বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই, ২০১৭

একাকী সী-গাল

ক্যাপ্টেন সাহেব যখন বাসায় আসলেন তখন রাত্রি বারোটা। তার স্ত্রী কুমকম মির্জা তখন সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ক্যাপ্টেন জুতার খটখট শব্দ তুলে সোজা বেডরুমে চলে যায়। তার পায়ের শব্দে কুমকুমের ঘুম ভেঙে যায়। কুমকুম যেয়ে দেখে তার স্বামী সু পায়ে দিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়েছে এবং চোখ বন্ধ করে রয়েছে। কুমকুম তাকে ডাকলো কিন্তু সে আর উঠলোনা। এতোক্ষণ কুমকুম না খেয়েই তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। সেই রাতে কুমকুমের আর খাওয়া হলোনা।
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই ঝরঝর বৃষ্টি হচ্ছিল। কখনো হালকা দমকা বাতাস। দেয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে থাকে কুমকুম, একে একে রাত বারোটা, এক টা, দুই টা বেজে গেলো। তারপর এক সময় ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে কুমকুম ঘুমিয়ে পড়ে। রাতের আলোছায়ার ভিতরে ক্যাপ্টেন রেইনকোট গায়ে দিয়ে বৃষ্টিমুখর রাতে একাকী বড়ো রাস্তা থেকে হেটে হেটে বাসার গলিতে প্রবেশ করে। বাসার দরজায় যখন নক্ করে তখন রাত্রি আড়াইটা। কুমকুম দরজা খুলে দেয়। ক্যাপ্টেন সোজা বেডরুমে চলে যায়।
কুমকুম: খাবেনা তুমি?
ক্যাপ্টেন : না, খেয়ে এসেছি।
কুমকুম নিজেই আজ স্বামীর পায়ের জুতা খুলে দেয়। ক্যাপ্টেন বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে এবং ঘুমিয়ে পড়ে। আজ রাতেও আর কুমকুমের খাওয়া হলোনা।
সকালে যখন ক্যাপ্টেন বেরিয়ে যায়, তখন সে কুমকুমকে বলে - দুই দিন বাসায় ফিরবোনা।
কুমকুম : কেন, কোথায় যাবে?
ক্যাপ্টেন : মংলা পোর্ট, খুলনা।
কুমকুম : আমার একাকী ভালো লাগেনা।
ক্যাপ্টেন শুনলো কিনা সে কথা,বোঝা গেলোনা। সে কোনো কথা না বলে গলির পথ দিয়ে হেটে হেটে বড়ো রাস্তার দিকে চলে গেলো। কুমকুম শুধু তার স্বামীর চলে যাওয়াটাই দেখলো। কিন্তু ক্যাপ্টেন পিছনের দিকে আর ফিরে তাকালোনা।
ক্যাপ্টেন মংলা থেকে এসে তিন দিন ঢাকায় ছিলো। এই তিন দিনও সে অধীক রাতে বাড়ী ফিরেছে। এই তিন দিনও কুমকুম স্বামীর জন্য অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। কখনও ঘুমে কখনও নির্ঘুমে বসে থেকেছে। ক্যাপ্টেন এবার পাঁচ দিনের জন্য চট্টগ্রাম পোর্টে চলে যায়। চট্টগ্রাম থেকে যথারীতি আবার ঢাকায় চলে আসে।
একদিন ক্যাপ্টেন সকালে নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার জন্য বের হবে, তখন কুমকুম স্বামীর কাছে এসে বলে - কখন ফিরবে বাসায়?
ক্যাপ্টেন : কেন? আজও রাত হবে।
কুমকুম : তুমি বাসার চাবিটি তোমার কাছে রাখো।
ক্যাপ্টেন : কেন?
কুমকুম : আমি একটু বড়ো আপার ওখানে যাবো। আজ নাও আসতে পারি।
ক্যাপ্টেন : ঠিক আছে, চাবি দাও।
ক্যাপ্টেন আজ রাতে যখন বড়ো রাস্তা দিয়ে একাকী হেটে হেটে গলিতে ঢুকেছিল, তখন মহল্লায় বিদ্যুৎ ছিলোনা, আজকের আকাশে কোনো চাঁদও নেই । রাত তখন বারোটার উপরে বাজে। নির্জন অন্ধকারে শুধু তার জুতার খটখট শব্দ শোনা যাচ্ছিল। জনশূন্য রাস্তায় হাটতে হাটতে সে বাসায় চলে আসে। প্রতি দিনের মতো আজও সে দরজায় নক করে। কিন্তু ভিতরে থেকে কেউ দরজা খুলে দিলোনা। হঠাৎ তার মনে হলো, ঘরের চাবি তো তারই কাছে!
তালা খুলে ক্যাপ্টেন যখন ঘরে প্রবেশ করে, দেখে ভিতরে নিঃসিম এক আঁধার। দিয়াসলাই দিয়ে সে আলো জ্বালায় একবার। কিন্তু সে আলো নিভে যায়। অন্ধকারেই সোফার উপরে যেয়ে বসে পড়ে। প্রায় তিরিশ মিনিট পর বিদ্যুৎ চলে আসে। সে রুমের সুইসগুলো জ্বালিয়ে দেয়। বুকের ভিতরে শুন্যতায় হূহু করে ওঠে। আজ আর কেউ অপেক্ষায় নেই। টেবিলে কোনো খাবারও রেডী নেই। সে খেয়েও আসে নাই। রাতে তার আর খাওয়া হলোনা। পায়ের জুতোও কেউ খুলে দিলোনা। জুতা পায়ে রেখেই সে বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়ে এবং ঘুমিয়ে যায়।
সকালে ক্যাপ্টেনের যখন ঘুম ভাঙে তখন আর সকাল ছিলোনা। অনেক বেলা হয়ে গেছে তখন। বিছানা থেকে উঠে বসে সে। বালিশ সরাতে যেয়ে দুই বালিশের মাঝে সে একটি চিঠি দেখতে পায়। চিঠিটি কুমকুমের লেখা।
'' প্রিয়তম, মনকে তৈরী করছিলাম অনেক দিন ধরে। তুমি আমাকে একটা মুহূর্ত বুঝতে পারোনি। অসীম একাকীত্ব আর তোমার অবহেলা প্রতিদিনই তোমার থেকে আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। তাই আজ আমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। তুমি আমাকে কোনোদিন খুঁজবেনা। সন্ধ্যায় বাসার সামনে গলি আর বড়ো রাস্তা পর্যন্ত আমি আজও তাকিয়েছিলাম। এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন তোমার চলে যাবার দিকে আমি তাকিয়ে থাকতাম। একটু পর চাঁদহীন এই রাতে এই পথ দিয়ে হেটে হেটে আমি অনেক দূর চলে যাবো। অথচ তুমি আমাকে দেখতে পাবেনা। "
অনেক বেলা করেই ক্যাপ্টেন আজ ঘর হতে বের হলেন। বাসার সামনে গলিতে নামতেই দেখে ঠিক সামনের বাসার কাছে কতোগুলো মানুষের ভীড়। জানতে পারে সাবলেটে থাকা এক যুবক গতরাতে কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে। ক্যাপ্টেন মুহূর্তে বুঝতে পারে পুরো ঘটনাটি। এরপর দিন কয়েক ঐ বাড়িতে ক্যাপ্টেন ছিলো। তারপর সে ঐ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।
যে থাকে, যখন থাকে, অন্তরে অন্তরেই থাকে। বোঝা যায়না তা। সে ভালবাসা অনেক সময় দূরেরও হয়ে যায়। সে তখন প্রকৃতই একা হয়। বড়োই মায়া হয় ক্যাপ্টেনের জন্য। কিন্তু কুমকুমের জন্য নয়। কী আশ্চর্য! কেন? অথচ তারই তো সহানুভুতি প্রাপ্য ছিল। তবু কেন জানিনা বৃষ্টি নামলে আজও ক্যাপ্টেনকেই মনে পড়ে। হতভাগ্য একজন মূর্খ দুঃখী। আজও সে না জানি কোন বন্দরের সোঁ সোঁ লোনা হাওয়ায় সী-গালের ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে। বুড়ো চামড়ার গালে অনেকদিনের দাড়ি। কেউ একবারও তাকে বলেনা, এত কষ্টভোগের পরও তুমি তাকেই চাও? যাকে কারণে অকারণে এত অবহেলা করেছিলে?
ক্যাপটেন কি কাউকে জবাব দেয়? নাকি বালির ওপর অস্তসূর্যের মুখের দিকে তাকিয়ে হেটে হেটে সে কোনো অচিনপুরের দিকে চলে যায়?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন