শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০২০

চতুর্থ নাম্বার

চতুর্থ নাম্বার
  
তুলতুলি আমার চতুর্থ মেয়ে। আসলে ওর নাম -- তাসনুভা। ওর শরীরটা এত তুলতুলে ছিল যে সবাই আমরা ওকে তুলতুলি বলে ডাকি। 

বয়স আড়াই বছরের একটু কম। টুকটুক করে সে অনেক কথা বলে। হাঁটেও ঝম্ থপ্ করে। মাঝে মাঝে পড়েও যায়। আবার একাকী উঠে দাঁড়ায়। উঠে দাঁড়িয়ে আবার ঝম্ থপ্ করে হাঁটতে শুরু করে।   

আসলে ওকে আমরা চাইনি। চেয়েছিলাম আমাদের একটি ছেলে হোক  তিন মেয়ের পর চতুর্থ নাম্বার কেউ মনে হয় মেয়ে চায় না। আমরাও চাইনি। তাই ওর আগমন বার্তা শুনে চিত্ত অতখানি আনন্দিত হয়ে  ওঠেনি।     

কিন্তু মেয়েটা যত বড়ো হতে লাগল, তত ও যেন মায়া কেড়ে নিতে লাগল। ওর বয়স যখন তিন চার মাস তখন থেকেই ও আমার পায়ের শব্দ বুঝতে পারত। আমি যখন অফিস থেকে বাসায় আসতাম এবং ঘরে ঢুকতাম, তখন তুলতুলি শুয়ে থেকে পা নাড়াতো।  আমার কন্ঠস্বরও বুঝতে পারত ঐ তিন-চার মাস বয়স থেকেই।    

আর তারপর তো তুলতুলির পৃথিবীতে ওর রাজকুমার বলতে সে আমাকেই বুঝত। বাইরে কোথাও থেকে এলে লতার মতো জড়িয়ে ধরত আমাকে। চলতে ফিরতে যদি কখনও ব্যথা পেয়ে কাঁদত, আমি ওকে বুকে জড়িয়ে কোলে নিলেই ওর কান্না থেমে যেত। শরীরের ব্যথা যেন সব উপশম হয়ে যেত।    

আমি ও আমার স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবী। বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকতে হয়, ওর মা ওকে পুরো সময় দিতে পারে না লালন পালনের। যদিও একটা মেয়ে রাখা হয়েছিল দেখাশোনার জন্য।    

একদিন আমার বড়ো এক বোন তার স্বামীসহ আমাদের বাড়িতে আসে।  তারা নিঃসন্তান। প্রচুর অর্থবিত্ত তাদের। তারা আমাদের তুলতুলিকে চেয়ে বসে। তারা প্রতিশ্রুতি করে -- তাদের সমস্ত মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা ও যত্ন দিয়ে তুলতুলিকে বড়ো করবে, লাগলপালন করবে, শিক্ষাদিক্ষা দেবে। কোনো রূপ অবহেলা ওকে করবে না। নিজের আপন সন্তানের চেয়ে অধিক করবে।  

আমরা তাদের অদম্য  চাওয়ার শক্তির কাছে হেরে গেলাম। একদিন আমার ঐ বোন তুলতুলিকে কোলে তুলে নিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে  তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল।    

তুলতুলিকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আমি যখন অফিস থেকে বাসায় আসতাম, তখন আমার পা আঙিনায় এসে থেমে যেত। পা আর চলত না। পায়ের কোনো শব্দ হতো না। আমার পদশব্দ শুনে তাই কেউ আর দৌড়ে এসে আমার কোলে উঠত না।    

মেয়েটা কখনোই রাতে মাঝখানে ওর মায়ের দিকে মুখ দিয়ে ঘুমাত না, আমার দিকে মুখ দিয়ে ঘুমাত। এখন রাতে যখন শুয়ে থাকি, মনে হয়, আমার আর আমার স্ত্রীর মাঝখানে বিরাণ এক উদাসী প্রান্তর।  কেমন ধুঁ-ধু শূন্যতা। আমার চোখে ঘুম আসে না।       

আমার তো আরও রূপময়ী তিনটি মেয়ে আছে। ওরা আমাকে কতরূপ ভাবে কাছাকাছি থাকে, আমাকে ব্যস্ত করে রাখে, তারপরও তুলতুলির অভাব ওরা পূর্ণ করে দিতে পারে না।    

তুলতুলি চলে যাওয়ার পর প্রায় সাত আট মাস কেটে গেছে। এর মাঝে আমরা আর তুলতুলিকে দেখতে যাইনি। এই না যাওয়াটা মনের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত।  এর কারণ-- তুলতুলি যেন আমাদের ভুলে যায়।  

তখন ঈদ সামনে।  আমরা তুলতুলির জন্য নতুন জামা কাপড় কিনলাম, জুতা কিনলাম। রাঙা ফিতা ও ডল ক্লীপ কিনলাম।  আমি এবং  ওর মা তুলতুলিকে দেখতে একদিন আমার বোনের বাড়িতে চলে যাই।

আমরা ড্রয়িং রুমে বসে আছি। তুলতুলি আমাদের সামনে দিয়ে ঝম্ থপ্ করে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। কিন্তু সে আমাদের দিকে একবারও ফিরে তাকাল না। একটু জড়িয়ে ধরে কোলে নেবার জন্য কতবার ওকে ডাকলাম, কিন্তু তুলতুলি আমার  কোলেও এল না।   

এত ছোট্ট একটি মেয়ে। ওর অভিমানের ভিতর কোনো লুকানো কান্না দেখতে পাইনি। দেখতে পাইনি মুখে স্মিত কোনো হাসিও।   
   

২২ আগস্ট, ২০২০ ইং
দক্ষিণখান, ঢাকা।।                                                                                                                                                                                            

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন