বেস্ট ফ্রেন্ড
আসলে পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার জন্য সে এসব করত না। আমরা যেটা বুঝতে পেরেছি, তাহলো ক্লাসে সে কোনো ভালো বন্ধু খুঁজে পায়নি। এমন কাউকে বন্ধু করতে পারেনি, যার সাথে সময় কাটাবে, তার সাথে গল্প করবে। এটা ওরও সীমাবদ্ধ হতে পারে। ও হয়ত কাউকে বেস্ট ফ্রেন্ড করে নিতে পারেনি।
একদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে ঐশ্বর্যময়ী খুব খুশি। ওর সারা মুখে চোখে এক অপূর্ব হাসির ঝিলিক। সে নিজে থেকেই বলছিল -- বাবা, আমাদের ক্লাসে একটা নতুন মেয়ে ভর্তি হয়েছে। ওর নাম রুম্পা। ও খুব ভালো। রুম্পা আমাকে বলেছে -- 'তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হবে?' আমি ওকে বলেছি -- 'হবো।' তারপর, ওর থাম্ব আমার থাম্বে মিলিয়ে বলেছে -- 'আজ থেকে আমরা দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড।'
এরপর থেকে দেখলাম ঐশ্বর্যময়ী স্কুলে যেতে আর কোনো টালবাহানা করছে না। ও খুব উৎসাহ নিয়ে স্কুলে যায়। কোনো ক্লাস মিস করে না। পড়াশোনাও খুব আগ্রহ সহকারে করে। বাসায় আমার কাছে, ওর মায়ের কাছে, ওর বড়ো বোনের কাছে সারাক্ষণ রুম্পার প্রসংশা করে।
স্কুলে ওরা দুজন টিফিন শেয়ার করে খেত। এইজন্য ওর মাকে স্পেশাল নাস্তা করে দিতে হতো। কেক, ন্যুডুল, পুডিং, ফলমূল, এটা ওটা একটু বেশি করেই দিয়ে দিত। আবার রুম্পাও ওর জন্য অনেক রকম খাবার নিয়ে আসত।
ঐশ্বর্যময়ীর স্কুলে যাওয়া নিয়ে আমাদের আর কোনো টেনশন করতে হতো না। ও নিজে নিজেই ওর ব্যাগ গুছিয়ে রাখে। হোমটাস্ক গুলো ঠিকমতো করে নিয়ে যায়।
একদিন ঐশ্বর্যময়ী স্কুল থেকে খুব মন খারাপ করে বাসায় আসে। আমি ওকে বলি -- 'মামণি, তুমি মন খারাপ করে আছ কেন? কী হয়েছে?' ঐশ্বর্যয়ী বলে -- 'বাবা, আজ রুম্পা ক্লাসে আসেনি।' আমি ওকে বললাম -- 'রুম্পার কোনো অসুবিধা ছিল হয়ত, তাই আজ আসেনি। দেখবে কাল আসবে।'
পরের দিন মেয়ে আবারও মন খারাপ করে স্কুল থেকে এসে বলে -- 'বাবা, আজও রুম্পা ক্লাসে আসেনি। আমি বললাম --' হয়ত ওর জ্বর হয়েছে তাই ক্লাসে আসছে না। তুমি মন খারাপ করো না। রুম্পার অসুখ ভালো হলে ঠিকই স্কুলে চলে আসবে।
এক সপ্তাহ মতো রুম্পা যখন স্কুলে আসছে না, তখন ঐশ্বর্যময়ীর পীড়াপীড়িতে স্কুলে অফিস থেকে খবর নিয়ে জানতে পারলাম -- 'রুম্পার আসলেই জ্বর। তাই স্কুলে আসছে না।' এদিকে, ঐশ্বর্যময়ী প্রতিদিনই মনখারাপ করে বাসায় ফেরে এবং আগের মতো স্কুলে যেতে অনিহা প্রকাশ করতে থাকে । কোনো উৎসাহ নেই।
আরও বেশ কিছুদিন পরে একদিন ঐশ্বর্যময়ী স্কুল থেকে বাসায় এসে ফুপিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে -- 'জানো বাবা, আজ রুম্পাকে ওর বাবা মা স্কুলে নিয়ে এসেছিল। ওর নাকি অনেক অসুখ। ও আমাদের দেখতে চেয়েছিল। তাই ওকে স্কুলে নিয়ে এসেছিল।'
পরে খবর নিয়ে জানতে পারলাম রুম্পার লিউকেমিয়া হয়েছে। রক্তে ক্যান্সার। ডাক্তার বলে দিয়েছে -- ও বেশি দিন বাঁচবে না। রুম্পা আর বাঁচবে না জেনেই ওর বাবা মা রুম্পাকে স্কুলে এনে ওর সহপাঠী বন্ধুদের দেখিয়ে নিয়ে গেছে।
আরও কয়েকদিন পর ঐশ্বর্যময়ী আমার কাছে খুব কান্নাকাটি করে বলতে থাকে -- বাবা, আমাকে রুম্পার কাছে নিয়ে যাও, আমি ওকে দেখব।'
ওকে কিছুতেই বুঝিয়ে রাখতে পারা যাচ্ছিল না।
ঐশ্বর্যকে নিয়ে আমি এবং ওর মা রুম্পাকে দেখতে একদিন ওদের বাসায় যাই। বাসায় যেয়ে শুনি -- রুম্পা হাসপাতালে। আমরা ওখান থেকেই হাসপাতালে চলে যাই
হাসপাতালে রুম্পা ওর বেডে শুয়ে আছে। মেয়েটা শুকিয়ে একদম কালচে হয়ে গেছে। শুধু প্রাণটাই যেন আছে। দেখলাম -- স্যালাইন চলছে। নাকে পাইপ লাগানো। ঐশ্বর্যময়ীকে খুব মায়া করে ও দেখছিল। রুম্পা ওর একটি হাত এগিয়ে দেয় ঐশ্বর্যময়ীর দিকে। ঐশ্বর্য ওর হাত ধরে -- এবং বলে -- 'তুমি আবার কবে স্কুলে যাবে? আমি ক্লাসে তোমাকে খুব মিস করি।'
রুম্পা বলছিল -- যাব। আমিও তোমাকে খুব মিস করি মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।
তারিখ -- ৭ আগস্ট, ২০২০ ইং
দক্ষিণখান, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন