শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২০

লক্ষ্মীমতি

লক্ষ্মীমতি


নাজিম উদ্দীন ছিল আমার স্বল্প সময়ের জন্য  একজন সহকর্মী। বছর তিনেক একটি সরকারি প্রকল্পে আমরা একসাথে কাজ করেছিলাম।  আমি তখন ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য পাশ করে বের হয়েছি। দক্ষিণখানে একটি বাংলো বাড়িতে একা থাকি।    

নাজিম উদ্দীন আমার চেয়ে সাত আট বছরের  বড়ো ছিল। বয়সে সে বড়ো হলেও খুব অল্প দিনের মধ্যে আমরা একে অপরে ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। নাজিম উদ্দীন থাকত ইন্দিরা রোডের একটি মেসে। ওর বাড়ি ছিল শ্রীপুরের কাওরাইদে। গ্রামের বাড়িতে বউ বাচ্চা থাকত। সাপ্তাহিক ছুটিতে সে ট্রেনে করে কাওরাইদে আসা যাওয়া করত। 

একদিন নাজিম উদ্দীন আমাকে বলছিল --  'তোমার ভাবীকে ঢাকায় আনতে হবে চিকিৎসার জন্য। সাত আট দিন থাকতে হবে।  আমি মেসে থাকি। ঢাকায় দুএকজন আত্মীয় স্বজন আছে কিন্তু সেখানে উঠতে চাচ্ছি না।  তুমি তো একা এক বাড়িতে থাকো। তোমার ওখানে তোমার ভাবীকে নিয়ে উঠতে চাই।'  

আমি বললাম -- তুমি উঠতে পারো,  আমার সামান্যতম অসুবিধা নেই। কিন্তু, আমার চাল চুলো কিছু নাই। খাওয়াব  কী !  আমি যেখানে থাকি, সেটি এখনও গ্রাম। কাছে একটা ইতালিয়ান হোটেল অবশ্য আছে। কিন্তু ঐ হোটেলে ভাবীকে নিয়ে বসে খাওয়া যাবে না। প্রেস্টিজ চলে যাবে।    যদিও আমি বিপদে পড়ে মাঝে মাঝে সেখানে খাই।  আর বেশির ভাগ সময় বাইরে এদিক সেদিক কোনো হোটেল থেকে খেয়ে তারপর বাড়িতে যাই । আবার এমনও ইতিহাস আছে, না খেয়েও রাতে ঘুমিয়ে পড়েছি। অনেক সময় শুধু রুটি-পাউরুটি কলা খেয়েও রাতের খাবার সারি।     

নাজিম বলছিল -- তা অসুবিধা হবে না।  এটা নিয়ে তুমি ভেবো না। আমরা ম্যানেজ করে নেব।  

-- আচ্ছা, তাহলে ভাবীকে নিয়ে চলে এসো। 

-- আমি এবার বাড়িতে যেয়ে আসার সময় তোমার ভাবীকে নিয়ে সোজা তোমার ওখানেই এসে উঠব।


সেদিন ছিল ছুটির দিন। সকাল এগারোটা বাজে আমি তখনও ঘুম থেকে উঠিনি। হঠাৎ শুনতে পাই --- বাইরের গেটে কে যেন নক করছে।  দরজা খুলে দেখি, নাজিম উদ্দীন তার স্ত্রীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।  

হেমন্তের রোদ্দুর তখন সারা আঙিনাতে মুখর।  নাজিম উদ্দীনের স্ত্রীর পরনে একটি সবুজ রঙের তাতের শাড়ি, হাতে চারটি চিকন সোনার চুড়ি, মুখে কোনো আবীর মাখা নেই।  অনেকটাই নিরাভরণ।  বয়স ত্রিশ বত্রিশ হবে। মাথায় ছোট্ট ঘোমটা দেওয়া। আমায় দেখে ঘোমটাটা আরও একটু সামনের দিকে টেনে আনেন। হেমন্তের রোদ্দুর সেই ঘোমটার ভিতর দিয়ে আবছায়া রূপে প্রবেশ করে তার মুখখানিকে বেশ উজ্জ্বল করে তুলেছিল। নাজিম উদ্দীন আমাকে পরিচয় করে দেয় -- এই হচ্ছে তোমার ভাবী। তোমার শারমিন ভাবী। আমি তাকে সালাম দিলাম।   

নাজিম উদ্দীন ও শারমিন ভাবী ঘরে এসে বসলেন। আমার কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছিল। তখন আমি ইউনিভার্সিটির সদ্য পাশ করা মাস্টার্স তরুণ এক , বয়স চব্বিশ পঁচিশ। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম। তখনও বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, মেঘদূতম, শকুন্তলা দুস্মমন্ত'রা মগজে ঘোরাফেরা করে। সুযোগ পেলেই কল্পনায় চলে যাই, দূর শিপ্রানদীর তীরে। সেই আমি দেখলাম আজ হেমন্তের রোদ্দুর ছোঁয়া একজন কুসুমিত রমণীর অনাবৃত দুটো হাত। আমার মনের ভিতর এক প্রকারের নূতন অনুভূতি, আমার বুকের রক্তের তালে তালে সেদিন এক প্রকার নূতন স্পন্দন স্পন্দিত হয়েছিল।  

রুমের ভিতর মৌনব্রত বসে আছি। ভাবছি, আগত এই অতিথিদের কী খাওয়াব? নাজিম উদ্দীন আমার বিব্রত মুখ দেখে বুঝতে পারে -- আমি কিছু দুশ্চিন্তা করছি।  
সে বলে -- তোমার ভাবী মশাখালীর দেশী মুরগী, সুতিয়াখালীর নদীর বাইটকা মাছ আর ছোট ছোট আইর মাছ রান্না করে নিয়ে এসেছে।  আমরা সবাই এগুলো দুইদিন খেতে পারব।    

তরকারি না হয় হলো। কিন্তু ঘরে ভাত নেই। চাল নেই। চুলো নেই। কী করব? আজিজ মিয়ার টিনের চালার হোটেল থেকে ভাত কিনে এনে দুপুরে  তিনজন খেয়ে নিলাম।    

আমার বাড়িতে থাকার কোনো অসুবিধা ছিল না। পরিপাটি রুম।  আলনা, টেবিল, নিওন বাতি, ইলেকট্রিক ফ্যান সবই আছে৷  আমি নাজিম উদ্দীনকে বললাম -- 'যাও তোমরা এখন বিশ্রাম করো গে।' এই কথা বলে আমি আমার রুমে চলে আসি।    

বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিভূতিভূষণের 'উপেক্ষিতা' পড়তে থাকি। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বুঝতে পারিনি। যখন ঘুম ভাঙে, দেখি -- জানালার ওপাশে বাঁশ ঝাড়ের পাতাগুলো মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলছে।  অপরাহ্ণের মিহি আলোয় চিকচিক করছে মাধবীলতার গুচ্ছগুচ্ছ ফুল।  একটুপর  ছায়া ছায়া অন্ধকার নামবে। এই সময়ে খুব একা একা লাগে।  কিন্তু আজ লাগছে না। আজ আমার ঘরে দুজন অতিথি আছে। যাদের পদচারণায় নৈঃশব্দ ভেঙে গেছে।     

আমি উঠে মাঝখানে ড্রইং রুমে চলে আসি। সোফায় বসে নাজিম উদ্দীনকে ডাক দেই। -- 'নাজিম ভাই....। ' আমার ডাক শুনে পাশের রুম থেকে নাজিম ভাই চলে আসে, সাথে শারমিন ভাবীও। 

নাজিম ভাই বলছিল -- তোমার রান্নাঘর শারমিন ভিজিট করেছে। কিছু নাই। সব নাকি খালি। ঠনঠন করছে। তোমার ভাবী একটা লিস্ট করেছে। কী কী লাগবে। তুমি আমার সাথে চলো টংগী বাজারে। সব কিনে আনব।   

আমার কোনো 'না' তারা শোনেনি। বাধ্য হয়েছিলাম চলে যেতে। ভাতের পাতিল, তরকারির পাতিল,  কড়াই, খাবার প্লেট, গ্লাস, চামচ, খুন্তি, বটি, বালতি, গামলা থেকে শুরু করে যা যা লাগে সব কিনল নাজিম ভাই। আরও কিনল চাল, ডাল, লবন, পিয়াজ, কাঁচামরিচ, মসলাপাতিসহ কতকিছু। শারমিন ভাবী করে দিয়েছিল লম্বা ফর্দ। ফর্দের সবই কিনলেন তিনি। আমাকে একটা টাকাও দিতে দিল না।  আমি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু নাজিম ভাই বলেছিল -- ' তুমি যদি টাকা দাও তাহলে শারমিন আমাকে মেরেই ফেলবে।' এই কথা শুনে আমি থেমে গেলাম।    
                                               
রাতে যখন খেতে বসি -- দেখি -- আজ অন্যরকম সব আয়োজন। এ যেন আমাদের দেশের বাড়িতে খাবার টেবিলে মার মতো করে সাজানো সব খাবারের সমারোহ। 

শারমিন ভাবী পাশে দাঁড়িয়ে থেকে খাবার পরিবেশন করছিল আর বলছিল -- 'রঞ্জন ভাই, আমি যে কয়দিন এখানে আছি, আপনার সংসার টা সব সাজিয়ে দিয়ে যাব।  এরপর যদি কখনও আসি, এসে যেন দেখি -- একজন লক্ষ্মীমতি বউ ঘরে এনেছেন।'      

শারমিন ভাবীরা সাতদিন ছিলেন আমার বাড়িতে। ঐ কয়দিনে সত্যি সত্যি আমার বাড়িটা তিনি সাজালেন। ঘরের কোণে কোণে ধূলোময়লা জমেছিল সেগুলো তিনি নিজ হাতে পরিস্কার করলেন। বারান্দার চালে মাকড়সা বাসা বেঁধে অসংখ্য  ঝুলে  ভরে রেখেছিল, সেগুলোও ঝারলেন। পড়ার টেবিল গোছালেন। বিছানাপত্র সব পরিপাটি করে রাখলেন।  বাড়ির সামনের বাগানে আগাছাগুলো লোক ডেকে কাটিয়ে ফেললেন। মালিনীর মতো প্রতিদিন গোলাপ, বেলী, পাতাবাহারের গাছগুলোতে পানি ঢাললেন।   

 হঠাৎ করেই জমিদার পুত্রের মতো জীবন হলো আমার। বাড়িতে খাবার রেডি থাকত। হাতখান ধূয়ে শুধু খেতে বসতাম। শারমিন ভাবী খালি মুখে তুলে খাওয়ানোটাই বাকি রাখতেন।  বাকি সবই তিনি করতেন, তৈরি রাখতেন।     
                                              
শারমিন ভাবীকে ডাক্তার দেখানো, তাকে চেক-আপ করানো, রিপোর্ট নেওয়া এবং ডাক্তারের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ঔষধ কেনা, সবই একসময় শেষ হয়ে যায়।  একদিন বিকালে ডাক্তারের কাছে থেকে ফিরে  এসে নাজিম ভাই বলছিল -- তোমার ভাবীকে ডাক্তার দেখানো শেষ। আগামীকাল সাড়ে বারোটার ট্রেনে আমরা চলে যাব।              

তখন ছিল বিকেল।  নাজিম ভাইয়ের কাছে থেকে তাদের চলে যাবার কথা শুনে মনটা খুব  খারাপ লাগছিল। ঘরের পিছনে বৃক্ষরাজিতে তখন  বসে থাকা পাখিদের কলকাকলি ক্রমান্বয়ে বিষাদের সুরের মতো হৃদয়ের তন্ত্রীতে অনুরণিত হতে লাগল। যে সুরের উদাস মাধুর্য প্রাণের মধ্যে কোনো সাড়া দেয় না।

বিকালগুলো কী এমনই বিষণ্ণতার হয়? মনে হতে লাগল -- জীবনটা এমন হয় কেন, এই এলমেল, এই সাজানো গোঋানো, আবার হয়ে যায় এলমেল। সেদিনের সেই অপরাহ্ণের রোদ্দুর বাশের পাতার উপর পড়ে আর চিকচিক করল না৷ মাধবীলতা গুলোও ম্রিয়মাণ হয়ে আছে। জানি আঁধার নামবে, জানি --  ' সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী ফুড়ায় জীবনের সব লেনদেন, তারপর থাকে শুধু অন্ধকার !'       

পরের দিন সকালে আমি অফিসে চলে যাই। যাওয়ার সময় নাজিম ভাইকে বলি -- তোমাদের ট্রেন তো ছাড়বার দেরি আছে। তোমরা পরে বের হইও। ঘরের তালা টিপ দিয়ে লক করে বেরিয়ে যেও। আমি চাবি নিয়ে যাচ্ছি। পরে এসে তালা খুলে ঘরে ঢুকব।                       

আমি যখন বেরিয়ে যাব -- তখন দেখি,  শারমিন ভাবী সেদিনের মতো ঘোমটা অর্ধেকটা খুলে স্থির শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হলো তার কালো চোখদুটির নীচে জগতের সকল অশ্রু ভার যেন গোপনে লুকিয়ে রেখেছে। ঈষৎ ভারী সেই চোখ দুটো তুলে বলেছিল -- 'আমি কিন্তু সব সাজিয়ে গুজিয়ে রেখে যাচ্ছি। কোনো এলমেল যেন না হয়। যদি কখনও আবার আসি -- ঘরে  যেন একজন লক্ষ্মীমতিকে দেখতে পাই।' 

 


৩০ আগস্ট,  ২০২০ ইং
দক্ষিণখা,   ঢাকা।   
          

                                                                                                                                                   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন