শনিবার, ১৬ মে, ২০২০

নদীর কূলে করি বাস

নদীর কূলে করি বাস    

অভয় দাশ লেনের একটি গলিতে আলী হোসেন দুই রুম নিয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে ভাড়া থাকেন। বিল্ডিংটি প্রায় শত বছরের পুরোনো। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। ফাটলও ধরেছে। পরগাছাও জন্মেছে। প্রতি রুমে একটি করে  জানালা থাকলেও দিনের বেলায় সারা ঘর অন্ধকার থাকে। আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। কেমন গুমোট পরিবেশ।          

আজ পনেরো বছর ধরে আলী হোসেন এই বাড়িতেই ভাড়া থাকে। বাংলাবাজারে একটি প্রেসে সে চাকুরি করে। চাকুরিও করছে সে একই জায়গায় পনরো বছর ধরে। এক বাড়িতে বছরের পর বছর বসবাস করা এবং একই চাকুরি বছরের পর বছর করে যাওয়া -- দুটোর ভিতরই তার একঘেয়েমি এসে গেছে।         

একঘেয়েমি এসে গেছে তার স্ত্রীরও। সে প্রায়ই তার স্বামীর সাথে ঝগড়া করে, বলে -- জীবনে ভালো আর কোনো চাকুরি পেলে না। বাসাও পরিবর্তন করলে না, ড্রেনের দূর্গন্ধের মাঝে মশা-মাছি পোকামাকড়ের ভিতর সারাজীবন বসবাস করালে।একটু মুক্ত হাওয়া নেই। জানালা খুললে দখিনা বাতাস আসে না। নীল আকাশ দেখতে পাই না। দূরে কোথাও খোলা মাঠ নেই। কোথাও কোনো নদী নেই। গাছ নেই। পাখি নেই।                                     
আলী হোসেনের বাড়ি সাতক্ষীরার দেবহাটা।পড়াশোনা করেছিল কালীগঞ্জের নালতায় এক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে লজিং থেকে। আর এই লজিং বাড়িরই রূপবতী মেয়ে রুমার সাথে তার প্রেম হয়। কিন্তু  রুমার বাবা মা এই প্রণয় মেনে নেয়নি।

আলী হোসেন আইএ পাশ করে ঢাকায় চলে আসে। এবং বাংলাবাজারের একটি প্রেসে চাকুরি নেয়। একবার বাড়িতে যেয়ে রুমাকে পালিয়ে ঢাকায় নিয়ে এসে বিয়ে করে এবং অভয়দাশ লেনের এই বাড়িতে তোলে। আর সেই থেকেই এখানে তারা বসবাস করে আসছে।         

তার জীবনে অনেক অপ্রাপ্তি ও অতৃপ্তি আছে। সে স্কুল কলেজ থেকেই ভালো কবিতা লিখত। তার স্ত্রী রুমা যখন প্রেমিকা ছিল, তখন তাকে নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখেছে। আর এইসব কবিতা চিঠির মতো করে  রুমাকে দিত। রুমার মন ভুলে যেত সেইসব কবিতা পড়ে। একটা কবিতার কিছু কথা এখনও মনে আছে --            
'দূরে বহুদূরে চঞ্চল মেঘের মাঝে আকাশ ছাড়িয়ে যদি তুমি ভেসে যাও, ব্যাপ্তিও ছড়াও ঐ দূরালোকে। আমি গভীর গহনে আবর্তিত হই একাকী আমার ভূবন মাঝে। তুমি যতদূরেই যাও, আমার ভূবনেই তুমি ব্যাপ্ত হয়ে থাকো।'

আলী হোসেন এই মেয়েটিকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কখনও কবিতার শব্দের মায়াবুননে তাকে গেঁথেছে, কখনও রূপকথার গল্প কথা বলে তার মন ভুলিয়েছে, কিন্তু কোনো রূপকথা কখনোই আর নিজের গল্পকথা হয়ে ওঠেনি। 

এই জীবনে সে কবি হতে পারেনি যেমন, তেমনি তার স্ত্রীকে সুন্দর পরিবশে একটি বাড়ি করে দিতে পারেনি এখনও। কিন্তু এই স্বপ্ন দুটো অনেক দিন ধরে এখনও সে দেখে আসছে।                          

অভাব অনটনের এই সংসারে অনেক গঞ্জনা সইতে হয় আলী হোসেনের। অবিশ্বাসী, চরিত্রহীন,  লম্পট হওয়ার কথাও শুনতে হয় তার স্ত্রীর কাছে থেকে। অনেক বছর ধরে আলী হোসেন তার মাহিনার পুরো হিসাব তার স্ত্রীকে দিতে পারে না। প্রতি মাসেই কিছু না কিছু টাকা হিসাবে গরমিল থাকে।  এই নিয়ে স্ত্রীর সাথে অনেক বছর ধরে ঝগড়া হয়ে আসছে।

স্ত্রী রুমার ধারণা আলী হোসেন অন্য কোনো মেয়ের পিছনে টাকা খরচ করে। সে খারাপ মেয়েদের কাছে যায়। স্ফূর্তি ও বিলাসিতা করে টাকা অপচয় করে।       

একদিন স্ত্রীর সাথে তার এই ব্যাপারটি নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়।  আলী হোসেন অফিসে চলে যায়। অফিসে যেয়ে তিন মাসের অবৈতনিক ছুটি নেয়। এবং ওখানেই বসে বসে রুমার কাছে একটি পত্র লেখে। বিকালে বাসায় চলে আসে।  চুপিচুপি সেই পত্রখানি রুমার বালিশের নীচে রেখে দেয়। এবং একটি কাগজের ইনভিলপে কিছু টাকা রেখে দিয়ে পূণরায় ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায।      

সন্ধ্যা হয়ে রাত্রি হয়ে যায়। আলী হোসেন আর ঘরে ফিরে আসে না। রুমা কী করবে কোথায় যাবে বুঝে উঠতে পারে না। সে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। তার কান্না দেখে নাবালক সন্তান দুটোও কান্না করতে থাকে।  অনেক রাত পর্যন্ত সে না খেয়ে বিছানায় বসে বসে অশ্রুপাত করে। হঠাৎ বালিশটা সরাতেই সে একটি চিঠি দেখতে পায়। চিঠিখানি খুলে সে পড়তে থাকে ---           

কল্যাণীয়াসু রুমা

এই জীবনে তোমাকে যে আমি কত ভালোবাসিয়াছি, তা তুমি বুঝিতে পারো নাই। তোমার অনেক স্বপ্ন আমি পূরণ করিতে পারি নাই। এই জন্য আমারও গ্লানি কম হয় নাই। তুমি অনেক কষ্ট করিয়া আমার অভাব অনটনের সংসারে থাকিয়া গিয়াছ। তুমি আমাকে ফেলিয়া রাখিয়া বিত্তবান পিতার গৃহে ফিরিয়া যাও নাই।  আমি জানি, তুমি আমাকে এখনও অনেক ভালোবাসো, এই সংসারকে ভালোবাসো, তোমার সন্তানদের ভালোবাসো। 

আমি কিছুদিনের জন্য  তোমাদের মায়া ত্যাগ করিয়া নিরুদ্দেশ হইয়া চলিয়া গেলাম। বেঁচে থাকিলে আমি আবার তোমাদের কাছে ফিরিয়া আসিব। ইনভিলপের ভিতর কিছু টাকা রাখিয়া গেলাম। আমার ধারণা, কষ্ট করে তুমি মাস তিনেক  চলিতে পারিবে।

আমি এখনও স্বপ্ন দেখি -- তোমার সুন্দর একটি বাড়ি হইবে। কবিতা লেখার জন্য আমার একটি আলাদা কক্ষ থাকিবে। দক্ষিণের জানালা খুলিলেই দখিণা হাওয়া আসিয়া তোমার গায়ে লাগিবে। অদূরে নদী থাকিবে। নীল আকাশের ছায়াতল দিয়া হাঁটিয়া হাঁটিয়া আমরা দুজন নদীর কূলে বেড়াইতে যাইব। ওখানেই সন্ধ্যা নামিবে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠিবে। তারায় তারায় আকাশ ভরিয়া উঠিবে।  আমরা জোছনা মাখিয়া মাখিয়া তারপর ঘরে ফিরিয়া আসিব।           

জানিনা এই স্বপ্ন পূর্ণ হইবে কী না, তবু আমি সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে অভিযাত্রা করিলাম।
ইতি -- তোমার আলী।         

ঠিক দুই মাস পঁচিশ দিন পর.... 

একদিন সন্ধ্যারাতে আলী হোসেন গৃহে ফিরে আসে। মুখ ভর্তি তার দাড়ি। এই কয়দিনে সে দাড়ি কাটে নাই। চোখে, মুখে, শরীরে ক্লান্তির ছাপ। অনেক ধকল ও পরিশ্রমের ছাপ সুস্পষ্ট। রুমা তার স্বামীকে পেয়ে খুব খুশি হয়। আনন্দে উৎফুল্ল হয়  তার ছেলেমেয়ে দুটোও। সে রাতে রুমা আলী হোসেনের বুকে মাথা রেখে আনন্দ অশ্রু জলে ভাসিয়ে দিয়ছিল।                                                                                    
পরের দিন আলী হোসেন চাকুরি থেকে ইস্তফা দিলেন। বাড়িওয়ালাকে নোটিশ করলেন বাড়ি ছেড়ে দেবার। আসবাব পত্র যাকিছু ছিল সব বিক্রি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। রুমা, তার স্বামীকে বলে -- তুমি এসব কী করছো? 
-- এখানে আর থাকব না। আমরা আবার দেবহাটা আমাদের গ্রামের বাড়ি ফিরে যাব।

অভয়দাশ লেনের এই ঘিঞ্জি গলির বাড়িতে সেদিন ছিল শেষ রাত। আলী হোসেন ও রুমা বিছানায় শুয়ে আছে। কারোর চোখেই ঘুম আসছে না। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে। কত হাসি কান্না, কত দুঃখ-সুখ, কত ঝগড়া বিসম্বাদ, কত ভালোবাসার ক্ষণ কেটেছে এই বাড়িতে। কত মধুময় স্পর্শ ছিল দুজনের মধ্যে।  কত প্রেম এসেছিল দুজনের জীবনের প্রান্তে। 

মনে পড়ে,  রুমা সবকিছু ছিন্ন করে তার হাত ধরে উঠেছিল এসে এই বাড়িতেই। বিষণ্ণ দুটো তরুণ তরুণী সেদিন স্বজনহীন একাকী বাসর রাত কাটিয়েছিল । রুমার পরনে কোনো লাল বেনারসি শাড়ি ছিলনা, হাতে ছিলনা মেহেদি। মুখে ছিলনা চন্দন চিহ্ন। গায়ে মাখেনি কোনো আতরের গন্ধ। একটি ফুলও কেউ ছিটিয়ে দেয়নি তাদের বাসর শয্যায় । আয়নাতে দেখেনি দুজন দুজনের মুখ। কেউ মুখে তুলে খাওয়ানি একটুখানি মিষ্টি। কেউ কোনো প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে রাখেনি এই বন্ধ ঘরে।   

এই বাড়ি এই ঘর, পনেরোো বছরের গড়া সুখ দুঃখের এই খেলাঘর ভেঙে দিয়ে তারা পরেরদিন সকালবেলা দেবহাটার উদ্দেশ্যে স্বপরিবারে রওনা হলেন।      

ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাসটি যখন দেবহাটা এসে থামে তখন বিকাল হয়ে গেছে। রুমা এর আগে আসেনি কখনও এই উপজেলা শহরে। ওরা সবাই নেমে একটি টমটমে ওঠে।  গাড়োয়ান আলী হোসেনকে জিজ্ঞাসা করে,  'ভাই কোথায় যাব?'
আলী হোসেন বলে --- হিজল ডাঙা। 

টমটম চলছে আধা পাকা রাস্তার উপর দিয়ে ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দ করে। একসময় টমটমটি কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলতে থাকে। কী অপূর্ব দৃশ্য চারিদিকে। দূরে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ  সবুজ বেষ্টনী। আরেক পাশে ইছামতী নদী বয়ে চলেছে। কী দারুণ শীতল হাওয়া বইছে ! 

রুমারও কী যে ভালো লাগছিল এই প্রকৃতি দর্শনে। পনেরোটা বছর সে বন্দী ছিল ঘিঞ্জি দুর্গন্ধময় গলির ভিতর এক জীর্ণ বাড়িতে। আজ যেন সে প্রাণ থেকে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।  চারিদিকে ঘন সবুজ ফসলের মাঠ, অনিঃশেষ দিগন্ত, ঝাউ বন, শুপারি বাগান, গাছগাছালি, পশু পাখি, খোলা নীল আকাশ, মানুষ, নারী ও নদী।                                                                     

টমটমটি  ইছামতী নদীর তীরে একটি কাঠের দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামে। তখন সন্ধ্যাপূর্ব বিকাল। কী সুন্দর এই কাঠের বাড়িটি। যেন রবি ঠাকুরের কুঠি বাড়ি। একদম ইছামতী নদীর তীর ঘেসে তৈরি এই বাড়িটি। সেই বিনম্র সন্ধ্যাবেলায় নদীর জল কুলকুল শব্দে বয়ে যাচ্ছিল সাগরের দিকে।

আলী হোসেন সবাইকে নিয়ে  টমটম থেকে নামে।  তারা হেঁটে চলে আসে -- বাড়িটার কাছে। বাড়ির  গেটে ছোট্ট একটি নেম প্লেটে লেখা, 'রুমা ভিলা।' আলী হোসেন পকেট থেকে  চাবি বের করে রুমার হাতে দিয়ে বলে -- এটি তোমার বাড়ি।                          
      
কাকতালীয়ভাবে সেদিন ছিল হেমন্তের পূর্ণিমা রাত্রি। আলী হোসেন আর রুমা বসে আছে দোতালায় বারান্দায়। আকাশে কমলা সুন্দরীর মতো রূপময়ী চাঁদ। পাশে নদীর জল মৃদঙ্গ সুরে  বয়ে চলেছে ঝিরিঝিরি দ্যোতনায়। রুমা, তার স্বামীর বুকে মাথা ঠেকিয়ে পরম আনন্দ চিত্তে 
বলে -- 'ওগো, তুমি এত টাকা কোথায় পেলে?'
আলী হোসেন রুমার গ্রীবা ছুঁয়ে  মুখখানি উপরের দিকে উঠিয়ে বলে -- আমি প্রতি মাসে কিছুকিছু করে টাকা ব্যাংকে জমিয়ে রাখতাম। তুমি তা জানতে না। জানলে আমাদের অভাবের সংসারে খরচ করে ফেলতে। আমাকে কতই না সন্দেহ করতে তুমি। জানো, বারো বছর ধরে আমি এই টাকা জমিয়েছিলাম!

রুমা সলজ্জিত হয়ে আলী হোসেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে --  
আমাকে তুমি ক্ষমা করো, আমাকে তুমি অশেষ করো, আমার দেহখানি প্রদীপ করো ঐ চাঁদের মতোন জোছনায়, আমার ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো আমার যত গ্লানি  ... 

 
সেদিন হেমন্তের চাঁদ ডুবতে চায়নি হিজল ডাঙার অন্ধকার বন-প্রান্তরে। নদীর কূল আকুল হয়ে ভেসেছিল জোছনার বন্যায়। এমন আরও কত অপরূপ প্রহর কেটেছে তাদের। এই নদীর কূলে কত দিবস রাত্রি করেছে বাস ।        

                                                                          
কোয়েল তালুকদার
১৮ মে, ২০২০ ইং, ঢাকা।   
                              

                             
                                                     

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন