সোমবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৮

কমলিকা

১৩.   কমলিকা

বহু বিস্মৃত বহু বছর আগের এই কাহিনী। কমলিকা নামে এক সন্ন্যাসিনী কবে মহেশখালী দ্বীপে এসে তপস্যায় বসেছিল, তা কেউ বলতে পারেনা। মৈনাক শিখরে আদিনাথ মন্দিরের কাছে দেবী দুর্গার মন্দিরের পাশেই সে থিতু হয়েছিল। জনশ্রুতি আছে এই তপস্বিনী এসেছিল উজ্জ্বয়িনী থেকে।

প্রতি বৎসর ফাল্গুনের শিব চতুর্দ্দশী তিথিতে মন্দির প্রাঙ্গণে পূজো-অর্চনা ও মেলা হয়। এসময় পূণ্য সঞ্চয় ও মনস্কামনা পূরণার্থে বিভিন্ন স্থান হতে আগত তীর্থ যাত্রীদের পদচারণায় মন্দির প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে। মন্দিরে বিরল প্রজাতির একটি পারিজাত ফুলগাছ রয়েছে। যেভক্তগণ প্রতিনিয়ত মনস্কামনা পূরণার্থে মানত করে গাছে সূতা বেঁধে রেখে যান এবং কামনা পূর্ণ হলে সূতা খুলে পূজা অর্পণ করেন।

এমনই ফাল্গুনের শুক্লা চতুর্দ্দশীতে এক নাগা সাধক এসেছিল মন্দিরে পূজা অর্চনা করতে। কী এক মনস্কামনা নিয়ে যখন সেই সাধক পারিজাত ফুল গাছে সুতা বাঁধতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই দেখা হয় কমলিকার সাথে। মুহূর্তেই যেন সাধকের হাত পা অবশ হয়ে গেল। তাঁর হাত থেকে সুতা মাটিতে পড়ে যায়। সে পুনরায় তা মাটি হতে তুলে পারিজাত গাছের দিকে এগুতে থাকে। দেখে সব পারিজাত ফুলগুলো ব্রহ্ম কমল হয়ে গেছে।

সাধক সুতা বেঁধেছিল ডালে। তবে পূর্ব মনস্কামনা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল তার। সুতা বাঁধতে বাঁধতে সে মনে মনে বলেছিল --- আমি কমলিকাকে চাই। মুখরিত মেলা প্রাঙ্গণে পূণ্যার্থীদের ভীড়ে কমলিকাও দেখেছিল এই ভিনদেশী সাধককে। চোখ মিলেছিল সাধকের চোখে। সে দুই চোখ বুজে ফেলে। পুনরায় চোখ মেলে দেখতে পায় ---পারিজাত ফুলগুলো আজ বেশি রক্তিম হয়ে আছে। সে অনুভব করে, তার শরীরের বহমান রক্ত কনিকাগুলো ঐ রকমই লাল হয়ে উঠেছে। সে দ্রুত পদ ফেলে ফিরে আসে আশ্রমে।

কমলিকা দুই দিন আশ্রম থেকে বের হলোনা। সে বিছানায় শুয়ে কেবল অশ্রুপাত করেছে আর ভেবেছে --- যে প্রেম তাকে ঘর ছাড়া করেছে , যে প্রেমের গ্লানি ভুলে থাকার জন্য তাকে সন্ন্যাসিনী হতে হয়েছে। সেই রকম অভিশপ্ত কোনো মায়ার টানে নিজেকে আর জড়িয়ে ফেলতে চায়না।

এই দুই দিনে মেলা প্রাঙ্গণের কোলাহল অনেকটাই
স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। মনকে আর শরীরকে সে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আজ বড়ই ইচ্ছা হলো মন্দিরে সন্ধ‍্যা পূজা দেবার। কমলিকা আশ্রম থেকে বাহির হয়। সে পথ চলতে থাকে মন্দিরের দিকে। পাহাড়ে ওঠার সোপান গুলোতে সে পা ফেলতে পারছিলনা। পা কেমন থেমে থেমে যাচ্ছিল। সে হাঁপিয়ে উঠছিল বারবার। হঠাৎ পিছন থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেল --- 'আমি কী আপনার হাতটি ধরব?'

এ যেন বহু বছরের পুরনো এক মহাজাগতিক কন্ঠস্বর। কোন্ দেবালয়ের দেবতা আজ এইখানে, এই সোপান উপরে। চোখ তুলে দেখতে পেল, সেই ভিনদেশি সাধক। যাকে সে দেখেছিল পারিজাত বৃক্ষ তলে। ততক্ষণে সাধক কমলিকার একটি হাত তার বাহুতে জড়িয়ে নিয়েছে।

অনেক রাত পর্যন্ত কমলিকা প্রণমিত ছিল দেব মূর্তির পদপাশে। নিরব অশ্রু বর্ষনে সে প্রার্থনা করেছিল পরমেশ্বরের কাছে --- 'আমাকে তুমি প্রেম দিওনা। দিওনা কোনো পাপ। কোনো অনাচার দিওনা। জগতের যত আনন্দ কেড়ে নাও। যত মর্মরিত দুঃখ বেদনাও।'

কখন রাত্রি মধ্যপ্রহর হয়েছে জানতে পারে নাই। দেবালয় খালি হয়ে গিয়েছে। কমলিকা মন্দির থেকে বের হয়ে আসে। সে দেখতে পায়, সাধক ফটকে তার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় --- আকাশ ভরা তারা আছে। নিশীথের নিঝুম মৌনতা আছে। কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়িঞ্চু চাঁদ তখনও অস্তমিত হয়নি। তখনও মান্দার ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে চারদিক। সাধকের আবারও সেই বিনীত কন্ঠস্বর --- 'তোমাকে আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে আসি।'

আবারও সেই পুরোনো মায়ার টান। আবারও যেন পথ ভুল করে ফেলল আশ্রমের যাওয়ার পথ। তখন সাগরের মোহন শব্দ ভেসে আসছিল। আস্তে আস্তে চাঁদ ডুবে যাচ্ছিল পশ্চিমের মেঘের নীচে। মায়াবী এক আঁধার নেমে আসে মৈনাক পাহাড়ে। তপস্বিনী আর তপস্যায় রইলনা। সন্ন্যাসিনীরও রূপ হারাল তার। কমলিকা হয়ে উঠল সম্পূর্ণ মানবী। আবারও সে একই ভুল করে ফেলল তার প্রথম যৌবনের ভুলটির মতো। এক অপার্থিব প্রেম প্রকাশিত হলো দেহ থেকে দেহান্তরে। একি পাপাচার, নাকি পূণ্যময়তা‌।

ভোর হওয়ার আগেই সাধক কমলিকাকে আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে পারিজাত গাছটির কাছে ফিরে আসে। গাছে বেঁধে রাখা মনস্কামনার সুতাটি খুলে ফেলে। তারপর মন্দিরে যেয়ে পূজা দেয় দেবতার। অর্চণার সময় সে দৈব বানী শুনতে পায় --- 'তুই পাপ করে এসেছিস। তোর পূজা আমি নেবনা। তূই দূর হয়ে যা এখান থেকে।'

সাধক ক্লেশে আর গ্লানিতে --- প্রভাতের সূর্য কিরণ বিচ্ছূরনের আগেই মন্দির ত‍্যাগ করলেন। এরপর তাকে আর ঐ দ্বীপে দেখা যায়নি কখনও।

তারপর থেকে তপস্যায় আর মন নেই কমলিকার। পূজাও দিতে যায়না মন্দিরে। কায়ক্লেশ ছেয়ে আসতে থাকে জীবনে। সে বুঝতে পারে একটি ভ্রুণের প্রাণ স্পন্দন। সারা দ্বীপময় তার কলংক রটে গেল। এক সেবককে কমলিকা অনুরোধ করে --- ' তুমি আমাকে কিছু পারিজাত ফুল ছিঁড়ে এনে দেবে?'

সেদিন ছিল পূর্ণিমার চাঁদভাসি রাত। সে চলে যায় সাগর কূলে। চাঁদের আলোয় জলের ভিতর দেখতে পায় নিজের মুখ। আর দেখে প্রণয়ের সৃষ্টিতে তৈরি হওয়া একটি শিশুর মুখ। সে পারিজাতের পাঁপড়িগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে জলে ভাসাতে থাকে।

দ্বীপের মানুষ সকালবেলা দেখতে পেল -- পারিজাতের ছেঁড়া পাঁপড়িগুলো সাগর জলে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে।

১২.       রূপালী রাত্রি

বহু বছর আগে বর্ষা দিনের এক প্রসন্ন বিকেল। বৃহদ্বটু গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে স্বচ্ছ করোতয়া নদী। ঐ গ্রামেরই সন্ধ্যাকর নামে এক চারণ কবি নদীর কূলে একাকী বসে শুনছিল জলের কুলকুল ধ্বনি। নদী ছিল তখন ভরা যৌবনবতী। সারা নদীতে কোথাও একটি নৌকাও ছিলনা। মনুষ্যহীন সেই নির্জন নদীর তীরে বসে সন্ধ্যাকর যখন জলের ধ্বনি শুনছিল, তখন পাশের জগদ্দল বিহার থেকে কমলাবতী নামে একজন মন্দির সেবিকা নিরবে হেঁটে হেঁটে তার কাছে এসে বসেছিল।

কমলাবতী মাথা রাখে সন্ধাকরের বাহুতে। সেও হেলান দিয়ে বসে শুনছিল জলের শব্দ। কোথা থেকে কয়েকটি বালি হাঁস ডানা ঝাপটে ওদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। কেউই কোনো কথা বলছিলনা। এ যেন কথাহীন ভালবাসাবাসি।

তারপর নিরবতা ভেঙ্গে প্রথম কথা ছিল কমলাবতীর। আমাকে তুমি হরণ কর। আমাকে তুমি নিয়ে যাও দূরে কোথাও। বহু দূরের কোনো পাহাড়ের আড়ালে। ঘর বাঁধি যেয়ে নির্জন গুহায়। তুমি জানো, আমাকে তোমার করে মেনে নেবেনা সমাজপতি।

দখিনা বাতাস তখন বয়েছিল মৃদুমন্দ। কমলাবতীর মাথার চুল উড়ে পড়ছিল সন্ধ্যাকরের মুখের উপর। তখনকার সেই নিঝুম হূ হূ বাতাস কান্নার মতো করে নদীর শব্দের সাথে মিলে গিয়েছিল। কমলাবতী আবারও সন্ধ্যাকরের মুখপানে চেয়ে বলে --- তুমি কী আমাকে ভালবাস না ?
সন্ধ্যাকর বলেছিল : ভালবাসি, ভালবাসি।

সন্ধ্যাকর আর কমলাবতীর ভালবাসার কথা জানল করোতয়ার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বালি হাঁস‌। বৃক্ষ রাজিতে বসে থাকা সন্ধার পাখিরা, আর জানল বৃহদ্বটূ গ্রামের মানুষেরা। আরও জানল জগদ্দল বিহারের ভিক্ষু। মন্দিরের পুরোহিত। ধর্মপতি ও সমাজপতি।
কেউ বলল -- ছি ছি জাত গেল। কেউ বলল -- ধর্ম গেল। কেউ বলল -- ক্ষত্রিয়ের সাথে শুদ্রের মেলামেশা। ছি ! সব উচ্ছন্নে গেল।

সেদিন ছিল শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথি। সন্ধ্যাকর চলে যায় জগদ্দল বিহারে। প্রার্থনার ছলে কথা বলে কমলাবতীর সাথে। কমলাকে বলে --- আজ রাত্রিতে নদীর তীরে চলিয়া আসিও।

রূপালী রাত্রি। আকাশ ভরা তারা। সারা ভূবন জুড়ে জোৎস্নার ঢল নেমেছে। করোতয়ার স্রোত বেগ পেয়েছে যেন এই জোৎস্নায়। অতলান্ত প্রেমে ডুবে থাকা এক জোড়া যুবক যুবতী মিলেছে আজ এই শ্রাবণের রাত্রিতে। এই নদীর কূলে। পিছনের জঙ্গলে জোনাকি জ্বলছে। আকাশে চাঁদও জ্বলছে আকাশ প্রদীপের মতো। ঠিক এমন ক্ষণে সন্ধ্যাকর কমলাকে ডাকে --- কমলাবতী।

কমলার পরনে ছিল মন্দির থেকে দেওয়া এক প্রস্থ সাদা ধুতি কাপড়। মাথায় কোনো ঘোমটা নেই। তার মুখখানি অবনত। চোখে জল এসেছে কিনা বোঝা গেল না।
দূরে কোন্ অশ্বথ বৃক্ষ থেকে কোঁত কোঁত করে ডেকে উঠল পেঁচা। ঝপাং করে পাড় ভাঙার শব্দ হলো জলে। কমলাবতী ভয়ে যেন একটু কেঁপে উঠল। সে সন্ধ্যাকরকে জড়িয়ে ধরে। এবং পরম আবেগ জড়িত কণ্ঠে তার বুকে মুখ রেখে বলে --
ওগো, আমাকে তুমি দূরে কোথাও নিয়ে যাও‌।

সন্ধ‍্যাকর বলেছিল --- এই বিজন রাত্রিতে তুমি সামনে তাকিয়ে দেখ, কী সুন্দর জল! ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনি শোনো তার। যেন আমাদেরই ডাকছে ঐ জল। এই কূলে আর কেউ নেই। আছো তুমি । আছে তারা। আছে চাঁদ। তারও ঐ প্রান্তে আছে নীহারিকা।

কোথায় যেন মাটির পাড় ভেঙ্গে পড়ল। আর্তনাদের মতো ক্রন্দনের ধ্বনি শোনা গেল একবার। তারপর আর কাউকে দেখা গেল না সেখানে। তখন সেখানে ছিল কেবল জ‍্যোৎস্নাভূক রূপালী রাত্রি।

১০.         যশোর রোড

অনেক বছর আগে কোনো এক অবসন্ন জৈষ্ঠ্য্ দুপুরে হাটছিলাম যশোর রোড ধরে। জায়গাটার নাম ছিল গদখালি। বিভিন্ন ফুলের চাষ হয় সেখানে। রাস্তার উপর গাঁদাফুল, রজনীগন্ধা ও গোলাপের পশরা নিয়ে বসে থাকতো ফুল চাষীরা। উপরের দিকে তাকালে আকাশ দেখা যেতনা। বড় বড় রেইনট্রীর ঘন ডালপালা আর পত্র পল্লবে ঢেকে থাকত সেখানকার সুনীল আকাশ। তবুও হরিদ্রাব পাতার ফাঁক দিয়ে চলে আসত সূর্যের সোনালী আলো। আমি দেখেছি সে আলোর ছ্টায় মুহুর্তেই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল আমার পাশে হাটতে থাকা কান্তা গোমেজ নামে একটি মেয়ের মুখ।

আমি তার মুখের দিকে ফিরে তাকাই। সে মুখে কোনও মলিনতা ছিলনা। ছিলনা আবার হাস্যজ্জ্বল কোনো রেখাও। বিমুগ্ধ হয়েছিলাম সেই মুখখানিতে চেয়ে। সেদিন সেই অবসন্ন দুপুরে কোথাও বাতাশের শব্দ ছিলনা। রিমঝিম রোদ্র ছায়া ছেয়েছিল সারা গদখালিতে। আমরা হাটতে হাটতে নেমে পড়ি আলপথে। যেতে হবে কৃষ্ণপুর গ্রামে। ঐ গ্রামেই আমাদের অফিসিয়াল এ্যাসাইনমেন্ট।

হেঁটে যেতে যেতে পথের দুপাশে দেখেছিলাম গ্লাডিওলাস ফুলের প্রান্তর। রঙ বেরঙের ফুলের ফাঁকে ফাঁকে গ্রীষ্মের ফালি ফালি রোদ খেলা করছে ঝাড়ে । কখনও গ্লাডিওলাসের সৌরভের সাথে কেমন যেন মৌ মৌ সুর ধ্বনিত হচ্ছিল বাতাসে। কেমন যেন মর্মর মায়া হিল্লোলিত হচ্ছিল মেঠো পথের ধূলির উপরে। বাঁশি বেহালা আর পিয়ানো যেমন করে অ্যাকর্ডিয়নে একের পর এক মায়া জড়িয়ে যায়, তেমন করে নির্জন ফুলের প্রান্তরে ভালবাসার পাখিরা যেন হারিয়ে যাচ্ছিল।

এখানে কেউ কোথাও নেই। চারিদিকে এত ফুল, এত সৌরভ, উপর থেকে ঝুলে পড়া এমন নির্জন আকাশ, ফুলের বনে ফড়িং আর হলুদ প্র্রজাপতিদের এত গান। মনটা কেমন যেন উদাস উদাস লাাগছিল। চারদিকে ছিল অসীম মৌনাতাও। হঠাৎ সেই মৌনতা ভঙ্গ করে সেই মেয়ের কন্ঠস্বর শোনা গেল --- আর কতদূূর কৃষ্ণপুর গ্রাম ?
আমি বললাম -- ক্লান্তি লাগছে ?
--- না।।
--- রোদ লাগছে ?
--- না।
--- খিদে লাগছে ?
--- না।
--- খারাপ লাগছে ?
--- না।

মনে মনে বললাাম, কৃষ্ণপুর গ্রামটি আরো দূরে চলে যাক। রোদকে ঢেকে দিক মেঘ। মেঠো পথের দুপাাশের আচ্ছাদিত ফুলের প্রাান্তর দীর্ঘতর হোক। পথ যেন না ফুড়ায়।

আসলেই পথ শেষ হলোনা। গ্লাডিওলাসের পর শুরু হলো হলুদ গাঁদা ফুলের প্রান্তর। কাকতালীয়ভাবে মিলে যায় গাঁদা ফুলের রংএর সাথে কান্তার পরনের সালোয়ার কামিজের রং। তারপর, অফুরন্ত সেই ফুলের পথ হাটতে হাটতে কান্তাা যেন আর পথ চলতে পারলোনা। সে একটি গাঁদা ফুল হয়ে লক্ষ গাঁদা ফুলের মাঝে হারিিয়ে গেল। সেইদিন সেই সন্ধ্যায় সবাই দেখল -- একজনই মানব একাকী ফুলের ক্ষেতে ক্লান্তিতে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার শরীরময় গাঁদা ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু লেগে আছে।

তারপর জীবনের অনেক পৃষ্ঠা এক এক করে উল্টে গেছে। জীবন পাাতার কোনো পাতাতেই ক্ষণকালের রোদ্রছায়ার সেই আলো ছড়ানো মেয়েটি আর দ্যূতি ছড়াতে আসেনি। তারও অনেক বছর পরে একবার সোহাগ এন্টারপ্রাইজের একটি বাসে করে বেনাাপোল হয়ে কোলকাতা যাচ্ছিলাম। পথে যেতে যেতে সেই গদখাালি। যশোর রোড ধরে বাসটি যখন চলছিল -- দেখলাম, রেইনট্র্রিির ছায়াতল। রাস্তার দুপাশে অসংখ্য গ্লাডিওলাস ও হলুদ গাঁদা ফুলের আচ্ছাদিত প্রাান্তর। বাসের জানালা দিয়ে ফুলের ক্ষেতের মাঝে সেই মেঠো পথটি খুঁজছিলাাম। দেখতেও পেলাম সেই পথ। কী আশ্চর্য ! দূরাগত সেই মেঠো পথটি ধরে অজস্র গাঁদা ফুল সরিয়ে সরিয়ে কান্তা নামের সেই মেয়েটি আমার বাসটির দিকে ছুটে আসছে। ইশারায় ওকে ডাকতে না ডাকতেই বাসটি দ্রুত ওকে আড়াল করে চলে গেল।

৯.   কোমল গান্ধার

ছাদের কার্নিশের উপর একটি নীলকন্ঠী পাখি এসে বসেছিল। সেই পাখিটি দেখতে যেয়ে কনিকা দেখতে পায়, নীচে গলির মুখে একটি ছেলে দাড়িয়ে আছে। হঠাৎ দূর থেকে ওকে দেখে খুব ভাল লাগছিল কনিকার। সে একবার পাখিটিকে দেখছিল, একবার ছেলেটিকে। কিন্ত ছেলেটি কনিকার দিকে একবারও তাকালনা। সে আশা করছিল -- ছেলেটি অন্তত একটিবার উপরের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে তাকে দেখুক।

কার্নিশে বসে থাকা পাখিটি হঠাৎ উড়ে চলে যায়। সে দেখতে পায়, সেখানে কয়েকটি পালক পড়ে আছে। কনিকা পালকগুলো কুড়িয়ে তার ওড়নাতে রাখে।  ছেলেটি যে তাকে দেখলনা, এজন্য অভিমান হলো তার। রুমে এসে একটি একটি করে পালক ছিঁড়ে ফেলল সে। তারপর জানালার ধারে যেয়ে ছেঁড়া পালকগুলো পথের উপর উড়িয়ে দেয়। পালকগুলো যেয়ে ছেলেটির গায়ে পড়ে। ছেলেটি তখন উপরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় -- একটি মেয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পালকগুলো ফেলছে।

ছেলেটির নাম অমিত। সে এই পাড়ায় অতিথী হয়ে এসেছে বরিশালের আগৈলঝরা থেকে। একটি কর্কটীয় দুঃখ নিয়ে এসেছে ঢাকায়। সে তার মর্মর দুঃখের চাহনীতেই দেখল কনিকাকে। হঠাৎ তার দুঃখটি যেন সোনালি হয়ে গেলো। সে সরাসরি তাকিয়েছিল কনিকার চোখের দিকে। কনিকা যেন ঝিলমিল চিত্রিত স্বপ্ন এক। কিংবা সে তাকে এর আগে দেখেছিল কোনো এক মহাজাগতিক সহস্রাব্দ-প্রাচীন ভোরবেলার স্বপ্নে?

এই পৃথিবীতে পথ চলতে চলতে কত মানুষের সাথেই তো এমন হঠাৎ দেখা হয়। সবাইকে কী আর এমন করে একে অপরে ভাললাগে? এদের ভিতর থেকেই কখনও দুজন দজনকে ভাললেগে যায়। কনিকা আর ঐ ছেলেটির মধ্যে এমনই এক ভাললাগা তৈরি হয়েছিল।

বেচারাম দিউরির গলির মুখে মনোহারী দোকানদার রতন মিয়াকে কনিকা  চেনে সেই ছোটববেলা থেকেই। তার কাছ থেকেই সে খোঁজ নিয়ে জেনেছিল ছেলেটি চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এসেছে। কিন্তু তার যে কর্কট রোগ আছে তা রতন মিয়া জানতনা। কনিকা একটি চিরকুট লিখে রতন মিয়ার হাতে দেয় -- অমিতকে দেওয়ার জন্য। সেই চিরকুটে অমিতের সাথে তার দেখা করার কথা লেখা ছিল।

একদিন তারা দেখা করে বুড়িগঙ্গার পাড়ে। প্রথম কথা বলেছিল কনিকাই, প্রথমেই ছিল ভাললাগার কথা। তারপর একে অপরের নিবেদন। প্রতিশ্রুতি হলো ভালবাসার। অমিত যখন বলছিল -- আমিও তোমাকে  ভালবাসি। ' তখন বুড়িগঙ্গার জল কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছিল। পানিতে ঢেউ তুলে লঞ্চগুলো কর্কশ শব্দ করে হুইসেল বাজিয়ে চলে যাচ্ছিল দুরের কোনো বন্দরে।

কনিকার সাথে কথা হওয়ার পর অমিত দুই দিন ছিল ঢাকায়। তারপর চলে যায় বাড়িতে। যাবার আগের দিন আবার ওরা দেখা করে এই বুড়িগঙ্গার পাড়েই।
সেদিনও প্রথম কথা বলল কনিকাই -- 'আমাদের  মিলনে অনুমোদন দেবে না কেউ, চল আমরা পালিয়ে কোথাও চলে যাই।'
অমিত বলেছিল ---  'আমাকে এক দুই মাস সময় দাও। আমি বাঙ্গালোর যাব। সেখান থেকে ফিরে এসে এই ঘাট থেকেই দুজন লঞ্চে উঠব একদিন । মেঘনা, কীর্তনখোলা পার হয়ে চলে যাব অনেকদূর, অন্য কোনো বন্দরে। সেখানে আমরা ঘর বাঁধব। তুমি হবে কোমল। আমি হব গান্ধার। আমাদের জীবনে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সুর বাজবে রবিশংকরের সেতারের সুর ঝংকারের মতো।'

আজ বুড়িগঙ্গার জল কেমন যেন স্থির হয়ে ছিল। কোথাও থেকে উতল হাওয়া বইলনা। লঞ্চ, নৌকা আর যাত্রীদের কোনো কোলাহল নেই। অমিত তার বিষন্ন একটি হাত রাখে কনিকার হাতে। দুজন হাটতে থাকে নদীর কূলে ধরে। তখন সন্ধ্যা নেমে আসছিল। পশ্চিম আকাশের শেষ অস্তরাগের ছায়া এসে পড়েছিল কনিকার মুখের উপর। এক মায়াবী বিষন্নতায় কনিকা অমিতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল --- আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।

কোমল গান্ধার সুরটি এমনই যা ঘরের আলো নিভিয়ে একাকী শুনতে থাকলে চোখ সিক্ত হয়ে যায়। একাকীত্বের দিনে বিরহের অত্যাচারে পুড়তে থাকা মনে এর প্রভাব এতটাই যে, দুঃখের মেঘ আকাশে উড়ে বজ্রপাত ঘটায় কোমল গান্ধারে। সব সুর ঘুরে ঘুরে অসীম দিগন্তের মেঘ তলে থমকে যায়। কনিকার জীবনও এমনি এক অসীমে থেমে গেল। বাঙ্গালোরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অর্কবতী নদীর তীরে এক শ্মশান ঘাট থেকে অমিতের দেহ ভস্মের ছাই উড়ে আসেনি ঢাকার বেচারাম দেউরির আকাশে। কিংবা বাতাসে ভেসে আসেনি তার পোড়া মাংসের গন্ধ। অমিত কনিকার জীবনে কোমল দুঃখ হয়েই থাকল। গান্ধার হয়ে আর আসেনি।

৭.   বনবেশ্যা

এই কাহিনীটি শুনেছিলাম একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছ থেকে। অফিসের কাজে সেবার গিয়েছিলাম রামুতে। আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল রাবার বিভাগের একটি ডাকবাংলোতে। কী সুন্দর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই রামু। যে দিকে তাকাই শুধুই -- রাবার বাগান, মেহগনি, জারুল আর সেগুন গাছের সারি।

প্রথম দিনের কথা। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দূরে কোথাও থেকে জন কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছিল । বাংলোর কেয়ারটেকার ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করি --- এটি কিসের শব্দ শোনা যায়? ও বলে,  'একটু দূরেই বৌদ্ধ বনবিহার। ওখানে আজ বিশেষ প্রার্থনা হচ্ছে। ছোট একটি মেলাও বসেছে। জন মুখরতার এই শব্দ  আসছে ওখান থেকেই। ''  আমি বলি --- আমাকে তুমি ওখানে নিয়ে চলো ।'

আমি ওর সাথে চলে যাই ঐ বৌদ্ধ বিহারে।  ঢুকতেই দেখি --- মন্দির  প্রাঙ্গণে পাইন গাছের নিচে  চল্লিশোর্ধ্ব একজন ভিক্ষু বসে আছে। পরনে কমলা রঙের ধূতি কাপড়। দেখতে অনেকটা সন্ন্যাসীদের মতো। সন্ন্যাসীর মতো কাউকে দেখলে, আমি কেমন যেন বিচলিত হয়ে যাই ।  কেন জানি মূহূর্তে দেখা এই লোকটিও আমার নজর কেড়ে নেয়।

বিহারের ভিতরে প্রবেশ করে দেখি মহামতি বুদ্ধের পিতলের মূর্তি। মূর্তির চারপাশে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ বসে প্রার্থনা করছে। আমিও ওদের সাথে বসে মঙ্গল প্রার্থনায় অংশ নেই। প্রার্থনা শেষে উপসানালয় থেকে বের হওয়ার সময় ঐ ভিক্ষুকে আবারও দেখতে পাই। আমার খুব কৌতুহল হয় ওর সাথে কথা বলবার।

ওর নাম ছিল হংসধ্বজ সেরিং। বান্দরবানের থানচি থেকে সে এসেছিল। সীমান্তবর্তী মদক পাহাড়ের গহীন অরণ্যে রেমাক্রীতে ওদের বাড়ি। উপত্যকার বুক চিরে বয়ে আসা শঙ্খ নদীর পাড়ে ওর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এক অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ ছিল হংসধ্বজ। কিয়াং এর পাশে এক টিনের ছাউনিতে হংসধ্বজ থাকত। তারুণ্য উদ্ভাসিত জীবন আমার তখন। পথ চলতে চলতে অদ্ভুত এই ধরণের মানুষদের সাথে পরিচয় হলে কেন জানি আমিও মিশে যাই তাদের জীবনের সাথে।

একদিন সন্ধ্যায় হংসের  ওখানে যেয়ে দেখি, সে একাকী বসে আছে। ঘরের ভিতর অন্ধকার। আমাকে দেখে সে একটি কেরোসিনের শিখা ধরায়। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে পকেট থেকে সে দুটো চুরুট বের করে বলে --- 'এটি বার্মিজ ভেষজ চুরুট। তুমি একটি খাও। খুব ভালো লাগবে। তোমার যদি কোনো দুঃখ থাকে, তুমি সব ভুলে যাবে।' আমি বললাম -- ' আমার তো কোনো দুঃখ নেই। ' হংস আবার বলে -- 'তুমি যদি সুখীও হও তারপরও তোমার ভাল লাগবে, তোমাকে আরও বেশি সুখী মনে হবে ।'

দুজন দুটো চুরুট ধরাই। দুজনই টানছিলাম সুখ আনন্দে। নিজেকে তখন সত্যিই সুখের অধিক সুখী মানুষ মনে হচ্ছিল। আলো অাঁধারে দেখছিলাম হংসধ্বজকে। ওকে দেখে মনে হলো --- ও কোনো দুঃখ ভুলেনি। রুমটি কেমন যেন ধূয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। বৌদ্ধ মন্দিরে আজ কোনো কোলাহল নেই । বাইরে বনতলায় নিরবতা নামছে আকাশ ভেঙে। আমি হংসধ্বজকে বলি --- তুমি কী তোমার দুঃখ ভুলে যেতে পেরেছো?
হংস :  না।
আমি :  কী এমন দুঃখ তোমার? আমাকে বলোনা!
হংস :  চলো বাইরে যাই। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

বনতলে হাটতে হাটতে আমরা একটি পুকুর ঘাটে যেয়ে বসি। সেই সন্ধ্যা রাতে অনেক কথাই শুনেছিলাম হংসধ্বজের কাছ থেকে। আমার কাছে মনে হয়েছিল, কিছু কথা বলেছিল সে স্বাভাবিক ভাবে। কিছু বলেছিল উন্মাতালের মতো। হংসধ্বজের মুখ থেকেই ওর কথাগুলো শোনা যাক।

আমাদের রোমাক্রীতে শঙ্খ নদীর তীরে পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার আছে। বংশানুক্রমে সেই বিহারের ভিক্ষু হতে হলো আমাকে। এর আগে ছিল আমার বাবা, তার আগে আমার দাদা।  আমাকে এই বৌদ্ধ বিহারের  দায়ভার নিতে হবে জেনে আমি প্রথম থেকেই বৈরাগ্য জীবন বেছে নিয়েছিলাম। বিবাহ কিংবা সংসার ধর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করি নাই।

এক প্রবারণা পূর্ণিমা দিনে বিহারে আসে এক বৃদ্ধা। তার সাথে ছিল বিশ বাইশ বছরের এক তরুণী। এর আগে এদের কোনো সময় কিয়াং এ প্রার্থনা করতে দেখিনি। পরিচয় পেয়েছিলাম, তারা সীমান্তের ওপারে ব্রহ্মদেশের বাসিন্দা। বৃদ্ধা সমর্পণ ভঙ্গিতে বিনীত করে বলে, বাবা, তুমি আমার এই মেয়েকে মঙ্গলের পথে ফিরে নিয়ে এসো।

তরুণীর নাম জিনা অংপ্রু। উপত্যকার এক ভাসমান বন বেশ্যা। মেয়েটি এত সুন্দরী ছিল যে, সে নাকি তার খদ্দরের বাইরেও প্রতিদিন ধর্ষিত হত। সীমান্তের ওপার থেকে ওর বৃদ্ধা মা নিরুপায় হয়ে তাই এই রেমাক্রীতে ওকে নিয়ে চলে আসে। এখানে এক পরিচিতের কাছে আশ্রয় নেয়। আমি বৃদ্ধাকে বলি, তুমি ওকে সাথে করে কয়েকদিন এই মন্দিরে নিয়ে আসবে।

মেয়েটি প্রায় তিনমাস প্রতিদিন মন্দিরে এসেছিল। আমি তাকে বুদ্ধের অমোঘ বানীগুলো শোনাতাম প্রতিদিন। মেয়েটি যেন সুস্থ জীবনে ফিরে আসে, তার জন্য তাকে বোঝাতাম আমার যত চিন্তা চেতনা দিয়ে। ওকে বলতাম, আমার সংসার নেই। কিন্তু আমি ভালবাসি এই বৌদ্ধ বিহার। দীক্ষা নিয়েছি ধর্মের। বুদ্ধের অমিয় বানী আমার আত্মাকে দিয়েছে শান্তি। তুমি সুন্দর জীবনে ফিরে আস। কাউকে বিয়ে কর। ঘরকে ভালবাস।  সংসার পাতো। সন্তান নাও। ওকে বুঝিয়ে বলতাম ---  মানুষের কামনা-বাসনা সবই দুঃখের মূল। ঐসবের মাঝে যে সুখ আসে তা দুঃখ মিশ্রিত এবং অস্থায়ী। অবিমিশ্র সুখ বলে কিছু নেই। নিবার্ণ লাভে এই দুঃখের অবসান ঘটে। কামনা-বাসনার নিস্তারের মাঝে পূর্ণ শান্তি অর্জিত হয়।

মেয়েটি আশ্চর্যজনক ভাবে তার জীবনধারা বদলিয়ে ফেলে। মোহ কাটিয়ে নির্বাণ লাভ করে বুদ্ধের অহিংস বানীতে। সে ধর্মের প্রতি আসক্ত হয়ে ওঠে। এবং রোমাক্রীর এই বৌদ্ধ বিহারের  সেবিকা হয়ে যায়। নদীতীরে বনভূমির এই বিহারের জন্য মেয়েটি প্রতিদিন ঘটে করে জল আনত নদী থেকে। আমি নির্মোহ ভাবে অবলোকন করতাম তার চলাফেরা, তার প্রতিদিনের জীবন পট।

একদিন বসন্তের আবেশ হিল্লোলে অরণ্যের বাতাস স্পন্দিত হচ্ছিল। পলাশ ও কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম উচ্ছ্বাসে আকুল হয়েছিল অন্তরীক্ষ। কুসুমার্দ্র সুবাসে সুরভিত হয়ে উঠেছিল বনভূমি। কোকিলের কূজনে কুহরিত হচ্ছিল দশদিক। যেন ভ্রমর এসে বসেছে প্রসূনের বক্ষে। প্রকৃতির নিয়মে বিমুগ্ধ হরিণ-হরিণীর মতো কী এক আবেগে আমরা আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে যাই।

ঋতু বসন্তের কোন্‌ আচম্বিত বাসনায় জিনা অংপ্রু তার বক্ষের উত্তরীয় উন্মুক্ত করে দিল। স্তনপট্টের উপর দিয়ে কুচকুম্ভের স্পষ্ট আভাস দেখা দিল। আমি উদাত্ত জিনাকে দেখছিলাম মুগ্ধ চোখে। কিন্তু সহসা একটা দমকা বাতাস এসে সব এলমেল করে দিল। চকিতে সরে গিয়ে সে অরণ্যের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

তাকে সেদিন আর খুঁজে পাওয়া গেলনা। পরেরদিন জিনা অংপ্রুর মৃতদেহ গ্রামের লোক খুঁজে পেল শঙ্খ নদীতীরে বনঝোপের ভিতর থেকে। তার সমগ্র শরীর বিষ নাগিনের ছোবলে ক্ষত বিক্ষত ছিল।

------------------------------------------------------------------------

ডিসক্লেইমার :  এই গল্পের দুটো প্যারা আমি সন্মাত্রানন্দ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছি।

৪.  কেবলই দুঃখের শ্বাস

এই শহরে পথ চলতে চলতে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া কতজনকে যে খুঁজে বেড়াই। পৃথিবীর কত অলিতে গলিতে হন্ন হয়ে হাঁটি কাউকে আর একটিবার দেখবার জন্য। কত প্রিয় মুখ ম্লান হয়ে আছে কত কাল ধরে। আমি কেবল আকুল হই। কিন্তু কারোরই দেখা পাইনা। এ রকম কত যে মুখ অনেক দূরের স্বপ্ন হয়ে আছে।

আবার কিছু মুখের কথা মনে নেই। কিংবা মন চায়নি কখনও তাদের দেখতে। বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেছে তারা। এই রকমই না দেখতে চাওয়া বিস্মৃত কত মুখ যে আঁধারে পড়ে আছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।  সেই রকমই হারিয়ে যাওয়া একটি মুখের দেখা পেয়েছিলাম একদিন, যার নাম আব্দুল মান্নান।

বারডেম হাসপাতাল থেকে পরিচিত এক রোগীকে দেখে পথের উপরে নেমে হাঁটছিলাম। কোনো মুমূর্ষু মানুষকে দেখার পর মন ভাল লাগার কথা নয়। যদি তিনি থাকেন জীবনের প্রান্ত সীমায় দাঁড়িয়ে। বিষন্নতায় মনটা তাই ছেয়ে আসছিল । তখন সন্ধ্যা ঘনয়মান। একটি সিগারেট কিনে ধরাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময় দেখি, আরও একজন মানুষ সিগারেট কিনছে। আমি তার দিকে তাকাই, সেও আমার দিকে তাকায়। দুজন দুজনকেই চিনতে পারি।

ওনার নাম আব্দুল মান্নান। একবারই দেখেছিলাম তাকে। সেও বহু বছর আগে। একবার দেখা এই মুখটিকে এত বছর পরও চিনতে পারলাম। ওনার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল নীলু। ওরা তখন কেনাকাটা করে বের হচ্ছিল নিউমার্কেট থেকে। ঠিক গেটেই হয়েছিল দেখা। নীলু বলেছিল --- 'ইনি আমার হাজব্যান্ড।' আর আমাকে দেখিয়ে ওর স্বামীকে বলেছিল, 'ওর নাম শুভ্র। আমার ইউনিভার্সিটি বন্ধু।' আশ্চর্য লাগল -- সামান্য মুহূর্তে দেখা এই আব্দুল মান্নানকে মনে রেখেছি এতদিন!

কিছুটা বিমর্ষ কন্ঠে প্রথম কথা বলেছিল আব্দুল মান্নান, কেমন আছেন আপনি?
--- ভাল আছি। আপনি ভাল আছেন?
--- ভাল মন্দ মিলিয়েই আছি। জানেন, অনেক দিন আগে আমি একবার কলাবাগানে একটি মেসে আপনাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। আপনি ছিলেন না। আপনার মেসমেট রা বলেছিল, 'উনি এখন এখানে থাকেন না।' আপনি কোথায় থাকেন, তাও তারা বলতে পারেনি।
---- কেন গিয়েছিলেন ?
---- সে অনেক কথা। আমার হাতে সময় খুব কম। যদি সময় থাকত, তাহলে সব কথা বলা যেত। আমি অপেক্ষা করছি, এই রাস্তার উপরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি গাড়ি আসবে। আমি সেই গাড়িতে উঠে চলে যাব।
--- কিছু কথা নাহয় বলেন, আমি শুনি।

আব্দুল মান্নান বলছিলেন --- 'এখান থেকে রমনা পার্ক বেশি দূরে নয়। এই পার্কে একদিন বিকালে নীলুকে নিয়ে আমি এসেছিলাম বেড়াতে। নীলু চিনে চিনে লেকের পাড়ে একটি কড়ই গাছের ছায়ায় বসে। মাঝে মাঝে কড়ই গাছ থেকে মরা পাতা ঝরে পড়ছিল। নীলু বলছিল, এই ঝরা পাতা আগেও একদিন এমনি করে ঝরে পড়েছিল। আজও পড়ছে।
নীলু বলেছিল, দেখ -- 'লেকের জল কত স্বচ্ছ। কী স্তব্ধ হয়ে আছে দুঃখিনীদের মতো। তুমি একটি ঢিল ছুড়ে দাও ঐ জলে।'
আমি ঢিল ছুড়েছিলাম সেই নিস্তব্ধ জলে। জলের সেই তরঙ্গ আর আলোড়ন দেখে নীলু বলেছিল ---'হলোনা তোমারটা।'

মান্নান সাহেব আরো বলছিল ---
'আর একদিন নীলুই আমাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল বুড়িগঙ্গার ধারে। আমি বলেছিলাম, চলো সদরঘাটের প্লাটফর্মে যাই। ওখানে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখব, বুড়িগঙ্গার জল। নীলু সেখানে গেলনা। সে আমাকে নিয়ে গেল ওয়াইজ ঘাটে। সে বেছে বেছে একটি শানকরা ঘাটের উপর দাঁড়াল। মনে হলো, এই ঘাট এই নদী এই পথ ওর অনেক দিনের চেনা।
আমাকে নীলু বলেছিল, 'আজকের নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আনন্দের মনে হচ্ছে না। এর চেয়ে ক্রন্দনের শব্দ অনেক সুন্দর।'

মান্নান সাহেবকে একটু পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছিল। সে আবারও একটি সিগারেট কিনে ধরায়। আমাকেও একটি অফার করে। তিনি বলছিলেন --- ' আপনি কী কখনও জীবন মূত‍্যু সন্ধিক্ষণের মানুষের চোখের পাতা দেখেছিলেন? ঐ সময়ে তাদের চোখগুলোতে জলের কনা চিকচিক করে। বলতে পারেন, কেন সেই জলগুলো অমন চিকচিক করে?'

মান্নান সাহেব বলছিলেন ---
'ঐ যে হাসপাতালটা দেখছেন, এর নাম ছিল পিজি হাসপাতাল। এই হাসপাতালটিতে একটি মেজর অপারেশন হয়েছিল নীলুর। আমি একজন ডাক্তার, তাই অপারেশন থিয়েটারে থাকবার অনুমতি পেয়েছিলাম । একজন রোগীকে যখন এ‍্যানেস্থেসিয়া দেয়া হয়, সে তখন অজ্ঞান অবস্থায় অনেক কথাই বলে। নীলুকে যখন এ‍্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয়, অজ্ঞান অবস্থায় সে বারবার আপনার নাম বলেছিল। চোখের কোণ থেকে তখন চিকচিক করে জল ঝরে পড়ছিল। আর বিরবির করে বলছিল -- 'আমি শুভ্রকে দেখব।'

মান্নান সাহেবের কন্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। এবং কথা বলতে যেয়ে থেমে থেমে যাচ্ছিল। আমি বললাম --- তারপর নীলুর কী হলো? ও এখন কেমন আছে ? মান্নান সাহেব বলছিল --- সেদিন ছিল শুক্রবার। আমার বাসা তখন জিগাতলায় । মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে বের হয়েছি। মনটা কেমন যেন উদাস লাগছিল। এত শূন্যতা এত হাহাকার এই জীবনে। ভাবলাম, আপনার সাথে একটু দেখা করব। হাঁটতে হাঁটতে সেই দিনই চলে গিয়েছিলাম কলাবাগানে আপনার মেসে। কিন্তু আপনাকে পাইনি।

হঠাৎ সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কার আমাদের সামনে এসে থামে। রাস্তার উপর গাড়িটা থামানো দেখে ট্রাফিক পুলিশ এসে চালককে ধমকাতে থাকে। মান্নান সাহেব তখন আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত গাড়িতে গিয়ে ওঠে।

আরও কিছুক্ষণ আমি একাকী দাঁড়িয়ে থেকেছিলাম পথের উপরে। বিপন্ন দুটো চোখ তাকিয়ে দেখছিল বহু বছর আগের বিস্মৃত কিছু মধুময় স্মৃতির দিকে। বুকের অতল থেকে একটি দুঃখের শ্বাস বেরিয়ে এল।
তারপর, সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে ফুটপাতের পথ ধরে সামনের দিকে হাঁটতে থাকি।

১. মায়া মরিচীকা

হঠাৎই আচ্ছন্ন হয়ে থাকি। ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি কোনো মুপ্রতিতী যেন। স্বপ্ন আর কল্পনার পার্থক্য অনেক সময় বূঝতে পারিনা। শত বছর আগের পুরোনো ধূলি মাখা কোনো পথ। এক গায়েন কবি পায়ে ধূলি উড়িয়ে হেঁটে এসেছিল কুসুমপুর।

ইছামতির তীরে ছোনপাতা ঘরে তার বাস। পিছনে ঘন বাঁশ ঝাড়। উঠোনেই একটি বাবলা গাছ। গাছ ভরা ছোট ছোট হলুদ ফুল। বাবলা তলায় বসে থাকত কবি, অনেকটা সিদ্ধার্থের মতো। কার কথা মনে করে তাকিয়ে থাকে বিষন্ন চোখে ইছামতির জলের দিকে।
মনের দুঃখ কী ঝরে পড়ে যায়? মৃত্যুর পরে মানুষের কী হয়? এসব সে ভাবে। তারপর চোখ মেলে তাকায়। চারিপাশে সব কিছু কেমন কোমল সবুজ হয়ে আছে। আকাশটা কেমন নীল। মেঘগুলো ধীরে ধীরে কোথায় ভেসে যাচ্ছে যেন। সে চোখ বুজে থাকে। কখনো চোখ খুলে এই মাঠ, এই জলফড়িং, এই মেঘ, এই আকাশ সে দেখে।

ঠিক তখনই দূর থেকে হেঁটে আসে একটি মেয়ে। সেও আসে শতাব্দী পুরানো ধূলি পথের পথ ধরে। সব কবিদের জীবনেই হয়ত এমন স্বপ্ন দেখানিয়া রমণীর আগমন ঘটে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হলোনা। সেই মুখরিত রমণীর খিল খিল হাসির শব্দে সে চমকে ওঠে।

বাবলা গাছে হঠাৎ আচমকা বাতাস লেগে হলুদ ফুল সব ঝরে পড়তে থাকে। সেই নির্জন দুপুরে বাবলা গাছের তলায় কী কথা হয়েছিল তাদের? কী প্রেম ছিল? ঐ মেয়েটার নামই বা কী ছিল? যাকে ইছামতির জলে ভাসতে দেখেছিল জেলে মাঝি মাল্লারা।


১৩.   মনে রেখো আমায়

মোঃ আব্দুল বারেক নামে আমার এক ফেসবুক বন্ধু কবে লিস্টে যোগ হয়েছিল মনে নেই। সে কখনই সক্রিয় ছিলনা। আমার কোনো পোস্টে লাইক কমেন্টও সে দিতনা।  গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে আমার ইনবক্সে একটি ম্যাসেজ আসে তার থেকে। সেখানে লেখা ছিল --
'শ্রদ্ধেয় ভাইজান,
আমার ছালাম গ্রহণ করিবেন। আমি নিতান্তই আপনার একজন পাঠক। আপনার লেখা আমি নিয়মিত পড়ি। খুব ভাল লাগে। কিন্তু আমি কোনো লাইক কমেন্ট দেইনা। যাহাহোক, পর সমাচার এই যে, আমি সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে এক নিভৃত পল্লীতে থাকি। আমি কবিতা লিখি। এইবার অনেক কস্ট করিয়া একটি কবিতার বই প্রকাশ করিয়াছি। আপনি যদি আমার কবিতার বইখানি পড়িতেন তাহা হইলে আমি খুব খুশি হইতাম। আপনি আপনার ঠিকানা পাঠাইলে আমার প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ' মনে রেখো আমায়' বইটি পাঠাইয়া দিতাম। '
আরজ গুজার ---
মোঃ আব্দুল বারেক।
মৌতলা, কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা।'

আমার খুব ইচ্ছা হলো এই কবির বইটি পড়তে।  আমি তাকে উত্তরে জানালাম, আপনি বইটি পাঠাতে পারেন একটি শর্তে। আমার কাছ থেকে সম্মানীর টাকা নিতে হবে। আপনার বিকাশ নাম্বারটি পাঠিয়ে দেন। আমি  টাকাটা পাঠিয়ে দিব। তিনি আমাকে তাই করেন এবং আমি টাকা ও ঠিকানা পাঠিয়ে দেই। যথারীতি দুইদিন আগে ' মনে রেখো আমায় ' বইটি আমার হস্তগত হয়েছে।

বইটির মুদ্রন মান খুবই নিম্নমানের। মফস্বলের কোনো এক অখ্যাত প্রেস থেকে বইটি ছাপা হয়েছে। প্রকাশক : মো: আবুল কালাম চৌং। প্রচ্ছদে হাতের সেলাইয়ের কাজ করা একটি রুমালের ফটোগ্রাফ। বিভিন্ন রঙের সুতা দিয়ে লতা পাতা ফুল আর পাখির ছবি আঁকা। অস্পষ্ট ভাবে লাল সুতার সেলাইয়ে লেখা আছে ---' মনে রেখ আমায়। ' পাতা উল্টিয়ে দেখলাম, প্রচ্ছদ পরিকল্পনা : মোসাম্মদ দিলারা বেগমের নকশি রুমালের ফটোগ্রাফ অবলম্বনে, মো : আব্দুল বারেক।

বইটির উৎসর্গ পত্র এইভাবে লেখা আছে :

'এই গ্রন্থটি আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী, আমার নয়নতারা নয়নের মনি মোসাম্মৎ দিলারা খাতুন কে উৎসর্গ করিলাম। যাহাকে অন্তর্যামি বেহেস্তে লইয়া গিয়াছেন।'

উৎসর্গ পত্রটি দেখে মনটা একটু খারাপই হলো। ' মনে রেখো আমায় ' বইটির সব পাতা এলমেল করে উল্টাতে থাকি। বইটি আমার কাছে পুরোপুরি কবিতার বই মনে হলোনা। গদ্য পদ্য মিলে একটি খন্ডিত আত্মকথা মূলক বই মনে হলো। কিছু কিছু লেখায় চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলাম, মো: আব্দুল বারেক তাঁর স্ত্রীকে অত্যধিক ভালবাসিত।

প্রথম দেখা :

বইয়ের প্রথম লেখাটির নাম 'প্রথম দেখা'। কবি মো: আব্দুল বারেক লিখেছে -- আমি তখন দশম শ্রেনীতে পড়ি। একদিন আশ্বিন মাসের বিকালে থানা পরিষদের কাঁচা রাস্তার উপর দিয়া হাটিয়া বাড়িতে আসিতেছিলাম। মেঠো রাস্তায় নামিয়া কিছুদূর আসিবার পরই শেখদের বাড়ি । আইল রাস্তার পাশেই একটি ছোট্ট পুকুরপাড় পরে । সেই পুকুরপাড়ে লিচু গাছ তলায় দাড়াইয়া থাকিতে দেখি দিলারা বেগমকে। মাথায় তাহার ঘোমটা দেওয়া ছিল। আমি তাহাকে দেখিলাম, সেও আমাকে দেখিল। দুজনের চোখ দুজনকেই দেখিয়া ভালো বাসিয়া ফেলিল।'
তারপরেই পদ্যে লেখা ---
'হেরিনু যখন পদ্ম আঁখি তাহার
ধ্যান যেন ভাঙ্গিতনা আমার, মুগ্ধ হইয়া দেখিতাম তাহাকে, যেমন দেখিত
বুদ্ধ তাহার আম্রপালীকে। '...তারপর
ধ্যান ভাঙ্গিত গৌতম বুদ্ধের। '

এক জায়গায় দেখলাম, কবি উল্লেখ করেছে -- ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর দাদাজান আমাকে বিবাহ করাইবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে। আমি দাদাজানকে বলিলাম, শেখ ৰাড়ির দিলারা বেগমকে যদি আমার সাথে বিবাহ করাইয়া আনেন, তবেই বিবাহ করিব। '
পরম আহলাদে নবপরিণীতা বধূকে নিয়ে কবির লেখা একটি কবিতা আছে এই রকম ---

' চাঁদ পরী আমার টিয়া পাখির শাড়ি পড়িয়া হাটে উঠানে,
মন আমার উৎফুল্ল হইয়া ওঠে
চুপি চুপি নয়ন মেলিয়া দেখি তাহাকে
আমার সাথে দেখে বেহুঁশ হয় আমার দাদাজান
বঁধুর পায়ের আলতা যেন আমার হৃদয়ের
রক্তের মতো লাল ... তারপর
থরথরিয়ে কাঁপুনি আসে, কখন নামিবে রাত্রি। '

'মনে রেখো আমায়' বইটি জুড়ে দিলারা কে নিয়ে ভালবাসার অনেক কথা লিখেছেন কবি। লিখেছেন তাদের দাম্পত্য খুনসুটির কথা, রোমান্টিক মুহূর্তের অনেক মধুর মধুর কথা লেখা আছে কবিতায়। অজো পাড়াগাঁর সামান্য এক অখ্যাত কবি এমন সুন্দর সুন্দর লেখা লিখিতে পারে, তা পড়ে সত্যিই আমি বিস্মিত হলাম।

কালিন্দী তীরে :

বইয়ের শেষের দিকে 'কালিন্দী তীরে' অংশটুকু কবি ৰর্ণনা করেছেন এইভাবে ---
'বাড়ীর পিছনে আমাদের কালিন্দী নদী। আমি প্রায়ই দিলারাকে নিয়া নদীর কূলে বেড়াইতে যাইতাম।  ওপারেই ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলা। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। সন্ধ্যায় আকাশে চাঁদ উঠিল। জ্যোৎস্নায় বান ডাকিল প্রান্তর জুড়িয়া। একবার ইচ্ছা হইল ঘরে বসিয়া কবিতা লিখি। কিন্তু তাহা করিলাম না। মন বড়ই চঞ্চল হইয়া উঠিল। দিলারাকে দেখিলাম -- একটি সাদা রঙের তাঁতের শাড়ি পড়িয়াছে। তাহাকে বলি,  চলো -- নদী দেখিয়া আসি। '
দিলারা আমাকে বলিল, ওগো, আমার বুকে একটু কান পাতিবে? শোনো, কেমন যেন নদীর কূলকূল ধ্বনি  বাজিতেছে। নদী যেন আমাকে ডাকিতেছে। তুমি আমাকে কালিন্দী তীরে লইয়া যাও। '

আমরা সেদিন রাতে গিয়েছিলাম কালিন্দী তীরে। যাইয়া দেখিতে পাই, ঘাটে একটি ছোট্ট ডিঙি নৌকা নিয়া বসিয়া আছে সন্তোষ মাঝি। আমরা ওর নৌকায় যাইয়া বসিলাম। নৌকা মাঝ দরিয়ায় চলিয়া গেল। অজস্র জ্যোৎস্নার রোসনাই আসিয়া পড়িতেছিল জলে। চিকচিক করিতেছিল জলরাশি। আমি দিলারার মুখের দিকে তাকাইলাম। দেখি  জগতের সকল সৌন্দর্য যেন ওর মুখখানিকে আলোকিত করিয়া ফেলিয়াছে। আমি আলো আঁধারিতে মুগ্ধ হইয়া দেখিতেছিলাম সেই রূপ। আমি ঝুঁকিয়া পড়িয়া একটি চুম্বন দিতে চাহিয়াছিলাম ওর কপালে। নৌকাটি তখন স্রোতের টানে ভাসিয়া চলিয়া যায় ভারতের জলসীমায়। হঠাৎ ওপারের দিক হইতে একটি গুলির শব্দ পাওয়া যায়। দেখি, দিলারা আমার বুকের উপরে লুটাইয়া পড়িল।'

শেষের কবিতাটি ছিল এইরকম :
'আমার রাত্রি শেষ হইতে চাহেনা, আমার দিন ফুড়াইতে চাহেনা,
পূর্নিমা আসে প্রতিমাসে একবার
শতবার আমার বুক পোড়ে চাঁদের আগুনে
কালিন্দীর ভাঙ্গনের শব্দ শুনি
মনে হয় বিসর্জন দেই এই দেহকে তাহারই জলে
এখনও যে আগুন জ্বলে
এখনও যে পরান পোড়ে তাহারই তরে।'


১৪.     যতই কালো হোক

গুনে গুনে দেখলাম আজ থেকে তিরিশ বছর আগের কথা। সেদিনও ছিল এমনই বসন্ত চৈত্রের দিন। তপ্ত রোদ্দুর ঝরে পড়ছিল আকাশ থেকে। আমরা বসেছিলাম মেঘনা ঘাটে। নাসরিন সকালবেলা সায়েদাবাদ বাস স্টান্ডে একটি চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে বলেছিল --  ' আজ তোমার সাথে হয় শেষ দেখা, না হয়, অনন্ত জীবনের শুরু। '

সায়েদাবাদ থেকে একটি লোকাল বাসে করে চলে আসি মেঘনা ঘাট। ব্রীজের কাছ থেকে নদীর কূল ধরে হাটতে হাটতে একটু পূর্ব দিকে চলে যাই। যতই দূরে যাচ্ছিলাম, ততই যেন জনশূন্য মনে হচ্ছিল নদীর কূল। এক জায়গায় কেমন যেন পোড়া গন্ধ পাচ্চিলাম। পোড়া কাঠ আর কয়লাও দেখতে পেলাম নদীর পাড়ে। এগারো বারো বছরের একটি বালক লুঙ্গী পড়ে খালি গায়ে আসছিল আমাদের দিকে। ওকে বলি --  এখানে কিসের পোড়া গন্ধ?
বালক :  স্যার, এখানে কাল বিকেলে লাশ পোড়াইছে। এটি একটি শ্মশান ঘাট।
নাসরিন : মেয়ে মানুষের লাশ ছিল, না, ছেলে মানুষের লাশ?
বালক :  আফা, মাইয়া মানুষের লাশ।

শ্মশান ঘাটটি পার হয়ে আমরা আরো কিছু দূরে চলে যাই। নদীর কূলেই দেখতে পাই একটি বড় নিম গাছ। আমরা দুজন সেই নিম গাছের তলে ঘাসের উপরে যেয়ে বসে পড়ি। জায়গাটা বেশ রোমান্টিকই মনে হ্চ্ছিল। দূরে ব্রীজের উপর দিয়ে অসংখ্য গাড়ি এদিকে ওদিকে ছুটে যাচ্ছে। নদীতে শ্যালো নৌকা ভটভট করে চলছে। মাঝে মাঝে দুএকটি লঞ্চও চলছে। পাশেই শ্মশান ঘাট। নিম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উপর থেকে আমাদের উপর চৈত্রের রোদ্দুর ঝরে পড়ছিল।

নাসরিন অনেকটা সুরঞ্জনার মতো করে বলে : ' এই খাঁখাঁ চৈত্র দুপুরে, এই শ্মশান ঘাটে কী কথা আমার সাথে? তোমার সাথে কেন যে আমার প্রেম হলো? তার চেয়ে নুরা পাগলা কিংবা শহীদ ডাকাত অনেক ভাল ছিল। ওরা ভাল প্রেমিক হতে পারত। '

আমি বলছিলাম --- 'আজ কয়েকদিন ধরে কেবল শ্মশান ঘাটের স্বপ্ন দেখছি। চন্দন কাঠে জড়ানো লাশ। দাউদাউ করে কাঠ আর লাশ পুড়ছে। স্বপ্নে এমনই একটি  নদী দেখেছি। এখানে আসার পর সবকিছুই কেমন যেন মিলে যাচ্ছে। ঠিক যেন স্বপ্নে দেখা সেই জায়গা! সেই নদী, সেই নিম বৃক্ষ।'

কাছেই তাকিয়ে দেখি, মেঘনার উপর দিয়ে যাত্রা পার্টির একটি নৌকা যাচ্ছে।  হারমোনিয়ামের কড়া সুরের তালে একটি মেয়ে ঘাঘরা পরে নাচ্ছে আর গান গাচ্ছে :
' “হাওয়া মে উড়তা যায়ে,
মেরা লাল দোপাট্টা...মল মল কা হো জি...হো জি।”

আমি নাসরিনকে বলি : 'দেখ মেয়েটি কী সুন্দর করে গান গাচ্ছে। তুমি যদি ঐরকম একটি নটী হতে, কী যে সুন্দর লাগত তোমাকে! '
--- ' আমাকে এই শ্মশান ঘাটে এনে শেষ পর্যন্ত যাত্রার নর্তকী বানালে। '
---- এই চৈত্র দুপুরে যদি কোকিল ডাকত এই নিম গাছের ডালে বসে, কী যে ভাল লাগত! কিন্তু কোনো কোকিল এখানে নেই।
----  ঐ দেখ, দাড় কাক বসে আছে নিমের ডালে। '

সত্যি তাই। দেখলাম, দুটো কাক কা - কা করে উড়ে চলে গেল। মনটা একটু খারাপই হলো। ওরা কাক না হয়ে যদি শালিক হত। মনটা সত্যিই প্রফুল্ল লাগত। যেন 'টু ফর জয়'।

এবার নাসরিন একটু গম্ভীর হলো। আমি বললাম -- 'তোমার কী খিদে পেয়েছে? '
---- হ্যাঁ।
---- কাছে কোনো হোটেল নেই। যেতে হবে মেঘনা ঘাট বাজারে। যাব?
---- না।
---- খাবেনা।
---- না।

নাসরিন আমার একটি হাত টেনে নিয়ে ধরে থাকে ওর হাতের ভিতর। খুব মায়াবী করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।  কিছু সময় পর বলছিল -- 'তুমি এত উদাসীন কেন, বলো তো? তুমি কী সারাজীবন এমনই থাকবে? একটা ভাল চাকুরির খোঁজ নেবেনা? টিউশনি করে বিয়ে করতে পারবে? সারাজীবন মেচেই থাকবে?'
---- কেন, তুমি আমাকে বিয়ে করে এমন শ্মশান ঘাটে নিম গাছ তলায় থাকতে পারবেনা? '
----  তুমি পাগল। তুমি ইডিয়ট। '
---- আমিতো তোমাকে নিয়ে এমন খোলা আকাশের নীচে বসবাস করতে পারব হাজার বছর। প্রতি বসন্ত রাতে নক্ষত্র ঝরে পড়বে আমাদের উপর। শীতে পড়বে শিশির। আর বর্ষায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। কী যে ভালো লাগবে !  কী পারবেনা আমার সাথে থাকতে এমন হাজার বছর? '
--- তুমি সত্যিই একটা পাগল, সত্যিই তুমি ইডিয়ট।

হঠাৎ পশ্চিম দিক থেকে একটি ঘূর্ণিবায়ুর ধূলো বাতাস এসে লাগল আমাদের গায়ে। বাতাসে উড়ে আসছিল জীর্ণ মরা পাতা। শ্মশানের লাশ পোড়ার গন্ধও পেলাম।
নাসরিন ওড়না দিয়ে ওর চোখ ঢাকে। একসময় ঘূর্ণিবায়ুটি উড়তে উড়তে মেঘনার জলের স্রোতের ঘুর্ণিতে মিশে যায়।

আমরা তখনও বসে আছি ঘাসের উপরে। নাসরিন ওড়না থেকে মুখ বের করে আমার কাঁধের উপরে মাথা ঠেকিয়ে বলছিল --- কাল একজায়গা থেকে পাত্র আসবে আমাকে দেখতে। বড় দুলাভাই হচ্ছে ঘটক। যদি পাত্র পক্ষ আমাকে পছন্দ করে ফেলে। যদি বিয়ে পাকাপাকি হয়ে যায়। আমার খুব ভয় লাগছে। চলো কালই আমরা কোর্টে যেয়ে বিয়ে করে ফেলি। '

---- আরে না, তোমাকে কেউ পছন্দ করবেনা। তুমি দেখতে অনেক কালো। কালো মেয়েদের এত তাড়াতাড়ি কেউ পছন্দ করবেনা। আর, করলেও কালই তো তোমার বিয়ে হবেনা। পরে আমরা সিদ্ধান্ত নিব। দেখি, এর মাঝে একটি চাকুরী হয়ে যায় কিনা? '
আর কপালে যা হবার তাই হবে। ভানু চক্রবর্তীর সেই কবিতার মতো ----
' ...পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন তারে করি না খাঁচায়,
ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তিপ্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত।
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
ক্বচিৎ কিরণে দীপ্ত।...'

কোথা থেকে সেই কাক দুটো আবার ফিরে এসে বসে নিম গাছের ডালে । কিছু ধূসর মেঘ হঠাৎ আকাশের তপ্ত সূর্যটাকে ঢেকে ফেলে। একধরনের প্রশান্তির ছায়া নেমে আসে মেঘনার তীরে। চেয়ে দেখি, এমন ছায়া রোদ্দুরে নাসরিনের মুখখানি আরও বেশি উজ্জল দেখাচ্ছে। নদী থেকে তখন শীতল হাওয়া বয়ে আসছিল। বাতাসে উড়ছিল ওর চুল। আমি নাসরিনের চোখের দিকে একবার তাকাই। দেখি সেই চোখে কোনো বিষন্নতা নেই। ওর বিনম্র মুখের দিকে তাকাই। চেয়ে দেখি -- সেই মুখে কোনো অভিমান নেই। আমরা দুজন মেঘনার তীর ধরে হাটতে হাটতে বাস স্টান্ডের দিকে চলে আসতে থাকি।

কথা ছিল আমাদের দেখা হবে আবার। কিন্তু তারপরে নাসরিনের সাথে অামার আর দেখা হয় নাই। যে সমস্ত জায়গাগুলোতে আমরা সাধারণত দেখা করতাম, সে সমস্ত জায়গায় আমি ঘন্টার পর ঘন্টা ঠাঁয় দাড়িয়ে থেকেছি। কিন্তু নাসরিন আর আসে নাই। ওর ঠিকানায় কটি চিঠিও লিখেছিলাম। কিন্তু সেগুলোরও নো রিপ্লাই ছিল।

ওতো কালো মেয়ে ছিল। তারপরও সেদিনই হয়ত ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তারপর তিরিশ বছর চলে গেছে। ওকে ভুলিনি, ও যতই কালো হোক।



১৫.     রোড টু কোলকাতা

দুবাই থেকে বন্ধুবর সুচিন্ত্য র একটি ম্যাসেজ পেলাম। ও লিখেছে, 'কোলকাতা আসলি, আমাকে একটু আগে থেকে বলবিনা, আমিও থাকতাম। মধ্যমগ্রামে আমার বাসা খালি পড়ে আছে। সেখানেই থাকতে পারতিস। তা, কোথায় উঠেছিস?'
আমি বললাম, নিউ মার্কেটের কাছাকাছি একটি হোটেলে উঠেছি। মাত্র দুইদিনের জন্য এসেছি। ট্রেনে কোলকাতা আসার একটি সখ ছিল। সেই সখটা পূরণ করলাম।
সুচিন্ত্য আবার লিখল -- 'মাত্র দুইদিনে কোলকাতায় কী দেখবি? '
আমি বললাম -- কিছুই দেখবনা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে যেয়ে দাড়িয়ে আমরা দুজন  একটি সেল্ফি তুলব। গঙ্গার ধারে যাওয়ারও ইচ্ছা আছে। সন্ধ্যায় কালীঘাটে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে নাকি গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। প্রদীপ জ্বলা সেই সন্ধ্যার মনোরম দৃশ্যটি দেখারও ইচ্ছা আছে। আর ঠিক দুপুরবেলায় একদিন গড়ের মাঠে যেয়ে সবুজ ঘাসের উপরে বসে দুজন গপ্পো করব ।

আরও লিখলাম -- নিউ মার্কেটের সামনে ফুটপাত থেকে হ্যাপি  গোল গাপ্পা, বেলপুরি, আর দোসা খাবে। অার আমার মহিষের দুধের এক গ্লাস মাঠা খাওয়ার ইচ্ছা আছে। আর মেট্রোতে টালিগঞ্জ যেয়ে দুজন আইসক্রিম খাবো।
সুুচিন্ত্য লিখল -- পার্ক স্ট্রীটে পার্ক হোটেলের পাশে মমো পাওয়া যায়। হ্যাপিকে নিয়ে ওখান থেকে মমো খেয়ে নিস। খুব ভাল লাগবে।
আরেক ফেসবুক বান্ধবী শ্রাবণী বিশ্বাস সাজেস্ট করল, কোলকাতায় যখন এসেছেন, কফি হাউসে যাবেন আর ইকো পার্কটাও দেখে নিবেন।

ঘটনাটি ছিল কাকতালীয় :

এবারই দেখলাম, টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের নাম বদলিয়ে রাখা হয়েছে মহানায়ক উত্তম কুমার। একদিন সন্ধ্যায় মেট্রোতে ফিরছিলাম এই উত্তম কুমার স্টেশন থেকে। ফেরাটা ছিল অফ্ আওয়ারে। অতো ভীড় ছিলনা। আমি আর হ্যাপি একটি খালি বেঞ্চে বসে পড়ি। আমাদের পাশের বেঞ্চে বসা ছিল একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা সাথে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের একজন তরুণ। মহিলার হাতে একটি ক্রাচ। হয়ত ওনার পায়ে সমস্যা আছে। ক্রাচে ভর করে হাটতে হয়। ওনারা উঠেছিল গীতাঞ্জলি থেকে।

আমি বারবার ঘুরে ফিরে দেখছিলাম এই মহিলাকে। মহিলাও দেখছিল আমাকে। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল এই মুখ। মুখে পড়েছে তার বলিরেখা। চোখের পাতায় নেই সেই ঔজ্জ্বল্য। কিন্তু তার চোখের দিকে চেয়ে দেখছি, এই চোখ আমি কোথায় যেন দেখেছি। হ্যাপি আমাকে বলছিল -- তুমি ওনাকে যেভাবে দেখছ, মনে হচ্ছে উনি তোমার পরিচিত। '
আমি মনে মনে মিলাচ্ছিলাম, এই মুখটির সাথে অনেক বছর আগে দেখা একটি মুখের সাথে। মন বলছিল হয়তো সেই হবে।

সে ছিল কীর্তিকা পোখরেল। একটি নেপালি মেয়ে।  কীর্তিকা এসেছিল নেপাল থেকে স্কলারশীপ নিয়ে ঢাকায় । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ও আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। কিন্তু ওতো অনেক আগে ওদের দেশে জন যুদ্ধে মারা গেছে। কীর্তিকাকে নিয়ে আমার একটি স্মৃতিচারণমুলক গল্পকথাও আছে। ওর তো এখানে এই কোলকাতায় থাকার কথা নয়। মন খুব আনচান করছিল ওনার সাথে একটু কথা বলবার। কিন্তু দ্বিধা করছিলাম। হ্যাপিকে বলছিলাম, 'তুমি যেয়ে ওর সাথে একটু কথা বলো। '

কথা বলব বলব করে মেট্রো ট্রেনটি কখন রবীন্দ্র সূদন চলে এসেছিল বুঝতে পারিনি। ওনাদের মুভমেন্ট দেখে মনে হলো, সামনের কোনো স্টেশনে হয়ত নেমে যাবে। কেমন যেন অস্থির লাগছিল মনটা। কিছু বলব ভাবতে ভাবতেই ময়দান স্টেশনটি চলে আসে। এখানে তারা নামলনা। কিন্তু পরের স্টেশন পার্ক স্ট্রীটে নামবার জন্য তারা প্রস্তুতি নেয়।

মহিলা নামবার জন্য আস্তে করে একহাতে ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আমি হ্যাপিকে বলি -- চলো, ওনার সাথে একটু কথা বলি। আমি কাছে যেয়ে বলি --- 'এক্সকিউজ মী, আপনেরা কোথা থেকে এসেছেন?'
মহিলা :  কাঠমান্ডু, নেপাল থেকে।
আমি :  আপনার নাম কি?
মহিলা :  কীর্তিকা পোখরেল।

আমার আত্মার স্পন্দন ধ্বনি মুহূর্তে থেমে গেল। আমি তার দুচোখের দিকে মায়া ভরে তাকিয়ে বলছিলাম --- 'তুমি কী বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে গিয়েছিলে কখনও ? '

মেট্রো ট্রেনের এ্যানাউন্সমেন্ট বক্স থেকে বলছিল তখন, ' দিস ইজ স্টেশন পার্ক স্ট্রীট '।
কীর্তিকা আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আর সুযোগ পায়নি। ক্রাচে ভর করে সেই ছেলেটির হাত ধরে দ্রুত সে নেমে চলে যায়।

মেট্রো ট্রেনটি তারপর শো শো করে এসপ্লানেডের দিকে ছুটতে থাকে। ভাবছিলাম -- কী আফসোস তুমি রেখে গেলে কীর্তিকা! এত বছর পরে সুযোগ পেয়েও জানতে পারলাম না তোমার কথা। পরক্ষণেই ভাবছিলাম, এই পৃথিবীতে কাকতালীয় কত কিছুই না ঘটে। সেই রকমই কিছু হবে এই ঘটনাটি। কিংবা কোনো ঘোর।  কীর্তিকা পোখরেল আসলে বেঁচে নেই।



১৫.   ধীরে বহে ইছামতি

সেদিন ছিল চৈত্রের চাঁদের রাত্রি। লোকালয়ের সব কোলাহল থেমে গেছে সন্ধ্যা রাতেই। ইছামতী নদী থেকে ফিরে আসা বকগুলো পাঁকুরের ডালে বসে ঝিমুচ্ছে। রাত বাড়ছে আর ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাক ততবেশি গুঞ্জরিত হচ্ছে । বাড়ির কোণে সোনাল গাছের ফুলগুলো সুবাস ছড়িয়েছে। নুরজাহান বেগম তার স্বামীকে পান বানিয়ে এনে খেতে দেয়। তার স্বামী পানের খিলিটি মুখে পুরে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তার একটি অভ্যাস পান চিবুতে চিবুতে ঘুমিয়ে যাওয়া। আজও তিনি পান চিবুতে চিবুতে ঘুমিয়ে গেলেন।

নুরজাহান বেগমও শুয়ে আছে, কিন্তু তার চোখে ঘুম আসছেনা। ঘরের জানালা দিয়ে একাদশী চাঁদের আলো এসে বিছানায় পড়েছে। সোনাল ফুলের গন্ধে ভরে গেছে ঘর। নুরজাহান পাশ ফিরে দেখে  চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার স্বামীর মুখের উপরে। সে আলোয় তার মুখখানি অপূর্ব দেখাচ্ছিল। কী এক আকুলতায় নুরজাহানের মন ব্যাকুল হয়ে উঠল।

নুরজাহান বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে আসে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে দূরের নিরালা বৃক্ষতল। পাতা বাহারের পাতাগুলিতে জোসনা পড়ে ঝিলমিল করছে। আলো আঁধারিতে দেখা যাচ্ছিল মাধবীলতাগুলি  ঝুঁকে পড়েছে দেবদারু গাছের দিকে। এমন জ্যোৎস্না ভরা রাত বিবশ করে তোলে নুরজাহানের দেহকে। সে বন্ধ করতে উদ্যত হয় ঘরের জানালা। ঠিক তখনই  দুর থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসে রাত্রির আঁধার ভেধ করে। এত রাতে নদীর কূলে কে বাজায় বাঁশি?

বহু বছর আগে তাদের গাঁয়ের এক গায়েন এমন করে বাজাতো বাঁশি। তখন সে বালিকা ছিল। সে তখন বুঝতে পারত অপ্রস্ফুটিত কলিগুলি দিনে দিনে কী ভাবে পাঁপড়ি মেলে। সকালবেলা শিশির ঝরে পরে লাজুক সেই ফুলের উপরে। সে এও দেখেছে কী ভাবে মৌমাছি  চারপাশে গুনগুন করে। বালিকা ভালবেসেছিল সেই গায়েনকে। আর ভালবেসেছিল তার বাঁশীটিকে।

এক ভরা বর্ষায় সেবার রাজবাড়ি থেকে এসেছিল যাত্রা অপেরা। গায়েন যোগ দেয় সেই যাত্রাদলে। একদিন চাঁদনী পরশ রাতে সেই যাত্রা দলের সাথে গায়েন গ্রাম ত্যাগ করে চলে যায়। সেই যে সে চলে যায় তারপর  আর সে ফিরে আসে নাই।

আজকের এই জ্যোৎস্না ঝালর রাত, এমন বাঁশির বেবাগী সুর -- মন যেন বাইরে টানে নুরজাহানকে। সে দেখতে পেল দূরের ঝাঁউ গাছের চিরিচিরি পাতার ফাঁক দিয়ে  চৈত্র রাত্রির উন্মাতাল বাতাস এসে তার শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। আর কবেকার বসন্ত মর্মর স্মৃতিগুলো তারই অন্তরে ঐ বাঁশির সুরের সাথে ধ্বনিত হচ্ছে। সে একবার তার স্বামীর মুখের দিকে তাকালো, আর একবার খোলা জানালা দিয়ে  ইছামতি নদীর কূলে। যেখানে শীতল জল ধীরে বহিতেছে। যেখান থেকে এই স্মৃতি মর্মর সুর ভেসে আসছে।

পরনে তার শাড়ি পড়া ছিল। দুই হাতে ছিল দুটি শাঁখা। নাকে ছিল বিয়ের দিনের নাকফুল। চিরুনিতে কেশ বিন্যাসটুকু করলনা। বুকের ভিতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বের হতে চেয়েছিল, কিন্তু তা সে আটকে রাখল, যদি পাছে শব্দ হয়। দরজার কাঠের খিল আস্তে করে খুলে ফেলল। এবং খালি পায়ে ঘর হতে বের হয়ে পড়ল।

পুকুরের ধারে তখন নী এওল বেতস ফুল ফুটে উঠেছে। বাঁশ ঝাড়ের বাঁশ ঝুঁকে পড়েছে পথের উপর।  যে যায় সে উদাস হয়ে যায়। সে আর ফিরে আসেনা। বাঁশের পাতার ভিতর দিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস আসছিল ইছামতি থেকে। তখনও নুরজাহানের অন্তরের ভিতরে বেজেছিল বহু দিনের সেই পুরনো বাঁশির সুর। পৃথিবীর ক্রন্দনগুলো আজ যেন এই জ্যোৎস্নাস্নাত জমিনের  উপর আছড়ে পড়ছে।

রাতভর লোকালয়ের কেউ আর বাঁশির সুর শোনেনি। পাখিদের ডানায় ডানায় ঘষা লেগে যে বিদ্যুতের আলোর ছ্বটা তৈরি হয়েছিল, তাতে কী পুড়ে ভস্ম হয়েছিল কোনো আসক্ত শরীর?  নাকি আরও বেশি ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছিল জোসনা। কেউ কি দেহজ আগুন নিভিয়েছিল ইছামতির জ্বলে সেই রাতে?

সকালবেলা নুরজাহান বেগমকে না পেয়ে তার স্বামী চলে যায় ইছামতির কূলে। সেখানে সে ধবল বকের কয়েকটি পালক পড়ে থাকতে দেখে । আর ধূর্বা ঘাসের উপরে পড়ে থাকতে দেখে কূঁচ পাথরের নুরজাহানের নাকফুলটি আর কার যেন একটি পুরনো ভাঙা বাঁশি।



১৬.    বিপুল তরঙ্গ রে

কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে তখন ভর্তি হয়েছি। শেষ কৈশোরের উন্মাতাল সময়কাল কেবল শুরু। সারা শরীর মনে কেমন যেন 'বিপুল তরঙ্গ রে '। কলেজের নবীন ররণ অনুষ্ঠানে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে দ্বৈত কন্ঠে একটি গান গেয়েছিল। তাদের নাম আজ আর মনে নেই। একরকম অখ্যাত ছিল তারা। সেই অনুষ্ঠানের গান শুনে গ্রাম থেকে আসা এক অর্বাচীন তরুণের মন কেমন যেন হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো ঝলমলিয়ে উঠেছিল। কী এক আবেগ দিয়ে, কী এক প্রেমাশ্রিত কন্ঠে গেয়েছিল তারা সেই গান। আমি তন্ময় হয়ে শুনেছিলাম গানটি । গানটি হয়ত অনেকের কাছে সাধারণ মনে হবে। কিন্ত আমার কাছে ঐসময়ে অসাধারণ মনে হয়েছিল। বিশেষ করে তাদের গায়কী ভঙ্গি। যখন তারা একে অপরে মুখপানে চেয়ে গেয়েছিল :
'তুমি সাত সাগরের ওপার হতে আমায় দেখেছ
আর মন ভ্রমরের কাজল পাখায় ছবি এঁকেছ
আমি ময়ুর পংখি নাও ভিড়িয়ে তোমায় দেখেছি
আর প্রবাল দ্বীপের পান্না ভেবে চেয়ে থেকেছি...'

আমার জীবনের একধরনের অব্যক্ত ভাবনা তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। ক্লাশে কয়েকটি মেয়ে ছিল আমাদের। কখনও কখনও ওদের সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছা করত। কখনও আবার ভয়ে আর লজ্জায় বেঞ্চের একপাশে চুপচাপ বসে থাকতাম। ক্লাশ শেষ হলে প্রায়ই একাকী ধানমন্ডি লেকের পাড় ধরে হেটে হেটে চলে যেয়ে বসতাম কোনো কৃষ্ণচূড়া ছায়াতলে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে শেষ বিকেলের রোদ্র এসে মুখে পরত। তখন একটা অদ্ভুত মনখারাপের ভাব কোত্থেকে যেন চলে আসত আমার মুখের উপরে। একসময় লেকের সেই নির্জন রাস্তায় ক্লান্ত পায়ে হাটতে হাটতে চলে আসতাম কলাবাগানের কালাচাঁদ রেস্টুরেন্টে। তখন আট আনা দিয়ে সিঙাড়া পাওয়া যেত। খিদে পেটে আমি দুটো সিঙারা খেয়ে নিতাম।

সেই তরঙ্গায়িত যৌবন সময়ে কাউকে যে ভাল লাগেনি তা নয়। অনেককেই খুব ভাল লেগেছিল। মনে হত মেয়ে তুমি আমার বন্ধু হও। তখন কার সাথে যে সম্পর্ক হয়েছিল, আর কাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখতাম। আর কত যে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। তার ইয়াত্তা নেই। সেই সব ভাঙ্গা গড়ার সময়কাল কখন যে শেষ হয়ে গেছে তাও জানতে পারিনি। শেষবারের মতো কলেজ ইউনিভার্সিটির গেট ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময়, একের পর এক সম্পর্ক গড়া আর ভাঙার মুহূর্তের মর্মর কথা আর কতজনেরই মুখচ্ছবি যে মনে ভেসে উঠেছিল, সেইসব মুখগুলো মনের কোণে অস্পষ্ট জলছবি হয়ে আছে।

জীবনের এ প্রান্তে এসে মনে হয়, জীবনের কোনো গানই স্বপ্ন দেখাতে পারেনি। সব ভাললাগাগুলো হয়ে গেছে বিগত জীবনের বিষাদসিন্ধু। সব রোমান্টিক ভাবনাগুলো হয়ে গেছে প্রেমের বৃন্দগান। চির মনখারাপের একান্ত এলেজি।

এখন সেই গান আর নেই। নেই যৌবনকাল। নেই বিপুল তরঙ্গ রে। তবুও ---
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।...
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥



১৭.   মাধু গোয়ালিনী

অনেক বছর আগে আমি একবার পুন্ড্রনগরীতে গিয়েছিলাম। পুন্ড্রনগরী তখন পুরোটাই গড়। যেটি মহাস্থানগড় হিসাবে পরিচিত। এই গড়ে একটি প্রাচীন ভিটা আমি দেখতে পেয়েছিলাম, নাম গোবিন্দ ভিটা।
এই ভিটার পশ্চিম পার্শ্বে একটি ভগ্নস্তুপ মন্দির ছিল । যেটি "করতোয়া মহাত্ন্য’’ মন্দির নামে পরিচিত ছিল । এটিকে গোবিন্দ বা বিষ্ণু মন্দিরও বলা হত। আমি হাটতে হাটতে আরও উত্তর দিকে চলে গিয়েছিলাম । করোতোয়ার কূল ঘেষে সেখানে একটি প্রাচীন অশ্বত্থ বৃক্ষ দেখতে পাই। মনে হয়েছিল এই বৃক্ষটি কয়েকশত বছরের পুরনো। এই গাছের তলায় একটি আশ্রম আছে। কয়েকজন সাধু জাতীয় লোক সেখানে বসবাস করত। 

আমি সবসময়ই এই সাধু সন্ন্যাসীদের পছন্দ করতাম। আমার একসময় জীবনের লক্ষ্য ছিল সাধু সন্ন্যাসী হওয়া। কিন্তু তা হতে পারিনি। কেন হতে পারিনি, সেই দুঃখের কাহিনী আরেকদিন বলব।  আজ এই সন্ন্যাসীকুলদের দেখে খুব ইচ্ছা হল, দুইতিন দিন এদের সাথে এই আশ্রমে থেকে যাই । আশ্রমের সবচেয়ে প্রবীণ সাধুটির নাম ছিল অনুকূল বৈশ্য। আমি তারই শিশ্যত্ব গ্রহণ করি। 

আমার এই লেখার যা কিছু তথ্য বা কাহিনী কিংবা উপকাহিনী সবই এই গুরু অনুকূল বৈশ্যের কাছ থেকে শোনা। গোবিন্দ ভিটার উপর দিয়ে আমি হাঁটতাম আর ভাবতাম,  --- ইতিহাসের এক ধূসর ধূলি পথে আমি কোথায় যেন যাচ্ছি । আজ থেকে হাজার বছর আগের পুন্ড্রনগরীর ইট বিছানো সেই পথ। যেখানে এখন লাল পোড়া মাটির ধুলো  উড়ছে। বৃক্ষ রাজির ছায়াতল দিয়ে চলতে চলতে মনে হলো আমি অনেক বছর আগের এই মন্দিরের একজন গায়েন।

ফ্লাশব্যাক :

আমি মনি শংকর, কীর্তন করি গোবিন্দ ভিটার পার্শ্বে ঐ বিষ্ণু মন্দিরে। আমাদের বাড়ি ছিল বুমানপাড়া অঞ্চলে মাথুরা গ্রামে। গ্রামটির একপাশে দিয়ে বয়ে গেছে করতোয়া নদী। আমার বালক বয়স থেকেই গান গাইতাম বাবার গানের দলের হয়ে। এখন আমি যুবা এক পূর্ণ গায়েন। গানের দলের হয়ে বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় যেতাম। পৌষ সংক্রান্তির দিনে হুগলি নদীর তীরে গঙ্গাসাগর মেলা,  মাঘে বাঁকুড়ার কেঞ্জেকুড়া গ্রামে দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে মুড়ি মেলা, শিবরাত্রিতে জলপাইগুড়িতে জল্পেশ্বর মেলা, শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মনসার পূজা উপলক্ষে ঝাঁপান উৎসব। এইসব মেলা পার্বনে সেখানে কীর্তন আর শ্যামা সংগীত গাইতাম।

আমি গান করি এখানে, এই পুন্ড্রে। কীর্ত্তন আসর মাতিয়ে রাখি। দূর দূড়ান্তের গানের দল থেকে অনুরোধ আসত আমাকে তাদের দলে নেবার । কিন্তু আমি যেতামনা। কী এক মায়ার মোহে এখানেই পড়ে থাকি  এই বিষ্ণু মন্দিরে। পৃথিবীর সব মোহ আমি ছাড়তে পারি, গান ছাড়তে পারি, ঠুমরির খুঞ্জরীর শব্দ আর না শুনতে পারি কিন্তু আমি ছাড়তে পারি নাই মাধু গোয়ালিনীকে।

বাঁকুড়ার কেঞ্জেকুড়া গ্রামের কার্তিক ঘোষের বউ ছিল মাধু। দেখতে অপরূপ সুন্দরী ছিল। দেবী প্রতিমার মতো দেহ বল্লরী তার। কার্তিক দুধ বিক্রি করত দ্বারকেশ্বর নদীর ঘাটে । মাধু গাভী দেখা শুনা করতো। এক আশ্বিনে কেঞ্জেকুড়া গ্রামে ওলাওঠা রোগ ছড়িয়ে পড়লে কার্তিক ঘোষ সেই রোগে মারা যায়। মাধু হয় অকাল বিধবা। আমাদের গানের দল গিয়েছিল সেখানকার এক মুড়ি মেলায় গান করতে। মাধু আসত সেখানে গান শুনতে। মেলা শেষ হলে দ্বারকেশ্বর নদীর ঘাট থেকে খুব প্রত্যুষে যেদিন নৌকা ছেড়েছিল , সেদিন দেখেছিলাম নৌকার ভিতরে মাধু গোয়ালিনীকে। আমাদের গানের দলে আরও দুই জন মেয়ে গায়েন ছিল শিবানী ও দিপালী। ওদের সাথে সেদিন যোগ হয়েছিল এই মাধু গোয়ালিনী।

আমাদের নৌকাটি যখন দ্বারকেশ্বর পেরিয়ে কংসাবতী নদীতে এসে পৌঁছে তখন বিকাল হয়ে গিয়েছিল। ছইয়ের উপর আমি একাকী বসেছিলাম। কংসাবতীতে তখন মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। আমার মনটা খুব ভাল লাগছিল, আবার কেন জানি খারাপও লাগছিল। ভাল লাগছিল এইজন্য যে, মাধুকে আমার খুব ভাললাগত। ওকে প্রথম দেখেছিলাম মেলায় গানের আসরে। হেজাকের আলোর নীচে দেখেছিলাম ওর আনত মুখ। কী মাধুর্যময় সারল্য ছিল ওর মুখখানিতে।  সেই অপূর্ব  মুখের মেয়েটি এখন আমাদের দলে। এই নৌকায়। কংসাবতীর উচ্ছল জল ছলাৎছল করছিল ৰাতাসের ঢেউ লেগে। আমার মন কেমন যেন ফাগুন দোলায় দুলে উঠছিল। আবার খারাপও লাগছিল এইজন্য যে, আমি তো মাধুকে এই নৌকায় তুলি নাই। আমাকে তো ও কখনও ঐভাবে দেখে নাই, কথাও বলে নাই। আমাকে ওর ভাল লাগারও কথা না। তবে কেন সে এই নৌকায় উঠল? কে তুলল তাকে?

হঠাৎ চেয়ে দেখি শিবানী। এবং ওর পিছনে মাধু গোয়ালিনী দাঁড়িয়ে। শিবানী বলছিল --- ' কী ভাবছ তুমি। '
আমি :  কিছু না। দেখছি কংসাবতীর জল।
শিবানী : ( মাধুকে দেখিয়ে) একে চেন?
আমি :  না।
শিবানী :  ইনি মাধু গোয়ালিনী। জয় শংকর ওকে পছন্দ করে এই নৌকায় তুলেছে। নতুন গায়েন। ওকে নাকি নাচও শেখাবে।'
শিবানী মুচকি হেসে আরও বলছিল -- 'জয় শংকর খুব পছন্দ করেছে ওকে। মাধুও পছন্দ করে। তুমি শুধু আমাকে পছন্দ করনা। কী এখন থেকে করবেনা?'
আমি :  তোকে না কত বলেছি, তুই আমাকে বিরক্ত করবিনে। যা, ভাগ এখান থেকে।

শিবানী রাগ হয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় মাধুকে হাত ধরে টান দিয়ে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু মাধু যায় নাই। দাড়িয়ে ছিল আরও কিছুক্ষণ। দেখছিল কংসাবতীর জল। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে নিভু নিভু প্রায়। মেঘের নীচে ম্লান হয়ে যাওয়া লাল আভা এসে পড়েছিল মাধুর মুখে। ওর সেই স্বপ্নীল মুখে অস্ফুট করে আমাকে বলেছিল --- '  জয় শংকরের জন্য নয়। আমি তোমার জন্যই এই নৌকায় উঠেছি। '

জয় শংকর আমার বাবা। বিয়ে করেছিল পাহাড়পুর গ্রামের কিশোরী  অশ্বিনী ডুমনীকে। আমার মা ছিল ডোম। অনিন্দ্য সুন্দরী হওয়াতে বাবা নাকি জোর করেই তাকে বিবাহ করেছিল। অল্প বয়সেই সে সন্তান সম্ভবা হয়। আমি জন্মিবার সময় আমার মা মারা যায়। তারপর বাবা আবার বিয়ে করে। আমার সেই মা নিঃসন্তান। মাথুরা গ্রামে নিভৃতে সে একাকী বসবাস করে।

আমি জানি বাইরে মেয়েদের সাথে বাবা  স্ফূর্তি করে। এই যে শিবানী, যে আমাকে ভালবাসতে চায়, তার সাথেও আছে বাবার অবৈধ সম্পর্ক। কাবেরী, দিপালীও যেন বাবার রক্ষিতা। মাঝে মাঝে মনে হত, এই গানের দল ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই। কিন্তু যাইনা। যাইনা এই জন্য যে, বাবা আমাকে অধিক ভালবাসে। জগতের যত স্নেহ মমতা সে আমাকেই করে। আমি নাকি দেখতে হয়েছি মার মতো। বাবা সুন্দর গান করে। আমিও ঠিক বাবার মতো করে গান গাই।

সেই বার এই পুন্ড্রে, এই করতোয়া নদীর তীরে, এই অশ্বত্থ গাছের তলে মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে মেলা বসেছিল। কত মানুষ, কত সাধু, কত সন্ন্যাসী, কত যোগিনী, কত বোষ্টুমী এসেছিল সেই মেলায়। গান আর নাচের উৎসব হয়েছিল মন্দিরের অদূরে অশ্বত্থ তলায়। সেদিন ছিল, শুক্লা দ্বাদশীর রাত। আমি মাধুকে সকালবেলাই  বলে রেখেছিলাম, তুমি দেখা করবে পাহাড়পুর জঙ্গলে। আমি ওখানে নাগলিঙ্গম বৃক্ষতলে  অপেক্ষা করব। আমরা  নিরুদ্দেশ হয়ে যাব এই লোকালয় থেকে অন্যত্র।

শুক্লা দ্বাদশীর সেই রাতে মাধু যায়নি গড়ের সেই জঙ্গলে। আমি রাত দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম বৃক্ষতলে।  ত্রয়োদশীতে মাধুকে আবার বলি --- ' তুমি আজ অবশ্যই যাবে। আজও অপেক্ষা করবো জঙ্গলের ঐ নাগলিঙ্গম বৃক্ষ তলে। ' মাধু আমাকে মাথা নেড়ে ইশারায় বলেছিল --- 'যাব'। আমি সেদিনও মাঝ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম মাধুর জন্য। কিন্তু মাধু সে রাতেও আসেনি।

সেদিন ছিল মাঘী পূর্ণিমা। সকালবেলা মন খারাপ করে বসে আছি। মাধুর সাথে আমি কথা বলছিলাম না। মাধু নিজেই কাছে এসে আমাকে বলে --- 'আজ রাতে অবশ্যই আমি পাহাড়পুর জঙ্গলে  যাইব। তুমি থাকিও। '

সন্ধ্যায়  মন্দিরে শঙ্খধ্বনি বেজে উঠল। মহাস্থান গড়ের আকাশে চতুর্দশী পূর্ণিমার চাঁদ দেখা দিল। গানে গানে মন্দির প্রাঙ্গণ উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠল। মঞ্চে আমরা গান করছিলাম। গান গেয়েছিল শিবানী, দিপালী, বাবা এবং আমি। মধ্য রাত পর্যন্ত গানের উৎসব চলে। আমার গানের সাথে মাধু ক্ষণে ক্ষণে নাচ্ছিলও।   তারপর একসময় ঢাকের বারি থেমে যায়। হারমোনিয়ামের সুর বন্ধ হয়ে যায়, ঘুঙুর আর খুঞ্জরীর শব্দও থেমে যায়। একে একে খালি হয়ে যায় মেলা প্রাঙ্গণ। আমি আস্তে আস্তে হাটতে হাটতে অনেকটা চুপিসারে চলে যাই পাহাড়পুর জঙ্গলের দিকে।

সেদিন পাহাড়পুড় জঙ্গলে আলোর ৰান ডেকেছিল। থৈথৈ জ্যোৎস্না ঢলে পড়েছিল বনে বনে, গাছে গাছে, বৃক্ষে বৃক্ষে, পল্লবে পল্লবে। আমি একাকী নির্জনে বসে থাকি নাগলিঙ্গম তলে। চাঁদ ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে নুয়ে পড়েছে। দেখলাম মাধু আসছে গানের পোশাক পড়েই। পায়ের ঘুঙুরও সে খোলে নাই। তার পদধ্বনির সাথে নুপুরের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
মাধু :  বের হতে পারছিলাম না। জয়শংকর কে ব্যবস্থা করে তারপর আসতে হলো।
আমি :  কী ব্যবস্থা করেছ?
মাধু : পরে বলব।
আমি :  চল, আমারা আগে মন্দিরে যাই। পুরোহিতকে বলে রেখেছি। আজ রাতেই আমি তোমাকে বিবাহ করব। কাকে করব, সে কথা পুরোহিতকে বলি নাই। চল আর দেরি করবনা।
মাধু :  না, আমি তোমাকে বিবাহ করব না।
আমি : কেন করবে না।
মাধু:   তুমি এখন ধর্মতো আমার ছেলে হয়ে গেছ। আমাকে তোমার বাবা জয় শংকর প্রতিদিন ভোগ করে। আমি তার রক্ষিতা। আমাকে সে বিবাহ করে নাই। কিন্তু আমি তাকে দেখি আমার স্বামীর মতো। ধর্মতো আমি এখন তার বউ।
আমি :  কিন্তু, তুমি যে আমাকে ভালবাসতে।
মাধু:   হ্যাঁ  আমি তোমাকে এখনও ভালবাসি।

মাধুকে আমি অনেকটা জোর করেই বুকে টেনে নেই। মাঘী পূর্ণিমার সকল জ্যোৎস্না মাখিয়ে আমি তাকে পাগলের মতো আদর করতে থাকি। হয়ত সে রাতে স্বর্গ নেমে এসেছিল বনতলে।  কতক্ষণ আমরা জড়িয়ে থেকেছিলাম, সে কথা কী কোনো মৃত মানুষ  বলতে পারে?

শেষ এপিসোড :

মাধুকে না পেয়ে জয় শংকর সেই রাতে পাহাড়পুর জঙ্গলের দিকে চলে গিয়েছিল। তারপর কী হলো? তারপর একসময় মন্দিরে ভোরের শঙ্খধ্বনি বেজে ওঠে। জয় শংকরের সারা শরীরে রক্তের দাগ!  বনের নীচ দিয়ে হাটতে হাটতে, সূর্যের রশ্মি ভেদ করে জয় শংকর নিরুদ্দেশ হয়ে গেল! পিছনে নাগলিঙ্গম বৃক্ষ তলে পড়ে রইল দুইটি নিথর মৃত দেহ। সে দেহে পত্র পল্লবের ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মি এসে পড়ছিল।

1 টি মন্তব্য:

  1. "এক আশ্বিনে কেঞ্জেকুড়া গ্রামে ওলাওঠা রোগ ছড়িয়ে পড়লে কার্তিক ঘোষ সেই রোগে মারা যায়। মাধু হয় অকাল বিধবা" এই লাইনটি কি কল্পনা প্রসূত, নাকি এর কোন বাস্তব ভিত্তি আছে।

    উত্তরমুছুন