সোমবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৮

রাজকুমারীর গল্প

১৫.   এক রাজকুমারীর গল্প

রাজকুমারীর প্রথম ভাললাগা আমাকেই লেগেছিল।  আমিই ছিলাম তার প্রথম ভালবাসার মানুষ। সে ছিল তখন বালিকা থেকে তরুণী পর্যায়ের একটি মেয়ে। ভালবাসা কী বুঝত না ঠিকমতো। স্বপ্ন দেখত না অন্য কাউকে। বুঝতোনা সংসার গড়তে হয় কিভাবে? তারপরও আমি তাকে প্রেম দিয়েছিলাম। যা কোনো বিষয় সম্পত্তির মতো করে দেইনি। দিয়েছিলাম অপার্থিব আলোর মতো করে। মন থেকে মননে তা ছড়িয়ে দিয়েছিলাম।

রাজকুমারীকে আমার পাওয়া হলনা।  বিয়ে হয়ে গেল অন্যত্র । স্বামীর ঘরে যেয়ে সে প্রেমের আলো ছড়ালো। যেন ত্রিভূবন আলোকিত হয়ে গেল, আমারই দেওয়া প্রেম রশ্মিতে। সংসার বাঁধল রাজকুমারী। সন্তান, ধন দৌলত সব পেল সে।

তারপর কত বছর চলে গেছে। কত বসন্ত হয়েছে পলাশ শিমুলে রঙ্গিন। কত পূর্ণিমা আলো ছড়িয়েছে কত অন্ধকার রাত্রিতে। দিনগুলি কেটেছে আমার কেবলই প্রেমহীন একাকীত্বে।  নিজ হাতে কখনও জ্বালাতে মন চায়নি ঘরে সন্ধ্যা বাতি। ভাবতাম, এমনি এক আঁধার রাত্রিতে আলো জ্বেলে রাজকুমারী হয়ত আসবে একদিন। কিন্তু আসেনি। 

অনেক বছর হলো রাজকুমারীর দেখা নেই। সে জানেও না আমি কেমন আছি। আজ তার ফেসবুকের ওয়ালে একটি লেখা দেখতে পেলাম। গল্পের মতো করে লিখেছে সে। মনে হলো যেন তারই কথা।  এখানে অংশ বিশেষ  উল্লেখ করছি।

" তুমি আমাকে যে ভালবাসা দিয়েছিলে সেই ভালবাসা দিয়েই ভালবাসলাম আমার স্বামীকে। কী ভাবে প্রিয়তর  করতে হয় তা তুমিই আমাকে শিখিয়েছিলে। আমি ঠিক সেইভাবেই তাকে প্রিয়তর করলাম। তুমি একদিন বলেছিলে, প্রেম কোনো বিষয় সম্পত্তি নয়, যে কাউকে বস্তুর মতো করে দান করা  যাবে। কিন্তু তোমার দেওয়া সেই প্রেম বস্তুর মতো করেই আমি আমার স্বামীকে দান করে যাচ্ছি । "

------------------------------------------------------------------------
ডিসক্লেইমার :  এটি আমার নিজের জীবনের ঘটনা নয়। সম্পূর্ণ কাল্পনিক।


১৬.   কনিকা

তখন কলেজে পড়ি। ঢাকা থেকে একবার ট্রেনে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে যাচ্ছিলাম। আমি বসেছিলাম সামনের মুখো সিটে জানালার পাশে। ট্রেনের ভিতর থেকে শ্রীপুর, রাজেন্দ্রপুর, ধীরাশ্রম, নুরেরচালা জায়গাগুলো দেখতে দেখতে যেতে ভালই লাগছিল আমার । বিশেষ করে ঘন শালবন যখন পার হচ্ছিলাম, তখন মনটা কেমন যেন প্রেমময় হয়ে উঠেছিল। গভীর অরণ্য দেখে মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, মানুষ বিয়ে করে হানিমুনের জন্য কক্সবাজার যায়। আমি আর কক্সবাজার যাবনা। আমি আসব নতুন বউ নিয়ে এই শালবনে।

ট্রেনটি ময়মনসিংহ জংশনে এসে পৌঁছলে, দেখি কম্পার্টমেন্ট অর্ধেক খালি হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবলাম, ময়মনসিংহের এই মানুষগুলোর জন্য কমলাপুরে সিট পেতে কতই না অসুবিধা হয়েছিল। এখন দেখছি সব খালি। আবার দেখি, এই খালি সিটগুলোতে মুহূর্তেই লোক উঠে ভরে গেল, অনেকটা সেই কমলাপুর স্টেশনের ভীড়ের মতই। আসলে ময়মনসিংহের মানুষ ট্রেন ছাড়া কিছু বুঝতনা।

এই ময়মনসিংহ থেকে একটি পরিবার ওঠে আমার কম্পার্টমেন্টে। ঠিক আমার সামনের সিটে তারা আসন নেয়। তারা ছিল স্বামী স্ত্রী সাথে ষোল সতের বছরের একটি মেয়ে ও পাঁচ ছয় বছরের একটি ছেলে। মেয়েটি যখন সিটে এসে বসে তখন আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি কিন্তু সে আমার দিকে তাকাচ্ছিলনা। আমি আমার দৃষ্টি বেশ কিছুক্ষণ মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে রাখি। ভাবি,  মেয়েটি অন্তত একটিবার সরাসরি আমাকে তাকিয়ে দেখুক। কিন্তু নাহ্, মেয়েটি আমার দিকে একবারও তাকালনা। আমি অনেকটা মন খারাপ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।

ট্রেন চলছিল ঝিকঝিক করে । আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম,  গ্রামের পর গ্রাম, খাল, নদী,বিল, সাঁকো, মানুষ, বক, পাখি, জেলে, নৌকা আরও কত দৃশ্য। এসব দেখতে খুব ভাল লাগছিল আমার। আমি আর ঐ মেয়ের দিকে একটিবারও তাকালাম না। ওর প্রতি একটু রাগ হয়েছিলাম, মনে মনে বলছিলাম --- ' মেয়ে! তুমি একটিবার আমাকে তাকিয়ে দেখলেনা। তুমি বুঝতে পারলেনা, আমার এই চোখে তোমাকে দেখে কী যে ভাল লেগেছিল। তুমি জানলেনা,  বৃক্ষের ছায়ায় ছায়ায়, মেঘে মেঘে, রোদ্রে পুড়ে পুড়ে আমার এই চোখ তোমাকেই দেখছে বারবার।'

আমার অন্তর চোখ দেখতে পাচ্ছিল, মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ক্ষণে ক্ষণেই । ওর ছোট ভাই যখন জানালার ধারে যেয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল, তখন সে ওর ভাইকে ডেকে বলেছে -- 'বাইরে কি দেখছ? আসো এখানে। আমার কাছে থাক। দেখ আমাকে। ' আমার কাছে মনে হয়েছিল, এ যেন পরোক্ষ ভাবে আমাকেই আমন্ত্রণ করছে। বসতে বলছে তার পাশে। তাকিয়ে দেখতে বলছে তাকে। তারপরেও আমার ভিতরে কি এক অবাস্তব জেদ হয়েছিল যে, মেয়েটিকে আমি আর তাকিয়ে দেখলামই না।

জামালপুর জংশনে ঐ মেয়ে এবং ওর পরিবারের লোকজন নেমে চলে যায়। আমি ওদের নেমে যাওয়াটুকুও তাকিয়ে দেখলাম না। ওদের আলাপচারিতায় জানতে পেরেছিলাম, মেয়েটির নাম কনিকা। ময়মনসিংহ মমিমুন্নেসা গার্লস কলেজে ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। যাই হোক, আমার ট্রেনটি জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের দিকে ঝিকঝিক করে চলতে থাকে। আমি এবারও বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম --- গ্রাম, খাল, নদী,বিল, সাঁকো, মানুষ, বক, পাখি, জেলে, নৌকা আরও কত দৃশ্য। কেন জানি এসব দেখতে আমার ভাল লাগছিলনা। সবকিছুই কেমন যেন বিষাদের মনে হচ্ছিল।

বিকেলের রোদ্র ছায়ায়, আর মেঘের নীচে নীচে, আমার এই চোখ কনিকার সৌন্দর্যমাখা মায়াবী মুখটিকেই খুঁজে দেখছিল বারবার।


১৭.   ছোট মাস্টারজি

ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর আমি আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারি নাই। সংসারে অভাব অনটন ছিল। তাই দায় হল আমারই পরিবারের জন্য কিছু করার। চাকুরির জন্য ঢেষ্টা করতে থাকি। এবং চাকুরি একটা হয়েও যায় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের। আমার বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় হলেও আমার পোস্টিং দেওয়া হয় দূর্গাপুরের এক পাহাড়ি জনপদে।

রোড টু রানীখং :

সকাল এগারটায় জারিয়া এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছাড়ে ময়মনসিংহ জংশন থেকে। ট্রেনটি যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হচ্ছিল, জানালা খুলে দেখছিলাম দূরের জলরাশি। ভাবছিলাম, গরীবের ঘরে জন্ম হলেও স্বপ্ন ছিল অনেক বড় হবার। কিন্তু তা আর হতে পারলাম না। লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে হতে হলো আমাকে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। মনে মনে আবার ভালও লাগছিল এই ভেবে যে, ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা আমাকে স্যার ডাকবে, মন্দ কী? 

ট্রেনটি জারিয়াতে এসে পৌঁছে দুপুরে। স্টেশনে নেমে টমটমে করে দূর্গাপুর চলে আসি। প্রথমে থানা শিক্ষা অফিসে রিপোর্ট করে তারপর রিক্সায় করে চলে যাই সোমেশ্বরী নদীর তীরে। নৌকায় সোমেশ্বরী পাড় হয়ে পায়ে পায়ে হেটে পৌঁছে যাই রানীখং গ্রামে। এই গ্রামেরই স্কুলে আমি যোগদান করি।

স্কুলের হেড মাস্টারজি আমাকে স্কুল আঙিনার পিছনে একটি পুরোন ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। ওখানে একটি রুমে স্কুলের দফতরি বিশু দিব্রাও থাকে। বিশু থাকাতে আমার বেশ সুবিধাই হলো। রান্না বান্নার আর কোনো চিন্তা করতে হলনা। ওখানে কোনো চোকি ছিলনা। প্রথম দিন আমি হোগলার পাতার মাদুরে কাঁথা বিছিয়ে ঘুমাই। পরের দিন স্থানীয় হাট থেকে একটি চোকি, একটি টেবিল ও একটি চেয়ার কিনে নিয়ে আসি।

প্রথম দিন আমার প্রথম ক্লাস ছিল শিশু শ্রেণীর। ক্লাশে পনের জনের মত ছাত্র ছাত্রী ছিল। বেশির ভাগই গারো উপজাতীয়। দুচারজন ছিল বাঙালি। সবার হাতে একটি করে শিশু শিক্ষা বই। আমার জীবনের প্রথম ক্লাস। কেমন যেন আবেগে ভরে উঠছিল মন। এই ছোট ছোট শিশুদের কাছে আমি কেমন যেন নার্ভাস ফিল করছিলাম। মনে হচ্ছিল এরাও এক একজন বিজ্ঞ পন্ডিত । কোথায় কোন্ ভুল ধরে বসে না জানি আমাকে।

প্রথম থেকেই ভাল লাগছিল এই রানীখং। প্রকৃতির এক অপরুপ লীলাভূমি যেন। এর পূর্ব পার্শ্ব দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা পাহাড়ী নদী সোমেশ্বরী। এই নদীর স্বচ্ছ জলধারার নিচ দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় সিলিকন বালিকণা। নজর কেড়ে নেয় বালিকণার নিচ থেকে আদিবাসী নারী-পুরুষদের পাহাড়ি কয়লা এবং কাঠ সংগ্রহের দৃশ্য। ওপরের নীল আকাশও খুব কাছাকাছি। এখানেই সুউচ্চ টিলায় রয়েছে ক্যাথলিক মিশন। এর উত্তর পাশে চোখ মেললে হাতছানি দেয় ভারত সীমান্তে অবস্থিত মেঘালয়ের সুউচ্চ পাহাড় সারি।

প্রায় দিনই বিকেল বেলা কোথাও না কোথাও ঘুরতে বের হতাম। কখনও একাকী কখনও বিশু দিব্রাকে সাথে নিয়ে নিতাম। সোমেশ্বরীর নির্জন তীরে কখনও একাকী বসে থাকতাম। আবার কোনো কোনো দিন বিশুকে নিয়ে   যেতাম সিলিকন বালি উত্তোলনের দৃশ্য দেখবার জন্য। বিশু আমার মতোই বাইশ তেইশ বয়সের তরুণ। ওর বাড়ি এখান থেকে বেশি দূরে নয়। মাইল খানেক দূরে পাহাড় অার অরণ্যের ফাঁকে এক টিলার উপরে।
সোমেশ্বরীর তীরে বসে একদিন বিশুকে বলছিলাম ---
' তুমি তো বাড়িতেই থাকতে পারো। এই স্কুলের পাশে এই ঘরে থাকো কেন? '
বিশু :  'এই স্কুলের প্রতি আমার খুব মহব্বত হয় যে। আমার বাবাও এই স্কুলের দফতরী ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক আর্মিরা আমার বাবাকে মেরে ফেলে এই স্কুল প্রাঙ্গণে। সেও থাকত এই পুরনো ঘরটিতে। যেখানে আমি থাকি। বাবার কাজগুলোই আমি করি। স্কুল প্রাঙ্গণ পরিচ্ছন্ন রাখি। ক্লাস শুরুর ঘন্টা বাজাই। ঘন্টা বাজাই ছুটির। রাতে পাহারা দেই । গভীর রাতে উঠে একাকী স্কুলের বারান্দা দিয়ে হাটি।'

আমি :  আমি খুব ব্যাথিত হলাম বিশু। তুমি খুব ভাল ছেলে। তোমার বাবা মুক্তি যুদ্ধে একজন শহীদ। তিনি  এদেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।  তাকে আমি স্যালুট দেই।

একদিন ছুটির দিনে বিশুকে আমি বলি, তোমার মাকে আমার খুব প্রণাম করতে ইচ্ছা করছে। তোমাদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবে? বিশু বলে --- 'অবশ্যই যাবেন। তবে মা আজ বিকেলে গীর্জায় আসবে প্রার্থনা করতে। আপনি গীর্জায় যেয়ে দেখা করতে পারেন। আমিও আজ গীর্জায় যাব। '
আমি বললাম, ' আমিও যাব গীর্জায়।

রানীখং গির্জায় এমনিতেই আমার  যাবার ইচ্ছা ছিল। আমি আজ বিশুর সাথেু চলে যাই গীর্জায়।  দক্ষিণ দিকে গির্জার দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বার। ঢুকে এর বাম পাশেই শত বছরের প্রাচীন এই ক্যাথলিক গীর্জা। আমি বিশুর সাথে গীর্জায় প্রবেশ করি। দেখি যীশু মূর্তিকে সামনে রেখে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষেরা প্রার্থনা করছে। আমরা দুজনে সেই প্রার্থনায় যোগ দেই।

প্রার্থনা শেষে গির্জা থেকে যখন বের হয়ে আসি, তখনই গির্জা প্রাঙ্গণে চল্লিশোর্ধ্ব একজন  রমনীর সাথে বিশু আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। বিশু বলে --- 'ইনিই আমার মা।' আমি চেয়ে দেখলাম --- পরনে তার মলিন পোশাক। খালি পায়ে। মুখ তার রোগ ক্লীষ্ট। পরিপাটিহীন মাথার চুল। চোখে নেই কোনো হাসি। মনে হলো হাজার জনমের বিষন্নতা মুখে ছেয়ে আছে। তবুও তাকে দেখে একজন  মহিয়সী মায়ের মতো মনে হলো। আমি তার পা ছুঁয়ে প্রনাম করি। আমাকে দেখে তিনি থমকে দাঁড়িয়েছিল গির্জার সোপানে। বিশু ওর মাকে বলেছিল --- 'ইনি আমাদের স্কুলের ছোট মাস্টারজি। ওনার নাম সুনীল কুমার রায়। '

আমি দিনে দিনে বিশুর প্রতি আরও গভীর ভালবাসায় বাঁধা পড়ে যাই। ও আমার আপন কেউ নয়, কিন্তু ওর জন্যে আমার প্রাণ কাঁদে । এই নির্জন পাহাড়ি উপত্যকায় বিশুই আমার সকল সময়ের সঙ্গী হয়ে যায়। ও আমাদের স্কুলের একজন সামান্য দফতরী হলেও ওকে আমি আমার অন্তরে ঠাঁই করে নেই বন্ধুর মতো।

একদিন বিশু বলছিল ওর মা নাকি খুব অসুস্থ। দেখতে যাবে বাড়িতে। আমি ওকে বললাম, আমিও যাব তোমার মাকে দেখতে। টিলা আর অরণ্যের পথ ধরে  হাটতে হাটতে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ওদের বাড়িতে চলে যাই । পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট একটি কাঠের বাড়ি। চারিদিকে খোলা উঠোন। দূরে আরো ছোট বড় পাহাড় ও টিলা আছে । দূরে পাহাড়ের কোল থেকে ঝরনার জল ঝরে পড়ছে। ৰাড়িটির উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সোমেশ্বরী নদী। এমনি এক নৈসর্গিক পরিবেশে ধীতাং ধীতাং করে হেটে আসছিল সোমেশ্বরী নদীর কুল থেকে জল নিয়ে একটি পাহাড়ি মেয়ে। বাড়িতে যখন প্রবেশ করি, তখনই ঐ মেয়ের সাথে দেখা হয়। বিশু বলছিল, ও আমার ছোট বোন জরী দিব্রা।

জরী দিব্রাকে সেদিন শুধু দেখেই এসেছিলাম। ওর সাথে আমার কোনো কথা হয়নি। কিন্তু পাহাড় আর অরণ্যের সেই নির্জনতায় ওকে একদম প্রকৃতি কন্যার মতো লাগছিল। পথে আসতে আসতে আমি বিশুকে জিজ্ঞাসা করি, তোমার বোনটি কী করে?
বিশু :  কিছু করেনা। এই স্কুলেই পঞ্চম ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে। তারপর আর পড়ানো হয় নাই।
আমি :  বিয়ে দিয়েছ?
বিশু  :  না।
আমি :  বিয়ে দিয়ে দাওনা কেন?
বিশু :   বিয়ে দিতে পারিনা গুড্ডুর জন্য। ও বিয়ে দিতে দেয়না। আবার নিজেও বিয়ে করবেনা। ও খুব মাস্তান ছেলে। ষন্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। জরীর  বিয়ে আসলে বিয়ে ভেঙে দেয়। পাত্রকে ভয় ভীতি দেখায়।
আমি : গুড্ডু কোথায় থাকে?
বিশু : রানীখং গির্জার পাশের পুঞ্জিতে ।

আমি নিজেকে নিজে খুব ধিক্কার দিচ্ছিলাম। একজন শহীদদের মেয়েকে দেখবার কী কেউ এখানে নেই। সবাই কী সন্ত্রাসী দেখে ভয় পায়? সবাই কী সন্ত্রাসের কাছে জিম্মি?

একদিন গির্জায় যেতে পথে গুড্ভুর সাথে আমার দেখা হয়! গুড্ভু আমাকে দেখে শাসিয়ে বলে --- 'এই মাস্টার, তুমি নাকি বিশুদের অভিভাবক হইয়াছ? হও। একেবারে  সোমেশ্বরী দিয়া ভাসাইয়া দিব। '
আমি বললাম, তুই দিস। আমিও দেখব তোকে।

গ্রীষ্মের ছুটিতে একবার আমি বাড়িতে চলে আসি।  বিশ দিনের ছুটি ছিল। বাবা অসুস্থ তাই পুরো ছুটির সময়টা আমি বাড়িতেই থাকি।  মাঝে মাঝে জেলা সদরের অফিসে যেয়ে বদলি আদেশের তদবির করি। বদলি আদেশটি হয়েও যায়। বদলি করা হয় মুক্তাগাছা থানার একটি স্কুলে। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র আড়াই মাইল দূরে। ছুটি শেষে আমাকে এই স্কুলে  এসে যোগদান করতে হবে।

আবারও রোড টু রানীখং :

সকাল এগারটায় জারিয়া এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছাড়ে ময়মনসিংহ জংশন থেকে। ট্রেনটি যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হচ্ছিল, জানালা খুলে আজকেও দেখছিলাম দূরের জলরাশি। ভাবছিলাম, নিজের কথা। আমিও কী তবে কাপুরুষ হলাম? কেউ কেউ বলবে, আমি ভয়ে বদলি নিয়ে চলে যাচ্ছি। গুড্ভু শুনে অট্টহাসি দেবে। এই সব ভাবতেই ভাবতেই ট্রেনটি একসময় জারিয়া পৌঁছে যায়।
আজও নৌকায় পার হচ্ছিলাম সোমেশ্বরী নদী। সোমেশ্বরীর জল আজ কেমন যেন স্তব্ধ ও স্থির মনে হচ্ছিল।

আমি হেড মাস্টারজিকে আমার বদলি আদেশের কপি দেই। উনি সেটি ফরোয়ার্ড করে থালা অফিসে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। বিশুকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। হেড মাস্টারজিকে বলি --- বিশু কোথায়?
হেড মাস্টারজি :  ও আজ দুতিন দিন ধরে অনুপস্থিত। শুনেছি, ওদের বাড়িতে নাকি কী ঝামেলা হয়েছে।

আমার অন্তর্আত্মায় খুব টান দিল। বিশু তো স্কুলে অনুপস্থিত থাকার ছেলে নয়। আমি পরের দিন আমার বদলির কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কাজ শেষে বিকালের দিকে বিশুদের বাড়িতে চলে যাই। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আমি ওদের ঘরের দরজার কাছে যেয়ে বিশুকে ডাকি। বিশু ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বাড়ির কাঠের বারান্দায় বসে আমি ওর সাথে কথা বলতে থাকি।
ওর সাথে যখন কথা বলছিলাম, তখন ঘরের ভিতরে থেকে একটি মেয়ের গুমরে গুমরে কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি ওকে বলি -- কে কাঁদছে?
বিশু :  জরী কাঁদছে।
আমি : কী হয়েছে ওর?
বিশু আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। ও আমাকে যা বলল, তাহলো জরি গুড্ভু কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছে। সেই থেকে ও কেবল কাঁদছে।  মা অসুস্থ। জরিকে চোখের অাড়াল করতে পারছেনা। চোখের আড়াল হলেই ও যদি  আত্মহত্যা করে।

আমি সেই সন্ধ্যায় বিশু ও বিশুর মাকে বললাম, যদি আপনেরা রাজি হন তাহলে আমি জরীকে বিবাহ করব। এবং কাল প্রত্যুষেই ওকে নিয়ে এই এলাকা ছেড়ে চলে যাব।
বিশু :   আপনি তো হিন্দু ধর্মীয় ....।
আমি : খ্রীষ্ট ধর্ম মোতাবিকই ওকে বিয়ে করব।
ওরা রাজি হয়। সন্ধ্যা রাতেই জরীকে নিয়ে আমি ও বিশু চলে যাই রানীখং গির্জায়। গির্জার ফাদার আমার সাথে জরিকে বিবাহ পড়িয়ে দেয়।

আমরা যখন জরীকে নিয়ে ওদের বাড়ি যাচ্ছিলাম, তখন দেখে ফেলে গুড্ভু। বিশু খুব ভয় পাচ্ছিল। ও বলছিল, ছোট মাস্টোরজি --- সাবধানে থাকতে হবে। গুভ্ডু খুব খারাপ ছেলে।

আমাকে সে রাতে বিশু আর বিশুর মা স্কুলে ফিরে আসতে  দেয়নি।  আমি ওদের বাড়িতেই থেকে যাই। পাশের একটি ঘরে সারারাত প্রায় লন্ঠন জ্বেলে রেখেছিলাম। দু একটা করে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম জরীর সাথে। লন্ঠনের আলোয় দেখছিলাম জরীর মুখখানি। সেদিনের সেই ধীতাং ধীতাং করে চলা মেয়েটি আজ কেবলই স্তব্ধ ও নির্বাক হয়ে আছে। আমার সাথে একটি কথাও বলছেনা। ম্লান মুখে চেয়ে রইল লন্ঠনের অালোর দিকে। আমি ওর বিষাদ দুটো চোখের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম --- এমনই তুমি হতভাগী! বাসর সজ্জাটাও তোমার সাথে পাতা হলনা।

লেখকের জবানবন্দি :

খুব ভোরবেলা জরির ঘুম ভাঙ্গে। চেয়ে দেখে ছোট মাষ্টারজি ঘরে নেই। তখনও মিটমিট করে লন্ঠন জ্বলছিল। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে দরজাটির খিল ভাঙা। বাইরে থেকে কেউ ভেঙেছে এই রকম মনে হলো। জরী চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। বিশু পাশের ঘর থেকে উঠে আসে। বাড়ির উঠোনে দেখতে পায়, ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে।

তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি :

তারও বছর ছয়েক পরের কথা। একদিন প্রভাতবেলায় বিশু একটি বাচ্চা ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে আসে। ক্লাসে সেদিন ছিল ছোট মাস্টারজির মত একজন নবীন শিক্ষক। সেই নবীন শিক্ষক বাচ্চেটিকে জিজ্ঞাসা করে --- 'বাবু তোমার নাম কি?'
বাচ্চাটি :     সুদীপ্ত কুমার দিব্রা
শিক্ষক :  তোমার মায়ের নাম কি?
সুদীপ্ত.:    জরী দিব্রা
শিক্ষক :  তোমার পিতার নাম কি?
সুদীপ্ত :    স্বর্গীয় সুনীল কুমার রায়।


১৮.   ক্ষণিকা

বহুযুগ আগের কথা । একদিন এক শান্ত শীতল বিকেলে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে দুজন হাঁটছিলাম। পাহাড়ের গায়ে ছিল হাজার রকমের লতাগুল্ম। মনে মনে খুঁজছিলাম কী যেন একটি ফুল। উপরে তাকিয়ে দেখি পলাশও ফুটে আছে। দেখলাম লজ্জায় নুয়ে পড়েছে অপরাজিতা। আমার পাশে থাকা মেয়েটিও কী যেন খুঁজছিল আমার মতোই, কোনো ফুল বা পত্র পল্লব। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি, কী খুঁজছ তুমি? মেয়েটি বলেছিল --- 'আমি যে তোমাকে কিছু দিতে চাই। তাই খুঁজছি এই পাহাড়ের বন ঝাড়ে।'

আমরা দুজনই  পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে হেসেছিলাম। হঠাৎ মনে হল আমি কী অমিত রায়? এ জন্মে আমি তো অমিত রায় নই। আমি নামযশহীন এক লেখক। আর পাশের মেয়েটি লাবন্যও নয়, সে অন্য কেউ।
অথচ লাবন্যের মতোই সেইদিনের সেই বিকেলের মেয়েটি বলেছিল --- "তুমি গোপন হবে আর আমি তোমায় প্রকাশ করব। এ তো আমাদের জন্মজন্মান্তরের খেলা। কিন্ত তোমার তো কেটির মতো আছে অন্য কেউ। আমি কেন তোমার হব এই ক্ষণিকের তরে ক্ষণিকা হয়ে?''

কেমন মায়াময় হলো চন্দ্রিনাথের পাহাড়। আমি আবৃত্তি করছিলাম ----

"পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন তারে করি না খাঁচায়,
ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তিপ্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত।
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
ক্বচিৎ কিরণে দীপ্ত।"

সেই মেয়ে সেদিন চোখ নামিয়েছিল বনলতা সেনের মতো। আমরা নিতে পারিনি বন্ধনহীন পথ চলার শপথ। সেদিনের সেই অস্তপ্রায় সূর্যের শেষ রশ্মি এসে রক্তিম আবীর মাখিয়ে দিল আমাদের দুজনের সর্বাঙ্গে। মৃদু হাওয়ায় তখন চারদিকে ঝরে পড়ছে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। না, লাল পলাশ নয়।
রডোডেনড্রন।


১৯.   বেনারসি শাড়ি

এ টি এম তাজুল ইসলাম সাহেব চাকুরী করেন একটি ইন্ডেন্টিং ফার্মে।  সকাল নয়টায় অফিসে যান। কিন্তু বিকালে বাসায় ফিরবার কোনো টাইম টেবিল নেই তার। এক একদিন এক এক রকম সময়ে অফিস ছুটি হয়। অনেকটা মালিকের মর্জিমত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাত আটটা নয়টা বেজে যায়।

কিন্তু আজ বিকাল পাঁচ ঘটিকার সময় তাজুল সাহেব তার বসের কাছে যেয়ে বলে --- স্যার, আজকে আমার একটু তাড়াতাড়ি বাসায় যাইতে হইবে। অনুগ্রহপূর্বক ছুটি দেবেন।

----  এত তাড়াতাড়ি কেন যাবেন বাসায়?
----  আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। সকালে যখন অফিসে আসি তখন আমার স্ত্রী বলিয়া দিয়াছে, আমি যেন আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরি।
----  ঠিক আছে যান।
----  স্যার কিছু মনে করবেননা। আমাকে কিছু অগ্রিম মাহিনা দেবেন?
বস অনেকটা বিরক্ত হয়ে বলে --- আপনাকে আগে আগে ছুটি দিলাম। এখন আবার টাকা চাচ্ছেন? কি করবেন টাকা দিয়ে?
 ----- স্যার, স্ত্রীর জন্য একটি লাল রঙের বেনারসি শাড়ি কিনে নিয়ে যাব।
----- ক্যাশে তো আজ টাকা নেই। ঠিক আছে, একাউন্টটেন্টের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে যান।

তাজুল সাহেব অফিস থেকে ফিরবার পথে মিরপুর বেনারসি পল্লী থেকে একটি লাল রঙের বেনারসি শাড়ি কিনেন। তখন সন্ধ্যা গত হয়ে রাত হয়েছে। হঠাৎ আকাশে মেঘ গর্জন করে মুশুলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। রাস্তায় কোনো রিক্সা ছিলনা। সে বৃষ্টিতে ভিজে হেটে হেটে কালশীতে তার বাসায় চলে আসে। বৃষ্টির পানিতে শাড়িটি যেন না ভিজে যায় তারজন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল সে। বুকে চেপে ধরেছিল শাড়ির বক্সটি। কিন্তু তারপরও শাড়িটি ভিজে চুপসে যায়।

বাসায় যখন পৌঁছে তখনও মুশুলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। সাথে দমকা বাতাস। ভেজা শাড়ির বক্সটি টেবিলের উপর রেখে তাজুল সাহেব খাটে শুয়ে থাকা তার স্ত্রীর কাছে যেয়ে বসে। বলে তোমার কী হইয়াছে? শুইয়ে আছ কেন?

তাজুল সাহেবের স্ত্রী রুখসানা বেগম কিছু বলার আগেই তিনি তার স্ত্রীর কপালে হাত রাখেন। দেখে শরীরে প্রচন্ড জ্বর। মনে হচ্ছে যেন সারা শরীর আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করে, 'তুমি কী ঔষধ খেয়েছ? ' তার স্ত্রী মাথা নেড়ে বলে : ' দুপুর থেকে হঠাৎ করেই  জ্বর চলে আসে। আমি নাপা ট্যাবলেট খেয়েছি। '
----  তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই?
---- হাসপাতালে নিতে হবেনা। এমনিতেই ভাল হয়ে যাব।
---- তুমি কী কিছু খেয়েছ?
---- না। খেতে ইচ্ছা করছেনা। তুমি খেয়ে নাও। দুপুরের ভাত আছে।
তাজুল সাহেব মাথা নেড়ে বলে, ' আচ্ছা, খেয়ে নিব। '

তাজুল সাহেব স্ত্রীর শিয়রেই বসে থাকেন। আস্তে আস্তে রাত বাড়তে থাকে। টেবিলে রাখা বেনারসি শাড়ির বক্সের দিকে একবার সে তাকায়। দেখে, বক্সের ভিতর থেকে পানি চুয়ে চুয়ে টেবিল ভিজে যাচ্ছে। লাল রঙের পানি। শাড়িটি বের করে বাইরে মেলে দিতে তার আর ইচ্ছা হলনা।

সে তার স্ত্রীর পাশেই বসে আছে। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, বিয়ের পরে এক শ্রাবণ রাতের কথা। আজকের মতো এমনি বৃষ্টি ছিল সেদিন। এমনি ঝরো বাতাস বয়েছিল উত্তরের জানালা দিয়ে । রুখসানা সেই রাতে বলেছিল -- ' এমন বৃষ্টির রাতে এসো আমরা সারারাত জেগে থাকি। এমন বৃষ্টির সময়ে ঘুমিয়ে রাত শেষ করতে হয়না। '
আমারও কী যে ভাল লাগছিল!  আমি তো কবি ছিলাম না, তারপরেও মন চেয়েছিল একটি কবিতা লিখতে। লিখেওছিলাম একটি কবিতা, ' আজি ঝড়ের রাতে। '

তাজুল সাহেব তার স্ত্রীর কপালে আবারও হাত রাখে। জ্বরের প্রচন্ডতায় তার হাত পুড়ে যাচ্ছিল। সে বালতিতে করে পানি এনে মাথায় জল ঢালতে থাকে। প্রায় ঘন্টা খানেকের মতো একটানা মাথায় জল ঢালে। জ্বর কিছুটা কমে গেলে সে তার কপালে জলপট্টি দিতে থাকে। একসময় দেখে তার স্ত্রী ঘুমিয়ে গেছে। সে নিজে আর ঘুমায়না।

তাজুল সাহেব তার স্ত্রীর ঘুমন্ত মুখখানির দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবছিল, সেই সাত ৰছর আগের বাসর রাতের কথা। তাদের বিয়েতে সেদিন কোনো উৎসব হয়নাই। গায়ে কোনো হলুদ দেওয়া হয়নি কারোরই। তার পরনে ছিলনা শেরওয়ানি। মাথায় কোনো ঝালর টুপি পড়ে নাই। রুখসানাও পড়েনি লাল রঙের বেনারসি শাড়ি। এক ক্রান্তিকাল পরিস্থিতিতে তাদের সেদিন বিয়ে হয়েছিল। ক্লান্তিতে সেদিনও রুখসানা ঘুমিয়ে পড়েছিল আগেই। সে আর তার ঘুম ভাঙায়নি। '

তাজুল সাহেব স্ত্রীর শিয়রেই বসেই সেবা করে  সারারাত। তারপর একসময় ভোর হয়ে যায়। ঘরের ভিতরে সূর্যের আলোক রশ্মি এসে রুখসানার মুখে পড়ে। ভোরের সেই  আলোর রোশনাইতে রুখসানার মুখখানি ভীষন মায়াময় দেখাচ্ছিল। হঠাৎ আলোর কিরণে সে একসময় চোখ মেলে তাকায়। দেখে তার স্বামী পরম বিস্ময়ে তারই দিকে তাকিয়ে আছে।

তাজুল সাহেবের একটি হাত আবার রুখসানার কপালে রাখে। দেখে জ্বর নেই। সারারাত জেগে থাকার নির্ঘুম ক্লান্ত শরীর প্রসন্ন লাগছিল তার। কাগজের বক্সটি খুলে ভেজা বেনারসি শাড়িটি বের করে রুখসানার গায়ের উপর জড়িয়ে ধরে। এবং বুকের উপর সে মুখ গুজে থাকে। রুখসানাও যেন প্রাণ পেয়ে বলছিল তখন ----
' আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো--
নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে। '


২০.    হাস্নাহেনা

সাধারণত গ্রামের বাড়িতে বাড়ির কোনো নাম থাকেনা। কিন্তু সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর তীরে জয়নগর নামে একটি গ্রামে একটি বাড়ির নাম আছে 'হাস্নাহেনা'। পুরানো টিনের সীটের উপরে অস্পষ্ট ভাবে আলকাতরা দিয়ে এখনও লেখা আছে এই নামটি। পুরো বাড়িটা হাস্নাহেনা ফুলের ঝাড়ে ঢাকা। ফাঁকে ফাঁকে দুই একটা ফলের গাছ থাকলেও সে গাছগুলো হাস্নাহেনা ফুলের ঝাড়ে জঙ্গল হয়ে গেছে। বাড়িতে দুটো জীর্ণ টিনের ঘর অাছে। এই পুরোনো জীর্ণ বাড়িতে বসবাস করে আশি বছরের বৃদ্ধ সেকেন্দার আলী। যার সংসারে কেউ নেই।

গত বছর হেমন্তে বাড়িতে গেলে, গিয়েছিলাম এই 'হাস্নাহেনা ' বাড়িটিতে। একাকী হাটতে হাটতে জয়নগর গ্রামে এই বাড়ীটিতে চলে যাই। তখন সন্ধ্যা। সূর্য কিছু আগে অস্তমিত হয়েছে। বাড়িটি দেখে আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। পুরো বাড়িটা যেন একটি হাস্নাহেনা ফুলের বাগান। হেমন্তে সব ফুল ফুটে গেছে। পুরো বাড়িটা হাস্নাহেনার গন্ধে মৌ মৌ করছে। আমি প্রাণ ভরে এর নিঃশ্বাস নিতে থাকি।

আমি ষখন ওখানে যাই, তখন দেখি, বৃদ্ধ সেকান্দার আলী ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির ছোট পুকুর পারের দিকে যাচ্ছে। আমি তাকে সালাম দিয়ে আমার পরিচয় দেই। সে আমাকে চিনতে পারে। সে আমাকে নিয়ে পুকুর পারে একটি কবরের কাছে নিয়ে যায়। কী আশ্চর্য! এই কবরটিও হাস্নাহেনা ফুলে ফুলে ঢাকা। দেখি পুকুর পারে কবরের কাছে একটি কাঠের হেলানো চেয়ার রাখা আছে। যে চেয়ারে তিন চার জন একসাথে বসা যায়।
সেকেন্দার দাদাভাই  ও আমি সেই চেয়ারটাতে বসি। আমি তাকে বলি : কেমন আছেন আপনি।?
----  'ভালই আছি। এইযে এখানে যে কবরটি দেখছ, সেটি আমার স্ত্রীর কবর। অনেক রাত পর্যন্ত এখানেই বসে থাকি একাকী। খুব ভাল সময় কাটে।'

সে যখন আমার সাথে কথা বলছিল, দেখি, সে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছিল বারবার। আমি বললাম, আমি বরঞ্চ চলে যাই। আপনি একাকীই থাকেন। আমার মনে হয় আপনি একাকী ভালো থাকেন। তিনি আমাকে সম্মতি দিয়ে বললেন : '.আচ্ছা, যাও। '

ষাট বছর আগে :

এই কাহিনীটি প্রায় অর্ধশত বছরেরও বেশি আগেকার। বাংলার মাটি বাংলার জল ধন্য করে আব্দুল মজিদ শেখের ঘরে একে একে পাঁচটি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। তিনি বহু আদর করে তাঁর পাঁচ কন্যার নাম রাখলেন ফুলের নামে --- হাস্নাহেনা, শেফালী, চামেলী, জবা ও বকুল। বকুলের যখন জন্ম হয়, তখন হাস্নাহেনার বয়স চোদ্দ বছর। পিতা আব্দুল মজিদ শেখ কেন জানি তাঁর বড় কন্যা হাস্নাহেনাকে একটু বেশি আদর করতেন।

সবচেয়ে বড় কন্যা নাকি বাবার কাছে বেশি আহলাদি হয়। বাবার মায়ের আসনও নাকি বড় মেয়েই নিয়ে নেয়। হাস্নাহেনাও তার বাবার মায়ের অাসনটি নিয়ে ফেলেছিল সবার অলক্ষ্যে।

হাস্নেহেনা পঞ্চম ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পেরেছিল। তখন গ্রামে মেয়েদের এরচেয়ে বেশি লেখাপড়া করার সুযোগ ছিলনা। সে ছিল অত্যন্ত লক্ষ্মী একটি মেয়ে। সকালবেলা প্রতিদিন হাঁসমুরগীর খোয়ারের দরজা খুলে দিত এবং ধান কুঁড়ো চাল সেই খেতে দিত। কবুতরের ঘরের দরজাও হাস্নাহেনা খুলত। কবুতরগুলো যখন বেড়িয়ে ঘরের চালে যেয়ে বসত, তাদের উড়ে যাবার ডানা মেলার শব্দ সে শুনত কান পেতে।

হাস্নাহেনা দেখতেও ছিল ফুলের মতই লাস্যময়ী। গ্রামে তখন মেয়েদের অল্প বয়স থেকেই শাড়ি পড়তে হত। হাস্নাহেনাকেও নয় দশ বছর বয়স থেকেই শাড়ি পড়তে হয়েছিল। বাবা আব্দুল মজিদ শেখ প্রথম লাল সবুজ রঙের চেক শাড়িটি কিনে এনে দিয়েছিল ছোনগাছা হাট থেকে। শাড়িটি পড়ে হাস্নাহেনা সেদিন উঠনে ছোট ছোট করে পা ফেলে হাটছিল। আর স্মিত হাস্যে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাচ্ছিল পরম খুশি মনে।

মাত্র চোদ্দ বছর বয়সেই এক অগ্রহায়ণে হাস্নাহেনার বিয়ে ঠিক হয়ে যায় পার্শ্ববর্তী গ্রামের মরহুম আব্দুল আলীর পুত্র সেকেন্দার আলীর সাথে। সেকেন্দার শিশু বয়সেই পিতৃহীন হয়। ওর আর কোনো ভাই বোন নেই। মাকে নিয়ে  সংসার। থার্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করার পর আর পড়ে নাই। চাকুরীও করেনা। জমি জিরাত ভালোই আছে। তাই দিয়ে চলে সংসার।

দিন ক্ষণ দেখে বিয়ের তারিখ ধার্য হয় : ১৪ ই অগ্রহায়ণ, ব়হস্পতিবার, ১৩৬৩ বাংলা সন। আব্দুল মজিদ শেখ দুই তিন গ্রাম মিলে হাজার লোককে দাওয়াত দেয়। গঞ্জে থেকে বিয়ের যাবতীয় সওদা করে। হাস্নাহেনার জন্য কানের একজোড়া ঝুমকা, হাতের শাঁখা, গলার মালা, কোমরে রূপার বিছা এবং পায়ের জন্য রুপার ছড়া বানালেন পাঁচকৌড়ি কর্মকারকে দিয়ে। কুড়াগাছা হাট থেকে লোকজনদেরকে খাওয়ানোর জন্য আনলেন একটি মহিষ, একটি গরু ও একটি বড় খাসি ।

গাঁয়ের উঠতি বয়সের ছেলেরা আব্দুল মজিদ শেখের কাছে এসে বায়না করল --- ' চাচা, আমরা হাস্নাহেনার বিয়েতে শহর থেকে কলের গান নিয়ে আসব আর বাগবাটী সুবোধ গায়েনের কাছ থেকে ব্যান্ড পার্টি আনব। ' আব্দুল মজিদ শেখ সহাস্যে রাজি হয়ে বললেন --- ' যাও তোমরা আজই বায়না করে আসো। টাকা যা লাগবে আমি দেব। তবে ভাল দেখে গান নিয়ে আসবে। আব্বাস উদ্দিন, কানন দেবী, মধুবালাদের যত ভাল ভাল গান।  '

হঠাৎ বিয়ের দুইদিন আগে হাস্নাহেনার জ্বর আসে। মকবুল ডাক্তারের কাছ থেকে ঔষধ এনে খাওয়ানো হয়। যেহেতু বিয়ের আয়োজন সব সম্পূর্ণ। তাই আর তারিখ পিছানো হলনা। সবাই আশা করল, এই দুইদিনে জ্বর ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু, ভাল হলনা। যথারীতি বিয়ের দিন শহর থেকে কলের গান আসল। সুবোধ গায়েনের ব্যান্ড পার্টি আসল। মহিষ গরু ছাগল জবাই করা হলো। মহাসমারোহে রান্না বান্না হতে লাগল। বাবুর্চি আনা হলো কাজিপুরের জোজোরিয়ার চর থেকে। সবাই বলাবলি করতে লাগল --- ' তরকারি দারুণ স্বাদের হইবে। '

দুপুরের আগেই দামান আসল পাল্কিতে চড়ে। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় জিন্নাহ টুপি। বিয়ে পড়ানোর জন্য আবুল মুন্সীকে ডাকা হলো। দুই হাজার এক টাকা দেনমোহর ধার্য করে কাজী সাহেব বিয়ে পড়ালেন। হাস্নাহেনা অন্দর বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শোয়া ছিল। সাক্ষীরা যেয়ে তার কাছ থেকে সম্ততি আনলেন। আবুল মুন্সী কালেমা পাঠ করলেন। এবং নব দম্পতির জন্য সুখ শান্তি চেয়ে মোনাজাত করলেন।

এরপর মহা ধূমধামে ভোজন পর্ব সমাপ্ত হলো। মেহমানরা প্রায় সবাই চলে গেল যার যার মতো। কিন্তু কলের গান থেমে ছিলনা। ব্যান্ড পার্টির বাজনাও বাজছিল। জামাইকে যখন অন্দর মহলে নেওয়া হবে, ঠিক তখনই ভিতর থেকে অার্ত চিৎকার শোনা যায়। হঠাৎ এই চিৎকারে কলের গান থেমে যায়। ব্যান্ড পার্টির বাজনা বন্ধ হয়ে যায়।

এর আগেই সব প্রাণ স্পন্দন থেমে যায় হাস্নাহেনার। নিথর হয়ে যায় তার কিশোরী দেহ। তখনও ওর পড়নে ছিল  লাল শাড়ি, কানে ছিল ঝুমকা, গলায় ছিল মালা, আর হাতে ছিল শাঁখা। এসবই তার শরীর থেকে খুলে ফেলা হয়। বড়ই পাতার গরম জলে তাকে গোসল করানো হয়। তারপর সাদা কাফনের কাপড় পড়ানো হয়। সেই কাপড়ে আতর গোলাপ আর চন্দনের সুবাস মেখে দেওয়া হয়।

প্রিয় মানুষদের ক্রন্দনধ্বনিতে খাটিয়ায় শুয়ে সেদিনের সেই সন্ধ্যায় হাস্নাহেনা শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। শব যাত্রায় সেকেন্দার আলীর পরনে তখনও ছিল বিয়ের সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবি।

ষাট বছর পরে :

যে থাকে যখন থাকে -- অন্তরে অন্তরেই থাকে। ভালবাসা কখনই  দূরের হয়ে যায়না।  প্রকৃত প্রেম  একা হয়না কখনও। বড়ই মায়া হলো বৃদ্ধ সেকেন্দার আলীর সাথে কথা বলে। হেমন্তে পূর্ণিমার চাঁদ উঠলে মনে পড়ে কী তার হাস্নাহেনার কথা?  কোনো বৃষ্টি ভেজা লোনা হাওয়ায় হাস্নাহেনার সুবাস নিয়ে কী সে ঘুমিয়ে পড়ে? কেউ কোনদিন তাকে কী বলেছে --- এত কষ্টভোগের পরও তুমি তাকেই নিয়ে কেন আছো? তাকে তো কোনোদিনই পাওনি।

সেকেন্দার আলী আজও পূর্ণিমা চাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে পুকুরপারে গভীর নিশীথ পর্যন্ত। সে কোনো অচিনপুরের দিকে চলে যেতে চায় না তো?

-------------------------------------------------------------------------
ডিসক্লেইমার :  কাহিনীটির কিছু অংশ কারোর বাস্তব জীবন থেকে নেয়া হয়েছে। তবে কল্পনার মিশেল আছে অনেক কিছুতেই।


২১.     তাঁর পদচিহ্ন

আমি তখন একটি কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত । সেদিন অফিসে খুব কাজ ছিল। লেটার অফ ক্রেডিটের শর্ত অনুযায়ী পরেরদিনই শিপমেন্টের শেষ দিন, তাই সকাল থেকে অফিসে খুব ব্যস্ত সময় পার করছিলাম। এরই ফাঁকে রিসেপশনিস্ট এসে বলেছিল --- 'স্যার, একটা বৃদ্ধ লোক অাপনার সাথে দেখা করতে চায়। .....'  আমি তার নাম শুনবার আগেই বলেছিলাম : ওনাকে বসতে বলো, আমি ফ্রী হলে ডাকব তাকে।'

ভাগ্যটা মনে হয় এমনই আজ,  'পড়বি পর মালীর ঘারেই' এর মতো অবস্থা আমার। আজই আমাদের বিবাহেরও পাঁচতম বার্ষিকী। কাজগুলো তাই দ্রুততার সহিত শেষ করে ফেলি। ফাঁকে দিয়ে লান্চটাও সেরে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম , একটি লোককে বাইরে বসিয়ে রেখেছি। বিকেলে বের হওয়ার সময় হঠাৎ মনে পড়ে তার কথা। আমি রিসেপশনিস্টকে বলি --- ' ঐ লোকটি কোথায়?'
---- উনি বাইরে বারান্দায় বসে আছে। ভিতরে বসতে বলেছিলাম, বসেনি।
আমি বারান্দায় চলে আসি। দেখি,  টুলের উপরে লুঙ্গী পড়া একজন বৃদ্ধ লোক পিছন দিক হয়ে বসে আছে। লোকটা তখন ঝিমুচ্ছিল। সহসা চিনতে পারছিলাম না তাকে। ভাল করে যখন সে চোখ মেলে, তখন তাকে চিনতে পারি। ইনি গফরগাঁও এর কান্দির পাড়ের আছির উদদীন চাচা।

আমি তাকে হাত ধরে নিয়ে ভিতরে বসাই। চোখে মুখে তার রোগ ক্লিষ্ঠতার ছাপ। সকাল থেকে সে যে কিছু খায়নি, এটা বোঝা গেল। নিজকে খুবই অপরাধী লাগছিল। আমি পিয়নকে দিয়ে হোটেল থেকে কিছু খাবার আনালাম। সে তৃপ্ত সহকারে সে খাবারগুলো খেয়ে নেয়।

আমি বললাম, সেই কত বছর পর আপনাকে দেখলাম। হঠাৎ এভাবে চলে এলেন? আপনি কীভাবে জানলেন, আমি এখানে আছি।
----  সে অনেক কথা। অনেক কষ্ট করিয়া তোমার খোঁজ আমি পাইয়াছি।
---- চাচি মা কেমন আছে?
---- দুই মাস আগে মারা গিয়াছে। আল্লাহ এমন রোগ তাহাকে দিয়াছিল। আমার যেটুকু জমি জিরাত ছিল, তা সবই তাহার চিকিৎসার জন্য শেষ করিয়া দিয়াছি। তারপরেও তাহাকে বাঁচাইতে পারি নাই।
---- আকলিমাকে কোথায় ৰিয়ে দিয়েছেন?
---- শম্ভুগঞ্জ চটকলের এক কেরানির সাথে।
---- তাসলিমা তো মনে হয় এখন অনেক ৰড় হয়েছে। ওকে কী বিয়ে দিয়েছেন?
---- 'না। বাবা, আমি খুব বিপদে পড়িয়া এবং নিরাশ্রয় হইয়া তোমার কাছে আসিয়াছি।'
এই কথা বলে সে আমার দুটো হাত ধরে, এবং অনুনয় করে বলে --- 'আমাকে কিছু টাকা দিয়া সাহায্য করো। যদি আমি পারি, তোমাকে সে টাকা ফেরত দিয়া দিব। '
সে আরও বলছিল, 'তুমি তো জানো আমার কোনো ছেলে নাই। আমার শরীরটা ভালো যাইতেছেনা। যে কোনো সময় ইহলোক ত্যাগ করিতে পারি। তাসলিমার একটি বিবাহ দিতে পারিলে আমি বাঁচি। ওর বিবাহের জন্যই এই টাকা আমি তোমার কাছে ধার চাহিতেছি। '

আমি তাকে বলি, আপনি আমার হাত ধরে এভাবে অনুনয় করে বলছেন কেন? ঠিক অাছে, আমি যতটুকু পারি, তাসলিমার বিয়ের খরচের টাকা দিব। সে টাকা আপনাকে পরিশোধ করতে হবেনা।'
দেখলাম, মুহূর্তেই আছির উদ্দিন চাচার মলিন মুখে হাসি ফুটে উঠল।

তখন সন্ধ্যা গত হয়ে গিয়েছে। এই সন্ধ্যারাতে বৃদ্ধ এই লোকটিকে আমি টাকা দিয়ে বিদায় করতে পারতাম। কিন্তু আমার বিবেকে বাঁধল। রোগা ক্লীষ্ঠ শরীরে কিভাবে তাকে এই রাতের বেলায় একাকী পাঠিয়ে দেই। আমি ওনাকে বললাম -- আজ আমার বাসায় থাকবেন। কাল সকালের ট্রেনে আপনি চলে যাবেন।

আমার গাড়ির পিছনের সিটে বসিয়ে ওনাকে বাসায় নিয়ে আসি। আমার স্ত্রী শারমীন দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেল, আমি তাকে হাত ধরে নামিয়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসালাম। নোংরা কাপড় আর ধূলি মাখা পায়ে একটি লোককে পরিপাটি একটি সোফায় বসাই, তা দেখে শারমীন বিস্মিত হচ্ছিল, পাশের রুমে বসে সে আমাকে বলছিল --- 'উনি কে? ওনাকে তো চিনিনা। '
----  'তুমি চিনবেনা। আমার পরিচিত। গফরগাঁও থাকে।
----   তুমি তো কখনও ওনার কথা বলোনি।
----- পৃথিবীতে চলতে চলতে কত মানুষের সাথেই তো পরিচয় হয়। কার কথা কে কাকে অত বলে। অনেক মানুষই অজানা থেকে যায়, অনেকের কাছে। এই ধরো, তোমার সব পরিচিত মানুষকে কী আমি চিনি? কিংবা তাদের সবার কথা কী তুমি আমাকে বলেছ?
---- আচ্ছা, তা ঠিক। তুমি কী ভুলে গেছ, আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী? আমার জন্য কী গিফট এনেছ?
 ----  'কিছু কেনা হয়নি। তোমার জন্য গিফট কিনব বলে যে টাকা উঠায়েছিলাম, তা কাল সকালে ওনাকে দিতে হবে। উনি খুব বিপদে পড়ে আমার কাছে এসেছে।'
শারমিন খুব মন খারাপ করে বললো --  ' আচ্ছা, দিও।'

শারমীন একটু বিরক্ত  হয়ে বলছিল --- 'ওনাকে শুইতে দেবে কোথায়?
----- কেন? ড্রয়িং রুমে ডিভানের উপরই শুইবে।
শারমীন একটু শ্লেষ সুরে বলছিল --- 'উনি কী আমাদের সাথে বসে খাবে? '
 ---- হ্যাঁ, উনি  আমাদের সাথে ডাইনিং টেবিলে বসেই খাবে।
----- মনে হচ্ছে উনি তোমার শ্বশুর। কী আগে কোনো বিয়ে করেছিলে নাকি?
----- দেখো, তুমি ঝগড়া করোনা।

শারমীনের সাথে আমার আরো কিছু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। পরে আমার মনে হলো, আমার সম্পর্কে ওর ভুল ধারণাটি  ভেঙে দেওয়া  দরকার। আমি ওকে কাছে ডেকে বলি ---
' দেখো, অনেকের জীবনে এমন কিছু ঘটনা থাকে, তা অনেক সময় গোপন রাখে। স্বামী তার স্ত্রীর কাছে কিংবা স্ত্রী তার স্বামীর কাছে সেসব কথা বলেনা। লুকিয়ে বা গোপণ করে রাখে সারা জীবন । আছির উদ্দিন চাচার কথা তোমাকে আমি বলিনি এই জন্য যে,  যদি তুমি আমাকে অবহেলা বা ছোট করে দেখ, এই জন্য।
আমি ওনাদের বাড়িতে পাঁচ বছর জায়গীর থেকে লেখাপড়া করেছি। জায়গীর থেকে লেখা পড়া করাকে অনেকে ছোট করে দেখে। হয়ত তুমি আমাকে বলতে -- 'আমি অনাথ।' তাই তোমাকে সেকথা কোনোদিন বলিনি।  আসির উদদীন চাচার কাছে, ওনার  পরিবারটির কাছে  আমি অনেক ঋণী। এই যে আমি অাজ এত বড় হয়েছি, তার পিছনে ওনাদের অনেক ত্যাগ আছে। অনেক দুঃখ কষ্ট আছে। অনেক অশ্রু জল মিশে আছে। '

শারমীন আমার দুহাত চেপে ধরে বলে ---' লক্ষীসোনা, এই পাঁচ বছরে তুমি আমাকে এইটুকুই চিনলে? আমি কী এতই খারাপ মেয়ে? তোমাকে আমি বুঝবনা? ওনার কাছে এত অকৃতজ্ঞ হইওনা। আজ আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর পূর্তি হচ্ছে। আজকের এই বিশেষ দিনে -- চলো, আমরা আসির উদ্দিন চাচার পা ছুঁয়ে কদমবুচি করে আসি।'

আমরা দুজন ড্রয়িং রুমে যেয়ে দেখি, আছির উদদীন চাচা সেখানে নেই। সাদা কার্পেটের উপর তাঁর ধুলো পায়ের কতকগুলি পদচিহ্ন রেখে কখন যে সে চলে গেছে। জানি নাই।


২১.        পদ্মফুলের রূপকথা

আমার দাদাজানকে আমি কখনই দেখি নাই। তাহার কোনো ফটোগ্রাফ কিংবা কোনো মূর্তি বা কোনো  তৈলচিত্রও কোথাও আঁকা নাই। বাবার কাছে শুনিয়াছি,  তিনি  ঊনিশ শত ছত্তিশ সালে মৃত্যুবরণ করিয়াছিলেন। তিনি দেখিতে নাকি অনেকটা ঋৃষিদের মতো ছিলেন। ভাল পুঁথি পাঠ করিতে পারিতেন। গত রাতে আমার দাদাজানকে স্বপ্নে দেখিলাম।

উনিশশ তিরিশ দশকের এক নিঝুম সন্ধ্যারাত্রি। বাড়ির উঠানে বসিয়া দাদাজান পুঁথি পাঠ করিতেছে।  মাটির প্রদীপদানীতে সলতে মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছে। তাহার পাশে অনেকেই বসিয়া তাহার পুঁথি পাঠ শুনিতেছে। দাদীমাও বসিয়া আছেন সেখানে । আমি ঠিক দাদীমার বাহুতে হেলান দিয়া সেই পূথি পাঠ মন্ত্রের মতো হা করিয়া শুনিতেছি। পরম উদ্গ্রীব হইয়া শুনিতেছিলাম আর ভাবিতেছিলাম --- আহা! এমন করিয়া তিনি যদি সারা রাত্রি পুঁথি পাঠ করিয়া যাইতেন। কী সুন্দর  সুরেলা প্রেমময় কন্ঠ তাহার। অনেকটা ব্রজবুলি ভাষায় তিনি দৌলত কাজীর পুঁথি পাঠ করিয়া যাইতেছেন।

'‘‘কি কহিব কুমারীর রূপের প্রসংগ।
অংগের লীলায় যেন বান্ধিছে অনংগ
কাঞ্চন কমল মুখ পূর্ণ শশী নিন্দে।
অপমানে জ্বলেতে প্রবেশে অরবিন্দে "

একটা সময়ে তিনি পুঁথি পাঠ বন্ধ করিলেন। আমার দিকে তাকিয়া কহিলেন ---
বৎস, এই যে তুমি তোমার দাদীজানকে দেখিতেছ এর কথা তোমাকে কী বলিব? একবার আমি আরাকান পাহাড়ে গিয়াছিলাম। সে তখন হাঁস হইয়া ওখানের একটি নদীতে ভাসিতেছিল। সে কখনও মাছ হইয়া সাঁতার কাটিত নাফ, কর্ণফুলী , হালদা নদীতে । আবার কখনও  হাজার পাপড়ির পদ্মফুল হইয়া ফুটিয়া থাকিত সরোবরে – দূর দূর দেশ থেকে অনেকেই আসিত তোমার দাদীমার সৌন্দর্য দেখিতে। কেহই তাহার সৌন্দর্য সুধা উপভোগ করিতে পারে নাই। আমিই পারিয়াছিলাম। তাহার পাঁপড়ির ঘ্রাণে আমিই প্রথম  মুগ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলাম।

আমি আমার দাদাজানকে বলিলাম, আমি কী এমন একটি পদ্মফুলের ঘ্রাণ কোনোদিন লইতে পারিবনা? তিনি বলিলেন --- তুমি তোমার মাথাটি আমার দিকে আগাইয়া ধরো। এসো বর দিয়া দেই -- তোমার এই রূপবতী দাদিমার মতো তুমিও যেন জীবনে এমন একটি পদ্মফুলের পাঁপড়ির ঘ্রাণ লইতে পারো।

আমি ঠিক বুঝিতে পারিলামনা কোন্ পদ্মফুলের পাঁপড়ির ঘ্রাণে আমার ঘুম হঠাৎ ভাঙ্গিয়া গেল।


২৩.    কবি

বহু বৎসর আগে এক কিশোর বালক ঝড়  বৃষ্টি রোদ্রে পায়ে হাঁটিয়া স্কুলে যাইত। কত দ্বিপ্রহর তার পথে পথে কাটিয়াছে। কত ব্যাথাতুর বিষন্ন বিকালে সে শুন্য প্রান্তরের দিকে মুখ রাখিয়া চলিয়াছে। তাহার মন কতই যে ব্যাকুল হইয়া থাকিত, কেহই তাহা জানিতনা। সে কবি হইতে চাহিয়াছিল কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে সে কবি হইতে পারে নাই। অভিমানে তাই সে বৈরাগ্য জীবন বাছিয়া নিবে বলিয়া স্থির করিল। বালক মনে করিল, সে কোনো দরবেশ পীরের মাঝারে যাইয়া নিজ জীবন উৎসর্গ করিবে। সেখানে ভিক্ষুক রূপ ধারণ করিবে। এই ভাবিয়া রৌদ্রদগ্ধ এক ক্লান্ত দুপুরে রিক্ত হাতে সে পথে বাহির হইয়া পড়িল।

পথে বাহির হইবার পর সে বুঝিতে পারিল, পথের ক্লান্তি বড়ই কঠিন। পথ চলিতে চলিতে সে দেখিতে পাইল, লালন শাহের আখড়ায় যাইয়া উপস্থিত হইয়াছে। সেখানে কিছুদিন থাকিবার পর, পুণরায় মনস্থির করিল, সন্ন্যাসী হইবে। সে মোতাবেক সে কাশিধামে চলিয়া যায়। সেখানে সে বেদান্ত পড়িতে লাগিল। এবং সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করিল।

পদ্মাপাড়ের হিম শীতল বাতাস কিংবা গঙ্গার ঢেউ তাহাকে উদ্বেলিত করিতে পারে নাই। যোগিনী কাঙ্গালিনীরাও তাহাকে মায়াডোরে বাঁধিয়া রাখিতে পারে নাই। বালক ভিতরে ভিতরে, প্রাণে প্রাণে, কবি হইবার সাধ কখনই দূর করিতে পারে নাই। তাই সে আবার নিজ ধামে ফিরিয়া আসিল। সে যাহা হইতে চাহিয়াছিল, তাহা সে হয় নাই। তাহার জীবন কাব্যের সেইসব সম্ভাবনাগুলি কী একেবারে শেষ হইয়া গিয়াছে? না হয় নাই। সেই সব সম্ভাবনাগুলি হইতেই একটি একটি করিয়া লেখা সে লিখিয়া চলিয়াছে। তাহার সেই সৃষ্টি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়া পৌঁছিবে, তাহা কি সে জানে? না, তা সে জানেনা।



২৪.     হলুদকণ্ঠ পাখির খোঁজে

কিশোর সময়ের কথা। একদিন বৈশাখের এক বিকেলে বাড়ির পুকুর পাড়ে আমগাছ তলায় বসে আছি। হঠাৎ দেখি দুটো হলদে পাখি ছাতিম গাছের ডালে এসে বসল। ওরা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে কোনো সবুজ বৃক্ষ ছিলনা। ছিল দিগন্ত জোড়া খোলা মাঠ। আর উপরে আকাশ ছিল নীলিমার নীল। ভাবলাম, এত নীলে থেকে ওরা এল, অথচ ওরা নীলকন্ঠী না হয়ে এমন হলুদকন্ঠী হলো কেন?

তিন দিন পরে যেয়ে দেখি, হলদে পাখি দুটো ছাতিম গাছের পাতার ফাঁকে নতুন বাসা বেঁধেছে। আমার কী যে ভালো লাগল ওদের বাসা বাঁধা দেখে। এত ভাল লাগছিল যে, সেদিন রাতে আনন্দ আতিশয্যে আমার আর ঘুম এলনা।

পরের দিন সন্ধ্যা রাতে হঠাৎ প্রচুর শীলা বৃষ্টি হয়। সাথে প্রচন্ড ঝড়। ঝর বৃষ্টি থেমে গেলে আমি হ্যারিকেন নিয়ে পাখির বাসাটি দেখতে যাই। দেখি, পাখির বাসাটি সেখানে নেই। ঝড়ে বাসাটা ভেঙে গেছে। পাখি দুটোকে তখন দেখতে পেলাম না।

সকালবেলা যেয়ে দেখি -- শীলার আঘাতে স্ত্রী পাখিটি মরে মাটিতে পড়ে আছে। সারা শরীরে তার রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সে যে মরে পরে আছে, ছেলে পাখিটা তা জানতো না। পাখিটার মৃত শরীর ঝরা পাতায় ঢাকা ছিল।

ছেলে পাখিটা মন খারাপ করে সারাদিন ছাতিম গাছের ডালে বসে থাকত। সে ভাবত, তার স্ত্রী ঝড়ে উড়ে কোথাও চলে গেছে। একদিন  হয়ত সে চলে আসবে। তাই সে অপেক্ষা করে। কিন্তু সে আর আসেনা।

আর একদিন যেয়ে দেখি, ছেলে পাখিটির চোখে মুখে বেশ খুশি খুশি ভাব। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি  ' তুমি আজ এত খুশি কেন? ' সে তখন বলে --- ' আজ আমি মধুপুর বনে চলে যাচ্ছি। ওখানে সব হলুদ পাখিদের মিলন মেলা বসবে। আমার প্রেয়সীও ওখানে আসবে। তার সাথে আমার দেখা হবে। ' এই বলে পাখিটি উড়ে চলে গেল।

আমি সেই পাখিটিকে শুভাশীষ জানিয়ে বললাম -- 'তুমি যেন তোমার প্রেয়সীর দেখা পাও।'


২৫.       মনু মাঝি

তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছি। একদিন বিকালে আমাদের বাড়িতে আমার এক ভগ্নিপতি এল। ( খালাত বোনের স্বামী )। ভগ্নিপতিটি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক। ঘটনা ক্রমে সে একটি খুনের মামলায় প্রধান আসামি হয়‌। বছর খানেক পলাতক ছিল। পরে কোর্টে আত্মসমর্পণ করে। দুই বছরের অধিক হাজতও খাটে। পরে তার জামিন হয়। আদালতে বিচার তখন চলমান।

আমি দেখলাম, দুলাভাই আমার মা'র সাথে খুবই গোপনীয়তার সহিত ফিসফিস করে কী যেন আলাপ করছে। মা'ও খুব কৌতুহলভরে তার কথাগুলো শুনছে। বেশ সময় ধরে তারা আলাপ করে। এবং সন্ধ্যার দিকে আমার সেই দুলাভাই চলে যায়।

পরে মার কাছ থেকে জানা গেল -- সে একটি কবিরাজের মাহাত্ম্যের কথা আলাপ করেছে। কবিরাজটি নাকি পিচাশ লালন করে। পিচাশের দ্বারা সে নাকি বিভিন্ন রোগ ব‍্যাধি ও সমস্যার সমাধান করে। আমার ভগ্নিপতি যে খুনের মামলায় জামিন পেয়েছে, সেটাও নাকি ঐ কবিরাজের পিচাশের কেরামতিতে হয়েছে।

আমার বাবার পায়ে গ‍্যাংরিনের মতো অসুখ হয়েছিল। ভাল চিকিৎসাও চলছিল তার। আমার সেই দুলাভাই মাকে বুদ্ধি দেয় --- ' খালা আম্মা, আপনি একবার যেয়ে ঐ কবিরাজের কাছে অসুখের কথা বলেন। দেখবেন, খালুজানের অসুখ ভাল হয়ে যাবে।' মা এইসব বিশ্বাস করতে চায়নি। কিন্তু আমার সেই দুলাভাইয়ের পীড়াপীড়িতে কৌতুহলবশত রাজি হয়।

কবিরাজের নাম মনু মাঝি। বাড়ি গারাদহ গ্রামে। সে কেবলমাত্র অমাবশ‍্যা রাত্রিতে রোগিদের সমস্যা শোনে। এবং পিচাশকে হাজির করে। আমারও কৌতুহল হলো এই কবিরাজের কেরামতি দেখবার। পৌষের এক অমাবশ‍্যার রাতে আমরা পায়ে হেঁটে, নৌকায় নদী পার হয়ে বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে গারাদহ গ্রামে চলে যাই।

মনু মাঝির বাড়িটি নির্জন নদীর কূলে। আশেপাশে অন‍্য কোনো বাড়িঘর নেই। বাড়িটি যে একজন হতদরিদ্রের, দেখে তা বোঝা গেলো। কাচারি ঘরটি টিনের চালের। থাকার ঘরটি ছোনের চালা। পুরো বাড়িটার চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমরা বাড়ির বাইরেই পায়চারি করছিলাম। আরো কয়েকজন নারী পুরুষকে দেখলাম বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তারাও মনু মাঝির সাক্ষাৎ প্রার্থী।

আমার ভগ্নিপতিটি বাড়ির ভিতরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে সে এসে বলে --- রাত আরো গভীর হলে কবিরাজ মহাশয় আসনে বসবে। পিচাশের হাজির হবার লগ্ন এখনও নাকি হয় নাই। আমরা এবং অন্যান্য মিলে দশ বারো জন ছিলাম। আমরা সকলে কাচারি ঘরের ভিতর যেয়ে মাটির মেঝেতে চটের উপরে বসে অপেক্ষা করতে থাকি। ঘরের মেঝের মধ্যখানে একটি কেরসিনের লন্ঠন মিটমিট করে জ্বলছিল।

রাত আরো গভীর হলো। কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই। বাইরে আঁড়াবন থেকে মাঝে মাঝে পেঁচার ডাকের শব্দ ভেসে আসছিল। ঝিঁঝিঁ পোকা মাকড়ের ডাকও শোনা যাচ্ছিল। একটু পর মনু মাঝি আসল। পরনে লুঙ্গি। গায়ে চেকের পুরানো বেপারি হাফ সার্ট। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। সে চটের উপরে আসন পাতলো।

মনু মাঝি পান চিবোচ্ছিল আর আমাদের সতর্ক করে বলছিল --- 'আমি যখন বাতি নিভাইয়া দিমু, তখন আপনেরা সবাই হাঁটুতে মুখ লুকাইয়া রাখিবেন। আমার প্রেত মশাই উলঙ্গ। যদি আপনেরা কেউ ফিরিয়া তাকান , তবে প্রেত মশাই আপনেদের ঘার মটকাইয়া ফেলিবে।' তার এই কথা শুনে সবাই ভয়ে জড়সড় হয়ে হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে ফেলল।

একটা ব‍্যাপার লক্ষ্য করলাম, মনু মাঝি আমাদের কারোর পরিচয় নিলনা। এবং কারোর কোনো সমস্যাও জানতে চাইলনা। তাঁর সম্মুখে একটি কাঠের টুল রাখা আছে। সেইটার উপরেই প্রেত এসে বসবে। সে বাতি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফেলল। সারা ঘর কালো অন্ধকার হয়ে গেল। একটি বেতের ডালার ভিতরে কিছু পরিমাণ শুকনা ধান হাত দিয়ে জোরে জোরে করে নাড়াচাড়া করতে লাগল। এবং হিব্রু ভাষার মতো এক ভাষায় মন্ত্র জপ করতে থাকে।

সে উচ্চ স্বরে মন্ত্র পাঠ করছে। সবাই ভয়ে হাঁটুর ভিতরে মাথা লুকিয়ে আছে। পাঁচ সাত মিনিট পর ধচমচ করে , ঘরের দরজার চৌকাঠের উপর দিয়ে, লাফিয়ে প্রেত রুমের ভিতরে প্রবেশ করে। মনে হলো, সে কাঠের টুলটির উপর এসে বসল। উপস্থিত লোকজনদের ভিতরে কেউ বলছে -- আদাব। কেউ বলছে -- নমস্কার।

প্রেত তার পরিচয় দিচ্ছে কেমন যেন বিকৃত কর্কশ স্বরে। বলছে --- আমার নাম নৃপেন। জাতিতে আমি মুচি। অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছিল পিতৃদেব। আমি হয়েছিলাম দারোগা। আমার গর্দান ছিন্ন করে ফেলেছে ডাকাত দল। আমার মাথা নাই। আমি এখন থাকি ধুনুটের এক নির্জন শ্মশান ঘাটের বটবৃক্ষে।

উপস্থিত কে যেন হাঁটু থেকে মাথা তুলে প্রেতকে একটু দেখবার চেষ্টা করেছিল। ঠিক তখনই প্রেত তাকে গালি দিয়ে ওঠে --- 'ঐ চুদির বাই, তুই আমাকে দেখতে চাস ক‍্যান? আমি তোর চোখ টেনে তুলে ফেলব। জানোস না, আমি যে ন‍্যাংটা।'

আমাদের ভিতরে একজন বারো তেরো বছরের বালিকা বসা ছিল। তাকে লক্ষ্য করে প্রেত বলছে -- অরে তো পিচাসে ধরেছে। মেয়েটির বাবা উত্তর দেয় -- জ্বী।

ঐ ছেমরি তোর নাম কি ?
ছালেহা।
তোর পিচাসের নাম জানোস ?
না।
যাবি তার কাছে?
না।
পিচাস তো তোরে ছাড়বো না।

মেয়েটির বাবা বলছে  -- বাবু, আমার মেয়েটার ভূত একটু ছাড়াইয়া দেন।

প্রেত তখন বলছে --- তোমরা বসে থাকো। আমি পিচাসটাকে ধরে নিয়ে আসি। এই বলে প্রেত ধচমচ করে ঘরের চৌকাঠের উপর দিয়ে বের হয়ে চলে গেল।

একটু পর প্রেত আবার ধচমচ করে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়লো। সঙ্গে পিচাসকেও ধরে নিয়ে আসে। এবং পিচাসটিকে ইচ্ছামত পিটাতে থাকে। এবং বলে -- তুই সালেহা কে ছেড়ে যাবি কিনা বল?
পিচাস বলে --  আমি অরে ছাইড়া চইলা যাইতাছি। আমারে আর মাইরেন না। আমারে মাফ কইরা দেন।

প্রেত ওকে ছেড়ে দিল। পিচাসটি ভয়ে পালিয়ে চলে গেল ‌।

তারপর প্রেতের কাছ থেকে আরো দুই ব্যক্তির সমস্যার বিচিত্র কেরামতি দেখলাম। আমি এখানে তা আর উল্লেখ করলাম না।

প্রেত মহাশয় এবার আমার মা'র দিকে তাকিয়ে বলল -- মাসিমা আপনি অনেক বিপদে আছেন। আপনার স্বামীকে শত্রু বাণ মারিয়াছে। তাহার পায়ের নখ কৌটায় ভরিয়া কবরস্থানে পুতিয়া রাখিয়াছে। ঐটা তুলিয়া ফেলা না পর্যন্ত আপনার স্বামী ভাল হইবে না। আপনি একটু বসুন। আমি উহা কবরস্থান হইতে তুলিয়া আনিতেছি। এই বলে প্রেত মহাশয় ধচমচ করে বের হয়ে চলে গেল।

একটুপর প্রেত আবার ফিরে আসলো। প্রেত বলল -- 'আমি উহা কবরস্থান হইতে তুলিয়া আনিয়াছি। আমি এখানে মেঝের উপর তাহা রাখিয়া দিলাম। আপনার স্বামী এবার ভাল হইয়া যাইবে।' এই বলে প্রেত ধচমচ করে ঘরের চৌকাঠের উপর দিয়ে লাফিয়ে বের হয়ে চলে গেল।

মনু মাঝি কেরোসিন শিখাটি প্রজ্বলিত করলেন। আমরা সবাই দেখতে পেলাম --- একটি মাটি মিশ্রিত পুরানো কৌটার ভিতরে কয়েকটি পায়ের নোখ (চারা) পড়ে আছে।


২৬.     পথের কড়চা

প্রাক যৌবন পর্বের কথা। সেবার ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ যাচ্ছিলাম। মহাখালী থেকে বিকেলের বাসে উঠে প্রথমে চলে আসি ভূয়াপুর। সেখান থেকে লঞ্চে সিরাজগঞ্জ। ভূয়াপুরের চর গাবসারা থেকে লঞ্চ ছাড়ে সন্ধ্যার আগেই। যমুনার জল ঠেলে ভটভট করে লঞ্চটি চলতে থাকে সিরাজগঞ্জ ঘাটের দিকে। লঞ্চের দোতলায় খোলা কেবিনে বসেছিলাম। চারদিকে শুধু জল আর জল। মাঝে মাঝে যমুনায় জেগে ওঠা চর দেখছিলাম। শীতের মৌসুমে কাশবন মরে শুকিয়ে গেছে। একটি সাদা কাশফুলও কোথাও দেখা গেল না।
মনটা একটু খারাপই লাগছিল।

নদীতেই রাত নেমে এসেছিল। শীতের কুয়াশা ঝরে পড়ছিল অথৈ জলের উপরে। সারা আকাশ জুড়ে জ্বলে উঠেছিল তারা। ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ তুলে লঞ্চটি ছুটে চলছিল ঘাটের দিকে। খুব ভাল লাগছিল রাতের আকাশ আর নদীর জল দেখতে। অথৈ পাথারে জলের উপর দিয়ে লঞ্চ চলছে তো চলছেই। কোথাও গ্রাম নেই। আলো নেই। এই রকম জলের পথ চলতে চলতে একসময় দূরে দেখা যাচ্ছিল সিরাজগঞ্জ শহরের নিয়ন বাতি। মন উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল একটু পরেই ঘাটে পৌঁছব।

সিরাজগঞ্জ ঘাটে পৌঁছতে রাত আটটা বেজে যায়। খুব খিদে লেগেছিল তখন। আমি ঘাটেই একটি হোটেলে যমুনা নদীর আইর মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে নেই। আমাকে যেতে হবে সিরাজগঞ্জ শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে আমাদের গ্রামে। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটেই ভাল ছিলনা। মানুষ সাধারণত হেঁটে চলত। না হয় টমটম কিংবা গুরুর গাড়িতে। আমি একটি রিক্সা নিয়ে শহরের বাহিরগোলায় চলে যাই। ওখানে টমটম পাওয়া যায়। যেয়ে দেখি, স্টেশনের কাছেই একটি শেয়ারিং টমটম দাঁড়িয়ে আছে। তিনজন যাত্রী টমটমে বসে আছে। আর একজন যাত্রীর জন্য কোচয়ান অপেক্ষা করছে। সৌভাগ্যক্রমে আমি চতুর্থ যাত্রী হয়ে টমটমটিতে উঠে বসে পড়ি।

পৌষের শীতের রাত্রি। যাত্রীগুলো সবাই চাদর গায়ে দিয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। তাদের মধ্যে একজন মেয়েও আছে।  টমটমটি একসময় কাটাখালী পার হয়ে রহমতগঞ্জ গোরস্থান অতিক্রম করছিল। গ্রামের পথঘাট সন্ধ্যার পরপরই খালি হয়ে গেছে। অন্ধকার রাত্রি। খুব ভয় ভয় লাগছিল। যে লোকগূলো টমটমে বসে আছে তাদের কাউকেই চিনতে পারছিলাম না। মেয়েটিকে তো আরো নয়। কেউ কারোর সাথে তেমন কথাও বলছিল না।

রাস্তার দুপাশের গ্রামগুলো ক্রমশ ঘুমিয়ে পড়ছে। দু একটি বাড়িতে টিমটিমে করে বাতি জ্বলছিল। ঘন কুয়াশায় ফসলের ক্ষেতগুলো ঢেকে গেছে। প্রান্তরের মধ্যে আরো বেশি নিকষ অন্ধকার। আস্তে আস্তে চোখ কেমন যেন ঘনিভূত হয়ে আসছিল। দূরদূরান্তের গ্রাম, বৃক্ষ, গাছ গাছালি কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।

পথে শৈলাভিটা খেয়াঘাটের কাছে একজন যাত্রী নেমে যায়। আমার ধারণা ছিল ওরা তিনজনই একে অপরের পরিচিত। কিন্তু একজন নেমে যাওয়াতে আমার সেই ভুলটি ভেঙ্গে যায়।

টমটমটি যখন সাহানগাছা গ্রামে পৌঁছে, তখন আরো একজন যাত্রী নেমে যায়। যাত্রীটি নামার পূর্বে আমাকে বলেছিল ---' আপনি কোথায় নামবেন? আমি বলি, ' সামনেই, ছোনগাছা হাট।'
লোকটি বলে ---- ' মেয়েটি একা। সে সম্ভবত হরিপুর যাবে। আপনি একটু খেয়াল রাখবেন।'

টমটমটি অন্ধকারের ভিতরে সামনের দিকে চলতে থাকে। হঠাৎ এমন একা হয়ে যাওয়াতে একটূ
ভয়ই লাগছিল। পাশেই শ্মশান ঘাট। শিয়াল হুক্কা হুয়া করে ডাকছে। পাকুর গাছে ডাকছিল পেঁচা। আমি আমার চোখ ভয়ে শ্মশান ঘাটের দিক থেকে ফিরিয়ে অন‍্য দিকে রেখেছিলাম।

মেয়েটিকেও মনে হলো, ভয় পাচ্ছে। সে তখনও চাদর মুড়ে দিয়ে হুবুজুবু করে বসে আছে। ঘোমটা দিয়ে থাকার কারণে তার মুখখানি আমি ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলাম না।

আমি কখনই আগ বাড়িয়ে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলি না। এবারও বললাম না। মেয়েটিও আমার সাথে কোনো কথা বললো না।

সামনের গ্রামটিই ছোনগাছা হাট। যেখানে আমি নেমে পড়বো। টমটমটি সেখানে পৌঁছলে কোচয়ানকে থামাতে বলি। আমি তাকে ভাড়া পরিশোধ করে নেমে পড়ি। খানিকটা পথ হেঁটে চলে আসছিলাম, তখন পিছন থেকে মেয়েটির সকরুণ কন্ঠস্বর শুনতে পাই --- 'তুমি আমাকে একা ফেলে রেখে চলে গেলে !'

 এ যে অনেকদিনের চেনা কন্ঠস্বর! আমি পিছনে ঘুরে তাকাই‌। কিন্তু টমটমটি ততক্ষণে দ্রুত অনেক দূরে চলে গেছে। বিপুল অন্ধকারের ভিতর কেবলই ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

ডিসক্লেইমার:  এটি নিছক একটি গল্প। বাস্তব জীবনের সাথে কোনো মিল নেই।


২৭.         এই জনারণ্যে

জীবনের এক ক্রান্তিকালে সব ছেড়ে ছুড়ে একদিন চলে এসেছিলাম রাশিয়ার নিষিদ্ধ শহর সামারায়। এই শহরেই শুরু হয়েছিল আমার জীবনের এক অধ‍্যায়।

সেদিন ছিল বসন্তের এক বিকেল। ভলগা নদীর তীর ধরে একাকী হাঁটছিলাম। মনটা ভালো ছিলনা। দূরে জিগোলস্কি পর্বতমালা ঢেকে ছিল মেঘে। উপত্যকায় জড়িয়েছিল কুয়াসার মায়াজাল৷ এখান থেকে দেখা যায় সামারার অপার্থিব যত সৌন্দর্য৷

রাশিয়ার এই প্রাকৃতিক শোভা মন্ডিত পার্বত্য শহরে ঘুরতে আসে অনেকেই। সেদিন এমনি ঘুরে বেড়াচ্ছিল কয়েকজন পর্যটক ভলগা নদীর তীরে । ছিপছিপে এক যুবতী বিস্ময় চোখে দেখছিল দূরের পর্বত শৃঙ্গ। হঠাৎই আমার চোখে চোখ রাখে সেই যুবতী৷ স্টাইলিশ আইরিশ মেয়েদের মতো এগিয়ে দিল তার ডান হাত৷ বলল ---
গুড ডে ……, মী... মেলেনা অরলোয়েস্কি।
মেলেনার সাথে পরিচয়টা হয়েছিল এইভাবেই।

আর একদিন লিবার্টি স্কোয়ারের  উদ্যানে সাক্ষাৎ হয়েছিল আমাদের। একটা ফাঁকা বেঞ্চের এক পাশে বসে কথা বলেছিলাম। বিকেলের দিকে এমনিতেই এ দিকটায় খুব ভিড় হয়না। কাছেই ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা অনেক সময় ভিড় জমায়। আড্ডা মারে। প্রেম করে। কিন্তু আজ ওসব ছিলনা। আজ বন্ধের দিন ছিল।

তখন বিকেলের রোদ ফিরে যাচ্ছিল আকাশের কোলে। মেলেনার সাথে টুকরো টুকরো অনেক কথাই হয়েছিল। জীবনের অপূর্ণতার কথা, আশা নিরাশার কথা এবং মেলেনার কথাও।

মেলেনা আমার ছবি আঁকার মডেল হয়েছিল। ওকে নিয়ে যে ছবিগুলো আঁকতাম, তা বিক্রি করে আমরা ভাগাভাগি করে নিতাম। একবার ওকে নিয়ে একটি ছবি এঁকেছিলাম। পিছনের ক‍্যানভাস ছিল,ভলগা নদী আর দূরের পর্বত শৃঙ্গ। ছবিটির নাম দিয়েছিলাম ---'এই জনারণ্যে।' ছবিতে অন্য কোনো মানুষ নেই। কিন্তু নাম দিয়েছিলাম জনারণ্য।

সুন্দর সুন্দর অনেক মুহূর্ত তৈরি করেছি আমরা দুজন। আমার মনে হতো, মানুষ অনেক কিছুই হারায়। আবার সেই শুন‍্যতায় ঈশ্বর অনেক কিছুই আবার পূর্ণ করে দেয়। যা হারিয়ে এসেছিলাম একদিন কোনো এক জীবনে, তাই আবার অকাতরে পেলাম এইখানে পূর্ণ করে। জীবন সবখানেই অনেক সুন্দর।

সেইবার উইন্টারে সামারাতে খুব তুষারপাত হয়েছিল ।   তাই ঐ শহর ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল আমাকে।  ছিলাম বার্লিনের এক ভবঘুরে আস্তানায়। একটি শীতকালের সমান বিচ্ছেদ ছিল। তারপর আবার চলে গিয়েছিলাম ঐ শহরে।

ভলগা নদীর তীরে মেলেনাকে আর খুঁজে পাইনি। আমি দেখেছি জিগোলস্কি পর্বত মালা থেকে অজস্র জমে থাকা পাথরের তুষার খন্ড জল হয়ে ঝরে পড়ছে ভলগার জলে।



২৮.      অতিথিনী

একবার একটি সরকারী কাজে সীতাকুণ্ড গিয়েছিলাম। পাঁচ ছয় দিন সেখানে থাকতে হয়েছিল। আমার থাকার ব্যবস্থা ঠিক করা হয়েছিল সীতাকুণ্ড স্টেশন লাগোয়া একটি ডাকবাংলোতে।  ছিমছাম নিরিবিলি পরিবেশ। অদূরেই পাহাড়, ঝোপ ঝাড় আর বন। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষেই রেল লাইন সমান্তরাল ভাবে চলে গেছে দুই দিকে।

বাংলোর কেয়ারটেকার ছিল একজন মধ্যবয়স্ক লোক। ওর কথাবার্তা আচার আচরণ আমার কাছে ভালোই লেগেছিল। বাংলাটিতে দুইটি আলাদা কক্ষ ছিল। আমি থাকতাম একটি কক্ষে। অন‍্য কক্ষটি তখন খালি ছিল।কেয়ারটেকার থাকত পিছনের একটি ছোট্ট টিনের চালা ঘরে।

আমার খুব ভালো লাগত জায়গাটি। অফিসের কাজ সেরে আমি প্রায়ই ঘুরতাম। কোনো কোনো দিন চলে যেতাম সাগরের কাছাকাছি । আবার কোনো দিন যেতাম পাহাড়ে। ঘরে বসে শুনতাম ট্রেনের হুইসেল আর ধাবমান ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ। কোনো কোনো দিন সন্ধ‍্যায় স্টেশনে যেয়ে চা'র দোকানে বসে চা খেতাম। আবার কখনও প্লাটফর্মের উপর হাটতাম একাকী। দ্রুতগামী ট্রেন এই স্টেশনে থামতনা। থামত লোকাল ট্রেন। তাও সারা দিনে দু-তিনটি।

সেদিন সকাল থেকে আকাশ গুরুগম্ভীর ছিল। তার আগের দিন থেকে শুরু হয়েছিল চন্দ্রনাথ মন্দিরে তীর্থ মেলা। এ উপলক্ষে সীতাকুণ্ডে বহু মানুষের সমাগম ঘটেছিল। রেডিওর খবরে জানা গেল সাগরে নিম্নচাপ শুরু হয়েছে। সাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে। সব মানুষের ভিতরে একধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে।

দুপুর থেকেই বৃষ্টি এবং ঝরো হাওয়া শুরু হয়ে যায়। সন্ধ্যার দিকে আরও বেশি। আমি একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম। তবে সীতাকুণ্ডে ঘূর্ণিঝড় যে আঘাত হানবেনা, তা খবরে নিশ্চিত হতে পেরেছিলাম। সেদিনের সেই রাতটি ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। দমকা ঝরো হাওয়া বয়েছিল, সাথে মুশুলধারে বৃষ্টি । ইলেকট্রিসিটি আগেই বিচ্ছিন্ন ছিল। বাংলো এলাকা, স্টেশন, পুরো জনপদ ছিল অন্ধকার। আমি রাতে একাকী বিছানায় শুয়ে আছি।  রাত তখন দশটা হবে। হঠাৎ বাইরে থেকে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। রুমে হেরিকেন জ্বালানোই ছিল। আমি যেয়ে দরজা খুলে বাইরে দেখি, কেয়ারটেকার। পাশে অদূরেই অবগুণ্ঠন দিয়ে একজন রমনী দাঁড়িয়ে আছে।

আমি বিব্রত হই। স্ত্রীলোকটিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে কেয়ারটেকার আমার রুমে প্রবেশ করে। এবং আমাকে বলে --- স‍্যার এই মহিলাটি খুবই বিপদগ্রস্ত। সে তার পরিবারের সাথে তীর্থে এসেছিল। কিন্তু তীর্থ যাত্রীদের ভীড়ে আর হঠাৎ ঝড় বাদলের অন্ধকারে সে তার সতীর্থদের হারিয়ে ফেলে। সে এই ঝড়ের রাতে স্টেশনে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। ওনার বাড়ি ভৈরবে। ভেবেছিল, ট্রেন পাবে, এবং অদ‍্যই চলে যাবে। কিন্তু লোকাল ট্রেন কাল ভোর ছয়টায়। ওনাকে স্টেশনে একাকী খুব অনিরাপদ মনে হচ্ছিল। তাই এখানে নিয়ে এলাম। স‍্যার, উনি এই পাশের রুমটিতে শুধু রাতটুকু থাকবেন। এবং প্রত‍্যুসেই সে চলে যাবেন।

আমি প্রথমে একটু দ্বিধা করছিলাম কিন্তু পরক্ষনেই রাজি হলাম। বললাম, থাকুক।

কেয়ারটেকার যেয়ে রুমের দরজাটি খুলে দেয়। এবং সেখানে তার থাকার ব্যবস্থা করে আবার আমার কাছে চলে আসে এবং বলে --- 'স‍্যার মহিলা আপনার কথা জেনে খুব ভয়ও পাচ্ছে, আবার সাহসও পাচ্ছে।'
আমি বললাম, তাকে বলে দিও --- 'সে যেন কোনো রুপ ভয় না পায়।' কেয়ারটেকার বলে, আমি তাই বলে দিয়েছি।'
রাতভর ঝড় হলো, বৃষ্টি হলো। আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। খুব ভোরবলায় ট্রেনের হুইসেলে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখলাম, ঝড় থেমে গেছে, বৃষ্টিও নেই। বারান্দায় কেয়ারটেকারের কথার আওয়াজ শুনতে পেলাম। মনে হলো মহিলাটি হয়ত এই ট্রেনটিতে চলে যাবে।

আমি উঠে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াই। দেখলাম ---মহিলাটি দ্রুত কেয়ারটেকারের সাথে স্টেশনের দিকে চলে যাচ্ছে। ট্রেন ছাড়ার শেষ হুইসেলও তখন বেজে উঠেছে। আমার দরজা খোলার শব্দ আর পায়ের আওয়াজ শুনে মহিলা পিছনে ফিরে তাকায়। আমিও দেখি তাকে, সেও আমাকে দেখে। কী যে এক বিস্ময়ের দৃষ্টি !  দেখি --- সে যে আমারই জন্মজন্মান্তরের পরিচিত একজন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন