বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন, ২০২১

ঘাস ফড়িং-এর রং

অনেক বছর আগের কথা। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি এসে দেখি -- আমার দূর সম্পর্কিত একজন মামু তার দশ এগারো বছরের একটি মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছে। এই মামুকে এর আগেও আমাদের বাড়িতে প্রায়ই একা আসতে দেখেছি। উনি সকালে আসত, এবং বিকালেই চলে যেত। এই প্রথম দেখলাম -- উনি একা নয়, এবার ওনার মেয়েকে সাথে করে আমাদের বাড়িতে এসেছে।

মার কাছে শুনেছিলাম, তার এই ভাইটি দূর সম্পর্কের খালাত ভাই হয়। বয়সে মার থেকে অনেক ছোট। মেয়েটির জন্মের পরেই ওনার স্ত্রী মারা যায়। এর পরে আর বিয়ে করেনি। এই মেয়েকে নিয়েই থাকে। উনি খুব গরীব। অনেক অভাব অনটনের ভিতর জীবন নির্বাহ করে।

মেয়েটির নাম ফিরোজা। ক্লাস ফাইভ পাস করেছে। ওকে আরও পড়ানোর ইচ্ছে আমার সেই মামুর। তাদের গ্রামে আশেপাশে কোনো হাই স্কুল নেই। আবার অভাব অনটনও আছে। তাই এই মেয়েটিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। ওনার ইচ্ছে, এখানে থেকে তার মেয়ে লেখাপড়া করুক।

মার সাথে এই ব্যাপারে কী আলাপ আলোচনা করেছিল -- সে কথা আমি জানিনা। শুধু দেখলাম, ফিরোজাকে আমাদের বাড়িতে রেখে আমার সেই মামু চলে গেল। যাবার সময় তার মেয়েকে ডেকে কাছে জড়িয়ে নিয়ে বলল - মা, তুমি ভালোভাবে এখানে থাকবে। সবার কথা শুনবে। সবাইকে মান্য করে চলবে।

ফিরোজা মাথা নেড়ে বলেছিল --' আচ্ছা। তুমি আবার আইসো, আমাকে দেখে যাইবা।' দেখলাম, বাবা মেয়ে দুজনেই অশ্রু মোচন করছে।

মেয়েটি এখন থেকে এখানেই থাকবে, আমার খুব ভালোই লাগল, মনে হলো-- একজন সাথী পেলাম। যে আমার ছোট বোনের মতো, খেলার সাথীর মতো। ঐ বয়সে ফিরোজা আমার প্রেমিকার মতো কেউ একজন হবে, এই কথা ভাবিনি।

প্রথম দিন সন্ধ্যা রাতে হেরিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসেছি, ফিরোজা আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। টেবিলের উপর রাখা আমার বইগুলো নেড়েচেড়ে বলে -- রতন ভাই, তুমি মনে হয় অনেক ভালো ছাত্র, ক্লাসে তোমার রোল নং কত?

আমি বললাম, 'আমার রোল নং চব্বিশ।' ফিরোজা শুনে খুব মন খারাপ করল। ও ভেবেছিল - আমার রোল নং এক হবে। আমি খুব ভালো ছাত্র।

টুকটাক করে কথা বলতে বলতে আমি ওকে বললাম, এখন থেকে তুমি তো আমাদের বাড়িতেই থাকবে, তাই না? ফিরোজা বলল, 'হে। তুমি খুশি হও নাই ?' বললাম, 'খুশি হয়েছি।'

পরের দিন আমি স্কুলে গেলে স্কুলের ক্লাসগুলো কেমন যেন শেষ হচ্ছিল না। মন খুব আকুবাকু করছিল -- কখন ছুটি হবে, কখন বাড়ি যাব, কখন ফিরোজার সাথে গল্প করব?

স্কুল ছুটি হলে বাড়িতে আসতে আসতে পথে মনে হলো, ফিরোজাও নিশ্চয়ই আমার জন্য এমন ছটফট করছে, ভাবছে-- কখন আমি বাড়ি আসব, কখন আমাকে ও দেখতে পাবে, আমার সাথে গল্প করবে।

দ্বিতীয় দিন বিকালবেলা, ফিরোজাকে নিয়ে পাড়ার অন্যান্য খেলার সাথীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। ওদের বলি - ওর নাম, ফিরোজা, ও আমার বোন হয়। এখন থেকে ও আমাদের বাড়িতেই থাকবে। আমি ফিরোজাকে নিয়ে সারা আঙ্গিনা ঘুরে ঘুরে দেখাই। পুকুর পাড় ধরে হাঁটতে থাকি। কদমগাছ তলায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যায় জল থেকে উঠে আসা হাঁসগুলোর ঘরে ফেরা দেখি।

মাত্র দুতিনদিনেই ফিরোজা আমার সারাক্ষণের সাথী হয়ে ওঠে। আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে অন্য খেলার সাথীদের সাথে খুব বেশি মিশতাম না। ফিরোজাকে নিয়েই এ বাড়ি ও বাড়ি যেতাম। কোনো কোনো দিন পুকুর পাড় পেড়িয়ে আলপথ দিয়ে হাঁটতাম। তখন ছিল হেমন্তের দিন। সারা প্রান্তর জুড়ে ছিল সরিষার ক্ষেত। চারদিকে শুধু হলুদের সমারোহ। আমরা বিমুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখতাম হলুদ গালিচার মতো সরিষা ফুলের মাঠ। মৌ মৌ গন্ধ নিতাম নাক ভরে।

আমি চার পাঁচ দিনেই ফিরোজাকে খুব আপন করে নিলাম। ফিরোজাও আমাকে আপন করে নেয়। ভাবছিলাম, কবে ওকে ভর্তি করে দেবে স্কুলে। দুজন প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যাব। প্রতিদিন স্কুলে যেতে যেতে সারা পথে কথা বলব, গল্প বলব। গল্প করতে করতে, কথা বলতে বলতে -- কথা ফুরাবে না, গল্পও ফুরাবে না, কিন্তু পথ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে।

সেদিন ছিল বুধবার, গুনে দেখলাম ছয়দিন ধরে ফিরোজা আমাদের বাড়িতে এসেছে। আমি স্কুলে চলে যাই। সেদিনও ক্লাসে মন বসছিল না পড়ায়। খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘ হচ্ছিল ক্লাস। মনে হচ্ছিল, কখন ছুটি হবে, কখন বাড়ি যাব, কখন দেখব যেয়ে ফিরোজাকে।

ক্লাস শেষে ছুটির পর আমি খুব জোরে জোরে পা ফেলে বাড়ির দিকে আসতে থাকি। পায়ে পায়ে পথের ধুলি উড়িয়ে আসছিলাম, আর ভাবছিলাম কখন এই পথ চলা শেষ হবে।

যখন বাড়িতে আসি, এসে দেখি-- আজ ফিরোজা বাড়ির গলি মুখে দাঁড়িয়ে নেই। ওকে না দেখে মন খারাপ করে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করি। উঠোনেও কোথাও ওকে দেখতে পেলাম না। ঘরের ভিতর যেয়ে দেখি, ঘরেও নেই। ভাবলাম, হয়তো পাশের বাড়ি বেড়াতে গেছে।

মা আমাকে খেতে দিল। আমি ভাত খেতে খেতে মাকে বললাম -- ফিরোজা কোথায় গেছে? মা জবাব দেয় , ওর বাবা এসে ওকে আজ নিয়ে গেছে। আমি বললাম, কবে আবার আসবে? মা, বলল, এমনিতেই আর কখনও আসবে না, তবে বেড়াতে আসলে আসতে পারে।

ফিরোজার চলে যাবার কথা শুনে, আমি আর এক নকলা ভাতও মুখে দিতে পারিনি। আমার চোখে জল চলে আসে। আমি হাতে পানি ঢেলে হাতও ধুইনি। এঁটো হাতেই মাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে
থাকি। আমার সেই কান্নার অর্থ সেদিন মা কী বুঝেছিল, আমি জানিনা।

পরে শুনেছি -- ফিরোজার বাবাই ফিরোজাকে আমাদের বাড়ি থেকে ফিরিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল। মেয়েকে ছাড়া সে নাকি একদণ্ড একাকী থাকতে পারেনা।

সেই কত বছর চলে গেছে কত দিনকাল ক্ষণ। এত বছর পরেও সেই বালিকাকে আমি ভুলতে পারিনি। কী মায়া করেই না আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কথা বলত, স্মিত হাসি লেগে থাকত চোখে মুখে, সন্ধ্যার দীপশিখায় দেখতাম সেই মুখ, হাঁটত ছোট ছোট পা ফেলে আমাদের বাড়ির উঠোনে। ওর কিছু কথা এখনও ক্ষীণ করে আমার কানে বাজে। বিশেষ করে আদুরে কণ্ঠের সেই ডাক -- রতন ভাই।

খুব করে মন চায় রাঙা পথের ধুলো উড়িয়ে চলে যাই পল্লীর নিভৃত ওর সেই গাঁয়ে। যেয়ে যদি দেখা পাই ঐ বালিকার, কিংবা খুঁজতে খুঁজতে যদি দেখা মেলে ফিরোজা রঙের কোনো ঘাস ফড়িং কিংবা অপরাজিতার। দেখতে তো পাব তবু তার রূপ রং ঠিক অনেক বছর আগে দেখা ঐ বালিকার মতো। আম-কাঁঠালের ঝাড়ের উপর দেখতে পাব নীল আকাশ, দেখব রাতের নক্ষত্র বীথি, আলো আঁধারে চেয়ে দেখতে পারি কারোর চোখের অশ্রু ছল ছল।…

~ কোয়েল তালুকদার




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন