সোমবার, ৩১ জুলাই, ২০১৭

জ্যোৎস্না পড়ুক গায়ে

তার সাথে আমার কোনো রাগ নেই, কোনো অভিমানও নেই। তারপরও আমরা দুইজন দুইজনের সাথে ঠিকমতো কথা বলিনা। আজ রিক্সায় আসছিলাম ওর মামার বাড়ি থেকে । সারা রাস্তা সে আমার সাথে কথা বললোনা অথচ গোপনে গোপনে আমি তার চুলের গন্ধ নিচ্ছিলাম। উত্তরের এলোমেলো হাওয়ায় ওর মাথার এক গুচ্ছ চুল এসে পড়েছিলো আমার গালে। মাঝে মাঝে ঢেকে যাচ্ছিলো আমার চোখ। সে কি নির্বিকার ছিলো, নাকি সেও দেখছিলো এ সব।
একবার রমনা পার্ক থেকে বেরিয়ে মিন্টো রোড ধরে শেরাটনের দিকে আসছিলাম। বৃষ্টি নেই, রাস্তায় জল নেই, কোনো খানা খন্দক নেই। হঠাৎ শাড়ীর পাঁড়ে জুতা প্যাঁচ লেগে পা ফসকে পড়ে যাচ্ছিলো সে। আমি আমার শক্ত হাতে তার বাহু ধরে ফেলি। দেখলাম তিরিশ সেকেন্ড আমার বুকে সে আলিঙ্গন বদ্ধ হয়ে থাকলো। পথচারীরা সে দৃশ্য দেখে হতচকিত হয়ে উঠেছিলো।
প্রায়ই খাট ছেড়ে সে সোফার উপর যেয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর সে দেখতে পেতো, তার মাথার নিচে বালিশ রাখা আছে, আর শরীর তার চাদর দিয়ে ঢাকা। আমি খাটের উপর ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকি তখন। আমি জানি সে বিস্ময়ে দেখছিলো তার রাতের বেলার এই পরিবর্তনগুলো।
আবার কোনো কোনো দিন উল্টোটাও হয়। একদিন খুব ক্লান্ত্ হয়ে অফিস থেকে ফিরেছি। বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই। যখন ঘুম ভাঙ্গে দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত দেড়টা। আমার চোখের চশমাটি সে খুলে ওয়্যারড্রবে রেখে দিয়েছে। বুকের উপর পরে থাকা পত্রিকাটি ভাঁজ করে সাইড টেবিলে রাখা। খাবার টেবিলে খাবার সাজানো রয়েছে। সে সোফায় বসে মাথা হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমি বিস্ময়ে দেখছিলাম এসব। সে কি ঘুমের ভিতরে আমার এই বিস্ময় ভরা চোখ দেখতে পেয়েছিলো?
খাটের দুই পাশে দুইজন শুয়ে আছি। কথা বলিনা কেউই। মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। সারাদিন অফিসে কাজ করেছি। ক্লান্ত ছিলো শরীর। তাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যাই। সে ওপাশ ফিরে হয়তো জেগেই ছিলো। রাতের শেষ প্রহরে যখন জেগে যাই, দেখি সে আমার বাহুর উপর মাথা রেখে বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার একহাত আমার পাজর জড়িয়ে রয়েছে। আমি নিঃশব্দে চোখ মেলে সবই দেখলাম। আমি জানি তার এই অবস্থাটি ঘুমের ঘোরে হয়েছে।
দেখা গেলো,ডাইনিং টেবিলে বসে একসাথে দুইজন খেতে বসেছি। আমার পাতের ভাত খাওয়া শেষ হয়েছে। সে আর দ্বিতীয় বার দিচ্ছে না। আমি চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ি। দেখলাম সেও পূর্ণ খাবার না খেয়ে উঠে চলে গেলো।
সকাল বেলা অফিসে যাওয়ার সময় টাইয়ের নট বেঁধে দেয়না। আমিও বলতামনা, তুমি বেঁধে দাও। অফিস থেকে বিকাল বেলা বাসায় এসে দেখি, সে আর সেদিন তার চুল বাঁধেনি। চোখে কাজল নেই। হাতের চুড়ি রিনিঝিনি করে বাজেনা।
কেন এই অস্বাভাবিক আচরণ তার? তখন আশ্বিনের মধ্য সময়। তাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। পরনে তার লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি। সেদিন ছিলো পূর্ণিমার রাত। বানের পানি নেমে গেলেও পুকুর ভরা ছিলো জল। সন্ধ্যায় আম আর কদম গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা গেলো। প্রগাঢ় আকুলতা দেখলাম তার ভিতরে। পুকুর পাড়ে বসে থাকবে সে, দেখবে পূর্ণিমার চাঁদ।
পূরানো কাঠের চেয়ার পেতে বসে আছি দুইজন। সে বলছিলো প্রথম কথা -- সারারাত বসে থাকতে ইচ্ছে করছে এইখানে!
আমি : আমার সারা জীবনই বসে থাকতে ইচ্ছা হয়।
আমি : একটা গান গেয়ে শোনাও না।
সে : আমি তো গান গাইতে পারিনা।
আমি : গুণ গুণ করে শুধু কথাগুলো শোনাও।
সে : ' একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে
ওগো বন্ধু কাছে থেকো, কাছে থেকো
রিক্ত আমার ক্ষুদ্র প্রাণে
তোমার আঁখিটি রেখো। '
আমি : এই গানটি আমার খুব প্রিয়। আমার এক বন্ধু এই গানটি খুব পছন্দ করতো।
সে : কোন বন্ধু? নাম কি?
আমি : মানসী
সে : কেমন বন্ধু?
আমি : ভালো বন্ধু!
সে : সে এখন কোথায়?
আমি : জানিনা কোথায়, হয়তো দূর পাহাড়ে সে ঘুরে বেড়ায়! অথবা চেঙ্গী ভ্যালীর বাঁকে বাঁকে।
সে : তুমি তাকে মিস করো?
আমি : করি।
সে : আমি আর এই গান কোনো দিন গাইবো না।
আমি : কেন?
সে : আমার আর চাঁদ দেখতে ইচ্ছা করছেনা।
এইটি তার রাগ না অভিমান আমি এই ব্যাপারে খুব কনফিউজড্। সে আমাকে যে পাগলের মতো ভালোবাসে এটা আমি বুঝতে পারি। আমি অনুভব করতে পারি সে আমাকে এক দন্ড না দেখে থাকতে পারেনা।
সেদিন ছিলো ছুটির দিন। দুপুরে খাবারের পর শুয়ে আছি। তাকে বললাম -- এসো, পাশে শোও। সে সোফায় যেয়ে শুয়ে পড়লো। তাকিয়ে দেখলাম, দুই চোখ বন্ধ করে রেখেছে। তারও কিছু পরে সে ঘুমিয়ে যায়। আমি তার মুখখানি দেখছিলাম। কিছু দুঃখ সেখানে ছেয়ে আছে। সে এখনো নিতান্তই একজন বালিকা। ওকে তৈরী করতে হবে যে আমাকেই।
আমার আর ঘুম এলোনা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। টেবিলের কাছে বসে লিখছিলাম ---' তুমি আগের মতো চুল বাঁধোনা কেনো মেয়ে? দুই বেনী বেঁধে খুকু হয়ে যাও। পায়ের আলতা তুলে আবার আলতা লাগাও। যখন তুমি আলতা উঠাও তখন তোমার পা আরো গোলাপী হয়ে যায়। আমি সুন্দর আলপনা আঁকতে পারি। এসো তোমার পায়ে আলপনা এঁকে দেই। আমি দেখছি তোমার আনত মুখ! ঐ মুখে দুঃখ রাখতে নেই। তুমি জেগে থাকলে তোমাকে নিয়ে তুরাগ নদীর পারে নিয়ে যেতাম। এই মায়াবী সন্ধ্যায় দু'জনে বসে থাকতাম তুরাগ নদীর তীরে। আজও তো পূর্ণিমা সেখানে। আমরা দেখতাম অসম্পূর্ণ সেই পূর্ণিমা তিথি। যা তুমি একদিন না দেখে চলে এসেছিলে। '
অনেকটা মন খারাপ করেই ঘর হতে বেরিয়ে যাই। পাশেই রেলস্টেশন। একাকী হাটতে হাটতে স্টেশনে চলে যাই। চা 'র দোকানে বসে চা খাই। একটা লোকাল ট্রেন স্টেশনে দাড়ানো ছিলো। ট্রেনটি হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে চলে গেল। আমি শুন্য পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কতোক্ষণ। মনটা ভালো করতে পারলামনা। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাত নয়টার দিকে বাসায় চলে আসি।
ঘরে এসে দেখি সে একটা লাল পেঁড়ে সাদা শাড়ি পড়ে বিছানায় পা মেলে বসে আছে। সন্ধ্যা মালতী ফুল দিয়ে খোঁপা বাঁধা তার। কপালে কালো টিপ পড়েছে অপর্ণা সেনের মতো। আজ ওকে দেখে আর বালিকা মনে হলোনা। যেনো সে একজন সম্পূর্ণ রমণী। পাশে তার আলতার বাটি। সে বলছিলো -- 'পায়ে আলপনা এঁকে দাও। '
আমি তার পায়ে আলপনা এঁকে দেই। রাতে দুইজন পাশাপাশি শুয়ে আছি। জানালা দিয়ে পূর্ণিমার আলো এসে পড়েছিলো ঘরে। আমি বলি -- 'জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে আসি।' সে বলছিলো -- 'খোলাই থাক্। জ্যোৎস্না এসে পড়ুক আমাদের গায়ে! '

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন