আমার জীবন দুইদিক থেকে বয়ে আসা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ হাওয়ায় এলমেল হতে লাগল। যেন হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল তছনছ হয়ে গেল! আনিসের দিক থেকে বয়ে আসা ঝড়টি কেন জানি বেশি অমঙ্গলের মনে হলো। তাই এই ঝড়টিকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য প্রাণমনে চেষ্টা করতে থাকি।
এরপর থেকে আনিসকে বুঝতে দিতে চাইনি যে -- আমি ওকে ভালোবাসি। দূর থেকে দিনের পর দিন ভালোবেসেছি, কিন্তু কখনও বুঝতে দেইনি ওকে। নিজে নিজেই একটি সিদ্ধান্ত নেই -- মাইনুলই আমার জীবনের প্রথম পুরুষ। কত কিছু দিয়ে, কত অর্ঘ্য আর চোখের জলে ওকে জীবনে পেয়েছিলাম -- ও-ই আমার জীবনে চির জীবনের বাঁধন হয়ে থাক্।
সেমিনার কক্ষে বসে পড়াশোনা, লাইব্রেরি যেয়ে বসে বসে নোট করা, ক্যান্টিনে চা সিঙ্গারা খাওয়ার মধ্যেই আনিসের সাথে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের চলাফেরা সীমাবদ্ধ করে রাখলাম। এরপর মাঝে মাঝে আনিস অনেক কবিতা লিখে আমার কাছে নিয়ে এসেছে, কিছু তার শুনেছি, কিছু তার শোনা হয়নি।
মাইনুলের সাথে আমার গোপন অবৈধ সম্পর্ক, আমার গর্ভধারণ, গর্ভপাত এসব কিছুই আনিসকে কোনোদিন বলিনি। আমার এই গোপন অন্ধকার জীবনের গ্লানির কথা আনিসের কাছে অজানাই রয়ে গেছে।
অনার্স শেষ বর্ষের এক গ্রীষ্মের ছুটির দিনে বাড়ি গেলে অনেকটা অনাড়ম্বর করে মাইনুলের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়। এই বিয়ের কথাও আনিসকে আর বলিনি। ইতোমধ্যে আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়।
পারিবারিক ভাবে সিদ্ধান্ত ছিল -- আমার আর মাস্টার্স পড়া এখানে হবে না। আর আমারও ইচ্ছে করছি না পড়তে।
এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাব। এই স্মৃতিময় নবাব ফয়জুন্নেসা হল। এই সবুজ ক্যাম্পাস! দূরে বয়ে যাওয়া বংশী নদীর কলধ্বনিও আর শুনব না। এখানে আর সন্ধ্যা নামা দেখব না পাখিদের মুখর করা সন্ধ্যার গানে।
খুব ইচ্ছে হলো -- আনিসের সাথে একটি বিকাল কাটাতে বংশী নদীর তীরে। চলেই তো যাচ্ছি আনিসকে ছেড়ে চিরদিনের করে, আর কোনোদিন হয়ত দেখা হবে না। স্বামী - সংসার, সন্তান নিয়ে গদবাঁধা জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকতে হবে।
যেদিন চলে আসব - ঠিক তার আগের দিন আমি আর আনিস চলে যাই -- বংশী নদীর তীরে। কাকতালীয় ভাবে সেদিনও ছিল আষাঢ় মাস। কিন্তু এর আগে যে এখানে এসেছিলাম ঠিক সেই সবুজের ধানক্ষেত আজ দেখতে পেলাম না। নেই সেই কদমগাছটিও। কোনো বৃক্ষরাক্ষস সম্ভবত কদম গাছটি কেটে ফেলেছে। তবে নদীর দিকে চেয়ে দেখলাম, নদী কুলকুল করে বয়ে চলেছে ঠিক আগের মতোই।
আমরা নির্জন মেঠোপথে নদীর কূল ধরে হাঁটতে থাকি। একজায়গায় দেখতে পাই একটি বাবলা গাছ। সারা বাবলাগাছ ধরে হলুদ ফুল ফুটে আছে। আমরা দাঁড়াই এই বাবলা তলে। আনিস বলছিল -- তুমি কী এখানে বসতে চাও?
আমি বললাম, বসব, তোমাকে নিয়ে দেখব নদীর জল। হয়ত এমন করে আর তোমাকে নিয়ে নদী দেখা হবে না।
তখন সন্ধ্যা পূর্ব বিকাল। আমরা দুজন বসে আছি। টুকটাক করে অনেক কথা বলছি, আবার নীরবতায়ও কেটে যাচ্ছিল সময়। আজ আনিসের একটি হাত খুব ধরতে ইচ্ছা করল -- আমি ওর একটি হাত ধরি। হাত ধরে বলি -- এই হাতে একটি চুমু কী আমি দিতে পারি? আনিস বলল,
দাও।
আনিস আমাকে ওর বাহুডোরে বেঁধে নিয়ে বলে, 'আমরা কী চিরদিনের জন্য দুজন দুজনের হতে পারি না?'
আমি আনিসের মুগ্ধ দুচোখের দিকে চেয়ে বলি -- না। আমি যে অনেক আগেই আর একজনের জন্য চিরদিনের হয়ে গেছি। আমার জীবন তোমার জীবনে নেই।
দেখলাম -- আনিসের বাহু মুহূর্তেই শিথিল ও নির্জীব হয়ে গেল। হাঁটুতে মাথা গুজিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সেদিনের অস্তবেলার শেষ সন্ধ্যা নেমেছিল নদীর বুকে। দুজন চেয়ে থেকে দেখছি -- কী ভাবে সোনালি আবীর মাখা রং আকাশ থেকে মুছে গেল।
ফিরবার পথে সন্ধ্যার সেই বিলুপ্ত মেঘের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম -- যাকে বেশি করে ভালোবাসা যায়, নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ বুঝি তার সাথেই করা যায়, আবার এই ভেবে মনে শান্তিও পেলাম -- আনিসের জীবনে আমি যে জড়াইনি এইটাই ওর জন্য চির কল্যাণ হয়ে থাক্। ওর সামনে যে অনেক কর্ম।
পথে আসতে আসতে আবারও মনে হলো ওর একটি হাত আমার হাত ধরে আছে -- কিন্তু কেমন যেন অসার সেই হাত। আমাকে কেমন মায়া করে ডাক দিল আনিস -- কঙ্কাবতী!
-- জ্বী।
-- তোমার সাথে আর কী কখনো দেখা হবে না আর?
-- না। লুকিয়ে রাখব তোমার থেকে নিজেকে বাকী জীবনকাল।
পথের উপর সেই সন্ধ্যার আঁধারে থেমে যাই। পা চলছিল না। কেমন যেন ব্যথা করছিল পায়ে। আমি আনিসকে বলি - তোমার বুকে একটু মুখ লুকোতে দেবে?
-- দাও।
-- একটু কাঁদতে দেবে?
-- কাঁদো।
তারপর আমার জীবনের কত পিঙ্গল পথ, কত পটে কত বর্ণের হয়ে জীবনের এই অস্ত পর্বে এসে দাঁড়ালাম। কত শুকতারার আলোকোজ্জ্বল রাত আঁধারে উড়িয়ে অদৃশ্য হয়েছে – প্রতিদিনই কোনো কোনো সন্ধ্যায় সেই হারিয়ে ফেলা বংশী নদীর কূলের মতো হাসি আনন্দের সন্ধ্যা নেমেছে, আপন ভালবাসার রঙে আমার প্রাণ রাঙিয়ে তুলেছি কত। আমি শুধু অনুভব করেছি -- একজনকে ভালোবেসে পেয়েছি, আর একজনকে ভালোবেসে হারিয়েছি। একজনকে দেহ মন দিয়ে কেবল আনন্দ দিয়ে গিয়েছি, আর একজনকে জীবনভর মনে রেখে দুঃখ কুড়িয়েছি।
*** *** *** ****
তারপর চলে গেছে জীবনের পয়ত্রিশ বছর। আমি এখন বিগত যৌবনা এক রমণী। জানো! এই শহরেই আমি থাকি।
তোমাকে আমি অনেক কথাই বললাম, আবার অনেক কথা বলিনি। জীবনের এমন অনেক কথা আছে, লেখা যায় না, বলাও যায় না, চোখে এসে দেখতে হয়। তোমাকে কফি খাওয়ার নিমন্ত্রণ করলাম -- যদি আসো তাহলে তুমি দেখতে পাবে আমার জীবন ছবি।
আমার ঠিকানা ঃ রোড নং ২৩,
বাসা নং ... , বনশ্রী, রামপুরা -- ঢাকা।
আমি একদিন সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম কঙ্কণার বাড়িতে। বাসায় নক করতেই একটি লোক এসে দরজা খুলে দেয়। লোকটি আমাকে দেখে বুঝতে পারে - আমি কে? মনে হলো কঙ্কণা আমার কথা আগেই বলে রেখেছিল ওনাকে। পরে জেনেছি - লোকটি হচ্ছে কঙ্কণার স্বামী মাইনুল।
ভিতরে শোবার ঘরে যেয়ে দেখি একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা অন্যদিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে। মাইনুল ওনাকে ডাকে -- দেখ কে এসেছে!
কঙ্কণা, আস্তে করে ঘুরে আমার দিকে তাকায়, কী করুণ শীর্ণা রোগক্লিষ্ট মুখ। চোখের নীচে কালো দাগ। চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল। আমি ওকে দেখে আৎকে উঠি। আমি যে একে চিনি। বহু জন্মজন্মান্তরের সে যে আমার একজন ছিল। শুধু নামটি ভিন্ন, কঙ্কণা নয় -- ও যে দিলারা জাহান।
এইরকম কতকিছু পরিবর্তন করে আমাকে লিখেছিল দিলারা -- বংশী নদী নয়, নদী ছিল বুড়িগঙ্গা, জাহাঙ্গীরননগর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর, আনিস রহমান সে নয়, সে ছিল রঞ্জন রহমান।
দিলারা কর্কট রোগে আক্রান্ত ছিল। পৃথিবীর সমস্ত ঔষধ ও চিকিৎসা অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল ওর শরীরে। ডাক্তার হাসপাতাল থেকে ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
সেদিন একটি সন্ধ্যাই কেবল দিলারার শিয়রে বসেছিলাম -- খুব আবছা করে দেখতে পাচ্ছিলাম অনেক দূরের একটি নদী। শ্রাবণের বুড়িগঙ্গা বয়ে চলছিল যেন কুলুকুলু করে...
দিলারা আমাকে একদিন বুকে মাথা রেখে বলেছিল, "প্রাণের হিল্লোলে তুমি এসো, সকল মাধুরি শুকায়ে গেলে গীতসুধারসে তুমি এসো।"
সমাপ্ত।
~ কোয়েল তালুকদার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন