রবিবার, ২০ জুন, ২০২১

চিত্রিতা - ২

আমি চিত্রাকে বললাম - এই নিঝুম রাত্রি নিশীথে আপনি আমার এখানে কেন এসেছেন? কেউ জানলে কেউ দেখলে আপনার বদনামি হবে, আমারও বিপদ হবে। আপনি চলে যান।

চিত্রা পরিহাস করে বলছিল - আমার একদণ্ড সান্নিধ্য পাবার জন্য কত পুরুষ হাহুতাস করে, আর তুমি কী না তোমার ঘরের মধ্যে এই নির্জন গভীর রাত্রিতে আমাকে একা পেয়েও তাড়িয়ে দিতে চাইছ। সত্যি তুমি এক আহম্মক তরুণ!

আমি বললাম - ঠিক আছে, আপনি আপনার পরিচয় দিন। কী জন্য এসেছেন, বলুন। দেখি, আপনার জন্য কী করতে পারি।

চিত্রা বলছিল -- আমি জমিদার বাড়ির বধু। জমিদারের বড়ো ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল চার বছর আগে। আমাদের কোনো সন্তান হচ্ছিল না। ডাক্তার কবিরাজ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছে -- আমার স্বামীই সন্তান প্রদানে অক্ষম।

-- এই রকম তো হতেই পারে। তো এই সমস্যার জন্য আপনি এত রাতে আমার এখানে কেন এলেন?

-- রাতে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। দিনের বেলায়, দিনের আলোয় জনসম্নূখ দিয়ে এসে আমার সমস্যা তোমাকে বলা সম্ভব হতো না। তাই এত রাতে নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে আসতে হলো।

-- তো কী সমস্যা আপনার?

-- আমি দেড়মাসের সন্তান সম্ভবা। আমার গর্ভে অন্য পুরুষের সন্তান এসেছে। যার সন্তান এসেছে তাকে আমি ভালোবাসি না। এটি ক্ষণিক আনন্দের একটি দূর্ঘটনা। আমি গর্ভপাত করার জন্য তোমার এখানে এসেছি। আমার এই অবৈধ গর্ভধারণের খবর জানাজানি হলে জমিদার বাড়ির মান সম্মান হানি হবে। তুমি আামাকে রক্ষা করো - আমাকে বাঁচাও।

-- কীভাবে সম্ভব হবে? আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি এখানে নতুন এসেছি। নতুন চাকরি। আমার খুব ভয় লাগছে। আমি এটা করতে পারব না।

চিত্রা আমার অপারগতার কথা শুনে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বলে - তুমি যত টাকা চাও, তাই দেব। তবুও করে দাও।

আমি বললাম -- টাকার লোভ আমাকে দেখাবেন না। আমার কোনো টাকা পয়সার দরকার নেই।

চিত্রা বলছিল -- তবে গর্ভপাত করাতে চাচ্ছ না কেন?

-- এটি একটি অবৈধ কাজ। গর্ভপাত করানো হবে আমার জন্য বেআইনি। তাই।

-- দেখো, তুমি বয়সে তরুণ। আমি তোমার চেয়ে বয়সে পাঁচ ছয় বছরের বড়ো হবো। তোমাকে আমি মিনতি করছি। তুমি আমার এই উপকারটা করে দাও। কী করবে না?

-- না, করব না। আমার খুব ভয় লাগছে। যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়, যদি বিপদ হয়। আমার চাকরি চলে যাবে।

চিত্রা এবার বলছিল -- আমি যৌবনবতী রূপসী রমণী। আমাকে তোমার ভোগ করতে ইচ্ছে করে না? আমার সৌকর্য, আমার গোপন রূপ তোমার দেখতে মন চায় না? আমি কালরাতে আসব। তুমি সব সার্জিক্যাল জিনিসপত্র নিয়ে রেডি থাকবে। ঘরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করবে। আমি আসব মধ্য নিশীথে একাকী। কাল পরব কালো রঙের তাঁতের শাড়ি। শরীরে গহনা পরা থাকবে আজকের গহনাগুলোই। তোমাকে আমি আজই প্রথম দেখলাম -- খুব সুদর্শন তুমি। তোমাকে খুব ভালো লেগেছে। কেন জানি জীবনে আর একটি ভুল করতে খুব ইচ্ছে করছে। তোমাকে এই রাত্রি নিশীথে হেরিকেনের ম্লান আলোয় যতটুকু দেখলাম- খুব ভালো লাগছে। অদ্ভুত সরল তুমি। এই কলঙ্কিত জীবন, এই দেহ এই মন তোমাকে দিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আবার! কী আমাকে নেবে তুমি!

আমি কোনো কথা বলছিলাম না। শুধু নিষ্পলক চেয়ে দেখছিলাম চিত্রাকে। কী মোহিনী রূপ! কী আবেদনময়ী! কী চুম্বক আমন্ত্রণ! এই চিত্রিত রাত থমকে যাচ্ছিল অসীমে!

চিত্রা এসে আমার একটি হাত ধরে বলে -- চলো, একটু বাইরে যাই। এই আঁধার রাতে আজ আকাশে চাঁদ নেই। কিন্তু কোটি কোটি তারা জ্বলছে। সেই কোটি তারার আলোয় তুমি আমাকে একবার দেখ প্রাণ ছুঁয়ে। দেখবে -- আমাকে তোমার ভালো লাগবে। আমার শরীরে এক অলৌকিক গন্ধে পাগল হবে তুমি!

চিত্রা আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসে। আকাশে জ্বলে থাকা কোটি কোটি তারার আলোয় দেখলাম চিত্রাকে! কী মাধুর্যময় ওর মুখ। কী নিষ্কলুষ মায়াভরা চোখ! কী যে স্বর্গীয় ক্ষণ ছিল তখন! অন্তরে আমার তখন অন্য অনুভব, যেন --
"আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,/ তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।"

বিমুগ্ধ হয়ে দুজনেই আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে থেকেছিলাম কতক্ষণ জানিনা। একসময় চিত্রা বুক ছেড়ে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল -- কাল আসব। 

সকালে আমার  ঘুম ভাঙে নাই স্বাভাবিক নিয়মে। শ্যামল এসে ঘরের কড়া নাড়ছিল খুব জোরে জোরে এবং ডাকছিল 'স্যার, স্যার' ওঠেন।  আমি যেয়ে দরজা খুলে দেই।  শ্যামলের চোখ মুখ কেমন যেন ভয়ার্ত ও বিষাদময়!  

শ্যামল বলছিল - স্যার আপনাকে এখনই জমিদার বাড়িতে যেতে হবে। গতরাতে জমিদার বাড়ির বউ চিত্রিতা খুন হয়েছে। আপনাকে তার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। 

****  ****  ****








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন