বুধবার, ৯ জুন, ২০২১

প্রাণের হিল্লোলে এসো -৪

পর্ব - ৪

কর্ণঝরা নদীর স্বচ্ছ জলের উপর  দিয়ে ভাসতে ভাসতে আমি এসে পড়েছিলাম আরেক রূপবতী নদী ব্রহ্মপুত্রের উদ্দাম বুকে। নাহ্, ঠিক জলে নয়। এর কূলে একটি শহরে। জীবনের যত ঝড় ঝাপটা এর কূল দিয়েই বয়ে গেল আমার। গ্রামের একটি  লাস্যময়ী তরুণীর জীবন হঠাৎ কঠিন দুর্মর ব্যাথা বেদনার ভরে উঠল। এক করুণ কাব্য গাঁথা রচিত হলো এই শহরে।  

ময়মনসিংহের সরকারী মমিনুন্নিসা মহিলা কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। থাকতাম ছাত্রী হোস্টেলে। সারা শরীরে তখনও গ্রামের রোদ্র তাপের তামাটে দাগ। ভেজা চুল থেকে গন্ধ বের হতো কর্ণঝরার জলের। বেণীর ভিতর থেকে খুঁজে পাওয়া যেত হাঁসুলীগাঁওয়ের বন মল্লিকার শুকনো পাপড়ি।  

এখানে এসে পড়াশোনা করছিলাম ভালোই। ইন্টারমিডিয়েট পাস করি ভালো রেজাল্ট নিয়ে। আর এখানেই কী না ঘটে গেল আমার জীবনের এক কলুষিত ঘটনা। কলুষিত হলো ব্রহ্মপুত্রের জল। আমার এই জীবন ব্যথার মর্মর কথা জেনেছিল ব্রহ্মপুত্র নদীর জল, নদীর উপরের রাতের আকাশ, আকাশের যত তারা। আর সেখানকার আঁধার। 

কলেজের পাঠ শেষ করে এই শহর থেকে একদিন ট্রেনে করে ঢাকা চলে আসি। ভর্তি হই সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

তখন আশির দশক।  কী চমৎকার গ্রামীণ পরিবেশ, ছায়া ঢাকা, পাখিদের কলকাকলি মুখর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গন। দূরে দিগন্তের নীচ দিয়ে দেখা যেত কলধ্বনিতে বয়ে যাওয়া বংশী নদীর জল।

ভূগোল বিভাগের প্রথম দিনের ক্লাস। ক্লাসে যেতে আমার সেদিন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। স্যারের অনুমতি নিয়ে শ্রেণি কক্ষে ঢুকি। বুক হাত পা থরথর করে কাঁপছিল। ক্লাস রুমের মাঝখানের স্পেস দিয়ে হেঁটে যেতেই একটি ছেলের পায়ের গোড়ালিতে হোঁচট খেয়ে মেঝেতে ধাম্ করে পড়ে যাই। মুহূর্তে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। কেউই এগিয়ে এসে উঠাল না আমাকে। আমি একাই বই খাতা কুড়িয়ে নিয়ে পিছনের একটি খালি  সিটে গিয়ে বসি। 

ক্লাস শেষে করিডরে একাকী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। যার পায়ে লেগে হোঁচট খেয়েছিলাম, সেই ছেলেটি আমার কাছে এসে বিনম্র ভঙ্গিতে বলে -- "আমি একান্তভাবে দুঃখিত ও ক্ষমা প্রার্থী।"
 
আমি বলি -- আমারও তো পা লেগেছিল আপনার পায়ে। আমিও দুঃখিত। 

এইভাবেই ঐ ছেলেটির সাথে আমার প্রথম কথা হয় এবং সখ্যতা ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ওর নাম-- আনিস রহমান। 

আমার ভাগ্য কী এই রকমই হয়, জগতের যত সহজ সরল ছেলের সাথে পরিচয় হয়। তাদের জন্য মায়া লাগে। আর এই মায়ায় পড়ে তাদের সাথে এক অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে যাই।

আনিস এসেছিল ফরিদপুরের রাজবাড়ি থেকে। গোয়ালন্দের কাছে পদ্মাপাড়ে ওদের বাড়ি। আনিসকে আস্তে আস্তে চিনতে লাগলাম। ভালো লাগলো বন্ধুর মতো করে। একটু সতর্ক থাকলাম -- কোনো ভাবেই যেন দূর্বল হয়ে না যাই। 

ছেলেটি ভালো কবিতা লিখত।  নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, হেলাল হাফিজদের মতো সুন্দর সুন্দর কবিতা। ও প্রায়ই  কবিতা লিখে এনে আমাকে দেখাত এবং পড়ে শোনাত। খুব ভালো লাগত ওর কবিতা। আনিসের একটাই দোষ ছিল, ও কবিতা কোথাও ছাপানোর জন্য পাঠাত না। বলত -- আমি কবি হতে চাইনা। আমি কবিতা লিখি আমার জন্য। ছাপিয়ে কী হবে। 

-- শুধু তোমার জন্য? 

-- আমার জন্য এতদিন লিখেছি, এখন লিখি তোমার জন্য। 

আমি বলতাম, আমার জন্য কেন লেখ? আমি আবার কবিতা লেখার তোমার কেউ হয়েছি নাকি? 

আনিস বলত -- তুমি আমার অনেক কিছু। তুমি পছন্দ করো, তাই লিখি। 


একটা কবিতার কথা মনে আছে। একদিন  ক্লাস শেষে করিডরে দাঁড়িয়ে আছি। আনিস আমার কাছে এসে বলে -- কঙ্কাবতী। 
-- বলো।  
-- চলো আজ বংশী নদীর পারে। ওখানে কূলে বসে নদীর জল, আর নীল আকাশ দেখে আসি।
আমি বললাম - চলো। 

আমরা চলে যাই বংশী নদীর তীরে। তখন ছিল আষাঢ় মাস। নদী সবে মাত্র জলে ভরে উঠেছে। তখনও জল উপচে ক্ষেতে খামারে  ঢুকে পড়েনি। চারদিকে আউশ ধানের প্রান্তর। ধানক্ষেত পার হলেই নদী। ঠিক নদীর কূল ঘেষে একটি কদম গাছ আছে। গাছ ভর্তি ডালে ডালে কদমফুল ফুটে আছে। অপরাহ্ণের রোদ লেগে ফুলগুলো থেকে তীব্র গন্ধ বের হচ্ছিল। আমরা যেয়ে কদমতলায় ঘাসের উপর বসি। নদীর জল বয়ে যাচ্ছিল ছলাৎছল করে। কিছু সময়ে নদীও কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়। আমরা দেখলাম- আষাঢ় মাসের এই ভরা নদী আমাদের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। নদীর কথা সবাই সবসময় শুনতে পায় না। কেউ কেউ কখনও পায়। আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম সেই কথা নির্জন সেই অপরাহ্ণ বেলায়। 

আনিস ওর বুক পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে। সেই কাগজে লেখা আছে একটি  কবিতা। পড়ে শোনায় সেই কবিতাটি। যেন নদী এসে কথা বলছিল নিভৃতে আমার কানে কানে।  

আনিস কবিতাটি পড়ার পর আমাকে দিয়ে দিয়েছিল কাগজটি। আমি রেখে দিয়েছিলাম তা আমার বইয়ের পাতায়। পয়ত্রিশ বছর চলে গেছে। বইটি এবং কবিতাটি রেখে দিয়েছিলাম যত্ন করে একটি পুরনো কাঠের তোরঙ্গে। আনিসের লেখা  সেই কবিতাটি ছিল ---

" একদিন এক নিরাভরণ আয়োজনহীন বিকালে আমরা হাঁটছিলাম, কাঁচা ধান শীষের নির্জন সেই পথ, পাশে দূর্বা ঘাসের উপর দুপুরের এক পশলা বৃষ্টির মুক্তো লেগেছিল। তখন আকাশ ছিল ধূসর নীল।

আষাঢ়ে কাশফুল ফোঁটার কথা না। দয়িত হারানো বিরহী রমণীর মত শেফালিকাও কোথাও নেই। ধুলোর পথ ছেড়ে দূর্বা ঘাসের উপর আমাদের চরণ পড়ে দূর্বাও রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল।

যে পাশে ছিল সে ছিল আমার আনন্দময়ী, আমার প্রাণাধিকা। বিকালের রোদ্র মেখে স্বর্ণপ্রভা হয়ে উঠেছিল সে। যেন কতকালের পরিচিত আরক্ত মুখশ্রী। দেখেছি কত সন্ধ্যার ছায়ায়, কত চন্দ্রালোকিত নিশীথে। সে প্রকৃতিভৈরবী হয়ে আমাকে ঘর থেকে কত যে বের করে নিয়ে আসে ।

কতদিন পর আজকে এই বিকালে এখানে এসেছি। পশ্চিম দিগন্তে আলো নেভে নাই, তখনও দিগন্তে কমলা রঙে ছেয়েছিল..
আমরা হেঁটে চলেছি ........
এমন কত পথ পাশাপাশি হেঁটেছি
হাঁটতে হাঁটতে কত দূর চলে গেছি
কত কথা বলেছি, কত কথা বলতে ইচ্ছা করত !
পথের পাশে অচ্যূত ঘাসফুলের দিকে চেয়ে
কত প্রাণের ছোঁয়া যে তাকে দিতে চেয়েছি।

আমি দেখেছি তার মাথার  চুল উড়ছে আসন্ন সন্ধ্যার ধূপগন্ধ বাতাসে,
তাকে একাকার করে নিতে ইচ্ছা করত আমার সকল একাকীত্বে...

অন্তরের ভিতর তখন অন্য তরঙ্গ --

'জানি না কোথা অনেক দূরে   বাজিল গান গভীর সুরে,
           সকল প্রাণ টানিছে পথপানে
           নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।'"



সন্ধ্যায় যখন ফিরে আসি তখন আনিস ধরেছিল আমার একটি হাত। আমি  কিছুই বলিনি ওকে। জগতে কিছু হাতের স্পর্শে অনুভব করা যায়, এই হাত বিশ্বাসের। আনিসের হাতটা ছিল তেমনই জাদু স্পর্শের মতো। গত একবছর ধরে ওকে আমি দেখে আসছি। এত ভালো ছেলে। ওর হাতে পাপ নেই। 

কিন্তু আমার? এমন একটি ছেলেকে আমি কী নোংরা করে দিতে পারি? কিংবা নস্ট করতে পারি ওর আসন্ন নবীন জীবন? আমি আনিসকে সেদিন থেকে এমন আচরণ করতে থাকি, যেন ওকে বোঝাবার চেষ্টা করি, 'আমি কেবলই বন্ধু তোমার একজন। আর কিছু না। কিছুই হবো না তোমার কোনোদিন।'

চলবে --

~  কোয়েল তালুকদার  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন