রবিবার, ৯ আগস্ট, ২০২০

তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে

তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে
   

একটা স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে যায় । 

ঘড়িতে চেয়ে দেখি -- রাত তিনটে দশ। স্বপ্নটি খুব সুন্দর ছিল। সুন্দর স্বপ্ন নাকি হঠাৎ করে ভেঙে যায় না। পুরোটাই দেখতে পায় মানুষ।  কিন্তু আমার দেখা স্বপ্নটি অসম্পূর্ণ রেখেই ভেঙে গেল। কিছু স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া পর স্বপ্নটির জন্য মানুষ  আফসোস করে।   

স্বপ্নটা ছিল -- আমি একটি দুই ঘোড়ার টমটম গাড়িতে করে সাহানাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। টমটমটি লাল ঝালর কাপড়ে সাজানো। আমার পরনে রাজস্থানের  শেরওয়ানি, মাথায় পাগড়ি, চোখে সুরমা পরা।  শরীরে বাগদাদের আতরের গন্ধ। পায়ে কোলাপুরী জুতো। টমটমটি চলছে একটি অচেনা বনপথ ধরে। অন্য কোনো বরযাত্রী নেই। আমি একা চলেছি। চারদিকে শাল পিয়াল আর আমলকীর বন ঝাড় ।  নির্জন সে পথ। ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দ হচ্ছে।         

আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, সাহানা একটি লাল বেনারসি শাড়ি পরেছে।  মুখে ট্রেডিশনাল বিয়ের সাজ। সিঁথিতে টিকলি। চোখে কাজল। কানে ঝুমকো। গলায় মতিহার। খোপায় বেলী ফুলের মালা জড়ানো।  মাথায় ঘোমটা দিয়ে আনত চোখে বিয়ের আসনে সে বসে আছে।   

স্বপ্নের পট দৃশ্যগুলো দ্রুত পরিবর্তন হতে লাগলো। দেখি -- আমিও একটি বিয়ের আসনে বসে আছি।  আমার সামনে মৌলানা সাহেব বসে আছেন।  কোরান থেকে কিছু সুরা মুখস্থ পাঠ করলেন তিনি। তারপর আমার উদ্দেশ্য করে উনি বলতে লাগলেন--  '..... ... .. আপনি কী সাহানা বেগমকে বিবাহ করতে রাজি? ' রাজী থাকলে তবে বলুন -- 'কবুল'। '

কবুল বলার আগেই স্বপ্নটা ভেঙে যায়। স্বপ্ন ভাঙার সাথে সাথেই ঘুমও ভেঙে যায়। ঘরময় অন্ধকার। আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করল না। একবার মনে হলো বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে একটু দাঁড়াই। যদি আকাশে চাঁদ থাকে, যদি জ্যোৎস্নায় ভাসে চরাচর। তবে মনটা একটু ভালো লাগতে পারে । কিন্তু, উঠতে পারছি না। অসুখটা আজ কয়েকদিন ধরে একটু বেশি। ক্রাচে ভর করে হেঁটে যেতে হবে। ক্রাচে হেঁটে  যাওয়ার  মতো শক্তি আমার এই মুহূর্তে নেই।          

সাহানা আমার ছোট ফুফুর মেয়ে। ওর জন্ম হয়েছিল আমাদের বাড়িতেই। জন্মের সময় ফুপু মারা যান। দাদী সাহানাকে ওনার কাছেই রেখে দিয়েছিল। সে বেড়ে ওঠে দাদীর ক্রোরে। দাদীকেই সাহানা মা ডাকত। ও এমনই দুঃখী, দাদীও মারা যান ওর পাঁচ বছর বয়সের সময়। তারপর ওর সমস্ত দায়িত্ব নেয় আমার মা। আমার মা- ই ওর মা হয়ে ওঠে।                          
             
সাহানার বাবা অর্থাৎ আমার ফুপা কখনোই মেয়ের দাবি নিয়ে ওকে ফিরে নিয়ে যেতে চায়নি কখনো। তাছাড়া, তিনি পরবর্তীতে আর একটি বিয়ে করে সুখে সংসার করতে থাকেন। সাহানা নামে তার যে একটি মেয়ে আছে, তা সে ভুলেই যায়।    

আমাদের ভাইবোনের মাঝে সাহানাও আর একজন বোনের মতো বড়ো হতে থাকে। ওকে আমরা সবাই আপন করে নিয়েছিলাম। বাবা আরও বেশি ভালো বাসত ওকে। বাবার সকল কাজে, তার সকল সেবায়, তার খাওয়া দাওয়ায় খেয়াল করা, তাকে যত্ন করা, সব সাহানাই 
করত।       

এই সাহানার কয়েকদিন পর বিয়ে হয়ে যাবে। দিন তারিখ ঠিক হয়ে আছে। ৬ ই আশ্বিন, শুক্রবার।  ওর বর একজন বেসরকারি কলেজের বাংলার প্রফেসর।  ভালো কবিতাও লেখে। সে কবি।  তার একটি কবিতার বইও বের হয়েছে, নাম -- 'মনে জাগে আশা।'  বরের এই কাব্য প্রতিভার গুণকে বাবা বেশ গুরুত্ব দিয়েছিল।    

ছেলে পক্ষ আমাদের বাড়িতে এসে সাহানাকে দেখে। সাহানাকে সেদিন লাল সিল্কের শাড়ি পরানো হয়েছিল। বরের মা নিজে ঘোমটা খুলে সাহানার লম্বা লম্বা কালো চুল দেখে মুগ্ধ হয়ে  বলেছিল -- 'ও মা, আমাদের বউ মা কী সুন্দর!  ডাগর ডাগর চোখ!  কী সুন্দর হাতের নোখ। কাঞ্চিবরণ গায়ের রং।' বরের মা খুশিতে আটখান হয়ে নিজের গলার মালাটি খুলে সাহানার গলায় পরিয়ে দিয়েছিল, কন্যা পক্ষের কোনো মতামত না নিয়েই।    

মা সাহানাকে ডেকে একদিন সকালবেলা বলেছিল, 'তোমার কী বর পছন্দ হয়েছে? তোমার মামা তোমার মত জানতে চেয়েছেন।'     

-- আমি কালকে আপনাকে আমার মতামত জানাবো। 
-- আচ্ছা, ভেবে চিন্তে কালকেই জানাও।                  
         
সাহানা সেদিনই সন্ধ্যায় আমার ঘরে এসেছিল। আমি বিছানায় শুয়ে আছি। ঘর অন্ধকার।  পাকস্থলিতে প্রদাহ খুব বেশি করে অনুভূত হচ্ছিল। সাহানা বলছিল -- সাঈদ ভাই, ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দেই? 

-- দে। 
-- তোমার বুকে খুব ব্যথা করছে? 
-- হে। 
-- ঔষধ খাও নাই? 
-- দুপুরে খেয়েছি, রাতে আবার খাব। 
-- মামা, মামী আমার বর দেখে রেখেছে। আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে।    
-- খুব ভালো। তোর বর খুব সুন্দর, প্রফেসর, কবি। 
 
সাহানা অঝোর ধারায় কাঁদছে। কোনো কথা বলতে পারছে না। 

-- এই তুই কাঁদছিস কেন? 
-- আমি এই বিয়ে করব না। 
-- কেন করবি না। 

সাহানা আমার বুকের উপর মাথা ঝুকে অশ্রুপাত করে বলে -- আমি তোমাকে ভালোবাসি সাঈদ ভাই। 
-- তুই তো এই কথা কখনও আমাকে বলিস নাই। 
-- তুমি বুঝতে পারো নাই? 

-- শোন্ এই শেষবেলায় তুই পাগলামি করিস না। আমি পঙ্গু একজন মানুষ। ক্রাচে ভর করে হাঁটি।  কিডনি ফেইলর। কদিন পরে মরে যাব। আর তুই কী না আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস। এত বোকা মানুষ হয়? তোর সামনে কত অনন্ত সুখের সময়।    আমাকে বিয়ে করলে  তোকে তো বিয়ের পরপরই বৈধব্যের সাদা কাপড় পরতে হবে। তোকে আমার বিয়ে করা সম্ভব হবে না। আমি তোকে ছোট বোনের মতো সারাজীবন দেখে এসেছি।  তুই আমার ছোট বোন হয়েই থাকবি।           
  
সাহানা আর কোনো কথা না বলে সেদিন কাঁদতে কাঁদতে ঘর হতে বেরিয়ে এসেছিল।                          
পরের দিন সে মার কাছে যেয়ে বলে -- মামী, আমার এই বিয়েতে আপত্তি নেই। আপনেরা এই বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন।         

বাড়িতে আমি খুবই অসুস্থ। এই কারণে ভিতরে ভিতরে একটা দুঃখের আবহ থাকলেও বাবা সাহানার বিয়ের ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করতে রাজি ছিল না।  সে সব রকমের ধুমধামের আয়োজন করলেন।  বর পক্ষ থেকে সাহানাকে গায়ে হলুদ দিয়ে যায়। কন্যা পক্ষ থেকেও বরকে গায়ে হলুদ দিয়ে আসে। 

বিয়ের দিন শহর থেকে ব্যান্ড পার্টি আনা হলো। সানাই বেজে উঠল।  সাহানার বান্ধবীরা, সহপাঠীরা, খেলার সাথীরা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠল। আনন্দ উৎসবে আমার অন্যান্য ভাই বোনেরাও অংশ নিলো। 

আমার এত ইচ্ছা করছিল সাহানার সব আনন্দ উৎসবে অংশ নিতে।  কিন্তু বিধাতা আমাকে সে আনন্দ করতে দিল না। ১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলাম। একদিকে শরীর পুড়ে যাচ্ছিল, অনদিকে শীতে থরোথরো করে কাঁপছিলাম।  ক্রাচে ভর করে যে একটু হেঁটে অনুষ্ঠান স্থলে যাব, তাও আর পারলাম না। সে শক্তি নেই।  অন্তরের ভিতর সানাইয়ের সুর বেদনার মতো করে বাজছিল --                              'প্রমােদে ঢালিয়া দিনু মন, তবু  প্রাণ কেন কাঁদে রে।
চারি দিকে হাসিরাশি,  তবু  প্রাণ কেন কাঁদে রে।'                                                                   
সামিয়ানা টানিয়ে তার নিচে চেয়ার টেবিলে বসিয়ে আগত অতিথিদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাই মহা ধুমধামে খেলেন, আনন্দ করলেন। 

এরপর সন্ধ্যারাতে বর আর কনেকে পাশাপাশি বসিয়ে নানারকম আনুষ্ঠানিকতা করা হয়। সব কিছুর ভিতর ছিল নির্মল আনন্দ, আর অনাবিল প্রাণোচ্ছ্বাস।  এত আনন্দ উৎসব হচ্ছে যে, তার কোনোটাই দেখার সুযোগ আমার হলো না। 

রাতেই সাহানা ওর শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। যাবার বেলায়  মা আর বাবাকে সাথে করে সাহানা আমার কাছে থেকে বিদায় নেবার জন্য ঘরে  চলে আসে।  আমি লেপের নিচে শুয়ে আছি।  শরীর কাঁপছে।  সাহানা আমার কপালে হাত রাখে। ও কেঁদে ফেলে। কান্না কন্ঠে বলে -- তোমার এত জ্বর !  বুকে অনেক ব্যথা বুঝি।  অনেক কষ্ট হচ্ছে তোমার। তাই না!  কে তোমায় কপালে জলপট্টি দেবে? আমি থাকলে আমি দিয়ে দিতাম। সাহানা মাকে ডেকে বলে --মামী আপনি  সাঈদ ভাইয়ের মাথায় একটু পানি দিয়েন। 

সাহানা আমার হাত ধরে বলে -- আমি চলে যাচ্ছি সাঈদ ভাই। তুমি আমাকে আশীর্বাদ করে দেবে না? 

আমি বিছানার উপর  উঠে বসি।  সাহানাকে বলি -- 'আমার ক্রাচ দুটো একটু এগিয়ে দে।' সাহানা ক্রাচ আমার হাতে তুলে দেয়।  ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াই। সাহানা আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। আমি ওকে বলি -- এসব সালাম করিস না। আমি তোর জন্য এমনিতেই প্রাণ ভরে অনেক দোয়া করব। 

সাহানা কাঁদছে। ওকে বলি -- আমাকে ধরে একটু  জানালার কাছে পর্যন্ত  নিয়ে যাবি?  ওখানে একটু দাঁড়িয়ে থাকব। সাহানা আমাকে জানালা কাছে পর্যন্ত  নিয়ে যায়। 

সাহানা রুম থেকে বেরিয়ে চলে যায়।  উঠোন দিয়ে হেঁটে হেঁটে গাড়িতে গিয়ে বসে। বর-কনের গাড়িটি একসময় ছেড়ে চলে যায়। আমি জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আলো আঁধারের ভিতর ওদের চলে যাওয়া দেখলাম।  

আকাশে ত্রয়োদশী চাঁদ উঠেছে। জানালার ফাঁক দিয়ে আচমকা স্রোতের মতো জ্যোৎস্না ধারা এসে আমার চোখ মুখ ললাট ধূয়ে দেয়। কোথাও আর একবিন্দু অশ্রুজল রইল না। 'মুহূর্তের মধ্যে একটি সত্য বুঝতে পারি -- অকূলে কেবল জেগে রয়, ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি আমার এ হৃদয়'।                                                                              

১১ আগস্ট, ২০২০ ইং
দক্ষিণখান, ঢাকা।     

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন