বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৭

মৈত্রেয়ী দেবী ও মির্চা এলিয়াদের প্রেম

কোলকাতা শহরের ভবানিপুরে মৈত্রেয়ী দেবী নামে ১৬-বছরের এ তরুণি বাস করতো তার মা, বাবা, বোনের সাথে। মির্চা এলিয়াদের জন্ম রুমানিয়ার বুখারেস্টে। ১৯২৮-৩২ সালে ভারতে 'নোয়েল এন্ড নোয়েল' কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে ২৫০-টাকা বেতনে সে ভারতে আসে চাকুরি করতে। উদ্দেশ্য চাকুরির সাথে ভারতীয় সংস্কৃতি আর জ্ঞান সাধনা। এবং ঘটনাক্রমে  মৈত্রেয়ী'র বাবা ড. সেনের বাড়িতে পেয়িংগেস্ট হয় তখনকার খৃস্টধর্মী ইউরোপিয়ান শেতাঙ্গ মির্চা। এ দার্শনিক বিজ্ঞানীর মেয়ে তৎকালীন ভারতীয় কফিরঙা অমৃতা কলেজছাত্রী, ভাবুক ও কবি। তার কথাবার্তায়, চালচলনে রয়েছে কিছুটা দার্শনিকতার ছাপ। অল্প বয়সী মেয়ের এমন আচরণ মির্চার মধ্যে যার পর নাই বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। একদিন সেই মেয়েটিকেই তখনকার ফ্রেন্স ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়ল মির্চার ওপর। আর মেয়েটিকে দেয়া হলো মির্চাকে ঐ সময়ের কলকাতার বাংলা শেখানোর কাজ। 
১৯৩০-সালে কালচে বাদামি রঙের ভারতীয় এ বালিকার সাথে রোমানিয়ার এ তরুণের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনা। এ সম্পর্ক তারা গোপন রাখতেও পারেনি বেশিদিন। অল্পদিনেরই অভিভাবকেরা বিষয়টি জেনে যায়। জাতপাত তথা ধর্মীয় কারণে তরুণটিকে শিক্ষকের বাড়ি থেকে চলে যেতে রূঢ়ভাবে এবং আর কখনোই মেয়েটির সাথে যোগাযোগ না করতেও বলা হয় কঠোরতর নির্দেশে। সন্যাসজীবন শেষে পরবর্তীতে সেই তরুণ পরিচিতি পান বিশ্বখ্যাত দার্শনিক হিসেবে। লেখেন একটি আধা-আত্মজৈবনিক উপন্যাস। উপন্যাসটির ইংরেজি নাম 'বেঙ্গল নাইটস'। মির্চা এলিয়াদও এরপর সংসারি হন। তার স্ত্রীর নাম ছিল Nina Mareş কিন্তু  ঘটনাক্রমে জ্ঞানতাপস মির্চার আগেই মৃত্যুবরণ করে তাকে একাকি রেখে।
 বিশ বছর বয়সে অমৃতার বিয়ে হয়ে যায় কলকাতার ভারতীয় মনমোহন সেনের সাথে। তাদের সন্তানও হয় দুটো। এরপর সে লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন, প্রকাশ করতে থাকেন কবিতা ও গদ্যের বিবিধ বইপত্র। ১৯৭২-সালের দিকে লেখকের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কোলকাতায় এলে অমৃতা বুঝতে পারেন যে, 'বেঙ্গল নাইটস বইটিতে তাদের দুজনের 'যৌন' সম্পর্কের বর্ণনা করা হয়েছে। ঐ বইতে মির্চা সহজাতভাবে লেখেন, তাদের প্রেমের এক পর্যায়ে প্রায়শ রাতে তার প্রেমিকা তার ঘরে চলে আসতো তথা তাদের মধ্যে স্থাপিত হতো শারীরিক সম্পর্ক। যদিও মির্চার বইর উৎসর্গপত্রে অমৃতাকে লেখা ছিল "..... Tomar Ki moné acché ? .... Yadi thaké, taholé Ki, Kshama Karté Paro ? ...." 'মির্চার এ বর্ণনা পরিপূর্ণ মিথ্যে' - এ সত্য প্রতিষ্ঠা করতেই পাল্টা আরেকটি বই লেখেন মৈত্রেয়ী দেবী বা অমৃতা। সে বইটিই হলো ‘ন হন্যতে’। বাংলা করলে ‘ন হন্যতে’-এর অর্থ দাঁড়ায়, "হত্যা করা যায় না" বা "নিহত হয় না" এমন কিছু। মানবাত্মার আঁধার যে মানব-শরীর, তাকে হত্যা করা যায় কিন্তু আত্মাকে যায় না। 
 ১৯৫৭ শিকাগোতে ইতিহাসের ধর্মীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন মির্চা এলিয়াদ, স্ত্রীীক হারিয়ে নি:সঙ্গ একাকি জীবন কাটাতে থাকেন পুস্তক আর জ্ঞানের রাজ্যে। ১৯৮৬-সনে মির্চার মৃত্যুর আগে অমৃতা একাকী ভারতবর্ষ থেকে শিকাগোতে গমন করেন, কেবল তার ১৬-বছর বয়েসি প্রেমিক মির্চার সাথে দেখা করতে। কিন্তু শেষ জীবনে অমৃতা যখন পৌঁছলো তার বিশ্ববিদ্যালয়ে, মির্চা ততদিনে অন্ধ হয়ে গেছে চিরদিনের জন্যে। তাদের সেই সাক্ষাতের দৃশ্য আমাদের চিত্তকে এতো আলোড়িত করে যে, সারা জীবন তা ভোলার নয়। সাক্ষাতের প্রথমেই মির্চার টেবিলে অমৃতা তার নিজের লেখা ৪০-বছর আগের যে চিরকুটটি দেখতে পায়, তাতে লেখা ছিল - "অজস্র মণিমুক্তা সজ্জিত সুবর্ণ দেবতার মত, অপার অসীস সুষমায় আমি তোমার সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণতা হই, আর তুমি আমাকে বুকে তুলে নাও"। ঐ চিরকুটির কোনে মির্চারও শেষ কথাটি ছিল - "আমার প্রচণ্ড ইচ্ছে করতে লাগলো, অমৃতাকে অন্তত একবার চোখের সামনে দেখি"।
এবং ৪২-বছর পর অশীতিপর বৃদ্ধা অমৃতা যখন পৌছলো বৃদ্ধ অধ্যাপকের কক্ষে মেঝেতে ছড়ানো হাজারো পুস্তকের পাহাড় ডিঙিয়ে, তখন তার কাঙ্খিত ২০-বছরের মির্চা চুলহীন টাক মাথায় থুড়থুড়ে বুড়ো তার দিকে না তাকিয়েই বললো - "তুমি অমৃতা"। এবং প্রলাপের মত যখন মির্চা স্বগতোক্তিতে বলতে লাগলো - "চল্লিশ বছর! হায়! চল্লিশ বছর"। তখন ঐ কথার রেশ টেনে অমৃতা বললো-
- "জান লোকে আমায় জিজ্ঞাসা করে, কতোদিন তুমি আমাদের বাড়িতে ছিলে, আমার মনে পড়ে না, কতো দিন ছিলে বল তো?'
'হাজার বছর-' তবে?... আমি তো সেই তোমাকেই দেখতে এসেছি, যাকে Weapon cannot pierce, fire cannot burn... সংস্কৃতিতে বললে, 'ন হন্যতে হন্য মানে শরীরে-' ।
ফিরে যাচ্ছিল অমৃতা -অবশেষে কথা কইতে কইতে মুখ তুললে অমৃতা দেখলো স্থির দৃষ্টির পাথুরে চোখ মির্চার। চোখের আলো নিভে গেছে তার। এবং অমৃতার কণ্ঠ রুদ্ধ অনুভব করে মির্চা বললো -
......'একটু দাঁড়াও অমৃতা-... এতো দিন এতো সাহস দেখিয়ে, এখন তুমি ভেঙে পড়লে কেন? আমি বলছি, আমি যাব তোমার কাছে, এখানে নয়, সেখানে গঙ্গার তীরে, আমার সত্যরূপ তোমাকে দেখাব I will show you my real self on the shores of the Ganges..।'
এবং অমৃতারূপী মৈত্রেয়ী দেবী তার উপন্যাসটির শেষ বাক্য পর্যন্ত পাঠকদের ধরে রাখেন তার সৎ ভাষণে স্নাত করে যে, "ফিনিক্স পাখি হলেও মির্চার চোখে আলো জ্বালাবেই সে একদিন"। এবং শেষ বাক্যটি মির্চাই বলে - 'যেদিন ছায়াপথে তোমাদের দেখা হবে, তার তো আর বেশি দেরি নেই।'

তথ্য সূত্রঃ  ‘ন হন্যতে’,মৈত্রেয়ী দেবী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন