সোমবার, ১২ জুন, ২০১৭

আষাঢ়ের প্রথম দিন

বিয়ের কয়েক মাস পরের কথা। স্ত্রী বাপের বাড়ী নাইওর চলে গিয়েছে। সকালবেলা খবরে কাগজ পড়ে জানতে পারলাম, আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। জানালা খুলে দেখি,বাইরে সত্যি সত্যি বৃষ্টি হচ্ছে। মনটা একটু খারাপই হয়ে গেলো। এমন বাদল দিনে আমি একা। ঘরে সে নেই। বিটিভি অন করতেই জানা গেলো আবহাওয়ার খবর। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ শুরু হয়েছে। এ রকম মেঘলা বৃষ্টি থাকবে নাকি আরো তিন দিন। খবরটা শুনে মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে গেলো।

ঘর থেকে বৃষ্টির মধ্যেই বড়ো কালো ছাতাটি নিয়ে বের হই। প্রথমে আজিজের হোটেলে গরম পরোটা খেয়ে নেই।তারপর চলে যাই অফিসে। অফিস থেকে ফিরে আসি সন্ধ্যায়। রাতেও ছাতা মাথায় দিয়ে হেটে হেটে চলে যাই আজিজের হোটেলে। শুনলাম ওরা নাকি আজ কচু দিয়ে ইলিশ মাছ রান্না করেছে। আমি ইলিশ মাছের অর্ডার দিলাম।মাছ দিয়ে ভাত খেতে বসেছি. তখন বেয়ারা এসে বললো- 'স্যার রুই মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডালের ঘন্টো রান্না করা আছে, দিবো নাকি?' আমি বললাম- দাও । হোটেলে ভাত খেয়ে বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা মোরে দিয়ে ঘরে চলে এলাম।

বাড়ীতে আর কেউ নেই। রাতে একা একা বিছানায় শুয়ে আছি। গ্রামীন পরিবেশ। বাংলো টাইপের ঘর। টিনের চালের উপর ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে ঝরো বাতাসও বইছে। হঠাৎ করেই জানালার কাঠের পাল্লা বাতাসে শব্দ করে দুলে ওঠে। ঘরের পশ্চিম পাশে বাঁশ ঝাঁর। দমকা বাতাসে হেলানো বাঁশগুলো টিনের চালে ঘর্ষণ দিচ্ছিলো। একা একা একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম। ঘুমও আসছিলোনা। উঠে বিছানার এক পাশে এসে বসি। বৃষ্টি তখন অঝোর ধারায় ঝরছে। খুব ইচ্ছা হলো রাতের এই বৃষ্টি দেখতে। দরজা খুলে বাইরে চলে আসি। ঘরের চাল থেকে বৃষ্টির জল তখন গড়িয়ে পড়ছে। আমি হাত দিয়ে সে জল ধরলাম। বাইরে  নিস্তব্ধ নির্জন অন্ধকার। দূরে কেবল এয়ারপোর্ট টার্মিনালের আলোটাই দেখা যাচ্ছিলো।

আমি ঘরের ভিতর এসে আবারও শুয়ে পড়ি। ঘুমাবার চেস্টা করছিলাম। কিন্তু ঘুম আসছিলোনা। বাইরে বাঁশ ঝাঁরে কোঁত কোঁত করে পেঁচা ডেকে উঠলো। তার কিছু পরে বিমান বন্দর স্টেশনে ট্রেনের হুইসেলের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি শুয়ে আছি, জানালাটা আরো একবার ঝরো বাতাসে দুলে ওঠে। হঠাৎ বাইরে বারান্দার  গেটে কড়া নারার শব্দ শুনতে পাই। একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম, তারপরও উঠে দরজা খুলে বারান্দায় চলে আসি। দেখলাম, আমার স্ত্রী বাইরে দাড়ানো। পরনের সালোয়ার কামিজ বৃষ্টির জলে ভিজে গেছে। আমি এতো রাতে তাকে দেখে বিস্মিত হই। গেট খুলে দেই। সে ভিতরে প্রবেশ করে।

ঘরের ভিতর আমার বিছানায় এসে সে বসলো। হাতে ওর একগুচ্ছ ভেজা কদমফুল। ফুলগুলো আমার হাতে দিয়ে বললো- 'আজ এই প্রথম বর্ঘার রাতে তোমাকে আমার ভালোবাসায় সিক্ত করলাম।' আমি ফুলগুলো হাতে নিয়ে তার সুবাস নেই, তারপর বলি - 'হঠাৎ এতো রাতে কি ভাবে তুমি এলে ?'

স্ত্রী:  ট্রেনে চলে এলাম। পথে কোনো অসুবিধাই হয় নাই।
আমি :  তোমারতো আরো পরে আসার কথা ছিলো, এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলে যে ?
স্ত্রী :  সকালে বৃষ্টি দেখে তোমার কথা খুব মনে পড়লো। তুমি বৃষ্টি পছন্দ করো এবং সেই বৃষ্টির সময়ে আমি তোমার কাছে থাকবোনা তা কি করে হয় ? এটা মনে করেই তোমার কাছে চলে এলাম।
আমি : এই ফুল কোথায় পেলে ?
স্ত্রী:  রাজেন্দ্রপুর স্টেশন থেকে কিনেছি।

সে তার গায়ের ভেজা জামা কাপড় চেঞ্জ করে নিলো। হঠাৎ এই বৃষ্টির রাতে ওকে পেয়ে চিত্ত আমার আনন্দে ভরে উঠলো। আষাঢ়ের প্রথম দিনে সকালবেলায় যে শূণ্যতা অনুভব করছিলাম, আজ এই রাতে তাকে কাছে পেয়ে মন প্রাণ পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। দেখলাম ,সে একটি সাদা রঙ্গের সালোয়ার কামিজ পড়েছে। মূখে কোনো সাজ সজ্জা করা নেই। নির্মল প্রকৃতির মুখ। কবেকার সেই লোধ্ররেণুও সে মাখেনি। পায়ে তার রূপার নুপুরটাও আজ পড়ে নাই। বৃষ্টির রিনঝিন ধ্বনি যেনো তার পায়ে বাজছে। এই বৃষ্টি ঝর ঝর বাদল দিনে স্টেরিওতে কোমল মৃদমন্দ সুরে গান শুনতে ইচ্ছা করলো-

'আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরানসখা বন্ধু হে আমার॥
আকাশ কাঁদে হতাশ-সম, নাই যে ঘুম নয়নে মম--
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বার॥
বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,
তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
সুদূর কোন্ নদীর পারে, গহন কোন্ বনের ধারে
গভীর কোন্ অন্ধকারে হতেছ তুমি পার।'

গান বাজতে বাজতে একসময় গান থেমে যায়। বাইরে বৃষ্টির আবেগ প্রবল হতে থাকে।দমকা বাতাস ঝড়ে রূপ নিলো।ঝুম ঝুম শব্দে ভরে উঠলো বাইরের পৃথিবী। কে কবি কখন লিখেছিলো- 'এমন দিনে কি তারে বলা যায় !' অথবা 'দুঁহ করে দুঁহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।' তারপর বৃষ্টির রিমঝিম দোলায় কখন ঘুমিয়ে গেছি,জানি নাই।

সকালে দেরী করেই আমার ঘুম ভাঙ্গে। বাইরে তখনো  বৃষ্টি হচ্ছিলো। পাশে ফিরে দেখি বিছানায় সে নেই। ভাবলাম, আগেই ওর ঘুম ভেঙ্গেছে । হয়তো সে স্নান ঘরে গেছে। অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ,কিন্তু আসছিলোনা। খুঁজলাম এ রুম ও রুমে, কোথাও সে নেই। ঘরের দরজা এবং বারান্দার গেটও বন্ধ। বিস্ময়ে ভাবছিলাম- তাহলে কোথায় গেলো সে ! আলনায় রাতের ভেজা সালোয়ার কামিজ মেলে দেওয়া দেখলাম। বিছানার কাছে যেয়ে দেখি- রাতের কদম ফুলগুলো এলোমেলো হয়ে বিছানার উপরে পড়ে আছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন