গল্প ---
নীল আকাশের খোঁজেেএই করোনা কালে মাধবীর সাথে আমার একবারই যোগাযোগ হয়েছিল। ও আমাকে লিখেছিল, আমিও ওকে লিখেছিলাম, লকডাউনের সময় কে কেমন আছি -- তা জানতে চেয়েছিলাম দুজন দুজনের কাছ থেকে। তারপর আর কোনো খোঁজ খবর নেই। কারোর সাথে কোনো কথাও নেই। আসলে মাধবী আর আমার সম্পর্কটা এই রকমই। দীর্ঘদিন চলে যায় দীর্ঘ রাত্রি। দুজনেই কোথায় ডুব দিয়ে থাকি। কেউ কারোর খবর নেই না। কিন্তু আমাদের দুজনের মাঝে এই নিয়ে কোনো মান অভিমান নেই। কোনো ভুল বোঝাবুঝিও নেই। আমরা জানি -- একে অপরকে ভুল বোঝার দুঃসাহস আমাদের কারোর নেই।
দীর্ঘ প্রায় চার মাস পর মাধবী আমাকে লিখেছে ওর কথা ---
২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২০ ইং
ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।
রঞ্জন,
তুমি তো জানোই তোমার মন খারাপ থাকলে আমার মনখারাপ লাগে। কোনো কিছুতে তুমি কষ্টে থাকলে আমার অন্তর বীণার তার ছিঁড়ে য়ায়। 'পরানে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা-- দুখের মাধুরীতে করিল দিশেহারা, সকলই নিবে-কেড়ে, দিবে না তবু ছেড়ে-- মন সরে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে।'
কয়দিন ধরেই মনটা তোমার জন্য আকুল হচ্ছিল খুব। কেমন যেন ভেতরটা ভারী হয়ে আসছিল। মন বলছিল -- তুমি ভালো নেই। তুমি কষ্টে আছ। তোমার মন যে কতখানি কোমল, তা এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে কে বেশি জানে ! আর সেই মনটি যদি যাতনায় থাকে, তাহলে আমি কী ভাল থাকি, বলো ? কী যে এক অনিঃশেষিত মায়ায় তুমি আমাকে জড়িয়ে রেখেছ চিরকালের জন্য, তা জানে বিধাতা, আর জানি আমি।
এই শহরে করোনার বন্দীকাল জীবন আর নেই। তবুও মন কেন যে উচাটন হয়! তুমি তো জানো -- সুখে হোক আর দুঃখে হোক, তোমার কথা মনে হলে আমি নিভৃতে চলে যাই। ঘর হতে বেরিয়ে পড়ি। একাকী ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকি। আজ হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূর। টিলার মতো একটু উঁচু জায়গায় একটি নিরিবিলি ইতালিয়ান কফিসপে বসেছিলাম কফি খেতে। ওয়েটারকে অর্ডারও করেছিলাম এক গ্লাস গরম কফি দিতে । কিন্তু এক চুমুক খাওয়ার পর আর খেতে ইচ্ছে করল না। হঠাৎ মনে পড়ল-- সেই কতবছর আগের একদিন শাহবাগের মৌলিতে বসে কফি খাওয়ার কথা। গরম কফি চুমুক দিতে যেয়ে তুমি তোমার টি সার্টের উপর সব কফি ঢেলে ফেলেছিলে।
কফিসপ থেকে বেরিয়ে একটি ট্যাক্সি কল করে চলে যাই আল্পস পাহাড়ের দিকে। ভেবেছিলাম রডোডেনডন গুচ্ছ দেখে মন ভরাব। গাড়ির উইন্ড গ্লাস খুলে দেখি -- কোথাও কোনো পাহাড়ের ঢালে রডোডেনডন ফুটে নেই। এখানেও এসে স্মৃতি খুরে রক্ত ঝরালাম। একবার তুমি কী যে এক পাগলামি করলে ! একদিন একটি লোকাল বাসে করে আমাকে জোর করে নিয়ে গেলে রাজেন্দ্রপুর শালবনে। ওখানে নাকি রডোডেনডন থোকায় থোকায় ফুটে থাকে। কিন্তু সেদিন সারা শালবন তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও একটি রডোডেনডন গুচ্ছের ঝাড়ও খুঁজে পাইনি।
ট্যাক্সি চালককে বললাম -- তুমি আমাকে দানিয়ুব নদীর তীরে নিয়ে যাও। গেলাম সেখানে, কিন্তু ওখানেও ভালো লাগল না। এত নির্জন, এত নির্মল জল, এত নৈঃশব্দ -- ভালো লাগছিল না। দানিয়ুবের তীর ধরে যখন হাঁটছিলাম-- তখন মনে পড়ে গেল, একবার এক চৈত্রের ভর দুপুরে তুমি বললে -- 'চলো বুড়িগঙ্গার পারে শ্মশান ঘাটে যেয়ে বসে থাকি। ঐ জায়গা নাকি খুব নির্জন হয়, ভয়ে কেউ ওখানে যায় না'।
কোথাও মন ভালো হলো না। সন্ধ্যার পর ভিয়েনা শহর আলোয় আলোয় ভরে উঠল। ঘরে ফিরে এসে আমার স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে কতক্ষণ কেঁদে নিলাম। বুকের ভার অনেকটাই কমে গেল। আমার আফসোস শুধু একটাই -- আমারও রক্তের গ্রুপ AB Positive.. তোমার মায়াবতীর এই সংকটকালে আমিও তো ওকে রক্ত দিতে পারতাম। কিন্তু এত দূরে পড়ে রয়েছি যে -- আমার শরীরের প্রবাহমান সব রক্ত বেদনায় হিম হয়ে গেল।
কেমন আছ তুমি? কেমন আছে তোমার মায়াবতী জানাইও।
--- মাধবী।
আমি মাধবীর লেখার শেষ লাইনটাই শুধু প্রলম্বিত করলাম। লিখে জানালাম ওকে --
চির কল্যাণীয়াসু,
দার্জিলিং থেকে আনা ধবধবে সাদা শাড়িটা মায়াবতীর খুুব পছন্দ। সেই কতবছর ধরে একটি কাঠের তোরঙ্গের ভিতর যত্ন করে শাড়িটি রেখে দিয়েছে সুগন্ধী আতর মেখে । আজ বিকালে পরেছিল সেই শাড়িটি।
কতদিন ধরে বন্দী ঘরে রোগ শয্যায় শুয়েছিল কত কাতরতায়। এখন অনেক ভালো সে। ও নীল আকাশ দেখতে বের হবে। মায়াবতী তাই বলছিল-'তুমি আমাকে হাত ধরে একটি খোলা অটো রিকশায় নিয়ে বসাও। দেখে নিয়ে আসো উদাস কোনো প্রান্তরের উপরের নীল আকাশ।
আমরা চলে যাই শিয়ালডাঙ্গার মাঠে নীল আকাশের খোঁজে। খুঁজে পেলামও মাথার উপর অসীম নীল আকাশ। সারা আকাশ জুড়ে শরতের সাদা মেঘরাশি তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। রাস্তার দুপাশে বিস্তির্ণ কাশবন। অজস্র শুভ্র কাশফুল ফুটে আছে থরে থরে। ঝিরিঝিরি বাতাসে দুলছে পাপড়িগুলো। পথের উপর নেমে খুঁজলাম আমাদের প্রিয় সেই বাবলা গাছটিও। যার তলে বসলে মনখারাপ ভালো হয়ে যায়।
কত কথা আমাদের গল্পে ছিল। কী অদ্ভুত সন্ধ্যা এসেছিল ভৈরবীর অস্ত রাগে। আজ এখানেও তেমনই নেমে এসেছিল সন্ধ্যা -- গল্পের মতো, রাগ ভৈরবীর মতো । চুপচাপ আঁধার হয়ে আসছিল। পথে কাশবনের ঝাড়ে জোনাকিদের আলো জ্বলে উঠেছিল আর নিভছিল। এমন ক্ষণে মন আবার বিষণ্ণও হয়--- ' যে -জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা।'
তবুও মনে কত আশা জাগে , কত স্বপ্ন গাঁথা হয়ে থাকে চিত্রের মতো ....
---- রঞ্জন।
৩ আগস্ট, ২০২০ ইং
মানসী কুঞ্জ, দক্ষিণখান, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন