শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০১৭

চন্দ্ররাত্রির কথা

কিশোর বয়সে আমি একবার সরিষাবাড়ী থানার পিংনার চিতলি পাড়া নামে এক গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম । ঐ গ্রামেই দেখেছিলাম-শান বাঁধানো একটি পুকুর । আমার মনে আছে সেদিন আকাশে চাঁদ উঠেছিলো। জ্যোৎস্নায় ডুবে যাচ্ছিলো বৃক্ষ লতা গুল্ম।ঝোঁপে ঝাঁরে জোনাকিরা সব জ্বলে উঠেছিলো। আমরা অনেক রাত পর্যন্ত ঘাটের বকুলতলায় বসে গল্প করেছিলাম। সেই রাত, সেই ঘাট, সেই জল, সেই বকুলের মৌ মৌ গন্ধ আজো আমাকে উতলা করে রাখে।
তারও অনেক পরে শিলাইদহ কুঠিবাড়ীতে এই রকমই শান বাঁধানো পুকুর দেখেছিলাম। আজ থেকে শতো বছরও বেশী আগে কবিগুরু তার তরুণী বধূ মৃণালিনী দেবীকে নিয়ে এই পুকুর ঘাটে বকুলের তলায় বসে কতো গান গেয়েছিলো । কতো কবিতা লিখেছিলো । এতো বৎসর পরে আজো সেখানে চাঁদ ওঠে। বকুল ফুল ফোটে। এখনো সেই ঘাট আছে, এখনো দূরের পদ্মা থেকে বয়ে আসে শীতল হাওয়া। শুধু কবিগুরু নেই। মৃণালিনী দেবী নেই।
বসন্তের এক মধু সন্ধ্যার কথা। রাঙামাটির সাজেক ভ্যালী থেকে ফেরার পথে চট্টগ্রামে একদিন ছিলাম। আমার সাথে ছিলো নব পরিনীতা। আমরা চলে যাই উত্তর কাট্টলীর নমিতা দেবীর শান বাঁধানো ঘাটে। পুকুরের দুই দিক থেকে দুটি পথ দুই দিকে চলে গেছে। অদূরে গীতা মন্দিরে শঙ্খধ্বনি বেজে উঠেছিলো। পুরো আঙ্গিনায় সবুজ আর সবুজ, বিচিত্র সব বৃক্ষরাজি। তারই ফাঁক দিয়ে উঠেছিল শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। আমরা বিমুগ্ধ হয়ে বসেছিলাম ঘাটে। রাতের প্রথম প্রহর সেখানেই কাটিয়েছিলাম সেদিন। আমার আজো সেই রাতের মুহূর্তগুলি ফিরে পেতে ইচ্ছা করে।
তারপর অনেক দিন হয়েছে গতো। নানান কর্মে বেঁধে যাই সংসার মায়াজালে। এখনো অনেক নস্টালজিয়ায় আকুল হই। এখনো হঠাৎ পূর্ণিমা এলে ঘর হতে বেরিয়ে পড়তে মন চায়। শান বাঁধানো পুকুরপাড় আমাকে টানে। বকুল ফুল ঝরে পড়া দেখতে ইচ্ছা করে । আমার খুব শখ হয় এমনি কোনো চাঁদনী রাতে আমরা দু'জন যেয়ে বসে থাকি আবারও কোনো বকুলের তলায়।
আবারও যদি আসে কখনো সিদ্ধার্থের গৃহ ত্যাগের মতো চন্দ্ররাত্রি, তাহলে সেই রাত্রির কানে কানে তাকে বলতাম -- 'এসো রাত্রি, এই আকাশে আমরা আসন পাতি। তুমি বাজাও তোমার বীণা। সে বীণার সুর ঢেউ তুলুক জোছনায়। নরম চামোলি-আলোয় স্নান করিয়ে দিই তোমায়। তার আগে এসো ঘুমের দেশের স্বপ্নতরীগুলোকে ভাসিয়ে দিই আলোর বন্যায়। ওরা স্বপ্ন ছড়িয়ে দিক দিকে দিগন্তরে। এই চরাচরের বুকে স্বপ্নরা আকাশপ্রদীপের মতো জ্বলতে থাকুক।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন