শনিবার, ১১ জুলাই, ২০২০

পরিচ্ছেদ ১২

ঘরে বসেই রোহিত ও শহীদুল গল্প গুজব করছিল। রোহিত শহীদুলকে বলে -- আমি আগামী পরশু দিনই চলে যাচ্ছি। তুই এই একদেড়দিন আমার সাথে সাথেই থাকবি। কাল মণিকাদের আসতে বলেছি। ওরাও চলে আসবে। কাল সন্ধ্যায়  তুইও চলে আসবি শেফালী ভাবীকে সাথে করে। রাতে তোদের  আমার  নিমন্ত্রণ। আমরা সবাই মিলে খাব, গান গাইব, আনন্দ করব।    

-- এত তাড়াতাড়ি চলে যাবি? খুব মন খারাপ লাগছে। এত বছর  হারিয়ে থেকেছিলি সেও একরূপ ছিল। তোকে ভুলেই গিয়েছিলাম।  কেনই এলি। এসে হৃদয়টাকে উসকে দিলি। তোকে কত বছর পর পেলাম। পেয়েও আবার হারাব। কেন জানি মনে হচ্ছে , বাকি যে স্বল্প জীবনটুকু আছে সেই জীবনে তোর আর দেখা পাব না। 
'একটা সিগারেট দে, খাই।' 

সিগারেট ধরিয়ে খেতে খেতে শহীদুল  বলতে থাকে, তোকে দেখার পর থেকে তোর উপর আমার কী যে  মায়া পড়ে গেছে। এত একাকী তুই ! মন বলছে,  তুই অনেক বড়ো কোনো বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছিস। 

আচ্ছা রোহিত, তুই বলত -- এই যে তুই ঢাকায় ছিলি দুই আড়াই বছর, তারপর বিদেশে কত দেশে দেশে গেলি, এবং থাকলি । তোকে পাবার জন্য কোনো মেয়েই কি ব্যাকুল হয়নি? দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে কেউ কি বলেনি --  'এস আলিঙ্গণে জড়িয়ে ধরো, সারা জীবন কালের জন্য তুমি  আমাকে চিরসঙ্গী করে নাও।'   

রোহিত শহীদুলের মুখপানে চেয়ে মনে মনে বলছিল -- ' কেউ তো একজন এসেছিল, কেউ তো একজন এক নিশীথে পরম ভালোবাসায় বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল ---  'আমাকে তুমি এখান থেকে লইয়া যাও। আমি তোমার ঘরে যাইব। জনম জনম ধরিয়া তোমার কাছে থাকিব।'

তাকে আর ঘরে আনা হয়নি । আর আমি হয়ে  গেলাম চিরকালের জন্য ঘরহীন। শুধুই আক্ষেপ, কেবলই দীর্ঘশ্বাস এখন। অন্তর কেঁদে কেদে বলি -  
'দুঃখসুখের দোলে এসো,  প্রাণের হিল্লোলে এসো।ছিলে আশার অরূপ বাণী ফাগুনবাতাসে বনের  আকুল নিশ্বাসে-- এবার ফুলের প্রফুল্ল রূপ এসো বুকের 'পরে।' 
কিন্তু সে আর ঘরে এল না। বেদনায় শোকে দুঃখে এবং অভিমানে সে এখন দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে।       

রোহিত বলছিল -- শহীদুল চল, আমরা দুজন একটি রিক্সা নিয়ে  ইছামতী নদীর তীরে যাই। পুরো সন্ধ্যা ওখানে নদীর কূলে সবুজ ঘাসের উপর বসে কাটিয়ে দেই। হেমন্তের ঝিরিঝিরি বাতাসে দোল খেয়ে রাত্রি নামবে। রাত্রির নিরবতায় তোকে আমি একটি ছোট্ট গল্প শোনাব।  

দুই বন্ধু নদীর কূলে একটি পাকুড় গাছের তলে  যেয়ে বসে । অদূরে ইছামতী বয়ে চলেছে। যদিও এই হেমন্তে নদীর জলের ধারা তীব্র নয়। অনেকটাই শান্ত, এবং শীর্ণ এই নদী।

জীবনে  কিছু কঠিন গোপন কথা থাকে, তা কাউকে না কাউকে স্বাক্ষী করে বলে যেতে হয়। কারোর কাছে প্রতিশ্রুতি দেওয়া থাকলেও ভঙ্গ করে হলেও তা বলতে হয়। রোহিত শহীদুলকে এখানে এই নদীর কূলে এনে রেবেকার সাথে তার সম্পর্কের কিছু  কথা বলতে চেয়েছিল। কতটুকু সম্পর্ক ছিল তার সাথে । কী ঘটেছিল তাদের জীবনে, সব কথা। কিন্তু কী এক দ্বিধায় তা বলতে পারল না। একজন মৃত মানুষের সব কথা বলা কী ঠিক?   

আর এইভাবে মুখোমুখি অনেক সত্য কথা তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল -- রেবেকা আর তার ভিতরকার না বলা কিছু কথা শহীদুলকে কাগজে লিখে যাবার বেলায়  বলে দিয়ে  যাবে। 

রোহিত সত্যি সত্যি তার মত পরিবর্তন করে ফেলল।  সে শহীদুলকে নদীর কূলে  সেই সন্ধ্যা রাতে  শোনাল অন্য গল্প কথা ---    

'তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। আমার সহপাঠিনী ছিল দীপান্বিতা। ও প্রেম করে বিয়ে করেছিল তাদেরই পাড়ার নীলেশকে। নীলেশদের সোয়ারি ঘাটে পাইকারি মাছের আড়ত ছিল। পড়াশোনা করেছিল সে অস্টম ক্লাস পর্যন্ত। কাড়ি কাড়ি টাকা ছিল নীলেশদের।  কিন্তু  টাকা থাকলে কি হবে, নীলেশরা ছিল একটু গোয়ার গোবিন্দ ও গারোল টাইপের।

একদিন দেখি, দীপান্বিতা ক্লাশে আসেনি। পরের দিনও সে এল না। তারপরের দিনও না। এবং তারপরে কোনদিন আর দীপান্বিতা ক্লাসে আসেনি।

নীলেশ শরীর চিনত দীপান্বিতার। এক রাত্রে দীপান্বিতার ভিতর জৈবিক ভালোবাসার চাহিদা নাকি আদৌ  ছিল না। কিন্তু নীলেশের ছিল গোয়ার্তুমি। নীলেশ তাকে বলাৎকার করেছিল।
ফলে দীপান্বিতার পেটে  সন্তান আসে নেহাতই জৈবিক নিয়মে।  কি নিষ্করুণ সৃষ্টির এই রুঢ় নিয়ম। যা আসতে দিতে চায়নি তাই আসে জীবনে। 

দীপান্বিতার জন্য  মন খারাপ লাগত। ক্লাসে এত গুলো মুখের মাঝে দীপান্বিতার মুখটি আর দেখতে পেতাম না। কিছু ভালোলাগা,  কিছু অন্তর নিসৃত টান আমাকে বিষণ্ণ করে রাখত। দীপান্বিতা আমার কেউ ছিল না। কিন্ত ওর জন্য আমার প্রাণ 
কাঁদত। 

আমি পুরানো ঢাকার বাকরখানি খেতে খুব পছন্দ করতাম। দীপান্বিতা প্রতিদিন আমার জন্য বাকরখানি নিয়ে আসত ওর ব্যাগে করে । এইগুলি খেয়েই প্রায়ই কাটিয়ে দিতাম বিকাল পর্যন্ত। যদি কোনো দিন বেশি খিদে লাগত, তাহলে শহীদুল্লাহ হলের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেয়ে , চাঁনখারপুল পার হয়ে হাজির দোকান থেকে পাতায় মোড়ান বিরিয়ানি কিনে এনে দুজন খেতাম। 

যেদিন আমার পকেটে টাকা থাকত না সেদিন আগেই আমার মুখ দেখে বুঝতে পারত দীপান্বিতা। ক্লাস শেষে সন্ধ্যায় ও যখন বাড়ি চলে যেত, তখন ভ্যানেইটি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে আমার বুক পকেটে দিয়ে বলত, চাকুরি পেলে -- পরে এ টাকা আমায় শোধ করে দেবে। এখন শুধু হিসাবটা ডাইরিতে লিখে রাখবে। 

প্রায়ই দীপান্বিতা মন খারাপ করে ক্লাসে আসত। সবাইকে হাসি খুশি মুখ দেখাবার চেষ্টা করত। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম, ওর অন্তরের গভীর বেদনার কথা। আমি জানতে চাইতাম, কিন্তু কোনো কথা বলত না দীপান্বিতা। কান্না এবং দীর্ঘশ্বাস দুটোই বুকের গভীরে আড়াল করে রাখত সে। মাঝে মাঝে উদাস কোনো রাত্রি বেলা একাকী শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, জগতে এত মেয়ে থাকতে কেন এই অন্তর দুঃখী মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় হলো। 

একদিন এক মেঘলা দিনের অসতর্ক মুহূর্তের কথা। কার্জন হলের সামনে সবুজ ঘাসের উপর দুজন বসেছিলাম। চুপচাপ আছি দুইজনই, কারও মুখে কোনো কথা নেই।  হঠাৎ দীপান্বিতা আমার হাত টেনে নিয়ে আঙুল ছুঁয়ে বলেছিল -- 'তুমি তোমার এই অঙুলি দিয়ে আমার সিঁথির সিঁদুর সব মুছিয়ে দাও।' সেদিন কোনো সিঁদুর মোছা হয়নি। ঝমঝম করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল।  

যেদিন ওর সাথে আমার শেষ দেখা হলো, সেদিন বুঝতে পারিনি এইটি হবে ওর সাথে আমার শেষ দেখা। আমরা বসেছিলাম, লাইব্রেরী বারান্দায়। আমাকে দীপান্বিতা বলেছিল -- 'কে যেন আমার চলাফেরা গতিবিধি অনুসরণ করে। এক অজানা আশংকা আমার মধ্যে। যদি আর তোমার সাথে আর কোনো দিন দেখা না হয়। '

আমার শিক্ষা বর্ষের বাকি সময়গুলোতে আর কোনো বন্ধু করিনি কাউকে। প্রতিদিন ক্লাশে আসতাম। পিছনের ব্রেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকতাম। দুপুরে প্রায় দিনই খাওয়া হতো না আমার । খেতে ইচ্ছাও করত না। ক্লাস শেষে একাকী শহীদ মিনারের সোপানের উপরে বসে থাকতাম। বসন্তদিনে ইউক্যালিপটাসের পাতা ঝরে পড়ত। পথের ধূলো উড়ত বসন্ত বাতাসে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের চেনা পথ দিয়ে তারপরেও প্রায় দুই বছর চলেছি। কোথাও কোনো দিন আর দীপান্বিতার দেখা পাইনি। কার্জন হলের সামনে সবুজ লনের ঘাস, বাংলা একাডেমির বৃক্ষছায়া তল, কিংবা খাজা নাজিমউদ্দিনের মাজার প্রাঙ্গণের সোপান, সেখানকার বৃক্ষরাজি কেউই বলতে পারেনি, দীপান্বিতা এখানে আর এসেছিল কি না?  

প্রার্থনার দিনগুলোতে প্রায় সন্ধ্যায় চলে যেতাম ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। শঙ্খ ধ্বনি বাজত সেখানে । আরতি হতো পূজার। কোনো দিন কোনো পূজার স্থলে দীপান্বিতার দেখা পাইনি।  ধূপের গন্ধ বিষাদের ধূয়া হয়ে মন্দিরে মিলিয়ে গেছে। সকল পূজা শেষ হয়ে গেছে। আরতি থেমে গেছে। কিন্তু দেবীর দেখা আর মেলেনি। 

শিক্ষা জীবন শেষ হয় একসময়। বৃটিশ সরকারের স্কলার্শিপের চিঠি আমার হাতে আসে । হঠাৎই      বঙ্কিমের 'আনন্দ মঠ' বইটি নতুন করে আবার পড়বার ইচ্ছা হয় । কিন্তু  'আনন্দ মঠ ' কোথাও খুঁজে না পেয়ে নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকানে বইটি খুঁজতে যাই । বইটি  পেলামও সেখানে। 

বইটি কার ছিল জানি না। বইটি কিনে বাসায় এসে আনন্দ মঠের পাতা উল্টায়ে দেখছিলাম। প্রথম সাদা পাতাটি ছিল আংশিক ছেঁড়া। কোনো কিছু লেখা ছিল না তাতে। বইয়ের শেষ সাদা পাতার প্রথম পৃষ্ঠায় আবছা নীল কালিতে লেখা ছিল -- 

' বুড়িগঙ্গার ধারে নির্জন শ্মশান ঘাট থেকে
লাশ পোড়ানোর গন্ধ আসছে, 
কার হৃদয় পুড়ছে ওখানে দাউ দাউ করে
বাতাস ভারী হয় কার ক্রন্দনে --
কে চলে গেল কাকে শূন্ঢ় করে দূরের পরপারে। '

আনন্দ মঠের শেষ সাদা পাতার অপর পৃষ্ঠায় লেখা ছিল --

'সময়ের ব্যবধানে হার মেনেছি সময়ের সাথে
আজো বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে নিঝুম রাতে
মন খারাপের তো কয়েক হাজার কারণ থাকে
সত্যিই কেন যে দেখা হয়েছিল তোমার সাথে। '
                           ----------  দীপান্বিতা সেন।

প্রথম চরণগুলো উৎসর্গ করা ছিল স্বর্গীয় শ্রী নীলেশ সেনকে, আর দ্বিতীয় চরণগুলো উৎসর্গ করা ছিলো আমাকে।'

------  -------  ------   -------
     
শহীদুল বলছিল -- নদীর কূলে এই সন্ধ্যায় তুই একটি আনন্দময় স্মৃতির কথা শোনা আমাকে। এত দুঃখের কথা আর সইতে পারি না। 
                                                                          রোহিত বলছিল -- তবে শোন্ আনন্দময় এক সন্ধ্যারাত্রির কথা ---
আরিজোনা ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার

একবার দক্ষিণ আরিজোনার টুসন শহরে যাত্রা বিরতি করেছিলাম। হোটেল থেকেই জানতে পারি সোনারন নামে একটি  মরুভুমিতে নাকি  থোকা থোকা কমলা রঙের ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফুটে থাকে। আরও আছে  বালিয়াড়িতে প্রান্তরের পর প্রান্তরে  ক্যাকটাসের ঝাড়। হাতে সময় নেই। পরের দিনই চলে যাব লাসভেগাস। আমার খুব দেখতে সাধ হলো মরুভুমিতে ফুটে থাকা ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার আর ক্যাকটাসের ঝাড় । হোটেলের ইনফরমেশন সেন্টার থেকে সোনারন যাওয়ার সব তথ্য জেনে নিলাম। ওরা আমার সাথে  একজন গাইড নিয়ে যাবার  পরামর্শ দিল এবং একজন গাইডের ব্যবস্থা করেও দেয় আমাকে।

গাইড মেয়েটির নাম -- নিকিতা জুলি। আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্রী। জুয়োলজীতে পড়াশোনা করে।  মেয়েটি ল্যাটিনা। ভেনেজুয়েলা থেকে এসেছে। ভারতীয় মেয়েদের মতো কালোকেশী।  অসম্ভব সুন্দরী, নদীর মতো দেহবল্লরী তার। চমৎকার ইংরেজিতে কথা বলে। ইউনিভার্সিটি ভ্যাকেশন সময়ে সে পার্টটাইম জব হিসেবে টুসন শহরে আগত পর্যটকদের গাইড হিসাবে কাজ করে।  

সকাল দশটার দিকে একটি পর্যটন মাইক্রোবাসে করে সোনারন মরুভূমির উদ্দেশ্য রওনা হই। আমাদের সাথে ছিল আরও ছয়জন নারী পুরুষ। তারাও যাবে সোনারন দেখতে।   

আমি আর নিকিতা সামনের সিটে বসে আছি। চলতে চলতে মাইক্রোবাসটি শহর ছেড়ে একসময় মরুভূমিতে যেয়ে পড়ে। চারিদিকে  ধু-ধু বালুকাময় প্রান্তর। কিন্তু এখানকার বালি অনেকটা ঊষর। জায়গায় জায়গায় পাথুরে মাটিও দেখতে পাই। নিকিতা আমাকে বলছিল, এই একমাত্র মরুভূমি তুমি একটু পর দেখতে পাবে ছোট্ট ছোট্ট টিলা। এবং পাহাড়। 

মাইক্রোবাসের অন্য সঙ্গীরা যে যার মতো আনন্দ করছে, স্ফূর্তি করছে, হুল্লোড় করছে, বিয়ার খাচ্ছে, গান গাইছে। নিকিতা আমাকে বলছিল --' তুমি কী কিছু খাবে?'  বললাম 'দাও।' 
'কী দিব?' 
'আনারসের জুস'। 
নিকিতা একটু বিস্মিত হলো! 

কী অপূর্ব দৃশ্য অপেক্ষা করছিল!  মরুভূমির বালি ফুঁড়ে সবুজ ঘাস !  অপেক্ষা করছিল আরও বিস্ময় !  রাস্তার দুপাশে ক্যাকটাসের জঙ্গল।  জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে কমলা রঙের অজস্র ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফুটে আছে। সুন্দর আবহাওয়া, বেশ মোলায়েম । না শীত, না গরম।  নিকিতার দিকে চেয়ে দেখি-- এখন যে তার গানের সময়। স্প্যানিস ভাষায় সে গুণ গুণ করে গান গাইছে।  আমি ওকে বলেছিলাম, তুমি যে গানটি গাইলে তা ইংরেজিতে একটু ট্রানস্লেট করে কথাগুলো বলো না ! ও বলছিল ---
'How it is to be with you
From the first day I saw your face
I knew this love was true…'

প্রান্তরের পর প্রান্তর মাইলের পর মাইল পথ  ছাড়িয়ে যাওয়ার পর একটা বাড়ি চোখে পড়ে।  আসলে এটি একটি গেস্ট হাউজ। পরে দেখলাম,  এই রকম গেস্ট হাউজ একটি নয়, বেশ কয়েকটি আছে। নিকিতা বলছিল -- 'এইটিই সোনারন ডেজার্ট।' যে সমস্ত পর্যটকরা এখানে এসে রাত্রিযাপন করতে চায়, তারা এই গেস্ট হাউজ গুলোতে ওঠে।  এখানে রেস্টুরেন্ট ও বার আছে। আছে মিউজিক ক্যাফে ও স্পোর্টস কাফেও।' একটি মিউজিয়ামও দেখলাম। আমি আর নিকিতা একটি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে নেই। তখন বিকেল হয়ে যায় ।   

এখান থেকে অদূরে ছোট বড়ো পাহাড় দেখতে পেলাম।  তারও আরো দূরে সানফ্রান্সিসকো পর্বতমালা। এখানে আগত নারী পুরুষ ও ছেলেমেয়েদের প্রধান আনন্দময় জায়গা হচ্ছে এই পাহাড়ের পাদদেশ।   

নিকিতা আমাকে বলছিল -- ' তুমি কী ঐ পাহাড়ের পাদদেশে যাবে?'  আমি বললাম,  যাব।  হেঁটে হেঁটে দুজন  যাচ্ছিলাম পাহাড়ের দিকে ক্যাকটাস আর ওয়াইল্ডফ্লাওয়ারের ঝাড়ের ভিতর দিয়ে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছিল।  ছায়া ছায়া ময় মনোরম পরিবেশ। সবুজ গালিচার মতন ঘাসে পাথর ঢাকা। কত নারী পুরুষ আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে  নিজেকে সপে দিচ্ছে পাহাড়কে সাক্ষী রেখে। অনেক ছেলেমেয়ে এখানে এসে প্রপোজ করে ভালোবাসার। ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার হাতে দিয়ে বলে -  I love you, I marry to you.  
          
কয়েকজোড়া ছেলেমেয়েকে দেখলাম --  প্রপোজ শেষে হাত ধরে জড়িয়ে হেঁটে হেঁটে আরও দূর পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি নিকিতাকে বলি -- ওরা কোথায় যাচ্ছে?  
নিকিতা বলছিল --  'ওরা মরুভুমি ভালোবাসে, ওরা পাহাড় ভালোবাসে।  আজ রাতটা এখানেই কাটাবে ওরা। খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকবে। পৃথিবীটাই ওদের বিছানা।'

তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছিল। দেখলাম প্রচন্ড একটি চাঁদ উঠেছে আকাশে। জ্যেৎস্নায় ভাসছে প্রান্তর। ভাবছিলাম, কী নির্জনে মধুযামিনী না হবে ওদের ! চাঁদের নিচে  ঘাসের শয্যা। 

নিকিতা বলছিল -- 'যাবে না তুমি?' বলেছিলাম -- যেতে ইচ্ছে করছে না যে ! 


                        
                             

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন