বুধবার, ১৪ জুন, ২০১৭

বৃষ্টিমঙ্গল

আমি তখন বাগবাটী স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র। আষাঢ় মাস শুরু হয়েছে। কিন্তু নদী নালায় তখনো বন্যার পানি ঢোকে নাই। সেদিন স্কুলে ক্লাস শেষে বাড়ী ফিরবো কিন্তু হঠাৎ আকাশ জুড়ে মেঘ দেখা দেয় এবং বৃষ্টি নামা শুরু হয়। সবাই বৃষ্টি থেমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমি আর তা করলাম না। বইগুলো প্লাস্টিকের কাগজে পেঁচিয়ে নেই। ধূলির রাস্তা একটু বৃষ্টি হলেই কাঁদা হয়ে যেতো। কাঁদায় স্যান্ডেল পড়ে হাটা যেতো না। আমি একহাতে বই আরেক হাতে স্যান্ডেল নিয়ে আড়াই মাইল পথ কাঁদায় হেটে এবং বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ী ফিরি। মা প্রথমেই তার শাড়ীর আঁচল দিয়ে আমার মাথা মুছে দেয়। কিন্তু মাথা মুছে্ দিলে কি হবে, রাতে ঠিকই ভীষণ জ্বর এসে গিয়েছিলো।

একবার বাবার সাথে শহর থেকে হেটে বাড়ী ফিরছিলাম। শৈলাভিটা খেয়াঘাট পার হওয়ার পর থেকেই মুশলধারে বৃষ্টি শরু হয়ে যায়। পথ চলতে যেয়ে বাবা তার হাতের ছাতা আমার দিকে ঝুঁকে রাখে। আমি যেনো ভিজে না যাই। কিন্তু আমি বার বার ছাতার বাইরে এসে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকি। সেদিন সারা রাস্তা বাবার ছাতার নীচে এমনি লুকোচুরি খেলে ভিজতে ভিজতে বাড়ী ফিরে এসেছিলাম।

তখখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমি। কবি জসিম উদ্দীন হলে থাকি। সেদিন সারাদিন বৈশাখের তপ্ত গরম ছিলো। রাতে সামান্য গুরি গুরি বৃষ্টি হচ্ছিলো। ঠিক ঐ রকম নয়, দু'এক ফোঁটা ফোঁটা। একটু শীতল হওয়ার জন্য সে রাতে সারারাত আমি আর আমার এক বন্ধু হলের ছাদে শুয়ে থেকেছিলাম।

ঢাকার দক্ষিণখানের বাড়ীতে তখন আমি একা থাকি। বর্ষার দিনে সন্ধ্যার পর অফিস থেকে যখন বাড়ী ফিরতাম, তখন প্রায়ই বৃষ্টির জন্য প্রা্র্থনা করতাম। এয়ারপোর্ট বাস স্ট্যান্ডে নামার পর যেদিন বৃষ্টি পেতাম, সেদিন আমার মনের স্ফূর্তি বেড়ে যেতো। আমি সারা পথ একাকী ভিজতে ভিজতে ঘরে চলে যেতাম।একা থাকার কারনে কেউ দেখতে পেতোনা আমার শরীরের ভেজা কাপড়।

সবে মাত্র বিয়ে করেছি তখন। একদিন সন্ধ্যার পর আমরা দুজন শেরেবাংলা নগর মামার বাসা থেকে রিক্সায় করে মিরপুরে আমার বোনের বাসায় যাচ্ছিলাম। আবহাওয়া অফিসের কাছে যেতে না যেতেই মেঘ শুরু গম্ভীর করে বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে। আকাশ ভেঙ্গে বূষ্টি শুরু হয়ে যায়। বউ রিক্সার হুট উঠিয়ে দিতে চায়। আমি বাঁধা দেই। আমরা দুইজন কাক ভেজার মতো ভিজে চুপসেে যাই। সেদিন মিরপুর পর্যন্ত সারা রাস্তা ভিজে ভিজে চলে গিয়েছিলাম। আমার বালিকা বধূ প্রথম সেদিন বুঝতে পেরেছিলো- একটা পাগল তার কপালে জুটেছে।

ফুয়েন্টসোলিং ভূটানের একটি ছোট্ট শহর। একে একটি বাজারও বলা যেতে পারে। ভারতের জলপাইগুরির জয়গাঁও সীমা্ন্ত লাগোয়া এই শহরটি অবস্থিত। ভারত থেকে সড়কপথে ভূটানে যাবার অন্যতম এটি একটি প্রবেশ দূয়ার । এই ফুয়েন্টসোলিং এ যাওয়ার উদ্দেশ্যে শিলিগুরি থেকে আমি আর আমার স্ত্রী ট্যাক্সিতে জয়গাঁঁও যাচ্ছিলাম। আমরা যখন ডুয়ার্স অতিক্রম করি তখন থেকেই মুশুলধারে বূষ্টি শুরূ হয়ে যায়। জলপাইগুরির চা বাগানের ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা টিলা পথে আমাদের ট্যাক্সি জয়গাঁওয়ের দিকে চলতে থাকে। গাড়ীর উইন্ড গ্লাস বৃষ্টির জলে ঘোলা হয়ে আসছিলো। চা বাগাানের ভিতর দিয়ে বৃষ্টিমুখর সেই দিনের পথচলা স্বর্গীয় মনে হয়েছিলো । কি যে ভালো লেগেছিলো সেই ক্ষণ। মনে হয়েছিলো এই পথ যেন কোনোদিন শেষ না হয়। কিন্তু-

'গীতিময় সেইদিন চিরদিন বুঝি আর হলো না
মরমে রাঙ্গা পাখি উড়ে সে গেলো নাকি
সে কথা জানা হলো না.....
চোখের ভাষাতে আজকে না হয়
মনের কথা বলো না।'





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন