রবিবার, ২০ জুন, ২০২১

চিত্রিতা - ১

এই গল্পের কাহিনিকাল গত শতাব্দীর ষাটের দশকের। গল্পের নায়ক একজন ডাক্তার। আমি তার হয়ে উত্তম পুরুষে কাহিনিটি বর্ণনা করছি মাত্র।

এলএমএফ পাস করার পর চাকুরি নিয়ে নবাবগঞ্জের একটি পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তার হিসাবে যোগদান করি। স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি ছিল কালিগঙ্গা নদীর তীরে। বান্দুরা-কলাকোপা থেকে কেন্দ্রটি বেশি দূরে না হলেও আসা যাওয়ার পথ ছিল খুবই খারাপ। সেই সময়ে গ্রামের কাঁচা পথে বৃষ্টিতে কাদা হতো, শুকনো দিনে ধুলো উড়ত আর বর্ষায় অথৈ পানিতে থৈথৈ করত।

আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয় কেন্দ্রের পিছনে একটি পুরানো আধা পাকা ঘরে। যেটিতে গত এক দেড়বছর ধরে কেউ থাকত না। অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। আমার কেন্দ্রের কম্পাউন্ডার শ্যামল গোমেজকে দিয়ে ঘরটি সাজ সজ্জা করিয়ে নেই। সেখানে তখন বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। আমাকে রাতে হারিকেন কিংবা লণ্ঠন জ্বালাতে হতো।

শ্যামল ওখানকার স্থানীয় ছেলে। আমার চেয়ে তিন চার বছরের বড়ো হবে। বিয়ে করেছে। একটি বাচ্চাও আছে। বউ সন্তান নিয়ে থাকে। বাড়ি থেকেই ডিসপেনসারিতে আসা যাওয়া করে। শ্যামল আমার জন্য একটি কাজ করেছিল, তাহলো পাশের একটি বাড়ি থেকে আমাকে পেয়িং খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।

এলাকাটির নাম সোনাবাজু। নিভৃত গ্রাম। অদূরে বয়ে চলেছে কালিগঙ্গা নদী। আমি বিকাল হলেই হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম গঙ্গার তীরে। জেলে পাড়া দিয়ে হাঁটতাম। ওরা আমাকে খুব মান্য করত। বলত - ডাক্তার বাবু এসেছে। কোথায় বসতে দেই! কী খেতে দেব! তারপরও কাঠের টুলে বসতে দিত। বেতের টুরিতে মুড়ি খেতে দিত নারিকেল দিয়ে, না হয় আখের গুড়। গাছের পিয়ারাও খেতে দিত।

আবার কোনো কোনো দিন একাকী হেঁটে নদীর কূল ধরে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেতাম। সন্ধ্যা নামত নদীর কূলেই। বক, পানকৌড়ি, বালিহাঁসের দল উড়ে চলে যেত মাথার উপর দিয়ে ওদের কুলায়। সন্ধ্যা ঘোর হয়ে রাত্রি নেমে এলে আমি ঘরে চলে আসতাম। ঘরে এসে নিজ হাতে সন্ধ্যা বাতি জ্বালাতাম।

সন্ধ্যার পরে কেউ থাকত না। মাঝে মাঝে শ্যামলকে বলতাম, তুমি কিছু সময় আমার এখানে থাকো, কথা বলো, গল্প করো আমার সাথে। শ্যামল আমার অনুরোধে প্রায়ই সন্ধ্যা রাত্রি পর্যন্ত থাকত, এবং গল্প গুজব করে চলে যেত।

আমি শুনতাম ওর অনেক গল্প কথা। বলত এখানকার অনেক পুরাণ কাহিনিও। দুইশত বছর আগের কলাকোপার কোকিলপেয়ারী জমিদার বাড়ির কেচ্ছা কাহিনিও শোনাত। বলত ব্রজেন নিকেতনের নানা রঙ্গ-লীলার কথা। ভালোই লাগত সেই সব কল্পকথা শুনতে। আমি শ্যামলকে বলতাম -- তুমি এসব কার কাছে থেকে শুনেছ? শ্যামল বলত, আমার পিতামহের কাছে থেকে। পিতামহ আবার শুনেছে নাকি তার পিতামহের কাছে। এইভাবেই শোনা কাহিনি। সবই কিংবদন্তি।

সারাদিন ডিসপেনসারিতে রোগীরা আসত, ভালোই লাগত। বিকালবেলা এদিক সেদিক ঘুরতে বের হতাম, সময় কেটে যেত। কিন্তু সমস্যা হতো সন্ধ্যা হতে রাত্রিতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। ঐ সময়টুকু কেমন যেন ভয় ভয় লাগত। যেদিন শ্যামল থাকত সেদিন ভালোই লাগত, যেদিন থাকত না, সেদিন খারাপ লাগত।

একদিন সন্ধ্যায় শ্যামল বহু বছর আগের কোকিলপিয়ারির জমিদার বাড়ির এক কাহিনি আমাকে শোনায়। পুরোটা বলেনি, আংশিক বলছিল। ওর গল্প শোনার পর আমি কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। একবার মনে হলো দরজা খুলে বাইরে যাই। এই নিশীথে সন্তর্পণে হেঁটে চলে যাই ব্রজেন নিকেতনে। কিন্তু পা থেমে গেল!

খুব অস্থির লাগছিল। পায়চারি করছিলাম কক্ষের ভিতর। কী মনে করে দরজা খুললাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি -- প্রাচীন বিধ্বস্ত নগরীর মতো নিকষ অন্ধকার, কেমন ভূতুড়ে লাগছিল চারদিকে। কেমন যেন হুহু করছে আঁধার। আমার হাত পা ভয়ে হিম হয়ে আসছিল। আমি আর বাইরে এগুলাম না। ঘরের ভিতর এসে দরজা বন্ধ করে দেই। বিছানায় শুয়ে থাকি চুপচাপ।

হারিকেন জ্বলছে টেবিলের উপর। নিভালাম না। কালিগঙ্গার কূলবর্তী সোনাবাজুর চরাচরে ক্রমে গভীরভাবে রাত নেমে আসছে। নিস্তব্ধতার ভিতর শুধু নিশি পোকাদের গুনগুনানি শুনছিলাম। ভয়ে ঘুম নেমে আসছিল চোখে। অবশে বুক থরথর করছিল। কেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। হয়ত ঘুমিয়েও পড়েছিলাম।

হঠাৎ বাইরে কার যেন পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। হারিকেন তখনও জ্বলছে। আমি চুপচাপ কান পেতে শুনছিলাম পায়ের শব্দ। একটুপর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। খুব ভয় লাগছিল। ঘড়িতে চেয়ে দেখি রাত ১.৪০ মিঃ। আমি দরজা খুলছিলাম না। কাঁপা কাঁপা পায়ে দরজার এপাশ থেকে বলছিলাম -- আপনি কে? কিছুক্ষণ নীরব। কোনো কথা নেই। আবার বলি-- কে আপনি? ওপাশ থেকে রমণীকণ্ঠে জবাব এল, 'আমাকে তুমি চিনবে না, দরজা খোলো, দেখলে আমাকে চিনবে, আবার নাও চিনতে পারো।'

আমি দুরুদুরু বুকে দরজা খুলে দেই। চেয়ে দেখি - বাইরে এক অপরূপ রমণী মূর্তি দাঁড়িয়ে। আমার কোনো অনুমতি না নিয়েই সে গৃহের ভিতর প্রবেশ করে। সোজা যেয়ে খাটের উপর বসে। হারিকেনের আলোয় দেখলাম - পরনে তার ধূসর রঙের ফিনফিনে ঢাকাই জামদানী শাড়ি। কানে সোনার ঝুমকা, গলায় সীতাহার। দুহাত ভরে সোনার চুড়ি। মৃদু রিনঝিন করছে। রমণীর মুখ অপার মাধুর্যে পরিপূর্ণা। গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরীয়। চোখ দুটো টানাটানা। কালো ভ্রুকুটি। নিরাভরণ মুখশ্রী, কিন্তু লাবণ্যময়। আমি ভয়মিশ্রিত বিস্ময়ে দেখছিলাম তাকে। রমণী আমাকে বলছিল - তুমি চেয়ে দেখছ আমাকে কিন্তু চিনতে পারছ না। আর চিনবে কী করে? এর আগে আমাকে কখনও দেখনি! আমার নাম চিত্রিতা। সবাই আমাকে চিত্রা বলে ডাকে। তুমিও আমাকে চিত্রা বলে ডাকতে পারো।
চলবে ---

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন