আমি যে ছেলেটির কথা বলছি --
ভালো লাগার আমার এই সহপাঠীর নাম মাইনুল ইসলাম।
এক অপার্থিব মাধুর্যের রূপ ধারণ করে ক্ষণে ক্ষণে ওর ছায়ামূর্তি আমার চোখের সামনে এসে ভাসতে থাকে। কখনও সন্ধ্যার আকাশের অপরূপ শোভায়, কিংবা কখনও দূরের খাসিয়া পাহাড়ের ধূসর মেঘের ছায়ায়, কর্ণঝরা নদীর কুলকুল কলতানের মধ্যে -- ওর অস্তিত্ব অনুভব করতে থাকি। মনে হয়, অনেক দূর থেকে সুর ভৈরবীর তানে হেঁটে হেঁটে সে আমার দিকে আসছে। আমি কান পেতে ওর আগমনের পদধ্বনি শুনছি। আমার অবুঝ অবলা মন কেন যে ওর মাঝে থিতু হলো, কী এমন ঐশ্বর্য দেখতে পেয়েছিলাম, যা আমি চাইলাম এমন আকুল করে।
মাইনুল ছিল পল্লী গ্রাম-নিবিড়ের প্রস্ফুট বন-কুসুম-গন্ধ ছড়ানো একটি সহজ সরল তরুণ। তাই তো ওকে আমি এমন পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলাম
আমার লেখা চিঠিখানি ভূগোল বইয়ের পাতায় পুরনো হয়ে পড়ে থাকে প্রায় দেড় দু'বছর। এতদিনেও মাইনুলকে চিঠিটি দেওয়া সম্ভব হয়নি। মাঝের সময়ে টুকটাক ওর সাথে যদিও কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে স্কুলের বারান্দায় কিংবা পথের উপরে। কিন্তু চিঠিটি ওকে দিতে পারিনি। আমার ভালোলাগার কথাও বলার সুযোগ হয়নি কখনও। সবসময় কেউ না কেউ আমাদের কাছাকাছি থেকেছে।
কেমন করে কখন স্কুল জীবনের এতগুলো দিন চলে গেল! কত বিরহে কত অপেক্ষায় সময় করেছি পার। মাঝে মাঝে অজানা আশঙ্কায় মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠত। ভাবতাম -- যা চাইছি তা পাব তো?
একসময় আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসে। ক্লাসও বন্ধ হয়ে যায়। স্কুল থেকে আমাদের ফেয়ারওয়েল দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সেই বিদায় অনুষ্ঠানে ছাত্র- ছাত্রীদের পক্ষ থেকে মায়নুল খুব সুন্দর বক্তৃতা দিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে বিদায়ী সহপাঠীদের সাথে আমাদের একে অপরের কথা বলার সুযোগ হয়। কথা বলি আমি মাইনুলের সাথেও --
-- পাস করার পর তুমি কোথায় ভর্তি হবে?
-- জানি না কোথায় ভর্তি হবো। পড়ার আর ভাগ্য হবে কী না তাও জানি না।
-- পড়া থামিয়ে রেখ না।
-- তুমি কোথায় ভর্তি হবে?
-- ময়মনসিংহ।
-- আচ্ছা। ভালো ভাবে লেখা পড়া করবে। ভালো থেকো। তো যাই এখন।
মাইনুল খুব তাড়াহুরো করছিল, অস্বস্তি ও বিব্রতও হচ্ছিল লজ্জায়। আমি আস্তে করে ওকে বলি -- 'যেওনা তুমি। একটু দাঁড়াও।' আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যাগ থেকে দু'বছর আগের লেখা সেই পুরনো চিঠিটি বের করে ওর হাতে দেই এবং বলি -- বাড়িতে যেয়ে এটি পড়বে।
বাড়িতে যেয়ে মায়নুল চিরকুটটি পড়েছিল হয়ত কোনো প্রদীপ জ্বালা সন্ধ্যার আলোয়। হয়ত পুলকিত হয়ে উঠেছিল আমার মতো একজন প্রস্ফুটিত রক্ত জবার উন্মত্ত ভালোবাসার এমন নিবেদন দেখে! একটি মেয়ের এমন প্রাণ হিল্লোল দেখে, এমন দ্যুতি ছড়ানো অরুণ আলো!
তারপর কর্ণঝরা নদীর জল গড়েছে ব্রহ্মপুত্র নদীর দিকে। কত বাঁকে স্রোত হয়েছে ধীর, খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড় থেকে বয়ে এসেছে কত হিমেল বাতাস, আমি ওকে পেয়েছিলাম আমার জীবনের সকল গ্লানি ও যাতনাকে হারিয়ে দিয়ে। সে যে সত্যি এসেছিল প্রাণের হিল্লোলে। সেই তরুণী বয়সের সপ্তরঙের রঙধনুর মতো অতীত দিনের কত কথা মনে পড়ে আমার। কত কম্পিত প্রেম দান। কেন যে মাইনুলের উপর মাঝে মাঝে এতটা নিষ্ঠুর আচরণ করতাম। সেসবের জন্য অনুশোচনাও করি। কত কথা মনে পড়ে, কত বেদনায়, কত দীর্ঘশ্বাসে চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু জল ঝরে পড়ে।
মাইনুলের সাথে আমার জীবনের প্রকৃত ঘটনাটা আমি ব্লাক আউট করলাম। মানুষের জীবনের কিছু অন্ধকার পর্যায় থাকে, সেই অন্ধকারের কথা একান্তই তার একার। সেই অন্ধকারের কথা কাউকে বলা যায় না। তারপরও যদি সম্ভব হয় আমি বলব সেই আঁধারের কথা।
শুধু এইটুকু বলছি -- আমার সেই অল্প বয়সের কুমারী জীবনের পূর্ণচ্ছেদ পড়েছে অনেকদিন আগেই। তবু সে-সব দিনের কিছু আনন্দ বেদনার মুহূর্তগুলোর জন্যে এখনও মাঝে মাঝে মন কেমন করে ওঠে। সেই সারল্যমুখর স্মিত মুখ, সেই পূর্ণিমা ঝালরের আলো মাখা স্বর্গীয় রাতের বিমুগ্ধ ক্ষণ, হারানো সেই সুখস্মৃতির জন্যে আক্ষেপ করি। শুধু ভাবি, যা পেয়েছিলাম তা সত্যি করেই পেয়েছিলাম। মানুষ অনেক কিছুই পায়, তা আবার ফুরিয়েও যায়। শূন্য হয়ে গেলে আবার পাওয়ার আশায় পথে নামে। কোনো অচেনা পথিক অকাতরে কিছু দেওয়ার জন্য হয়ত দাঁড়িয়ে পথের উপর আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
এখন শুরু করব আমার ইউনিভার্সিটি জীবনের কথা। 'পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি' র মতো কেউ কী আমার সেই জীবনে প্রাণের হিল্লোল তুলে এসেছিল? আবার কী ভেঙেচুরে রক্তক্ষরণ হয়েছিল আমার হৃদয় মন?
( চলবে)
~ কোয়েল তালুকদার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন