিবিলি একটা স্টেশন। তুষারে ভিজতে ভিজতে আমি ঐ স্টেশনে চলে যাই। ততক্ষণে সারা শরীর হিম শীতল হয়ে গেছে । আমার মাথার চুল, ভ্রু, কান, কাপড়চোপড় বরফে ঢেকে যায়।
স্টেশনটা তখন ফাঁকা ছিল। মনুষ্য সমাগম তেমন ছিল না। একটা বেঞ্চে জড়োসড়ো হয়ে বসে কাঁপছিলাম খুব । পাশে দিয়ে যাচ্ছিল মধ্য বয়সী একজন আইরিশ মহিলা। সে মনে করেছিল আমি একটা আধা পাগল ছেলে। নইলে এমন করে তুষারে ভিজে কেউ? দয়াপরবশ হয়ে সেই মহিলা তার সুটকেস থেকে একটি বিগ সাইজের লেডিস কোট আমাকে বের করে দেয়, এবং বলে -- 'তুমি এটা পরো।' আমি কোটটি পরে নেই।
সে আরও বলে -- তোমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই?'
আমি বললাম -- না।
সে আমাকে কুড়ি পাউন্ড দিয়ে বলে -- তুমি ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি চলে যাও।' সে বিড়বিড় করে এও বলছিল, -- এমনও পাগল ছেলে হয় ? '
স্মৃতিকথা থামিয়ে দিয়ে রোহিত শহীদুলকে বলছিল -- কী মন ভালো করতে পেরেছি তোকে?
--- তুই তোর আসল কথা বলছিস না। এ সমস্ত গল্পকথা আমাকে বলে তোর জনম জনমের আসল দুঃখকে ঢেকে রাখতে পারবি না।
-- যে মানুষের জীবনে দুঃখ নেই, সে তো জীবনের স্বাদই পায় নাই। জীবনকে চিনতে হলে দুঃখের নদী সাঁতরাতে হয়। তবেই বোঝা যায়, জীবন কী? ব্যর্থতা, গ্লানি, খেদ, অপূর্ণতা, আফসোস, অশ্রুত কান্না, দীর্ঘশ্বাস, বিরহ, বিষাদ, উপেক্ষা, অবহেলা -- এই সবই জীবনের বোধ। আর এই বোধগুলোকে যে না চিনেছে, সে তো আর একজন ব্যর্থ মানুষ। সত্যি অর্থে সে জীবনই দেখেনি।
কথায় কথায় সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত হয়ে যায় অনেক।বেলীফুলের ঝাড় থেকে গন্ধে ভরে ওঠে সারা পুকুর পার। ঝিঁঝি ডাকছে। জোনাকিরা মিটি মিটি করে সবুজ আলো জ্বালিয়েছে ছিটকির বনে। রোহিত শহীদুলকে বলে -- 'আর একটা সিগারেট দে। খেয়ে ঘরে চলে যাই।'
যেদিন শেষ বারের মতো চলে যাব, সেদিন পথ
ডেকে বলবে , দাঁড়াও তুমি-- ধূলি মেখে যাও পায়ে।
শূন্য নীল আকাশ বলবে, এস তোমাকে নীলাদ্রি করে দেই। রাতের তারা মন্ডল বলবে --- কোথায় আর যাবে? তারা হয়ে জ্বলে থাকো আমাদের পাশে।
দখিনা সজল বাতাস দোলা দিয়ে বলবে -- তোমার আতর মাখা শরীরের গন্ধ ছুঁয়ে দাও।
ফুল বলবে, আজ তোমার জন্য ফুঁটেছিলাম, সুবাস নিয়ে যাও। পাখি বলবে -- যাবেই যখন আমার একটি পালক পরে নাও।
নদী বলবে, এস আর একবার, অবগাহন করো, পুণ্য হয়ে যাও।
নারী বলবে, প্রেম দিব তবু তুমি যেওনা।
খরতাপে চোখ পুড়ে তপ্ত মাঠ পেরিয়ে চলে যাব।
ধুনো ধূপের গন্ধ পাব আকুল করা আশ্বিন সন্ধ্যায়। হাঁটব যতক্ষণ না তারা ফুটে উঠবে আকাশে। চলব যতক্ষণ না আলো নিভে মেঠো পথে। অন্ধকারে যতক্ষণ না দেখতে পাব জোনাকিরা উঠছে, পড়ছে, জ্বলছে, নিভছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন