হৈমন্তীবালা
দুই হাজার নয় সালে একবার আমরা শিলিগুড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাাম । বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ করেছিল শিলিগুড়ির আমাদের বন্ধু শিশির রায়। শিশির এবং ওর স্ত্রী পৃথার প্রবল ইচ্ছা ছিল আমরা শিলিগুড়িতে যেয়ে ওদের বাড়িতেই উঠি। কিন্তু তা না উঠে আমরা হোটেল সেন্ট্রাল প্লাজাতে উঠেছিলাম।
এই ভ্রমণের উপর বেশ কিছু লেখা এর আগে আমি লিখেছিলাম। সেইসব লেখা ফেসবুকে ও ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল। আজ সেই সব কথা আর বলব না। আজ বলব অন্য কথা।
ছোট্ট এই শহরে এলাম। শহর থেকে একটু দূরে গেলেই পাহাড় দেখা যায়। আবার যদি মন চায় সমতলে পাকা রাস্তার উপর দিয়ে ট্যাক্সি চালিয়ে চলে যাওয়া যায় তিস্তার পাড়ে, জলপাইগুড়ির চা বাগানে, ডুয়ার্সের বন জঙ্গলে। তিস্তার পাড়ে গেলে মনে হবে, এই নদী ওপারে বাংলাদেশেও আছে। শুধু বিভাজন করা হয়েছে সীমানারেখায় আর কাঁটা তারের বেড়ায়।
শিশির একদিন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল --আমি জানি, তুমি ভালো কবিতা লিখ। কাল আমাদের এখানে ঘরোয়া ভাবে একটি কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়েছে। আমি চাই -- তুমি সেখানে তোমার একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করো।'
আমি শিশিরকে 'না' বললাম না।
এই শহরে এসে আমি কবিতা পড়ছি! এই শহরে আমি কবিতা পড়ব -- এই কথা শুনলে সবচেয়ে যে বেশি খুশি হতো, যে এসে আমার কবিতা শুনত, সে আজ এই শহরে নেই।
বহু পুরনো বহু বিস্মৃত স্মৃতিকথা মনে পড়ে মুহূর্তেই চোখ দুটো মৌনতায় স্থীর হয়ে গেল। জীবন পাতার পিছনের পৃষ্ঠাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছু সময় ।
ঝাপসা ও ম্লান হয়ে যাওয়া জীবনের সেই প্রথম দিককার পৃষ্ঠাগুলো এক এক করে উল্টাতে
থাকি ---
ফুলকোচা ফ্রী প্রাইমারি স্কুলে তখন টু ক্লাসের ছাত্র আমি। প্রথম দিনের কথা। মা আমার মাথায় সরিষার তেল মেখে পরিপাটি করে চুল আঁচড়িয়ে দিয়েছিল। জহুরা বুবু দিয়েছিল চোখে পুরু করে কাজল এঁকে । পরনে ছিল রাবার লাগানো চেক হাফ প্যান্ট। গায়ে ছিল পপলিনের সাদা হাফ সার্ট। পায়ে ছিল স্পঞ্জের স্যান্ডেল। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে এক কোণে চুপচাপ বসেছিলাম। ওপাশ থেকে দেখি --- হৈমন্তীবালা আমার হ্যাবলাকান্ত চেহারা দেখে মিট মিট করে হাসছে।
একদিন হৈমন্তীবালা চুপিচুপি ওদের গাছের একটি কাঁচা ঢাসা পেয়ারা এনে আমাকে খেতে দিয়ছিল। আর একদিন দিয়েছিল পূজোর প্রসাদ--- খেঁজুরের গুরের খাজা, নারিকেলের নারু আর তখতি। মাঝে মাঝে আমি কুণ্ডুদের দোকান থেকে মা'র দেওয়া এক আনা পয়সা থেকে কাঠি লজেন্স কিনে এনে হৈমন্তীকে খেতে দিতাম এবং আমিও খেতাম। ফাইভ ক্লাস পর্যন্ত হৈমন্তী আমার সহপাঠি ছিল।
একদিন দেখি হৈমন্তীবালা ক্লাসে আসেনি। কেন সে আসেনি সে কথা জানতেই -- সবাই বলাবলি করছে হৈমন্তীদের পরিবার গত রাতে দেশ ত্যাগ করে ওপারে চলে গেছে। সেই শিশু বেলায় বুঝিনি, হৈমন্তীরা কেন দেশ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল।
হৈমন্তী আর ক্লাসে আসে না। ওকে আর দেখতে পাই না। শুধু এই কথা ভেবেই মন খারাপ লাগত। ওর জন্য তখন কেঁদেছিলাম কিনা, সে কথা আজ আর মনে নেই।
তারপর চলে গেছে আরও কয়েকটি বছর।
তারপর প্রাইমারি স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হলাম। সেখানে কত নতুন নতুন সহপাঠী বন্ধু পেলাম। ঝর্ণা, দোলা, জাহানারা, সাইফুল, আমিনুল -- আরও কত বন্ধু। কিন্তু শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাওয়া আমার সেই সহপাঠিনী বন্ধু হৈমন্তীবালা আমার মনের কোণে রয়েই গেল।
তারপর চলে গেছে আরও কয়েকটি বছর।
তারপর প্রাইমারি স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হলাম। সেখানে কত নতুন নতুন সহপাঠী বন্ধু পেলাম। ঝর্ণা, দোলা, জাহানারা, সাইফুল, আমিনুল -- আরও কত বন্ধু। কিন্তু শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাওয়া আমার সেই সহপাঠিনী বন্ধু হৈমন্তীবালা আমার মনের কোণে রয়েই গেল।
তারপর চলে গেছে আরও কয়েক বছর। হৈমন্তী'রা কোথায় আছে? কেমন আছে? জানতে ইচ্ছা করত। পরস্পরে শুধু এইটুকু জেনেছি যে, ওরা নাকি জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির কাছাকাছি তিস্তা নদীর পারের কোনো একটি গ্রামে থাকে। কিন্তু কে যায় তিস্তা পারে ! কার এত দায় একজন হৈমন্তীবালাকে দেখতে যেতে ? মনেও পড়ে না ওকে তেমন আর ! আর হৈমন্তীও কী মনে রেখেছে আমাকে ?
জীবন পাতা ইতোমধ্যে লিখে লিখে ভরে ফেলেছি অনেক। বিস্মৃতির অতল আঁধারে হারিয়ে গেছে শিশুকালের সেই ফ্রক পরা লাস্যময়ী সহপাঠিনী হৈমন্তীবালা।
কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎই মনটা বিহবল হয়ে উঠত। উদাস হয়ে চেয়ে দেখতাম -- চার চালের সেই টিনের স্কুল ঘর। ছোট্ট মাঠের উপরে নিম গাছ। স্কুলে ছুুুটির ঘন্টা পড়ছে। দৌড়ে দৌড়ে বালক বালিকারা বাড়ি চলে যাচ্ছে। হাতে বই খাতা নিয়ে হৈমন্তীবালাও বাড়ি যাচ্ছে। আমিও যাচ্ছি। যাবার বেলায় ফিরে ফিরে দেখছি হৈমন্তীকে। আর হৈমন্তী দেখছে আমাকে।
তখন আমি কলেজে পড়ি। গ্রীষ্মের ছুটিতে সেবার বাড়িতে এসেছি। একদিন পিওন একটি চিঠি নিয়ে আসে। চিঠিটি ভারতীয় একটি ডাক খামের। খুলে পড়তে থাকি --
রঞ্জন,
কেমন আছো তুমি। আমি তোমার কৈশোরের সহপাঠিনী হৈমন্তী। আমাকে কি তোমার মনে আছে? চিনতে পারছ কী আমাকে? বাংলাদেশ থেকে আমাদের এক আত্মীয় এসেছিল এখানে । তার কাছে থেকে জানতে পারলাম তোমার কথা। তারপর থেকে তোমাকে আমার খুব লিখতে ইচ্ছে করছিল। তাই লিখছি এই চিঠি।
যদি আমার কথা তোমার মনে থাকে, যদি আমাকে লিখতে মন চায়, তাহলে লিখ। আজ আর বেশি কিছু লিখছি না। তোমার কাছে থেকে উত্তর পেলে তখন লিখব আরও অনেক কথা। নীচে আমার ঠিকানা দিলাম। আমি তোমার চিঠির জন্য অপেক্ষা করব।
ভালো থেকো।
ইতি -- হৈমন্তী।
হৈমন্তীর চিঠির উত্তর আমি লিখেছিলাম। ও তখন শিলিগুড়ি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ত। থাকত কলেজের কাছেই হাকিম পাড়াতে একটি ছাত্রী হোস্টেলে। হৈমন্তী খুবই সাহিত্য সংস্কৃতিমনা ছিল। ও কবিতা লিখত, আবৃত্তি করত। গানও গাইত। ওর সাথে বছরখানেক আমার পত্র যোগাযোগ ছিল। প্রায় চিঠিতে ও কবিতা লিখে পাঠাত। আমিও লিখে পাঠাতাম কবিতা। ওর লেখা একটি কবিতার কয়েকটা লাইন এখনও মনে আছে --
'আমার ছোট কিছু আশা ছিল, ছোট ছোট ভালোবাসা ছিল, ছোট কিছু স্বপ্ন ছিল, আমার কিছু পাওয়ার ছিল।
আমার কিছু আক্ষেপ আছে, বুকের নীচে কান্না আছে, চোখ ভরা জল আছে -- পুতুল খেলার ঘরটি আমার ভেঙে গেছে। ,
একখানা ঘর পাব কী আর আগের মতো, স্বপ্বগুলো কী আর ফিরে পাব পুুুুুুতুলখেলার সেই খেলাঘরটির মতো.... ' হ্যাঁ, আমিও স্বপ্ন দেখতাম হৈমন্তীবালার মতো। কত স্বপ্নের কথা চিঠিতে লিখে পাঠাতাম ওকে। তপ্ত রোদ্রের নীচে হাঁটতে হাঁটতে উদাস হয়ে চলে যেতাম অনেক দূরে । ইছামতীর নদীর কূলে বসে স্বচ্ছতোয়া জল দেখতাম। ছুটিতে ঢাকা থেকে বাড়িতে গেলে প্রায়ই চলে যেতাম স্কুল প্রাঙ্গনে। নিম গাছটা বুড়ো হয়ে সেখানেই আছে। কখনও কখনও মরা পাতা ঝিরঝির করে ঝরে পড়তে দেখতাম মাটির উপরে।
বাস্তবে কোনো কিছু পাওয়ার ভিতর যেমন আনন্দ থাকে , আবার স্বপ্নে পাওয়া বস্তু পেয়েও মানুষ আনন্দ পায়। বাস্তবে পাওয়া বস্তু হারিয়ে মানুষ আক্ষেপ করে, কান্নাকাটি করে। কিন্তু স্বপ্নে পাওয়া কোনো দূর্লভ বস্তু হারিয়ে মানুষ কাঁদে না।
কেমন করে যেন সব স্বপ্নগুলো ভেঙে গেল। একটা সময়ে হৈমন্তীবালার আর কোনো পত্র আসত না। আমি তারপরও দুতিনটি লিখেছিলাম কিন্তু সবগুলোর নো রিপ্লাই ছিল।
কেমন যেন অন্তর হাহাকার করে উঠত। মনে পড়ত পিছনের সব মানুষ, নদী, ধানক্ষেত। শুনতে পেতাম বাউল আর ভোরের পাখিদের গান। মনে পড়ত হৈমন্তীবালার কথা। খুব ইচ্ছা হতো তিস্তা নদীতে নৌকা ভাসিয়ে চলে যাই ময়নাগুরিতে।ওখানে তো এই নদী আছ। যেয়ে খুঁজে বের করি ওর গ্রাম। ওর শহর। দেখে আসি একটিবার আমার ছেলেবেলার সেই হৈমন্তীকে।
হৈমন্তীবালার খবরটি জেনেছিলাম আরও পরে।
সেদিন সন্ধ্যায় শহর থেকে বাড়িতে ফিরছিলাম। শৈলভিটা নদীর খেয়াঘাট পারাপারের সময় দেখা হয় হৈমন্তীদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সাথে। ওর নাম দীলিপ। স্কুলে আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিল। সেই বলল হৈমন্তীর করা।
হাতে শাঁখা পলা পরা হয়নি ওর। সিঁথিতেও দিতে পারেনি কেউ সিঁদুর। তার আগেই পোড়ামুখী চিতায় পুড়ে নাকি ভস্ম হয়ে গেছে। আহা! কেউ যদি ওর দেহের ছাইভস্ম ওপারের তিস্তা নদীতে ভাসিয়ে দিত, তাহলে চলে আসত সেই ছাইভষ্ম ভেসে ভেসে এপারের তিস্তায়। একই নদী, একই স্রোত, উপরে একই নীল আকাশ।
"এই স্নেহহীন, মায়াহীন, জলবায়ু শুন্য জতুগৃহে
কতোদিন শুনি না ঘুঘুর ডাক, রাখালের বাঁশি,
টানা বাতাসের শব্দ
দেখিনা সবুজ মাঠ, উধাও দিগন্ত
ঘরের পিছনের ছোট্ট জংলায় দোয়েলের উড়াউড়ি,
কোথাও দেখিনা একটি ধানের শীষে গঙ্গাফড়িং,
লাউ জাংলার পাশে স্থলপদ্ম..... "
কতোদিন শুনি না ঘুঘুর ডাক, রাখালের বাঁশি,
টানা বাতাসের শব্দ
দেখিনা সবুজ মাঠ, উধাও দিগন্ত
ঘরের পিছনের ছোট্ট জংলায় দোয়েলের উড়াউড়ি,
কোথাও দেখিনা একটি ধানের শীষে গঙ্গাফড়িং,
লাউ জাংলার পাশে স্থলপদ্ম..... "
--- মহাদেব সাহার কবিতা।
সব চাওয়া এক জীবনে পাওয়া হয় না, হয়ত বহু জন্মেও না– প্রাপ্তির আনন্দ এইটুকু পাই যেন আমি, মনের কোণে কারোর মায়া যেটুকু পুঞ্জীভূত হয়ে আছে তা যেন কখনও নিঃশেষ না হয়ে যায়। শাশ্বত যুগসমূহের মধ্যে, সুদীর্ঘ অনাগত কাল ব্যেপে তা যেন ভরে থাকে। ঐ নীল আকাশ, ওই কলতরঙ্গিনী তিস্তা নদী , দূরের নীহারিকাপুঞ্জ, হলদে-ডানার প্রজাপতি, এই শোভা, এই আনন্দের মধ্যে দিয়ে যেন বেঁচে থাকি ।
সেদিনের সেই গভীর রাতে সেন্ট্রাল প্লাজা হোটেলের কাঁচের জানালা খুলে দেখেছিলাম -- দূরের আঁধার হওয়া আকাশ। তারা জ্বলছিল তখনও। শহরের রাজপথ সব জনশূন্য। জাতীয় সড়ক থেকে দু'একটা গাড়ির কর্কশ হর্ণ শোনা যাচ্ছিল কেবল। একটা সিগারেট ধরাই। জানালার পাশ থেকে ফিরে এসে টেবিলে বসি। এই শহরে হৈমন্তীবালা থাক বা না থাক। আমার আবৃত্তি করা কবিতা সে শুনুক আর না শুনুক। একটা কবিতা তো লিখতে হবে।
~ কোয়েল তালুকদার
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ইং
ঢাকা।
্
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন