শুক্রবার, ১২ জানুয়ারী, ২০২৪

কংসাবতীর তীরে ( পাণ্ডুলিপি )

উৎসর্গ -

আমার প্রকাশক বাঙ্গালা গবেষণার স্বত্বাধিকারী আমাদের প্রিয় আনোয়ারা শিরীন ভাবীকে --
কতো সময়ে অসময়ে তার রান্না ভাতে আমি ভাগ বসিয়েছি। 


১.        কংসাবতীর তীরে 


তেমন কোনও বিত্ত ছিল না আমাদের। ছিল না দৌলতও। টিউশনি করে লেখাপড়া করেছি। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর লেখাপড়া চালিয়ে  যাওয়া আর সম্ভব হয় নাই। পরিবারের প্রয়োজনে  একটি এনজিও তে চাকুরি নেই। আমার পোস্টিং হয় শেরপুরের নালিতাবাড়ীর ভারতের  মেঘালয় সীমান্তবর্তী এক অজো পাড়া গাঁয়ে।  আমার পদবী ছিল মাঠকর্মী। যারা এনজিও থেকে ঋণ নেয়, তাদের কাছ থেকে ঋণের কিস্তির টাকা আদায় করাই আমার কাজ ছিল।  

আমি এর আগে কখনও এই নালিতাবাড়ী আসিনি। বাড়ি থেকে আসার পথে খুব দুর্ভাবনা করেছি, ঐ অপরিচিত জায়গায় গিয়ে কোথায় উঠব, কোথায় থাকব। কিন্তু এখানে আসার পর সেই ভাবনা অনেকটা দূর হয়েছে। আমাদের কেন্দ্রের ম্যানেজার সাহেব অফিস সংলগ্ন একটি ছোট্ট রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেন। 

এখানে নিজেই রান্না করে খাই। বেশিরভাগ সময়  সকালবেলা রান্না করে তিন বেলা খেয়ে নিতাম। ভাত রান্না করার সময় ভাতের মধ্যে ডিম সিদ্ধ দিতাম। সেই ডিম কাঁচা মরিচ ও পিয়াজ দিয়ে ভর্তা করতাম। আবার ডিম মামলেটও করতাম মাঝে মাঝে।  কোনও কোনও সময় মসুর ডাল ভর্তা দিয়েও ভাত খেয়েছি। মাছ মাংস তেমন কেনা হতো না। ওগুলো কাটাকুটি করে রান্না করে খাওয়া আমার পক্ষে  সম্ভব ছিল না।
  
এলাকাটি দারুণ প্রকৃতি শোভাময়। অদুরেই ভারতের মেঘালয় রাজ্য। সীমান্ত শুরু হয়েছে সুউচ্চ গারো পাহাড় দিয়ে। সেই পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে  এসেছে কংসা নদী। জেনেছি  ভারতের শিলং মালভূমির পূর্বভাগে তুরার কাছে এ নদীর উৎপত্তি। কী অদ্ভুত ! যে নদীর জন্ম দিল শৃঙ্গে জমে থাকা মেঘ আর চেরাপুঞ্জির অজস্র বৃষ্টির জলধারা। আর সেই ধারা কী-না বয়ে এল আমাদের দেশে নদী হয়ে। কী স্বচ্ছ এর জল।  পাথর, পাথরকুচি আর সিলিকন বালু এই নদীর অতল দিয়ে ভেসে আসে এ দেশে । 

এই নদীর এখানে অন্য নাম -- ভোগাই। নাহ্ আমি  তাকে সে নামে ডাকতাম না। ভালো লাগত না এই নামটি। আমি ওকে কংসাবতী বলে ডাকতাম। আমিই  ওকে ডাকি, আমি তা শুনি। আমিই তার অপরূপ রূপ দেখি । 

আমার তেমন কোনও বন্ধু ছিল না এখানে। তাই এই নদীটাকে আমি আমার বন্ধু করে নিয়েছিলাম। এর কূল ধরে হাঁটতাম, কত সন্ধ্যা নেমেছে কংসাবতীর তীরে, কত সূর্য ডুবে গেছে গারো পাহাড়ের শৃঙ্গের আড়ালে। অস্তাচলের কত সোনালি আভার দিগন্ত আঁধারে কালো  হয়ে গেছে।  মনে হতো জীবনের সব গান  হারিয়ে ফেলেছি ঐ দূর আকাশে,  ঐ পাহাড় শৃঙ্গের ঘন লতাগুল্মের নিভৃতে । 

এই কংসাবতীর তীরের একটি গ্রাম নয়াগাঁও।  আমাদের এনজিওর একটি কেন্দ্র ছিল এখানে। কেন্দ্রটির অফিসিয়াল নাম দেওয়া হয়েছিল 'সন্ধ্যাতারা'।  এই কেন্দ্র থেকে গরীব, দুস্থ ভূমিহীন মেয়েরা ঋণ গ্রহণ করত।  আছিয়া, নুরজাহান, নুরী, বুলবুলি, নসিরণ, জরিনা সহ আরও এমন অনেক মেয়ে এই সন্ধ্যাতারা কেন্দ্র থেকে ঋণ নিয়ে  তারা নিজেদের স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে । শাখার ম্যানেজার সাহেব প্রথম দিনই ঋণ গ্রহিতাদের তালিকা আমাকে দিয়ে বললেন -- এই সন্ধাতারা কেন্দ্রে আপনাকে কাজ করতে হবে। তিনি এই ব্যাপারে আমাকে আরও কিছু প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দিলেন। 

পথম দিনের কথা। 

শাখা অফিস থেকে কংসাবতীর তীর  ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম নয়াগাঁও সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে। তখন ছিল আশ্বিন মাস। কংসাবতীর বুক ভরা অথৈই জল। কংসার স্বচ্ছ পানির উপরে পড়েছে শরতের সাদা মেঘের ছায়া। জলের উপর রোদ্দুর ঝিলমিল করছে। নদীর কূল ধরে যখন হাঁটছিলাম তখন দেখছিলাম জল আর মেঘ-রোদ্দুরের খেলা।  আরেক দিকে  দেখছিলাম হলুদ ফুলের সরিষার ক্ষেত। ফড়িং আর প্রজাপতি এসে পড়ছিল গাদা গাদা ফুলের উপর। অদূরে দেখতে পাই একটি প্রাচীন বটবৃক্ষ। কোথাও একটি মানুষও নাই। একদম  বিজন। বটবৃক্ষটি পার হয়ে সামনের দিকে হাটঁতে থাকি। 

তখন বেলা বারোটা হবে। নয়াগাঁও গ্রামের নিকটবর্তী হতেই দেখতে পাই -- একটি স্ত্রীলোক নির্জন কংসাবতীর জলে নেমে সে স্নান করছে। বক্ষের বসন ঈষৎ উন্মোচন করা,  সাদা ঝকঝকে গায়ের রং, হাতে বালা , পরনে লালপাড় শাড়ি, বয়স চব্বিশ পঁচিশ হবে। স্ত্রীলোকটি প্রথমে আমাকে দেখতে পায় নাই, যখন আমাকে দেখতে পায়, সে লজ্জাশীলা হয়ে উঠে। বুকের বসন ঠিক করে  নদীর কূলে অবস্থিত  তার বাড়ির দিকে হেঁটে চলে যায় । 

তখন আমার বয়সই কত !  বিশ হবে। একজন উচ্ছল তরুণ,  বিয়ে করি নাই। আমি  অত বড়ো বিদ্বান ব্যক্তিও ছিলাম না। তেমন কিছু পড়া হয় নাই উপন্যাস, গল্প, নাটিকা। পড়লে বুঝতে পারতাম -- মঞ্জুলিকা, বাসন্তী, শকুন্তলা, বিনোদিনী, অভিসারিকা এইসব  কী !  কিন্তু সেদিন সেই আশ্বিনের মিষ্টি রোদের নীচে কংসাবতীর জলে যে রমণীকে স্নানরত দেখলাম -- তা আমার তরুণ হৃদয় মনে একধরনের মদিরার মতো চির আসক্তির অনুভব হয়ে থাকল। 

নয়াগাঁও গ্রামে ঢুকে কেন্দ্র প্রধান নুরজাহান খাতুনের বাড়িটি খুঁজে বের করি। আমি নুরজাহানের বাড়িতে ঢুকে  আমার পরিচয় দেই। নুরজাহান আমাকে ছালাম দিয়ে বলে-- 'স্যার আপনি বসেন। আমি সব সদস্যদের ডেকে নিয়ে আসি।'  

আমি উঠোনে একটি কাঠের চেয়ারে বসে থাকি। আমার ভালোই লাগছিল এই জন্য যে, সামান্য একটা চাকুরী করি। আর এই মেয়েটি কীনা আমাকে স্যার ডাকল। আমাকে তাহলে এখানকার সবাই স্যার ডাকবে। 

ঘন্টা খানেকের মধ্যে প্রায় বিশ বাইশ জনের মতো মেয়ে জড়ো হলো। তাদের সবার বয়স কুড়ি থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। আমি ওদের নিকট আমার পরিচয় দিলাম-- বললাম, 'আমার নাম আনিসুর রহমান। এই কেন্দ্রে নতুন জয়েন করেছি। আমার বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ি থানায়। শাখা অফিসেই আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আমি নবীন, অল্প বয়স।  আপনেরা আমাকে স্যারও ডাকতে পারেন, আবার আনিস ভাইও ডাকতে পারেন।' নুরজাহান বলে উঠল -- স্যার, আমরা সবাই আপনাকে স্যারই ডাকব। '

সবাই তাদের ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তিগুলো আমাকে প্রদান করে তাদের জমা বইয়ে এন্ট্রি করে নিচ্ছিল।  একটি মেয়ে ঘোমটা টেনে একটু  দূরে দাঁড়িয়েছিল। সে আসছিল না আমার কাছে।  নুরজাহান ঐ মেয়েটিকে ডেকে বলে -- ও জরী, তুই দাঁড়িয়ে রইছোস ক্যান, কিস্তি জমা দে। '

মেয়েটি ঘোমটা টেনে মৃদু পায়ে আমার কাছে এসে টাকা ও জমা বইটি  আমার হাতে দেয়।  আমি ঘোমটাটার ফাঁক দিয়ে দেখলাম তার মুখ। এ যে সেই  মেয়ে যাকে আমি কংসাবতীর জলে স্নানরত দেখেছিলাম। জমা বইতে নাম দেখলাম -- মোছাঃ জরিনা খাতুন, স্বামী  -- সোলাইমান মিয়া, সাকিন -- নয়াগাঁও। মেয়েটি আমার দিকে একবারও তাকাল না। খুব সলজ্জ ভঙ্গিতে টাকা জমা দিয়ে চলে গেল। 

সেদিনের মতো কাজ শেষ করে  চলে আসি। ফিরে আসছিলাম কংসাবতীর তীর ধরে। নদীর জলগুলো কেমন স্থির হয়ে আছে।  বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেতের প্রান্তরের দিকে তাকালাম -- ফুলগুলো দুপুরের  রোদে ম্রিয়মাণ হয়ে আছে। বটবৃক্ষের তলে গিয়ে দেখি -- একটি মধ্যবয়সী গারো গায়েন বসে গান গাইছে বাঁশের দোতারা বাজিয়ে। আমি তার গান শুনি। কী অপূর্ব গাইছিল।  ওর গানের ভাষা আমি  বুঝিনি। কিন্তু গানের সুরটি ছিল দুঃখের। 

রুমে এসে খেয়ে একটু বিশ্রাম নেই। বিকালবেলা কংসাবতীর তীরে  গিয়ে চুপ করে বসে থাকি। নদীর নীরব তরঙ্গধ্বনি শুনি।  গারো পাহাড়ের  মাথার ওপর দিয়ে  সূর্য অস্তমিত হতে থাকে। সোনালী আভা সরিয়ে ক্রমে আকাশ ধূসর হয়ে উঠে। তারপর অন্ধকার নামে আদিম গুহার আঁধারের মতো। সেই আঁধার জগতে একটি সিক্ত বসনার রমণী মূর্তি ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল। যাকে আমি দেখে এসেছিলাম আজ কংসাবতীর তীরে। 

রাতে বিছানায় শুয়ে  ভাবছিলাম অনেক কথা। ঘুম আসছিল না চোখে। মধ্য প্রহরে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াই।  দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়কে দৈত্যের মতো লাগছিল। একবার মনে হলো -- কংসাবতীর তীরে গিয়ে ঘুরি। কিন্তু এত অন্ধকার যে,  ঐ জনমানবহীন নদীর তীরে যেতে শঙ্কা লাগছিল। বারান্দা থেকে রুমে এসে আবার শুয়ে পড়ি। তারপর কখন ঘুমিয়ে যাই জানতে পারি নাই। 

সপ্তাহে একদিন আমাকে নয়াগাঁও এ সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে যেতে হতো। বাকী কর্ম দিনগুলোতে অফিসে কাজ করতাম। নয়াগাঁও কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য সারা সপ্তাহ উন্মুখ হয়ে থাকতাম। 

একদিন নয়াগাঁও যাওয়ার জন্য বের হয়েছি। যখন বের হয়েছি তখন ঝকঝকে রোদ ছিল।  সেই একই রাস্তা, একই নদীর কূল ধরে চলেছি সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রের দিকে।  অর্ধ রাস্তা যাওয়ার পর হঠাৎ আকাশে মেঘ হয়। প্রাচীন বটবৃক্ষের নিকট যাওয়া মাত্র ঝমঝম করে বৃষ্টি নামতে থাকে। আমি বটগাছের নীচে দাঁড়াই। কিছুটা বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেলেও ভিজে যায় জামা ও মাথার চুল । বৃষ্টি ছাড়লে আমি আবার রওনা হই। ভেজা শরীর নিয়েই নয়াগাঁও পৌঁছি। 

জরিনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে আমি যাচ্ছিলাম। বাড়ির আঙিনা থেকে জরিনা আমাকে ভেজা অবস্থায় দেখে ফেলে।  একটি ছয় সাত বছরের বালক কাছে  এসে বলে -- 'আপনাকে মায়ে ডাকছে।' আমি দেখলাম -- জরিনা ঘোমটা মাথায়  দিয়ে বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছে যেতেই সে মুখ আড়াল করে বলে -- 'আপনি ভিজে গেছেন। বারান্দায় টুলের উপর বসেন।' 

আমি টুলের উপর বসি। জরিনা একটি গামছা এনে দিয়ে সেই একই রকম মাথায় ঘোমটা টেনে বলে -- 'এইটা দিয়ে মাথা মুছে নিন। আপনার  ঠান্ডা লেগে যাবে।'

মাথা মুছে এবং জামা একটু শুকিয়ে নিয়ে নুরজাহানের বাড়ি যাই। সেদিনও জরিনা মাথায় ঘোমটা দিয়ে কিস্তির টাকা আমার কাছে এসে জমা দিয়ে যায়। জরিনার এমন ঘোমটা দেওয়া দেখে নুরজাহান ওকে বলে-- 'কী লো জরী, তুই মাথায় এমন ঘোমটা দ্যাস ক্যান?  স্যারেরে দেইখা তুই কি শরম পাস? '

কাজ শেষে কাঠের চেয়ারের উপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি। দেখলাম, জরী মুখ ঘুরিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর  সলজ্জিত মুখখানি দেখতে বড়ই সাধ হয়। জরী মনে হয় -- ওর সেদিনের সেই নির্জন নদীর কূলে ঈষৎ উদোম হওয়া দেহখানি দেখেছি যে, সেই লজ্জা ঘোমটা দিয়ে আড়াল করে  ফেলতে চাইছে। কিন্তু জরী জানে না -- তার সেই অপরূপ রূপ আমার অন্তরের কোণে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে রেখেছে।
 
সেদিনও পথে আসতে আসতে চেয়ে দেখছিলাম কংসাবতীর জল। কেমন অতৃপ্ত বিষাদ বাতাস ঝাপটার বেগে আমার দেহ মনে এসে লাগল। কেমন শীতল অনুভব হলো -- জরি আমার সব না। কেউ না। কিন্তু আমি এই কদিনে অনেক কিছু ভেবে বসলাম। জরির মতো এমন একটি মেয়েকে নিয়ে এমন ভাবনা করা ঠিক নয়। জীবনের মধুকাল তো ধরতে গেলে শুরুই হয়নি। সামনে আরও কত সময় আসবে। দেখা পাবো কত কুমারী মেয়ের।  কত উদ্যোত প্রস্ফুটিত সন্ধ্যামালতী ফুল  ফুটে থাকবে পুষ্প কাননে। যা কিছু পাবো তার গন্ধবিলাস উপভোগ করব।  তখন মনে হবে আমিই জগতের সুখী মানুষ। 

বিকাল বেলা রুম থেকে  বাইরে আর বের হলাম না। শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। ঘরে আলো জ্বালাতে ইচ্ছা করল না।  অন্ধকারেই শুয়ে  থাকলাম আরও কিছু সময়।  তারপর উঠে আলো জ্বালাই। সকালের রান্না করা ভাত খেয়ে নেই।  খেয়ে বিছানায় এসে আবার শুয়ে পড়ি। আজও চোখে কোনও ঘুম নেই।  আজও দরজা খুলে বাইরে আসি। 

নিস্তব্ধ তারাভরা রাত্রি। কংসাবতীর পাড় থেকে হু-হু হাওয়া বইয়ে আসছিল। এই রকম তারাভরা অন্ধকার আকাশের তলে দাঁড়ালে কত কথা মনে আসে। জীবনের গ্লানিগুলো মনে জাগে। আবার কত পাওয়া আঁধারে হারিয়ে যেতে থাকে। আসলে জীবন বড়োই পলাতকা। পাওয়া হয় না কোনও  কিছু, যা আমি চাই। 

আর একদিন যখন নয়াগাঁও যাই, পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, আহা! আজ যদি জরী ওর ঘোমটাখানি সরিয়ে ফেলত।  তাহলে প্রাণ ভরে  দেখে নিতাম ওর মুখ , স্থির শান্তদৃষ্টিতে আমার দিকে যদি একবার চাইত। ঐ সুশ্রী মুখ যে আমি এখনো মন ভরে  দেখিনি। ঐ চোখ নিশ্চয়ই ডাগর কালো হবে। ঠোঁটের নীচে আলগা ভাঁজ আছে, হাসলে নিশ্চয়ই গালে টোল পড়ে। এর আগে ওকে যতটুকু দেখেছিলাম তা দূর থেকে। দেখতে না দেখতে সেই শুভ দৃষ্টি মিলিয়ে গিয়েছিল বিন্দুর মতো। জরীর বাড়ির কাছে গিয়ে  ওকে খুজলাম, কিন্তু আজ সে বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে নেই। 

সন্ধ্যাতারায় গিয়ে দেখলাম -- জরী দূরে দাঁড়িয়ে আছে  চুপচাপ। কারোর সাথে কথা বলছে  না।  আজও নীরবে এসে সবার আগে কিস্তির টাকা দিয়ে চলে গেল।  জরীর সাথে কথা বলার তেমন সুযোগ নেই।  আর বললেও মাথা থেকে ঘোমটা তো সে সরাবে না।  

জরী তাড়াতাড়ি করে চলে যাওয়াতে মন ভালো লাগছিল না।  সকালে আমি কোনও রান্না করে খেয়ে আসিনি। অভুক্ত ছিলাম। পেটে খুব খিদা ছিল। দ্রুত কাজ সেরে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে পড়ি। জরীর বাড়ির পাশ  দিয়ে যখন আসছিলাম, তখন দেখি -- জরী পথের উপরে একটি ছোট্ট টোপলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।  টোপলাটি আমার হাতে দিয়ে বলে -- আপনার মুখটি খুব শুকনো দেখেছিলাম। এর ভিতর কিছু খাবার আছে।  ঘরে গিয়ে খেয়ে নেবেন।'

আমি বললাম -- তুমি একটু ঘোমটা সরাও না জরী। তোমাকে একটু দেখি। 

-- না। 

-- কেন না। 

-- এই মুখ আপনাকে দেখাতে লজ্জা করে। 

জরি আরও বলছিল -- আমি যাই। আপনার সাথে একাকী দাঁড়িয়ে কথা বলছি, কেউ দেখে ফেললে আমার বদনামি হবে।  আমার স্বামী আমাকে মারধর করবে। আপনি জানেন না, সে একটা কসাই। 

ঘরে এসে টোপলাটা খুললাম। টোপলার ভিতর তেলের পিঠা, নারিকেলের কুশলি পিঠা, আর মুড়ির কয়েকটি মোয়া দেখলাম।  আমার পেটে প্রচণ্ড খিদা ছিল। আমি বেশ পরিমাণ খেয়ে নিলাম। 

এরই মধ্যে সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে আমার কাজ করা দুই মাস পূর্ণ হয়।  প্রতি সপ্তাহেই জরীর সাথে কেন্দ্রে আমার দেখা হতো।  ঘোমটা টেনে কোনও কথা না বলে কিস্তি দিয়ে  নিঃশব্দে সে চলে যেত। আমার দিকে একটুও তাকাত না। ওর বাড়ির কাছে দিয়ে আসা যাওয়ার পথে ওকে খুঁজতাম ওর আঙিনায়। ঘোমটা টেনে মাঝে মাঝে চুপচাপ  দাঁড়িয়ে থাকত অদূরে। দেখতাম ওকে দূর থেকেই।   

দুই মাস পূর্ণ হওয়ার প্রেক্ষিতে আমাকে অন্য একটি কেন্দ্রে বদলি করে। এরপর থেকে নয়াগাঁও সন্ধ্যাতারা কেন্দ্রে আমার আর যাওয়া হতো না। মনটা প্রায়ই বিষণ্ণ হয়ে থাকত।  যেখানেই যাই, কেমন যেন অবসন্ন লাগত। সন্ধ্যায় ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম কংসাবতীর তীরে। নদীর জলের দিকে তাকিয়ে বলতাম -- 'আমার সাথে তুমি একটু কথা বলো। তোমার জলে আমাকে টেনে নাও।' সেই ধূসর সন্ধ্যায় বক ও বালিহাঁসগুলো নদীর চরাচর ছেড়ে উড়ে  চলে যেত গারো পাহাড়ের দিকে। হয়ত ওখানেই ওদের বাসা।ওখানেই ওদের কুলো। 

কূলেই রাত্রি নেমে আসত।  নদীর কোনও কথাই শোনা হতো না।  আকাশ ভরা নক্ষত্রবীথি তখন জ্বলে উঠত। ফিরে আসি ঘরে। আমি কী বুঝি অত কোনো গান, কোনো সুর। জীবন মর্মরে তখন অন্য কথা বাজে -- 

'যে-পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস—আকাশ তোমার। জীবনের স্বাদ ল’য়ে জেগে আছো, তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে পারো তুমি...'।

আরও চার মাস পর ---

আমার বদলি অর্ডার আসে জেলা সদর অফিস থেকে। ইতোমধ্যে বাড়িতে আমার দাদাজানের পীড়াপীড়ি তে আমার বিবাহ ঠিক হয়ে যায়। আমার দাদা খুব অসুস্থ। মৃত্যুর আগে সে তার নাত্ বউকে দেখে যেতে চায়। 

আমি শাখা অফিসে সমস্ত খাতাপত্র ও হিসাব নিকাশ বুঝিয়ে দিই।  ব্যাবস্থাপক সাহেবকে বলি, আমার চাকুরি জীবনে প্রথম যাদেরকে নিয়ে কাজ করেছিলাম, নয়াগাঁও এর সন্ধ্যাতারার সেই  মেয়েগুলোর কাছ থেকে একটু বিদায় নিয়ে আসতে চাই। উনি আমাকে অনুমতি দিলেন এবং বললেন -- 'যান, দেখা করে আসেন নুরজাহান, নুরী, নসিরন ও জরিনাদের সাথে।'

আমি আজও গেলাম নয়াগাঁও-এ সেই প্রথম দিনের মতো কংসাবতীর তীর ধরে একাকী হেঁটে হেঁটে। যেদিন প্রথম যাই --  সেদিন ছিল শরতের রোদ্দুর।  আজ চৈত্রের দুপুর। সেদিন মাঠ ভরা ছিল সরিষা ফুলের হলুুদ প্রান্তর। আজ ধুঁ-ধূঁ  বিস্তীর্ণ খালি মাঠ। সেদিন ছিল কংসাবতীতে ভরা জল, আজ সেখানে স্বল্প পাথুরে পানি , বালি আর নুড়ি। 

পথের পাশে বৃক্ষগুলির পাতা চৌচির হয়ে ঝরে পড়ছে। ধুলো উড়ছে। পাখিদের সুমধুর গান নেই। কংসাবতীর জলে ঠোঁট চুবিয়ে জল খাচ্ছে তৃষিত কয়েকটি বক ও পানকৌড়ি। রুক্ষ বাতাস এসে লাগছিল আমার গায়ে। একসময় প্রাচীন সেই বটবৃক্ষ তলে এসে দাঁড়াই। আজ আর কোনও গায়েন নেই এখানে। একটু জিরিয়ে আবার নয়াগাঁও এর দিকে হাঁটতে থাকি। 

একসময় নয়াগাঁও-এ জরীদের বাড়ির কাছে চলে আসি। কংসাবতীর তীরে যে ঘাটে জরী সেদিন স্নান করেছিল, সেখানে এসে দাঁড়াই। আজ আর  সেখানে জরী স্নানরত নেই। কিন্তু আমার মানসপটে দেখতে পাচ্ছিলাম, সেদিনকার সেই স্বর্গীয় দৃশ্য ! একটি পল্লীবালা, যার দেহবল্লরী ছিল  এই কংসাবতী নদীর মতো উচ্ছ্বলা, স্বচ্ছ জলের ঢেউ আছরে পড়ছিল যেন শরীরের বাঁকে।  আজও কম্পিত হলাম কিছু মুহূর্তের জন্য । চোখ ফিরিয়ে আনলাম কংসাবতীর জল থেকে। 

আমি জরীর বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি।  ওর বাড়ির আঙিনায় গিয়ে দেখতে পাই ওর ছেলেটাকে। ওকে বলি -- 'তোমার মাকে একটু ডেকে নিয়ে আসো।'  ছেলেটা ওর মাকে গিয়ে বলে -- তোমার স্যার এসেছে।'

জরী ঘর থেকে বের হয়ে আসে। আজকেও সে ঘোমটা টেনে আমার কাছে এসে দাঁড়ায়।  আমি জরীকে ডাকি -- জরী। 

-- জ্বী। 

-- কেমন আছো তুমি? 

-- ভালো। 

-- জরী...

-- বলেন। 

-- আমার বদলি হয়েছে,  আগামীকালই চলে যাচ্ছি এখান থেকে। 

-- আর আসবেন না? 

-- না। 

জরী কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।  কেমন যেন স্থির, এবং নির্বাক। কথা বের হচ্ছিল না মুখ থেকে। আমি আবার ওকে ডাকি -- জরী... 

জরী কথা বলছে না। 

আমি জরীকে বললাম -- 'আমার  বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তোমাদের সবাইকে আমি  নিমন্ত্রণ করব।  তুমি যাবে না আমার বিয়েতে? '

জরী এবার মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি খুব কাছে থেকে  দেখলাম তার বিষাদস্নাত ম্লান মুখ ও চোখ। দেখলাম, ওর চোখ দুটো জলে ভরে আছে !  কংসাবতীর জলের মতো সেই জল স্বচ্ছ ও নির্মল।

পরিশিষ্ট --

আমার সেই অল্প বয়সের জীবনঅধ্যায় শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। সেই জীবনের  প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির কথা ভেবে  এখনকার জীবনেও অবসাদ নামে। হঠাৎই মন কেমন করে ওঠে। হারানো মধুময় কোনও দৃশ্য কখনোই আর দেখতে পাব না। সেই সবের জন্যে আক্ষেপও নেই।  মহাকালের বীথিপথের দিকে চোখ মেলে দেখব -- কংসাবতীর তীরে এক পল্লী রমণী  হাঁটছে ফিরছে, জলের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে আছে। দক্ষিণা শীতল হাওয়া এসে তার শরীরে লাগছে, তার মাথার চুল উড়ছে।

আমি যা পেয়েছিলাম, তা সত্য। আবার হয়ত কখনও পাবো তা, এটি আশা। পেলেও তা আবার ফুরিয়ে যাবে, এটা অমোঘ । 



২.        এক আশ্চর্য সন্ধ্যা 



একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। পরিচিত অপরিচিত অনেক মানুষই সেই অনুষ্ঠানে এসেছিল।  আগত অতিথিদের মধ্যে কেউ খাচ্ছিল। কেউ গল্পগুজব করছিল। একজন রমণীকে দেখলাম সে একাকী এককোণে চুপচাপ সোফায় বসে আছে। কারোর সাথে কথা বলছিল না। মহিলাটির বয়স  পঁয়তাল্লিশের মতো হবে। 

ওনাকে দেখে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল। দূর থেকে দেখলাম তার চোখ। মনে হলো এই চোখ আমি এর আগে অনেক দেখেছি। মুখ দেখে মনে হলো -- এই মুখের দিকে আমি বহুবার চেয়ে থেকেছি। তার কপাল, ভ্রূ, মাথার চুল, নাক, ঠোঁট, আনত চাহনি আমার বহুদিনের চেনা।

সে একটি হালকা নীল রঙের জামদানি শাড়ি পরেছিল।  গায়ে ফিকে নীল-রঙা ব্লাউজ। চুল খোঁপা করা, টিপ পরেছে বড়ো করে। ঠিক এমন সাজে একটি মেয়েকে দেখেছিলাম অনেক বছর আগে এক আশ্চর্য সন্ধ্যায় কলাকোপার কোকিল পিয়ারীর জমিদার বাড়ির দিঘির পাড়ে। সেও কপালে পরেছিল বড় করে টিপ। খোপায় ছিল চন্দ্রমল্লিকা ফুল। অনেক আগের সেই সন্ধ্যার কথা, সেই মেয়েটির কথা, সেই দিঘির পাড়ের নির্জনতার কথা, ঘাটের কথা, টলটলে জলের কথা -- আমার মনমুকুরে আজও মণিদীপার মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। 

আমি ঐ রমণীর একটু কাছে যাই। তার মুখের দিকে চেয়ে বলি -- তুমি পল্লবী না? রমণীটি আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছু মুহূর্ত স্থির চোখে, তারপর বিস্মিত হলো!  তারপর বললো -- তুমি রঞ্জন না? 

বললাম, হ্যাঁ আমি রঞ্জন। 

পল্লবী বলছিল -- সেই কত বছর পর তোমাকে দেখলাম। জানো কত বছর? 

 -- তেইশ বছর পর।

পল্লবীর সাথে কথা বলছিলাম যখন, তখন খুব  ইচ্ছে করছিল -- ওর হাতটি একটু ধরি। পরক্ষণেই মনে হলো, কী ভাবছি? পল্লবী কী আর সেই পল্লবী আছে? সে এখন আর একজনের বউ।  ঘরসংসার করে। ছেলে মেয়ে আছে। ওর কী আর মনে আছে? সেই কবে শীতের এক অস্ত বিকালে কোকিল পিয়ারীর জমিদার বাড়ির দিঘির ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম টলটলে জল। জলে পড়েছিল আকাশের লাল আবীর মাখা ছায়া।  দূর অস্তাচলে ডুবতে দেখেছিলাম সূর্য। কী মায়াময় সন্ধ্যা নেমেছিল দিঘির পাড়ে ! তারপর রাত হয়েছিল। আমার খুব শীত লাগছিল। কেন জানি কাঁপছিলাম খুব। পল্লবী ওর শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে জড়িয়ে ধরেছিল আমাকে সেদিন। 

আজ এত বছর পর ওর সাথে আমার দেখা। ওকে বললাম -- তুমি কেমন আছ? কী করো, কোথায় থাকো এখন? 

--  কেমন আছি সে কথা পরে বলি। থাকি অনেক দূর। অন্য আরেক গোলার্ধে। আমেরিকার আরিজোনার এক ছোট মরু শহরে আমার বাস। সেও দেড় যুগ হয়ে গেল। দু সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলাম। কালই চলে যাচ্ছি। এই জীবনকাল তোমাকে কত যে খুঁজেছি আমি। দেখা পাইনি তোমার। সেই যে কবে কেমন করে তুমি হারিয়ে থাকলে! 

পল্লবী একটি শ্বাস ফেলে বলছিল --  সেই তোমার দেখা পেলাম। একেবারে জীবনের ক্রান্তিকাল সময়ে। কেমন করে যেন শেষ হয়ে গেল বেলা।  জীবন যখন শুকায়ে গেল, তখন তোমার দেখা পেলাম।

পল্লবী বলছিল -- তোমার বউকে এখানে নিয়ে আসো নাই? 
-- না। 
-- কেন? 
-- নেই। 
-- নেই মানে! 
-- ও দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে সেই যৌথ জীবনের শুরুর ঊষা লগ্নেই। 
-- শুনে ব্যথিত হলাম। কী হয়েছিল ওর? 
-- সে অনেক কথা। 
-- তারপর আর কাউকে জীবনে আনো নাই? 
-- না। ইচ্ছে করে না আর! 

আমি পল্লবীকে বললাম -- তুমি কেমন আছো?  
-- ভালো নেই। 
-- কেন, কী হয়েছে? 
-- ঐ যে বললাম, জীবন শুকিয়ে গেছে। ডাক্তার একটি নির্দিষ্ট সময় পর্বের কথা  বলে দিয়েছে -- ঐ ক'দিনই নাকি বাঁচব। শেষ বারের মতো এই দেশ, এই মাটি ও প্রিয় মানুষদের দেখতে এসেছিলাম। তোমাকেও খুঁজেছি। মরে গেলে টুসন শহর থেকে দূরে কান্ট্রি সাইডে নির্জন কোনও মরু প্রান্তরে গ্রেভইয়ার্ডের বালুর নিচে শুয়ে থাকব। ওখানে দূর্বা ঘাস নেই। ব্লু বনেটও ফোটে না। কলাকোপার জমিদার বাড়ির বাগানে ফুটে থাকা চন্দ্রমল্লিকার মতো সুবাসে ভরে থাকবে না মৌন সন্ধ্যায়। মরু বাতাসে হুহু করে শুনতেও পাব না জীবনের কোনও মর্মর ধ্বনি। 

আমি পল্লবীর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল ওর  চোখ জলে ভরে উঠেছে। শুধু ঝরে পড়ছে না কেবল। চারদিকে কত মানুষ কত অতিথিজন। সুরের কত মূর্ছনা। কেঁদে ফেললে লোকে কী ভাববে? আমারও খুব কান্না পাচ্ছিল। অনেকটা জোর করে জল আটকিয়ে রাখলাম।  

পল্লবীর সাথে কথা বলছিলাম যখন, তখন একজন বয়স্ক রাশভারি লোক ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। এবং  গম্ভীর কণ্ঠে বলে - পল্লবী, তুমি কী করছো এখানে , কার সাথে কথা বলছো?  তুমি চলো। গাড়ি চলে এসেছে। 

লোকটি খুব তাড়া করছিল চলে যাবার। এরই ফাঁকে পল্লবী আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় লোকটির সাথে। বলে -- ইনি আমার স্বামী। আমাকেও পরিচয় করে দেয় ওনার সাথে। বলে-- ওর নাম রঞ্জন। আমরা একসময় সাংস্কৃতিক সহকর্মী ছিলাম। পল্লবী আমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে  চলে যায়। 

তারও কিছুকাল পরে জেনেছিলাম-- পল্লবীও চলে গেছে জীবন সীমানার ওপারে। কী যে দুঃখ আমার, কেন যে ঈশ্বর দুটো বেদনার ভার বয়ে বেড়াবার দায় আমাকেই দিলো।

মাঝে মাঝেই দিনের শেষ আলোর স্বপ্নলোকে কোনও  দূরাগত ঘন্টারধবনি  কানে বাজে, তখন নিরুদ্দেশ হয়ে দূর কোনও গন্তব্যে যেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কখনও আবার অতীতের মধুময় সুন্দর কোনও সন্ধ্যার সমস্ত আলো, শব্দ, গন্ধ এসে প্রবেশ করে সানন্ধকারে আমার ঘরে। তখন নিঃশ্চুপ চেয়ে থাকি অনিমিখ। 

আমার সমস্ত প্রাপ্তির মধ্যে আমি কত অসহায়, কত নিঃস্ব।


৩.        পদ্মা পাড়ের উপাখ্যান 



স্কুল ছুটির সময়ে মেয়েকে আনতে সেদিন স্কুলে গিয়েছিলাম। আমার অফিস ও নানা ব্যস্ততার কারণে সাধারণত মেয়েকে স্কুলে আনা নেওয়া করা সম্ভব হয় না।  এই কাজটি তাই মেয়ের মা-ই করে।

তখনও ছুটির ঘন্টা বাজেনি। দেখি -- মাদার্স কর্ণারে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। ওনাকে দেখে চিনতে পারলাম । ওনার সাথে কথা বলব কী বলব না, ভাবতেই তার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। সে মাদার্স কর্ণার থেকে লবিতে চলে আসে। কাছে এসে প্রথম কথা সেই বলে-- 

-- কেমন আছ তুমি? চিনতে পারছ আমাকে? 

-- খুব ভালো চিনতে পারছি। তুমি রুনু। প্রায় দশ বছর পর তোমাকে দেখলাম। কী জন্য এখানে? 

-- আমার মেয়ে এখানে পড়ে । ওকে নিতে এসেছি। 

- আমারও মেয়ে পড়ে। আমিও ওকে নিতে এসেছি। তা তোমার মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে? 

-- ক্লাস থ্রি। 

- আমার মেয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে। 

রুনু বলে -- তোমাকে তো এর আগে  কখনও দেখিনি স্কুলে। 

-- ওর মা-ই মেয়েকে আনা নেওয়া করে। তবে হঠাৎ হঠাৎ আমারও  আসা হয়, কিন্তু তোমার সাথে দেখা হয়নি।

রুনুকে দেখে একটু মনখারাপ হলো। ওর চেহেরা কেমন যেন নিরাভরণ লাগল। কোনও সাজসজ্জা নেই। সিম্পল একটি শাড়ি পরেছে। ঠোঁটে লিপস্টিক নেই। হাতের নোখে নেইলপালিশ মাখা নেই। চোখে কাজল নেই। চুল পরিপাটি করে বাঁধা নেই। খুব সাধারণ করে  চুল খোঁপা করে রেখেছে। 

আমি রুনুকে বললাম -- এই শহরেই তুমি থাকো, অথচ জানতাম না তা। দেখাও পাইনি কোথাও। তা তুমি কেমন আছ? কোথায় থাকো? 

স্কুলের ছুটির বেল বাজতে থাকে। বেলের শব্দটা খুব জোরে কর্কশ করে বাজছিল। কিছুক্ষণ চুপ থাকে রুনু। 
তারপর বলছিল -- আমি কেমন আছি সে কথা পরে বলব একদিন। কয়েকদিন পর এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি  ভেড়ামারাতে। বাকি জীবন ওখানেই থাকব। যদি ইচ্ছে হয়, একবার বাসায় এসো। বাসার ঠিকানা-- ৩৬ দলিপাড়া, উত্তরা। বাসায় এলে সব বলব।

একটি সাত আট বছরের ফুটফুটে মেয়ে দৌড়ে এসে রুনুকে জড়িয়ে ধরে। ওর কাঁধে বইয়ের ব্যাগ। রুনু মেয়েটির কাছে থেকে ব্যাগটি নিয়ে রিকশায় উঠে। যাবার বেলায় বিষাদমাখা হাসি দিয়ে বলে -- বাসায় এসো তুমি।

দশ বছর আগে -
 
রুনু পদ্মা পাড়ের মেয়ে। পদ্মার তীর ঘেঁষে একটি গ্রাম, নাম তার চাঁদগ্রাম। সেখানেই কেটেছে ওর শৈশব। কৈশোরেই বাবা মাকে হারিয়ে ফেলে। গ্রাম ছেড়ে চলে আসে মামার কাছে  থানা শহর ভেড়ামারায়। ওখানেই পড়াশোনা করে।  রুনু যখন কলেজে পড়ে, ঠিক সেইসময়  এক ছুটির দিনে আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম ভেড়ামারা। ওখানে গঙ্গা-কপোতক্ষ প্রজেক্টে আমার ভগ্নিপতি চাকুরি করত।  কয়েকদিন আমার বোনের বাসায় ছিলাম। রুনু আমার ছোট্ট একটি ভাগ্নীকে পড়াতে আসতো প্রতিদিন। সেই ছলেই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়।

আমি তখন ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্র। উচ্ছল প্রাণের এক তরুণ বয়স আমার। সুন্দর লাগে পৃথিবীর সব রূপ। নদী ভালো লাগে। বৃক্ষ ভালো লাগে। পাতা ঝরা দেখতে ভালো লাগে। রোদ্দুরে হাঁটতে ভালো লাগে। বৃষ্টির মেঘ দেখতে ভালো লাগে। গীতবিতান খুলে গান পড়তে ভালে লাগে। ভালো লাগলো এই রুনু নামের মেয়েটাকেও।  

মেয়েটা সালোয়ার কামিজ পরে, চপ্পল পায়ে হেঁটে হেঁটে আসতো। চোখ দুটোতে মায়া জড়িয়ে থাকত। কেমন স্বপ্নময়ী দৃষ্টি তার! আমার সাথে কথা বলত না। আমিও কোনও কথা বলতাম না। যেন সব কথা লুকিয়ে থাকে কণ্ঠের নীচে। কিন্তু খুব ইচ্ছে হতো ওর সাথে কথা বলতে। 

কয়েকদিন এইভাবে কথা না বলেই কেটে গেল। বলি বলি করে কোনো কথাই বলা হলো না। আমারও ওখানে থাকবার দিনগুলো শেষ হয়ে যেতে লাগলো। কী করব?  ভাবলাম, থাক। ওকে কিছুই বলব না। আমার ভালোলাগা আমার মাঝেই গোপন থাক। এখান থেকে যখন চলে যাব। তখন সব ভুলে যাব। এই জীবনকালে এইরকম কত মেয়ের দেখা পাবো, দেখতে পাবো মায়াবী চোখের কত মায়াবতীকে! এদের ভিতর থেকেই  ভালোলাগার কোনও  মেয়েকে ভালোবেসে ফেলব। কেউ না কেউ আমার জীবনে এসে যুক্ত হবে। এত দূরের পদ্মাপাড়ের এই মেয়ে আমার জীবনে কিছু  না-ই বা হলো।

ভেড়ামারা থেকে চলে আসবাব দুইদিন আগে কেন জানি কী মনে করে মেয়েটিকে ছোট্ট একটি চিরকুট দিয়েছিলাম।  তাতে লেখা ছিল --

'' হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে তোমাকে নিয়ে খুব পদ্মার জল দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি কাল বিকালে ব্রিজের কাছে পদ্মা পাড়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। এসো। "

রুনু সেদিন এসেছিল পদ্মাপাড়ে। আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম পদ্মার জল। খোলা হাওয়ায় উড়ছিল রুনুর চুল। আমরা দেখেছিলাম ছোট ছোট ঢেউ। স্রোতে ভেসে যেতে দেখলাম কত খড়কুটো। কী স্নিগ্ধ শীতল বাতাস নদীর জল ছুঁয়ে এসে লাগছিল গায়ে। কী কথা বলব আমি রুনুর সাথে? কত কথা অন্তরে বাজে। রূপকথার মতো যত কথা। ভেবে পাচ্ছিলাম না কিছুই। তবুও বলেছিলাম কম্পিত স্বরে -- 'তোমাকে আমার ভালো লাগে রুনু।'

রুনু বলেছিল -- 'তোমার এই ভালোলাগাটুকু আমার জন্য চিরকালের করে রেখে দিও। ভালোবেসো না। আমি যে বাগদত্তা। মামা আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন।' দেখলাম, রুনু আমার চোখের দিকে স্থির শান্ত তাকিয়ে আছে। তখন পদ্মার জল ছলাৎ ছলাৎ করছিল। রুনুর চোখ জলে ছলছল করছে। নদীর উপর দিয়ে বয়ে আসা বাতাস কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। ব্রিজের উপর থেকে জলের দিকে চেয়ে দেখি -- ঢেউগুলো জলের নিবিড়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। 

পদ্মা পাড়ের রুনু উপাখ্যান সেদিনের সেই অলৌকিক সূর্য অস্তকালেই শেষ হয়ে গিয়েছে। 

তারপর, এই পৃথিবীর পথে প্রান্তরে কত বনঝাড়ে কত ফুল ফুটে থাকতে দেখেছি। কত নাম না জানা ফুল।  সব ফুলের সৌরভ কী আর নেওয়া হয়? স্পর্শহীন, মায়াহীন হয়ে কত ফুল নীরবে ঝরে গেছে। আবার পথ চলতে চলতেই সেখান থেকেই রাজকুমারীর মতো সৌন্দর্যের একটি ফুল ছিড়ে এনে ফুলদানিতে রেখেছি। শোভিত হয়েছে ঘর। সুবাস ঝরিয়েছে সারা ঘরময় । প্রতিদিন সেই ফুলে জল দেই। পরিচর্যা করি। ভালই লাগে। ভালোবাসি।
দশ বছর পর সেই রুনুকে আজ দেখলাম।  মেয়েটিকে দেখে কেমন নির্জীব স্পন্দনহীন ঝরা ফুলের মতো মনে হলো। ও কী খুব দুঃখে আছে? ওর কোনও পরিস্ফুটন নেই।  জীবন থেকে একদম বিস্মৃত হয়ে যাওয়া এই মেয়েটির জন্য  কেমন যেন মায়া লাগছিল।  

রুনুর ওখানে যাব কী যাব না একটু দ্বিধা করছিলাম। 
ভাবছিলাম পুরনো কোনও মায়াকে মায়া করতে নেই। তারপরও নিজের কাছে হেরে গেলাম। ক'দিন পর এক সন্ধ্যায় চলে যাই দলিপাড়া রুনুর বাড়িতে। বাড়ির গেটে নক্ করি। একজন মধ্যেবয়সী রমণী বের হন। আমি ওনাকে বলি -- এখানে রেহেনা জোয়ার্দার রুনু নামে কোনও মেয়ে থাকে? মহিলা বললেন -- বাসা ছেড়ে দিয়ে  উনি আজ সকালেই চলে গেছেন।  তা, আপনার নাম কী? বললাম -- রঞ্জন। 

মহিলা বললেন, আপনার একটি চিঠি আছে। এই কথা বলে ঘরের  ভিতর থেকে একটি ইনভিলাপ এনে আমার হাতে  দিলেন।

পথের উপর দাঁড়িয়ে চিঠিটি পড়ছিলাম --

"রঞ্জন, 
দীর্ঘ রোগভোগের পর দেড়মাস আগে আমার স্বামী চলে গেছেন। ওকে ধরে রাখার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই শহরে নিজেকে কেমন নিরাপত্তাহীন ও একা মনে হচ্ছিল। তাই চলে গেলাম আমার ছোট্ট শহর ভেড়ামারাতে। জানি, ওখানেও ভালো লাগবে না। মন ছুটে চলে যেতে চাইবে অপার্থিব কোনও ছায়াপথ ধরে দূরে কোথাও। একটি স্কুলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াব। ওদের মাঝেই ভুলে থাকব আমার স্বামীর কথা। প্রতিদিন ঘরে সন্ধ্যায় আলো জ্বালাতে গিয়ে ওর কথা মনে করে দম বন্ধ হয়ে আসবে। 

মনটাকে ভালো করার জন্য কোনও কোনদিন হয়তো একাকী হেঁটে চলে যাব পদ্মা পাড়ে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে দেখব পদ্মার জল। পদ্মায় এত জল! কী যে ভালো লাগবে আমার! সেই জলে ছায়ার মতো দেখতে পাবো তোমার মুখ। " 
 -- রুনু।



৪.       ব্যাক বেঞ্চ



ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শুরুর প্রথম দিনেই ক্লাসে যেতে আমি দেরি করে ফেলেছিলাম। ক্লাস শুরু হয়ে গেলে সামনের দরজা দিয়ে রুমে ঢোকার নিয়ম ছিল না । তাই আমি পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে ব্যাক বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ি। ঐ ব্যাক বেঞ্চে বসতে গিয়ে দেখি আরও একটি মেয়ে বসে আছে।

ক্লাস শেষ হলে করিডোরে এসে দাঁড়াই। পাশে বসা ঐ মেয়েটি অনেকটা কাছাকাছি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। দুজনেই চুপচাপ। কোনো কথা নেই। তারপর প্রথম কথা আমিই বলেছিলাম ওকে -- তোমার নাম কী?

-- মরিয়ম।
-- কোথায় থেকে এসেছ?
-- বানরীপাড়া, বরিশাল ।

তারপর এককথা, দু’কথা। তারপর দিনকয়েকের মধ্যে এই মেয়েটিই আমার বন্ধু হয়ে গেল।

ক্লাসে আমরা ষাট জনের মতো ছেলেমেয়ে ছিলাম। তার ভিতর অর্ধেক ছিল মেয়ে। সব মেয়েদের ভিতর এই মেয়েটি ছিল সবচেয়ে নিরীহ ও সাধারণ । অন্যসব মেয়েরা ছিল তুলনামূলকভাবে আধুনিক। মরিয়ম ছিল গ্রাম থেকে আসা অতি সাধারণ একটি মেয়ে। আর এই মেয়েটি আমার বন্ধু হলো।

মেয়েটিকে ক্লাসের অন্যসব ছেলেমেয়েরা খুব একটা পাত্তা দিত না। সবাই কেমন অবজ্ঞা করত। মেয়েটি ঠিকমতো কথাও বলতে পারত না। কথায় গ্রাম্য টান চলে আসত। চালচলন ছিল সাদামাটা। কোনো রূপসজ্জা করত না। একদম নিরাভরণ ছিল। আমি পর্যবেক্ষণ করেছি সবমিলিয়ে ওর দুই তিনটে সালোয়ার কামিজ ছিল।

মেয়েটির সাথে কথা বলতে বলতে এবং ওর সাথে মিশতে মিশতে ওকে ভালো লেগে যায়। ওর ভিতর লুকিয়ে থাকা একটা অনন্য মাধুর্য রূপ ছিল। যা আমি আমার চোখে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।

মরিয়মের গায়ের রং ছিল শ্যামলা ধরণের গৌরীয়। চুল ছিল কালো। সবসময় সাধারণ খোপা করে বেঁধে রাখত। প্রায়ই ওর চুল থেকে সুগন্ধি তেলের গন্ধ পেতাম। খুব একটা দামি তেল নয়। ওর চোখদুটো ছিল টানাটানা। অন্য মেয়েরা যেখানে আইব্রাউ করত মাসকারা লাগাত। মরিয়ম তা করত না। চোখের পাতার পালকগুলো ছিল ঘন। ঠোঁট ছিল নজরকাড়া কিন্তু লিপস্টিক দিয়ে তা রাঙিয়ে রাখত না। ওর ত্বক ছিল কোমল ও মসৃণ। শরীরের ভাজ ছিল সেতারের তারের মতো টানটান। সুডৌল শরীর সৌষ্ঠব। লম্বা পা। কোথাও বাড়তি কোনো মেদ নেই । গ্রামের একটি মেয়ে যে এমন রূপশ্রী হয়, তা সাধারণভাবে বোঝা যেত না।

প্রথম দিনের মতো আমরা দুজন বেশির ভাগ সময় ব্যাক বেঞ্চেই বসতাম। ক্লাস শেষ হলে ঘুরেফিরে সেই আমরা দুজন। সেমিনার কক্ষে কিংবা লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনা করতাম, টিফিনের সময় টিফিন খাওয়া সব একসাথেই। এইরকম একসাথে চলতে চলতে আমরা দুজন সম্পর্কে জড়িয়ে যাই।

একদিনের কথা। ইউনিভার্সিটিতে ঐদিন হঠাৎ করেই একটি ছাত্র সংগঠন ধর্মঘট ডেকেছে। কোনও ক্লাস হবে না। মরিয়ম বলছিল - কী করব থেকে? বাসায় চলে যাই। 
ওকে বললাম - চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি। 
-- কোথায় যাবে? 
-- কোনও নদীর পাড়ে, কিংবা শালবনে । তোমার যেখানে যেতে মন চায়, সেখানেই চলো। 

-- অনেকদিন ধরে সন্ধ্যা নদী দেখা হয় না। খুব মনে পড়ে আমাদের ঐ নদীর কথা। জলের ধ্বনি শুনতে ইচ্ছা করছে খুব , জলের ঢেউও দেখতে ইচ্ছে করছে।  চলো, কোনও নদীর পাড়ে চলে যাই। 

ওকে বললাম -- তাহলে চলো, বুড়ীগঙ্গার তীরে।
-- আচ্ছা।

চানখার পুলের কাছে থেকে আমরা একটি রিকশায় উঠি। রিকশার হুডি ফেলে কাটাসুর আর ফরিদাবাদের সরু গলির রাস্তা পেরিয়ে চলে যাই বুড়িগঙ্গার তীরে। নদীর কূল ছিল তখন জনারণ্য। কোথাও নিরিবিলি একটুও বসার জায়গা নেই। সারা নদী জুড়ে নৌকা আর লঞ্চ। লঞ্চের ভেঁপু'র শব্দে জলের ধ্বনি আর শোনা হলো না।  আমরা ফিরে চলে আসি ওয়ারীর  বলধা গার্ডেনে।

গার্ডেনের গেট দিয়ে ঢুকে সাইকীতে চলে যাই। সাইকীতে আছে  নীল, লাল, সাদা, হলুদ, জাতের শাপলায় ভরা অনেক গুলো শাপলা হাউজ, বিরল প্রজাতির দেশী বিদেশী ক্যাকটাস, অর্কিড, এনথুরিয়াম, ভূজ্জপত্র গাছ, বিচিত্র বকুল, আমাজান লিলি ও সুরংগ সহ একটি ছায়াতর ঘর। আমরা গিয়ে ঐ ছায়াতর ঘরটিতে বসি। তখন ছিল আসন্ন দুপুর। চারদিকে থৈথৈ নীরবতা। অজানা অচেনা সব ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল! 
মরিয়ম বলছিল এত অদ্ভুত সুন্দর এই জায়গা! এত ছায়াময়!  এত ফুল চারদিকে!  এত ফুল ফুটে আছে!  আমার কী যে ভালো লাগছে! 

আমি ওকে বললাম -- তাহলে একটা অভিজ্ঞান রেখে দাও এই অপূর্ব সুন্দর  মুহূর্তটির উপর। 
-- কী অভিজ্ঞান?  বুঝিনি। 
-- বোঝো নি? 
-- না। 
-- আদর। 
-- দাও। নাও।
এই প্রথম কোনো লাল টকটকে একটি ক্যাকটাসের কাঁটায় আমরা রক্তাক্ত হলাম।

****

মরিয়ম থাকত ওর দূর সম্পর্কের এক মামার বাসায়। ঐ পরিবারের সাথে কথা ছিল যতশীঘ্র হোস্টেলে সিট পেলে মরিয়ম হোস্টেলে চলে যাবে। ও চেষ্টা করছিল হোস্টেলে সিটের জন্য। আবেদনও করে রেখেছিল। মরিয়ম হোস্টেলে সিট পেয়ে যায়৷ এবং  চলে আসে হোস্টেলে।

হোস্টেলে ওঠার পর প্রথম যেদিন মরিয়ম ক্লাসে আসে ওকে সেদিন খুব উৎফুল্ল লাগছিল। ওকে বললাম - খুব আনন্দে আছ বুঝি! 

-- হ্যাঁ, খুব ভালো লাগছে। আমার রুমমেট আমার অনেক  সিনিয়র । মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। নাম এষা। আমি ওনাকে এষা আপু বলে ডাকি। আমাকে প্রথম দিনই অনেক আপন করে নিয়েছে। আমাকে বলেছে -- তুমি খুব ভালো মেয়ে।

আমি বললাম -- তাই? 
-- হ্যাঁ।
মরিয়ম ওর দু'হাতের আঙুল দেখিয়ে বলে -- দেখ, উনি আমার নখে নেইলপালিশ লাগিয়ে  দিয়েছে।  নেইলপালিশ মাখতে মাখতে আপু বলছিল -- তোমার এত সুন্দর হাত, এত সুন্দর নোখ! আর এই নোখে কোনো নেইলপালিশ মাখা নেই!  তাই কী হয়! 

জুতা খুলে পা দেখিয়ে বলে -- এই দেখো আমার পায়ের নোখেও নেইলপালিশ দিয়ে দিয়েছে। 

আমি ওকে বললাম -- খুব ভালো। তুমি একজন চমৎকার আপু পেয়েছ! 
- জ্বী।

ক্লাস শেষে মরিয়মকে বলি -- চলো, লাইব্রেরি বারান্দায় গিয়ে একটু বসি। দুজন ফুসকা খাব। চৈত্রের বিকালের কড়ই গাছের পাতা ঝরা দেখব। তোমার রাঙানো হাতের নোখ ছুঁয়ে বলব -- 'ভালোবাসি তোমাকে, ভালোবাসি তোমাকে এই রাঙা আঙ্গুলের সৌন্দর্য মাধুর্যের মতো।'

মরিয়ম বলছিল -- আজ দেরি করতে পারব না লক্ষীটি। এষা আপু আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে। আর একদিন বসবো লাইব্রেরি চত্বরে।

আরেকদিন মরিয়মকে ক্লাসে দেখে তো অবাক হই। চুল  পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে। খোঁপা বাঁধা নেই। দামী  সালোয়ার কামিজ পরেছে। ক্লাসের অনেকেই ওকে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়। অনেককে আবার দেখলাম, বন্ধুত্ব করার জন্য ওর সাথে খাতির করছে। আমি  প্রতিদিনের মতো আজও ব্যাক বেঞ্চেই বসেছিলাম। মরিয়ম বসেছিল সামনের বেঞ্চে অন্য সহপাঠীদের সাথে। ব্যাক বেঞ্চে আমার পাশে এসে আজ আর বসলো না।

ক্লাস শেষ হলে আমি করিডোরে এসে দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করি। মরিয়ম  চলে আসে। ওকে বললাম -- তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না। একদম তিলোত্তমার মতো লাগছে। 

ও বলছিল -- 'আর বলো না। এষা আপু এইসব করেছে। সেই আমাকে চুল কেটে মাথায় শ্যাম্পু করে দিয়েছে। নতুন সালোয়ার কামিজ কিনে দিয়েছে। সে আমাকে বলেছে -- 'তুমি আমার ছোট হলেও  তুমি আমার পরমা বন্ধুও একজন।'

আমি মরিয়মকে বললাম -- তোমার এষা আপু খুব বড়োলোকের মেয়ে  তাই না? 

-- হ্যাঁ, উনি বড়োলোকের মেয়ে। চট্টগ্রামে ওনার বাবা শিপিং এর ব্যাবসা করেন। আমি সালোয়ার কামিজ নিতে চাই নি। উনি আমাকে জোর করে কিনে দিয়েছে। তাও একটি নয়। চারটি।

আমি ওকে বললাম, আজও কী তাড়াতাড়ি চলে যাবে? চলো না, কোথাও গিয়ে বসি। মরিয়ম মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। আমরা সেদিন কিছুক্ষণ বসেছিলাম ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসের উপর। প্রাণ খুলে খুব বেশি কথা বলা হলো না ওর সাথে। মনে  মনে বলছিলাম ওকে -- 'তোমার হৃদয় আজ ঘাস'।



খুব ঘনঘন  মরিয়মের বেশভূষা ও গেটআপে পরিবর্তন দেখতে পাই। একটি সাধারণ মেয়ে দিনে দিনে অসাধারণ হয়ে উঠতে থাকে। একটি নির্জন লাবণ্যময়ী মেয়ে  হয়ে ওঠে ধ্রুপদী সৌন্দর্যের অধিকারিণী একটি মেয়ে। এইরকম সৌন্দর্যের মেয়েকেও অন্যরকম রূপবতী দেখায়। আমিও ওর এই রূপকে চেয়ে চেয়ে  উপভোগ করতাম।

কিন্তু মরিয়ম আমাকে আগের মতো আর সময় দেয় না। একদিন ওকে বললাম -- একজন এষা আপুকে পেয়ে তুমি আমাকে ভুলেই যাচ্ছ। উনি বুঝি তোমাকে খুব আদর করেন? 

-- জ্বী, অনেক আদর করেন আমাকে। উনি আর একা  এক খাটে ঘুমাতে পারেন না। আমাকে ওনার কাছে গিয়ে শুইতে হয়। আমাকে জড়িয়ে ধরে  ঘুমান। আমি ওনার কাছে না শুইলে ওনার চোখে ঘুম আসে না। আমার শরীরের গন্ধে নাকি ওনার চোখে ঘুম চলে  আসে। 

আমি বললাম -- খুব ভালো। এত সুন্দর একজন আপু তুমি পেয়েছ , যে তোমাকে সারাক্ষণ আদরে সোহাগে আর ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখে।

দিন যত যেতে থাকে মরিয়মও কেমন যেন বদলে যেতে থাকে। এখন প্রায়ই সে ক্লাসে আসে না। পড়াশোনায় আগের মতো মনোযোগ  নেই। আমি ওকে বলতাম, কী হয়েছে তোমার?  কোনও কিছুই বলত না ও।  কখনও হেয়ালি করে বলতাম --' তুমি এত সুন্দরী হয়ে গেছ, এত আগুনপোড়া রূপ তোমার !  তোমার তো আনন্দে থাকার কথা। তা এত বিষাদ নিয়ে থাকো কেন?' মরিয়ম নির্বিকার থাকত।

একদিনের ঘটনা দেখে আমি বিষাদে নিমগ্ন হয়ে যাই। সেই নিমগ্নতা আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি।  মরিয়ম সেদিন গলায় ওড়না পেচিয়ে ক্লাসে এসেছিল।  আমি ওকে বলি- তোমার কী ঠাণ্ডা লেগেছে?  মরিয়ম বলে- না।
-- তবে কী হয়েছে? 
-- কিছু না। 

দুটো ক্লাস করার পর মরিয়ম বললো -- ভাল লাগছে না। হোস্টেলে চলে যাব। আমি বললাম -- চলো, হারিস মামার দোকানে বসে দুজন চা খাই। তারপর তুমি চলে যেও রুমে। 

-- আচ্ছা।  চলো।

চা খেতে গিয়ে মরিয়ম ম্যাসিভ একটি বিষম খায়। গলা থেকে সে ওড়নাটা সরিয়ে ফেলে। দেখতে পেলাম ওর গলায় জখমের চিহ্ন। আমি চমকে উঠি। কেমন যেন বুনো কামড়ের  দাগের মতো মনে হলো। কোনো কথা বলছিলাম না। মরিয়ম দ্রুত ওড়নাটা পুনরায়  গলায় পেচিয়ে নেয়।

মরিয়ম  একদিন বলছিল -- এষা আপু সম্ভবত জার্মানি চলে যাবেন এমফিল করার জন্য।  আমি বললাম,  তোমার কী এজন্য মন খারাপ? 
-- হ্যাঁ। 
-- তা কবে যাবেন উনি ? 
-- আমাদের সামার ভ্যাকেশনের ভিতরই চলে যাবেন । 

এরপর ইউনিভার্সিটি সামারের ছুটি হয়ে যায়। দুই মাস ক্লাস বন্ধ থাকবে। আমি গ্রামের বাড়ি চলে যাই। বাড়িতে যাবার আগে  মরিয়মকে বলেছিলাম -- তুমি বাড়ি যাবে না? 

-- না। এষা আপু যেতে দেবে না। 

মরিয়মই বলছিল -- চলো কোথাও যাই।  মনটা ভালো লাগছে না।  বললাম, কোথায় যাবে? 

-- তুমি যেখানে নিয়ে যাবে। সেখানেই যাব। 

আমি বললাম -- আজ আর কোথাও যাব না। 

দেখলাম -- মরিয়ম কাঁদছে।

****

ভ্যাকেশন শেষে ফিরে আসি  ইউনিভার্সিটিতে। ঢাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যায় । হোস্টেলের রুমের তালা খুলে ভিতরে ঢুকি । রুম ভর্তি গাঢ় অন্ধকার। দু'মাসের বদ্ধ রুম থেকে  কেমন যেন একটি ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এল। লাইট জ্বালাই। দরজার ফাঁক দিয়ে ডাকপিওন একটি চিঠি মেঝেতে ফেলে রেখে গেছে । খামের উপর লেখা দেখে বুঝতে পারলাম চিঠিটি লিখেছে মরিয়ম। 

চির-কল্যাণীয়েষু 
রঞ্জন,  

আমি এই দেশ ছেড়ে  সুদূর জার্মানিতে চলে যাচ্ছি। আমার পাসপোর্ট, ভিসা, অর্থ সবই এষা আপু ব্যবস্থা করেছেন।  তোমাকে আমার জীবনের অনেক কথা বলা হয়নি।  এখনও বলতে পারছি না।  শুধু এইটুকু বলছি -- আমার জীবনধারা বদলে গেছে। এষা আপু বলেছে -- আমাকে ছাড়া উনি নাকি বাঁচবেন না। তাই উনি আমাকে জার্মানিতে নিয়ে যাচ্ছে। ওখানে ওনার সাথেই থাকব। সে আমাকে একটি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করে দেবে। 

জানি না কেমন থাকব। তোমার কথা খুব মনে পড়বে। তুমি এত ভালো ছেলে ছিলে!  কী পরম সৌভাগ্য হয়েছিল আমার,  তোমাকে আমার জীবনের করে নিতে পারতাম।  বিধাতা আমাকে অমূল্য কিছু  দিয়েছিল ঠিকই , কিন্তু আমিই তা গ্রহণ করিনি।

বার্লিন শহরের পাশে নাকি নীল জলের হ্যাভেল নদী প্রবাহিত। কোনও বসন্ত বিকালে ঐ নদীর তীরে যখন একাকী  ঘুরব, তখন মনে পড়বে আমাদের সন্ধ্যা নদীর কথা। যার তীরে কেটেছিল আমার শৈশব ও তারুণ্যের স্মৃতিক্ষরিত সময়কাল। পুরনো ঢাকার বলধা গার্ডেনের মতো কোনও উদ্যান  ঐ শহরেও হয়তো দেখতে পাব। সেই  উদ্যানেও হয়তো ফুটে থাকবে অজস্র অর্কিড, আমাজন লিলি ও লাল ক্যাকটাস। মনে পড়বে  এক দুপুরের একটি ক্যাকটাসের রক্তাক্ত হওয়ার কথা! কী শিহরণই না ছিল ঐ স্বর্গীয় মুহূর্তের! 

আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল  তোমার দুটো চোখ। কী যে  মায়াময় তার চাহনি! ঐ চোখে কোনও অশ্রু ঝরা মানায় না।  তুমি কখনোই আমার জন্য কাঁদবে না।  এই জীবনে যত কান্না আছে তা আমিই কেঁদে নেব। 

তোমার জীবনকে সুন্দর রেখো।

--- মরিয়ম।

****

চিঠিটি পড়ে ঘরের আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। ভ্রমণে এত ক্লান্ত ছিলাম যে, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম  জানি না। সকালে ঘুম ভাঙে একটু দেরিতে। ভ্যাকেশনের পর আজ প্রথম ক্লাসে যাই। সেই প্রথম দিনের মতো আজকেও যেতে দেরি হয়ে গেল।  গিয়ে দেখি ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আমি পিছনের দরজা দিয়ে  ঢুকে ব্যাক বেঞ্চে গিয়ে বসি। আজ আর ঐ বেঞ্চে কেউ বসে নেই। আমি একাই বসেছিলাম ।


৫.           তেত্রিশ নম্বর 



আমার এক জুনিয়র হলমেট ছিল, নাম খোকন। ও একদিন আমাকে বলছিল -- রঞ্জন দা, একটা অনুরোধ করব আপনাকে, রাখবেন? বললাম -- কী অনুরোধ?  রাখার মতো হলে রাখব। তুমি বলতে পারো। 

-- নাহ্!  আমার একটু বলতে ভয়ই লাগছে। আপনি তো এই কাজটি করেন না! তাই বলতে দ্বিধা করছি।  

-- আরে, তুমি বলে ফেলো তো। 

ছেলেটি খুব বিনয় করে বলছিল -- আমার এক খালাম্মা আমাকে খুব করে ধরেছে, তার মেয়ের জন্য একজন বাংলার টিচার ঠিক করে দেওয়ার জন্য।  মেয়েটা ভারতের মানালীতে এক নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। পরে আর ওখানে কন্টিনিউ করেনি। ঢাকায় এনে ক্লাস নাইনে ওকে ভর্তি করা হয়। এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে।  ও বাংলায় ভীষণ কাঁচা। খালাম্মার আশা, একজন টিচার রেখে দিলে বাংলায় পাস করতে ওর কোনও অসুবিধা হবে না। 

আমি খোকনকে বললাম -- আমি তো টিচার নই। কোনদিন কখনও কাউকে পাঠদান করিনি। তাছাড়া, আমাকে টিউশনি করতে হবে, এইকথা ভাবিনিও 
আমি।

-- আমি জানি, তাইতো আপনাকে বলতে খুব ভয় লাগছিল। এই ছোট ভাইটার অনুরোধ  একটু রাখেন রঞ্জন দা। মাত্র ছয়মাস আপনাকে পড়াতে হবে৷ আমি আপনার কথা অলরেডি খালাম্মাকে বলে ফেলেছি। ওনারা খুব আশায় আছেন। আপনি রাজি হোন। আপনাকে ওনারা খুব সম্মান করবেন। 

কী আর করব!  শেষপর্যন্ত আমার সেই জুনিয়র হলমেটের অনুরোধ আমাকে রক্ষা করতে হলো। আমি ওর কাজিনকে কয়েক মাস বাংলা পড়ানোর জন্য রাজি হয়ে যাই।

আমার এই ছাত্রীটির নাম নায়না। একদিন সন্ধ্যায় হল থেকে হেঁটে হেঁটে চলে যাই এলিফ্যান্ট রোডের অ্যারোপ্লেন মার্কা মসজিদের পাশে ওদের বাসায়। মেয়েটি একদম বালিকা বয়স। চৌদ্দ পনের বছর হবে। ছিপছিপে গরণ। গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরীয়। চোখ দুটো টানা টানা। মায়াভরা চাহনি। আমি গিয়েছি ছাত্রী পড়াতে। ছাত্রীর রূপ দেখা আমার কাজ নয়। তবুও ওর মায়াবী রূপের কথা বলতে হলো।

আমি নায়নাকে বললাম -- তুমি কী বাংলায় ৩৩ নম্বর পেয়ে পাশ করতে চাও, নাকি ৪৫, অথবা ৬০ । কারণ, তুমি এই তিনটি থেকে  যেটি চাও, সেই অনুযায়ী তোমার উপর শর্ত ও বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।

নায়না বললো-- ৩৩ নম্বর।

আমি বললাম -- ঠিক আছে তাই হবে। 

-- শর্ত ও বিধিনিষেধগুলো কী? 

-- পরে আস্তে আস্তে জানতে পারবে। যেহেতু তুমি ৩৩ নম্বর চুজ করেছ, সেইক্ষেত্রে বিধিনিষেধ একটু কমই আরোপ হবে ।

নায়না বলছিল -- আপনাকে কী বলে সম্বোধন করব? রঞ্জন দা, নাকি স্যার বলে। 

-- স্যার বলে সম্বোধন করবে।

আমি নায়নাকে বললাম, কাল থেকে তোমাদের বাসায় ইংরেজি পত্রিকার পাশাপাশি বাংলা পত্রিকাও রাখবে। সাথে সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সন্ধানী ও চিত্রালীও রাখবে। এবং এগুলো পড়বে তুমি নিয়মিত। 

-- জ্বি স্যার, পড়ব।

-- আর একটি কথা। যেহেতু তুমি ৩৩ নম্বর বেছে নিয়েছ, তাই তোমাকে সিলেবাস থেকেও পড়াব এবং সিলেবাসের বাইরে থেকেও পড়াব।

জ্বি, আচ্ছা। 

আমি নায়নার বাংলা বইটি ওর হাতে দিয়ে বললাম -- মাইকেল মধুসূদন দত্তের " কপোতক্ষ নদ " কবিতাটি  পড়ো। নায়না পড়ল ঠিকই কিন্তু অনেক ভুল উচ্চারণে। আমি ওকে আবৃত্তির মতো করে কবিতাটি পড়ে শোনালাম। এবং বললাম -- এরপর এই কবিতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও কবির জীবনী পড়াব। 

তুমি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী পড়বে। এইটাই তোমার হোমটাস্ক।

আমি সপ্তাহে তিনদিন করে যেয়ে নায়নাকে পাঠদান করতে থাকি। মোটামুটি ভালোই অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু ওর মধ্যে কিছু মানসিক সমস্যা দেখছিলাম। নায়নার এই মানসিক সমস্যাটি আমার
জুনিয়র বন্ধু খোকন আমাকে বলেছিল না।

মেয়েটি মানালীতে পড়তে গিয়ে একটি দূর্ঘটনার শিকার হয়েছিল। রাজকুমার নামে এক রাজস্থানী তরুণের সাথে ওর গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। এক তুষারপড়া দিনে ওরা দুজনেই তুষারের উপর স্কিইং করেছিল।  ছেলেটা হঠাৎ পা ফসকে আচমকা দ্রুতবেগে গিরিখাতে পড়ে যায়। ওকে আর খাত থেকে উদ্ধার করতে পারে নাই কর্তৃপক্ষ। অতল গিরিখাতেই ছেলেটির গিরিসমাধি হয়। সেই থেকে নায়না মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তারপর ওকে আর মানালীতে রাখা সম্ভব হয় নাই। ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়।

মেয়েটির মা একদিন অবশ্য আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলছিল -- তুমি ওকে পড়াবার পর থেকে ওর পাগলামি অনেক কমে গেছে। পড়াশোনায়ও বেশ মনোযোগী হয়েছে। আমাকে তুমি কী যে উপকার করেছ বাবা! 

একদিন নায়নাকে বললাম -- তুমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'হৈমন্তী' গল্পটি পড়বে কমপক্ষে তিনবার। যদিও তোমার সিলেবাসে এটি নেই। সিলেবাসে আছে 'দেনাপাওনা'। এই হৈমন্তী গল্পটি পড়ে তোমার যে অংশটি বেশি ভালো লাগবে, তা আমাকে জানাবে।  ওর হাতে একটি পিনআপ কাগজ দিয়ে বললাম -- এখানে গল্পটির আমারও ভালোলাগার কথাগুলো লেখা আছে। এখন খুলে দেখবে না। পরে দেখবে।  দেখি তোমার সাথে আমার ভালোলাগা মিলে যায় কী না?

দুইদিন পর গিয়ে দেখলাম -- হৈমন্তী গল্পের ওর ভালোলাগার কথাগুলো একটি কাগজে  লিখে রেখেছে।  আমার পিনআপ করা কাগজটাও খুললাম-- দুজনেরই একই কথা লেখা।  "... যাহা দিলাম তাহা উজাড় করিয়াই দিলাম । এখন ফিরিয়া তাকাইতে গেলে দুঃখ পাইতে হইবে । অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই...।"

তখন একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে। আমি একদিন নায়নাকে পড়াতে গিয়ে বললাম -- ২০ ও ২১ তারিখ আসব না। আর্ট কলেজের ছাত্র- ছাত্রীদের সাথে ২০ তারিখে আমি রাজপথে আলপনা আঁকবো। আর একুশ তারিখ সকালবেলা যাব -- প্রভাতফেরিতে। গাইব নগ্নপায়ে গান -- "আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি?''

নায়না বায়না ধরেছিল সেও আমার সাথে রাজপথে আলপনা আঁকবে। ওর মাকে বলে গিয়েওছিল আলপনা আঁকতে। সারারাত রাজপথে আলপনা এঁকে সকালবেলা প্রভাতফেরি করে সেদিন নায়না বাড়ি ফিরে গিয়েছিল।

একসময় নায়নার পরীক্ষার তারিখ খুব কাছাকাছি চলে আসে। এই কয়মাসে নায়নাকে বাংলা বিষয়ে বেশ প্রস্তুতি করে তুলি। ওর ভিতর আমি একটি আস্থাও দেখলাম। আর এক-দুই দিন পড়িয়েই শেষ করে দেবো ভাবছি। 

সেদিন ছিল ওকে পড়ানোর শেষ দিন। নায়নাকে বললাম -- কাল থেকে আর আসব না। তুমি ভালোভাবে পরীক্ষা দিও। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে তোমাকে অভিনন্দন জানাতে আর একদিন হয়তো  আসব। নায়না মুখ নীচু করে আছে।  আমার কাছে মনে হলো, ওর চোখ ছলছল করছে।  হ্যাঁ, মানুষের জন্য মানুষের মায়া হয়, আমার প্রতি ওরও হয়ত মায়া হয়েছিল। যেমন ওর জন্য আমারও খারাপ লাগছে। কটা মাস কী এক দায়িত্ববোধ য়েন ছিল আমার । সেই  দায়িত্ব পালন শেষ হয়ে গেল।

নায়না বলছিল -- 'স্যার, একটা অনুরোধ করব, রাখবেন?' বললাম, বলো রাখব।'

আপনি কোনওদিন কোনও পর্বতমালায় যাবেন না। ওখানে কোনও তুষারপড়া দিনে তুষারের উপর দিয়ে হাঁটবেন না।  বলেন -- রাজি আপনি! 

বললাম -- আচ্ছা যাব না। রাজি।

-- 'স্যার, আমার এমন লাগছে কেন? কেমন যেন কান্না পাচ্ছে। ' দেখলাম -- নায়না কাঁদছে। 

আমি নায়নাকে বললাম-- সামনে আমাদের ইউনিভার্সিটি সামারের বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি চলে যাব। তিন মাস ওখানে থাকব। ভালোই লাগবে ওখানে। নিঝুম সন্ধ্যায় যমুনার কূল ধরে হাঁটব। আকাশ জুড়ে দেখব ঘন নীল!  অপূর্ব শীতল বাতাস জল ছুয়ে এসে লাগবে আমার গায়ে। 

আমি নায়নার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। তখন সন্ধ্যা রাত্রি। এলিফ্যান্ট রোডের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি নীলক্ষেত মোড়ে। একটি টং চার দোকানে বসে চা খাই। একটা সিগারেট ধরাই। সিগারেট টানতে টানতে চলে আসি ভিসি স্যারের বাসার সামনে। 

সেখানে রাস্তার উপর একধরনের অদ্ভুত আলো আঁধার বিরাজ করছিল। রেইনট্রির বড়ো বড়ো ডাল আর পাতার ফাঁক দিয়ে অসম্ভব সুন্দর চাঁদের আলো বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ছিল রাস্তার উপর। তার কিছু আলো এসে লাগছিল আমার শরীরে। কী যে ভালো লাগছিল তখন!  মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার এই কয়টি পংক্তি --

"...সবাই মানুষ থাকবে না।
কেউ কেউ ধুলো হবে, কেউ কেউ কাঁকর ও বালি
খোলামকুচির জোড়াতালি।
কেউ ঘাস, অযত্নের অপ্রীতির অমনোযোগের
বংশানুক্রমিক দুর্বাদল।
আঁধারে প্রদীপ কেউ নিরিবিলি একাকী উজ্জল।
সন্ধ্যায় কুসুমগন্ধ,
কেউ বা সন্ধ্যার শঙ্খনাদ।
অনেকেই বর্ণমালা
অল্প কেউ প্রবল সংবাদ... ।"

বাড়ি থেকে তিনমাস পর ফিরে আসি। ততদিনে নায়নার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। আমি খোকনকে জিজ্ঞাসা করি -- নায়নার রেজাল্ট কী? খোকন বললো -- প্রথম বিভাগ পেয়েছে। বাংলায় ওর নম্বর ৬০+।  একবার ভাবলাম -- একটি ফুলের তোড়া নিয়ে নায়নাকে একদিন অভিনন্দন জানিয়ে আসব। কিন্তু যাওয়া আর হয়নাই। মানুষের কিছু আবেগ ও মায়া নিষ্ঠুরতায় আটকে রাখতে হয়। প্রকাশিত করতে হয়না। 

মেয়েটা হয়তো অপেক্ষা করেছে অনেক বিকেল। ললাটগামী হয়েছে অশ্রুবিন্দু। মানুষের এমন কত চোখের জল অগোচরে কালের কপোল তলে ঝরে পড়ে যায়, কে তা দেখে! 



৬.        মহাপ্রস্থানের পথে



একদিন সকালবেলা বাড়ির সদর দরজায় কেউ একজন নক করছিল। আমি নিজেই যেয়ে দরজা খুলে দেই। লোকটাকে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে চিনেছি। তিনি ছিলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একজন সিনিয়র হলমেট।

ওনার নাম আবদুল গাফফার। বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলায়। উনি আমার তিন বছরের সিনিয়র ছিলেন।পড়তেন রাষ্ট্র বিজ্ঞানে। আমার রুম থেকে চার রুম পরেই ছিল ওনার রুম। কোরিডোর দিয়ে হাঁটার সময় তাকে প্রথম দেখি। দেখার মাঝেই কথা হয় ও পরে ঘনিষ্ঠতা হয়।  

উনি আমার সিনিয়র হলেও ওনার সাথে আমার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল।  তবে ওনাকে বেশিদিন হলে পাইনি। মাস ছয়েক পরে উনি মাস্টার্স সমাপ্ত করে হল ছেড়ে চলে যান। 

প্রায় ত্রিশ বছর পর ওনাকে আজ দেখলাম। মুখ ভর্তি দাড়ি।  চুলগুলো উসকোখুসকো, মোটেই পরিপাটি নয়। অর্ধেক চুল পেকে গেছে। কেমন যেন পাগল দার্শনিক টাইপের লাগছে। অনেক বছর পর  হঠাৎ আজ ওনাকে এইরূপ দেখে একটু বিস্মিতই হলাম। বললাম - গাফফার ভাই আপনি কেমন আছেন? আমার বাসা চিনলেন কীভাবে?

-- অনেক আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে , অনেক পথ ঘুরে,  চেনা অচেনা  কত মানুষকে জিজ্ঞাসা করে তোমার খোঁজ আমি  পেয়েছি। যখন জানতে পারলাম তুমি এখানে এই শহরে থাকো, তখনই চলে এলাম তোমার কাছে। 

-- খুব খুশি হলাম গাফফার ভাই। তা ভাবী কেমন আছেন? 

-- 'সে হয়তো খুব ভালো আছে। যেখানে সে চলে গেছে সেখানে তার ভালো থাকারই কথা।' উনি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন -- 'তোমার ভাবি পরপারে চলে গেছে। এই তো মাসতিনেক হয়ে গেল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই গাফফার ভাই তারই এ্ক সহপাঠিনীকে ভালোবাসতো। দেখেও ছিলাম তাকে সেই সময়ে। মেয়েটি একজন ভালো এ্যাথলেট ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হার্ডেল রেসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। একধরনের অদ্ভুত সৌন্দর্য ছিল তার ধ্রুপদী দেহ জুড়ে। একবার হলে এসেছিল সে। গাফফার ভাইয়ের রুমে আমাকে কয়েকটি তাসের জাদু শিখেয়েছিলেন তিনি । কী অমায়িক স্নেহশীলা মেয়ে ছিল সে। এখনও আমার ভিতর তার সেই ব্যবহার ও তার রূপ সৌন্দর্য ধারণ করে রেখেছি। তার মৃত্যুর কথা শুনে আমারও মনটা খারাপ হয়ে গেল। 

আমি গাফফার ভাইকে বললাম,  এ কী দুঃখের কথা শোনালেন গাফফার ভাই। আপনি এমন হয়ে গেছেন কেন? এত ভেঙে পড়েছেন যে! 

দেখলাম, গাফফার ভাইয়ের চোখ ছলছল করছে। আমি বললাম, কী হয়েছিল ভাবীর? সে বললো -- হার্টে সমস্যা ছিল। বাইপাস অপারেশনও করা হয়েছিল। অপারেশনের পর আট বছর তেমন সমস্যা হয়নি। সর্বশেষ আবার এ্যাটাক করে। হাসপাতালে ভর্তিও করেছিলাম। পঁচিশ দিন আইসিইউ তে ছিল। এক পর্যায়ে কোমায় চলে যায়।

বললাম, তারপর? 

-- সেদিন আমি হাসপাতালে ছিলাম না। কোমা থাকাকালীন অবস্থায় হঠাৎ সে নাকি চোখ মেলে তাকিয়েছিল। কর্তব্যরত ডাক্তারকে ইশারায়  বলে মুখের মাস্ক সরিয়ে ফেলতে বলেছিল। ডাক্তার প্রথমে রাজি হয়নি। ও নাকি করুণভাবে অনুনয় করছিল বারবার। ডাক্তার মাস্ক খুলে ফেলে। সে কথা বলছিল বিড়বিড় করে -- সব কথা ছিল অস্পষ্ট। পাশে থেকে এক নার্স তার ঐ কথাগুলি রেকর্ড করেছিল।  এক মিনিট তেত্রিশ সেকেণ্ডের একটি ভয়েস রেকর্ড আমার কাছে আছে। কিন্তু তার বলে যাওয়া কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

বললাম, তারপর ? 

-- ঐ কথাগুলো বলেই সে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল চিরতরে। তার আত্মা চলে যায় এক অপার্থিব জগতে। আইসিইউতে কোনও আপন কেউ ছিল না। আমিও ছিলাম না। ওর প্রাণ স্পন্দন থাকা তপ্ত কপালে আমি আমার হাতের স্পর্শ রাখতে পারিনি। দেখতে পারিনি বিদায়কালীন সময়ে ওর ঐ চেয়ে থাকা চোখ, চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু। কী বলতে চেয়েছিল সে, কী কথা? কিছুই শোনা হয়নি।

গাফফার ভাই একটি সিগারেট ধরালেন। আমি স্তব্ধবাক হয়ে ওনার দিকে চেয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর উনি বললেন -- জানো রঞ্জন, আমার রাত কাটতে চায় না, আমার দিন ফুরায় না। কোথাও একদণ্ড ভালো লাগে না। উদাস হয়ে এমনই ঘুরি পথে পথে। নদীর কূলে  যেয়ে বসে থাকি। কখন বিকাল হয়, কখন সন্ধ্যা নামে, কোথায় কখন পাতা ঝরে পড়ে যায়। কোথায় কে গায় আনন্দ সঙ্গীত। কিছুই শোনা হয় না। সিগারেট খেতে ভালো লাগে। সিগারেট  পুড়তে পুড়তে ছাই হয়ে যায়। 

তুমি হয়তো ভাবছ, আমি পাগল হয়ে গেছি। আসলে আমি পাগল হই নাই। তোমার ভাবী ত্রিশটি বছর আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে ছিল। আমার আত্মার সাথে, আমার দেহের রক্তকণিকার সাথে, আমার সুখ দুঃখ বেদনার সাথে মিশেছিল। আমরা কখনোই বিচ্ছিন্ন হই নাই একদিনের জন্য।

আমি গাফফার ভাইকে বলি -- আপনার বাড়িতে আর কেউ নেই? আপনার ছেলেমেয়ে কিংবা আপন কোনও জন?

-- আমরা নিঃসন্তান ছিলাম। আমার মা অনেক বছর  আমাদের সাথেই ছিলেন। সেও নেই। কয়েক বছর আগে তিনি গত হয়েছেন। 

-- আপনি এখন কোথায় থাকেন? 

-- পলাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাকুরি পেয়েছিলাম। প্রতিষ্ঠানটি পলাশে অবস্থিত। ওখানে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে সামান্য জায়গা কিনে বাড়িও করেছি। ওখানেই থাকি। শীতলক্ষ্যার পাড়ে কত স্মৃতি আছে তোমার ভাবীকে নিয়ে। কত চাঁদের রাত্রিতে আমরা নদীর তীর ধরে হেঁটে বেড়িয়েছি। কত আকুল করা সন্ধ্যা নেমেছে নদীর জলের কলধ্বনিতে। 

গাফফার ভাই আরও একটা সিগারেট ধরালেন।  কিছু সময় চুপ থেকে আমাকে ডাকলেন -  রঞ্জন। 

-- জ্বী। 

-- তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজে তোমার কাছে যে জন্য এসেছি তাহলো -- তুমি তো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলে। ভাষাতত্ব, ধ্বনিতত্ব পড়েছ। আমি তোমাকে তোমার ভাবীর মৃত্যুকালীন সময়ের কথাগুলোর 'ভয়েস রেকর্ড'' দেবো। তুমি সেই রেকর্ড শুনে তার কথাগুলো উদ্ধার করে আমাকে লিখে দেখাবে। তুমি রেকর্ডটা শুনলে বুঝতে পারবে, কিছু কিছু শব্দ অস্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু অর্থবহ কোনও বাক্য বোঝা যায় না।  তুমি বার বার বাজিয়ে সেই কথাগুলো উদ্ধার করবে।  কী পারবে না?

আমি গাফফার ভাইকে বললাম -- আপনি রেকর্ডটি আমাকে ফরোয়ার্ড করে দিয়ে যান। আমার অভিজ্ঞ একজন বন্ধু আছে। সে একজন ভাষা ও ধ্বনিতত্ববিদ। সে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক। আমি ওকে নিয়ে চেষ্টা করব ভাবীর কথাগুলো উদ্ধার করতে। 
আমি আমার সর্বমেধা দিয়ে চেষ্টা করব।

গাফফার ভাই আশ্বস্ত হলেন। এবং বললেন, তবে রেখে দাও। তুমি আমাকে অগ্রগতি জানাবে। আমি চলে আসব তোমার কাছে। 

গাফফার ভাই সেদিনের মতো চলে গেলেন।

আমার সেই ভাষাতত্ত্ববিদ বন্ধুটিকে একদিন বাড়িতে  ডেকে নিয়ে আসি। আমরা দুজন মিলে  বারবার ভয়েস রেকর্ডটি বাজিয়ে শুনি। প্রথম দিকে কিছু কথা রেকর্ডকৃত ছিল না।  হয়তো নার্স পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলেন না কথাগুলো রেকর্ড করতে। রেকর্ড করা   অনেক শব্দ বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছিল। কিছু শব্দ অস্পষ্ট। অনেক শব্দ কিছুই বোঝা যায় না। আমরা শব্দ জোড়া দিয়ে দিয়ে এবং কাছাকাছি কিছু শব্দ প্রয়োগ করে অনেক ভেবেচিন্তে একটা অর্থবোধক পর্যায় দাঁড় করাই। এবং মোটামুটি শিয়র হই -- উনি হয়তো মৃত্যুর সময়ে এই কথাগুলেোই বলেছিলেন।

ভয়েস রেকর্ডের সবগুলো কথা ভাবী তার স্বামী গাফফার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। গাফফার ভাইকে খবর দেই চলে আসতে। উনি একদিন  চলে আসেন। কাগজে লেখা ভাবীর কথাগুলো তাকে পড়তে দেই --

'  আমি চোখ মেলেছি তোমাকে দেখতে। কিন্তু  তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না যে!  মহাপ্রস্থানের পথে আমি পা বাড়িয়ে। কত পথ পেরিয়ে কত দূরে চলে যাব একা। তোমাকেও একা রেখে যাচ্ছি...  আমার খুব দুশ্চিন্তা হবে -- আমাকে ছাড়া তুমি তো ভালো থাকো না। দিব্বি রইল, পাগলামি করবে না। ঠিক মতো খাবে ও ঘুমাবে....।'

'আমি যে পথ দিয়ে চলে যাচ্ছি, ঐ পথে আমার পায়ের চিহ্ন চিনে তুমি আমার কাছে চলে এসো। আমি যেখানে যাচ্ছি -- সেই দেশ আমি চিনি না। ওখানে কী শীতলক্ষ্যা নদী আছে? পলাশের আমাদের বাড়ির উঠোনের মতো ঐখানে কী উঠোন আছে? বাড়ির আঙিনার মতো আছে কী অলকানন্দার ঝাড়....?' 

ঐখানে ঐ নদীর তীরে অলকানন্দার ছায়াতলে দাঁড়িয়ে  তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করব। আমার ইহকাল কালের স্রোতে ভেসে গেল। পরকাল থাকল। তুুমি এসো পরকালেই। আমি জানি -- তুমি ঠিকই পথ চিনে আমার কাছে চলে আসতে পারবে। লক্ষ লক্ষ তারা আর জোনাকগুচ্ছ আলো দেখিয়ে দেবে তোমাকে। আর সেখানকার গন্ধবাতাস পথ চিনিয়ে তোমাকে আমার কাছে ঠিকই নিয়ে আসবে...।"



৭.         রিনি আন্টি 



বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। রেজাল্টও বের হয়নি। অনেকটা না চাইতে বৃষ্টির মতো একটি সরকারি প্রকল্পে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকুরি পেয়ে যাই। চাকুরিটা ভালো লেগেছিল এইজন্য যে, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পকাজের মূল্যায়নের জন্য সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াতে হবে। আমরা কুড়িজন গ্রাজুয়েট ছেলেমেয়ে একসাথে যোগদান করেছিলাম ঐ প্রকল্পে কাজে। একটি আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, যোগদানকৃতদের মধ্যে আমরা ছিলাম দশজন ছেলে এবং দশজন মেয়ে। 

সম্ভবত অফিসের তৃতীয় দিন হবে। অফিসে গিয়ে দেখি- একজন স্মার্ট ও সফিসটিকেটেড মেয়ে হালকা ঘিয়ে রঙের একটি টাংগাইলের শাড়ি পরে চুপচাপ বসে আছে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, মাথার চুল বয়কাট করা। সিঁথি করা নেই। কিন্তু সিঁথির চুলের কাছে সিঁদুর লাগানো। হাতে শাখাপলা পরা। বয়স আমার চেয়ে দুতিন বছরের বড়ো হবে। লাবণ্যভরা মুখশ্রী তার। এক ধরণের কোমল সৌন্দর্য সারা মুখোয়বে ছড়িয়ে আছে। কেমন দেবী দেবী লাগছিল মেয়েটিকে।

সবার সাথে ওর পরিচয় হলো। ঐ মেয়েটি যখন ওর নাম পরিচয় বলছিল -- তখন জানলাম, মেয়েটির নাম আয়েশা নূর।

একটু বিস্মিতই হলাম। মেয়েটির মুসলিম নাম। অথচ হাতে তার শাখা পলা পরা, সিঁথিতে সিঁদুর। আমার মতো সবাই অবাক হলো ব্যাপারটি দেখে। কিন্তু তৎক্ষনাৎ কেউ কিছু বললো না। ভাবলাম, সবকিছুই পরে জানা যাবে।

আমাদের নতুন সহকর্মীদের ভিতর প্রথম থেকেই একটি 'তুমি' সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যেহেতু আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ  থেকে সদ্য পাশ করা তরুণ তরুণী, তাই হয়তো এমনটি হয়ে উঠেছিল। সহকর্মী নয়, আমরা সবাই যেন বন্ধু বান্ধবীর মতো। শিক্ষা সফরের ন্যায় ছোট ছোট গ্রুপে অফিসিয়াল ট্যুরে সারা বাংলাদেশে শহর গঞ্জ ঘুরে বেড়াতাম। বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরেই থাকতে হতো।

আয়েশা নূরের সাথে আমার বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মেয়েটি ছিল একদম নিরহংকারী, অমায়িক ও স্বল্পভাষী । ওর বাবা ছিল অনেক বড়ো ব্যবসায়ী। ধানমণ্ডিতে ওদের বাড়ি। এত ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে কেন যে একটি অস্থায়ী চাকরি করতে এল! এই কথাটাই ভাবতাম। 

আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম মেয়েটিকে। কেমন যেন সরল পাগলামি ছিল ওর ভিতর। সম্পূর্ণ একটা আলাদা ধরণ। পরিবারের সাথে একটু মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। আমরা পরে জেনেছিলাম -- আয়েশা নূর একটি হিন্দু ছেলেকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু বিবাহ পর্যন্ত গড়ায়নি। কী কারণে এই বিচ্ছেদ -- তাও জানা যায়নি। 

ওকে একদিন কী মনে করে বললাম -- তুমি তো আমার বয়সে বড়ো। আমার এক ছোট খালার নাম আয়েশা।  তোমাকে আমি খালা বলে ডাকব। মেয়েটি আমার প্রস্তাব লুফে নিল -- বললো, আজ থেকে তুমি আমাকে রিনি আন্টি বলে ডাকবে। উল্লেখ্য -- মেয়েটির ডাক নাম ছিল রিনি। ঐদিন থেকে আয়েশা নূর আমার রিনি আন্টি হয়ে গেল।

অফিসে এবং অফিসের বাইরে আমি ওর সহকর্মীর চেয়ে একজন ভাগ্নে হিসাবে মর্যাদা পেতে থাকলাম। প্রায় প্রতিদিন আমাকে অফিসে লাঞ্চ করাতো। সে বাসা থেকে বেশি করে খাবার নিয়ে আসতো। আমাকে বাইরে খেতে দিত না।

অফিসে হঠাৎ কখনও কখনও রিনি আন্টিকে খুব মন খারাপ দেখতাম -- বলতাম, 'তোমার কী হয়েছে আজ? মনখারাপ করে আছ যে!' সে বলতো, না, কিছুই হয়নি আমার।' মাঝে মাঝে আন্টিকে বলতে ইচ্ছে করতো -- তুমি সিঁথিতে সিঁদুর পরে থাকো কেন?  কিন্তু বলতে সাহস হতো না। কারণ, সে ছিল দারুণ জেদি ও অভিমানী মেয়ে। ওর সাথে মিশে এই ব্যাপারটি আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

একবার অফিস থেকে আমরা  কয়েকজন অফিসমেট ট্যুরে পটুয়াখালী যাচ্ছিলাম। সেই টিমে রিনি আন্টিও ছিল। একটি বড়ো লঞ্চ  সদরঘাট থেকে সন্ধ্যার পর ছেড়েছিল। আমরা সেই লঞ্চের যাত্রী ছিলাম। কেবিনে কেউ কেউ সময় কাটানোর জন্য তাস খেলছিল, কেউ কেউ গল্প করছিল। লঞ্চটি তখন চাঁদপুর পার হয়ে মেঘনা নদী অতিক্রম করছিল। রিনি আন্টি কারোর সাথে কথা বলছিল না। আমমনা হয়ে চুপচাপ বসে আছে। তার মন খারাপ দেখে আমারও মনটা ভালো লাগছিল না। 

রিনি আন্টি আমাকে ডাকে -- রঞ্জন। 

-- জ্বি। 

-- চলো, বাইরে গিয়ে রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে মেঘনার জল দেখি।

-- চলো। 

বাইরে রেলিঙের কাছে এসে দেখি -- আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ।  সারা আকাশ ছেয়ে আছে তারায় তারায়। আমরা দুজন রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে শুনছি মেঘনার ছলাৎছলাৎ জলের শব্দ। জলের উপর পড়া চাঁদের প্রতিবিম্ব ঢেউ লেগে ভেঙে যাচ্ছে। তারাদের কোনও ছায়া নেই। ওদের কোনো প্রতিবিম্বও নেই।  দূরে চাঁদপুর শহরের জ্বলে থাকা নিওন বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে।  আমি রিনি আন্টিকে ডাকি --

-- রিনি আন্টি। 

-- বলো রঞ্জন। 

-- তুমি এত মনখারাপ করে আছ কেন? 

-- এখন রাত্রি কয়টা বাজে? 

আমি আমার ঘড়ি দেখে বললাম -- রাত দেড়টা। 

রিনি আন্টি কিছুক্ষণ জলের দিকে নীরব হয়ে চেয়ে রইল। আকাশের দিকে চেয়ে দেখে নেয় কমলা রঙের বিশালাক্ষি চাঁদ। আমি চেয়ে দেখলাম আন্টির চোখ ছলছল করছে। চোখে জল ভরে আছে কী না আঁধারে বুঝতে পারলাম না। খুব ভেজা কণ্ঠে সে বলছিল --

' জানো রঞ্জন, আজ এই চন্দ্রতারার পবিত্র রাতে, মেঘনার ঐ জলের দিকে চেয়ে জল ছুঁয়ে বলছি -- প্রতিদিন এইরকম মধ্যরাত পর্যন্ত আমি জেগে থাকি, ঘুম আসে না চোখে। আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে একটি প্রদীপ জ্বালাই। তারপর অন্য আলোগুলো নিভে দেই। প্রদীপের আলোর দিকে চেয়ে থাকি। চেয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে যাই।

অন্ধকারে প্রদীপের আলো ক্রমে নিস্তরঙ্গ হয়ে ওঠে। আলোর মধ্যে কেমন যেন শূন্যতা দেখতে পাই। সেই শূন্যতার ভিতর একটা মুখ ছবির মতো ফুটে উঠে। একদম জীবন্ত মুখ, চোখের দৃষ্টিতে তার প্রাণপূর্ণ সজীবতা। সেই মুখখানার দিকে আমি মগ্ন হয়ে চেয়ে থাকি। নির্মল সেই  মুখখানি দেখতে দেখতে আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। একসময় প্রদীপের সলতে পুড়ে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। প্রদীপ নিভে যায়। পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে ওঠে। সেই নিস্তব্ধ আঁধারের ভিতর সেই মুখটি আর দেখতে পেতাম না। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি। এবং কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে যাই।

জানো রঞ্জন, প্রদীপের আলোয় যে মুখখানি আমি দেখি- সেই মুখটি আমার প্রদীপের। সেই অবয়বটি প্রদীপ দেব বর্মনের। 

-- সে এখন কোথায় আছে?  আমাকে বলবে? 

-- সে নেই। কোথায় আছে, তাও জানিনে। 

-- আমি বেশি কিছু জানতে চাইলাম না।  শুধু বললাম, তুমি সিঁথিতে সিঁদুর আর হাতে শাখাপলা পরে থাকো কেন? 

-- এমনি, তাকে স্মরণ করে পরে থাকি।

আমরা পটুয়াখালীর ট্যুর শেষ করে  ঢাকায় চলে আসি।  লঞ্চে ফিরতে ফিরতে রিনি আন্টি  বলেছিল -- 'আমার জীবনের কিছু গোপন ব্যাথার কথা এই তরঙ্গ নিনাদের জলপথে চলতে চলতে কেবল তোমাকেই বললাম। এই কথা আর কাউকে বলো না।'

-- না, বলব না।

দিনের পর দিন আমি রিনি আন্টির অবিসংবাদিত একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। আমিও তাকে সময় দেই। আমি চাইতাম, আমার এই রিনি আন্টি মনের দিক থেকে ভালো থাক। সে ভুলে যাক, একজন প্রদীপ দেব বর্মনকে। সে ভুলে যাক তার বিষণ্ণ অতীতকে। নতুন কোনও জীবনের গান সে শুনুক। 

কতো বিকেলে রিনি আন্টি আমাকে নিয়ে গেছে এই শহরের  কত জায়গায়, কত রেস্টুরেন্টে। নিয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। কত সন্ধ্যা অবধি বসে থেকেছি রবীন্দ্র সরোবরে। কড়োই গাছের কত শুকনো পাতা ঝরে পড়েছে, শুনেছি কত পাখিদের কিচিরমিচির।  কত বিমল সন্ধ্যা নেমেছে ছায়ার মতো অন্ধকারে। তখন জীবনানন্দ দাশের কবিতার এই পংক্তিগুলো ধ্বনিশ্রুত হতো কানে --

'...মানুষের হৃদয়ের পুরোনো নীরব
বেদনার গন্ধ ভাসে....
কতদিন মলিন আলোয় বসে দেখেছি 
বুঝেছি এই সব;
সময়ের হাত থেকে ছুটি পেয়ে স্বপনের গোধূলিতে নামি
ধূসর আলোয় বসে কতদিন দেখেছি বুঝেছি 
এইসব...।'

একবার  কী এক অসুখ হলো আমার। ঠাণ্ডা জ্বর ও কাশি।  কয়েকদিন অফিসে যেতে পারিনি। আবার অফিসে খবরও দিতে পারিনি। থাকতাম আমি আমার নির্জন বাড়িতে একা। তখন বিকাল হয়ে এসেছিল। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে রয়েছিলাম। হঠাৎ ঘরের মধ্যে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। আধো অন্ধকারে  চোখ মেলে দেখি -- একটি মেয়ে আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। খেয়াল করে দেখলাম, রিনি আন্টি।  বললাম -- '  তুমি হঠাৎ এখানে ? চিনলে কীভাবে বাড়ি?'

-- হ্যাঁ আমি। পথ চিনে চিনেই এলাম তোমার ঘরে। তা তোমার কী হয়েছে ? কোনও অসুখ হয়েছে? অফিসে যাও না কেন? 

-- সামান্য অসুখ হয়েছে। ভালো হয়ে যাব। দুএক দিনের মধ্যে অফিসে যাব।

-- ঘর অন্ধকার, আলো জ্বালওনি যে। 

-- এখানে নিওন বাতি এখনও আসেনি। হারিকেন জ্বালাতে হয়।

সেদিনের সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে রিনি আন্টি আমার ঘরে  আলো জ্বালালো।  তার আঙ্গুলের করস্পর্শ পড়লো আমার কপালে। ক্ষিণ মায়াকণ্ঠে বললো-- 'এইভাবে কোনকিছু না জানিয়ে কেউ কখনও থাকে? কারোর বুঝি দুশ্চিন্তা হয় না?' 

রিনি আন্টি  আমাকে খাবার খাওয়ালো। ঔষধপথ্য কী খেয়েছি, না খেয়েছি সবকিছুর খোঁজ নিলো। 

আর একবার আমরা বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে  ট্যুরে গিয়েছিলাম যশোরের ঝিকরগাছায়। আমরা ছিলাম ওখানকার একটি ডাকবাংলোয়। অফিসিয়াল এ্যাসাইনমেন্টে আমাকে আর রিনি আন্টিকে যেতে হবে গদখালি ইউনিয়নের একটি গ্রামে। 

তখন ছিল জৈষ্ঠ্যের তপ্ত দুপুর। বাংলো থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকি।  ভালোই লাগছিল পাকা রাস্তার উপর বড় বড় রেইনট্রির ছায়া। কী সুন্দর রোদ্দুর এসে পড়ছিল আমাদের গায়ে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একসময় মেঠো আলপথে নেমে পড়ি। 

হেঁটে যেতে যেতে পথের দুপাশে দেখেছিলাম গ্লাডিওলাস ফুলের প্রান্তর। রঙ বেরঙের ফুলের ফাঁকে ফাঁকে গ্রীষ্মের ফালি ফালি রোদ খেলা করছে ঝাড়ে । কখনও গ্লাডিওলাসের সৌরভের সাথে কেমন যেন মৌ মৌ সুর ধ্বনিত হচ্ছিল বাতাসে। কেমন যেন মর্মর মায়া হিল্লোলিত হচ্ছিল মেঠো পথের ধূলির উপরে। বাঁশি বেহালা আর পিয়ানো যেমন করে অ্যাকর্ডিয়নে একের পর এক মায়া জড়িয়ে যায়, তেমন করে নির্জন ফুলের প্রান্তরে ভালবাসার পাখিরা যেন হারিয়ে যাচ্ছিল।

এখানে কেউ কোথাও নেই। চারিদিকে এত ফুল, এত সৌরভ, উপর থেকে ঝুলে পড়া এমন নির্জন নীল  আকাশ, ফুলের বনে ফড়িং আর হলুদ প্রজাপতিদের এত গান। মনটা কেমন যেন উদাস উদাস লাাগছিল। আমি রিনি আন্টিকে বললাম -- দেখো, চারিদিকে চেয়ে। আমরা এসেছি ফুলের দেশে।  দেখো চেয়ে পথের দুপাাশের আচ্ছাদিত ফুলের প্রাান্তর।  চলো আমরা এই ফুলের পাশ দিয়ে ওদের সুগন্ধি নিয়ে হাঁটতে থাকি। আমরা যাব এখন কৃষ্ণপুর গ্রামে। যদি ক্লান্তি লাগে ফুলের বনে ঝাড়ের পাশে জিরিয়ে নিও। 

আমরা হাঁটছি। দেখলাম-- গ্লাডিওলাসের পর শুরু হলো হলুদ গাঁদা ফুলের প্রান্তর।  অফুরন্ত সেই ফুলের পথ!  হাঁটতে হাঁটতে রিনি আন্টি যেন আর পথ চলতে পারছিল না। সে বসে পড়লো। রিনি আন্টি বলছিল, রঞ্জন, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি তোমার কাঁধে মাথা রেখে একটু ঘুমাই? 

- আচ্ছা ঘুমাও্।

সেইদিন সেই দুপুরে ফুলের ক্ষেতের পাশে  ক্লান্তিতে আমার কাঁধে মাথা রেখে  ঘুমিয়ে গিয়েছিল রিনি আন্টি। 

ঘুমঘোর নাকি স্বপ্ন? জানিনা। দেখলাম- রিনি আন্টি নীল রঙের একটি গোলাপ ফুল হয়ে লক্ষ লক্ষ গাঁদা ফুলের মাঝে হারিয়ে গেল। তার শরীরময় গাঁদা ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু লেগে আছে। চেয়ে দেখি - আমার সর্বশরীরেও গাঁদা ফুলের অসংখ্য হলুদ জখমের দাগ। 

রিনি আন্টি একসময় জেগে ওঠে। চারদিকে ছিল তখন অসীম মৌনতা। হঠাৎ সেই মৌনতা ভঙ্গ করে আন্টি আমাকে বলে-- 'এবার ঢাকা গিয়ে চাকরিটা ছেড়ে দেবো।'

আমার অন্তরাত্মা কেঁদে উঠল। আমি বললাম -- কী হয়েছে তোমার রিনি আন্টি? 

-- কিছু না। 

-- তা চাকুরি ছেড়ে দেবে কেন? 

-- এমনই। চাকুরি করতে আর ভালো লাগছে না। 

আমি সেইদিন সেই ক্লান্ত দুপুরে রিনি আন্টিকে কিছুই বললাম না।  আমি জানি, রিনি আন্টি খুব জেদি মেয়ে। সে যা বলে তাই করে। 

যশোর ট্যুর শেষ করে আমরা ঢাকায় চলে আসি। দুইদিন বাড়িতে রেস্ট নিয়ে তৃতীয় দিনের দিন অফিসে যাই। অফিসে গিয়ে দেখি -- রিনি আন্টি আসেনি। পরের দিনও এল না। তারপরের দিনও এল না। রিনি আন্টি আর কোনদিন অফিসে আসেনি। এ্যাকনোলজমেন্ট করা একটি রেজিস্ট্রি ডাকে সে তার পদত্যাগ পত্র অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

অফিসটা কেন জানি আর ভালো লাগছিল না। কোথাও কী এক গভীর শূন্যতা আঁকড়ে ধরতো আমাকে। রিনি আন্টির সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম দেখা করতে , কিন্তু তার দেখা পাইনি।  ওনাদের বাড়িতে আগে থেকেই কাউকে নিত না সে। আমাকেও না।  হয়তো পারিবারিক কোনো অসুবিধা ছিল। 

আমি এই অফিসটা ছেড়ে দিয়ে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে চলে যাই। ইতোমধ্যে জীবনে আরও কতগুলো ওলট-পালট হয়ে গেল। বছর তিনেক পর বিয়ে করলাম। রিনি আন্টির শূন্যতায় এই পৃথিবী কেমন যেন অসহ্য হয়ে উঠেছিল। জীবনটা বিস্বাদ হয়ে থাকতো, আশা-আনন্দের কোনও অনুভবই অনুভূত হতো না। 

তারপর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেল। নতুন জীবনে আনন্দের স্বাদ পেলাম। জীবনটাকে আর আনন্দহীন করে রাখলাম না। কত বড় বড় সুখের আতিশয্যে জীবনকে ব্যাপৃত করে রাখলাম। কবেকার সেই একজন  রিনি আন্টির স্নেহ ভালোবাসা অন্তর থেকে মুছে যেতে লাগলো। একদিন যে স্নেহ মমতা পরম বলে মনে হতো, তা একদিন তুচ্ছ হয়ে গেল।  

অনেক বছর পর একটি ব্যাবসায়িক কাজ শেষ করে ফরিদপুর থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। ফেরীতে পার হচ্ছিলাম পদ্মা নদী। ফেরীটি যখন আরিচা ঘাটে ভীড়ছিল, তখন দেখি -- একটি মধ্যবয়সী রমণী পদ্মা তীরে ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় আধো ঘোমটা দেওয়া। চিনলাম তাকে। এ যে আমার সেই রিনি আন্টি।  আমি ফেরী থেকে নেমে তার কাছে যাই। ডাক দেই -- রিনি আন্টি।

রিনি আন্টি  স্থিরদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে দেখলো কতক্ষণ । তারপর বললো -- তুমি কেমন আছো রঞ্জন? 

বললাম -- ভালো আছি। তবে তুমি এখানে কেন? কোথায় যাচ্ছ তুমি ? 

 --  আমার জীবনের কত কথাই তোমাকে বলা হয়নি। তুমি হয়তো আমাকে ভুল বুঝেছিলে -- কেন সেদিন অফিস ছেড়ে, তোমাকে ছেড়ে অমন আচম্বিতে চলে এসেছিলাম। তুমি চেয়ে দেখো - আমার সিঁথিতে এখনও সিঁদুর লাগানো আছে, হাতে এখনও শাখাপলা পরে থাকি।  আজ এই পদ্মাতীরে দাঁড়িয়ে তোমাকে একটি  কঠিন সত্য বলছি -- কেন জানি আমার মনে হয়েছিল -- আমার সিঁথির সিঁদুর তুমি মুছে ফেলবে একদিন, হাতের এই শাখাপলা তুমি খুলে ছুড়ে ফেলে দেবে কোনও অতল দিঘিতে। তাই সেদিন তোমাকে ত্যাগ করে চলে এসেছিলাম।  আর... 

-- বললাম, আর কী? 

রিনি আন্টিকে বহন করা গাড়িটা তখন ফেরীতে উঠার জন্য বারবার হুইসেল দিচ্ছিল। রিনি আন্টি গিয়ে গাড়িতে বসে। গাড়িতে উঠতে উঠতে তিনি বলেছিল -- 'আমি একটি স্মরণ কাজে বের হয়েছি। মনে আছে কী তোমার.....।'

তার কথাটি ছিল অসমাপ্ত। শেষ শুনতে পারিনি।

ফেরীটি ততক্ষণে কর্কশ হুইসেল বাজিয়ে কালো ধূয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে ছেড়ে চলে যায়। আমি চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ পদ্মার আলোড়িত জলের দিকে।

পুনশ্চঃ--
যদি কোনদিন এই পৃথিবীর কোথাও  রিনি আন্টির সাথে আবার দেখা হয়, তবে তার সেই অসমাপ্ত কথা ও তার জীবনের আরও কিছু কথা জেনে এই আখ্যানের বাকিটুকু পূর্ণ করে দেবো।


৮.           বিগলিত  জোছনা 
 

একটি ব্যবসায়িক কাজ সেরে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে ঢাকা ফিরছিলাম । আখাউড়া জংশনে এসে ট্রেনটি যে থেমে রইল, ঢাকার দিকে আর আসছিল না। জানা গেল  ভৈরব ব্রিজের কাছে লাইনের রিপিয়ারিং-এর কাজ চলছে। ট্রেন ছাড়তে এক-দুই ঘণ্টা দেরি হবে।

আমি কামরা থেকে নেমে প্লাটফর্মের উপর হাঁটতে থাকি এলমেল। একসময় হেঁটে  পূর্ব দিকে শেষ মাথা পর্যন্ত চলে যাই। সেখানে একটি টং চার দোকান দেখতে পাই। কাঠের বেঞ্চটা খালি। কেউ নেই।  আমি ওখানে বসে চা খেতে থাকি। চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরাই। ঠিক তখনই একটি লোক এসে বেঞ্চে বসে। সেও চার অর্ডার দেয়। লোকটি আমাকেও চা অফার করে। আমি বলি, খেয়েছি। ধন্যবাদ।

লোকটিও সিগারেট খায়। আমাকেও সিগারেট অফার করে। আমি এবার সিগারেট নেই। যদিও একটু আগে একটি খেয়ে শেষ করেছি। সিগারেট পরপর তিন-চারটা স্টিক পর্যন্ত খাওয়া যায়। এইরকম এর আগে বহু খেয়েছি।

লোকটা  আগ বাড়িয়ে একটু বেশি কথাই বলছিল। সে বলছিল -- আপনার বাড়ি কোথায়? কী করেন?  বললাম -- ময়মনসিংহের গৌরিপুর। ব্যবসা করি। কিন্তু  আমার জানতে ইচ্ছে করেনি ওনার বাড়ি কোথায়? তবুও জেনেছিলাম -- ওনার বাড়ি  কিশোরগঞ্জের  মিঠামইন। 

আমাকে বলছিল -- আপনি বিয়ে করেছেন কোথায়?  বললাম -- ময়মনসিংহ শহরে। বলছিল -- আপনার স্ত্রীর নাম কী? আমি বিরক্ত হয়ে  বললাম --  আফসানা মরিয়ম। 

লোকটার সাথে প্রায় আধাঘন্টা এলমেল বিভিন্ন  কথা হয়। ইতোমধ্যে  ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। হয়তো লাইনের রিপিয়ারিং কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি লোকটিকে বললাম -- আপনি কোথায় নামবেন?
উনি বললেন -- ভৈরব জংশন ।

প্লাটফর্মের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উনি যে কথাটি বললেন -- আপনার সাথে হয়তো আর দেখা হবে না। আমি থাকি-- অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সিটিতে। এদেশে আর কখনও আসব না। বাবা-মার কবর জিয়ারত করতে এসেছিলাম। বাকী জীবনকাল ওখানেই ঐ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ইয়ারা নদীর পাড়ে নির্জন কুটিরে কাটিয়ে দেব। 

আমি বললাম -- আপনি তো বিয়ে করেননি এখনও। কোনও বন্ধন নেই আপনার। যখন তখন এ দেশে আসতে পারেন তো । 

-- নাহ্, আসব না আর।

যাবার বেলায় উনি আমাকে একটি অনুরোধ করলেন। বললেন -- আপনি একবার হলেও আপনার স্ত্রীকে নিয়ে কোন শীত মৌসুমে  সিলেটের জাফলং এ বেড়াতে যাবেন। ওখানে পিয়াইন নদীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা  পাথর, বালি আর নুড়ির উপর দিয়ে হাঁটবেন। দেখবেন পাথরের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জলধারা। কী অদ্ভুত রূপালী রং তার !  যদি আপনার স্ত্রী পা ফসকে পড়ে যায়, আপনি  ওনার হাতটি ধরবেন।  আর সময়টা যেন হয় পূর্ণিমা তিথি। রাতের নিরিবিলিতে দেখতে পাবেন সেখানে -- দূরে পাহাড়ের গায়ে অপরূপ চাঁদের আলোর বন্যা বইছে। শুনবেন কান পেতে -- পাহাড় আর রাত্রি কীভাবে কথা বলে। রাতের নির্জনতায় আরও শুনবেন ঝর্নার জলপতনের শব্দ! আপনি একা শুনবেন না, আপনার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে শুনবেন। বুঝতে পারবেন -- এমন একটি রাত পেলে সারা জীবনকালে আর কোনকিছু পেতে ইচ্ছে করবে না। মানুষের জীবনে কিছু আনন্দময় ক্ষণ আসে, তা ক্ষুদ্র সময়ের জন্য হলেও সারাজীবনকাল চিত্তকে সেই মধুক্ষণ রোমন্থন করে সুখ-আনন্দে ভরে রাখা যায়। 

এবার কেন জানি ভদ্রলোকটি সম্বন্ধে আরও বেশি 
কিছু জানতে ইচ্ছে করলো, কিন্তু হাতে সময় ছিল না। উনি দ্রুত হেঁটে গিয়ে ওনার কামরায় গিয়ে উঠে পড়লেন। শেষ মুহূর্তে  শুধু  ওনার নামটি জেনেছিলাম -- মনজুর হোসেন খোকন।

***  ***  ***  ***

বছরখানেক পর ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে আমাকে সিলেট যেতে হয়। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম- আমার সাথে সিলেট যেতে। ও প্রথমে রাজি হলো না। পরে আমার অনুরোধে রাজি হয়। তখন ছিল পৌষের শীতের সময়। পঞ্জিকা খুলে দেখলাম চাঁদের শুক্ল পক্ষ। ত্রয়োদশী হবে। আমরা রাতের ট্রেনে সিলেট চলে যাই। ঢাকা থেকেই হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। সিলেট শহরে একরাত থাকি। ব্যাবসায়িক কাজ সেরে পরের দিন জাফলং চলে যাই। সিলেটে আমার ব্যবসায়িক বন্ধু আগে থেকেই গোয়াইনঘাটের তামাবিলে যাবার জন্য একটি গাড়ি ও ডাকবাংলোতে থাকার জন্য রুম ব্যবস্থা করে রেখেছিল।

ভোরেই আমাদের গাড়িটি সিলেট শহর থেকে জাফলং-এর উদ্দেশ্যে বের হয়। পথের ধারে বন-বনানী ও অজস্র বৃক্ষের সমারোহ। রাস্তাটি উঁচুনিচু টিলা ও ছোট ছোট পাহাড়ি ঢালু ধরনের। খুব ভালো লাগছিল জার্নিটা। অনেক দিন পর মনে হলো আমরা দুজন নতুন করে মধুচন্দ্রিমায় ছুটেছি। গাড়ির চালক একটি গান ছেড়েছে --

গীতিময় সেইদিন চিরদিন বুঝি আর হলো না
মরমে রাঙ্গা পাখি উড়ে সে গেলো নাকি
সে কথা জানা হলো না।

আমরা দুপুরের অনেক আগেই ডাকবাংলোতে যেয়ে পৌঁছি। বাংলাটি উঁচু একটি টিলার উপর অবস্থিত। বাংলো থেকে ওপারে ভারতের  মেঘালয় রাজ্যের জৈন্তা পাহাড় দেখা যায়। পাহাড়ের গায়ে থেকে ঝর্নার জল গড়িয়ে পড়ছে। নীচে নদীটা অবশ্য দেখা যাচ্ছিল না। আমার সকল আকুতি এই নদীটি ঘিরে। কখন দেখব ওকে! কখন দেখব ওর রুপোলী জল!

ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে। আমি ওনাকে বললাম, আমরা একরাতই এখানে থাকব। এখানেই খাব। আপনি সেইভাবেই সব ব্যবস্থা করবেন।

পড়ন্ত বিকালে আমরা পিয়াইন নদীর তীরে চলে যাই। আফসানা একটি নীল রঙের টাংগাইলের তাঁতের শাড়ি পরে। ম্যাচিং করে কপালের টিপ, পাথর বসানো দুল, হাতের চুড়ি, গলার মালা, চুলের ক্লীপ, নীল জুতো, লিপস্টিক ও নোখে নেইলপালিশ পরে। কী যে অপরূপ লাগছিল ওকে। হেনকালে যদি চণ্ডীদাসের দেখা মিলতো, তবে নতুন করে তিনি পদ লিখতেন -- চলে নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরান সহিতে মোর।

এর আগে কত মধুময় ক্ষণে কত দেখেছি ওকে, কিন্তু আজকের এই পিয়াইন নদীর তীরে ওকে এমন রূপে দেখব, তা ভাবিনি কখনও। ও যেন হেম-কান্তি ও নীলকান্তিতে আচ্ছাদিত এক মনময়ূরী! খোঁপায় নীল অপরাজিতার গুচ্ছ, আধ-কপালের চন্দনবিন্দুতে আফসান মিশানো! গলায় খাসিয়া এক মেয়ের কাছে থেকে নিয়ে পরেছে বনফুলের মালা। এ যেন চিরপিপাসিত কোনও প্রকৃতি-পুরুষের সাথে তার আনন্দময় মিলন হবে আজ।

আমরা ধীরে ধীরে হেঁটে নদীর পাথুরে চরের দিকে চলে যাই। সিলিকন বালির সাথে হাজার হাজার ছোট বড় বিভিন্ন রঙিন পাথরে ভরে আছে। পাথরের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ জল!  আফসানা জুতো খুলে ব্যাগে রাখে। আমার জুতোও খুলে ফেলি। পাথর, বালি ও নুড়ির উপর দিয়ে, জলে পা ভিজিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি। হাঁটার সময় হঠাৎ পা ফসকে আফসানা পাথরের উপর পড়ে যায়। আমি খেয়াল করিনি। আমাকে অবশ্য খোকন সাহেব সতর্ক করে দিয়েছিল ওর হাতটি ধরে রাখতে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম হাতটি ধরতে ।

আফসানা পায়ে বেশ ব্যথা পায়। আমি ওর হাতটি ধরি। ও খুব মনখারাপ করে বলছিল -- ভেবেছিলাম, তুমি আমার হাত ধরে থাকবে !  তা ধরে রাখনি। তুমি এমনই উদাসীন আমার উপর! অন্য কেউ হলে ঠিকই আমার হাত ধরে রাখতো। 

আমি আফসানার হাত ধরে আস্তে আস্তে নদীর পাড়ে উঠে আসি। পিয়াইন নদীতে আর বেড়ানো হলো না। আমরা ডাকবাংলোয় ফিরে আসি।

আফসানা পায়ে বেশ ভালোই ব্যথা পেয়েছিল। বাংলোর কেয়ারটেকার আমির আলীকে দিয়ে ফার্মেসী থেকে অয়েন্টমেন্ট ও ব্যথার ঔষধ আনিয়ে নেই।  সারা বিকাল ও সন্ধ্যায় কোথাও আর যাওয়া হলো না।  বাংলোতেই সন্ধ্যা নামে। এবং রাত হয়। পিছনে সুপারি ও নারিকেল গাছে অজস্র বাদুড়ের কিচির মিচির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অদূরে খাসিয়া পুঞ্জিতে মিটমিট করে জ্বলে থাকা আলোগুলো একে একে একসময় নিভে যায়।  

আমির আলী আমাদের রাতের খাবার খাওয়ায়ে চলে যায় বাংলোর পিছনে ওর থাকার ঘরটিতে। যাবার সময় বারান্দায় দুটো চেয়ার পেতে রেখে যায় এবং বলে যায় -- আপনারা যদি রাতে এখানে বসতে চান তবে বসতে পারবেন।

সন্ধ্যার পর থেকে দুজন খাটের উপরই শুয়ে বসে ছিলাম। একসময় রাত অনেক হয়ে যায়। চোখে কারোরই ঘুম আসছিল না। আফসানা কেমন চুপচাপ ছিল ।  তেমন কোনও কথা বলছিল না।  আমি ওকে বলি-- চলো একটু বাইরে যাই। বাইরের রাত দেখি। আফসানা বললো - চলো। 

আমি আফসানাকে পাজরে জড়িয়ে নিয়ে বারান্দায় চলে যাই। দরজা খুলেই দূরে দেখতে পাই পাহাড়ের উপর প্রকাণ্ড একটি চাঁদ উঠেছে। এমন রাক্ষুসে চাঁদ এর আগে কখনও দেখিনি। কমলা রঙের জোছনায় ভেসে গেছে পাহাড়ের শরীর, গাছগাছালি ও বনবৃক্ষ।  বিগলিত জোছনার রোশনি আমাদের চোখে মুখে এসে লাগে।  হঠাৎ কেমন এক অদ্ভুত জগৎ তৈরি হলো। নিস্তব্ধতার ভিতর ঝর্নার জলপতনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। জলের শব্দ, রাতের শব্দ, আঁধারের শব্দ, জোছনার ধারা -- সব মিলে এক মায়াবী আবেশে ভরে উঠলো মন। তখন পাহাড় আর আকাশ পেরিয়ে ম্লান লালিমা মুছে গেছে আধো অন্ধকারে। সব লালিমা বিস্তৃত কালো রঙা গালিচা হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

আফসানা বারান্দার চেয়ারে বসে আছে। ও কেমন যেন আরও  চুপ হয়ে গেল। আমার মতো বিস্ময় ওর ভিতর নেই। মনে হলো এইরকম বিস্ময়কর দৃশ্য এর আগে ও দেখেছে। আমি আফসানাকে ডাকি- এই। ও বলে-- জী, বলো। 
-- এই চাঁদ এই জোছনা, দূরের ঐ পাহাড় ও নক্ষত্ররাজি   তোমার ভালো লাগছে না?
-- ভালো লাগছে। 
-- তবে এমন মনখারাপ করে আছো কেন?
-- কই না তো! 

আফসানা আমাকে বলে -- আমি কী তোমার কাঁধের উপর একটু মাথা রাখতে পারি? 

বললাম -- রাখো। 

আফসানা আমার কাঁধের উপর ওর মাথা রাখে। এবং বলে -- আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। 

বললাম -- কেন? 
আফসানা ওর একটি হাত আমার হাতটিকে শক্ত করে ধরে বলে -- এমন রাত, এমন জোছনা, এমন আলো  আঁধার যদি চিরকালের জন্য চির আঁধার হয়ে যায়! যদি তোমাকেও আমি হারিয়ে ফেলি? 

দেখি-- আফসানা কাঁদছে।  বললাম -- কেন এমন ভয় তোমার? কেন তুমি কাঁদছ? 

আফসানা বলে -- আজ এই রাতের নির্জনতার সামনে বসে -- তোমাকে কোনও মিথ্যা বলতে পারব না৷ আজ থেকে নয় বছর আগে একটি উন্মূল তরুণ এই জায়গায় এমনই পাহাড়ের পাদদেশে, এমনই চাঁদের রাতে আমাকে বলেছিল -- আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তাকে আমি প্রত্যাখান করেছিলাম। ছেলেটি আমার সহপাঠী ছিল। ভালো গান গাইতো। গানও লিখতো। সুরও দিতো। ছেলেটির নাম ছিল মনজুর হোসেন খোকন। সেইবার ময়মনসিংহ আমাদের কলেজ থেকে একদল ছাত্র ছাত্রী শিক্ষাসফরে এই জাফলং-এ এসেছিলাম। 

আমি বললাম -- তো কী হয়েছে? এমন ঘটনা অনেক মানুষের জীবনেই আছে। তোমারও যেমন আছে, আমারও আছে। এই সমস্ত ঘটনাগুলো আমাদের সংসার জীবনে খুব একটা প্রভাব ফেলে না। আমরা আমাদের প্রতিদিনের ঘর সংসার করে য়াই সুন্দর মতো। তবে মাঝে মাঝে তাদের কথা মনে পড়ে হৃদয় যে উদ্বেলিত হয়না, তা নয়। কখনও কখনও অশ্রুও ঝরে পড়ে। কিন্তু তাতে সংসারে অমঙ্গলের ছায়া পড়ে না একটুও।  

আমি আফসানাকে বলি -- তারপর  কী হয়েছিল? 

-- ছেলেটি তারপর আর কখনও কলেজে আসে নাই। সেই যে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল -- ওর আর খবর পাইনি। আমিও কোনো খবর নিইনি। ওকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ এই রাত, এই চাঁদ, দূরের ঐ পাহাড়, পাথুরের পিয়াইন নদী, ঐ ঝর্নার জল, তারার এই আকাশ দেখে ওকে খুব  মনে পড়ছিল । তুমি বিশ্বাস করো-- মনে হয়েছিল ঠিকই। তা চোখের জল ঝরিয়ে শেষ করে দিয়েছি। আর কান্না হবে না। 

আমরা পিয়াইন নদীর তীরে সেই দিনের সেই রাত, সেই চাঁদ, পাহাড়ের গায়ে সেই জোছনার সৌন্দর্যকে ব্যর্থ হতে দিইনি। আমরা ভেসেছিলাম বিগলিত জোছনায়। আমরা মিশেছিলাম শুভ্র স্বেদে ভালোবেসে অপার মাধুরিতে। 


৯.            অদিতি 

চৌদ্দ বছর ধরে অদিতির সাথে আমার কোনও যোগাযোগ ও দেখা সাক্ষাৎ নেই। চৌদ্দ বছর পর ম্যাসেঞ্জারে অদিতির এই প্রথম একটি ম্যাসেজ পেলাম। অদিতি লিখেছে -- " জানি, তুমি আমায় দেখতে আসবে না। তবুও বলছি। একবার এসে দেখে যেও আমাকে। শরীর একদম ভালো নেই। হাসপাতাল আর বাড়ি, বাড়ি আর হাসপাতাল -- এই করেই দিন চলে যাচ্ছে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে তোমাকে এই ম্যাসেজটি লিখছি। কেন জানি - তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। একবার এসে  দেখে যেও। কেবিন নং ১২, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

অদিতির সাথে আমার একটি চির অভিমান ছিল। 
কেন ওর প্রতি আমার  অভিমান তা অদিতি জানেও না। ওকে বলিও নি।  আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কোনোদিন আর অদিতির সাথে দেখা করব না। দেখা করিও নি এত বছর।

এই চৌদ্দ বছর অদিতি হয়ত আমাকে নিয়ে অনেক রকম ভুল বুঝে থেকেছে। হয়ত ভেবেছে আমি ওকে ভুলে গেছি। হয়ত ভেবেছে, বিয়ে করেছি তাই  স্ত্রী সন্তান নিয়ে দূরে চলে এসেছি। হয়ত ভেবেছে - আমি ওর একজন নিষ্ঠুর বন্ধুই কেবল ছিলাম।

আসলেই অদিতির সাথে নিষ্ঠুরতা আমি করেছি। এই অদিতিকে নিয়ে আমি একসময় ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছি। রিকশার হুডি ফেলে রোদ্রকরোজ্জ্বল আলোর নিচ দিয়ে পথ চলেছি। রেস্টুরেন্টে বসে কত খেয়েছি। নাটক পাড়ায় নাটক দেখেছি। সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখেছি। 

আমাদের প্রিয় ছিল নদী। ঢাকার আশেপাশে সবগুলো নদীর কূলে আমরা বেড়াতে গিয়েছি। নৌকায় ভেসেছি নদী বক্ষে। নদীর  উদ্ভ্রান্ত শীতল বাতাসে ওর খোলা চুল এলমেল হয়ে উড়ে এসে আমার মুখ ঢেকে দিত। ওর চুলের ফাঁক দিয়ে দেখেছি নীল আকাশ।  আমরা জলের দিগন্ত ছুঁতে নদীর স্রোতে ভেসে গিয়েছি। আমরা ডানামেলা গাংচিল হয়ে শূন্যে উড়ে বেড়িয়েছি। আমরা তুলোর মতো মেঘে মেঘে ভেসে ভেসে মিশে গেছি।

অদিতির সাথে পথ চলতে চলতে অনেক সময় পথ হারিয়ে ফেলতাম। ভুল পথে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম অনেক দূর!  চিনতাম না কোথায় আমরা এলাম। এইরকম কত পথ হারিয়েছি পথের উপরে।  প্রায়ই মনে হতো আমরা কোনও অরণ্যে চলে এসেছি। ময়ুরের পেখম পড়ে আছে বনপথে। বনবীথির ঘন ছায়াতল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আরও বন নিবিড়ে। কতরকম ফুলের গন্ধ নিতাম। কত পাতা ঝরার মর্মর শব্দ শুনতাম দুজন কান পেতে। শালবনে  বর্ষার দ্বিপ্রহরে এক ময়ূরকে পেখম মেলে নাচতে দেখেছিলাম। নাচতে নাচতে তার পেখম খুলে পড়েছিল। ময়ূরী তা দেখছিল কেবল। ময়ুরের কষ্ট দেখে ময়ুরী নিষ্ঠুর থাকতে পারেনি। তার কাছে যেয়ে কানে কানে ময়ুরী কী কথা বলেছিল, বুঝতে পারিনি তা। হয়ত মিলনের কথা বলেছিল। 

একবার একটি ছোট্ট খোলা কাঠের লঞ্চে করে পদ্মা পারি দিয়ে ভাগ্যকূল গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য - ওখানে নদীর ঘাটে হোটেলে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাব। লঞ্চটি যখন মাঝ দরিয়ায় তখন আমরা খোলা ছাদের রেলিঙের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। চারদিকে থৈথৈ জল। কোথা থেকে ঝলকে ঝলকে পুণ্যময় হাওয়া এসে অদিতির কুসুম কোমল চুল উড়িয়ে দিচ্ছিল। উড়ছিল ওর শাড়ির আঁচলও। ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ গানের সুরের মতো মনে হচ্ছিল। হঠাৎ  দেখি - অদিতি শীতে কাঁপছে। ওর কপাল ছুঁয়ে দেখি, শরীরে বেশ জ্বর।  অদিতি বলছিল -- 'আামাকে একটু জড়িয়ে ধরো।' ওর শাড়ির আঁচল দিয়েই ওকে ভালো করে ঢেকে আমার  বাহুডোরে  জড়িয়ে রাখি। জ্বরের ঘোরে অদিতি বলছিল -- পদ্মার অতল জলে আমাকে নিয়ে যাও।  আমি মরব এই জলধীতে।'

আমাদের আর ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া হয়নি সেদিন । ভাগ্যকূলে নেমে আর একটি লঞ্চে করে ঢাকায় ফিরে এসেছিলাম।

আর একটি ঘটনার কথা বলছি! ঘটনাটি স্বপ্ন না বাস্তব তা এখনও ভ্রান্ত হয়ে আছে আমার জীবনে। হয়ত স্বপ্ন দেখেছিলাম, নয়ত বাস্তবটাই স্বপ্নের মতো মনে হয়েছে।
কালিগঙ্গার তীরে একটা ভাঙা রথঘর। চৈত্রের তপ্ত দুপুরে নদীর কূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি আর অদিতি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমরা রথঘরটিতে গিয়ে বিশ্রাম নেই। বাইরে তখন তপ্ত রোদ ঝনঝন করছে। কোথাও কেউ নেই। একটা পরিত্যক্ত বেঞ্চের উপর দুজন বসি। সামনে নদী বয়ে চলেছে। জল শান্ত। চিকচিক করছে সূর্যের রশ্মি পড়ে। পাশে জঙ্গল থেকে একটি গিরগিটি জলে গিয়ে ঝাপ দিল। জল আলোড়িত হলো।  

অদিতি বলছিল -- 'আমার ঘুম পাচ্ছে।' আমি বলি --
-- এখানে কোথায় ঘুমাবে?
-- এই ভাঙা বেঞ্চের উপরে। 
-- এটা একটা ঘুমানোর জায়গা হলো? 
-- তুমি বেঞ্চের একপাশে বসো, আমি তোমার উরুতে মাথা রেখে ঘুমাব। 
-- আচ্ছা, শোও। ঘুমাও। 

অদিতি আমার উরুর উপর মাথা রেখে শুইল ঠিকই কিন্তু ঘুমাল না সে। ও বললো - ঘুম আসছে না।
-- ঘুম আসছে না কেন? 
-- তোমার শরীরের গন্ধে ঘুম আসছে না। 

অদিতি আমার একটি হাত টেনে নিয়ে ওর বুকের উপরে রাখে। আমি অদিতির চোখ দেখি।  এই চোখে এই কোন্ মায়া চাহনি! আমিও চেয়ে থাকি ! 
অদিতি বলছিল - আমার বুকের উপর কান পাতো। শোনো, কেমন নিঃশ্বাস তৈরি হচ্ছে ওখানে। কেমন সেই শব্দ! আমি সত্যি কান পাতলাম। চোখ মুখ ঠোঁট ললাট সবই স্পর্শ হলো... 

কী এক ঘোরের মুহূর্ত! যখন ঘোর কাটে তখন অদূরে চেয়ে দেখি -- কালিগঙ্গার জল থরথর করে কাঁপছে। হঠাৎ বসন্ত বাতাস হুহু করে বয়ে এসে লাগল আমাদের গায়ে। কবে কে কোন্ কবি লিখেছিল --
' অবশেষে, কোনও এক মধ্যাহ্নে 
বাঁশঝাড়ের ধারে যদি কেউ ললাট স্পর্শ করে 
ধীরে, অতি ধীরে - তাকে দিও আমার বিরহ.. '

****

কে এই অদিতি? কিছুই বললাম না ওর কথা।
এই মেয়েটি ঢাকায় এসেছিল মধুমতি নদীর তীরের সুদূর নড়াইল থেকে। অদিতি আমার সহপাঠী ছিল। সহপাঠী থেকে বন্ধু।  অদিতিই প্রথম বলেছিল কথা। কোরিডোরে দাঁড়িয়ে একদিন বলেছিল আমাকে-- 
" তোমার নামটি খুব সুন্দর! "অমিত!"  আমার নামের সাথে তোমার নাম মিল আছে।  আমি অদিতি। কিন্তু  আমি লাবণ্য নই।'

তারপর থেকে অদিতি আমার বন্ধু হলো। ভাবতাম ভালোই হলো। লাবণ্য না হলেও লাবণ্যের মতো চেহারা ওর।  চোখ দুটো উদ্বেলিত করত আমাকে। এ্যাথলেট দেহবল্লরী! সুচিত্রা সেনের মতো মায়া করে যখন  তাকাতো আমার দিকে, তখন আমার বুক কেঁপে উঠত। মনে একটা আকাঙ্খা তৈরি করে রেখেছিলাম -- আহা! এই মেয়ে আমার বউ হলে ভালোই হবে। 

কিন্তু ও যে বিবাহিত ছিল তা জানতাম না। জেনেছি পরে। ওর স্বামী ট্রেনিংএর জন্য দেশের বাইরে ছিল দীর্ঘ দিন। অদিতি থাকত হোস্টেলে। ওর একাকীত্বের সময়ে আমি ওর পাশে বন্ধু হয়ে থাকি। 

অদিতির স্বামী বিদেশ থেকে ফিরে এলে অদিতি হোস্টেল ছেড়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছে ভজহরি লেনে একটি বাসা  ভাড়া নেয়।  একদিন অদিতি বাসার ঠিকানা দিয়ে বলেছিল - 'বাসায় এসো'। যেন রবি ঠাকুরের ঐ গানের কথার মতো আহবান -- 'দুঃখসুখের দোলে এসো,  প্রাণের হিল্লোলে এসো।'

কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছিল না। যাইওনি অনেক দিন। অদিতি অনুযোগ করে প্রায়ই বলত-- 'তুমি আর এলে না। '

আমি বলেছিলাম -- ' যা হারিয়ে যায় তা আগলে রইব কত আর? '

কী মনে করে, একদিন সন্ধ্যায় হোস্টেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই অদিতির বাসায়।  দোতালায় ওরা থাকে। আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠি। বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ভিতর থেকে অদিতি ও অদিতির স্বামীর খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। একটু পর শুনতে পেলাম অদিতি গান গাইছে -- ' আমরা – মলয় বাতাসে ভেসে যাবো শুধু কুসুমের মধু করিব পান;
ঘুমোবো কেতকী সুবাস শয়নে চাঁদের কিরণে করিব স্নান।'

এই গানটি আমাকে একদিন অদিতি গেয়ে শোনায়েছিল বুড়িগঙ্গার পাড়ে। আমি আর  ভিতরে ঢুকলাম না। কেন জানি মনটা খুব খারাপ লাগছিল। সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসি। পথে নেমে পথের উপর হাটঁতে থাকি। পা  চলছিল না। কেমন যেন থেমে থেমে যাচ্ছিল!
মনের গভীরে মর্মরিত ব্যথা অনুভব করছিলাম আর ভাবছিলাম -- এই পৃথিবীতে অনেক সত্যই মিথ্যা। অনেক বস্তু আছে যা একান্তই  নিজের মনে হয় , কিন্তু সেইসব বস্তু  আমার নয়। সেই সব বস্তু যতই প্রিয় হোক না, তা নিজের অধিকারে রাখা ঠিক নয়।

পরিশিষ্ট --
তারপর আমার লেখাপড়ার জীবন শেষ হয়। বিয়ে করি। ঘরে একজন মায়াবতী আসে। আনন্দ বেদনার সংসার করতে থাকি।  অদিতির সাথে মাঝে মাঝে কথা হতো, দেখাও হতো। পরে আস্তে আস্তে ওকে দূরে সরে রাখলাম। দূর থেকে শুধু বন্ধুটাই সে রইল। আর সব ঢেকে থাকল গোপন দীর্ঘশ্বাসের নীরব শব্দহীনতার মধ্যে..।

অদিতির ম্যাসেজটি দেখে ইচ্ছে হলো - দেখে আসব ওকে। এতদিন শুধু শুধু অভিমান করে থেকেছিলাম ওর উপর। দেখা করে  ওর কাছে যেয়ে ক্ষমা চেয়ে নেব। কিন্তু পোড়ামুখী সে সুযোগ আমাকে দেয়নি।  ব্যস্ততার কারণে  হাসপাতালে যেতে ক'টা দিন  দেরি করে ফেলেছিলাম। পরে জানতে পারি -- অদিতি  পরপারে চলে গেছে।



১০.       সুতাং নদীর পাড়ে 



কিছুদিন ধরেই একটা ব্যাপার মাথার ভিতর  ঘুরপাক খাচ্ছিল। তা হলো নদী। এই জীবনে কত নদী যে দেখেছি।  কত নদীর জল ছুঁয়ে দেখেছি। নৌকায়, লঞ্চে, ইস্টিমারে কত রাত্রিদিন নদীতে ভেসেছি। আবার অনেক নদী আছে আজও  দেখা হয় নাই। নামও জানি না। আজ কয়েকদিন ধরে মন বলছিল কোথাও গিয়ে একটু নদী দেখে আসি।

কিন্তু কোথায় যাব? কোন্ নদীর কূলে গিয়ে দেখব জল? কোনোই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। 

কাউকে কিছু না বলে একদিন ভোরবেলা বিমানবন্দর স্টেশনে চলে যাই। একটি ট্রেন তখন  স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পাই। কাউন্টারে টিকিট মাস্টারকে বলি - এই ট্টেনটি কোথায় যাবে? 

-  এটি পারাবত এক্সপ্রেস। সিলেট যাবে। 
-  আমাকে এই ট্রেনের একটি টিকেট দেন।
-  কোন্ ক্লাসের টিকেট দিব? 
-  শোভন ক্লাসের। 

সিলেট পর্যন্তই টিকেট কাটলাম। ভাবলাম, ট্রেনে যেতে যেতে নদী খুঁজব। যে নদীটা দেখতে ভালো লাগবে সেই নদীর কাছাকাছি কোনও একটি  স্টেশনে নেমে পড়ব।

ট্রেন চলছে। আন্তঃনগর ট্রেন। খুব দ্রুত চলছে। জানালার কাছে সিট। খুব ভালো লাগছে। মাঠ ঘাট খালি প্রান্তর পেরিয়ে ট্রেনটি ছুটে চলেছে। মনে পড়ছিল সেই কবে ইন্টার ক্লাসে রবার্ট লুইস স্টীভেনশনের একটি কবিতা পড়েছিলাম -
'Faster than fairies, faster than witches, Bridges and houses, hedges and ditches; And charging along like troops in a battle, All through the meadows the horses and cattle...'

কিছুক্ষণ পরেই দেখি - ট্রেনটি বিকট শব্দ করে একটি ব্রিজ ক্রস করছে। নীচে চেয়ে দেখি নদী। নদীটির নাম শীতলক্ষ্যা। এই নদী এর আগে অনেক দেখেছি নারায়নগঞ্জের নিতাইগঞ্জে। নদীটা ভালো লাগলো। কিন্তু মন টানলো না তেমন। আর ট্রেনটা ছিল দ্রুতগামী। ঘোড়াশাল ফ্লাগ স্টেশনে ট্রেনটি থামল না। 

হঠাৎ মনে পড়ল আমার এক ফেসবুক বান্ধবীর কথা। কাকতালীয় ভাবে ওর নাম ছিল 'নদী'। পুরো নাম নদী ইসলাম। এখানে পলাশে ওদের বাড়ি। সে এখন আয়ারল্যান্ডে ডাবলিন শহরে থাকে। ও ইনবক্সে আমাকে বলেছিল- ওদের বাড়ির কাছে নাকি 'হাঁড়িধোয়া' নামে একটি নদী আছে। নদীটা নাকি দেখতে খুব সুন্দর! আঁকাবাঁকা সর্পীল। ও এও বলেছিল যদি পারো কোনও একদিন গিয়ে এই নদীটা  দেখে এসো। ট্টেনটা এখানে যদি থামতো তাহলে নাহয় নেমে এই হাঁড়িধোয়া নদীটাই দেখে যেতাম।

ট্রেনটি একসময় ভৈরব জংশন পার হয়ে আরও একটি সেতু অতিক্রম করছিল। ট্রেন থেকে নীচে চেয়ে দেখি, এ যে মেঘনা। এই নদীও দেখেছি এর আগে অনেক বার। ট্রেনটি ছুটছে দ্রুত গতিতে আখাউড়ার দিকে। এখানে কাছাকাছি কোনও স্টেশনে থামবে না।  তাই এখানে আর নামা হলো না। তাছাড়া নামতামও না এখানে। কারণ  আমি খুঁজছি স্বচ্ছতোয়া ছোট কোনও নদী। 

ট্রেনটি একসময় আখাউড়া গিয়ে পৌঁছে। ট্রেন থেকে প্লাটফরমে নামি। একটি চা'র দোকানে বসে  চা খাই। একবার ভাবছিলাম, এই ট্রেনটি ছেড়ে দিয়ে অন্য আর একটি ট্রেনে নাহয় চট্টগ্রামের দিকে যাব। কিন্তু তা আর হলো না। ট্রেন ছাড়ার সাইরেন বেজে উঠে। আমি দৌড়ে গিয়ে ট্টেনে উঠে পড়ি।

ট্রেনটি শায়েস্তাগঞ্জ জংশন পৌঁছার আগে কোথাও কোনও স্টেশনে আর থামল না। এরই মাঝে ছোট বড় দু-তিনটে নদী দেখলাম। ভালোও লেগেছিল। কিন্তু নেমে আর দেখা হয়নি। 

শায়েস্তাগঞ্জ জংশনেও ট্রেন থেকে একটু নামলাম। ইতস্ততভাবে ঘোরাঘুরি করছিলাম প্লাটফর্মের উপর দিয়ে। একটা টং দোকানে বসে চা খেলাম। সিগারেটও খাই। মনে পড়ছিল অনেক বছর আগের কথা। 

আশির দশকের হেমন্তকাল। সেবার আমরা কয়েকজন তরুণ কর্মকর্তা একটাি অফিসের কাজে এসেছিলাম হবিগঞ্জ ও চুনারুঘাট। আমাদের সাথে দুটো মেয়েও ছিল। মনে পড়ছিল এই স্টেশনের কাছে কোথাও একটি হোটেলে আমরা লাঞ্চ করেছিলাম। আরও মনে পড়ছিল অনেক কথা। একটি নদীর কথা। অনেক স্মৃতি ধেয়ে আসছিল অস্পষ্ট করে অনেক পিছনের পুরনো  জীবন থেকে। 

আরও একটি সিগারেট ধরাই। ইতোমধ্যে ট্রেন ছাড়ার সাইরেন বাজতে থাকে। আমি নির্বিকার চেয়ে থাকি ট্রেনটার দিকে। ট্রেনটি ছেড়ে চলে গেল। আমি বসেই রইলাম চা' র দোকানের সামনে বেঞ্চের উপরে। 

তখন দ্বিপ্রহর হয়ে গেছে। চা'র দোকান থেকে উঠে আস্তে আস্তে হেঁটে স্টেশনের বাইরে আসি। সেই খাবার হোটেলটি খুঁজতে থাকি। কত বছর আগের কথা। নামও মনে নেই হোটেলটির।
শেষ পর্যন্ত হোটেলটি খুঁজে পেলাম। তখন ছিল টিনের চালার হোটেল। এখন সেটি পাকা। দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম হোটেলটিতে। 

হোটেল থেকে বেরিয়ে স্থানীয় একজন লোককে জিজ্ঞাসা করি, আচ্ছা,  সুতাং যাব কীভাবে?  আমি নিজেই বললাম, আগে তো ট্রেনে যাওয়া যেত। 

লোকটি বলল - ঐ সেকশনে এখন আর ট্রেন চলে না। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। আপনি লোকাল বাসে অথবা অটোতে করে সুতাং বাজার যেতে পারবেন।

আমি বাসে না উঠে একটি খোলা অটোতে করে চলে যাই সুতাং রেল স্টেশনে। কেমন অপরিচিত লাগছিল স্টেশনটি। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। কোনও কর্ম চাঞ্চল্য নেই। টিকিট ঘরটি আছে। স্টেশন মাস্টারের ঘরটিও আছে । কিন্তু কোনও কর্মচারী নেই। ছোট্ট একটি স্টেশন। শুধুমাত্র লোকাল ট্রেন এখানে থামত। 

সেবার অফিস ট্যুরের সময় আমার আর নমিতার উপর দায়িত্ব পড়েছিল সুতাং নদীর পাড়ে খাসিয়া পুঞ্জিতে গিয়ে কয়েকটি পরিবারের সাথে আর্থ সামাজিকের উপর কিছু তথ্য জেনে নেওয়া। আমি আর নমিতা চুনারুঘাট থেকে একটি লোকাল ট্রেনে করে এসে নেমেছিলাম এই সুতাং স্টেশনে।

এই সুতাং স্টেশনের অদূরেই সুতাং নদী। কেমন যেন প্রকৃতিকালও মিলে গেল আজকেও। সেবার ছিল হেমন্ত সময়। আজকেও হেমন্ত।  ঝকমকে রোদ চারদিকে ঝিকমিক করছে । কিন্তু মনটা প্রফুল্ল লাগছে না। সেবার আমার সাথে ছিল নমিতা ৷ এবার কেউ নেই। কী উচ্ছ্বল ছলছল ছিল মেয়েটা। জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য ভূগোলে স্নাতকোত্তর করে এসেছিল । লম্বা লম্বা চুল ছিল ওর। চুলের গোছা ছড়িয়ে পড়ত  কটিদেশের উপরে। আমি ওকে বলতাম - এই যে কাজল কালোকেশী মেয়ে! কখনই চুল বাঁধবে না তুমি! নদী যেমন বুক উজার করে জল কলকলিয়ে চলে তেমনি তোমার চুল ছড়িয়ে দেবে আদিগন্ত তোমার পিঠের উপরে।

আমরা সেদিন হাঁটছিলাম সুতাং নদীর পাড় ধরে। 
কোথাও পাহাড়ি পথ, কোথাও আঁকাবাঁকা সমতল। আবার কোথাও উঁচু-নিচু পথ। সব পথের ধুলোয় লুটিয়ে থাকে পাহাড়ি লাল মাটি ও ঝকঝকে বালি। যেতে যেতে সবুজ প্রকৃতির মাঝে দেখা মেলে দূরের পাহাড়। নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ের থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশে এসেছে।

পথে চলতে চলতে পড়ছিল টিলা। পথের দুপাশে কত নাম না জানা জংলী ফুল ফুটে আছে। বিচিত্র সব সুবাসে বাতাস ভরে আছে। সুতাং এর স্বচ্ছ জল ছোঁয়ার জন্য নমিতা আকুল হয়। পাড়ে থেকে জলের কাছে যেতে ও ভয় পাচ্ছিল। নমিতা আমাকে কুসুমে কোমলে ডাকে - রঞ্জন, তুমি আমার হাতটি ধরো। 

কি পাগল মেয়ে যে নমিতা! আমার একটি হাত ওর পাঁজরে জড়িয়ে নিয়ে জলের কাছে চলে যায়। ও বলছিল - এত টলটলে জল, এত স্বচ্ছ রূপ ! এত পবিত্র! আমার সাথে তুমিও এই জল স্পর্শ করো। আমাকে তুমি অশেষ করো। দাও জগৎ  দাও। দাও তোমার মঙ্গল ছোঁয়া। তুমি  নিয়ে নাও আমার ধনদৌলত, সকল ঐশ্বর্য। সেই কত যুগের আগে তোমাকে দেখেছিলাম। সেই কতকাল ধরে এমনই ক্ষণ আমি চেয়েছিলাম। এমনই একটি নদীর কাছে তোমার মতো কাউকে আমার সমস্ত কিছু দান করতে ইচ্ছে জাগত। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে আমার জীবনে। তুমি ফিরিয়ে দিও না।

কী বিমুগ্ধ জীবন পায় মানুষ! হিরণ্য আখরে দাগ কেটে রয় তা জীবনের পরতে পরতে। 

নদী থেকে চলে আসি ঝর্ণার ঝিরিপথের বাঁকে।  এযে রবি ঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গের গান এখানেও। কেমন ভয়ংকর নির্জনতা চারদিকে! নমিতার বুক ধকধক করছিল। ও বলছিল - এ তুমি কোথায় নিয়ে এলে!  এ যে স্বর্গ এখানে নেমে এসেছে! সবকিছু স্বপ্ন নয় তো! 

তখন ছিল অপরাহ্ন সময়। সুতাং নদীর জল ছিল স্থির। ডাহুক উড়ছিল। পানকৌড়িরা বসেছিল শিয়ালপোতা গাছের ঝাড়ে। তখনও রৌদ্র করছিল ঝিলমিল। নমিতা ওর বুকের পাঁজর থেকে আমার হাত সরে এনে আমার বুকের ভিতর ওর বুক সমর্পণ করে। আবারও বিহ্ববলতা!  দীর্ঘ আলিঙ্গন যেন শেষ হতে চায়নি সেদিনের সুতাং নদীর পাড়ে মনুষ্যহীন নির্জন সেই অপরাহ্ন বেলায়।

আজ এত বছর পরে সুতাং নদীর কূল ধরে যখন হাঁটছিলাম তখন চারদিক থেকে কী এক নস্টালজিক বেদনা এসে মনকে আচ্ছন্ন করছিল। সুতাং নদীতে জল বয়ে চলেছে আগের মতোই কিন্তু কেমন যেন বিষাদ হয়ে আছে সে জল।  পায়ে পায়ে চলছিলাম ধীরে। কিন্তু পা চলছিল না।  পথ চলতে ব্যথা করছিল দু'পায়ে।

আরও কিছু দূর চলে যাই সেই টিলাটার কাছে।  টিলার গায়ে লতাগুল্মে ভরে আছে। শুধু পাশের ঝর্ণার জল আজ আর ঝরে পড়ছে না ৷ সব আজ শব্দহীন।  ভাবছিলাম আর এগুবো না সামনের দিকে। মনও চাইছিল না এগুতে । ফিরে চলে আসতে থাকি পরিত্যক্ত সুতাং স্টেশনের দিকে। 

পথ দিয়ে ফিরছিলাম আর ভাবছিলাম সেই তরঙ্গায়িত যৌবন সময়ের কথা। কতজনকেই তো ভালো লেগেছিল। নমিতা ছিল তাদেরই একজন।  মনে হতো মেয়ে তুমি আমার কিছু একটা হও। স্বপ্নও দেখতাম ওকে নিয়ে। এ রকম কত স্বপ্ন যে ভেঙ্গে গেছে সেই সময়ে। সেই ভাঙ্গা গড়ার সময়কাল কখন যে শেষ হয়ে গেছে তাও বুঝতে পারিনি। আমার গত জীবনকাল ধরে নমিতার মুখচ্ছবি যে মনে ভেসে উঠেনি তা নয়। এই সুতাং নদীর পাড়ে ওর বুকের সেই উষ্ণতা আজও আমাকে বিচলিত করে। কখনও কখনও নিজেকে  খুব খালি খালি লাগে। ওর মায়াময় মুখখানি  সুতাং নদীর জলের মতো হৃদয়ের ক্যানভাসে এখনও অস্পষ্ট জলছবি হয়ে আছে। সৌম্য বাতাসে কান পাতলে তার পায়ের ধ্বনি বাজে। সেই কবে নমিতা আমার হতে চেয়েছিল এক হৈমন্তিকা দিনে। ঝরা পাতাচিহ্ন ফেলে সে আর পুনরায় ফিরে  আসবে না কোনোদিন। অথচ বনফুলের বিজরিত গন্ধ  বাতাসে আকুল হবে এই সুতাং নদীর পাড়ে শতসহস্র বছর কাল।

কত যে ভ্রম আজও হয়! সুতাং স্টেশনে গিয়ে টিকেট ঘরের দিকে এগিয়ে যাই। মাস্টার মশাইকে বলি - ঢাকার বিমানবন্দর রেলস্টেশনের দুটো টিকেট দেন আমাদের । কেউ কোনও উত্তর দিচ্ছে না। টিকেট ঘরটি যে তালাবন্ধ ! ভিতরে কেউ নেই। পাশে চেয়ে দেখি - নমিতাও নেই। 



১১.           নদীর নাম সুবর্ণরেখা


  
সিফাত ওর বাবার পুরোনা বুকশেলফ থেকে একদিন একটি ডায়েরি খুঁজে পায়। ঠিক ডায়েরিও নয়, একটি বাঁধানো খাতার মতো অনেকটা। খাতার পাতাগুলো এত পুরোনো ও জীর্ণ হয়ে গেছে যে ধরলেই মরমর করে ছিঁড়ে যায়। 

সিফাত খুব আস্তে করে খাতার পাতা গুলো উল্টায়ে পড়তে থাকে। সে ডায়েরিটা পড়ে বুঝতে পারে এটি তার প্রপিতামহ মৃত ফয়জুর রহমানের । ঝরনা কলমে লেখা ডায়েরির অনেক শব্দ, অনেক অক্ষর ঝলসে অস্পষ্ট হয়ে গেছে।     

ডায়েরিতে সিফাতের প্রপিতামহ ঐ সময়ে ঘটিত  গ্রামের বিভিন্ন ঘটনা, তার নিজের স্মৃতিকথা, আত্মীয় স্বজন ও গ্রামের বিভিন্ন মানুষের জন্ম ও মৃত্যু তারিখ লিপিবদ্ধ করে  রেখেছেন। ব্যক্তিগত অনেক কথাও লেখা আছে। আছে অনেক ঐতিহাসিক তথ্যও । কোথাও কোথাও কাব্যিক ভাষায় অনেক গদ্য পদ্যও তিনি  লিখে রেখেছেন।       

একজায়গায় লেখা আছে --

'২৫ শে চৈত্র, ১৩২৮ বাং 

আজ দুপুরের পর হইতেই মনটা কেমন উতলা হইয়া উঠিল। আমগাছের শাখা হইতে এক সুমধুর কোকিলের কুহু ধ্বনি ভাসিয়া আসিতেছিল। সে এক সঙ্গীত মুখরিত কলকাকলি পুষ্প সুবাসা মোদিত সুর যেন ।  প্রেমোচ্ছল আজকের এই  বসন্তদিনে—কোথায় যেন শূন্যতা অনুভব করিতে লাগিলাম।  মনে হইল অদূরে ঐ সুবর্ণরেখা নদীর কূলে চলিয়া যাই। ওখানে কদম্বতলে এই অস্ত দুপুরে  বসিয়া বাঁশি বাজাই।'     

এইটুকু পড়ে সিফাত অবাক হয়ে যায়। সেই কত বছর আগের কথা।  আজ থেকে শত বছর আগেও পৃথিবী এমনি সুন্দর ছিল, এমনি বসন্ত নামত পাড়াগাঁয়ের ঐ বন-বুকে কুঞ্জে, এমনি কোকিল ডাকত রাত্রিদিনে। সুবর্ণরেখা নদীটি না জানি কত সুন্দর ছিল ! কেমন ছিল তার জল, নদীর পাড়? তখনও কী বালুচরে কাশফুল ফুটে থাকত? নানা কৌতূহল সিফাতের মনে উঁকি দিতে থাকে।   

সিফাতের দাদা গত শতকের মাঝামাঝিতে চাকুরি উদ্দেশ্যে  গ্রাম ছেড়ে ঢাকাতে এসে থিতু হয়েছিল। সিফাতের বাবার জন্ম এই ঢাকাতেই। সিফাতের জন্মও ঢাকায়। মোটামুটি দুই পুরুষ ধরে তারা গ্রাম ছাড়া। পৈত্রিক ভিটা এখনো আছে কী নেই, সে কথা সিফাত জানে না। ওর বাবা এক বছর আগে মারা গিয়েছে। মা জীবিত আছেন।      

সিফাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় অনার্স শেষ  করেছে। এখন মাস্টার্স করছে।  ও বরাবর অনুসন্ধিৎসু একটি ছেলে। প্রপিতামহের লেখা পুরনো এই ডায়েরিটি পড়ে তার ভিতর একটি কৌতূহল জেগেছে -- সে তাদের পৈত্রিক ভিটা দেখবে। এবং দেখবে সুবর্ণরেখা নদী।      

সে তার মাকে বলে -- মা, আমি আমাদের পৈত্রিক ভিটা দেখতে যাব। 

-- তোদের পৈত্রিক ভিটা এখন আছে কী না আমার জানা নেই। আমিও কখনো যাইনি। আমি আমার জীবনকাল এই ঢাকা শহরের ওয়ারীর এই বাড়িটিই শ্বশুরবাড়ি হিসাবে জেনে এসেছি। তোর বাবাও কখনো সেখানে যায়নি। আমি শুনেছি -- জায়গা জমি যতটুকু ছিল তা আমার শ্বশুরমশাই বিক্রি করে দিয়ে এই ঢাকা শহরে এসে স্থায়ী হয়েছিলেন।      

-- তুমি কী জানো আমাদের সেই গ্রামের নাম কী ছিল? 

-- আমার শ্বশুরমশাইয়ের কাছে শুনেছিলাম, কুসুমপুর। বৃহত্তর পাবনা জেলায় সিরাজগঞ্জ মহুকুমায় এই গ্রামটি অবস্থিত। ট্রেনে গেলে সলোপ স্টেশনে নামতে হয়, এইটুকু জেনেছিলাম। আর তোর বাবার মুখে শুনেছিলাম তাদের বংশীয় একজন চাচীর কথা। সে সম্ভবত এখনো জীবিত আছেন, নাম হালিমা বিবি।      

এক ফাগুন মাসের শুক্লপক্ষের দিনে  সিফাত একটি ট্রাভেল ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে সাথে একটি ক্যামেরা নিয়ে তাদের পৈত্রিক ভিটা দেখবার উদ্দেশ্য ঘর হতে বেরিয়ে পড়ে।

২.

ট্রেন থেকে সিফাত যখন সলোপ স্টেশনে এসে নামে তখন বিকাল হয়ে যায়।  ছোট্ট একটি স্টেশন। ট্রেন যখন এসে থামে তখন একটু জন সমাগম হয়। ট্রেন ছেড়ে চলে গেলে সারা স্টেশন নির্জন হয়ে যায়। একটি মধ্যবয়সী লোক স্টেশনে বসে ঘোল বিক্রি করছিল। সিফাত তার কাছে থেকে দুই গ্লাস ঘোল খেয়ে নেয়। তারপর ঐ লোকটিকে বলে -- 'চাচা, এখান থেকে কুসুমপুর কতদূর?'

-- তা ছয় মাইল হবে। 
-- কীভাবে যাব? 
-- বাইস্যা মাসে তুমি আসলে নৌকায় যেতে পারতে। এখন হেঁটে যেতে হবে। তা ওখানে কার বাড়িতে যাইবা?
 
-- ( আমি আমার দাদার নাম বললাম।)  আনিসুর রহমানের বাড়ি যাব। 
-- ওনারা কেউ তো এখানে থাকে না। এই দেশ গ্রাম ছেড়ে বহু বছর আগে চলে গেছে।
-- জানি। 
-- ঐ বাড়িতে একজন বুড়ী থাকে তার এক নাতনিকে নিয়ে। তুমি কী হও তার? 
-- আমিও তার নাতি হই। 

সিফাত ঐ লোকের কাছে থেকে কুসুমপুর যাওয়ার পথ নির্দেশনা জেনে নেয়।  তারপর সে হাঁটতে শুরু করে।             
              
সিফাত থানা পরিষদের কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। সে এর আগে এমন নিবিড় গ্রামে কখনো আসে নাই। পূর্বপুরুষদের জন্মভূমি এই দেশ। কী সুন্দর নীল আকাশ এখানে।  কেন যে এতকাল সে এখানে আসে নাই !  সে হাঁটছিল আর মনে মনে আফসোস করছিল। সে কী জানত এত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে এই গ্রাম বাংলার সবুজ শ্যামল মাঠে প্রান্তরে।  এত সুন্দর করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে এখানে। গাছে বাঁশ ঝাড়ে পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকে। কৃষক হাল গরু লাঙল নিয়ে ফিরে যাচ্ছে ঘরে।  একটু পর রাত্রি নামতে থাকে। ঘরে ঘরে টিম টিম করে কুপী- হ্যারিকেন জ্বলে ওঠে।  কী সুন্দর রাত্রির গন্ধ ।      

সিফাত যখন কুসুমপুর পৌঁছে তখন সন্ধ্যা রাত্রি হয়ে যায়। ওখানকার এক লোককে জিজ্ঞাসা করে হালিমা বিবির বাড়িটি চিনে নেয় সে।    

বাড়িতে পৌঁছে সিফাত দেখতে পায় একটি চারচালার টিনের ঘরে একটি হ্যারিকেন বাতি জ্বলছে। সিফাত আওয়াজ করে ডাক দেয় -- 'বাড়িতে কে আছেন?' একটি চৌদ্দ পনেরো বছরের বালিকা হ্যারিকেন নিয়ে উঠোনে এগিয়ে আসে। মেয়েটি সিফাতের মুখের উপর আলো ফেলে জিজ্ঞাসা করে -- 'আপনি কে?'   

-- আমি সিফাত, হালিমা দাদিমার কাছে এসেছি। ওনার সাথে আমি দেখা করব। ওনার কাছেই আমি আমার পরিচয় দেব।  উনি আমাকে চিনতে পারবেন। 

-- আসুন ঘরের ভিতর।     

ঘরে ঢুকে হালিমা বিবিকে পায়ে সালাম করে বলে-- দাদিমা, আমার নাম সিফাত রহমান , বাবার নাম -- আশিকুর রহমান, দাদার নাম -- আনিসুর রহমান, তৎ-পিতার নাম ফয়জুর রহমান। 

বৃদ্ধা হালিমা বিবি হ্যারিকেনের আলোয় সিফাতকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলে --- ওরে আমার সোনা, আমাদের কথা, এই দেশের কথা তোমার তবে মনে পড়েছে !

এতক্ষণ বালিকাটি বিস্ময়ে শহর থেকে আগত সিফাতকে দেখছিল। হালিমা বিবি মেয়েটির সাথে সিফাতকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে -- এই মেয়েটি আমার ছেলের ঘরের নাতনি। পিতৃ-মাতৃহীন, আমি ছাড়া এই জগতে ওর আর কেউ নেই ।  সম্পর্কে তোমার চাচাতো বোন হয়। ওর নাম লিলি।                         

সেই সন্ধ্যা রাতেই লিলিকে নিয়ে হালিমা বিবি ঢাকা থেকে আগত  তার নতুন নাতির জন্য রান্না করলেন। মেঝেতে শীতল পাটি বিছিয়ে খেতে দিলেন। হলদে রঙের পেইজরা চালের ভাত, পেঁপে ভর্তা,  মুগের ডাল, কোরলা ভাজা, নন্দই মাছের তরকারি। সরপড়া গরুর দুধ, দুটো সর্বি কলা ও আখের গুড়ের পাটালি। অদ্ভুত রান্না হালিমা বিবির হাতের।    

সিফাত তৃপ্তি সহকারে খেয়ে বলে -- দারুণ রান্না করেছেন দাদিমা। 

সিফাত ওর দাদিমাকে বলে -- 'আমি এখানে দুই দিন থাকব। ঘুরব ফিরব আর খাব। ' লিলিকে বলে, ' তুমি আমার সাথে সাথে থাকবে। তোমাকে নিয়েই ঘুরব।      

লিলি মাথা নেড়ে বলে -- আচ্ছা। 
-- তুমি কোন্ ক্লাসে পড়ো? 
-- ক্লাস নাইনে। কিন্তু এখন আর স্কুলে যাই না। 
-- কেন যাও না?
-- আমাদের স্কুল দেড় মাইল দূরে। পথে বোখাটে ছেলেরা আমাকে খুব জ্বালাতন করে। হুমকিও দেয়। ওদের ভয়ে যাই না।     
-- ওহ্ আচ্ছা।       

৩.

   
কী সুন্দর এই বাড়িটিও। পশ্চিম পার্শ্বে বাঁশবন, আমবন।  ফলের বাগান যেন প্রাচীন অরণ্যে পরিণত হয়েছে। এই বাড়িতে নির্জন দুটো মানুষ শুধু থাকে। আর যারা আছে, দুজন কামলা ও একটি কাজের মহিলা। তারা কাজ কর্ম করে সন্ধ্যা রাতেই চলে যায়। 

সকালবেলা দরজা খুলেই একঝলক সকালের রোদ্দুর এসে সিফাতের গায়ে লাগে। এত পরিচ্ছন্ন নীল আকাশ, আম কাঁঠালের পাতার ফাঁক দিয়ে  ভোরের রোদের এমন ঝলমলে  বিচ্ছুরণ এর আগে সিফাত দেখেনি কখনও। 

সিফাত দাদিমার ঘরে যেয়ে দাদিকে বলে -- আমি একটু পুকুরপাড়ের ওদিকে যাব। লিলিকে সাথে নেব।  
-- আচ্ছা, নিয়ে যাও। 

সিফাত লিলিকে নিয়ে পুকুরপাড়ে চলে যায়।  কী সুন্দর পুকুরের জল ! দিঘির জলের মতো স্বচ্ছ। পুকুরের চারপাশে নানা জাতের ঘাসের আচ্ছাদন। বিচিত্র সব ঘাসফুল ফুটে আছে। পাড়ের ফাঁকে ফাঁকে নারিকেল গাছ। ফুলের গাছও আছে। রক্তজবা, বেলী গাঁদা আর পাতাবাহার। সিফাত অনেক ঘাসফুল চিনতে পারে না। পুকুর পাড় ধরে দুজন হাঁটছিল আর লিলির কাছ থেকে জেনে নেয় কোন্ ফুলটির কী নাম।   

সিফাত লিলিকে বলছিল -- এত ফুলের সাথে তুমি আমাকে পরিচয় করে দিলে। কোথাও তো লিলি ফুল দেখলাম না। 
 
-- আমার নাম লিলি। কিন্তু আমি কখনও লিলি ফুল দেখিনি। 

-- আচ্ছা, এরপর আমি যদি কখনও আসি তখন ঢাকা থেকে লিলি ফুলের চারা নিয়ে এসে এখানে লাগিয়ে দিয়ে যাব। 
-- আচ্ছা, ভাইয়া।  
                                               
-- লিলি.... 
-- জ্বী, ভাইয়া। 
-- চলো, ঐ আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে প্রান্তরের ঐ দিকে যাই। 
-- চলো।       
            
দুজন মেঠো পথ ধরে হাঁটতে থাকে।  লিলি আগে, সিফাত পিছে। যেন লিলিই পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ফাগুনের নতুন কচি আউশ আর পাটক্ষেতের পাশে দিয়ে। মাঠে রাখালেরা কাজ করছে। তারা ধান ক্ষেতে জঙ্গল হয়ে থাকা ঘাস নিরাচ্ছে, আর জারীগান 
গাইছে।    

লিলিদের পাড়ার এক বৃদ্ধ লোক যাচ্ছিল ওদের পাশ দিয়ে। সিফাতকে লিলির সাথে দেখে লিলিকে বলে -- 
এত সুন্দর ছোয়ালডা কে রে লিলি? 

-- আমার ভাইয়া হয়।  ঢাকা থেকে এসেছে।     

সিফাত আর লিলি পুনরায় ফিরে আসতে থাকে  বাড়ির দিকে। পথিমধ্যে দেখা হয় দুটো ছেলের সাথে। এরা বখাটে। লিলিকে পথে ঘাটে উত্যক্ত করে। একটি ছেলে জিজ্ঞাসা করে এই ছোকরা কে রে লিলি? কই থেকে আমদানি হলো?  তোরে দেখে মনে হচ্ছে বেশ স্ফূর্তিতে আছিস।    

লিলি কোনো কথা বলে না।  সিফাত ওদেরকে বলে, এমন করে কথা বলছ কেন? 
-- কেমন করে কথা বলব?  তুই শিখাবি? 
-- আয়, শিখিয়ে দেই। 

ওদের একটারে দেয় কষে একটা থাপ্পড়।  লিলি যেয়ে সিফাতের হাত ধরে, এবং বলে -- চলো ভাইয়া। লিলি সিফাতের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে বাড়িতে। বখাটে ছেলে দুটো শাসাচ্ছিল, 'তুই কার নাতি?  তোকে আমরা দেখে ছাড়ব'।   

পথে আসতে আসতে লিলি বলছিল -- তুমি ওদের সাথে আর এমন করবে না। 
-- আচ্ছা। 
-- আমার মাথা ছুঁয়ে বলো আর এমন করবে না। 
-- এই তোমার মাথা ছুঁইয়ে বলছি  -- আর এমন করব না। দেখা হলে -- ওদেরকে সরি বলে দিব। আসলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তো। মাথা একটু বেশি গরম হয়ে গিয়েছিল ।                        
      
৪.

দুপুরে সিফাত খেতে বসে তো অবাক!  নানা রকম ব্যঞ্জন। চলনবিলের বোয়াল মাছের তরকারি, ভেটকি মাছের দোপিয়াজা, টাকি মাছের ভর্তা, মুরগির ঝাল তরকারি, চালতার আচার, ডিম মামলেট, তেলে ডুবে কাঁকরোল ভাজি। সাথে ঘোষদের গাওয়া ঘী। সিফাত ওর দাদিমাকে বলে --তুমি একদিনেই আমাকে এত ভালোবেসে ফেললে দাদিমা। আমি সত্যি মুগ্ধ।     

বিকালে সিফাত লিলিকে বলছিল -- এখান থেকে সুবর্ণরেখা নদীটি কতদূর? আমি ঐ নদীটা দেখতে যাব। মনে করো -- ঐ নদীটা দেখতেই আমি এখানে এসেছি। 

-- কাছেই।  বেশি দূরে নয়। আধা মাইল দূরে হবে। একটা মাঠের প্রান্তর পেরুলেই সুবর্ণরেখা নদী । 

-- আমি আজই যাব নদী দেখতে। তুমিও যাবে আমার সাথে। 
-- আচ্ছা। 
-- ওখানে নদীর কূলে কদম গাছ আছে কোনো? 
-- আছে। ওখানে তো বহু বছরের প্রাচীন একটা কদমবন আছে।  কিন্তু ফুল পাবে না। এখন ফাল্গুণ মাস। ফাগুনে কদম ফুল ফোটে না। পাশে শিমুল গাছ আছে। এখন শিমুল ফুটে । 

-- আচ্ছা, আমি আর তুমি শিমুল তলা আর কদম তলায় বসে সুবর্ণরেখার জল দেখব। 

-- আচ্ছা।          
                                                        
৫.

তখন সন্ধ্যা পূর্ব বিকাল। ফসলের প্রান্তরের পথ ধরে হেঁটে হেঁটে দুজন চলে যায় সুবর্ণরেখা নদীর তীরে। সিফাত বিমুগ্ধ হয়ে  তাকিয়ে দেখে নদীটাকে। পৃথিবীতে এত সুন্দর নদী থাকে?  নদীটি খুব বেশি চওড়া নয়।  ওপার দেখা যায় এপার থেকে। ওপারে ফসলের ক্ষেত। আছে কদম গাছ। বাবলা গাছও আছে। নদীর পাড় ধরে রাখাল গরু নিয়ে যাচ্ছে বাথানে। পশ্চিম আকাশে সূর্যের রং ক্রমাগত গাঢ় কমলা রূপ ধারণ করছে।                                

সিফাত সুবর্ণরেখার পারে তার প্রপিতামহ ফয়জুর রহমানের পায়ের ছাপ খুঁজতে থাকে। পায়ের ছাপ খুঁজতে খুঁজতে সিফাত লিলিকে নিয়ে কদমতলায় যেয়ে বসে।  দুজনই বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সুবর্ণরেখার জলের দিকে। স্থির পানি। স্রোত নেই। স্বচ্ছ জলের উপর পড়েছে কমলা রঙের সূর্যের ছায়া, সূর্যটি  একদম ভরা পূর্ণিমার চাঁদের মতো লাগছে।       

সিফাত লিলিকে বলছিল তুমি গান গাইতে পারো? 
-- না। তুমি পারো? 
-- পারি। 
-- তবে একটা গান গেয়ে শোনাও।                               

সিফাত লিলিকে গান গেয়ে শোনায় --

'যমুনা পুলিনে কদম্ব কাননে 
কি হেরিনু সখী আজ! 
শ্যাম বংশীধারী মণিমঞ্চোপরি 
লীলা করে রসরাজ।...... 
আমি  ঘরে না যাইব বনে 
প্রবেশিব ও লীলা রসের তরে, 
ত্যাজি কুললাজ ভজ ব্রজরাজ 
বিনোদ মিনতি করে।'

সিফাত লিলিকে ডাকে -- লিলি.... 
-- জ্বী। 
-- আমি ঢাকা যেয়ে মা বাবাকে বলে তোমাকে ঢাকা নিয়ে যাব। তুমি ওখানে যেয়ে স্কুলে ভর্তি হবে। পড়াশোনা করবে। 
-- সত্যি তুমি নিয়ে যাবে আমাকে? 
-- সত্যি বলছি।                

সন্ধ্যা নামে সুবর্ণরেখার তীরে।  আঁধার নামতে থাকে ধীরে। একসময় সত্যি বেশ রাত্রি হয়ে যায়। ওরা দুজন হেঁটে হেঁটে চলে আসে প্রান্তরের দিকে। 

কী সুন্দর রাত্রির অন্ধকার।  আকাশ ভরা নক্ষত্ররাজি। ওরা হাঁটছে আকাশের নীচে দিয়ে নক্ষত্রের আলো দেখে পথ চিনে চিনে। লিলি আগে, সিফাত পিছে। চলতে চলতে  লিলি হঠাৎ আর্তনাদ শুনতে পায়। পিছনে ফিরে সে দেখে -- দুটো ছেলে মুখোশ পরে বেয়নেট দিয়ে সিফাতের বুকে পেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। 

সেই রাত্রির চরাচরে ফসলের ক্ষেতের ভিতর  নিস্তেজ দেহে শুয়ে থেকেছিল সিফাত। তার দুচোখ তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে থেকেছিল নিষ্পলক। আত্মার শেষ অনুভবে হয়ত সে ভেবেছিল --  লিলি নিতান্তই একটি অনাথ বালিকা, ওর ওপর আমার এইজন্য  কি অনুকম্পা জেগেছিল?  ওর জন্য মায়া হয় আমার। ওর সকল দুঃখ, বিপদ থেকে আড়াল করে রাখতে ইচ্ছা হয়। 
      
সুবর্ণরেখা নদী বয়ে চলবে আরও বহুকাল।      


১২.         কাশফুল  



বইমেলায় প্রথম দিকে ভীড় একটু কম থাকে। ধুলো উড়ে কম। যেখানে ধুলো নেই সেখানে থাকে ঘাস। ঘাসগুলোও সতেজ থাকে। পায়ে পায়ে নুয়ে মিশে যায় না মাটিতে। আমার প্রকাশক অনুরোধ করে  বলেছিল,  আপনি মাঝে মাঝে মেলায় আসবেন। স্টলের সামনে দাঁড়াবেন। অনেক পাঠক আপনাকে খোঁজে, আপনার অটোগ্রাফ চায়। 

সেদিন কোনো ছুটির দিন ছিল না। মেলায় লোক সমাগম খুব কম ছিল । আমি স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তেমন কোনো দর্শনার্থী নেই। দু'একজন করে স্টলের সামনে এসে বইপত্র দেখছিল, নাড়াচাড়া করে দুচার লাইন পড়ছিল। পরিচিত তেমন কেউ আসছে না। একটু বোরিং লাগছিল নিজেকে। ভাবলাম, কফি খেয়ে আসি। 

হঠাৎ দেখি -- একটি একুশ বাইশ বছরের তরুণী স্টলের সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি দূর থেকে দেখছিলাম মেয়েটি আমার বইগুলো পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখছে।

তরুণী সেলসম্যানকে বলছিল -- লেখক সাহেব নেই? 
সেলসম্যান ছেলেটি বলে -- আছে। 
ছেলেটি আমাকে ডাক দেয়। আমি কাছে চলে যাই। আমাকে দেখিয়ে ছেলেটি তরুণীকে বলে, ইনি হচ্ছেন লেখক। 

মেয়েটি আমাকে সালাম দিয়ে বলে -- আমি কী যে খুশি হয়েছি। জানেন,  আমি কত যে আপনাকে খুঁজেছি। আজ আপনার দেখা পেলাম। 

আমি মেয়েটিকে বলি -- তোমাকে এর আগে কোথাও কী দেখেছিলাম? মেয়েটি বলে -- না মনে হয়। আবার দেখতেও পারেন।

আমি আমাকেই মনে মনে বলছিলাম -- ঠিক এই রকমই দেখতে একটি মেয়ের সাথে আমার পরিচয় ছিল। সে অনেক বছর আগের কথা। অনেক বছর আগেই সে আমার জীবন থেকে অনেক দূরের হয়ে  গিয়েছিল। কী আশ্চর্য ! ঠিক সেই মেয়ের মতো এই মেয়েটির চোখ, ভ্রূ, থুতনি, কপাল, মাথার চুল, কণ্ঠস্বর, হাসি। এত অবিকল চেহারা হয়! আমি বিস্ময়ে এই মেয়েকে দেখেছিলাম আর ফিরে যাচ্ছিলাম, বহু বছর আগের দিনগুলোতে। মনে হচ্ছিল -- সেই মেয়েটি যেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

মেয়েটি বলছিল, আপনার আগের দুটো বই আমি সংগ্রহ করেছিলাম। আপনার নতুন প্রকাশিত এই গল্পের বইটি আমি আজ সংগ্রহ করলাম। আগের বই দুটোতে আপনার অটোগ্রাফ নিতে পারিনি। কী যে আফসোস করেছি।  আজ আর কোনো আফসোস নেই। আপনার অটোগ্রাফ নেব। খুব খুশি লাগছে -- আপনাকে দেখলাম। কী যে ইচ্ছে ছিল, আপনাকে দেখবার!  আজ আপনাকে দেখলাম, আমার আর কোনো খেদ নেই।

মেয়েটি বইটি এগিয়ে দিয়ে বলে -- অটোগ্রাফ লিখে দিন।  আমি বইটি হাতে নিয়ে মেয়েটিকে বললাম -- তোমার নাম কী  ইশিকা? মেয়েটি অবাক হলো ভীষণ! বিস্মিত হয়ে বলছিল -- আপনি আমার নাম জানলেন কী করে? 

আমি বললাম -- মনে হলো তোমার নাম ইশিকা। তাই বললাম। 

-- জানেন, এই নামটি রেখেছিল আমার মা। মাকে বলেছিলাম, এই নামের অর্থ কী?  মা বলত, জানি না। যিনি আমাকে এই নামটি আমার  মেয়ে হলে রাখতে বলেছিল -- সে অনেক দূরে চলে গেছে। তার আর দেখা পাইনা। 

ইশিকা আমাকে বলে -- আপনি কী এই নামের অর্থ জানেন? 

-- জানি, ইসিকা নামের  অর্থ হচ্ছে, শরতের শুভ্র তুলতুলে কাশফুল। 

-- জানেন আমার জন্ম হয়েছিল শরৎকালে। আশ্বিনের এক সন্ধ্যায় আমি নাকি এই পৃথিবীতে এসেছিলাম।

আমি বইটির সাদা পাতায়  অটোগ্রাফ লিখি -- "তোমার মেয়ের নাম রেখে দিলাম -- ইশানা। মেয়ে হলে এই নামটি রেখো। "

ইশিকা খুব খুশি হয় -- বলে,  এই নামের অর্থ কী ?  বললাম  -- ইশানা অর্থ -- ঐশ্বর্যময়ী। 

আমি ইশিকার লাস্যময়ী মুখখানির ভিতর দেখছিলাম ঠিক বহু বছর আগের এমনই এক বিকালের অন্য একটি মুখকে। বংশী নদীর কূলে আমরা বসেছিলাম -- ওপারে ছিল সারি সারি কাশবন। শুভ্র কাশফুল গুলোকে লাগছিল সাদা গালিচার মতো। নীচে সাদা ফুল ঢেউয়ে দোল খেলছিল, আর পশ্চিম আকাশকে লাল আভার মেঘ ছেয়ে রেখেছিল।

আমি ইশিকাকে বললাম -- তোমার মা কেমন আছেন? 
ইশিকা কতক্ষণ চুপ থাকে। তারপর মৃদু কম্পমান স্বরে বলছিল -- মা তো নেই। দু'বছর আগে  চলে গেছেন পরপারে।

ইশিকা আমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আমি ধীরে ধীরে হেঁটে চলে আসি উদ্যানের বিজয় স্তম্ভের দীঘির পাড়ে। সোপানে একাকী বসে থাকি সারা সন্ধ্যা। রাত্রিও নামছিল ধীরে -- আঁধারে জলের ভিতর দেখছিলাম -- বহুবছর আগের সেই বিস্মৃত মেয়েটির হাতে প্রদীপশিখা জ্বলছে, কী অপার্থিব স্নিগ্ধ নির্মল সেই দীপালোক, এই দীঘির জল কী অপরূপ ধারায় আলোকিত হয়ে উঠেছে।



১৩.         হৈমন্তীবালা


 
দুই হাজার নয় সালে একবার আমরা শিলিগুড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাাম । বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ  করেছিল শিলিগুড়ির আমাদের বন্ধু শিশির রায়। শিশির এবং ওর স্ত্রী পৃথার প্রবল ইচ্ছা ছিল আমরা শিলিগুড়িতে যেয়ে ওদের বাড়িতেই উঠি। কিন্তু তা না উঠে আমরা হোটেল সেন্ট্রাল প্লাজাতে উঠেছিলাম। 

এই ভ্রমণের উপর বেশ কিছু লেখা এর আগে আমি লিখেছিলাম। সেইসব লেখা ফেসবুকে ও ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল।  আজ সেই সব কথা আর বলব না। আজ বলব অন্য কথা।

ছোট্ট এই শহরে এলাম। শহর থেকে একটু দূরে গেলেই পাহাড় দেখা যায়। আবার যদি মন চায় সমতলে পাকা রাস্তার উপর দিয়ে ট্যাক্সি চালিয়ে চলে যাওয়া যায় তিস্তার পাড়ে, জলপাইগুড়ির চা বাগানে, ডুয়ার্সের বন জঙ্গলে। তিস্তার পাড়ে গেলে মনে হবে, এই নদী ওপারে বাংলাদেশেও আছে। শুধু বিভাজন করা হয়েছে সীমানারেখায় আর কাঁটা তারের বেড়ায়।     

শিশির একদিন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল--
'আমি জানি,  তুমি ভালো কবিতা লেখ।  কাল আমাদের এখানে ঘরোয়াভাবে একটি কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়েছে। আমি চাই -- তুমি সেখানে তোমার একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করো।'   

আমি শিশিরকে 'না' বললাম না।     

এই শহরে এসে আমি  কবিতা পড়ছি! এই শহরে আমি কবিতা পড়ব -- এই কথা শুনলে সবচেয়ে যে বেশি খুশি হতো,  যে এসে আমার কবিতা শুনত, সে আজ আর এই শহরে নেই।        

বহু পুরনো বহু বিস্মৃত স্মৃতিকথা মনে পড়ে মুহূর্তেই  চোখ দুটো মৌনতায় স্থীর হয়ে গেল। জীবন পাতার  পিছনের পৃষ্ঠাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছু সময়।   
  
ঝাপসা ও ম্লান হয়ে যাওয়া জীবনের সেই প্রথম দিককার  পৃষ্ঠাগুলো এক  এক  করে   উল্টাতে 
থাকি ---      
   
ফুলকোচা ফ্রী প্রাইমারি স্কুলে তখন টু ক্লাসের ছাত্র আমি। প্রথম দিনের কথা। মা আমার মাথায় সরিষার তেল মেখে পরিপাটি করে চুল আঁচড়িয়ে দিয়েছিল। জহুরা বুবু দিয়েছিল চোখে পুরু করে কাজল এঁকে ।  পরনে ছিল রাবার লাগানো চেক হাফ প্যান্ট। গায়ে ছিল পপলিনের সাদা হাফ সার্ট। পায়ে ছিল স্পঞ্জের স্যান্ডেল। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে এক কোণে চুপচাপ বসেছিলাম। ওপাশ থেকে দেখি --- হৈমন্তীবালা আমার হ্যাবলাকান্ত চেহারা দেখে মিটমিট করে হাসছে।

একদিন হৈমন্তীবালা চুপিচুপি ওদের গাছের একটি কাঁচা ঢাসা পেয়ারা এনে আমাকে খেতে দিয়ছিল। আর একদিন দিয়েছিল পূঁজোর প্রসাদ--- খেঁজুরের গুড়ের খাজা, নারিকেলের নাড়ু আর তখতি। মাঝে মাঝে আমি কুণ্ডুদের দোকান থেকে মা'র দেওয়া এক আনা পয়সা থেকে কাঠি লজেন্স কিনে এনে হৈমন্তীকে খেতে দিতাম এবং আমিও খেতাম। ফাইভ ক্লাস পর্যন্ত হৈমন্তী আমার সহপাঠি ছিল। 

একদিন দেখি হৈমন্তীবালা ক্লাসে আসেনি। কেন সে আসেনি সে কথা জানতেই -- সবাই বলাবলি করছে হৈমন্তীদের পরিবার গত রাতে দেশ ত্যাগ করে ওপারে  চলে গেছে। সেই শিশু বেলায় বুঝিনি, হৈমন্তীরা কেন দেশ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। 

হৈমন্তী আর ক্লাসে আসে না। ওকে আর দেখতে পাই না।  শুধু এই কথা  ভেবেই মন খারাপ লাগত। ওর জন্য তখন কেঁদেছিলাম কিনা, সে কথা আজ আর  মনে নেই।                           

তারপর চলে গেছে আরও কয়েকটি বছর।       
তারপর প্রাইমারি স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হলাম।  সেখানে কত নতুন নতুন সহপাঠী বন্ধু পেলাম। ঝর্ণা, দোলা, জাহানারা, সাইফুল, আমিনুল -- আরও কত বন্ধু।  কিন্তু শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাওয়া  আমার সেই সহপাঠিনী বন্ধু হৈমন্তীবালা আমার  মনের কোণে রয়েই গেল।               

তারপর চলে গেছে আরও কয়েক বছর।  হৈমন্তী'রা কোথায় আছে? কেমন আছে? জানতে ইচ্ছা করত।  পরস্পরে শুধু এইটুকু জেনেছি  যে, ওরা নাকি জলপাইগুড়ি জেলার  ময়নাগুড়ির কাছাকাছি তিস্তা নদীর পাড়ের কোনো একটি গ্রামে থাকে।  কিন্তু কে যায় তিস্তা পাড়ে !  কার এত দায় একজন হৈমন্তীবালাকে দেখতে যেতে?  মনেও পড়ে না ওকে তেমন আর !  আর হৈমন্তীও কী মনে রেখেছে আমাকে ?          

জীবন পাতা ইতোমধ্যে লিখে লিখে ভরে ফেলেছি অনেক।  বিস্মৃতির অতল আঁধারে হারিয়ে গেছে শিশুকালের সেই  ফ্রক পরা লাস্যময়ী  সহপাঠিনী হৈমন্তীবালা।           
             

কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎই মনটা বিহবল হয়ে উঠত। উদাস হয়ে চেয়ে দেখতাম -- চার চালের সেই টিনের স্কুল ঘর। ছোট্ট মাঠের উপরে নিম গাছ। স্কুলে ছুুুটির ঘন্টা পড়ছে। দৌড়ে দৌড়ে বালক বালিকারা বাড়ি চলে যাচ্ছে। হাতে বই খাতা নিয়ে হৈমন্তীবালাও বাড়ি যাচ্ছে। আমিও যাচ্ছি। যাবার বেলায় ফিরে ফিরে দেখছি হৈমন্তীকে। আর হৈমন্তী দেখছে আমাকে।

তখন আমি কলেজে পড়ি। গ্রীষ্মের ছুটিতে সেবার বাড়িতে এসেছি। একদিন পিওন একটি চিঠি নিয়ে আসে। চিঠিটি ভারতীয় একটি ডাক খামের। খুলে পড়তে থাকি --

রঞ্জন, 

কেমন আছ তুমি। আমি তোমার কৈশোরের সহপাঠিনী হৈমন্তী। আমাকে কি তোমার মনে আছে? চিনতে পারছ কী আমাকে? বাংলাদেশ থেকে আমাদের এক আত্মীয় এসেছিল এখানে । তার কাছে থেকে জানতে পারলাম তোমার কথা। তারপর থেকে তোমাকে আমার খুব লিখতে ইচ্ছে করছিল। তাই লিখছি এই চিঠি। 

যদি আমার কথা তোমার মনে থাকে, যদি আমাকে  লিখতে মন চায়, তাহলে লিখ। আজ আর বেশি কিছু লিখছি না। তোমার কাছে থেকে উত্তর পেলে তখন লিখব আরও অনেক কথা। নীচে আমার ঠিকানা দিলাম। আমি তোমার চিঠির জন্য অপেক্ষা করব। 
ভালো থেকো। 

ইতি -- হৈমন্তী।       

হৈমন্তীর চিঠির উত্তর আমি লিখেছিলাম। ও তখন শিলিগুড়ি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ত। থাকত কলেজের কাছেই  হাকিম পাড়াতে একটি ছাত্রী হোস্টেলে।  হৈমন্তী খুবই সাহিত্য সংস্কৃতিমনা ছিল। ও কবিতা লিখত, আবৃত্তি করত। গানও গাইত।  ওর সাথে বছরখানেক আমার পত্র যোগাযোগ ছিল। প্রায় চিঠিতে ও কবিতা লিখে পাঠাত।  আমিও লিখে পাঠাতাম কবিতা।  ওর লেখা একটি কবিতার কয়েকটা লাইন এখনও মনে আছে --

'আমার ছোট কিছু আশা ছিল, ছোট ছোট  ভালোবাসা ছিল, ছোট কিছু স্বপ্ন ছিল, আমার কিছু পাওয়ার ছিল।
আমার কিছু আক্ষেপ আছে, বুকের নীচে কান্না আছে, চোখ ভরা জল আছে --  পুতুল খেলার ঘরটি আমার ভেঙে গেছে।           ,
একখানা ঘর পাব কী আর আগের মতো, স্বপ্বগুলো কী  আর  ফিরে পাব  পুুুুতুলখেলার সেই খেলাঘরটির মতো.... '                                       

হ্যাঁ, আমিও স্বপ্ন দেখতাম হৈমন্তীবালার মতো।  কত স্বপ্নের কথা চিঠিতে লিখে পাঠাতাম ওকে।  তপ্ত রোদ্রের নীচে হাঁটতে হাঁটতে উদাস হয়ে চলে যেতাম অনেক দূরে । ইছামতীর নদীর কূলে বসে স্বচ্ছতোয়া জল দেখতাম। ছুটিতে ঢাকা থেকে বাড়িতে গেলে প্রায়ই চলে যেতাম স্কুল প্রাঙ্গনে। নিম গাছটা বুড়ো হয়ে সেখানেই আছে। কখনও কখনও মরা পাতা ঝিরঝির করে ঝরে পড়তে দেখতাম মাটির উপরে।    
               
বাস্তবে কোনো কিছু পাওয়ার ভিতর যেমন আনন্দ থাকে , আবার  স্বপ্নে পাওয়া বস্তু পেয়েও মানুষ  আনন্দ পায়। বাস্তবে পাওয়া বস্তু হারিয়ে মানুষ আক্ষেপ করে, কান্নাকাটি করে। কিন্তু স্বপ্নে পাওয়া কোনো দূর্লভ বস্তু হারিয়ে মানুষ কাঁদে না। 

কেমন করে যেন সব স্বপ্নগুলো ভেঙে গেল। একটা সময়ে হৈমন্তীবালার আর কোনো পত্র আসত না। আমি তারপরও দুতিনটি চিঠি লিখেছিলাম কিন্তু সবগুলোর নো রিপ্লাই ছিল।   
                                                      
কেমন যেন অন্তর হাহাকার করে উঠত। মনে পড়ত  পিছনের সব মানুষ, নদী, ধানক্ষেত। শুনতে পেতাম বাউল আর ভোরের পাখিদের গান। মনে পড়ত  হৈমন্তীবালার কথা। খুব ইচ্ছা হতো  তিস্তা নদীতে নৌকা ভাসিয়ে চলে যাই ময়নাগুড়িতে। ওখানে তো এই নদী আছে। যেয়ে খুঁজে বের করি ওর গ্রাম। ওর শহর।  দেখে আসি একটিবার আমার ছেলেবেলার সেই হৈমন্তীকে।

হৈমন্তীবালার খবরটি জেনেছিলাম আরও পরে। 
সেদিন সন্ধ্যায় শহর থেকে বাড়িতে ফিরছিলাম। শালুয়াভিটা নদীর খেয়াঘাট পারাপারের সময় দেখা হয় হৈমন্তীদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সাথে। ওর নাম দিলীপ। স্কুলে আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিল। সেই বলল হৈমন্তীর কথা। 

হাতে শাঁখাপলা পরা হয়নি ওর। সিঁথিতেও দিতে পারেনি কেউ সিঁদুর। তার আগেই পোড়ামুখী চিতায় পুড়ে নাকি ভস্ম হয়ে গেছে।  আহা!  কেউ যদি ওর দেহের ছাইভস্ম ওপারের তিস্তা নদীতে ভাসিয়ে দিত, তাহলে চলে আসত সেই ছাইভষ্ম ভেসে ভেসে এপারের তিস্তায়।  একই নদী, একই স্রোত, উপরে একই নীল আকাশ।                   
                       
"এই স্নেহহীন, মায়াহীন, জলবায়ু শুন্য জতুগৃহে
কতোদিন শুনি না ঘুঘুর ডাক, রাখালের বাঁশি,
টানা বাতাসের শব্দ
দেখিনা সবুজ মাঠ, উধাও দিগন্ত
ঘরের পিছনের ছোট্ট জংলায় দোয়েলের উড়াউড়ি,
কোথাও দেখিনা একটি ধানের শীষে গঙ্গাফড়িং,
লাউ জাংলার পাশে স্থলপদ্ম.....। '
--- মহাদেব সাহার কবিতা।   
    
সব চাওয়া এক জীবনে পাওয়া হয় না,  হয়ত বহু জন্মেও না– প্রাপ্তির আনন্দ এইটুকু পাই যেন আমি, মনের কোণে কারোর মায়া যেটুকু পুঞ্জীভূত হয়ে আছে তা যেন  কখনও নিঃশেষ না হয়ে যায়। শাশ্বত যুগসমূহের মধ্যে, সুদীর্ঘ অনাগত কাল ব্যেপে তা যেন ভরে থাকে। ঐ নীল আকাশ, ওই কলতরঙ্গিনী তিস্তা নদী , দূরের নীহারিকাপুঞ্জ,  হলদে-ডানার প্রজাপতি, এই শোভা, এই আনন্দের মধ্যে দিয়ে যেন বেঁচে 
থাকি ।

সেদিনের সেই  গভীর রাতে সেন্ট্রাল প্লাজা হোটেলের কাঁচের জানালা খুলে দেখেছিলাম -- দূরের আঁধার হওয়া  আকাশ। তারা জ্বলছিল তখনও। শহরের রাজপথ সব জনশূন্য। জাতীয় সড়ক থেকে দু'একটা গাড়ির কর্কশ হর্ণ শোনা যাচ্ছিল কেবল।  একটা সিগারেট ধরাই। জানালার পাশ থেকে ফিরে এসে টেবিলে বসি।  এই শহরে হৈমন্তীবালা থাক বা না থাক। আমার আবৃত্তি করা কবিতা  সে শুনুক আর না শুনুক।  একটা কবিতা তো লিখতে হবে।
                                          ্


১৪.       বিবশ


একটি সরকারি প্রকল্প কাজের মূল্যায়নের জন্য আমরা কয়েকজন শিক্ষানবীশ কর্মকর্তা ফরিদপুরের নগরকান্দায় গিয়েছিলাম। সময়টা ছিল আশির দশক। আমাদের সাথে তিনজন মেয়েও ছিল। আমাদের টিম লিডার শওকত সাহেব ছাড়া আমরা বাকী ছয়জন ছিলাম নবীন। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল থানা পরিষদের ডাকবাংলোয়।

রাতে ব্রিফিং সভায় শওকত সাহেব বললেন -- 'আপনি আর নাসরীন আপনারা দুজন আগামীকাল যাবেন ফুলসুতি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সকালে যাবেন, সন্ধ্যার আগেই কাজ সেরে বাংলোয় ফিরে আসবেন।'

আমাদের অ্যাসাইনমেন্ট হচ্ছে নবনির্মিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি পরিদর্শন করা ও সেখানকার জনসাধারণ উক্ত কেন্দ্র থেকে কেমন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন সে সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া।

আমরা যথারীতি সকালে রওনা হই।

নদীর নাম ভুবনেশ্বর। আশ্বিনের স্তিমিত খরস্রোত তখন নদীটিতে। আমরা একটি রিক্সায় করে চলে আসি এর পাড়ে। ওপাড় যেতে হবে। একটি বড়ো খেয়া নৌকা ভিড়ে আছে ঘাটে। নৌকাটির দুপাশে কাঠের বেঞ্চির মতো করা। নাসরীন নৌকায় উঠে বেঞ্চিতে বসে। আমি ওর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকি। নৌকা ছেড়ে দেয়। দুজনেই দেখছি নদী। নাসরীনের খোলা চুল বাতাসে উড়ছে। দুজনেরই মাথার উপর শরতের শুভ্র মেঘের আকাশ। মেঘের ফাঁকে স্বচ্ছ নীল আকাশও দেখা যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরেই আমরা ওপাড়ে পৌঁছে যাই। ওপাড়ে নেমে দেখি, তিনটি ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। একজন ভ্যান চালককে জিজ্ঞাসা করি - ভাই আমরা ফুলসুতি গ্রামে যাব।' ভ্যানচালক বলল - 'খালপাড় পর্যন্ত ভ্যানে যেতে পারবেন। তারপর আবারও ছোট্ট একটি খেয়া পার হতে হবে। তারপর আধা মাইল হেঁটে অথবা ভ্যানে করে ফুলসুতি যেতে হবে।

বললাম, তাই হবে। আমাদের খালপাড় পর্যন্ত নিয়ে চলো।

আমরা ভ্যানে বসে আছি। আশ্বিনের রোদ পড়ছে আমাদের গায়ের উপর। থানা পরিষদের আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তা। রাস্তার দুপাশে জলের মাঠ। বন্যার জল রয়ে গেছে তখনও। আমনধানের ডোগা নুয়ে পড়েছে জলের উপর। পাটের ঝাঁকের পঁচা গন্ধ আসছিল জল থেকে। কাছে ও দূরে গুচ্ছ গুচ্ছ বাড়িঘর। কোথাও আবার কোনো বাড়িঘর নেই। জলে ভাসা বিজন প্রান্তর। খুব ভালো লাগছিল পথ চলতে। কত বিচিত্র মানুষ দেখছি। কত বৃক্ষ, কত খোলা জায়গা দিয়ে চলছে ভ্যান। ভালো লাগছিল আরও আমার পাশে সুন্দরী একটি তরুণী বসে আছে। নাসরীনও মুগ্ধ হয়ে দেখছে মাঠ ঘাট মানুষ, গবাদিপশু ও জলের প্রান্তর।

আমি নাসরীনকে বলি -- কেমন লাগছে তোমার এই গ্রাম ও পথ?

-- খুব ভালো লাগছে! এত কাছে থেকে কখনও দেখিনি এমন গ্রাম। শহরে বড়ো হয়েছি। কী যে ভালো লাগছে এই মাটির পথ। ভাবছি, এই পথ যেন শেষ না হয়।
-- তাই?
-- হুম।

কিন্তু পথ দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। আমরা চলে আসি খালপাড়ে। দেখলাম, জায়গাটা খুব নির্জন। খেয়াঘাটে নৌকা নেই। ওপাড়ে যাত্রী নিয়ে চলে গেছে। নৌকা আসতে মিনিট কুড়ি দেরি হবে।

আমরা ঘাটেই দাঁড়িয়ে আছি। অদূরে চেয়ে দেখলাম, একটি পাকুড় গাছ্। গাছের তলায় ছোট্ট একটি খোলা টিনের চালা। কোনও বেড়া নেই। গাছের আড়াল দিয়ে দেখা যাচ্ছিল কয়েকজন লোক চিতায় লাশ পোড়াচ্ছে। বুঝতে পারলাম এটি একটি শ্মশান ঘাট। যার কারণে জায়গাটা এত নির্জন। যার কারণে হয়তো এখানে কোনও জন বসতি নেই।

একটুপর ছোট ডিঙি খেয়া নৌকাটি ঘাটে এলো। আমরা গিয়ে নৌকায় উঠি। আরও তিনজন যাত্রী এলো। তারাও নৌকায় উঠলো।

আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল, ওপাড়ে যেয়ে একটি ভ্যান পাই। এবং ঐ ভ্যানে করেই বেলা বারোটার মধ্যেই ফুলসুতি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পৌঁছে যাই।

ফুলসুতি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার, নার্স, আয়া, পিওনসহ এলাকার গণ্যমান্যরা আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। কেন্দ্রটি আমরা যথাযথ ভাবে পরিদর্শন করি। দেখি এর নির্মাণ কাজ ও স্বাস্থ্য পরিসেবামূলক কার্যক্রম।

স্বাস্থ্য সেবা কেমন পাচ্ছে ঐ এলাকার মানুষ তা জানার জন্য দুপুরের পর গ্রামে বের হই। আমাদের সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিল দৈব চয়নের ভিত্তিতে কিছু সাধারণ মানুষ। আমরা একজোড়া দম্পতিকে পেয়ে যাই, নাম মোহনবাঁশি মালাকার আর তার স্ত্রী দিপালী মালাকার। তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য আমি ও নাসরীন চলে যাই মোহনবাঁশি'র বাড়িতে। ওনারা ছিল নিম্নবিত্ত শ্রেণির প্রান্তিক  মানুষ। একটিমাত্র ঘর তাদের। তারা এতই সহজ সরল ও আন্তরিক ছিল যে, ওনাদের থাকার ঘরটিতেই আমাদের বসতে দেয়।

আমি আর নাসরীন সবে বিশ্ববিদ্যালয় হতে বের হওয়া উচ্ছ্বল তরুণ তরুণী। আমাদের স্বাভাবিক কথাবার্তা প্রেমের কথার মতো মনে হয়। মোহনবাঁশি আর দিপালী ধরেই নিয়েছিল আমি আর নাসরীন হয়তো স্বামী-স্ত্রী কিংবা প্রেমিক প্রেমিকা।

তখন দুপুরঅন্ত পরন্ত বিকেল। বাইরে ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুর। পিছনে বাঁশ ঝাড়ে ঘুঘু ডাকছে। কেমন উদাস হাওয়া বইছে বাইরে। ঝরে পড়ছে ঝরা পাতা টিনের চালের উপর। নাসরীনের চোখে মুখে চঞ্চলতার দোলা। দেখলাম, মোহনবাঁশি আর দিপালী আমাদের দু'জনকে ঘরের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল। বন্ধ ঘরে তখন আমি আর নাসরীন, যেন সেই হিন্দী সিনেমার গানের মতো রোমান্টিক সময় পার করছি--' হাম তুম এক কামরা মে বন্দি হো, আউর চাবি খো যায়....।'

নাহ্ বন্ধ ঘরে আমাদের কোনো রোমাঞ্চ হয়নি।আমরা কোনো চাবিও হারাইনি। মোহন বাঁশীর বাড়ি থেকে বের হয়ে আমরা গ্রামের আরও কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নেই। সাক্ষাৎ গ্রহণ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সব কাজ শেষ করে সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ডাকবাংলোয় ফিরে আসার উদ্দেশ্যে একটি ভ্যানে করে খালপাড়ের দিকে রওনা হই।

গ্রামে আঁধার নামে খুব তাড়াতাড়ি। খালপাড়ে আসতে না আসতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যায়। হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। ভ্যানটি আঁধার ঠেলে খালপাড়ে চলে আসে। খেয়া নৌকার মাঝি তার নৌকাটি বেঁধে বাড়িতে চলে যাচ্ছিল। তাকে অনুরোধ করে নৌকা করে আমরা খালটি পার হই। খেয়ামাঝি বলছিল -- 'আপনারা কেন এই রাতে চলে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। ওপাড়ে যদি ভ্যান না পান?'

এপাড়ে এসে দেখি সত্যি কোনো ভ্যান নেই। কোনো মানুষজন নেই। মেঘ ডাকছে। বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। কী করব? খুব ভয় ভয় লাগছে। পিছনে ফিরে দেখি খেয়ামাঝি নৌকা ছেড়ে দিয়ে ওপাড়ে চলে যাচ্ছে।

আমরা রাস্তার উপর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। অপেক্ষা করতে থাকি ভ্যানের জন্য। ইতোমধ্যে গুড়িগুড়ি করে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে।

আমার মনে পড়ে গেল, যাওয়ার সময় পাকুড় গাছতলায় একটি টিনের চালা দেখে গিয়েছিলাম। আমি নাসরীনকে বললাম -- চলো, ঐ টিনের চালার নিচে গিয়ে দাঁড়াই। নাসরীনও বলল -- হ্যাঁ, তাই চলো।

আমরা দুটো মানব মানবী টিনের চালার নিচে দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টি আরও জোরে শুরু হয়ে যায়। চিতা থেকে লাশ পোড়ানো কাঠের উটকো গন্ধ আসছিল। বিদ্যুৎ চককানোর আলায় দেখতে পেলাম, পাকুড় গাছের ডাল ভর্তি শকুন বসে আছে। কুৎসিত স্বরে ডাকাডাকি করছে। একে অপরে কামড়াকামড়ি করছে। শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে।

নাসরীন বলছিল -- আমার খুব ভয় লাগছে। কী করব! আজ মনে হয় মরেই যাব।

আমারও খুব ভয় লাগছিল কিন্তু সে কথা নাসরীনকে বুঝতে দিলাম না। ওকে বললাম, ' বৃষ্টি থেমে যাবে। আমরা ভ্যান পেয়ে যাব।'

আমরা প্রার্থনা করছিলাম- বৃষ্টি যেন তাড়াতাড়ি ছেড়ে যায় এবং একটা ভ্যান যেন পেয়ে যাই। নইলে দেড় মাইল রাস্তা এই রাতে হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। এইসব ভাবছি, আর অসহায় চোখে তাকিয়ে আছি পথের দিকে।

হঠাৎ পিছনের দিক থেকে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমরা দুজনেই পায়ের শব্দ যেদিক থেকে আসছে সেই দিকে তাকাই। দেখি - খালের দিক থেকে একটা লম্বা গোছের লোক হেঁটে হেঁটে আসছে। সারা শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা। ভয়ে আঁৎকে উঠি। এযে মানুষ নয়! এ একটি লাশ। লাশ হাঁটে কী করে?  নাসরীন  ভয়ে আমার হাত চেপে ধরে। লাশ দেখতে না দেখতে দেখি -- এযে একটি  কঙ্কাল। কঙ্কালটি হেঁটে হেঁটে  অট্টহাসি দিয়ে আমাদের দিকে আসছে!  নাসরীন আমার বুকে বুক রেখে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে  ওঠে। ওর দুই হাত আমার দুই পাজর শক্ত করে ধরে থাকে। আমিও ভয়ে দুচোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকতে থাকি।

কিছুক্ষণ পর চোখ খুলি। দেখি কঙ্কালটি নেই। পাকুড় গাছের ডালে শকুন উড়াউড়ি করছে। বৃষ্টি আরও জোরে নামা শুরু করেছে। আমি নাসরীনকে বলি - কঙ্কাল নেই। চলে গেছে। নাসরীন আমার পাঁজর জড়িয়ে ধরা ওর হাত দুটো ছাড়িয়ে নেয়। 

কিছুক্ষণ ভালোই ছিলাম। বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘ গুরুম গুরুম করছে। হঠাৎ আবার কেমন যেন একটা গোঙানির শব্দ আসছিল পিছনের দিক থেকে। শব্দটা ক্রমেই খুব কাছে থেকে শোনা যাচ্ছিল। দেখি, কালো বিদঘুটে একটি লোক দাঁড়িযে আছে খালের পাড়ে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় দেখা যাচ্ছিল তার কুচকুচে শরীর। সে অনেকটা উলঙ্গ। সামান্য নেংটি পরে আছে। তার গলাটি কাটা। কাটা গলা দিয়ে রক্ত গলগলিয়ে ঝরে পড়ছে। আর গোঙাচ্ছে। ও বাবা! ঐ গলাকাটা লোকটা আমাদের দিকে হামলে আসছে গোঁ-গোঁ শব্দ করে। নাসরীন এবারও জোরে চিৎকার করে দুুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে আমাকে। এবং কাঁদতে থাকে হাউমাউ করে বুকে মুখ লুকিয়ে। আমিও আর্ত চিৎকার করে আল্লাহর নাম ডেকে চোখ বন্ধ করে থাকি। বেহুশ হয়ে কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিলাম জানিনা।

নাহ্ ঐ লোকটা আমাদের ছোঁয় নি। দুরুদুরু বুকে চোখ খুলি। তাকিয়ে দেখি, লোকটা নেই। আমরা ভয়ে ভয়ে দুজন দুজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকি।  বৃষ্টি একটু কমে গেছে। আমি নাসরীনকে ডাকি। বলি - চোখ খোলো। কিছু নেই। সব আপদ চলে গেছে। নাসরীন চোখ খোলে। বাহু বন্ধনও খুলে ফেলে আমার পাজর থেকে। বুক থেকে সরিয়ে নেয় ওর বুক।

একটু পর দেখতে পেলাম - রাস্তার দিক থেকে কয়েকজন যাত্রী নিয়ে একটি ভ্যান আসছে। পিছের আরও একটি ভ্যান যাত্রী নিয়ে খেয়াঘাটে এসে পৌঁছে। ওনারা খেয়ানৌকা ও খেয়ামাঝিকে খুঁজছে। আমরা একটি ভ্যানচালকের সাথে কথা বলে তার ভ্যানে উঠি। এবং চলে আসি ভুবনেশ্বর নদীর তীরে। তারপর খেয়া পার হয়ে রিকশায় ডাকবাংলোয়।

পরিশিষ্ট --

আমাদের চাকুরীটা ছিল খুব অস্থায়ী। কিছুদিনের মধ্যে নাসরীন অন্য জায়গায় চাকুরী নিয়ে চলে যায়। আমিও চাকুরী নিয়ে অন্যত্র চলে যাই। আমি আর নাসরীন পরবর্তীতে কেউই একে অপরের বন্ধু হতে পারিনি। তারপর কত বছর চলে গেছে!  কিন্তু অনেক আগের সেই দূর্যোগময় রাতের কথা, আমাকে জড়িয়ে ধরে নাসরীনের সেই প্রগাঢ় আলিঙ্গনের কথা, আমার বুকের ভিতর তার আশ্রয় নেবার কথা মনে হলে আজও আমি কেমন বিবশ হয়ে যাই। 

নাসরীনের কী মনে পড়ে না দূর্যোগময় সেই রাতের কথা? মেঘগুরুগম্ভীর অদ্ভূতুরে এক ভয়ার্ত ক্ষণে একটি ছেলের বুক জড়িয়ে ধরে সে নিরাপদে ছিল কিছুক্ষণ! তার বুকের মাঝে মাথা রেখে পরম আশ্রয়ের কথা মনে করে আমার মতো তারও মন কী একটুও বিবশ হয়ে উঠে না!

হয়তো উঠে, হয়তো না। 



১৫.        ধলেশ্বরী বহমান



তখনও মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়নি। কিন্তু মেঘ না চাইতেই জল পাওয়ার মতো প্রাপ্তি। চাকুরির আবেদন পাঠাতে না পাঠাতেই একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ পদে আমার চাকুরি হয়ে যায়।

মতিঝিলে অফিস। নতুন চাকুরিস্থলে ভালই লাগছে আমার। সবাই আমাকে খুব সহযোগিতা করছে। সবাই আমাকে ভালোবাসে।

একদিন এক সিনিয়র সহকর্মীর সাথে আমি পুরনো ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার ও ইসলামপুরে গিয়েছিলাম ওখানকার কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করতে। আমরা মতিঝিল থেকে একটি রিকশা নিয়ে প্রথমে চানখাঁর পুল গিয়ে নামি। ওখান থেকে হেঁটে নাজিমুদ্দিন রোড ধরে সেন্ট্রাল জেল পর্যন্ত যেতেই আমার সিনিয়র সহকর্মী মাহবুব ভাই বললেন -- বেগমবাজারে আমার এক মামাত ভাই থাকেন। শুনেছি দীর্ঘদিন ধরে উনি বেশ অসুস্থ। এদিকে যেহেতু আসলামই। ওনাকে একটু দেখে তারপর আমাদের কাজ শুরু করব।'

আমরা হেঁটে হেঁটেই বেচারাম দেউরি পার হয়ে একটি সরু গলিতে ঢুকি। গলির একদম শেষ মাথায় অনেক পুরানো একটি আধাপাকা টিনসেড বাড়ি। সেই বাড়িতে ওনারা থাকেন। বাড়িটার বাইরে পলেস্তারা খসে পড়ে গেছে। ফাটলের ফাঁক দিয়ে প্রচুর লতাগুল্ম জন্মেছে। গলির সাথে সদর দরজা। এই দরজা দিয়েই সরাসরি রুমে ঢুকতে হয়।

মাহবুব ভাই দরজায় কড়া নাড়তেই একজন পয়ত্রিশ-উর্ধ্ব বয়সী লোক দরজা খুলে দেন। বুঝতে পারলাম, ইনিই আমার সহকর্মী মাহবুব ভাইয়ের আত্মীয়।

ঘরখানা দেখে মনে হলো- দুটো রুম এখানে। পাশে একটা ছোট বারান্দার মতো আছে , সেটাও রুমের মতোই, রান্নাঘর হবে। আমরা প্রথম রুমটাতেই বসলাম। ঘরের আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিস সামগ্রী দেখে মনে হলো, এরা হতদরিদ্র।

মাহবুব ভাই, লোকটির সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওনার নাম জাকির হোসেন মন্টু। উনি একজন ভালো হারমোনিয়াম ও তবলাবাদক। গানও গান। গানের শিক্ষকও তিনি। পুরনো ঢাকার একটি গানের স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। ওনাকে দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কেমন রোগক্লিষ্ট। শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। গায়ের রং ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হলো, উনি একসময় সুদর্শন ছিলেন। চোখ কোটরে গেলেও চোখদুটো দেখতে বেশ টানা টানা। লম্বা দেহগড়ন, কণ্ঠস্বর অপূর্ব মাধুর্যময়। পুরুষও এত সুন্দর হয়!

ওনার সাথে আলাপচারিতার মধ্যেই উনি পরপর দুটি সিগারেট খেয়ে ফেললেন। আমি অবাক হলাম, এমন একজন রোগা মানুষ এত সিগারেট খায়? ওনাকে বললাম - ভাই আপনি এত সিগারেট খান কেন? আপনার শরীরের যে অবস্থা, এত সিগারেট খাওয়া ঠিক নয়।' উনি ম্লান হেসে বললেন -- 'আমি সব ছেড়ে দিতে পারি- আমার গান, হারমোনিয়ামের সুর, তবলার ঝংকার, ঘর, সংসার, স্ত্রী, স্বজন সব। কিন্তু সিগারেট ছাড়তে পারব না। সিগারেট ছাড়া আমি বাঁচতে পারব 
না।'
-- আপনি তো সিগারেট খেতে খেতে মরে যাবেন।
-- মরে গেলে মরে যাব। তবুও।

জীবনে অনেক সিগারেটখোর মানুষ দেখেছি। কিন্তু এমন মৃত্যুর সাথে জুয়া ধরে সিগারেট খেতে কাউকে দেখিনি। লোকটিকে দেখে রাগও হলো, আবার মায়াও হলো। জানিনা, জীবনের কোন্ পরাজয়ে তার এই অধপতন!

আমরা যখন কথা বলছিলাম -- তখন পাশের রুম থেকে আধো ঘোমটা দিয়ে একজন স্ত্রীলোক চলে আসেন আমাদের বসার ঘরে। গায়ের রং ফর্সা তার, কালো চুল, মায়া জড়ানো দুটো চোখ, হ্যাংলা পাতলা দেহগড়ন, বয়স কতই হবে- সাতাশ আটাশ। কী অপূর্ব সুন্দর সে দেখতে। একদম ছবির মতোন!

মাহবুব ভাই পরিচয় করে দিলেন ইনি আমাদের রোজী ভাবী। আমাকে দেখিয়ে বললেন -- ও আমার জুনিয়র কলিগ - আরিফ রহমান। মাহবুব ভাই ওনাকে রসিকতা করে বললেন, ভাবী, তুমি ওকে দেবরও ভাবতে পারো, ছোট ভাইও মনে করতে পারো। খুব ভালো ছেলে। একদম সহজ সরল।

মনে মনে কামনা করছিলাম, আমি এই অপূর্ব সুন্দর মেয়েটির দেবর হতে চাই না। ছোট ভাই হতে চাই। কেমন যেন দিদি দিদি সরল মুখোয়ব তার। কিন্তু উনি আমার এই আশাকে হতাশ করে দিয়ে সহাস্যে বললেন -- ' এ আমার নবীন দেবর'।

মন্টু ভাই ওনাকে বললেন, ' রোজী, তা তোমার এই দেবরদ্বয়কে নাস্তাপানি কিছু খেতে দাও।' এ কথা শুনে রোজী ভাবীর মুখটা মলিন হয়ে যায়। বুঝতে পারলাম, খেতে দেওয়ার মতো ঘরে হয়তো তেমন কিছু নেই। মন্টু ভাইও বুঝতে পেরে বললেন - 'বাইরে থেকে কিছু কিনে নিয়ে আসো'। এবারও ভাবীর মুখটা আরও বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেল। বুজতে পারলাম, ঘরে হয়তো টাকাও নেই।

ভাবী চলে গেলেন।

এরই ফাঁকে অনেক কথাই হচ্ছিল মন্টু ভাইয়ের সাথে। একসময় তিনি রেডিওতে তবলা ও হারমোনিয়াম বাজাতেন। বড়ো বড়ো গানের অনুষ্ঠানে যেতেন যন্ত্রীদলের সাথে। অসুখের কারণে এখন আর যেতে পারেন না।

আলাপের মাঝেই মন্টু ভাই আরও দুটো সিগারেট খেয়ে ফেললেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম, ওনার নানাবিধ রোগ। ডায়বেটিস, ফুসফুসে ইনফেকশন। লিভার ও কিডনির অবস্থাও ভালো নেই। রোগগুলো ক্রনিক হয়ে গেছে। কয়েকটি গানের টিউশনি করত। অসুখের জন্য তা কমিয়ে দু-তিনটি করে এখন। গানের স্কুলেও যেতে পারে না। হঠাৎ করেই যে কোনো সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। নেবুলাইজার নিতে হয়। শ্বাস কষ্টের কারণে আগের মতো সুর তুলতে পারে না কণ্ঠে। আঙুলও ঠিক মতো চালাতে পারেন না হারমোনিয়ামের রীডে, তবলায়ও তাল তুলতে পারেনা আগের মতো। হাত কাঁপে।

একটু পর রোজী ভাবী পুরানো ঢাকার বাকরখানি ও দুধের ছানা খেতে দিলেন। চা বানিয়েও খাওয়ালেন। আমাদের খাওয়া শেষ হলে মাহবুব ভাই বললেন- আমরা আজ আসি। মন্টু ভাই বললো, তোমরা আবার এসো।

এতক্ষণ রোজী ভাবী আমার সাথে একটি কথাও বলেনি। বিদায়কালীন সময়ে আমার দিকে আনত চোখে চেয়ে বললেন- 'নবীন দেবর, তুমি ভুলে যেওনা এই ভাবীকে। এসো আবার।'

আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম - আসব।

এর মধ্যে প্রায় দেড় মাস চলে গেছে, মন্টু ভাই ও রোজী ভাবীকে দেখতে যাওয়া হয়নি। এর কারণও ছিল, ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে পুরনো ঢাকার ঐদিকটায় আর যাওয়া পড়েনি। সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিল-- মাহবুব ভাই আমাদের অফিস ছেড়ে অন্য কোম্পানিতে চাকুরি নিয়ে চলে গেছে। তাও ঢাকায় নয়, একেবারে চট্টগ্রামে। উনি থাকলে হয়তো যাওয়া হতো।

এর মাঝে রোজী ভাবীদের কথা মনে পড়েছে আমার। প্রায়ই ইচ্ছে হতো আমি একাই যেয়ে ওনাদের দেখে আসব। কিন্তু কেমন যেন সংকোচ অনুভব করতাম। আমি ওনাদের তেমন কেউ না। কোনও আত্মীয়ও নই - হঠাৎ এমনি করে চলে যাব? কী মনে করবে তারা? যদি ভাবে রোজী ভাবীর প্রতি আমি দূর্বল। যদি মনে করে কার জন্য এত টান? গায়ে পড়ে কেন দেখতে যেতে চাও? কার জন্য তুমি যেতে চাও?

রোজী ভাবীর জন্যই আমার যেতে ইচ্ছে করে। ওনার প্রতি কেন জানি আমার মায়া জন্মে গেছে। এই মায়াটা কেন হচ্ছে বুঝতে পারিনা। তারা গরীব! অসহায়! এই জন্য? তাহলে তো করুণা হয়ে গেল। কিন্তু এ যে করুণাও নয়। সেদিনের বিদায়কালীন সময়ে ভাবীর সেই কথা এখনও কানে বাজে -- 'নবীন দেবর, তুমি ভুলে যেওনা এই ভাবীকে। এসো আবার।' 

সব দ্বিধা দূর করে একদিন ছুটির দিনে আমি রোজী ভাবীর বাসায় আবার যাই। ভাবী আমায় দেখে খুশি হলেন। মন্টু ভাই খাটের উপর শুয়ে আছে। শরীরটা আরও বেশি খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে দেখে উনি উঠে বিছানায় বসলেন। এবং বললেন - খুশি হলাম তুমি এসেছ।  

মন্টু ভাই সিগারেট ধরালেন। আজও ওনাকে বললাম -  আপনি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিন মন্টু ভাই। 

ভাবীকে বললাম - আপনি সিগারেট খাওয়া ছাড়াতে পারেননি? 

-- পারিনি। ওর আরও অনেক খারাপ অভ্যাস ছিল। যেমন, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকা। সুরা পান করা। সময় মতো আহার না করা। বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি করা। এই সবগুলো ছাড়াতে পেরেছি। শুধু সিগারেট খাওয়া বাদ দেওয়াতে পারিনি। 

ভাবী বলছিল - 'তুমি এসেছ ভালোই করেছ। আমরা এখানে আর বেশি দিন থাকব না। তুমি না এলে তোমাকে আর হয়তো দেখতে পেতাম না।'

বললাম - কোথায় চলে যাবেন? 

-- তোমার মন্টু ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি নাগরপুরে।

ভাবী আরও বললেন -- এখানে আমরা আর থাকতে পারছি না। তোমার মন্টু ভাইয়ের আয় রোজগার আর নেই বললেই চলে। মাস শেষে বাড়ি ভাড়া দিতে পারিনা।  দেশের বাড়িতে কিছু জমিজমা আছে, তাই থেকে জীবন চলবে। ওখানে কুমুদিনী হাসপাতালে তোমার ভাইয়ের চিকিৎসাও করানো যাবে। 

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এরা আমার আপন ভাই ভাবী নয়, তাই বলে কী এদের জন্য আমি কিছু করতে পারি না? কিন্তু কতটুকুই বা করতে পারব? সাময়িক দানে এদের কী চিরদিনের করে ঢাকায় রাখতে পারব? আর আমার দান ওনারা গ্রহণও করবে না। 

সেদিন রোজী ভাবীর ওখান থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় ভাবীর হাতে জোর করে কিছু টাকা দিয়ে বলেছিলাম -- 'মন্টু ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য রাখেন।' রোজী ভাবী গ্রহণ করতে চাননি। আমি বললাম- 'আপনি না আমাকে দেবর ডেকেছেন। আমি মন্টু ভাইয়ের ছোট ভাইয়ের মতো।'  দেখলাম, ভাবীর চোখদুটো জলে ছলছল করে উঠেছে। 

অফিসের কাজের চাপে বেশ কিছুদিন রোজী ভাবীর ওখানে  যাওয়া হয়নি। সেদিন অফিস থেকে একটু আগেই বের হই। একটি রিকশা নিয়ে চলে যাই জেলখানা পর্যন্ত। ওখান থেকে হেঁটে ভাবীর বাসায়। গিয়ে দেখি, সব জিনিসপত্র তারা গুছিয়ে বেঁধে রেখেছে। ভাবী নিজ থেকেই বললো - কাল সকালে চলে যাচ্ছি গ্রামের বাড়ি। তুমি একবার নাগরপুরে চলে এসো আমাদের দেখতে। ভুলে যাবে না। 

ভাবীকে বললাম - ভুলব না।  

মন্টু ভাইয়ের হারমোনিয়ামটা দেখলাম বিছানার উপরে পড়ে আছে। তবলা দুটোও আছে একপাশে। মনটা এত খারাপ লাগছিল যে কান্না পাচ্ছিল খুব। মন্টু ভাইকে বললাম, মন্টু ভাই একটা গান গেয়ে শোনান না! 

মন্টু ভাই সিগারেট ধরালেন, বললেন- আমার কণ্ঠ নষ্ট হয়ে গেছে, গাইতে পারি না। তোমার ভাবীও গান জানে। সেই শোনাক তোমাকে গান।

মন্টু ভাই ভাবীকে বললো - তুমি আরিফকে একটা গান গেয়ে শোনাও। 

মন্টু ভাই বলছিল, জানো আরিফ, আমার গান শুনেই তোমার ভাবী আমাকে ভালবেসেছিল। আর আমিও তোমার ভাবীর গান শুনে তাকে ভালবেসেছিলাম। দুজন একসাথে বসে কত রাঙা ভোরে হারমোনিয়ামে কণ্ঠ সেধেছি। কত বৃষ্টির দিনে গেয়েছি বর্ষার গান। কত হেমন্ত রাত্রি নিদ্রাহীন করে কাটিয়ে দিয়েছি গুনগুন করে গানে গানে। গেয়েছি দুজন যুগল কণ্ঠে -

আমরা এমনি এসে ভেসে যাই
আলোর মতন, হাসির মতন
কুসুমগন্ধ রাশির মতন
হাওয়ার মতন, নেশার মতন
ঢেউয়ের মতন ভেসে যাই।

আমি জানতাম না রোজী ভাবীও গান গাইতে পারে। আমিও ওনাকে বললাম, গেয়ে শোনান না ভাবী একটি গান। ভাবী নিজেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইলেন-

প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে   আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে   আরো আরো আরো দাও স্থান ॥
আরো আলো আরো আলো
এই      নয়নে, প্রভু, ঢালো।
সুরে সুরে বাঁশি পুরে
তুমি    আরো আরো আরো দাও তান ॥

ভাবী এমন করে গানটি গাইলেন যেন সহসা বেগম বাজারের একটি সরু গলির জীর্ণ পলেস্তারা খসে পড়া একটি কক্ষ বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল। মন্টু ভাই তবলায় তাল দিচ্ছিল, তার হাতটাও তবলার উপর হিম হয়ে থেমে গেল। গান শেষে রোজী ভাবীর চোখ কেমন আদ্র হয়ে উঠল। তার সেই  নিমীলিত চোখের তারায় জগতের অনেক অশ্রু যেন টলমল করছে। ঘরের ভিতরকার স্বল্প আলোয় তা সে লুকাতে পারল না।

সেদিনের সেই স্তব্ধবাকের  বিকালে একটা কথাই ভাবছিলাম, মানুষের কত অজানা বিস্ময় অজানা থাকে অন্য কারোর কাছে। এমন কত জীর্ণ কুটিরে কত বিস্ময়কর প্রতিভা আলোহীন হয়ে পড়ে থাকে নিবিড় আঁধারে। কেউ তাকে হাত ধরে আলোতে নিয়ে আসেনা। 

ভাবী ক্ষীণ কণ্ঠে আঁধার নেমে আসা সেই সন্ধ্যায়  বলেছিল-- 'এসো ভাই তুমি আমাদের বাড়ি। এসো তুমি। ধলেশ্বরীর তীরে ঘুরতে ঘুরতে তোমাকে শোনাব আরও গান। নৌকায় ভেসে ভেসে চলে যাব দূর বালুচরে। ওখানে ফুটে থাকে অজস্র কাশফুল। উড়ে সেখানে ধবল বক, পানকৌড়ি। দেখব আকাশ জুড়ে শরতের শুভ্র মেঘমালা।'

আমি রোজী ভাবীর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সরু গলি ধরে হাঁটতে থাকি। পা চলছিল না মোটেই। পিছনে ফিরিয়ে দেখার কিছু নেই। খালি মনে হতে লাগল - কেউ মনে হয় গোপনে টপটপ করে চোখের জল ফেলছে। ল্যাম্পপোস্টে একটি বাতিও তখন জ্বলেনি। কেমন আঁধার হয়ে আছে গলিটা। নেড়ি কুকুর ভুগ ভুগ করছিল অপরিচিত আমাকে দেখে। বেগম বাজারের মোড়ে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে কতকগুলো ছেলে বলছে -- '' নীল ছবি, নীল ছবি, ব্লু, ব্লু, সুইডিশ-সুইডিশ, ইতালিয়ান- ইতালিয়ান।'' বুঝতে পারলাম এখানে বিভিন্ন বাড়িতে ভিসিআরে  নীল ছবি দেখানো হয়। আমি ওদিকে কান দিলাম না। একটি টং দোকান থেকে একটি সিগারেট কিনে ধরাই। কোথাও না দাঁড়িয়ে সিগারেটটি টানতে টানতে হেঁটে চলে আসি চানখাঁর পুল। ওখান থেকে রিকশায় আমার মেসে।  

কদিন খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। কী এক যাতনা হতো বুকের ভিতর। অফিসে মনমরা হয়ে থাকতাম। লেখার সময় কলম চলত না। খিদে পেলেও খেতে মন চাইত না। মানুষ তার বর্তমান দুঃখকেই মনে হয় বড় করে দেখে। আমিও তাই দেখতাম। এমনি এমনি চোখ থেকে জল ঝরে পড়ত। 

তারপর আস্তে আস্তে সব ভুলে যাই। সময় বহিয়া যায়। অতীতের স্মৃতি চাপা পড়তে থাকে মধুময় বড়ো কোনো প্রাপ্তিতে। কর্মক্ষেত্রে সুনাম বাড়তে থাকে আমার। ভালো জায়গায় ভালো অফারে নতুন চাকুরি নিলাম। অনেক বড়ো কর্তাব্যক্তি হয়ে উঠলাম। ঘরে অসম্ভব সুন্দরী মায়াবতী বউ এল। সন্তান এল। কবেকার এক মন্টু ভাই ও একজন রোজী ভাবী মনের অতল গহীনে চাপা পড়ে গেল। যে রোজী ভাবী একসময় আমার মনকে এমন করে আলোড়িত করেছিল, সময়ের বিবর্তনে তাকে কী নিমিষেই ভুলে গেলাম। যদিও মাঝে মাঝে মনে হতো - একবার চলে যাই ধলেশ্বরীর তীরে, খুঁজে দেখে আসি হতভাগী রোজী ভাবীকে। যখনই ভাবতাম এইসব কথা, তখনই ছায়ার মতো সামনে এসে দাঁড়াত আমার মায়াবতী স্ত্রী। তার মুখের ঔজ্জ্বল্যের কাছে রোজী ভাবীর মুখখানি নিষ্প্রভ হয়ে যেত। নিমগ্ন আঁধারে হারিয়ে যেত রোজী ভাবীর ধূসর মুখ। 

বছর সাতেক পরের কথা। একবার বাসে করে সিরাজগঞ্জে বাড়িতে যাচ্ছিলাম। বাসটি একসময় মির্জাপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে থামে। আমি জানালার কাছের সিটে বসা ছিলাম। বাইরে পথের উপর তাকিয়ে দেখি, একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার সাদা সুতি শাড়ি। অনাড়ম্বর তার বেশভূষা। মুখে কোনো প্রসাধনী মাখা নেই। আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটিকে। চিনতে পারলাম তাকে। এ যে আমার রোজী ভাবী। আমি বাস থেকে নেমে পড়ি। কাছে গিয়ে ডাক দেই - 'ভাবী'। 

রোজী ভাবী আমাকে চিনতে পারে। সে বললো - তুমি এখানে!

- বাসে বাড়িতে যাচ্ছিলাম, আপনাকে দেখে নেমে পড়ি। তা আপনি এখানে? 

- হ্যাঁ, আমি এখানে আসি প্রতি বছর এইদিনে।

কুমুদিনী হাসপাতালটি দেখিয়ে রোজী ভাবী বললেন-- আজ থেকে ছয় বছর আগে এই হাসপাতালের একটি বেডে তোমার মন্টু ভাইয়ের প্রাণ চিরতরে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমি আসি এখানে এইদিনে। হাসপাতালের একটি প্রকোষ্ঠে সেই বেডটির কাছে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাই তোমার মন্টু ভাইকে। দেখি, কী সুন্দর করে সে ঘুমিয়ে আছে। আমি তাকে ছুঁয়ে দেখি। তার হিম হয়ে যাওয়া শরীরের স্পর্শ অনুভব করি। আমি কান পেতে শুনি তার আত্মার স্পন্দন! 

-- খুব খারাপ লাগছে মন্টু ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে। আল্লাহ ওনাকে বেহেশতে রাখুন।' ভাবীকে বললাম - আপনি এখন কোথায় থাকেন? 

-- নাগরপুরে ধলেশ্বরী নদীর তীরে ছায়া ঘেরা একটি গ্রামে। তোমার মন্টু ভাইয়ের সমাধি সেখানে। ওখানেই আমি থাকি। ওখানকার একটি স্কুলে ছোট ছোট বাচ্চাদের গান শিখাই। সময় কেটে যায়। প্রথম প্রথম খুব একাকী লাগত। তোমার কথা খুব মনে হয়েছে।  তা তুমি বিয়ে করেছ নিশ্চয়ই। 

--  জ্বী। 
--  বউ দেখতে কেমন? 
--  আপনার মতো। ওর মুখে আপনার ছায়া দেখতে পাই। 
-- নাম কী?
-- মহুয়া। 
-- বাচ্চা হয়েছে? 
-- জ্বী। একটা মেয়ে । 
-- কার মতো দেখতে হয়েছে ? 
-- মায়ের মতো। 
-- নাম কী?
-  রোজ। 
-  খুশি হলাম। 

আমি রোজী ভাবীকে বললাম -- 'ঢাকায় আর স্থায়ী হবেন না কখনও ? আসবেন না? 

-- না। এখানেই ভালো লাগে। মনখারাপ হলে চলে যাই ধলেশ্বরীর তীরে। কী অপরূপ রূপে ধলেশ্বরী বহমান।  শীতল বাতাস বয়ে আসে চরাচরের কাশফুলের সুবাস মেখে। সে বাতাস এসে লাগে আমার গায়ে। দেখি, দিগন্ত জুড়ে খোলা আকাশ। কী যে ভালো লাগে তখন। ভুলে যাই সব বঞ্চনার কথা।

বাসটি এতক্ষণ অতিরিক্ত বেশ কয়েক মিনিট দাঁড়িয়েছিল আমার জন্য। চালক ভেঁপু বাজাচ্ছিল বারবার। রোজী ভাবীকে বললাম -  যেতে হবে। আসি ভাবী। 

-- এসো। 

আমি দ্রুত এসে বাসে উঠি। জানালার কাছে সিটে বসতে না বসতে বাসটি অনেকদূর চলে আসে। জানালা দিয়ে তাকাই বাইরের দিকে। কিন্তু রোজী ভাবীকে আর দেখতে পেলাম না। ততক্ষণে সে আড়াল হয়ে গেছে। 

_________________________________
ডিসক্লেইমার --
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অতসী মামি' গল্পটি পড়ে  অনুপ্রাণিত হয়ে এই লেখাটা লিখেছি  । 


১৬.         পৃথিবী


'যে ভালোবাসা দূরের, যার ব‍্যপ্তি বিশ্বলোক ছাড়িয়ে অপার্থিব অন‍্য কোনো ভূবনে বিরাজ করে। সেই ভালোবাসার জন‍্য বৈরাগ্য জীবনই শ্রেয়। পার্থিব অন‍্য আর কোনো মায়ায় জড়িয়ে যেতে নেই।' এই কথা গুলো বলছিল আয়ান হায়দার। আয়ান এসেছিল লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে বাংলাদেশে। যাযাবরীয় জীবন তার। এখানে সে এসেছিল কোনো সুশৃঙ্খল জীবনের সাথে নিজেকে শৃঙ্খলে জড়াতে। কিন্তু করেনি। এলমেল জীবন যেমন ছিল তেমনই নিয়ে সে আবার ফিরে যাচ্ছে।

আয়ান চলে যাচ্ছে। আমি জানি, ওর এলমেল জীবন আরও বেশি অগোছালো হয়ে যাবে। দুই দিন কর্মে থাকবে তো, তিন দিন ঘুরবে ভবঘুরের মতো। বড়ফ পড়া শীতের রাত্রিতে কোনো পর্বতের পাশে তাঁবু টানিয়ে ক‍্যাম্প ফায়ার জ্বেলে উত্তাপ নিবে। ওর নিরুত্তাপ জীবনের উষ্ণতা খুঁজবে, তুষার পড়া রাত্রি দুপুরে।

ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল এমনি এক শীতের রাত্রিতে লস এ্যাঞ্জেলসের ডাউন টাউনে একটি কফিশপের দোতলায়। আমি ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, পদ্মা যমুনা মেঘনা পাড়ের কেউ একজন হবে। আগ বাড়িয়ে আমিই পরিচিত হয়েছিলাম। বয়সে আমার তিন চার বছরের ছোট হবে। কিন্তু আমি ওর ক্ষণিক বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম আমার সেই ক্ষণকালের প্রবাস জীবনে। 

আমার সেই ক্ষণকালের প্রবাস জীবনে ওর সাথে কয়েকটি বিকেল কাটিয়েছিলাম প‍্যাসিফিকের তীরের লং বীচ, মালিবু ও সান্তা মনিকায়। এক রাত কাটিয়েছিলাম ওর বাড়িতে। আর একদিন দুজনে সারারাত কাটিয়েছিলাম ডাউন টাউনের গ্রান্ড পার্কের বেঞ্চের উপরে।

মালিবু বিচের বালুকাবেলায় একদিন দুজন হাঁটছিলাম। আমাদের পিছনে ছিল পাহাড়। সামনে প‍্যাসফিকের বিশাল জলরাশি। একদিকে নাম না জানা কতো লতাগুল্ম আর থোকা থোকা ফুলের ঝাড়, আর অন‍্যদিকে বিকালের লাল মেঘের আভা মিশ্রিত রুপালি জলের ঢেউ। কথা বলছিলাম আমরা সাগরের দিকে মুখ চেয়ে। কেন যেন মনে হলো, আয়ানের মুখ বিষণ্ণ! মুখ ফিরে চেয়ে দেখি --  আয়ানের চোখের নীচে যেন প‍্যাসিফিকের লোনা জল। দেখলাম, মলিন হতশ্রী মুখচ্ছবি ওর। বিকালের রক্তিম সূর্যের রশ্মি সেই মুখকে একটুও রোশনি ছড়াতে পারেনি।

আমি আয়ানের পিঠে হাত রেখে বলেছিলাম, 'তুমি এমন একলা কেন? এখানে এই পরবাসে তোমার কেউ কী নেই? কদিনের দেখায় মনে হয়েছে, কোথায় কোন্ গভীরে, প‍্যাসিফিকের ঐ অতলান্তে তুমি তোমার অসীম কোনো দুঃখকে লুকিয়ে রেখেছ।' সেদিনের সেই নিমগ্ন সাগর বিকালে দূর হতে দমকা বাতাস বয়ে এসেছিল। আয়ানের এলমেল খুসকো চুল হাওয়া লেগে উড়ছিল। কিছুই বলতে চায়নি আয়ান, আবার বলতেও চেয়েছিল কী যেন কথা।

সেদিন মালিবু বীচের অপ্রসন্ন সেই বিকালে কিছুই বলেনি আয়ান। বলেছিল আর একদিন ওর বাড়িতে। ওয়েল ডান কার্ণ কান্ট্রি এরিয়াতে নিরিবিলি ছোট্ট একটি রেন্ট বাড়িতে ও একাই থাকত। গ্রামীণ ছিমছাম একতলা বাড়ি। ঐদিন ঐ বাড়িতে আমি রাত্রিবাস করেছিলাম। বাড়ির পিছনে ছোট্ট একটি বারান্দা ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা সেই বারান্দায় বসে কথা বলেছিলাম। অনেক কথাই সেদিন হয়েছিল।

আয়ানের বাড়ির বারান্দায় বসে সন্ধ্যায় দেখেছিলাম পিছনে একপাশে টিউলিপ ফুলের প্রান্তর, আরেক পাশে লিলি। মাঝখানে মেঠো পথের দুপাশে কার্ণেশনের ঝাড়। আমরা বসে যখন কথা বলছিলাম, তখন পিছনের প্রান্তর থেকে এইসব ফুলের গন্ধ আসছিল। রাত বেড়েই চলছিল। আয়ান আমাকে ওয়াইনের ওফার করেছিল। আমি বললাম, না। শুধু সিগারেট। এ‍্যাস্ট্রেতে এক এক করে পোড়া সিগারেটের ছাই দিয়ে ভরে উঠছিল। 

তখন ভালো লাগছিল ওয়েল ডান কান্ট্রির আকাশ। মনে হয়েছিল এ যেন বাংলাদেশের আকাশ! এ যেন আমাদের কুসুমপুরের তারাভরা রাত্রি। মাঝে মাঝে হিম প্রবাহ বয়ে আসছিল দূরের সান গাব্রিয়েল মাউন্টেন থেকে। সেদিন তারার আকাশে কোনো কথা ছিল না।  টিউলিপ ঝাড়ে কোনো জোনাকির গান নেই। বাতাসের কোনো শব্দ নেই। নিশ্চুপ ছিল নির্জন বিজন রাত। কী এক বিষাদ ছড়িয়ে সেদিন সেই রাতে আয়ান হায়দার বলেছিল তার কথা।

খুব সংক্ষেপিত করে আয়ানের মুখ থেকেই সে কথা শুনি:

মেয়েটির নাম ক‍্যাথেরিন রিচি। আমি ওকে ডাকতাম রিচি বলে। ও এসেছিল ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো থেকে। রিচি ছিল একজন স্ট্রিপ গার্ল। প‍্যাসাডোনার নাইট ক্লাব ক্রেইক এ‍্যাভিনে ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। নীল ঝলমলে আলোর নীচে আমি ওর বাঙালি মেয়েদের মতো কালো চোখ দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম।  ওর ঐ চোখ দেখেই আমার ভাল লেগেছিল। প্রথম কথা ছিল, 'তুমি কে? কোথা থেকে তুমি এসেছ। তোমার নাম কী?' তারপর বলেছিলাম, 'তোমার কথা কিছু বলো।' রিচি বলেছিল --  I am Katherine Ricci , came from Reo de Jenerio, Brazil. I am no bird, and no net ensnares me, I am a free human being with an independent will.' 

রিচির কোনো ঘর ছিল না। পাখির বাসার মতো আশ্রম ছিল না। কিন্তু, সেই মেয়ে পাখির মতো নীল আকাশে উড়ত। রিচি বলেছিল -- 'আমি ধূসর কালো মেঘ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির জলে ভিজি। রঙিন জলসায় পিয়ানো'র সুরে আমার অন্তর বীণা বাজে। আমার দুঃখ নেই। আমার সমস্ত বেদনা সুখ হয়ে যায় মূহুর্তে এই সব নৈশ ক্লাবের আনন্দে।'

আয়ান একের পর এক সিগারেট শেষ করছিল। আমি বললাম, 'তারপর কী হলো? ঐ মেয়েকে তুমি কী ভালোবেসে ফেলেছিলে?'

আয়ান :  জীবনের দুঃখতম নিয়তি ঈশ্বর মনে হয় নির্ধারিত করে রেখেছিল আমার জন্য। যে পাখির বাসা নেই। তার বাসা পৃথিবী জুড়ে নীল আকাশ। আমি রিচিকে এই ঘরে এনেছিলাম, বলেছিলাম-- এই ঘর তোমার। এখানেই তুমি তোমার সংসার বাঁধো। তোমাকে সন্তান দিব।

রিচির চোখ সত্যি বাঙালি। শাড়ি পরিয়েছিলাম ওকে বিয়ের রাত্রিতে। কী সৌভাগ্য! বাসর শয‍্যায় ওর ভ্রূণ তৈরি হলো। এক অনাগতের স্পন্দন ধ্বনি সেই রাতেই শোনা গেল।

আয়ান একের পর এক সিগারেট টেনেই যাচ্ছিল। কথা বলতে যেয়ে থেমে থেমে যাচ্ছিল বার বার। আমি বললাম -- তারপর ?

আয়ান : আমাদের সেই সন্তানটির পৃথিবীতে চলে আসবার দিন ক্ষণ খুব কাছাকাছি চলে আসতে থাকে। উইলশেয়ার বেলেভার্ডের সামারিতান হসপিটালে রিচির  একটি চেক আপ ছিল। ডাঃ লী জয়নার ওকে হসপিটালে ভর্তি করে নেয়।

আয়ান আমাকে বলছিল, তুমি কী গান গাইতে পারো রঞ্জন? আমি বলেছিলাম -- ভালো পারি না। 
--- তবুও শোনাও।
--- কী গান গাইব, বলো?
--- রবীন্দ্রনাথের গান।
--- কোন্ গানটি গাইব?
--- জীবন যখন শুকায়ে যায়।
--- আচ্ছা, গাইছি।

অন্তরা পর্যন্ত গানটি আমি সেই দিন আয়ানকে গেয়ে শোনায়েছিলাম। শেষটুকু আর গাওয়া হয়নি। রাত তখন অনেক হয়ে গিয়েছিল। হিম বাতাস বয়ে আসছিল প্রবলবেগে। মনে হচ্ছিল, কার্নেশন, আর টিউলিপ ঝাড়ে জলের মতো বিন্দু বিন্দু করে তুষার ঝরে পড়ছে।

আমি আয়ান হায়দারকে বলি -- তারপর?
আয়ান : একদিন হসপিটাল বেডে শুয়ে থেকে রিচি আমাকে বলেছিল --- যদি দূরে চলে যাই। জীবনের ওপাড়ে যদি অন‍্য কোনো ভূবন থাকে, সেই ভূবনেও তুমি এসো।

কতো প্রহর, কতো ক্লান্তিতে পথ ধরে হাঁটছি। আকুল হয়ে অপেক্ষায় আছি ওর ভুবনে পৌঁছার। কিন্তু ওর সেই ভুবন ওর সেই পৃথিবী যে অনেক দূর!



১৭.          ঝুমকা



মধ্য কার্তিকের এক মৌন অপরাহ্ণে  বাড়ির পুকুরপাড়ে একাকী বসেছিলাম। পুকুরপাড় থেকে একটি মেঠো পথ  চলে গেছে দক্ষিণ দিগন্তের দিকে। যতদূর দৃষ্টি যায়  চোখ মেলে চেয়ে দেখছিলাম আদিগন্ত । পথের দুপাশে আধাপাকা ধানগাছ ঈষৎ নুয়ে পড়েছে। সরিষার ক্ষেতগুলো দেখতে লাগছিল হলুদ গালিচার মতো। হঠাৎ দেখতে পাচ্ছিলাম- দিগন্ত ভেদ করে ছায়ার মতো কেউ একজন মেঠো পথ ধরে এগিয়ে আসছে সামনের দিকে। একটু পর দেখি, একজন নয় দুজন। আরও একটু পরে দেখি, দুজনের একজন পুরুষ আর একজন  মেয়ে। ওরা আস্তে আস্তে  আমাদের বাড়ির  দিকে এগিয়ে আসছে। যখন কাছে চলে আসে- তখন ছেলেটিকে দেখে চিনতে পারি। ও আমাদের গায়েরই ছেলে। ওর নাম আমজাদ।  পশ্চিম পাড়ায় থাকে। কিন্তু মেয়েটিকে দেখে চিনতে পারছিলাম না। ওকে এর আগে কখনও দেখিনি। 

আমজাদ একটা বাউণ্ডুলে ছেলে। ফ্রী প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছিল। তারপর আর পড়ে নাই। সংসারে ওর মন ছিল না। ওরা খুব গরীব। ছোনের চালা আর পাট সোলার বেরার ছোট দুটি ঘর ওদের। কোনো চাষের জমি নেই । আমজাদের আরও তিনটি ছোট  ভাই বোন আছে। বাবা শারীরিক অক্ষম। কোনো কাজ করতে পারে না। মা অন্য বাড়িতে ঝীয়ের কাজ করে দুঃখে কষ্টে  কোনো মতো সংসার চালায়।

আমজাদ ছোটবেলা থেকেই উড়নচণ্ডী স্বভাবের । কাউকে না বলে প্রায়ই উধাও হয়ে কোথাও চলে যেত। ছয় মাস একবছর নিরুদ্দেশ হয়ে থাকে। কখনও আরও বেশি। দুই তিন বছর ওর কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যেত না। 

শুনেছি আমজাদ যাত্রা দলে যোগ দিয়েছে। গ্রামে গঞ্জে হাটে বাজারে সে ঘুরে বেড়ায়। যাত্রা দলের লোকজনদের ফয়ফরমাশ করে। মাঝে মাঝে যাত্রা পালায় ছোট খাটো চরিত্রে অভিনয়ও করে। 

ওর বয়স  উনিশ কুড়ি হবে। দেখতে সুঠাম ও সুূদর্শন। সাথের মেয়েটিকে আমজাদ পরিচয় করে দিয়ে বলে - 'ওর নাম পাপিয়া। আমার স্ত্রী'। বয়স ওর চেয়ে তিন চার বছরের বড় হবে। মেয়েটিকে দেখতে বেশ রূপবতী  লাগছিল। একটি সুতি শাড়ি পরে আছে। কানে ইমিটেশনের ঝুমকা দুল। দু'হাত ভরা চুড়ি। চোখ দুটো মায়া করা। বেশভূষা দেখে  বোঝা যাচ্ছিল - মেয়েটি যাত্রা দলের সহশিল্পী কেউ একজন হবে।

পুকুরপাড়ে আমজাদ বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। পাপিয়াকে নিয়ে ওদের বাড়ির দিকে চলে যায় । যাওয়ার সময় আমাকে বলে যায়- 'কাল তুমি আমাদের বাড়িতে এসো। তখন নাহয় গল্প করা যাবে ।' আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম -  মুখে ছিল তার  অদ্ভুত রহস্যময়  হাসি।  মনে হলো,  এই বুঝি আমাকে ' ভ্রূ পল্লবে ডাক দিয়ে নিয়ে যাবে চন্দনের বনে।' মনে হলো মেয়েটি আমার সাথে অনেক কথা বলতে চায়। আমারও খুব ইচ্ছে করছিল ওর সাথে কথা বলতে।

রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবছিলাম অনেক কথা  -  আমজাদ বাউণ্ডুলে একটি ছেলে, সে কিছু করে খায় না , ওদের থাকার ঘরটাও জরাজীর্ণ। দু'বেলা ঠিকমতো ভাত জোটেনা। আর সেই কী না সুন্দরী একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে । মেয়েটিই বা কী দেখে ওর ঘরে এল! ওকে কোথায় থাকতে দেবে, কী খাওয়াবে? আমার উঠতি তরুণ মন উদ্বেগে ভাবছিল সেই সব কথা।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কী না, জানিনা। আমি চেতনে না অবচেতনে আছি, তাও বুঝতে পারছিলাম না। রাত অনেক হবে। হঠাৎ  মনে হলো কে যেন আমার ঘরের দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। আমি উঠে দরজা খুলে দিই। দেখি পাপিয়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । সে আমার  কাছে চলে আসে। এবং  বলে - চলো পুকুর পাড়ে। অনেক কথা আছে তোমার সাথে। 

রাতের গায়ে নিঝুম নীরবতা তখন।। পুকুর পাড় নির্জন, কেউ নেই।  আকাশভরা তারার আলোছায়া পড়েছে জলের উপর । পাপিয়া  আমাকে জড়িয়ে ধরে। বুকের ভিতর মুখ রেখে আবিষ্ট হয়ে বলে -- আমি তোমার হতে চাই। আমাকে তুমি তোমার করে নাও।

মধুৃময় কিছু মুহূর্ত আসে স্বপ্নের ভিতর। মানুষ কত সুখানুভুতিই না পায় সেই স্বপ্ন থেকে। আমিও সেই সুখই পেলাম পাপিয়ার কাছে থেকে।  ভালোলাগার এই স্বপ্নের ঘোর সারা জীবনকালেও কাটবে না। 

আমি পাপিয়াকে বুঝিয়ে বলি - তুমি আমজাদের কাছে ফিরে যাও। ও বাউণ্ডুলে হলেও খুব ভালো ছেলে। ওকে তুমি  মনঃকষ্ট দিও না। তুমি চলে যাও। পাপিয়া মনখারাপ করে চলে যায়।

সকালে ঘুম ভাঙে একটু দেরীতে। বিছানায় স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি। মনে পড়ছিল রাতের ঘটনাটির কথা। যা পেয়েছিলাম তা কী স্বপ্নে পাওয়া ছিল? নাকি বাস্তবে পেয়েছিলাম অনুপম মণিরত্নম! কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না।  খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল পাপিয়াকে। ইচ্ছে করছিল ওকে গিয়ে আর একবার নতুন করে দেখে আসি।

পূর্ব আকাশের উজ্জ্বল  সূর্যকে পিছনে রেখে হেঁটে হেঁটে চলে যাই আমজাদদের বাড়ি। গিয়ে দেখি - আমজাদ বারান্দার খুটিতে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। খুবই বিষাদে ভরা ওর মুখখানি।  আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি - মনখারাপ কেন তোমার? ও বলে -

--  পাপিয়া নেই। 
--  নেই মানে? 
-- সকালে ঘুম ভেঙে দেখি, পাপিয়া চলে গেছে। 

আমি আমজাদকে বলি - কী হয়েছিল তোমাদের ভিতর? একটা দিনও পাপিয়া থাকল না।
- কিছু হয়নি। 
- তাহলে পাপিয়া চলে গেল কেন? 
- আমাদের দারিদ্র ও অভাব অনটন দেখে হয়তো 
সে চলে গেছে। 

ওদের বাড়িটিতে যা দেখলাম তা অবর্ণনীয়। ঘরের চালের ছোনপাতা জায়গায় জায়গায় ছিন্ন। শোবার জন্য  কাঠের চোকি নেই। ঘরের মেঝেতে ও বারান্দার  ইঁদুর মাটি তুলে ঢিঁবি করে রেখেছে। একটি নেড়ি কুকুর উঠোনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াচ্ছে। চালহীন রান্না ঘরে খালি দুটো হাড়ি কাত হয়ে পড়ে আছে। একটি মা মুরগী কয়েকটি বাচ্চা নিয়ে উঠোনে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। বারান্দায় ছেঁড়া মাদুরের উপর শুয়ে ওর ছোট ভাইটি কাঁদছে। 

আমি  বাড়ির দিকে ফিরে চলে আসি। পথে আসতে আসতে পূর্ব আকাশের সূর্যের আলো আমার চোখে মুখে এসে পড়ছিল। কিছুই ভালো লাগছিল না । বাড়িতে এসে ঘরের ভিতর না গিয়ে পুকুর পাড়ে চলে যাই। ভাবছিলাম, পুকুরপাড়ে বসে মেঠো পথটির দিকে একটু চেয়ে থাকব। যদি ভ্রম করেও দেখতে পাই - 
ঐ  পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে পাপিয়া আবার  ফিরে চলে আসছে। 

এইসব ভাবতে ভাবতে পুকুর পাড়ে ঘাসের উপর গিয়ে বসি। বসতে গিয়েই ঘাসের উপর দেখতে পাই একটি ঝুমকা পড়ে আছে। আমি চিনতে পারি ঝুমকাটি। এই ঝুমকাটিই যে গতকালকে পরা দেখেছিলাম পাপিয়ার কানে।


১৮.        রাধা, কৃষ্ণ কও 


১৯৭১ সাল।
আগস্টের শেষের দিকে হবে। চারিদিকে বর্ষার পানি থৈথৈ করছে। একদিন বিকেলের দিকে নৌকা করে আমাদের বাড়িতে একজন পঞ্চাশার্ধো লোক আসে। লোকটি আমার বাবার পূর্ব পরিচিত। কিন্তু কেউ আমরা তাকে চিনিনা। আগে কখনও দেখিনিও। 

লোকটি আমাদের বাহিরবাড়ির কাচারি ঘরে বসে বাবার সাথে কী যেন আলাপ আলোচনা করেন। আমরা কেউ সে কথা শুনতে পারিনি। লোকটি প্রায় ঘন্টাখানেক বাবার সাথে কথাবার্তা সেরে  নৌকা করে আবার চলে যান।

লোকটি চলে যাবার পর বাড়ির ভিতর বাবা এসে মাকে বলেন - কাল একটি শরণার্থী পরিবার আমাদের বাড়িতে উঠবেন। তাকে আশ্রয় দিতে হবে। উনি খুব বিপদে আছেন। প্রত্যান্ত গ্রামে ওনার কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। এর আগে অন্য একটি গ্রামে অন্য একটি বাড়িতে ওনারা কয়েক মাস ছিল। কিন্তু সেখানে থাকাটা নিরাপদ মনে করছেন না। তাই আমাদের বাড়িতে ওনারা হয়তো কটা মাস থাকবে।

বাবার মতামতের উপর কারোর কোনও দ্বিমত পোষণ করার ক্ষমতা নেই। আমাদের বাড়িতে বেশ কয়েকটি ঘর আছে । তারই একটি ঘরে ঐ পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।

পরের দিন সকালবেলা একটি ছইওয়ালা ছোট নৌকা করে ঐ ভদ্রলোক তার পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। সাথে ওনার স্ত্রী এক মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েটির বয়স আঠারো ঊনিশ হবে। আর ছেলেটির বয়স আট নয়। 

ভদ্রলোকের নাম শওকত হোসেন। সে নাকি  মহুকুমা অফিসের একজন কেরানী। কিন্তু বাবা আমাদের তার পূর্ণ পরিচয়, পেশা, এগুলো সবার কাছে  বলে বেড়াতে নিষেধ করলেন। 

আমি তখন অষ্টম ক্লাসে পড়ি। নিতান্তই গ্রামের ছেলে। শহরে অত যেতাম না কখনও। শহরের কাউকে দেখলে একটু বিস্ময়ে তাকিয়ে  দেখতাম। যেমন বিস্ময় চোখে দেখেছিলাম ওনাদের। বিশেষ করে সাথে আসা মেয়েটিকে। মেয়েটি দেখতে কেমন যেন 'রূপ লাগি আঁখি ঝুরে', বেতস পাতার মতো কোমল মুখশ্রী। মায়াকাটা চোখ, নির্মোহ চাহনি। মার্জিত পরিধেয় পরনে।

ওনারা আসার সময় কোনও কিছু আনেনি। না কোনও বিছানা পত্তর, না কোনও হাড়ি পাতিল। আমার মা সবকিছু ব্যবস্থা করে দিলেন। বাবার সাথে শর্ত ছিল তারা নিজেরাই রান্নাবান্না করে খাবেন।

মেয়েটির নাম আলেয়া। শহরের গার্লস কলেজে ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। আমি ওনাকে আপু বলে ডাকি। আপু খাঁচায় করে একটি ময়না পাখি নিয়ে এসেছিল। এই পাখিটিকে সে খুব ভালোবাসে ও আদর করে। শহরের বাড়ি থেকে ওনারা যখন পালিয়ে গ্রামে আসে তখন আলেয়া আপু অন্য কিছু না আনলেও এই পাখিটিকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল।

একদিন আমি আপুকে বলি - পাখিটি কথা বলে না? 

- বলে। কিন্তু পাখিটি অভিমান করেছে। সে এখন আর কথা বলে না।
- ও কী কখনও আর কথা বলবে না? 
- বলবে একদিন। 
- কবে? 
- যেদিন দেশ স্বাধীন হবে সেই দিন।

২.

ওনাদের ভিতর একটি রক্ষণশীলতা দেখতে পাই। আশেপাশে মানুষের সাথে খুব একটা মিশত না। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেশি বের হতো না। শওকত চাচার স্ত্রী মার সাথে প্রয়োজনীয় সুবিধা অসুবিধার কথা ছাড়া বেশি কথা বলত না। শওকত চাচাও তাই। উনি একটি রেডিও এনেছিলেন সাথে করে। রেডিওটি কানের কাছে নিয়ে আস্তে আস্তে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনত। আর শুনত আকাশবাণী ও বিবিসির খবর। আর মাঝে মাঝে ভিতর বাড়ির বারান্দায় বসে বাবার সাথে গল্প গুজব করত। ওনারা কী কথা বলত আমরা তা শুনতে পেতাম না।

আলেয়া আপু আমাকে খুব পছন্দ করত। আমিও তাকে খুব পছন্দ করতাম।  আমি তার চেয়ে প্রায় চার পাঁচ বছরের ছোট ছিলাম। আলেয়া আপু ছিল শহরের মেয়ে। কী সুন্দর করে কথা বলত। গুনগুন করে গান গাইত। আমি একদিন আপুকে বলি - তুমি গান গাইতে পারো? 

- পারি।
- আমাকে একটি গান শোনাও না।
- আমি যে হারমোনিয়াম আনিনি। খালি গলায় শোনাতে হবে। 
- খালি গলায়ই  শোনাও। 

আলেয়া আপু গাইছিল --

'গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে, 
বলো কী হবে 
জীবন পাতার ছিন্ন পাতায় শুধু 
বেহিসাবে পড়ে রবে।'

আলেয়া আপু প্রায়ই আমাকে গান শোনাত। আমি গ্রামে থাকতাম । অনেক ভালো গান তখন কখনও শুনিনি, জানতাম না অনেক গানের কথা। মনে পড়ে একদিন কালি সন্ধ্যায় আলেয়া আপু বলেছিল, চলো পুকুর ধারে যাই। জলের শব্দ শুনব। জলের উপর দেখব  চাঁদের ছায়া। আমি বললাম, পুকুর তো বন্যার জলে ভেসে গেছে। 

তবুও চলো, দেখব।

সেদিন আকাশে উঠেছিল ত্রয়োদশী চাঁদ। সত্যি অপূর্ব জোছনায় ভাসছিল জল। কাঁঠাল গাছের গুড়িতে বসে আমরা জলছবি দেখি। আলেয়া আপু আবৃত্তি করছিল -

"কেন মিছে নক্ষত্রেরা আসে আর? কেন মিছে জেগে ওঠে নীলাভ আকাশ?
কেন চাঁদ ভেসে ওঠেঃ সোনার ময়ূরপঙ্খী অশ্বত্থের শাখার পিছনে?
কেন ধুলো সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে শিশিরের চুমো খেয়ে- গুচ্ছে গুচ্ছে ফুটে ওঠে কাশ?'"

৩.

আলেয়া আপু প্রতিদিন সকালে উঠে ময়না পাখিটিকে খাবার খাওয়াতো। হাতের আঁজলায় জল নিয়ে ময়নার ঠোঁট খুলে জল ঢেলে দিত মুখে। আমি আমাদের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম সেই দৃশ্য। কোনও কোনদিন কাছে গিয়ে বলতাম -
ময়নাটা কেমন কিচিরমিচির করছে। তোমার সাথে কথা বলতে চায়। 

- ও বলবে না কথা। রাগ করেছে। 
- রাগ ভাঙাও। 

আমি বললাম, আমি যদি তোমার ময়না পাখি হতাম ঠিকই তোমার সাথে কথা বলতাম। কখনোই রাগ করতাম না! 
আলেয়া আপু আমার থুতনিতে টোকা দিয়ে বলে-- ও আমার ময়না পাখিরে! তাই ! 

আমাদের বাড়িতে পিয়ারা গাছ ছিল। আমি কাঁচা ঢাসা পিয়ারা পেড়ে এনে আলেয়া আপুকে খেতে  দিতাম। মাঝে মাঝে কাঁচা পিয়ারায় কামড় দিয়ে আপু বলত, এটি আমি খেতে পারছি না। এটি তুমি খাও।' আমাদের একটি জাম্বুরা গাছও ছিল। জাম্বুরা পাকলে ভিতরের কোয়া গুলো টকটকে গোলাপি রঙের হতো। আলেয়া আপু জাম্বুরার কোয়াগুলো খেয়ে ঠোঁট ও জিহবা গোলাপি রঙ করে ফেলত। আমি বিস্ময় চোখে তাকিয়ে দেখতাম তা। আলেয়া আপু বলত - আমার ঠোঁট তোমার ভালো লাগছে! বলতাম, হ্যাঁ। 

আলেয়া আপু বলে - তুমিও কী রাঙাবে তোমার ঠোঁট? এস, রাঙিয়ে দিই। 

আর একদিন বিকালবেলা বাবাকে বলে নৌকায় করে ধনিদহ বিলে আমি আলেয়া আপু ও আলেয়া আপুর ছোট ভাই আদিব শাপলা আর কলমীলতা দেখতে যাই। নৌকা বাইছিল আমাদের বাড়ির কৃষি কর্মী সমীর আলী। দিগন্ত জুড়ে পানি থৈথৈ করছে। উপরে নীল আকাশ। সমীর আলীর বৈঠার শব্দে পানি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হচ্ছে। গাংচিল উড়ছে আকাশে। আমাদের নৌকা বিলের শাপলা ফুলের ভিতর দিয়ে চলছিল।  আলেয়া আপু শাপলা ফুল ছিঁড়ছিল আর জল ছুঁইছিল দুহাত দিয়ে।  কী অদ্ভুত করে নেমে আসছিল সেদিন সন্ধ্যা। আলেয়া আপু আমাকে ডাক দেয় - রঞ্জন! 
বললাম - জ্বি। 
- এখন তো গানের সময়! গান শুনবে না? 
- শুনব, গাও। 
আলেয়া আপু খালি কণ্ঠে গাইতে থাকে --

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু
কোন রক্তিম পলাশের স্বপ্ন
মোর অন্তরে ছড়ালে গো বন্ধু!
....…
বাতাসের কথা সে-তো কথা নয়
রুপকথা ঝরে তার বাঁশিতে
আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই
শুধু দু'টি আঁখি ভরে রাখি হাসিতে।

আলেয়া আপুর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমিও তার সাথে গাইছিলাম --

'কিছু পরে দূরে তারা জ্বলবে
হয়ত তখন তুমি বলবে
জানি মালা কেন গলে পড়ালে গো বন্ধু।'

৪.  

দেখতে দেখতে দুই আড়াই মাস চলে যায়। দিনে দিনেই যুদ্ধের মোড় বদলাতে থাকে। বন্যার পানি সরে গিয়ে চরাচর জাগতে থাকে।  মনে হচ্ছিল বিজয় আসতে এখন  শুধু সময়ের ব্যাপার  মাত্র। মন প্রফুল্ল হওয়ার পাশাপাশি মনটা বিষাদেও জড়াচ্ছিল খুব । মন বলছিল - এই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে আলেয়া আপু'রাও শহরে চলে যাবে। কতদূর সেই শহর! 

আমি আর আলেয়া আপু দুজন ইতোমধ্যে খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। কত খুনসুটি, কত লেনদেন। কত কথা বলতাম চাঁদনি রাতে উঠোনে শীতল পাটিতে বসে। আলেয়া আপু গুনগুন করে সুর তুলত -- 'আকাশে ঐ মিটিমিটি তারার সাথে কইব কথা, নাইবা তুমি শুনলে।'  যদিও অসম বয়স ছিল আমাদের। বিজয় ধেয়ে আসছে ভেবে মনবীণার তারে কেমন যেন টান লাগতে থাকে। মনে হচ্ছিল এই তার বুঝি ছিঁড়ে যাবে যে কোনও দিন, যে কোনও ক্ষণে। 

সেদিন ছিল হেমন্তের সন্ধ্যা। আমাদের কুসুমপুর গ্রাম ছিল গাছপালায় আশ্চর্য ছায়াছন্ন। প্রসন্ন নির্জনতায় আঁধার নেমে আসছিল তখন। বাড়ির পূর্বদিকে পুকুরপাড়। ঠিক তার পিছনটায় বাঁশ ঝাড়। রাত্রি আগমনের পদধ্বনি বাজছিল পাখিদের গানে। বুলবুলি, দোয়েল, হাঁড়িচাচা শিস দিচ্ছিল। আমি আর আলেয়া আপু হাঁটছিলাম বাঁশবনের পথে। পায়ের স্পর্শ লেগে শুকনো পাতাগুলো মর্মর করে শব্দ হচ্ছিল। দুজনেই নিশ্চুপ ছিলাম কিছুক্ষণ। আমি কম্পিত স্বরে আলেয়া আপুকে ডাকি - আপু। 

- কী! 

- তুমি চলে গেলে আমি খুব কাঁদব। 

- পাগল ছেলে, কাঁদবে কেন? 

আলেয়া আপু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। গভীর মমতায় আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রাখে অনেকক্ষণ। 
সেই সজলঘন নির্জনতায় বুকের সঙ্গে বুক জড়িয়ে নিবিড় গাঢ় স্বরে আপু  বলে -- 'তুমি কী আমাকে ভালোবাসো?'

- হ্যাঁ, আপু। তোমাকে অনেক  ভালোবাসি।

-  এখনও তুমি অনেক ছোট। এত ছোট বয়সে বড়ো করে ভালোবাসতে নেই। কষ্ট পাবে। তোমার স্পর্শ  বুকে নিয়ে কেবল বয়ে বেড়ানো যায়। অন্য কিছু না। তুমি আরও বড়ো হও। বড়ো হয়ে যেদিন আমায় অনেক ভালোবাসা দিতে পারবে সেদিন আমি নিজেই উন্মুখ হয়ে আমার সবকিছু তোমাকে দিয়ে দেবো।

****

অবশেষে চলে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! 
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ইং, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বারবার ঘোষণা হচ্ছিল --

'পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশি যৌথ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে, পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সব সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। "

বিজয়ের সেই ক্ষণে কুসুমপুর গ্রামের মানুষেরা আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে। জয়বাংলা শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠতে থাকে। রেডিওতে গান বাজতে থাকে -"পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল রক্তলাল! প্রলয় এসেছে কোন্ সমুদ্রে রক্তলাল রক্তলাল" 'জয় বাংলা বাংলার জয়।"

তখন অপরাহ্ন সময়। আলেয়া আপু রেডিওতে ঘোষণা শুনে  দৌড়ে ঘরের ভিতর চলে যায়। ভিতর থেকে  ময়না পাখির খাঁচাটি উঠোনে নিয়ে আসে। তা ধিন্ ধিনের মতো নেচে নেচে ময়না পাখিকে সে বলে - "রাধা, কৃষ্ণ কও।" 
ময়না পাখিও বলে ওঠে - "রাধা, কৃষ্ণ কও।"

আলেয়া আপু'রা ছিল হিন্দু পরিবার৷ এই কথা বাবা ছাড়া কেউ জানত না।

আলেয়া আপু'রা আরও দুই দিন আমাদের বাড়িতে ছিল। যেদিন আপু'রা চলে যাবে সেদিন  সকালবেলা একটি ঘোড়ার গাড়ি এসে আমাদের বাড়ির পাশে এসে থামে। দেখলাম - শওকত চাচার পরনে সাদা ধূতি ও পাঞ্জাবি। চাচীমার সিঁথিতে সিঁদুর। আলেয়া আপু পরেছে লাল সবুজ সালোয়ার কামিজ। ওনারা সবাই টমটমে গিয়ে উঠে। যাবার সময় আলেয়া আপু আমাকে কাছে ডেকে বলে -' তুমি তোমার এই জয়ন্তী দিদিকে কখনও ভুলে যাবে না।'

পরিশিষ্ট -

জয়ন্তী দিদি'রা চলে যাবার তিনমাস পর বাবা একদিন শহরে যান। মহুকুমা অফিসের সেরেস্তায় গিয়ে জানতে পারেন - শ্রী সুবিমল রায় ( শওকত চাচা) বদলি হয়ে চলে গেছেন দূরের অন্য আর এক শহরে। 

এরপর কত বছর চলে গেছে। কতদিন কত রাত্রির উপরে চুপিসারে আমার দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়েছে। মহাকালের ললাটের উপর ঝরেছে অশ্রুবিন্দু। অস্ফুট করে জয়ন্তী দিদিকে কত ডেকেছি বেদনা মর্মর মুহূর্তে। বলেছি - 'দিদি, আমি কত বড়ো হয়ে বুড়ো হয়ে গেলাম। কই, তুমি উন্মুখ হয়ে আমাকে আর ভালোবাসা দিতে এলে না তো।'


১৯.          অন্য রকম দিন 


একটি অন্তীম ইচ্ছে - জীবনের শেষ দু'একটা বছর যেন কুসুমপুরে কাটাতে পারি। সেই ইচ্ছেরই আর একটি কথা - মৃত্যুর আগের দিনটা ঠিক কেমন হবে আমার ! 

দু'একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া মানুষ ঠিক কবে কখন কোন্ দিন মারা যাবে, বেশির ভাগ মানুষই তা জানে না। আমিও জানতে পারব না, ঠিক কোন্ দিনটিতে মারা যাব। আর মৃত্যুর আগের দিনটাই বা কেমন হবে, কেমন করে কাটবে সেই দিনটি।

ধরুন - আমার মৃত্যুর আগের দিনটা যদি এমন করে কাটে --

আগের রাতে শেষ প্রহরে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরবেলা যখন ঘুম ভাঙে তখন শুনতে পাই - আজান হচ্ছে। পাখির ডাকও শুনতে পাচ্ছিলাম। 

ফজর নামাজ পড়ে আর ঘুমাই নি। টেবিলে গিয়ে বসি। ল্যাপটপ অন্ করি। উপন্যাসের কয়েকটি পরিচ্ছদ লেখা বাকি। লিখে ফেলি আরও দু'একটা পরিচ্ছদ। কেন জানি, একটি কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছিল। কয়েকটি পংক্তি কাল থেকেই মাথায় ঘুরঘুর করছিল।  কথাগুলো লিখছিলাম কীবোর্ডে আঙুল চেপে। তবে কবিতায় নয় গদ্যে। 

কত লোভের জিনিস আছে এই পৃথিবীতে। কত দামী বস্তকে পেতে প্রবল আকাঙ্খা করেছি। কত পথ চলেছি উদাস সঙ্গীত শুনে শুনে। শত পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার মতো কত আলো দেখে পথ চলেছি, খুঁজেছি কত জ্যোৎস্নাবরণী অনিন্দ্য তরুণী! শেষে কোথায় গিয়ে দেখে ফেললাম এক অর্বাচিনীকে! তাকে চিনিনা। দেখিও নাই কোনদিন। কেমন করে যেন ছুঁয়ে ফেলি সেই অপরিচিতার কৃষ্ণ কেশদাম, কী অপূর্ব ছিল তার গ্রীবাভঙ্গি! কী মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছিল সেই  মায়াবতী।

এই মেয়ে যখন কাছে আসে তখন কোনও কিছু লেখা হয় না। না কবিতা, না গদ্য। সে কাছে এসে বলে - 'চলো হেঁটে আসি তোমার প্রিয় মেঠো পথ দিয়ে। যেথায় দুপাশে ফুটে আছে  তোমার অনঙ্গ  ভাঁটফুলের প্রেয়সীরা।'

বহু বছর আগের বাবার তৈরি টিনের চালের ঘর। জীর্ণ হয়ে গেছে চাল। বৃষ্টিতে জায়গায় জায়গায় জল পড়ে। শুয়েছিলাম বাবার পালঙ্কে। ঘরের পূর্ব দিকে দরজা আছে, আবার পশ্চিম দিকেও দরজা। পূর্ব দিকের দরজাটা খুলি।  কী উজ্জ্বল রোদ্রে ছেয়ে আছে বাইরের আঙিনা!

আমরা দুজন ঘর থেকে নেমে বাইরে  আসি । আমগাছ আর কাঁঠাল গাছের ছায়াতল দিয়ে হেঁটে গিয়ে পুকুরপাড়ে চলে যাই। সকালবেলার জল দেখে মনে পড়ে - সেই ছেলেবেলার কথা।  জলের উপরে সকালবেলায় দেখেছি সূর্যের ছায়া। জলে ভাসত আরও একটি সূর্য!  রোদ্রের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ত সারা জলে। আজও দেখলাম সেই দৃশ্য! পার্থক্য এইটুকু, ঢিল ছুঁড়ে দিয়ে জলকে আজ আর আলোড়িত করলাম না।

পুকুরের কিনারে ঢোল কলমি লতাগুলো নেতিয়ে পড়ে আছে জলে। এই কার্তিকে ফুল ফোটেনি একটিও । মনটাকে খারাপ হতে দিলাম না। পুকুরপাড় থেকে হেঁটে চলে যাই মাঠের দিকে। যেতেই রাস্তার দু'ধারে দেখা পেলাম ভাঁটফুলের। সাদা ফুল ফুটে আছে থরে থরে। স্পর্শ করি রেণু।  বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে সরিষার ক্ষেত ৷ হলুদ ফুলে ফুলে শুয়ে আছে গালিচার মতো। অবারিত পাগল করা গন্ধ চারদিকে। আমরা মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে চলে যাই বহুদূর পর্যন্ত। আবার হেঁটে হেঁটে ফিরে আসি বাড়ির দিকে।

দুজনের সংসার। পাশের বাড়ির নয়নী এসে মায়াবতীকে কাজে সাহায্য করে। মাটির চুলোয় পাট সোলা দিয়ে সে রান্না করছে। আমি এসে বলি - কী রান্না করছ আজ। 

- ধনিদহ বিলের ছোট আইর মাছ। ময়নাল চাচাকে দিয়ে  কিনে এনেছি আজ।

- কলমীর শাক রেখ। সাথে মাসের ডাল। মা থাকলে সাথে একটি মুরগীও রান্না করত।

- ময়নাল চাচাকে দিয়ে এক সের দুধও কিনে এনেছি ছোনগাছা বাজার থেকে। সাথে সরবি কলা। 

- আমি ঢাকা থেকে বাড়ি আসলে মা দুধ ভাত খাওয়াতো। 

- আমি জানি, তাই তো দুধ কিনে এনেছি।

- হুম, তুমি আমার মায়ের মতো, মায়ের অভাব বুঝতে দাও না।

- যাও, পুকুর থেকে স্নান করে এস।

আমি একাকী গিয়ে পুকুরে নামি। কী স্বচ্ছ টলটলে জল৷ কেমন যেন অন্য রকম শীতল মনে হচ্ছে আজ। অদ্ভুত ঠাণ্ডায় দেহখানি হিম হয়ে আসছিল। বারবার ডুব দিচ্ছিলাম জলে। দু'হাতের  আজলায় জল তুলে নিয়ে চোখে মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছিলাম। 

স্নান সেরে বাড়ির ভিতর চলে আসি। 

মেঝের উপর শীতল পাটিতে বসে দুপুরে ভাত খাচ্ছিলাম। মায়াবতীকে বলি - তুমিও আমার সাথে বসে খাও। সে খেলো না। বলল, তুমি খাও।আমি বেড়ে দিচ্ছি। 

সে যেন মায়ের ভূমিকা পালন করছে।  মা'ও এমন করে সামনে বসে বেড়ে খাওয়াতো আমাকে।

বিকালবেলা পিয়ারা গাছতলায় বাবার পুরনো হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ারটাতে বসে ছিলাম। মায়াবতী নলিন গুড় দিয়ে মুড়ি মেখে নিয়ে আসে বেতের ডালায় করে৷ আমিও খাচ্ছিলাম, মায়াবতীও খাচ্ছিল। 

দুজন বসে আছি দুজনের মুখোমুখি চেয়ে। কখনও কথা বলছি, কখনও না। উঠোনে আর কেউ নেই। নিম গাছের ডালে একটি বুলবুলি এই ডালে ঐ ডালে উড়াউড়ি করছিল। ঘরের চালের কার্নিশে কবুতর বাকুম বাকুম করে  ডাকছে। মায়াবতীকে বলি - আজ উঠোনটা এত পরিপাটি লাগছে যে! সে স্মিত হেসে বলে - আজ আমি নিজ হাতে উঠোন ঝাড়ু দিয়েছি। নয়নীকে ঝাড়ু দিতে দিই নি। 

পরিপাটি উঠোনের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম - 'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।'

আমাদের বাড়ির উঠোন থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায় না। অস্তাচলের আকাশ ঢেকে থাকে বৃক্ষরাজিতে। যখন সন্ধ্যা নামে তখন পিছনের বাঁশ ঝাড়ের পাতায় এসে পড়ে অস্ত সূর্যের লাল আভা। আঁধার ঘনিয়ে আসতে থাকে ধীরে কাজল চোখের মতো কালো করে। আগে সন্ধ্যা হলে প্রতি ঘরে পিতলের কেরোসিন দীপশীখা জ্বলে উঠত। মুখর হয়ে থাকত সারা বাড়ি। আজ সব নিঝুম। কেউ নেই। একে একে কতজন পরপারে চলে গেছে। কতজন চলে গেছে কত দূরে। ভাই বোন যারা আছে - তারা কেউ কাছে নেই। কেন জানি, চোখটা জলে ভরে ওঠে। মায়াবতী বলছিল - 'তুমি যে কেমন শিশু এখনও!  চলো, পুকুরপাড়ে। আজ আকাশে অনেক বড়ো  চাঁদ উঠেছে। সারা চরাচর বিগলিত জোছনায় ভাসছে। আশ্চর্য সুন্দর এই পৃথিবী। চলো, দুজনে মিলে দেখব এই পৃথিবী ।

রাতে বাবার পুরনো পালঙ্কে দুজন পাশাপাশি বিছানার শুয়ে আছি। পূবের জানালাটা খোলা। আম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঠিকরে চাঁদের আলো পড়ছিল বিছানায়। নীরব রাতে মুখর করছিল ঝিঁঝি পোকার গান। মায়াবতী বলছিল - জানালাটা কী বন্ধ করে দেবো?  বললাম, বন্ধ কোরো না। খোলা থাক্। কোথাও থেকে কুন্দ ফুলের গন্ধ আসছে। আসছে দূর থেকে যমুনার হিম বাতাস। দেখলাম, চাঁদের আলো ওর মুখের উপর এসে পড়ছে।  নির্মল আরক্ত সুন্দর মুখশ্রী! কেমন  মায়ামলিন করে চেয়ে আছে আমার দিকে। ওকে বলি - আমার হাতটা একটু বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমাও। ঘুম ঘোরেও ছেড়ে নিও না হাত। যদি দূরে চলে যাই! 

আর কোনও কথা নেই।  কত মায়া করেছি দুজন দুজনের জন্য । জীবনের অনেক কিছুই মিছে হয় নাই। অপরূপ অনেক প্রাপ্তি মায়াকাজল জলস্রোতে ভেসে গিয়ে বিলীন হয়ে যায় নাই। কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। দীর্ঘশ্বাসের তপ্ত বাতাস বেগ পাচ্ছিল নিবিড় আঁধারে। মনে হচ্ছিল মায়াবতী বুকের উপর মাথা রেখে আকুল নয়নে  ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। 


২০.         পারাপার 


আশির দশক। অক্টোবরের এক বিষণ্ণ অপরাহ্ণ বেলায় ভিক্টোরিয়া পার্কে কংক্রিটের বেঞ্চের উপর বসে ভাবছিলাম অনেক কথা। পার্কে তখন তেমন জনসমাগম ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ বসে গল্প করছিল। কেউ কেউ বাদাম, চানাচুর ও এটা সেটা খাচ্ছিল। পার্কের এক গেট দিয়ে ঢুকে অন্য গেট দিয়ে কেউ কেউ হেঁটে বের হয়ে যাচ্ছিল। আমি একাকী বসে আনমনে একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছিলাম। ধূয়াগুলো উড়ে যাচ্ছিল সেদিনের ম্লান বাতাসে।

কুমু আজ চলে গেল। আজও ওকে খেয়া নৌকায় করে  বুড়িগঙ্গার ওপারে নামিয়ে দিয়ে এলাম। ওপারের ঘাট থেকে ওর কাছে থেকে যখন বিদায় নিয়ে চলে আসছিলাম, তখন কুমু আমার একটি  হাত টেনে ধরে। জল টলমল চোখে চেয়ে থেকে বলে- 'কথা দাও, বেশি সিগারেট খাবে না। সময়মত খাবে। রাত জাগবে না। আমি চলে যাচ্ছি , তার মানে এই না- তোমার সাথে আর কখনও কোনও দিন দেখা হবে না! তুমি আমার বন্ধু। বন্ধু হয়েই থাকবে চিরকাল।'

কুমু ওয়াইজঘাটে একটি ললিতকলা একাডেমিতে গীটার বাজানো শিখত। আমিও শিখতাম। ওখানেই ওর সাথে পরিচয়। ও আসত বুড়িগঙ্গার ওপারে খেজুরবাগ থেকে। গীটারের তারে আঙুল ছোঁয়ার সময় চুপিচুপি ওকে দেখতাম। মেয়েটির গায়ের রং গৌরীয়। চন্দ্রমুখ। টিকালো নাক। মাথাভর্তি কার্ল কালো চুল। নয়নতারার মতো বিনম্র চোখ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রথম একদিন ওর সাথে কথা হলো। কথা বলতে বলতে দুজন দুজনকে জানলাম। তারপর দুজন বন্ধু হয়ে উঠি। 

গত একবছর প্রতি শুক্রবার শনিবার  ছুটির পরে ওয়াইজ ঘাট থেকে খেয়া নৌকায় কুমুর সাথে আমিও চলে যেতাম ওপারে। ওপারের ঘাটে  ওকে পৌঁছে দিয়ে আমি আবার ফিরে আসতাম এপারে। নদী পার হওয়ার সময় ওর সাথে আমার যত কথা হতো। নদী পারাপারের সময়ই ওর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। নৌকায় পাটাতনের উপর  দুজন পাশাপাশি বসতাম। কথা বলতাম খুব কাছে থেকে। চুপচাপ বসে বসে দেখতাম নদীতে ভেসে যাওয়া অজস্র নৌকার সারি। দেখতাম জলের উপর আকাশের ছায়া। শুনতাম জলের কলধ্বনি।  

কত স্মৃতি মস্তিষ্কের শিরায় তোলপাড় করে। একবার নদী পার হওয়ার সময় হঠাৎ আকাশ মেঘে কালো হয়ে আসে। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামতে শুরু করে। ভিজে চুপসে যাচ্ছিলাম দুজনেই। আমার ফুসফুসে প্রদাহ ছিল। প্রায়ই খুসখুস করে কাশতাম। ওর সামনে সিগারেট খেতে পারতাম না। ঠোঁট থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে ফেলে দিত। কুমু সেই বৃষ্টির সময় ওর বুকের খাঁজে আমার মাথা লুকিয়ে নিয়ে ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখে। যেন আমার ঠাণ্ডা না লাগে। কুমুকে সেই মুহূর্তে অপার্থিব সুন্দর লাগছিল। কিছু স্পর্শ একটুও পাপের মনে হয় না। কোনো অলৌকিক দেবীর পুণ্যের ছোঁয়ার মতো মনে হয়।

কুমুর একজন প্রেমিক ছিল। তারপরও ও মনে হয় আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। কেমন যেন জটিল মনে হতো অনেক কিছু। একবার সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকারে বুড়িগঙ্গার কূলে দাঁড়িয়ে কুমু আমাকে বলেছিল - মানুষের দেহমন কেন যে একটা হলো। দুটো কেন হলো না? দুটো হলে একটা তোমাকে দিয়ে দিতাম আর একটা আমার ভাবি স্বামীকে দিতাম।

আমি কৌতুকছলে বলেছিলাম - 'তোমার যে একটা দেহ মন আছে সেটিই নাহয় আামাকে দিয়ে দাও।'

- তুমি এত ভালো ছেলে তোমাকে আমি ঠকাতে চাই না। কত মানুষ আছে শুধু আনন্দের জন্য মেয়েমানুষের শরীর খোঁজে। তুমি তো সেই রকম নও। শুধু আনন্দ করার জন্য যদি কখনও আমায় তোমার প্রয়োজন হয়, তবে তুমি আমাকে স্মরণ কোরো।

 - না, প্রয়োজন হবে না। আমি তোমাকে অনেক  ভালোবাসি কুমু। 

একবার ক্লাস ছুটির পর, আমি আর কুমু যাব নবাববাড়ির গেটে। কুমু কিছু কেনাকাটা করবে। ফুটপাতের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম ইসলামপুর রোডের দিকে। দেখি - গঙ্গাজলির  কয়েকটি মেয়ে চোলি পরে সেজেগুজে আমাদের সামনে দিয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে স্টার সিনেমা হলের দিকে চলে যাচ্ছে। আমি ওদেরকে দেখিয়ে কুমুকে বলি- পয়সা দিলে ওরা দেহের আনন্দ দেয়।' কুমু বলছিল, তুমি কখনও ওদের দেহের আনন্দ নেবে না। আমার মাথার দিব্বি রইল। 

কুমুর সাথে আমার সম্পর্ক একসময় বন্ধু ও প্রেমিকার মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে রূপ নেয়। কিন্তু  চির আক্ষেপ- স্ত্রী আর সে হলো না।

আজ ছিল শেষ পারাপার। আমাদের গীটার শেখার কোর্স শেষ হয়ে গেছে আরও দুই দিন আগে। কুমু আর আসবে না একাডেমিতে। ওকে রেখে যখন নৌকায় উঠি, নৌকা যেন মাঝ নদীতে থেমে যাচ্ছিল। মাঝির বৈঠা যেন চলছিল না । 
নৈর্ব্যক্তিক মনে হচ্ছিল নদীর জল। কেমন যেন বিধুর লাগছিল নিজেকে। নদী পার হওয়ার সময় আর কখনও নামতে দেখব না সন্ধ্যা। দেখা হবে না অস্তবেলার লাল আবীর মাখা সূর্য। বুড়িগঙ্গার জল নীরবে ছলছল করবে। ভেঁপু বাজিয়ে লঞ্চ চলাচল করবে। ঢেউ উঠবে। ঢেউ ভাঙবে। ঢেউ মিলিয়ে যাবে।

****

পার্কের লোকজন আস্তে আস্তে কখন সবাই চলে গেছে জানি না। আমি তখনও সিগারেট খেয়েই  যাচ্ছিলাম। লাইটপোস্টের বাতির চারপাশে উইপোকা ভিনভিন করছিল। আধো আঁধারে একটা মধ্যবয়সী লোক আমার দিকে এগিয়ে আসে। কাছে এসে  বলে - ছোট ভাই তুমি কেমন আছ? 

- ভালো আছি। 

- মনে হয় তুমি ভালো নেই। অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে আমি অনুসরণ করছি। তুমি একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছ। এত অল্প বয়স তোমার , তুমি নবীন। একদম তরুণ প্রাণ। শরীর খারাপ হয়ে যাবে! 

- খারাপ হবে না। এমনই খাচ্ছিলাম। 

- নাহ্, এমনই খাচ্ছ না। তোমাকে দেখে দেবদাসের মতো লাগছে।  তা, আমার সাথে একজায়গায় তুমি যাবে? 

- কোথায়? 

- জিন্দাবাহার তৃতীয় লেন। 
- ওখানে কে আছে?  
- লখনৌর বেগমজানের বংশদ্ভূত অপূর্ব সুন্দর  নাজমুন বাঈ। ভৈরবী রাগে গান ধরে সে ‘রসিয়া তোরি আখিয়ারে, জিয়া লাল চায়’ ঠুংরী ঠাটের গানের এ কলিতে জিন্দা বাহার গলির ওর জলসা কানায় কানায় ভরে উঠে।

আমি বললাম, টাকা দিতে হবে?  
- হুম।  টাকা দিতে হয়। 
লোকটাকে বললাম, আমি ছাত্র মানুষ। আমার কাছে  টাকা নেই। 

লোকটি হতাশ হয়ে চলে গেল।

আমি আরও একটি সিগারেট ধরাই৷ কুমুর কথা মনে পড়ল আবার। ও আমায় বলেছিল-- 'তুমি কখনও যদি দেহের আনন্দ চাও তবে আমার দেহ থেকে নিও। ঐসব মেয়েদের থেকে নেবে না।'

সেই সন্ধ্যারাতে পার্ক থেকে বেরিয়ে আসছিলাম নীরব পদচিহ্ন ফেলে। পায়ের নিচে কংক্রিট না ঘাস, না মাটি- বুঝতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম কেবল, আমার দিন কাটবে কুমুরও দিন কাটবে। যতদিন জীবন আছে ততদিন এই জীবন চলবেই। একটি ক্ষীণ আশা জাগিয়ে হাঁটছিলাম নিবিড় আলো আঁধারে- আর একবার কী দেখতে পাবো না কুমুকে সাথে নিয়ে নদীতে নৌকায় ভেসে সন্ধ্যার সূর্যাস্ত! ডানা ঝাপটে কুলায় ফিরে যাবে পাখি। অস্ত দিগন্তে মিলিয়ে যেত জীবনের সব অপ্রাপ্তির বেদনা চিহ্ন।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন