মঙ্গলবার, ১২ মে, ২০২০

নয়নে বহে ধারা

নয়নে বহে ধারা  

আজই দীপ্তর এমবিবিএস পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। সে পাশ করেছে। কলেজে যেয়ে দীপ্ত এই সুখবরটা প্রথম জানতে পারে।  

আর দীপ্ত এই সুখবরটি প্রথম জানায় তার মণিকে ফোনে --
মণি, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো আগে। আমার কপালে চুমু দাও। আমি পাশ করেছি মণি। আজ থেকে আমি ডাক্তার। তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পেরেছি মণি।                 

মণি দীপ্তর মা। দীপ্ত ওর মাকে একএকসময় এক একটা সম্বোধন করে ডাকে। কখনও মা, কখনও মামণি, কখনও মণিমা, কখনও শুধু  মণি বলে ডাকে। তবে বেশি আনন্দে থাকলে, দীপ্ত ওর মাকে মণি বলে ডাকে।             

দীপ্তর মা বিয়ের দুই বছরের মাথায় স্বামীকে হারায়। তখন দীপ্তর বয়স ছিল মাত্র ছয় মাস। দীপ্তর বাবাও ছিল একজন ডাক্তার। হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।

দীপ্তর মা আর বিয়ে করেন নাই। দীপ্তর বাবার রেখে যাওয়া সীমিত সম্পদ থেকে তিনি সংসার আর দীপ্তর লেখাপড়ার খরচ চালাতেন।      

দীপ্ত বাসায় এসে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে -- মণি তুমি খুশি হয়েছ? বাবা, মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা যেখানে রেখে গেছেন, আমি সেখানে থেকে আবার শুরু করব মা। তুমি আমাকে দোয়া করবে, আমি যেন তোমার স্বপ্ন ও বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।                                                     
দীপ্তর মা শাহনাজ বেগম তার ছেলেকে একটি আদর্শ সন্তান হিসাবে গড়ে তুলবার জন্য জীবনভর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সে আজ খুব খুশি।  দীপ্তর অলক্ষ্যে ওয়ালে টানানো  তার স্বামীর পোট্রের্ট এর সামনে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। 
বলে -- ওগো, তুমি আমাকে দোয়া করো ওপারে থেকে। আমি যেন দীপ্তকে তোমার আদর্শে গড়ে তুলতে কখনোই যেন ক্লান্ত না হই। 

দীপ্ত পিছনে থেকে চুপিচুপি এসে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় কপাল রেখে বলে -- মণি, তুমি না আমাকে প্রমিজ করেছিলে, আর কখনও কাঁদবে না। তুমি তোমার কথা রাখছ না। তুমি বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে প্রায়ই কাঁদো। শাহনাজ বেগম চোখের জল মুছে বলে, 'আবার প্রমিজ করছি, আর কাঁদব না। চলো, খেয়ে নাও। আমি এখনও খাইনি।'        

দীপ্ত কিছুদিনের মধ্যেই শহরের একটি নামকরা ক্লিনিকে জুনিয়র ডাক্তার হিসাবে যোগদান করে। পাশাপাশি বিসিএস পরীক্ষা দেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে।                                                   
একদিন খেতে বসে শাহনাজ বেগম দীপ্তকে বলে -
দীপ, তোমাকে একটা কথা বলব?
-- বলো, মণি।
-- তোমার কী কোনো মেয়ের সাথে জানাশোনা আছে? মানে, তোমার কী ভালোলাগার কেউ আছে? 
-- মণি, আমার কেউ থাকলে সে তো তুমিই আগে জানতে। কারণ, এই পৃথিবীতে তুমি আমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু।  আর... 
--- আর কী?
--- আর, আমার বউকে পছন্দ করে তুমিই ঘরে  আনবে। তুমি যাকে এনে দিবে, আমি তাকে নিয়েই  সারা জীবন ঘর করব। এও আমার আর একটি স্বপ্ন।       

আর একদিন এমনই খাওয়ার টেবিলে শাহনাজ বেগম তার ছেলেকে বলছিল -- দীপ।
--- বলো মা।
--- আমার এক দূর সম্পর্কের বোনের একটা মেয়ে আছে। ও এবার গার্হস্থ অর্থনীতিতে গ্রাজুয়েট ফাইনাল সেমিস্টার শেষ করবে। শুনেছি মেয়েটি বেশ সুন্দরী। ভালো গানও গাইতে পারে। আমার সেই বোনটির সাথে ফোনে প্রাথমিক কথা হয়েছে। আমি তোমাকে নিয়ে ওখানে বেড়াতে যাব। তুমি মেয়েকে দেখবে। মেয়ে তোমাকে দেখবে। মেয়ের বাবা মা থাকবে। আর কেউ না।
-- মণি, আমি তোমার উপর দিয়ে কোনো কথা কোনো দিন বলেছি? তুমি যা করবে, তুমি যা করতে বলবে, আমি তাই করব।     
-- আমি জানি। তুমি আমার অবাধ্য কোনো দিন হবে না।
-- মণি।
-- বলো বাপ।
-- তুমি বললে, মেয়েটি গান গায়। এই জন্য আমার খুব ভালো লাগছে। তুমি হয়ত জানো না মণি। আমি তোমাকে আজ একটা কথা বলি। 
-- কী, বলো।
-- তুমি প্রায়ই মাঝরাতে ওঠো। হয়ত হঠাৎ করেই  তোমার ঘুম ভেঙে যায়। তুমি উঠে তখন ঘরের লাইট জ্বালাও। বাবার পোট্রের্টের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখ অনেকক্ষণ । চশমা খুলে চোখ মোছো। তারপর ব্যালকনিতে যেয়ে ইজি চেয়ারে বসে থাকো। ওখানে বসে দূর আকাশে তারার দিকে তাকিয়ে থাকো, হয়ত মেঘের ভিতর লুকিয়ে থাকা  তারাদের মাঝে বাবার মুখ খোঁজো। কোথাও থেকে আসে তখন শীতল ঝিরিঝিরি হাওয়া। বেলী ফুলের ঝাড় থেকে আসে আকুলকরা গন্ধ! তুমি তখন গুনগুন করে সেই একলা রাত্রিতে একটি গান গাও --

'একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে
ওগো বন্ধু কাছে থেকো, কাছে থেকো।'    
     
জানো মণি, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপিচুপি তোমার সেই গান শুনতাম। তোমার গান গাওয়া শেষ হলে আমি যেয়ে শুয়ে পড়তাম। তুমি এইসব কিছুই জানতে না।                                                                                                                        
                
একদিন বিকালে শাহনাজ বেগম দীপ্তকে নিয়ে তার সেই বোনের বাসায় বেড়াতে যায়। সুন্দর পরিপাটি একটি ফ্ল্যাট বাড়ি।  বাসায় তার বোন মমতাজ বেগম, তার স্বামী শওকত আলী আর তাদের মেয়ে মালবী ছাড়া আর কেউ নেই। মালবী দেখতে সুন্দরী, লম্বা ছিপছিপে গড়ন, যেন রজনীগন্ধা ফুল, চোখ দুটো টানাটানা, চুল নিবিড় কালো, তার নাকটি কাঁঠালিচাঁপার রেণুর মতো  প্রস্ফুটিত। গায়ের রঙ উজ্জ্বল গৌরীয়, কপোতীর ডানার মতো মসৃণ দু'খানি হাত। পুরো মুখমন্ডল অদ্ভুত সৌন্দর্যময়,  যেন একটি উপমায় ভরা গীতি কবিতার রূপ সারা অবয়বে।

সেদিন উভয় পরিবার একে অপরের মাঝে নানা কথা বললেন। নানা ভাব বিনিময় করলেন। মেয়ে দেখল ছেলেকে, ছেলে দেখল মেয়েকে। তারা দুজন টুকটাক কথাও বলল। মালবী হয়ত ভাবছিল মনে মনে, যে রাজপুত্রকে সে এতদিন চেয়েছিল, সেই এসে আজ এখানে হাজির। অপরদিকে দীপ্তও মনে মনে ভাবছিল, 'এমনই একজন রাজকন্যাকে আমি এতদিন খুঁজেছিলাম।'              

দীপ্তর  মাও মালবীকে দেখে খুব খুশি। পারলে এখনই মালবীকে তার পুত্রবধূ করে ঘরে তুলে নিয়ে যাবে। অপরদিকে মালবীর বাবা মাও অনেক খুশি। তারাও পারলে এখনই তাদের মেয়েকে দীপ্তর সাথে বিয়ে দিয়ে ওর মায়ের হাতে তুলে দিবে।                     
দুই পরিবারের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হয়ে যায়। দীপ্ত ও মালবীর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়। বিয়েটি হবে মালবীর ফাইনাল পরীক্ষার পর। সেও মাস দেড়েক দেরি আছে এখনও । এর মধ্যে একদিন পানচিনি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওদের  একে অপরের হাতে আংটি পরানো হয়ে যায়।     

দীপ্ত আর মালবী একদিন দেখা করে উত্তরার একটি আকাশ ছোঁয়া রেস্টুরেন্টে। কাঁচের জানালার পাশে বসে দেখছিল -- নীল আকাশ। নীলের মাঝে থোকা থোকা শরতের সাদা মেঘ রাশি। দেখছিল এয়ারপোর্টের রানওয়ে। আর দূরের দিয়াবাড়ির শুভ্র কাশবন।
 
কথা বলছিল-- দুজন দুজনের মুখের দিকে চেয়ে। দীপ্ত বলছিল, আমার ভুবনে এতদিন ছিলাম আমি আর আমার মণি। সেই ভুবনে তুমিও আসছ। জানো, কী যে আলোয় আলোয় ভরে উঠবে আমাদের সেই ভুবন। মালবী দীপ্তর হাতের উপর হাত রেখে বলেছিল -- তোমাদের ভুবনে আমাকে স্থান দিও। কী দেবে তো আমাকে একটু স্থান?
দীপ্ত বলেছিল -- অবশ্যই। 
'এসো এসো আমার ঘরে এসো, বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে। স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে   মুগ্ধ এ চোখে।'

কত দুঃখ বেদনা মানুষের জীবনে । কত ভাঙাগড়াও আবার এই জীবনে! এই পৃথিবী কত স্বপ্ন দেখায়। কত স্বপ্নকে আবার নিষ্ঠুর ভাবে ভেঙে দেয়। এমনই এক স্বপ্ন ভাঙার দিনে মালবী সেদিন আসছিল কলেজ থেকে। বাস স্টান্ডে নেমে বাসায় আসার জন্য রিকশায় উঠবে, ঠিক তখনই দুজন যুবক মোটরসাইকেল করে এসে মালবীর মুখে এসিড মেরে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।                            

আর্ত চিৎকার করে মুখে দুহাত চেপে মালবী রাস্তার উপর বসে পড়ে।  তারপর দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।          

দীপ্ত খবর পায় মালবীর মুখে দুষ্কৃতকারীরা এসিড নিক্ষেপ করেছে। সে এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছে। 

দীপ্ত ছুটে চলে যায় হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে একটি বেডে মালবী শুয়ে আছে। মালবীর মুখ মণ্ডল পাতলা ব্যান্ডেজ কাপড় দিয়ে ঢাকা। অসহ্য যন্ত্রণায় সে কাৎরাচ্ছে। দীপ্ত ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। খুব আস্তে করে মালবীর একটি হাত ধরে। এবং বলে --
' তুমি ভালো হয়ে যাবে, সত্যি তুমি ভালো হয়ে যাবে। আমি আছি তোমার সকল অসুখে, তোমার সকল বেদনায়। এই দেখ -- আমি তোমার হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছি।'                                                
দুই মাস পর মালবীকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে বাসায় নিয়ে আসে। মালবীর পুরো মুখ পোড়া দাগে বিকৃত, কুৎসিত ও ভয়ার্ত রূপ হয়ে গেছে। চোখে দেখতে পায়। কিন্তু চোখের পাতা ও ভ্রূ সব ঝলসে গেছে।                        
                 
দীপ্ত ও দীপ্তর মাকে অনেকে এসে বলে এবং বোঝায়-- দীপ্তর মতো এত সুন্দর একটি ছেলের সাথে মালবীকে যেন বিয়ে না করানো হয়। দীপ্ত ও দীপ্তর মা শোনেনি কারোর কথা। মালবীর সাথে আবারও বিয়ের তারিখ ধার্য করা হয়।       

শাহনাজ বেগম খুব অল্প কজন মানুষ নিয়ে মালবীকে দীপ্তর বউ করে ঘরে নিয়ে আসে। বিয়েতে কোনো আড়ম্বর হল না, সানাই বাজল না, আলোকসজ্জা করা হল না। চারিদিকে কোনো হাসিরাশি নেই। কোনো উৎসব নেই।  কোনো সঙ্গীত নেই। কেমন যেন এক বেদনার সুর কোথাও থেকে ধ্বনিত হচ্ছিল।                                 
       
জীবন থেমে থাকে না। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ জীবন গায় তার জয়গান। পৃথিবীতে আনন্দ এতই ভঙ্গুর যে, তা কাঁচের মতো কখন ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। আবার বেদনাও ঢেকে পড়ে যায় জীবন থেকে পাওয়া নির্মল কোনো আনন্দে।    

একদিন মাঝরাতে শাহনাজ বেগমের ঘুম ভেঙে যায়। আস্তে আস্তে উঠে সে বারান্দায় যেয়ে পায়চারি করতে থাকে। ছেলে দীপ্তর ঘর থেকে তখন ক্ষীণ সুরে একটি গান ভেসে আসছিল, গানটি গাইছিল মালবী। 
'একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে
ওগো বন্ধু কাছে থেকো, কাছে থেকো।'  
রিক্ত আমার ক্ষুদ্র প্রাণে তোমার আঁখিটি রেখো।'


এমনই এক নিঝুম শারদ রাতে আজ থেকে  ছাব্বিশ বছর আগে শাহনাজ বেগম এই গানটি গেয়ে শোনায়েছিল তার স্বামীকে। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে মালবীর গাওয়া গানটি শুনতে থাকে। নয়নে বয়েছিল তখন অশ্রু ধারা।         
      
                
কোয়েল তালুকদার
১২ মে, ২০২০ ইং, ঢাক।                 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন