শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০

কেবা আপন কেবা পর

কেবা আপন কেবা পর 

অনেক আগের এক জৈষ্ঠ্য  দিনের কথা। আমি তখন বাগবাটী স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। গরমের কারণে তখন মর্নিং শিফট স্কুল ছিল। 

এগারোটায় স্কুল ছুটি হয়েছে। বাড়িতে চলে আসব। বই হাতে স্কুলের মাঠের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছিলাম। পা ফেলতে ফেলতে   হঠাৎ করে জেবুন্নেসা বুবুর কথা মনে হল। একবার আমাদের বাড়ি থেকে আসার সময় আমাকে কাছে টেনে আদর করে জড়িয়ে ধরে বুবু বলেছিল -- তোমার স্কুল থেকে আমার বাড়ি মাইলখানেক দূরে, যদিও বামদিকে উল্টো যেতে হয়, তবুও তুমি একদিন যেও। দেখে এসো আমাকে। আমি বুবুকে মাথা নেড়ে বলেছিলাম -- আচ্ছা, যাব একদিন।     
        
সেই প্রতিশ্রুতির কথা হঠাৎ মনে হল।    

পিছনে তাকিয়ে দেখি -- আমাদের ক্লাসের সাইফুল ও আমিনুল হেঁটে হেঁটে  আসছে।  আমি থেমে যাই।ওদের বাড়ি দত্তবাড়ি গ্রামে। ঐ গ্রামই হচ্ছে বুবুদের গ্রাম। আমি ওদেরকে বলি -- 'আমি তোদের সাথে আজ তোদের গ্রামে যাব।'  
ওরা তো বেজায় খুশি। ওরা বলে -- 'তা কার বাড়িতে যাবি তুই?' আমি বললাম, মোঃ আব্দুস সোবহান শেখের বাড়িতে যাব। উনি আমার দুলামিঞাভাই হন।'     

আমি এর আগে কখনও এই পথ দিয়ে বুবুদের বাড়িতে যাই নাই। আজই প্রথম যাচ্ছি। কী সুন্দর এই পথ। ইউনিয়ন বোর্ডের তৈরি কাঁচা রাস্তা। দু'ধারে বাড়ি। গাছ আর গাছ। হেঁটে যেতে জৈষ্ঠ্যের রোদ একটুও গায়ে লাগে না। রাস্তাটি সরু হলেও টমটম চলে। কিন্তু গরুর গাড়ি চলে না। সেই জন্য ধুলো কম। দুপাশে ঘাসও আছে।        

যেতে যেতে পথে কত বাড়িতে কত রকম গাছ যে দেখছিলাম!  আম, কাঁঠাল, জাম, জারুল, সোনাল, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, খেজুর, ডুমুর, নিম, সাজনা, আকন্দ, জাম্বুরা, পিয়ারা, কলা গাছ, তেঁতুল, ছিটকি, বাবলা সহ আরও কত রকমের গাছ। পাখিও দেখছিলাম কত রকমের!  ঘুঘু, ওরোল, ঘরবাদুনী, চড়ুই, শালিক, টুনটুনি, হলুদ ফিঙে, বুলবুলি, কাক, দোয়েল সহ আরও অনেক রকম পাখি।

এক জায়গায় দেখি -- একটি বড়ো জামগাছ। সারা গাছ ভর্তি পাকা জামে নীল হয়ে আছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গাছ তলায় জটলা করে দাঁড়িয়ে  আছে। পাখিরা ঠুকরে জাম খাওয়ার সময় অনেক সময় পাকা জাম নীচে পড়ে। কখনও আবার বাতাসেও টুপটুপ করে ঝরে পড়ে। সেইসব পাকা জামগুলো ওরা কুড়িয়ে খাচ্ছিল। আমরাও কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়ালাম। এবং কুড়িয়ে পাকা জাম খাই।     

বেলা বারোটার মধ্যেই আমি দত্তবাড়ি গ্রামে জেবুন্নেসা বুবুদের বাড়িতে পৌঁছে যাই। বুবু তো আমাকে দেখে যারপরনাই খুশি হন। আমাকে কাছে টেনে তাঁর আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে দিলেন ।  তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকেন। আমি বুবুকে বললাম - তোমার এইসব করতে হবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা !  

বুবু বাড়ির কামলা দিয়ে পুকুরপাড়ে ডাব গাছ থেকে ডাব পেড়ে ডাবের পানি খাওয়ালেন। মুড়ি খেতে  দেন ঝুনা নারিকেল আর কুশালের গুর দিয়ে। কয়েকটি পাকা আম ছিলে আমাকে দিয়ে বলল -- 'গেদা, এই আমগুলো আমাদের গাছের। খুব মিষ্টি। খাও এগুলো।'        

আমি এই বাড়িটিতে এর আগে আরও দুই একবার এসেছিলাম বাবার সাথে। তখন আরও ছোট ছিলাম। পাঁচ ছয় বছর বয়সের সময়। তেমন কিছু মনে নেই।  আজ বাড়িটি দেখে খুব ভালো লাগছে। 
বাড়ির তিন পাশে শস্যের ক্ষেত। পিছনে বড়ো বড়ো আম কাঁঠালের গাছ। অনেকটা জঙ্গলের মতো। পূর্ব পাশে ছোট্ট একটি পুকুরও আছে। 

সবচেয়ে ভালো লেগেছে গ্রামটি। পুরো গ্রামটি একটি বাঁশ ঝাড়ের বাগান যেন। একে বাঁশ ঝাড়ের বনও বলা যেতে পারে। বুবুদের বাড়িটিও বাঁশ ঝাড়ে বেষ্টিত। বাড়ির সামনে এক দুটো ফসলের ক্ষেতের পরই এই বাঁশবন।    

দুপুরে লিচুতলায় কাঠের হেলাঞ্চির উপর বসে ছিলাম। দেখি, দুটো বেজী বের হয়ে আসছে বাঁশ ঝাড়ের ভিতর থেকে। বেজী দুটো পিটপিট করে কতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি 
ওদের 'হো' বলতেই দৌড়ে জঙ্গলের ভিতর লুকিয়ে যায়।     

বুবুদের একটি পাখির ঘরও আছে । সেখানে কয়েকটি খরগোশ, দুটো টিয়াপাখি, অনেকগুলো মুনিয়া পাখি দেখলাম। পুকুর পাড়ে চারটি রাজহাঁস প্যাক প্যাক করে ঘাস খাচ্ছিল। পুকুরের জলে অনেকগুলো দেশি হাঁসও জলকেলি করছিল।         

আর, সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছিল বাঁশ ঝাড়ের দিক থেকে আসা বিভিন্ন পাখপাখালিদের কিচিরমিচির শব্দ। বুবু এসে বলছিল -- কুয়া থেকে ঠান্ডা পানি তুলে রেখেছি। চলো, গোসল করে নাও। আমি গোসল করবই না, বুবু আমাকে জোর করে গোসল করে দেয়। মাথায়, গায়ে, হাতে,পায়ে সাবান মেখে গোসল করে দিল। সে নিজেই আমার মাথা গা মুছে দিল। যেমন করে আমার মা আমাকে ছোট বেলায় গোসল করিয়ে দিত।       

বুবু আমাকে শীতল পাটিতে বসিয়ে খেতে দেয়। আমার সাথে দুলামিঞাভাইও বসে। বুবু এরই ফাঁকে কখন মোড়গ জবাই করে ও পুকুর থেকে মাছ ধরে রান্না করেছে। জানতাম না। কাতল মাছ ভেজেছে, আবার রান্নাও করেছে। চাল কুমড়া ভাজি, কাতল মাছের মাথা দিয়ে মুগডালের ঘন্টো, ডিমের তরকারি, ডাল, কলার ক্যান দিয়ে নাবড়া, মিষ্টি কুমড়া ভর্তা, এইসব  দিয়ে আমাকে খেতে দিল। আমি ছোট মানুষ! এত কিছু কী খেতে পারি?  খাওয়া শেষে আবার আম দিয়ে দুধ ভাতও খেতে দেয়।     

বিকালে বুবুকে বলি -- আমি এখন বাড়ি চলে যাব।
বুবু বলছিল -- আজ থাকো, কাল যেও।
আমি বললাম -- না। আজই চলে যাব। মা বকবে। চিন্তা করবে।        
                          
আমি আমার বইখাতা হাতে নেই। বুবু বললো -- আমি তোমাকে বাঁশ ঝাড়টা পার করে দিয়ে আসি। তারপর সোজা পথ,  তুমি তখন একা চলে যেতে পাররে।          

বুবু আমার হাত ধরে হাঁটতে থাকে। বাঁশ ঝাড়ের ভিতর দিয়ে পায়ে হাঁটার পথ।  কি যে ভালো লাগছিল!  আলোছায়ার সে এক মায়াবী পাতা ঝরার শব্দ । পাখিরা কিচিরমিচির করছিল।  বাঁশ ঝাড়ের পথ পেড়িয়ে আমি ও বুবু খোলা জায়গায় এসে পড়ি।

আমি তো খোলা প্রান্তর দেখে বিস্ময়ে চেয়ে থাকি।  অনেক দূর পর্যন্ত খালি মাঠ। মাঠের পর মাঠ। ক্ষেতের পর ক্ষেত। সবুজ আউশ ধানক্ষেত! সবুজ পাতার গালিচা যেন মেলে রেখেছে। এই খোলা প্রান্তরটি প্রায় এক মাইলের মতো হবে। যাকে নির্জন পাথার বলে।           

বুবু আমাকে বলছিল -- একা এই পাথার পারি দিতে পারবে?
--- পারব।
--- ভয় পাবে না তো!
--- না।
--- তুমি যতক্ষণ এই পাথার পার হবে, ততক্ষণ আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব।
--- আচ্ছা। আমি পিছনে ফিরে ফিরে তোমাকে দেখব।
-- ওহ! আমার সোনার ভাইরে! 

বুবু আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে --
তুমি আবার এসো।
-- না, আমি আর আসব না।
-- কেন, ভাই!
-- তুমি আমাকে বেশি করে খাওয়াও কেন? আমি কী অত খেতে পারি নাকি?
-- আচ্ছা, লক্ষী ভাইটা আমার! তুমি আবার যখন আসবে তখন একদম কম খাওয়াব।
--- আচ্ছা।                                                                      
                          
আমি সেই পাথার একাকী হেঁটে পার হতে থাকি। হাঁটছি যত পিছনে তাকিয়ে বুবুকে দেখছিলাম তত। যত দূরে চলে আসি তত বুবুকে আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম। আরও দূরে যখন চলে আসি তখন বুবুকে একটু বিন্দুর মতো দেখতে পাচ্ছিলাম।  পাথার পার হয়ে যখন এপারে চলে আসি, দেখি -- বুবু কোথায় যেন হারিয়ে গেল! আর দেখতে পাচ্ছিলাম না।                                      

হ্যাঁ,  আমার সেই বুবুটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। সেও আরও অনেক বছর পর।  

আমি কী কখনও তার মতো করে তাকে মায়া করেছি?  মায়া করলেও কেউ কী তা বিশ্বাস করবে? সে যে আমার সৎ বোন ছিল।     

আজও যখন কোনো স্তব্ধ মুহূর্তে  সুখ দুঃখের কোনো স্মৃতি বিস্মৃতি হাতড়াই, তখন মনে পড়ে -- সেই কৈশোরে  স্কুল থেকে ফেরা একটি বালককে আপন করে  হাত ধরে বাঁশঝাড়ের পথ ধরে কেউ  নিয়ে আসল। সবুজ ধানক্ষেতের পাশে জড়িয়ে ধরে আদর করল, চেয়ে চেয়ে দেখল সেই বালকের ফিরে আসা। 

তখন তার চোখ কী একটুও বিষাদে ভরে ওঠেনি ! সে কী কেবলই মরীচিকার মতো কোনে ঢেউ ছিল? অন্তরে বাজেনি কী তখন কোনো আপন রক্তের স্পন্দন !                              


কোয়েল তালুকদার
১৫ মে, ২০২০ ইং, ঢাকা।   


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন