বৃহস্পতিবার, ৩ জুন, ২০২১

প্রাণের হিল্লোলে এসো - ২

পর্ব -- ২

মেঘালয়ের লুসাই পাহাড়ের কোল থেকে ধিতাং ধিতাং বালিকার মতো এঁকেবেঁকে একটি নদী চলে এসেছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের দিকে। ওপারে ওর যেই নামই থাক, এপারে এই নদীটির নাম কর্ণঝরা। কর্ণঝরার আরও কতগুলো বোন আছে, যারা একই মায়ের গর্ভে জন্ম। ওদের মা'ও লুসাই পাহাড়। এই লুসাইয়ের অন্য মেয়েরা হচ্ছে ভোগাই, কংস ও সোমেশ্বরী। 

লুসাই থেকে মেঘ বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ে কত ঝর্ণা যে নদী হয়েছে। পাথর, বালু,মাটি, বৃক্ষ, লতাগুল্ম চিরে চিরে বয়ে এসেছে তারা সমতলের দিকে। কত হাজার বছর ধরে চলে এসেছে এই স্রোতধারা, কে তার কতটুকু জানে। এরই একটি ধারা কর্ণঝরা। এই কর্ণঝরা নদীর তীরে ছবির মতো একটি গ্রাম নাম তার হাঁসুলিগাঁও। 

আমি সেই হাঁসলিগাঁওয়ের মেয়ে কঙ্কণা। 

আমাদের বাবা চাচা'রা ছিলেন বিত্তবান কৃষক পরিবারের মানুষ। গোলাভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছ ছিল আামাদের। আমাদের বাড়ি ছিল ফুলে ফলে বৃক্ষ শোভিত। ছিল নানা জাতের ঔষধি গাছও। বাড়ির সামনে পুকুর। পুকুরের পর শস্য ক্ষেত। তারপর কর্ণঝরা নদী। 

এই নদীর পারে আমি বেড়ে উঠতে লাগলাম। বালিকা এখানে গোল্লাছুট খেলতো। মাথার দু'বেণী দুলিয়ে এক্কা দোক্কা খেলতো। আমগাছের পাতা আর বাঁশ ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে আসা পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সন্ধ্যা রাত্রিতে 'পলাতকা' খেলা খেলতো খেলার সাথীদের সাথে। খেলতে খেলতে একদিন বালিকা তরুণী হয়ে উঠল। 

আমাদের বাড়ির উঠোনের একপাশে ছিল ফুলের বাগান। ওখানে ছিল বিভিন্ন রকমের ফুল। জুঁই, কনকচাঁপা, রক্তজবা, কামিনী, গাঁদা, বেলী, গন্ধরাজ, সন্ধ্যা মালতী ও রংবেরঙের পাতাবাহার। লোকে বলত কঙ্কণা নাকি ঐ বাগানের একটি ফুল। কেউ বলত আমি নাকি কনকচাঁপার মতো দিনে দিনে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছি। কেউ বলত কঙ্কণা একদম রক্তজবার মতো রক্তিম। কেউ বলত সন্ধ্যামণির মতো সুবাসিত। 

পড়তাম গ্রামের স্কুলে। কোনো বালিকা বিদ্যালয় তখন ছিল না ওখানে। আমাদের স্কুলে ছেলেমেয়ে একসাথে পড়াশোনা করত। তবে নিয়ম ছিল কঠিন। মেয়েরা কথা বলতে পারত না ছেলেদের সাথে। কমনরুম থেকে স্যারদের পিছে পিছে ক্লাসে যেতাম। ক্লাস শেষে আবার কমনরুমে ফিরে আসতাম। কোনো ছেলের সাথে কথা বললে অভিভাবকদের জানিয়ে দেওয়া হতো। স্কুল থেকে বের করে দেওয়ারও নিয়ম ছিল। তাই কারোর সাথে কথা বলার সাহস করতাম না আমি। 

আমি যখন ক্লাস নাইনে উঠি তখন আমাদের ক্লাসে একজন নতুন ছাত্র এসে ভর্তি হয়। ছেলেটি দূর গ্রামের। গরীব দিনমজুরের ছেলে। প্রায় তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে এসে ক্লাস করত। ছেলেটি ছিল মেধাবী। ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছে।  ছেলেটির গায়ের রং শ্যাম বর্ণ। চুল কোঁকড়ানো। লিকলিকে লম্বা ধরনের। চোখ দুটো মায়াময়। কেন জানি দূর থেকে দেখে ছেলেটিকে আমার খুব ভালো লাগল।  

আমি ক্লাসে বসে ছেলেটিকে চুপিচুপি  খুঁজতাম কোথায় কোন্ বেঞ্চে বসে আছে। হয়ত দেখতে পেতাম কোনো কোনো দিন। আবার দেখা পেতাম না কোনো দিন। যেদিন দেখতে পেতাম না সেদিন খুব মন খারাপ করে বাড়ি চলে আসতাম। পথে আসতে আসতে পা চলত না, পা অবশ হয়ে থেমে যেত পথের উপরে। মনে হতো, আহা!  ঐ ছেলেটি এসে যদি আমার সাথে পায়ে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটত, তবে পথের উপর এমন করে পা আমার থেমে যেত না। 

বাড়িতে খুব মনমরা হয়ে থাকতাম। কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করত না। মা জিজ্ঞাসা করত -- কঙ্কণ, তোমার কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগে? '
আমি বলতাম -- না মা, কিছু হয়নি আমার। 

আমি যে ঘরে শুতাম, ঠিক আমার বিছানার পূর্ব দিকে একটি জানালা আছে। জানালার একপাশে লাগোয়া পড়ার টেবিল। আমি একদিন সন্ধ্যা রাতে হেরিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসেছি। পড়ার মন বসছিল না!  জানালাটা খুলে দেই। দেখি - বাইরে আলো আর অন্ধকার একসাথে মিশে আছে। আঁধারের মাঝে যে আলো তা ছিল চাঁদের আলো। রাতের আকাশ যেন ছুঁয়ে আছে নিঃশব্দে আকন্দ গাছের ঝাড় পাতায়। জ্যোৎস্নার এই  চন্দনমাখা স্বর্গীয় ক্ষণে চোখ মেলে অনেক দূরে আবছা আবছা দেখতে পেলাম ঐ ছেলের মুখ, রাতের তারার মতো চেয়ে আছে যেন আমারই দিকে। এই বিরাট আলো আঁধারের  বিশ্বজগতে কতকিছুই অদৃশ্যমান, কত প্রাপ্তিতা অপ্রাপ্তি হয়ে হারিয়ে যায়। একজন অবুঝ তরুণী কোন্ অসতর্ক মুহূর্তে কী চেয়ে বসল বিধাতার কাছে, তা কী বিধাতা আমার করে দেবে? 

দূরে কর্ণঝরা নদী থেকে বয়ে আসছিল শীতল বাতাস, জানালা দিয়ে প্রবেশ করছিল কাঁচা দুধের মতো ফিনকি দিয়ে জোছনা। কাউকে দু'কলম লিখতে ইচ্ছে করছিল খুব। কোনো কবিতা বা গানের পংক্তি নয়, ছোট্ট একটি চিঠি লিখতে ইচ্ছে করছে। ভাবছিলাম, একটি চিঠি লিখে রাখি কাছে। বইয়ের পাতায় সেই চিঠি গোপনে রেখে দেব। যদি কখনও সুযোগ আসে চিঠিখানি দিয়ে দেব ঐ ছেলেকে।

কল্যাণীয়ষু

খুব ভালো লাগে তোমাকে। এত ভালো লাগে যে, জনম জনম তোমাকে কাছে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছা করে। তুমি এসো গো আমার জীবনে। 'প্রাণের হিল্লোলে এসো'। জনম জনমকাল ধরে অপেক্ষা করব।

-- কঙ্কণা। 


হেরিকেনের পুষ্পিত আলোয় কী লিখলাম! অক্ষরগুলো ফুটে হয়ে আছে যেন কনকচাঁপাপুষ্পবর্ণাভা। বাইরে তখন চাঁদ ডুবছে নিভছে। চরাচর জুড়ে বিষণ্ণ আঁধার আর ম্লান আলো। আকাশের তারা'রা জ্বলছে নিভছে। কর্ণঝরা নদী থেকে বয়ে আসা শীতল বাতাস হঠাৎ থমকে গেল যেন । কুমারী মেয়ের কুন্তলের মতো  নৈঃশব্দ্য এসে ঘরটি ভরে গেল। বুকের তলায় দীর্ঘশ্বাস জট পেকে ধরল। আকাশে কোথাও আর দেখতে পেলাম না মণিনীল নক্ষত্র। 

( চলবে) 




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন