রবিবার, ২ আগস্ট, ২০২০

আরিজোনা

আরিজোনা ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার



একবার দক্ষিণ আরিজোনার টুসন শহরে যাত্রা বিরতি করেছিলাম। হোটেল থেকেই জানতে পারি সোনারন নামে একটি  মরুভুমিতে নাকি  থোকা থোকা লাল রঙের ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফুটে থাকে। আরও আছে  বালিয়াড়িতে প্রান্তরের পর প্রান্তরে  ক্যাকটাসের ঝাড়। হাতে সময় নেই। পরের দিনই চলে যাব লাসভেগাস। আমার খুব দেখতে সাধ হলো মরুভুমিতে ফুটে থাকা ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার আর ক্যাকটাসের ঝাড় । হোটেলের ইনফরমেশন সেন্টার থেকে সোনারন যাওয়ার সব তথ্য জেনে নিলাম। ওরা আমার সাথে  একজন গাইড নিয়ে যাবার  পরামর্শ দিল এবং একজন গাইডের ব্যবস্থা করেও দেয় আমাকে।

গাইড মেয়েটির নাম -- নিকিতা জুলি। আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্রী। জুয়োলজীতে পড়াশোনা করে।  মেয়েটি ল্যাটিনা। ভেনেজুয়েলা থেকে এসেছে। ভারতীয় মেয়েদের মতো কালোকেশী।  অসম্ভব সুন্দরী, নদীর মতো দেহবল্লরী তার। চমৎকার ইংরেজিতে কথা বলে। ইউনিভার্সিটি ভ্যাকেশন সময়ে সে পার্টটাইম জব হিসেবে টুসন শহরে আগত পর্যটকদের গাইড হিসাবে কাজ করে।  

সকাল দশটার দিকে একটি পর্যটন মাইক্রোবাসে করে সোনারন মরুভূমির উদ্দেশ্য রওনা হই। আমাদের সাথে ছিল আরও ছয়জন নারী পুরুষ। তারাও যাবে সোনারন দেখতে।   

আমি আর নিকিতা সামনের সিটে বসে আছি। চলতে চলতে মাইক্রোবাসটি শহর ছেড়ে একসময় মরুভূমিতে যেয়ে পড়ে। চারিদিকে  ধু-ধু বালুকাময় প্রান্তর। কিন্তু এখানকার বালি অনেকটা ঊষর। জায়গায় জায়গায় পাথুরে মাটিও দেখতে পাই। নিকিতা আমাকে বলছিল, এই একমাত্র মরুভূমি তুমি একটু পর দেখতে পাবে ছোট্ট ছোট্ট টিলা। এবং পাহাড়। 

মাইক্রোবাসের অন্য সঙ্গীরা যে যার মতো আনন্দ করছে, স্ফূর্তি করছে, হুল্লোড় করছে, বিয়ার খাচ্ছে, গান গাইছে। নিকিতা আমাকে বলছিল --' তুমি কী কিছু খাবে?'  বললাম 'দাও।' 
'কী দিব?' 
'আনারসের জুস'। 
নিকিতা একটু বিস্মিত হলো! 

কী অপূর্ব দৃশ্য অপেক্ষা করছিল!  মরুভূমির বালি ফুঁড়ে সবুজ ঘাস !  অপেক্ষা করছিল আরও বিস্ময় !  রাস্তার দুপাশে ক্যাকটাসের জঙ্গল।  জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে লালরঙের অজস্র ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার ফুটে আছে। সুন্দর আবহাওয়া, বেশ মোলায়েম । না শীত, না গরম।  নিকিতার দিকে চেয়ে দেখি-- এখন যে তার গানের সময়। স্প্যানিস ভাষায় সে গুণ গুণ করে গান গাইছে।  আমি ওকে বলেছিলাম, তুমি যে গানটি গাইলে তা ইংরেজিতে একটু ট্রানস্লেট করে কথাগুলো বলো না ! ও বলছিল ---
'How it is to be with you
From the first day I saw your face
I knew this love was true…'

প্রান্তরের পর প্রান্তর মাইলের পর মাইল পথ  ছাড়িয়ে যাওয়ার পর একটা বাড়ি চোখে পড়ে।  আসলে এটি একটি গেস্ট হাউজ। পরে দেখলাম,  এই রকম গেস্ট হাউজ একটি নয়, বেশ কয়েকটি আছে। নিকিতা বলছিল -- 'এইটিই সোনারন ডেজার্ট।' যে সমস্ত পর্যটকরা এখানে এসে রাত্রিযাপন করতে চায়, তারা এই গেস্ট হাউজ গুলোতে ওঠে।  এখানে রেস্টুরেন্ট ও বার আছে। আছে মিউজিক ক্যাফে ও স্পোর্টস কাফেও।' একটি মিউজিয়ামও দেখলাম। আমি আর নিকিতা একটি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে নেই। তখন বিকেল হয়ে যায় । আসতে আসতে পথে দেরি হয়ে গিয়েছিল।     

এখান থেকে অদূরে ছোট বড়ো পাহাড় দেখতে পেলাম।  তারও আরো দূরে সানফ্রান্সিসকো পর্বতমালা। এখানে আগত নারী পুরুষ ও ছেলেমেয়েদের প্রধান আনন্দময় জায়গা হচ্ছে এই পাহাড়ের পাদদেশ।   

নিকিতা আমাকে বলছিল -- ' তুমি কী ঐ পাহাড়ের পাদদেশে যাবে?'  আমি বললাম,  যাব।  হেঁটে হেঁটে দুজন  যাচ্ছিলাম পাহাড়ের দিকে ক্যাকটাস আর ওয়াইল্ডফ্লাওয়ারের ঝাড়ের ভিতর দিয়ে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছিল।  ছায়া ছায়া ময় মনোরম পরিবেশ। সবুজ গালিচার মতন ঘাসে পাথর ঢাকা। কত নারী পুরুষ আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে  নিজেকে সপে দিচ্ছে পাহাড়কে সাক্ষী রেখে। অনেক ছেলেমেয়ে এখানে এসে প্রপোজ করে ভালোবাসার। ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার হাতে দিয়ে বলে -  I love you, I marry to you.  
          
একজোড়া ছেলেমেয়েকে দেখলাম --  প্রপোজ শেষে হাত ধরে জড়িয়ে হেঁটে হেঁটে আরও দূর পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি নিকিতাকে বলি -- ওরা কোথায় যাচ্ছে?  
নিকিতা বলছিল --  'ওরা মরুভুমি ভালোবাসে, ওরা পাহাড় ভালোবাসে।  আজ রাতটা এখানেই কাটাবে ওরা। খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকবে। পৃথিবীটাই ওদের বিছানা।'

তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছিল। দেখলাম প্রচন্ড একটি চাঁদ উঠেছে আকাশে। জ্যেৎস্নায় ভাসছে প্রান্তর। ভাবছিলাম, কী নির্জনে মধুযামিনী না হবে ওদের ! চাঁদের নিচে  ঘাসের শয্যা। 

নিকিতা বলছিল -- 'যাবে না তুমি?' বলেছিলাম -- যেতে ইচ্ছে করছে না যে ! 


( 'অপ্রাপণীয়া' উপন্যাসের পান্ডুলিপি থেকে। 
ছবি -- ওয়াইল্ডফ্লাওয়ার। )       


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন