বাঁধন কেটে যায়
আমার ভালোই লাগত ওদের উড়াউড়ি ছোটাছুটি কিচিরমিচির। সকালবেলা ওদের কিচিরমিচির যেন বেড়ে যায়। মনে হতো, ওরা যেন বলছে --- 'ঘুমিয়ে থেকো না, ওঠো, তোমার অফিসে যাবার সময় হয়েছে।'
একদিন দেখলাম, মেয়ে চড়ুইটি বাসার ভিতর চুপটি করে বসে আছে। বুঝতে পারলাম, ডিম পেরেছে। সেই ডিমে তা দিচ্ছে। আমার খুব ভালো লাগল -- ওরা বাসা বাঁধল। এখন ওদের ছেলেমেয়েও হবে।া
আমি জেনেছিলাম, মেয়েরা যখন পোয়াতি হয়, তখন নাকি তাদের ভালো মন্দ খাবার খেতে হয়। এই ভেবে আমি একদিন অফিস থেকে আসার সময় দোকান থেকে চালের খুঁদ ও বিস্কুট কিনে নিয়ে আসি। আমি প্রতিদিন উঠোনে চালের খুঁদ ও বিস্কুট গুঁরো করে ছিটিয়ে দিতাম, চড়ুই দুটো খুব মহানন্দে তা খেত।
তারও কিছুদিন পর দেখলাম, চড়ুয়ের ডিমগুলো থেকে বাচ্চা ফুটেছে। ছেলে চড়ুই ও মেয়ে চড়ুই দুজনের চোখে মুখে সে কি হাসি! ওদের নতুন ধরনের কিচিরমিচির শব্দ শুনেই আমি তা বুঝতে পারতাম। ওদের পরিবারের সংখ্যা যেহেতু বেড়ে গেছে, তাই আমি খুঁদ ও বিস্কুটের গুঁরো বেশি করে উঠোনে ছিটিয়ে দিতাম।
বাচ্চা চড়ুইগুলো দিনে দিনে বড়ো হয়ে উঠল। আর একদিন দেখলাম, সেই বাচ্চা চড়ুইগুলো আর নেই।ওরা উড়ে চলে গেছে।
কয়দিন চড়ুই দুটোকে খুব মন খারাপ দেখলাম। ওরা আমার ছিটানো খাবারগুলো তেমন খাচ্ছে না।কিচিরমিচিরও তেমন করে না।
তারও কয়েকদিন পরে দেখি, ওরা আগের মতোই উড়াউড়ি ছুটাছুটি করছে। যেন সব দুঃখ বেদনা ভুলে গেছে। সকালবেলায় কিচিরমিচির করে আগের মতই বলত -- 'তুমি ওঠো, তোমার অফিসে যাবার সময় হয়ে গেছে।'
কতোদিন ধরে চড়ুই দুটো আমার ঘরের বারান্দায় বাসা বেঁধে আছে, আমার ভালই লাগত ওদের সাথে এই একাকী জীবন যাপন। মনে হতো, এই একাকী বাড়িতে কেউ না থাকলেও ওরা তো আমার সাথে আছে।
তার আরো পরে যেদিন আনন্দ উৎসব করে আমি বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে আসলাম। সেদিন চড়ুই দুটোও আমার সব আনন্দ উৎসব দেখল। ওদেরকেও খুব হাসি খুশি মনে হল। ওদের কিচিরমিচির আমার কাছে আনন্দ সঙ্গীতের মতো মনে হয়েছে।
পরের দিন সকালবেলা নতুন বউয়ের সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলাম, নতুন বউকে বললাম -- এই পাখি দুটো ছিল আমার একাকীত্বের সঙ্গী। ওরা আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিত।
কিচিরমিচির করে পাখি দুটো কী যেন বলছিল তখন, বুঝতে পারিনি।
ঐদিন সারাদিন পাখি দুটোকে আর দেখতে পেলাম না। সন্ধ্যায়ও ফিরে এল না। পরের দিন সকালেও না। আসলে ওরা বাঁধন কেটে উড়ে চলে গেছে। পরে মনে হয়েছিল -- ওরা যে কাল যাবার বেলায় কিচিরমিচির করে যে কথা বলেছিল, তখন তা বুঝতে পারিনি ।
ওরা হয়ত বলেছিল -- 'তোমার ঘরে এখন নতুন মানুষ এসেছে। এখন থেকে সেই তোমায় সকালবেলা ঘুম ভাঙাবে। তোমাকে গান গেয়ে শোনাবে। তুমি তার সাথে গল্প করবে। আমাদের দায় শেষ। আমরা তাই উড়ে চলে গেলাম।'
কোয়েল তালুকদার
২২ মে, ২০২০ ইং, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন