বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০২২

নতুন ছোট গল্প ( পাণ্ডুলিপি )


১. ব্যাক বেঞ্চ

ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শুরুর প্রথম দিনেই ক্লাসে যেতে আমি দেরি করে ফেলেছিলাম। ক্লাস শুরু হয়ে গেলে সামনের দরজা দিয়ে রুমে ঢোকার নিয়ম ছিল না । তাই আমি পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে ব্যাক বেঞ্চে যেয়ে বসে পড়ি। ঐ ব্যাক বেঞ্চে বসতে গিয়ে দেখি আরও একটি মেয়ে বসে আছে।

ক্লাস শেষ হলে করিডোরে এসে দাঁড়াই। পাশে বসা ঐ মেয়েটি অনেকটা কাছাকাছি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। দুজনেই চুপচাপ। কোনো কথা নেই। তারপর প্রথম কথা আমিই বলেছিলাম ওকে -- তোমার নাম কী?

-- মরিয়ম।
-- কোথায় থেকে এসেছ?
-- বানরীপাড়া, বরিশাল ।

তারপর এককথা, দু’কথা। তারপর দিনকয়েকের মধ্যে এই মেয়েটিই আমার বন্ধু হয়ে গেল।

ক্লাসে আমরা ষাট জনের মতো ছেলেমেয়ে ছিলাম। তার ভিতর অর্ধেক ছিল মেয়ে। সব মেয়েদের ভিতর এই মেয়েটি ছিল সবচেয়ে নিরীহ ও সাধারণ । অন্যসব মেয়েরা ছিল তুলনামূলকভাবে আধুনিক। মরিয়ম ছিল গ্রাম থেকে আসা অতি সাধারণ একটি মেয়ে। আর এই মেয়েটি আমার বন্ধু হলো।

মেয়েটিকে ক্লাসের অন্যসব ছেলেমেয়েরা খুব একটা পাত্তা দিত না। সবাই কেমন অবজ্ঞা করত। মেয়েটি ঠিকমতো কথাও বলতে পারত না। কথায় গ্রাম্য টান চলে আসত। চালচলন ছিল সাদামাটা। কোনো রূপসজ্জা করত না। একদম নিরাভরণ ছিল। আমি পর্যবেক্ষণ করেছি সবমিলিয়ে ওর দুই তিনটে সালোয়ার কামিজ ছিল।

মেয়েটির সাথে কথা বলতে বলতে এবং ওর সাথে মিশতে মিশতে ওকে ভালো লেগে যায়। ওর ভিতর লুকিয়ে থাকা একটা অনন্য মাধুর্য রূপ ছিল। যা আমি আমার চোখে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।

মরিয়মের গায়ের রং ছিল শ্যামলা ধরণের গৌরীয়। চুল ছিল কালো। সবসময় সাধারণ খোপা করে বেঁধে রাখত। প্রায়ই ওর চুল থেকে সুগন্ধি তেলের গন্ধ পেতাম। খুব একটা দামি তেল নয়। ওর চোখদুটো ছিল টানাটানা। অন্য মেয়েরা যেখানে আইব্রাউ করত মাসকারা লাগাত। মরিয়ম তা করত না। চোখের পাতার পালকগুলো ছিল ঘন। ঠোঁট ছিল নজরকাড়া কিন্তু লিপস্টিক দিয়ে তা রাঙিয়ে রাখত না। ওর ত্বক ছিল কোমল ও মসৃণ। শরীরের ভাজ ছিল সেতারের তারের মতো টানটান। সুডৌল শরীর সৌষ্ঠব। লম্বা পা। কোথাও বাড়তি কোনো মেদ নেই । গ্রামের একটি মেয়ে যে এমন রূপশ্রী হয়, তা সাধারণভাবে বোঝা যেত না।

প্রথম দিনের মতো আমরা দুজন বেশির ভাগ সময় ব্যাক বেঞ্চেই বসতাম। ক্লাস শেষ হলে ঘুরেফিরে সেই আমরা দুজন। সেমিনার কক্ষে কিংবা লাইব্রেরিতে যেয়ে পড়াশোনা করতাম, টিফিনের সময় টিফিন খাওয়া সব একসাথেই। এইরকম একসাথে চলতে চলতে আমরা দুজন সম্পর্কে জড়িয়ে যাই।

একদিনের কথা। ইউনিভার্সিটিতে ঐদিন হঠাৎ করেই একটি ছাত্র সংগঠন ধর্মঘট ডেকেছে। কোনও ক্লাস হবে না। মরিয়ম বলছিল - কী করব থেকে? বাসায় চলে যাই। 
ওকে বললাম - চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি। 
-- কোথায় যাবে? 
-- কোনও নদীর পাড়ে, কিংবা শালবনে । তোমার যেখানে যেতে মন চায়, সেখানেই চলো। 

-- অনেকদিন ধরে সন্ধ্যা নদী দেখা হয় না। খুব মনে পড়ে আমাদের ঐ নদীর কথা। জলের ধ্বনি শুনতে ইচ্ছা করছে খুব , জলের ঢেউও দেখতে ইচ্ছে করছে।  চলো, কোনও নদীর পাড়ে চলে যাই। 

ওকে বললাম -- তাহলে চলো, বুড়ীগঙ্গার তীরে।
-- আচ্ছা।

চানখার পুলের কাছে থেকে আমরা একটি রিকশায় উঠি। রিকশার হুডি ফেলে কাটাসুর আর ফরিদাবাদের সরু গলির রাস্তা পেরিয়ে চলে যাই বুড়িগঙ্গার তীরে। নদীর কূল ছিল তখন জনারণ্য। কোথাও নিরিবিলি একটুও বসার জায়গা নেই। সারা নদী জুড়ে নৌকা আর লঞ্চ। লঞ্চের ভেঁপু'র শব্দে জলের ধ্বনি আর শোনা হলো না।  আমরা ফিরে চলে আসি ওয়ারীর  বলধা গার্ডেনে।

গার্ডেনের গেট দিয়ে ঢুকে সাইকীতে চলে যাই। সাইকীতে আছে  নীল, লাল, সাদা, হলুদ, জাতের শাপলায় ভরা অনেক গুলো শাপলা হাউজ, বিরল প্রজাতির দেশী বিদেশী ক্যাকটাস, অর্কিড, এনথুরিয়াম, ভূজ্জ পত্র গাছ, বিচিত্র বকুল, আমাজান লিলি ও সুরংগ সহ একটি ছায়াতর ঘর। আমরা গিয়ে ঐ ছায়াতর ঘরটিতে বসি। তখন ছিল আসন্ন দুপুর। চারদিকে থৈথৈ নীরবতা। অজানা অচেনা সব ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল! 
মরিয়ম বলছিল এত অদ্ভুত সুন্দর এই জায়গা! এত ছায়াময়!  এত ফুল চারদিকে!  এত ফুল ফুটে আছে!  আমার কী যে ভালো লাগছে! 

আমি ওকে বললাম -- তাহলে একটা অভিজ্ঞান রেখে দাও এই অপূর্ব সুন্দর  মুহূর্তটির উপর। 
-- কী অভিজ্ঞান?  বুঝিনি। 
-- বোঝো নি? 
-- না। 
-- আদর। 
-- দাও। নাও।
এই প্রথম কোনো লাল টকটকে একটি ক্যাকটাসের কাঁটায় আমরা রক্তাক্ত হলাম।

****

মরিয়ম থাকত ওর দূর সম্পর্কের এক মামার বাসায়। ঐ পরিবারের সাথে কথা ছিল যতশীঘ্র হোস্টেলে সিট পেলে মরিয়ম হোস্টেলে চলে যাবে। ও চেষ্টা করছিল হোস্টেলে সিটের জন্য। আবেদনও করে রেখেছিল। মরিয়ম হোস্টেলে সিট পেয়ে যায়৷ এবং  চলে আসে হোস্টেলে।

হোস্টেলে ওঠার পর প্রথম যেদিন মরিয়ম ক্লাসে আসে ওকে সেদিন খুব উৎফুল্ল লাগছিল। ওকে বললাম - খুব আনন্দে আছ বুঝি! 

-- হ্যাঁ, খুব ভালো লাগছে। আমার রুমমেট আমার অনেক  সিনিয়র । মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। নাম এষা। আমি ওনাকে এষা আপু বলে ডাকি। আমাকে প্রথম দিনই অনেক আপন করে নিয়েছে। আমাকে বলেছে -- তুমি খুব ভালো মেয়ে।

আমি বললাম -- তাই? 
-- হ্যাঁ।
মরিয়ম ওর দু'হাতের আঙুল দেখিয়ে বলে -- দেখ, উনি আমার নখে নেইলপালিশ লাগিয়ে  দিয়েছে।  নেইলপালিশ মাখতে মাখতে আপু বলছিল -- তোমার এত সুন্দর হাত, এত সুন্দর নোখ! আর এই নোখে কোনো নেইলপালিশ মাখা নেই!  তাই কী হয়! 

জুতা খুলে পা দেখিয়ে বলে -- এই দেখো আমার পায়ের নোখেও নেইলপালিশ দিয়ে দিয়েছে। 

আমি ওকে বললাম -- খুব ভালো। তুমি একজন চমৎকার আপু পেয়েছ! 
- জ্বী।

ক্লাস শেষে মরিয়মকে বলি -- চলো, লাইব্রেরি বারান্দায় গিয়ে একটু বসি। দুজন ফুসকা খাব। চৈত্রের বিকালের কড়ই গাছের পাতা ঝরা দেখব। তোমার রাঙানো হাতের নোখ ছুঁয়ে বলব -- 'ভালোবাসি তোমাকে, ভালোবাসি তোমাকে এই রাঙা আঙ্গুলের সৌন্দর্য মাধুর্যের মতো।'

মরিয়ম বলছিল -- আজ দেরি করতে পারব না লক্ষীটি। এষা আপু আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে। আর একদিন বসবো লাইব্রেরি চত্বরে।

আরেকদিন মরিয়মকে ক্লাসে দেখে তো অবাক হই। চুল  পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে। খোঁপা বাঁধা নেই।
দামী  সালোয়ার কামিজ পরেছে। ক্লাসের অনেকেই ওকে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়। অনেককে আবার দেখলাম, বন্ধুত্ব করার জন্য ওর সাথে খাতির করছে। আমি  প্রতিদিনের মতো আজও ব্যাক বেঞ্চেই বসেছিলাম। মরিয়ম বসেছিল সামনের বেঞ্চে অন্য সহপাঠীদের সাথে। ব্যাক বেঞ্চে আমার পাশে এসে আজ আর বসলো না।

ক্লাস শেষ হলে আমি করিডোরে এসে দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করি। মরিয়ম  চলে আসে। ওকে বললাম -- তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না। একদম তিলোত্তমার মতো লাগছে। 

ও বলছিল -- 'আর বলো না। এষা আপু এইসব করেছে। সেই আমাকে চুল কেটে মাথায় শ্যাম্পু করে দিয়েছে। নতুন সালোয়ার কামিজ কিনে দিয়েছে। সে আমাকে বলেছে -- 'তুমি আমার ছোট হলেও  তুমি আমার পরমা বন্ধুও একজন।'

আমি মরিয়মকে বললাম -- তোমার এষা আপু খুব বড়োলোকের মেয়ে  তাই না? 

-- হ্যাঁ, উনি বড়োলোকের মেয়ে। চট্টগ্রামে ওনার বাবা শিপিং এর ব্যাবসা করেন। আমি সালোয়ার কামিজ নিতে চাই নি। উনি আমাকে জোর করে কিনে দিয়েছে। তাও একটি নয়। চারটি।

আমি ওকে বললাম, আজও কী তাড়াতাড়ি চলে যাবে? চলো না, কোথাও গিয়ে বসি। মরিয়ম মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। আমরা সেদিন কিছুক্ষণ বসেছিলাম ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসের উপর। প্রাণ খুলে খুব বেশি কথা বলা হলো না ওর সাথে। মনে  মনে বলছিলাম ওকে -- 'তোমার হৃদয় আজ ঘাস'।

****

খুব ঘনঘন  মরিয়মের বেশভূষা ও গেটআপে পরিবর্তন দেখতে পাই। একটি সাধারণ মেয়ে দিনে দিনে অসাধারণ হয়ে উঠতে থাকে। একটি নির্জন লাবণ্যময়ী মেয়ে  হয়ে ওঠে ধ্রুপদী সৌন্দর্যের অধিকারিণী একটি মেয়ে। এইরকম সৌন্দর্যের মেয়েকেও অন্যরকম রূপবতী দেখায়। আমিও ওর এই রূপকে চেয়ে চেয়ে  উপভোগ করতাম।

কিন্তু মরিয়ম আমাকে আগের মতো আর সময় দেয় না। একদিন ওকে বললাম -- একজন এষা আপুকে পেয়ে তুমি আমাকে ভুলেই যাচ্ছ। উনি বুঝি তোমাকে খুব আদর করেন? 

-- জ্বী, অনেক আদর করেন আমাকে। উনি আর একা  এক খাটে ঘুমাতে পারেন না। আমাকে ওনার কাছে যেয়ে শুইতে হয়। আমাকে জড়িয়ে ধরে  ঘুমান। আমি ওনার কাছে না শুইলে ওনার চোখে ঘুম আসে না। আমার শরীরের গন্ধে নাকি ওনার চোখে ঘুম চলে  আসে। 

আমি বললাম -- খুব ভালো। এত সুন্দর একজন আপু তুমি পেয়েছ , যে তোমাকে সারাক্ষণ আদরে সোহাগে আর ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখে।

দিন যত যেতে থাকে মরিয়মও কেমন যেন বদলে যেতে থাকে। এখন প্রায়ই সে ক্লাসে আসে না। পড়াশোনায় আগের মতো মনোযোগ  নেই। আমি ওকে বলতাম, কী হয়েছে তোমার?  কোনও কিছুই বলত না ও।  কখনও হেয়ালি করে বলতাম --' তুমি এত সুন্দরী হয়ে গেছ, এত আগুনপোড়া রূপ তোমার !  তোমার তো আনন্দে থাকার কথা। তা এত বিষাদ নিয়ে থাকো কেন?' মরিয়ম নির্বিকার থাকত।

একদিনের ঘটনা দেখে আমি বিষাদে নিমগ্ন হয়ে যাই। সেই নিমগ্নতা আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি।  মরিয়ম সেদিন গলায় ওড়না পেচিয়ে ক্লাসে এসেছিল।  আমি ওকে বলি- তোমার কী ঠাণ্ডা লেগেছে?  মরিয়ম বলে- না।
-- তবে কী হয়েছে? 
-- কিছু না। 

দুটো ক্লাস করার পর মরিয়ম বললো -- ভাল লাগছে না। হোস্টেলে চলে যাব। আমি বললাম -- চলো, হারিস মামার দোকানে বসে দুজন চা খাই। তারপর তুমি চলে যেও রুমে। 

-- আচ্ছা।  চলো।

চা খেতে গিয়ে মরিয়ম ম্যাসিভ একটি বিষম খায়। গলা থেকে সে ওড়নাটা সরিয়ে ফেলে। দেখতে পেলাম ওর গলায় জখমের চিহ্ন। আমি চমকে উঠি। কেমন যেন বুনো কামড়ের  দাগের মতো মনে হলো। কোনো কথা বলছিলাম না। মরিয়ম দ্রুত ওড়নাটা পুনরায়  গলায় পেচিয়ে নেয়।

মরিয়ম  একদিন বলছিল -- এষা আপু সম্ভবত জার্মানি চলে যাবেন এমফিল করার জন্য।  আমি বললাম,  তোমার কী এজন্য মন খারাপ? 
-- হ্যাঁ। 
-- তা কবে যাবেন উনি ? 
-- আমাদের সামার ভ্যাকেশনের ভিতরই চলে যাবেন । 

এরপর ইউনিভার্সিটি সামারের ছুটি হয়ে যায়। দুই মাস ক্লাস বন্ধ থাকবে। আমি গ্রামের বাড়ি চলে যাই। বাড়িতে যাবার আগে  মরিয়মকে বলেছিলাম -- তুমি বাড়ি যাবে না? 

-- না। এষা আপু যেতে দেবে না। 

মরিয়মই বলছিল -- চলো কোথাও যাই।  মনটা ভালো লাগছে না।  বললাম, কোথায় যাবে? 

-- তুমি যেখানে নিয়ে যাবে। সেখানেই যাব। 

আমি বললাম -- আজ আর কোথাও যাব না। 

দেখলাম -- মরিয়ম কাঁদছে।

****

ভ্যাকেশন শেষে ফিরে আসি  ইউনিভার্সিটিতে। ঢাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যায় । হোস্টেলের রুমের তালা খুলে ভিতরে ঢুকি । রুম ভর্তি গাঢ় অন্ধকার। দু'মাসের বদ্ধ রুম থেকে  কেমন যেন একটি ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এল। লাইট জ্বালাই। দরজার ফাঁক দিয়ে ডাকপিওন একটি চিঠি মেঝেতে ফেলে রেখে গেছে । খামের উপর লেখা দেখে বুঝতে পারলাম চিঠিটি লিখেছে মরিয়ম। 

চির-কল্যাণীয়েষু 
রঞ্জন,  

আমি এই দেশ ছেড়ে  সুদূর জার্মানিতে চলে যাচ্ছি। আমার পাসপোর্ট, ভিসা, অর্থ সবই এষা আপু ব্যবস্থা করেছেন।  তোমাকে আমার জীবনের অনেক কথা বলা হয়নি।  এখনও বলতে পারছি না।  শুধু এইটুকু বলছি -- আমার জীবনধারা বদলে গেছে। এষা আপু বলেছে -- আমাকে ছাড়া উনি নাকি বাঁচবেন না। তাই উনি আমাকে জার্মানিতে নিয়ে যাচ্ছে। ওখানে ওনার সাথেই থাকব। সে আমাকে একটি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করে দেবে। 

জানি না কেমন থাকব। তোমার কথা খুব মনে পড়বে। তুমি এত ভালো ছেলে ছিলে!  কী পরম সৌভাগ্য হয়েছিল আমার,  তোমাকে আমার জীবনের করে নিতে পারতাম।  বিধাতা আমাকে অমূল্য কিছু  দিয়েছিল ঠিকই , কিন্তু আমিই তা গ্রহণ করিনি।

বার্লিন শহরের পাশে নাকি নীল জলের হ্যাভেল নদী প্রবাহিত। কোনও বসন্ত বিকালে ঐ নদীর তীরে যখন একাকী  ঘুরব, তখন মনে পড়বে আমাদের সন্ধ্যা নদীর কথা। যার তীরে কেটেছিল আমার শৈশব ও তারুণ্যের স্মৃতিক্ষরিত সময়কাল। পুরনো ঢাকার বলধা গার্ডেনের মতো কোনও উদ্যান  ঐ শহরেও হয়তো দেখতে পাব। সেই  উদ্যানেও হয়তো ফুটে থাকবে অজস্র অর্কিড, আমাজন লিলি ও লাল ক্যাকটাস। মনে পড়বে  এক দুপুরের একটি ক্যাকটাসের রক্তাক্ত হওয়ার কথা! কী শিহরণই না ছিল ঐ স্বর্গীয় মুহূর্তের! 

আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল  তোমার দুটো চোখ। কী যে  মায়াময় তার চাহনি! ঐ চোখে কোনও অশ্রু ঝরা মানায় না।  তুমি কখনোই আমার জন্য কাঁদবে না।  এই জীবনে যত কান্না আছে তা আমিই কেঁদে নেব। 

তোমার জীবনকে সুন্দর রেখো।

--- মরিয়ম।

****

চিঠিটি পড়ে ঘরের আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। ভ্রমণে এত ক্লান্ত ছিলাম যে, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম  জানি না। সকালে ঘুম ভাঙে একটু দেরিতে। ভ্যাকেশনের পর আজ প্রথম ক্লাসে যাই। সেই প্রথম দিনের মতো আজকেও যেতে দেরি হয়ে গেল।  গিয়ে দেখি ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আমি পিছনের দরজা দিয়ে  ঢুকে ব্যাক বেঞ্চে গিয়ে বসি। আজ আর ঐ বেঞ্চে কেউ বসে নেই। আমি একাই বসেছিলাম ।


২.       বিবশ


একটি সরকারি প্রকল্প কাজের মূল্যায়নের জন্য আমরা কয়েকজন শিক্ষানবীশ কর্মকর্তা ফরিদপুরের নগরকান্দায় গিয়েছিলাম। সময়টা ছিল আশির দশক। আমাদের সাথে তিনজন মেয়েও ছিল। আমাদের টিম লিডার শওকত সাহেব ছাড়া আমরা বাকী ছয়জন ছিলাম নবীন। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল থানা পরিষদের ডাকবাংলোয়।

রাতে ব্রিফিং সভায় শওকত সাহেব বললেন -- 'আপনি আর নাসরীন আপনারা দুজন আগামীকাল যাবেন ফুলসুতি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সকালে যাবেন, সন্ধ্যার আগেই কাজ সেরে বাংলোয় ফিরে আসবেন।'

আমাদের অ্যাসাইনমেন্ট হচ্ছে নবনির্মিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি পরিদর্শন করা ও সেখানকার জনসাধারণ উক্ত কেন্দ্র থেকে কেমন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন সে সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া।

আমরা যথারীতি সকালে রওনা হই।

নদীর নাম ভুবনেশ্বর। আশ্বিনের স্তিমিত খরস্রোত তখন নদীটিতে। আমরা একটি রিক্সায় করে চলে আসি এর পাড়ে। ওপাড় যেতে হবে। একটি বড়ো খেয়া নৌকা ভিড়ে আছে ঘাটে। নৌকাটির দুপাশে কাঠের বেঞ্চির মতো করা। নাসরীন নৌকায় উঠে বেঞ্চিতে বসে। আমি ওর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকি। নৌকা ছেড়ে দেয়। দুজনেই দেখছি নদী। নাসরীনের খোলা চুল বাতাসে উড়ছে। দুজনেরই মাথার উপর শরতের শুভ্র মেঘের আকাশ। মেঘের ফাঁকে স্বচ্ছ নীল আকাশও দেখা যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরেই আমরা ওপাড়ে পৌঁছে যাই। ওপাড়ে নেমে দেখি, তিনটি ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। একজন ভ্যান চালককে জিজ্ঞাসা করি - ভাই আমরা ফুলসুতি গ্রামে যাব।' ভ্যানচালক বলল - 'খালপাড় পর্যন্ত ভ্যানে যেতে পারবেন। তারপর আবারও ছোট্ট একটি খেয়া পার হতে হবে। তারপর আধা মাইল হেঁটে অথবা ভ্যানে করে ফুলসুতি যেতে হবে।

বললাম, তাই হবে। আমাদের খালপাড় পর্যন্ত নিয়ে চলো।

আমরা ভ্যানে বসে আছি। আশ্বিনের রোদ পড়ছে আমাদের গায়ের উপর। থানা পরিষদের আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তা। রাস্তার দুপাশে জলের মাঠ। বন্যার জল রয়ে গেছে তখনও। আমনধানের ডোগা নুয়ে পড়েছে জলের উপর। পাটের ঝাঁকের পঁচা গন্ধ আসছিল জল থেকে। কাছে ও দূরে গুচ্ছ গুচ্ছ বাড়িঘর। কোথাও আবার কোনো বাড়িঘর নেই। জলে ভাসা বিজন প্রান্তর। খুব ভালো লাগছিল পথ চলতে। কত বিচিত্র মানুষ দেখছি। কত বৃক্ষ, কত খোলা জায়গা দিয়ে চলছে ভ্যান। ভালো লাগছিল আরও আমার পাশে সুন্দরী একটি তরুণী বসে আছে। নাসরীনও মুগ্ধ হয়ে দেখছে মাঠ ঘাট মানুষ, গবাদিপশু ও জলের প্রান্তর।

আমি নাসরীনকে বলি -- কেমন লাগছে তোমার এই গ্রাম ও পথ?

-- খুব ভালো লাগছে! এত কাছে থেকে কখনও দেখিনি এমন গ্রাম। শহরে বড়ো হয়েছি। কী যে ভালো লাগছে এই মাটির পথ। ভাবছি, এই পথ যেন শেষ না হয়।
-- তাই?
-- হুম।

কিন্তু পথ দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। আমরা চলে আসি খালপাড়ে। দেখলাম, জায়গাটা খুব নির্জন। খেয়াঘাটে নৌকা নেই। ওপাড়ে যাত্রী নিয়ে চলে গেছে। নৌকা আসতে মিনিট কুড়ি দেরি হবে।

আমরা ঘাটেই দাঁড়িয়ে আছি। অদূরে চেয়ে দেখলাম, একটি পাকুড় গাছ্। গাছের তলায় ছোট্ট একটি খোলা টিনের চালা। কোনও বেড়া নেই। গাছের আড়াল দিয়ে দেখা যাচ্ছিল কয়েকজন লোক চিতায় লাশ পোড়াচ্ছে। বুঝতে পারলাম এটি একটি শ্মশান ঘাট। যার কারণে জায়গাটা এত নির্জন। যার কারণে হয়তো এখানে কোনও জন বসতি নেই।

একটুপর ছোট ডিঙি খেয়া নৌকাটি ঘাটে এলো। আমরা গিয়ে নৌকায় উঠি। আরও তিনজন যাত্রী এলো। তারাও নৌকায় উঠলো।

আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল, ওপাড়ে যেয়ে একটি ভ্যান পাই। এবং ঐ ভ্যানে করেই বেলা বারোটার মধ্যেই ফুলসুতি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পৌঁছে যাই।

ফুলসুতি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার, নার্স, আয়া, পিওনসহ এলাকার গণ্যমান্যরা আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। কেন্দ্রটি আমরা যথাযথ ভাবে পরিদর্শন করি। দেখি এর নির্মাণ কাজ ও স্বাস্থ্য পরিসেবামূলক কার্যক্রম।

স্বাস্থ্য সেবা কেমন পাচ্ছে ঐ এলাকার মানুষ তা জানার জন্য দুপুরের পর গ্রামে বের হই। আমাদের সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিল দৈব চয়নের ভিত্তিতে কিছু সাধারণ মানুষ। আমরা একজোড়া দম্পতিকে পেয়ে যাই, নাম মোহনবাঁশি মালাকার আর তার স্ত্রী দিপালী মালাকার। তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য আমি ও নাসরীন চলে যাই মোহনবাঁশি'র বাড়িতে। ওনারা ছিল নিম্নবিত্ত শ্রেণির প্রান্তিক  মানুষ। একটিমাত্র ঘর তাদের। তারা এতই সহজ সরল ও আন্তরিক ছিল যে, ওনাদের থাকার ঘরটিতেই আমাদের বসতে দেয়।

আমি আর নাসরীন সবে বিশ্ববিদ্যালয় হতে বের হওয়া উচ্ছ্বল তরুণ তরুণী। আমাদের স্বাভাবিক কথাবার্তা প্রেমের কথার মতো মনে হয়। মোহনবাঁশি আর দিপালী ধরেই নিয়েছিল আমি আর নাসরীন হয়তো স্বামী-স্ত্রী কিংবা প্রেমিক প্রেমিকা।

তখন দুপুরঅন্ত পরন্ত বিকেল। বাইরে ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুর। পিছনে বাঁশ ঝাড়ে ঘুঘু ডাকছে। কেমন উদাস হাওয়া বইছে বাইরে। ঝরে পড়ছে ঝরা পাতা টিনের চালের উপর। নাসরীনের চোখে মুখে চঞ্চলতার দোলা। দেখলাম, মোহনবাঁশি আর দিপালী আমাদের দু'জনকে ঘরের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল। বন্ধ ঘরে তখন আমি আর নাসরীন, যেন সেই হিন্দী সিনেমার গানের মতো রোমান্টিক সময় পার করছি--' হাম তুম এক কামরা মে বন্দি হো, আউর চাবি খো যায়....।'

নাহ্ বন্ধ ঘরে আমাদের কোনো রোমাঞ্চ হয়নি।আমরা কোনো চাবিও হারাইনি। মোহন বাঁশীর বাড়ি থেকে বের হয়ে আমরা গ্রামের আরও কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নেই। সাক্ষাৎ গ্রহণ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সব কাজ শেষ করে সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ডাকবাংলোয় ফিরে আসার উদ্দেশ্যে একটি ভ্যানে করে খালপাড়ের দিকে রওনা হই।

গ্রামে আঁধার নামে খুব তাড়াতাড়ি। খালপাড়ে আসতে না আসতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যায়। হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। ভ্যানটি আঁধার ঠেলে খালপাড়ে চলে আসে। খেয়া নৌকার মাঝি তার নৌকাটি বেঁধে বাড়িতে চলে যাচ্ছিল। তাকে অনুরোধ করে নৌকা করে আমরা খালটি পার হই। খেয়ামাঝি বলছিল -- 'আপনারা কেন এই রাতে চলে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। ওপাড়ে যদি ভ্যান না পান?'

এপাড়ে এসে দেখি সত্যি কোনো ভ্যান নেই। কোনো মানুষজন নেই। মেঘ ডাকছে। বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। কী করব? খুব ভয় ভয় লাগছে। পিছনে ফিরে দেখি খেয়ামাঝি নৌকা ছেড়ে দিয়ে ওপাড়ে চলে যাচ্ছে।

আমরা রাস্তার উপর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। অপেক্ষা করতে থাকি ভ্যানের জন্য। ইতোমধ্যে গুড়িগুড়ি করে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে।

আমার মনে পড়ে গেল, যাওয়ার সময় পাকুড় গাছতলায় একটি টিনের চালা দেখে গিয়েছিলাম। আমি নাসরীনকে বললাম -- চলো, ঐ টিনের চালার নিচে গিয়ে দাঁড়াই। নাসরীনও বলল -- হ্যাঁ, তাই চলো।

আমরা দুটো মানব মানবী টিনের চালার নিচে দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টি আরও জোরে শুরু হয়ে যায়। চিতা থেকে লাশ পোড়ানো কাঠের উটকো গন্ধ আসছিল। বিদ্যুৎ চককানোর আলায় দেখতে পেলাম, পাকুড় গাছের ডাল ভর্তি শকুন বসে আছে। কুৎসিত স্বরে ডাকাডাকি করছে। একে অপরে কামড়াকামড়ি করছে। শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে।

নাসরীন বলছিল -- আমার খুব ভয় লাগছে। কী করব! আজ মনে হয় মরেই যাব।

আমারও খুব ভয় লাগছিল কিন্তু সে কথা নাসরীনকে বুঝতে দিলাম না। ওকে বললাম, ' বৃষ্টি থেমে যাবে। আমরা ভ্যান পেয়ে যাব।'

আমরা প্রার্থনা করছিলাম- বৃষ্টি যেন তাড়াতাড়ি ছেড়ে যায় এবং একটা ভ্যান যেন পেয়ে যাই। নইলে দেড় মাইল রাস্তা এই রাতে হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। এইসব ভাবছি, আর অসহায় চোখে তাকিয়ে আছি পথের দিকে।

হঠাৎ পিছনের দিক থেকে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমরা দুজনেই পায়ের শব্দ যেদিক থেকে আসছে সেই দিকে তাকাই। দেখি - খালের দিক থেকে একটা লম্বা গোছের লোক হেঁটে হেঁটে আসছে। সারা শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা। ভয়ে আঁৎকে উঠি। এযে মানুষ নয়! এ একটি লাশ। লাশ হাঁটে কী করে?  নাসরীন  ভয়ে আমার হাত চেপে ধরে। লাশ দেখতে না দেখতে দেখি -- এযে একটি  কঙ্কাল। কঙ্কালটি হেঁটে হেঁটে  অট্টহাসি দিয়ে আমাদের দিকে আসছে!  নাসরীন আমার বুকে বুক রেখে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে  ওঠে। ওর দুই হাত আমার দুই পাজর শক্ত করে ধরে থাকে। আমিও ভয়ে দুচোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকতে থাকি।

কিছুক্ষণ পর চোখ খুলি। দেখি কঙ্কালটি নেই। পাকুড় গাছের ডালে শকুন উড়াউড়ি করছে। বৃষ্টি আরও জোরে নামা শুরু করেছে। আমি নাসরীনকে বলি - কঙ্কাল নেই। চলে গেছে। নাসরীন আমার পাঁজর জড়িয়ে ধরা ওর হাত দুটো ছাড়িয়ে নেয়। 

কিছুক্ষণ ভালোই ছিলাম। বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘ গুরুম গুরুম করছে। হঠাৎ আবার কেমন যেন একটা গোঙানির শব্দ আসছিল পিছনের দিক থেকে। শব্দটা ক্রমেই খুব কাছে থেকে শোনা যাচ্ছিল। দেখি, কালো বিদঘুটে একটি লোক দাঁড়িযে আছে খালের পাড়ে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় দেখা যাচ্ছিল তার কুচকুচে শরীর। সে অনেকটা উলঙ্গ। সামান্য নেংটি পরে আছে। তার গলাটি কাটা। কাটা গলা দিয়ে রক্ত গলগলিয়ে ঝরে পড়ছে। আর গোঙাচ্ছে। ও বাবা! ঐ গলাকাটা লোকটা আমাদের দিকে হামলে আসছে গোঁ-গোঁ শব্দ করে। নাসরীন এবারও জোরে চিৎকার করে দুুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে আমাকে। এবং কাঁদতে থাকে হাউমাউ করে বুকে মুখ লুকিয়ে। আমিও আর্ত চিৎকার করে আল্লাহর নাম ডেকে চোখ বন্ধ করে থাকি। বেহুশ হয়ে কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিলাম জানিনা।

নাহ্ ঐ লোকটা আমাদের ছোঁয় নি। দুরুদুরু বুকে চোখ খুলি। তাকিয়ে দেখি, লোকটা নেই। আমরা ভয়ে ভয়ে দুজন দুজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকি।  বৃষ্টি একটু কমে গেছে। আমি নাসরীনকে ডাকি। বলি - চোখ খোলো। কিছু নেই। সব আপদ চলে গেছে। নাসরীন চোখ খোলে। বাহু বন্ধনও খুলে ফেলে আমার পাজর থেকে। বুক থেকে সরিয়ে নেয় ওর বুক।

একটু পর দেখতে পেলাম - রাস্তার দিক থেকে কয়েকজন যাত্রী নিয়ে একটি ভ্যান আসছে। পিছের আরও একটি ভ্যান যাত্রী নিয়ে খেয়াঘাটে এসে পৌঁছে। ওনারা খেয়ানৌকা ও খেয়ামাঝিকে খুঁজছে। আমরা একটি ভ্যানচালকের সাথে কথা বলে তার ভ্যানে উঠি। এবং চলে আসি ভুবনেশ্বর নদীর তীরে। তারপর খেয়া পার হয়ে রিকশায় ডাকবাংলোয়।

পরিশিষ্ট --

আমাদের চাকুরীটা ছিল খুব অস্থায়ী। কিছুদিনের মধ্যে নাসরীন অন্য জায়গায় চাকুরী নিয়ে চলে যায়। আমিও চাকুরী নিয়ে অন্যত্র চলে যাই। আমি আর নাসরীন পরবর্তীতে কেউই একে অপরের বন্ধু হতে পারিনি। তারপর কত বছর চলে গেছে!  কিন্তু অনেক আগের সেই দূর্যোগময় রাতের কথা, আমাকে জড়িয়ে ধরে নাসরীনের সেই প্রগাঢ় আলিঙ্গনের কথা, আমার বুকের ভিতর তার আশ্রয় নেবার কথা মনে হলে আজও আমি কেমন বিবশ হয়ে যাই। 

নাসরীনের কী মনে পড়ে না দূর্যোগময় সেই রাতের কথা? মেঘগুরুগম্ভীর অদ্ভূতুরে এক ভয়ার্ত ক্ষণে একটি ছেলের বুক জড়িয়ে ধরে সে নিরাপদে ছিল কিছুক্ষণ! তার বুকের মাঝে মাথা রেখে পরম আশ্রয়ের কথা মনে করে আমার মতো তারও মন কী একটুও বিবশ হয়ে উঠে না!

হয়তো উঠে, হয়তো না। 


৩.        ধলেশ্বরী বহমান


তখনও মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়নি। কিন্তু মেঘ না চাইতেই জল পাওয়ার মতো প্রাপ্তি। চাকুরির আবেদন পাঠাতে না পাঠাতেই একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ পদে আমার চাকুরি হয়ে যায়।

মতিঝিলে অফিস। নতুন চাকুরিস্থলে ভালই লাগছে আমার। সবাই আমাকে খুব সহযোগিতা করছে। সবাই আমাকে ভালোবাসে।

একদিন এক সিনিয়র সহকর্মীর সাথে আমি পুরনো ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার ও ইসলামপুরে গিয়েছিলাম ওখানকার কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করতে। আমরা মতিঝিল থেকে একটি রিকশা নিয়ে প্রথমে চানখাঁর পুল গিয়ে নামি। ওখান থেকে হেঁটে নাজিমুদ্দিন রোড ধরে সেন্ট্রাল জেল পর্যন্ত যেতেই আমার সিনিয়র সহকর্মী মাহবুব ভাই বললেন -- বেগমবাজারে আমার এক মামাত ভাই থাকেন। শুনেছি দীর্ঘদিন ধরে উনি বেশ অসুস্থ। এদিকে যেহেতু আসলামই। ওনাকে একটু দেখে তারপর আমাদের কাজ শুরু করব।'

আমরা হেঁটে হেঁটেই বেচারাম দেউরি পার হয়ে একটি সরু গলিতে ঢুকি। গলির একদম শেষ মাথায় অনেক পুরানো একটি আধাপাকা টিনসেড বাড়ি। সেই বাড়িতে ওনারা থাকেন। বাড়িটার বাইরে পলেস্তারা খসে পড়ে গেছে। ফাটলের ফাঁক দিয়ে প্রচুর লতাগুল্ম জন্মেছে। গলির সাথে সদর দরজা। এই দরজা দিয়েই সরাসরি রুমে ঢুকতে হয়।

মাহবুব ভাই দরজায় কড়া নাড়তেই একজন পয়ত্রিশ-উর্ধ্ব বয়সী লোক দরজা খুলে দেন। বুঝতে পারলাম, ইনিই আমার সহকর্মী মাহবুব ভাইয়ের আত্মীয়।

ঘরখানা দেখে মনে হলো- দুটো রুম এখানে। পাশে একটা ছোট বারান্দার মতো আছে , সেটাও রুমের মতোই, রান্নাঘর হবে। আমরা প্রথম রুমটাতেই বসলাম। ঘরের আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিস সামগ্রী দেখে মনে হলো, এরা হতদরিদ্র।

মাহবুব ভাই, লোকটির সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওনার নাম জাকির হোসেন মন্টু। উনি একজন ভালো হারমোনিয়াম ও তবলাবাদক। গানও গান। গানের শিক্ষকও তিনি। পুরনো ঢাকার একটি গানের স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। ওনাকে দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কেমন রোগক্লিষ্ট। শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। গায়ের রং ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হলো, উনি একসময় সুদর্শন ছিলেন। চোখ কোটরে গেলেও চোখদুটো দেখতে বেশ টানা টানা। লম্বা দেহগড়ন, কণ্ঠস্বর অপূর্ব মাধুর্যময়। পুরুষও এত সুন্দর হয়!

ওনার সাথে আলাপচারিতার মধ্যেই উনি পরপর দুটি সিগারেট খেয়ে ফেললেন। আমি অবাক হলাম, এমন একজন রোগা মানুষ এত সিগারেট খায়? ওনাকে বললাম - ভাই আপনি এত সিগারেট খান কেন? আপনার শরীরের যে অবস্থা, এত সিগারেট খাওয়া ঠিক নয়।' উনি ম্লান হেসে বললেন -- 'আমি সব ছেড়ে দিতে পারি- আমার গান, হারমোনিয়ামের সুর, তবলার ঝংকার, ঘর, সংসার, স্ত্রী, স্বজন সব। কিন্তু সিগারেট ছাড়তে পারব না। সিগারেট ছাড়া আমি বাঁচতে পারব 
না।'
-- আপনি তো সিগারেট খেতে খেতে মরে যাবেন।
-- মরে গেলে মরে যাব। তবুও।

জীবনে অনেক সিগারেটখোর মানুষ দেখেছি। কিন্তু এমন মৃত্যুর সাথে জুয়া ধরে সিগারেট খেতে কাউকে দেখিনি। লোকটিকে দেখে রাগও হলো, আবার মায়াও হলো। জানিনা, জীবনের কোন্ পরাজয়ে তার এই অধপতন!

আমরা যখন কথা বলছিলাম -- তখন পাশের রুম থেকে আধো ঘোমটা দিয়ে একজন স্ত্রীলোক চলে আসেন আমাদের বসার ঘরে। গায়ের রং ফর্সা তার, কালো চুল, মায়া জড়ানো দুটো চোখ, হ্যাংলা পাতলা দেহগড়ন, বয়স কতই হবে- সাতাশ আটাশ। কী অপূর্ব সুন্দর সে দেখতে। একদম ছবির মতোন!

মাহবুব ভাই পরিচয় করে দিলেন ইনি আমাদের রোজী ভাবী। আমাকে দেখিয়ে বললেন -- ও আমার জুনিয়র কলিগ - আরিফ রহমান। মাহবুব ভাই ওনাকে রসিকতা করে বললেন, ভাবী, তুমি ওকে দেবরও ভাবতে পারো, ছোট ভাইও মনে করতে পারো। খুব ভালো ছেলে। একদম সহজ সরল।

মনে মনে কামনা করছিলাম, আমি এই অপূর্ব সুন্দর মেয়েটির দেবর হতে চাই না। ছোট ভাই হতে চাই। কেমন যেন দিদি দিদি সরল মুখোয়ব তার। কিন্তু উনি আমার এই আশাকে হতাশ করে দিয়ে সহাস্যে বললেন -- ' এ আমার নবীন দেবর'।

মন্টু ভাই ওনাকে বললেন, ' রোজী, তা তোমার এই দেবরদ্বয়কে নাস্তাপানি কিছু খেতে দাও।' এ কথা শুনে রোজী ভাবীর মুখটা মলিন হয়ে যায়। বুঝতে পারলাম, খেতে দেওয়ার মতো ঘরে হয়তো তেমন কিছু নেই। মন্টু ভাইও বুঝতে পেরে বললেন - 'বাইরে থেকে কিছু কিনে নিয়ে আসো'। এবারও ভাবীর মুখটা আরও বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেল। বুজতে পারলাম, ঘরে হয়তো টাকাও নেই।

ভাবী চলে গেলেন।

এরই ফাঁকে অনেক কথাই হচ্ছিল মন্টু ভাইয়ের সাথে। একসময় তিনি রেডিওতে তবলা ও হারমোনিয়াম বাজাতেন। বড়ো বড়ো গানের অনুষ্ঠানে যেতেন যন্ত্রীদলের সাথে। অসুখের কারণে এখন আর যেতে পারেন না।

আলাপের মাঝেই মন্টু ভাই আরও দুটো সিগারেট খেয়ে ফেললেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম, ওনার নানাবিধ রোগ। ডায়বেটিস, ফুসফুসে ইনফেকশন। লিভার ও কিডনির অবস্থাও ভালো নেই। রোগগুলো ক্রনিক হয়ে গেছে। কয়েকটি গানের টিউশনি করত। অসুখের জন্য তা কমিয়ে দু-তিনটি করে এখন। গানের স্কুলেও যেতে পারে না। হঠাৎ করেই যে কোনো সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। নেবুলাইজার নিতে হয়। শ্বাস কষ্টের কারণে আগের মতো সুর তুলতে পারে না কণ্ঠে। আঙুলও ঠিক মতো চালাতে পারেন না হারমোনিয়ামের রীডে, তবলায়ও তাল তুলতে পারেনা আগের মতো। হাত কাঁপে।

একটু পর রোজী ভাবী পুরানো ঢাকার বাকরখানি ও দুধের ছানা খেতে দিলেন। চা বানিয়েও খাওয়ালেন। আমাদের খাওয়া শেষ হলে মাহবুব ভাই বললেন- আমরা আজ আসি। মন্টু ভাই বললো, তোমরা আবার এসো।

এতক্ষণ রোজী ভাবী আমার সাথে একটি কথাও বলেনি। বিদায়কালীন সময়ে আমার দিকে আনত চোখে চেয়ে বললেন- 'নবীন দেবর, তুমি ভুলে যেওনা এই ভাবীকে। এসো আবার।'

আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম - আসব।

এর মধ্যে প্রায় দেড় মাস চলে গেছে, মন্টু ভাই ও রোজী ভাবীকে দেখতে যাওয়া হয়নি। এর কারণও ছিল, ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে পুরনো ঢাকার ঐদিকটায় আর যাওয়া পড়েনি। সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিল-- মাহবুব ভাই আমাদের অফিস ছেড়ে অন্য কোম্পানিতে চাকুরি নিয়ে চলে গেছে। তাও ঢাকায় নয়, একেবারে চট্টগ্রামে। উনি থাকলে হয়তো যাওয়া হতো।

এর মাঝে রোজী ভাবীদের কথা মনে পড়েছে আমার। প্রায়ই ইচ্ছে হতো আমি একাই যেয়ে ওনাদের দেখে আসব। কিন্তু কেমন যেন সংকোচ অনুভব করতাম। আমি ওনাদের তেমন কেউ না। কোনও আত্মীয়ও নই - হঠাৎ এমনি করে চলে যাব? কী মনে করবে তারা? যদি ভাবে রোজী ভাবীর প্রতি আমি দূর্বল। যদি মনে করে কার জন্য এত টান? গায়ে পড়ে কেন দেখতে যেতে চাও? কার জন্য তুমি যেতে চাও?

রোজী ভাবীর জন্যই আমার যেতে ইচ্ছে করে। ওনার প্রতি কেন জানি আমার মায়া জন্মে গেছে। এই মায়াটা কেন হচ্ছে বুঝতে পারিনা। তারা গরীব! অসহায়! এই জন্য? তাহলে তো করুণা হয়ে গেল। কিন্তু এ যে করুণাও নয়। সেদিনের বিদায়কালীন সময়ে ভাবীর সেই কথা এখনও কানে বাজে -- 'নবীন দেবর, তুমি ভুলে যেওনা এই ভাবীকে। এসো আবার।' 

সব দ্বিধা দূর করে একদিন ছুটির দিনে আমি রোজী ভাবীর বাসায় আবার যাই। ভাবী আমায় দেখে খুশি হলেন। মন্টু ভাই খাটের উপর শুয়ে আছে। শরীরটা আরও বেশি খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে দেখে উনি উঠে বিছানায় বসলেন। এবং বললেন - খুশি হলাম তুমি এসেছ।  

মন্টু ভাই সিগারেট ধরালেন। আজও ওনাকে বললাম -  আপনি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিন মন্টু ভাই। 

ভাবীকে বললাম - আপনি সিগারেট খাওয়া ছাড়াতে পারেননি? 

-- পারিনি। ওর আরও অনেক খারাপ অভ্যাস ছিল। যেমন, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকা। সুরা পান করা। সময় মতো আহার না করা। বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি করা। এই সবগুলো ছাড়াতে পেরেছি। শুধু সিগারেট খাওয়া বাদ দেওয়াতে পারিনি। 

ভাবী বলছিল - 'তুমি এসেছ ভালোই করেছ। আমরা এখানে আর বেশি দিন থাকব না। তুমি না এলে তোমাকে আর হয়তো দেখতে পেতাম না।'

বললাম - কোথায় চলে যাবেন? 

-- তোমার মন্টু ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি নাগরপুরে।

ভাবী আরও বললেন -- এখানে আমরা আর থাকতে পারছি না। তোমার মন্টু ভাইয়ের আয় রোজগার আর নেই বললেই চলে। মাস শেষে বাড়ি ভাড়া দিতে পারিনা।  দেশের বাড়িতে কিছু জমিজমা আছে, তাই থেকে জীবন চলবে। ওখানে কুমুদিনী হাসপাতালে তোমার ভাইয়ের চিকিৎসাও করানো যাবে। 

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এরা আমার আপন ভাই ভাবী নয়, তাই বলে কী এদের জন্য আমি কিছু করতে পারি না? কিন্তু কতটুকুই বা করতে পারব? সাময়িক দানে এদের কী চিরদিনের করে ঢাকায় রাখতে পারব? আর আমার দান ওনারা গ্রহণও করবে না। 

সেদিন রোজী ভাবীর ওখান থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় ভাবীর হাতে জোর করে কিছু টাকা দিয়ে বলেছিলাম -- 'মন্টু ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য রাখেন।' রোজী ভাবী গ্রহণ করতে চাননি। আমি বললাম- 'আপনি না আমাকে দেবর ডেকেছেন। আমি মন্টু ভাইয়ের ছোট ভাইয়ের মতো।'  দেখলাম, ভাবীর চোখদুটো জলে ছলছল করে উঠেছে। 

অফিসের কাজের চাপে বেশ কিছুদিন রোজী ভাবীর ওখানে  যাওয়া হয়নি। সেদিন অফিস থেকে একটু আগেই বের হই। একটি রিকশা নিয়ে চলে যাই জেলখানা পর্যন্ত। ওখান থেকে হেঁটে ভাবীর বাসায়। গিয়ে দেখি, সব জিনিসপত্র তারা গুছিয়ে বেঁধে রেখেছে। ভাবী নিজ থেকেই বললো - কাল সকালে চলে যাচ্ছি গ্রামের বাড়ি। তুমি একবার নাগরপুরে চলে এসো আমাদের দেখতে। ভুলে যাবে না। 

ভাবীকে বললাম - ভুলব না।  

মন্টু ভাইয়ের হারমোনিয়ামটা দেখলাম বিছানার উপরে পড়ে আছে। তবলা দুটোও আছে একপাশে। মনটা এত খারাপ লাগছিল যে কান্না পাচ্ছিল খুব। মন্টু ভাইকে বললাম, মন্টু ভাই একটা গান গেয়ে শোনান না! 

মন্টু ভাই সিগারেট ধরালেন, বললেন- আমার কণ্ঠ নষ্ট হয়ে গেছে, গাইতে পারি না। তোমার ভাবীও গান জানে। সেই শোনাক তোমাকে গান।

মন্টু ভাই ভাবীকে বললো - তুমি আরিফকে একটা গান গেয়ে শোনাও। 

মন্টু ভাই বলছিল, জানো আরিফ, আমার গান শুনেই তোমার ভাবী আমাকে ভালবেসেছিল। আর আমিও তোমার ভাবীর গান শুনে তাকে ভালবেসেছিলাম। দুজন একসাথে বসে কত রাঙা ভোরে হারমোনিয়ামে কণ্ঠ সেধেছি। কত বৃষ্টির দিনে গেয়েছি বর্ষার গান। কত হেমন্ত রাত্রি নিদ্রাহীন করে কাটিয়ে দিয়েছি গুনগুন করে গানে গানে। গেয়েছি দুজন যুগল কণ্ঠে -

আমরা এমনি এসে ভেসে যাই
আলোর মতন, হাসির মতন
কুসুমগন্ধ রাশির মতন
হাওয়ার মতন, নেশার মতন
ঢেউয়ের মতন ভেসে যাই।

আমি জানতাম না রোজী ভাবীও গান গাইতে পারে। আমিও ওনাকে বললাম, গেয়ে শোনান না ভাবী একটি গান। ভাবী নিজেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইলেন-

প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে   আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে   আরো আরো আরো দাও স্থান ॥
আরো আলো আরো আলো
এই      নয়নে, প্রভু, ঢালো।
সুরে সুরে বাঁশি পুরে
তুমি    আরো আরো আরো দাও তান ॥

ভাবী এমন করে গানটি গাইলেন যেন সহসা বেগম বাজারের একটি সরু গলির জীর্ণ পলেস্তারা খসে পড়া একটি কক্ষ বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল। মন্টু ভাই তবলায় তাল দিচ্ছিল, তার হাতটাও তবলার উপর হিম হয়ে থেমে গেল। গান শেষে রোজী ভাবীর চোখ কেমন আদ্র হয়ে উঠল। তার সেই  নিমীলিত চোখের তারায় জগতের অনেক অশ্রু যেন টলমল করছে। ঘরের ভিতরকার স্বল্প আলোয় তা সে লুকাতে পারল না।

সেদিনের সেই স্তব্ধবাকের  বিকালে একটা কথাই ভাবছিলাম, মানুষের কত অজানা বিস্ময় অজানা থাকে অন্য কারোর কাছে। এমন কত জীর্ণ কুটিরে কত বিস্ময়কর প্রতিভা আলোহীন হয়ে পড়ে থাকে নিবিড় আঁধারে। কেউ তাকে হাত ধরে আলোতে নিয়ে আসেনা। 

ভাবী ক্ষীণ কণ্ঠে আঁধার নেমে আসা সেই সন্ধ্যায়  বলেছিল-- 'এসো ভাই তুমি আমাদের বাড়ি। এসো তুমি। ধলেশ্বরীর তীরে ঘুরতে ঘুরতে তোমাকে শোনাব আরও গান। নৌকায় ভেসে ভেসে চলে যাব দূর বালুচরে। ওখানে ফুটে থাকে অজস্র কাশফুল। উড়ে সেখানে ধবল বক, পানকৌড়ি। দেখব আকাশ জুড়ে শরতের শুভ্র মেঘমালা।'

আমি রোজী ভাবীর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সরু গলি ধরে হাঁটতে থাকি। পা চলছিল না মোটেই। পিছনে ফিরিয়ে দেখার কিছু নেই। খালি মনে হতে লাগল - কেউ মনে হয় গোপনে টপটপ করে চোখের জল ফেলছে। ল্যাম্পপোস্টে একটি বাতিও তখন জ্বলেনি। কেমন আঁধার হয়ে আছে গলিটা। নেড়ি কুকুর ভুগ ভুগ করছিল অপরিচিত আমাকে দেখে। বেগম বাজারের মোড়ে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে কতকগুলো ছেলে বলছে -- '' নীল ছবি, নীল ছবি, ব্লু, ব্লু, সুইডিশ-সুইডিশ, ইতালিয়ান- ইতালিয়ান।'' বুঝতে পারলাম এখানে বিভিন্ন বাড়িতে ভিসিআরে  নীল ছবি দেখানো হয়। আমি ওদিকে কান দিলাম না। একটি টং দোকান থেকে একটি সিগারেট কিনে ধরাই। কোথাও না দাঁড়িয়ে সিগারেটটি টানতে টানতে হেঁটে চলে আসি চানখাঁর পুল। ওখান থেকে রিকশায় আমার মেসে।  

কদিন খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। কী এক যাতনা হতো বুকের ভিতর। অফিসে মনমরা হয়ে থাকতাম। লেখার সময় কলম চলত না। খিদে পেলেও খেতে মন চাইত না। মানুষ তার বর্তমান দুঃখকেই মনে হয় বড় করে দেখে। আমিও তাই দেখতাম। এমনি এমনি চোখ থেকে জল ঝরে পড়ত। 

তারপর আস্তে আস্তে সব ভুলে যাই। সময় বহিয়া যায়। অতীতের স্মৃতি চাপা পড়তে থাকে মধুময় বড়ো কোনো প্রাপ্তিতে। কর্মক্ষেত্রে সুনাম বাড়তে থাকে আমার। ভালো জায়গায় ভালো অফারে নতুন চাকুরি নিলাম। অনেক বড়ো কর্তাব্যক্তি হয়ে উঠলাম। ঘরে অসম্ভব সুন্দরী মায়াবতী বউ এল। সন্তান এল। কবেকার এক মন্টু ভাই ও একজন রোজী ভাবী মনের অতল গহীনে চাপা পড়ে গেল। যে রোজী ভাবী একসময় আমার মনকে এমন করে আলোড়িত করেছিল, সময়ের বিবর্তনে তাকে কী নিমিষেই ভুলে গেলাম। যদিও মাঝে মাঝে মনে হতো - একবার চলে যাই ধলেশ্বরীর তীরে, খুঁজে দেখে আসি হতভাগী রোজী ভাবীকে। যখনই ভাবতাম এইসব কথা, তখনই ছায়ার মতো সামনে এসে দাঁড়াত আমার মায়াবতী স্ত্রী। তার মুখের ঔজ্জ্বল্যের কাছে রোজী ভাবীর মুখখানি নিষ্প্রভ হয়ে যেত। নিমগ্ন আঁধারে হারিয়ে যেত রোজী ভাবীর ধূসর মুখ। 

বছর সাতেক পরের কথা। একবার বাসে করে সিরাজগঞ্জে বাড়িতে যাচ্ছিলাম। বাসটি একসময় মির্জাপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে থামে। আমি জানালার কাছের সিটে বসা ছিলাম। বাইরে পথের উপর তাকিয়ে দেখি, একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার সাদা সুতি শাড়ি। অনাড়ম্বর তার বেশভূষা। মুখে কোনো প্রসাধনী মাখা নেই। আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটিকে। চিনতে পারলাম তাকে। এ যে আমার রোজী ভাবী। আমি বাস থেকে নেমে পড়ি। কাছে গিয়ে ডাক দেই - 'ভাবী'। 

রোজী ভাবী আমাকে চিনতে পারে। সে বললো - তুমি এখানে!

- বাসে বাড়িতে যাচ্ছিলাম, আপনাকে দেখে নেমে পড়ি। তা আপনি এখানে? 

- হ্যাঁ, আমি এখানে আসি প্রতি বছর এইদিনে।

কুমুদিনী হাসপাতালটি দেখিয়ে রোজী ভাবী বললেন-- আজ থেকে ছয় বছর আগে এই হাসপাতালের একটি বেডে তোমার মন্টু ভাইয়ের প্রাণ চিরতরে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমি আসি এখানে এইদিনে। হাসপাতালের একটি প্রকোষ্ঠে সেই বেডটির কাছে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাই তোমার মন্টু ভাইকে। দেখি, কী সুন্দর করে সে ঘুমিয়ে আছে। আমি তাকে ছুঁয়ে দেখি। তার হিম হয়ে যাওয়া শরীরের স্পর্শ অনুভব করি। আমি কান পেতে শুনি তার আত্মার স্পন্দন! 

-- খুব খারাপ লাগছে মন্টু ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে। আল্লাহ ওনাকে বেহেশতে রাখুন।' ভাবীকে বললাম - আপনি এখন কোথায় থাকেন? 

-- নাগরপুরে ধলেশ্বরী নদীর তীরে ছায়া ঘেরা একটি গ্রামে। তোমার মন্টু ভাইয়ের সমাধি সেখানে। ওখানেই আমি থাকি। ওখানকার একটি স্কুলে ছোট ছোট বাচ্চাদের গান শিখাই। সময় কেটে যায়। প্রথম প্রথম খুব একাকী লাগত। তোমার কথা খুব মনে হয়েছে।  তা তুমি বিয়ে করেছ নিশ্চয়ই। 

--  জ্বী। 
--  বউ দেখতে কেমন? 
--  আপনার মতো। ওর মুখে আপনার ছায়া দেখতে পাই। 
-- নাম কী?
-- মহুয়া। 
-- বাচ্চা হয়েছে? 
-- জ্বী। একটা মেয়ে । 
-- কার মতো দেখতে হয়েছে ? 
-- মায়ের মতো। 
-- নাম কী?
-  রোজ। 
-  খুশি হলাম। 

আমি রোজী ভাবীকে বললাম -- 'ঢাকায় আর স্থায়ী হবেন না কখনও ? আসবেন না? 

-- না। এখানেই ভালো লাগে। মনখারাপ হলে চলে যাই ধলেশ্বরীর তীরে। কী অপরূপ রূপে ধলেশ্বরী বহমান।  শীতল বাতাস বয়ে আসে চরাচরের কাশফুলের সুবাস মেখে। সে বাতাস এসে লাগে আমার গায়ে। দেখি, দিগন্ত জুড়ে খোলা আকাশ। কী যে ভালো লাগে তখন। ভুলে যাই সব বঞ্চনার কথা।

বাসটি এতক্ষণ অতিরিক্ত বেশ কয়েক মিনিট দাঁড়িয়েছিল আমার জন্য। চালক ভেঁপু বাজাচ্ছিল বারবার। রোজী ভাবীকে বললাম -  যেতে হবে। আসি ভাবী। 

-- এসো। 

আমি দ্রুত এসে বাসে উঠি। জানালার কাছে সিটে বসতে না বসতে বাসটি অনেকদূর চলে আসে। জানালা দিয়ে তাকাই বাইরের দিকে। কিন্তু রোজী ভাবীকে আর দেখতে পেলাম না। ততক্ষণে সে আড়াল হয়ে গেছে। 

_________________________________
ডিসক্লেইমার --
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অতসী মামি' গল্পটি পড়ে  অনুপ্রাণিত হয়ে এই লেখাটা লিখেছি  । 


৪.         পৃথিবী : The Earth


'যে ভালোবাসা দূরের, যার ব‍্যপ্তি বিশ্বলোক ছাড়িয়ে অপার্থিব অন‍্য কোনো ভূবনে বিরাজ করে। সেই ভালোবাসার জন‍্য বৈরাগ্য জীবনই শ্রেয়। পার্থিব অন‍্য আর কোনো মায়ায় জড়িয়ে যেতে নেই।' এই কথা গুলো বলছিল আয়ান হায়দার। আয়ান এসেছিল লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে বাংলাদেশে। যাযাবরীয় জীবন তার। এখানে সে এসেছিল কোনো সুশৃঙ্খল জীবনের সাথে নিজেকে শৃঙ্খলে জড়াতে। কিন্তু করেনি। এলমেল জীবন যেমন ছিল তেমনই নিয়ে সে আবার ফিরে যাচ্ছে।

আয়ান চলে যাচ্ছে। আমি জানি, ওর এলমেল জীবন আরও বেশি অগোছালো হয়ে যাবে। দুই দিন কর্মে থাকবে তো, তিন দিন ঘুরবে ভবঘুরের মতো। বড়ফ পড়া শীতের রাত্রিতে কোনো পর্বতের পাশে তাঁবু টানিয়ে ক‍্যাম্প ফায়ার জ্বেলে উত্তাপ নিবে। ওর নিরুত্তাপ জীবনের উষ্ণতা খুঁজবে, তুষার পড়া রাত্রি দুপুরে।

ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল এমনি এক শীতের রাত্রিতে লস এ্যাঞ্জেলসের ডাউন টাউনে একটি কফিশপের দোতলায়। আমি ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, পদ্মা যমুনা মেঘনা পাড়ের কেউ একজন হবে। আগ বাড়িয়ে আমিই পরিচিত হয়েছিলাম। বয়সে আমার তিন চার বছরের ছোট হবে। কিন্তু আমি ওর ক্ষণিক বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম আমার সেই ক্ষণকালের প্রবাস জীবনে। 

আমার সেই ক্ষণকালের প্রবাস জীবনে ওর সাথে কয়েকটি বিকেল কাটিয়েছিলাম প‍্যাসিফিকের তীরের লং বীচ, মালিবু ও সান্তা মনিকায়। এক রাত কাটিয়েছিলাম ওর বাড়িতে। আর একদিন দুজনে সারারাত কাটিয়েছিলাম ডাউন টাউনের গ্রান্ড পার্কের বেঞ্চের উপরে।

মালিবু বিচের বালুকাবেলায় একদিন দুজন হাঁটছিলাম। আমাদের পিছনে ছিল পাহাড়। সামনে প‍্যাসফিকের বিশাল জলরাশি। একদিকে নাম না জানা কতো লতাগুল্ম আর থোকা থোকা ফুলের ঝাড়, আর অন‍্যদিকে বিকালের লাল মেঘের আভা মিশ্রিত রুপালি জলের ঢেউ। কথা বলছিলাম আমরা সাগরের দিকে মুখ চেয়ে। কেন যেন মনে হলো, আয়ানের মুখ বিষণ্ণ! মুখ ফিরে চেয়ে দেখি --  আয়ানের চোখের নীচে যেন প‍্যাসিফিকের লোনা জল। দেখলাম, মলিন হতশ্রী মুখচ্ছবি ওর। বিকালের রক্তিম সূর্যের রশ্মি সেই মুখকে একটুও রোশনি ছড়াতে পারেনি।

আমি আয়ানের পিঠে হাত রেখে বলেছিলাম, 'তুমি এমন একলা কেন? এখানে এই পরবাসে তোমার কেউ কী নেই? কদিনের দেখায় মনে হয়েছে, কোথায় কোন্ গভীরে, প‍্যাসিফিকের ঐ অতলান্তে তুমি তোমার অসীম কোনো দুঃখকে লুকিয়ে রেখেছ।' সেদিনের সেই নিমগ্ন সাগর বিকালে দূর হতে দমকা বাতাস বয়ে এসেছিল। আয়ানের এলমেল খুসকো চুল হাওয়া লেগে উড়ছিল। কিছুই বলতে চায়নি আয়ান, আবার বলতেও চেয়েছিল কী যেন কথা।

সেদিন মালিবু বীচের অপ্রসন্ন সেই বিকালে কিছুই বলেনি আয়ান। বলেছিল আর একদিন ওর বাড়িতে। ওয়েল ডান কার্ণ কান্ট্রি এরিয়াতে নিরিবিলি ছোট্ট একটি রেন্ট বাড়িতে ও একাই থাকত। গ্রামীণ ছিমছাম একতলা বাড়ি। ঐদিন ঐ বাড়িতে আমি রাত্রিবাস করেছিলাম। বাড়ির পিছনে ছোট্ট একটি বারান্দা ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা সেই বারান্দায় বসে কথা বলেছিলাম। অনেক কথাই সেদিন হয়েছিল।

আয়ানের বাড়ির বারান্দায় বসে সন্ধ্যায় দেখেছিলাম পিছনে একপাশে টিউলিপ ফুলের প্রান্তর, আরেক পাশে লিলি। মাঝখানে মেঠো পথের দুপাশে কার্ণেশনের ঝাড়। আমরা বসে যখন কথা বলছিলাম, তখন পিছনের প্রান্তর থেকে এইসব ফুলের গন্ধ আসছিল। রাত বেড়েই চলছিল। আয়ান আমাকে ওয়াইনের ওফার করেছিল। আমি বললাম, না। শুধু সিগারেট। এ‍্যাস্ট্রেতে এক এক করে পোড়া সিগারেটের ছাই দিয়ে ভরে উঠছিল। 

তখন ভালো লাগছিল ওয়েল ডান কান্ট্রির আকাশ। মনে হয়েছিল এ যেন বাংলাদেশের আকাশ! এ যেন আমাদের কুসুমপুরের তারাভরা রাত্রি। মাঝে মাঝে হিম প্রবাহ বয়ে আসছিল দূরের সান গাব্রিয়েল মাউন্টেন থেকে। সেদিন তারার আকাশে কোনো কথা ছিল না।  টিউলিপ ঝাড়ে কোনো জোনাকির গান নেই। বাতাসের কোনো শব্দ নেই। নিশ্চুপ ছিল নির্জন বিজন রাত। কী এক বিষাদ ছড়িয়ে সেদিন সেই রাতে আয়ান হায়দার বলেছিল তার কথা।

খুব সংক্ষেপিত করে আয়ানের মুখ থেকেই সে কথা শুনি:

মেয়েটির নাম ক‍্যাথেরিন রিচি। আমি ওকে ডাকতাম রিচি বলে। ও এসেছিল ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো থেকে। রিচি ছিল একজন স্ট্রিপ গার্ল। প‍্যাসাডোনার নাইট ক্লাব ক্রেইক এ‍্যাভিনে ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। নীল ঝলমলে আলোর নীচে আমি ওর বাঙালি মেয়েদের মতো কালো চোখ দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম।  ওর ঐ চোখ দেখেই আমার ভাল লেগেছিল। প্রথম কথা ছিল, 'তুমি কে? কোথা থেকে তুমি এসেছ। তোমার নাম কী?' তারপর বলেছিলাম, 'তোমার কথা কিছু বলো।' রিচি বলেছিল --  I am Katherine Ricci , came from Reo de Jenerio, Brazil. I am no bird, and no net ensnares me, I am a free human being with an independent will.' 

রিচির কোনো ঘর ছিল না। পাখির বাসার মতো আশ্রম ছিল না। কিন্তু, সেই মেয়ে পাখির মতো নীল আকাশে উড়ত। রিচি বলেছিল -- 'আমি ধূসর কালো মেঘ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির জলে ভিজি। রঙিন জলসায় পিয়ানো'র সুরে আমার অন্তর বীণা বাজে। আমার দুঃখ নেই। আমার সমস্ত বেদনা সুখ হয়ে যায় মূহুর্তে এই সব নৈশ ক্লাবের আনন্দে।'

আয়ান একের পর এক সিগারেট শেষ করছিল। আমি বললাম, 'তারপর কী হলো? ঐ মেয়েকে তুমি কী ভালোবেসে ফেলেছিলে?'

আয়ান :  জীবনের দুঃখতম নিয়তি ঈশ্বর মনে হয় নির্ধারিত করে রেখেছিল আমার জন্য। যে পাখির বাসা নেই। তার বাসা পৃথিবী জুড়ে নীল আকাশ। আমি রিচিকে এই ঘরে এনেছিলাম, বলেছিলাম-- এই ঘর তোমার। এখানেই তুমি তোমার সংসার বাঁধো। তোমাকে সন্তান দিব।

রিচির চোখ সত্যি বাঙালি। শাড়ি পরিয়েছিলাম ওকে বিয়ের রাত্রিতে। কী সৌভাগ্য! বাসর শয‍্যায় ওর ভ্রূণ তৈরি হলো। এক অনাগতের স্পন্দন ধ্বনি সেই রাতেই শোনা গেল।

আয়ান একের পর এক সিগারেট টেনেই যাচ্ছিল। কথা বলতে যেয়ে থেমে থেমে যাচ্ছিল বার বার। আমি বললাম -- তারপর ?

আয়ান : আমাদের সেই সন্তানটির পৃথিবীতে চলে আসবার দিন ক্ষণ খুব কাছাকাছি চলে আসতে থাকে। উইলশেয়ার বেলেভার্ডের সামারিতান হসপিটালে রিচির  একটি চেক আপ ছিল। ডাঃ লী জয়নার ওকে হসপিটালে ভর্তি করে নেয়।

আয়ান আমাকে বলছিল, তুমি কী গান গাইতে পারো রঞ্জন? আমি বলেছিলাম -- ভালো পারি না। 
--- তবুও শোনাও।
--- কী গান গাইব, বলো?
--- রবীন্দ্রনাথের গান।
--- কোন্ গানটি গাইব?
--- জীবন যখন শুকায়ে যায়।
--- আচ্ছা, গাইছি।

অন্তরা পর্যন্ত গানটি আমি সেই দিন আয়ানকে গেয়ে শোনায়েছিলাম। শেষটুকু আর গাওয়া হয়নি। রাত তখন অনেক হয়ে গিয়েছিল। হিম বাতাস বয়ে আসছিল প্রবলবেগে। মনে হচ্ছিল, কার্নেশন, আর টিউলিপ ঝাড়ে জলের মতো বিন্দু বিন্দু করে তুষার ঝরে পড়ছে।

আমি আয়ান হায়দারকে বলি -- তারপর?
আয়ান : একদিন হসপিটাল বেডে শুয়ে থেকে রিচি আমাকে বলেছিল --- যদি দূরে চলে যাই। জীবনের ওপাড়ে যদি অন‍্য কোনো ভূবন থাকে, সেই ভূবনেও তুমি এসো।

কতো প্রহর, কতো ক্লান্তিতে পথ ধরে হাঁটছি। আকুল হয়ে অপেক্ষায় আছি ওর ভুবনে পৌঁছার। কিন্তু ওর সেই ভুবন ওর সেই পৃথিবী যে অনেক দূর!


৫.       অদিতি 

চৌদ্দ বছর ধরে অদিতির সাথে আমার কোনও যোগাযোগ ও দেখা সাক্ষাৎ নেই। চৌদ্দ বছর পর ম্যাসেঞ্জারে অদিতির এই প্রথম একটি ম্যাসেজ পেলাম। অদিতি লিখেছে -- " জানি, তুমি আমায় দেখতে আসবে না। তবুও বলছি। একবার এসে দেখে যেও আমাকে। শরীর একদম ভালো নেই। হাসপাতাল আর বাড়ি, বাড়ি আর হাসপাতাল -- এই করেই দিন চলে যাচ্ছে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে তোমাকে এই ম্যাসেজটি লিখছি। কেন জানি - তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। একবার এসে  দেখে যেও। কেবিন নং ১২, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

অদিতির সাথে আমার একটি চির অভিমান ছিল। 
কেন ওর প্রতি আমার  অভিমান তা অদিতি জানেও না। ওকে বলিও নি।  আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কোনোদিন আর অদিতির সাথে দেখা করব না। দেখা করিও নি এত বছর।

এই চৌদ্দ বছর অদিতি হয়ত আমাকে নিয়ে অনেক রকম ভুল বুঝে থেকেছে। হয়ত ভেবেছে আমি ওকে ভুলে গেছি। হয়ত ভেবেছে, বিয়ে করেছি তাই  স্ত্রী সন্তান নিয়ে দূরে চলে এসেছি। হয়ত ভেবেছে - আমি ওর একজন নিষ্ঠুর বন্ধুই কেবল ছিলাম।

আসলেই অদিতির সাথে নিষ্ঠুরতা আমি করেছি। এই অদিতিকে নিয়ে আমি একসময় ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছি। রিকশার হুডি ফেলে রোদ্রকরোজ্জ্বল আলোর নিচ দিয়ে পথ চলেছি। রেস্টুরেন্টে বসে কত খেয়েছি। নাটক পাড়ায় নাটক দেখেছি। সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখেছি। 

আমাদের প্রিয় ছিল নদী। ঢাকার আশেপাশে সবগুলো নদীর কূলে আমরা বেড়াতে গিয়েছি। নৌকায় ভেসেছি নদী বক্ষে। নদীর  উদ্ভ্রান্ত শীতল বাতাসে ওর খোলা চুল এলমেল হয়ে উড়ে এসে আমার মুখ ঢেকে দিত। ওর চুলের ফাঁক দিয়ে দেখেছি নীল আকাশ।  আমরা জলের দিগন্ত ছুঁতে নদীর স্রোতে ভেসে গিয়েছি। আমরা ডানামেলা গাংচিল হয়ে শূন্যে উড়ে বেড়িয়েছি। আমরা তুলোর মতো মেঘে মেঘে ভেসে ভেসে মিশে গেছি।

অদিতির সাথে পথ চলতে চলতে অনেক সময় পথ হারিয়ে ফেলতাম। ভুল পথে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম অনেক দূর!  চিনতাম না কোথায় আমরা এলাম। এইরকম কত পথ হারিয়েছি পথের উপরে।  প্রায়ই মনে হতো আমরা কোনও অরণ্যে চলে এসেছি। ময়ুরের পেখম পড়ে আছে বনপথে। বনবীথির ঘন ছায়াতল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আরও বন নিবিড়ে। কতরকম ফুলের গন্ধ নিতাম। কত পাতা ঝরার মর্মর শব্দ শুনতাম দুজন কান পেতে। শালবনে  বর্ষার দ্বিপ্রহরে এক ময়ূরকে পেখম মেলে নাচতে দেখেছিলাম। নাচতে নাচতে তার পেখম খুলে পড়েছিল। ময়ূরী তা দেখছিল কেবল। ময়ুরের কষ্ট দেখে ময়ুরী নিষ্ঠুর থাকতে পারেনি। তার কাছে যেয়ে কানে কানে ময়ুরী কী কথা বলেছিল, বুঝতে পারিনি তা। হয়ত মিলনের কথা বলেছিল। 

একবার একটি ছোট্ট খোলা কাঠের লঞ্চে করে পদ্মা পারি দিয়ে ভাগ্যকূল গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য - ওখানে নদীর ঘাটে হোটেলে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাব। লঞ্চটি যখন মাঝ দরিয়ায় তখন আমরা খোলা ছাদের রেলিঙের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। চারদিকে থৈথৈ জল। কোথা থেকে ঝলকে ঝলকে পুণ্যময় হাওয়া এসে অদিতির কুসুম কোমল চুল উড়িয়ে দিচ্ছিল। উড়ছিল ওর শাড়ির আঁচলও। ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ গানের সুরের মতো মনে হচ্ছিল। হঠাৎ  দেখি - অদিতি শীতে কাঁপছে। ওর কপাল ছুঁয়ে দেখি, শরীরে বেশ জ্বর।  অদিতি বলছিল -- 'আামাকে একটু জড়িয়ে ধরো।' ওর শাড়ির আঁচল দিয়েই ওকে ভালো করে ঢেকে আমার  বাহুডোরে  জড়িয়ে রাখি। জ্বরের ঘোরে অদিতি বলছিল -- পদ্মার অতল জলে আমাকে নিয়ে যাও।  আমি মরব এই জলধীতে।'

আমাদের আর ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া হয়নি সেদিন । ভাগ্যকূলে নেমে আর একটি লঞ্চে করে ঢাকায় ফিরে এসেছিলাম।

আর একটি ঘটনার কথা বলছি! ঘটনাটি স্বপ্ন না বাস্তব তা এখনও ভ্রান্ত হয়ে আছে আমার জীবনে। হয়ত স্বপ্ন দেখেছিলাম, নয়ত বাস্তবটাই স্বপ্নের মতো মনে হয়েছে।
কালিগঙ্গার তীরে একটা ভাঙা রথঘর। চৈত্রের তপ্ত দুপুরে নদীর কূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি আর অদিতি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমরা রথঘরটিতে গিয়ে বিশ্রাম নেই। বাইরে তখন তপ্ত রোদ ঝনঝন করছে। কোথাও কেউ নেই। একটা পরিত্যক্ত বেঞ্চের উপর দুজন বসি। সামনে নদী বয়ে চলেছে। জল শান্ত। চিকচিক করছে সূর্যের রশ্মি পড়ে। পাশে জঙ্গল থেকে একটি গিরগিটি জলে গিয়ে ঝাপ দিল। জল আলোড়িত হলো।  

অদিতি বলছিল -- 'আমার ঘুম পাচ্ছে।' আমি বলি --
-- এখানে কোথায় ঘুমাবে?
-- এই ভাঙা বেঞ্চের উপরে। 
-- এটা একটা ঘুমানোর জায়গা হলো? 
-- তুমি বেঞ্চের একপাশে বসো, আমি তোমার উরুতে মাথা রেখে ঘুমাব। 
-- আচ্ছা, শোও। ঘুমাও। 

অদিতি আমার উরুর উপর মাথা রেখে শুইল ঠিকই কিন্তু ঘুমাল না সে। ও বললো - ঘুম আসছে না।
-- ঘুম আসছে না কেন? 
-- তোমার শরীরের গন্ধে ঘুম আসছে না। 

অদিতি আমার একটি হাত টেনে নিয়ে ওর বুকের উপরে রাখে। আমি অদিতির চোখ দেখি।  এই চোখে এই কোন্ মায়া চাহনি! আমিও চেয়ে থাকি ! 
অদিতি বলছিল - আমার বুকের উপর কান পাতো। শোনো, কেমন নিঃশ্বাস তৈরি হচ্ছে ওখানে। কেমন সেই শব্দ! আমি সত্যি কান পাতলাম। চোখ মুখ ঠোঁট ললাট সবই স্পর্শ হলো... 

কী এক ঘোরের মুহূর্ত! যখন ঘোর কাটে তখন অদূরে চেয়ে দেখি -- কালিগঙ্গার জল থরথর করে কাঁপছে। হঠাৎ বসন্ত বাতাস হুহু করে বয়ে এসে লাগল আমাদের গায়ে। কবে কে কোন্ কবি লিখেছিল --
' অবশেষে, কোনও এক মধ্যাহ্নে 
বাঁশঝাড়ের ধারে যদি কেউ ললাট স্পর্শ করে 
ধীরে, অতি ধীরে - তাকে দিও আমার বিরহ.. '

****

কে এই অদিতি? কিছুই বললাম না ওর কথা।
এই মেয়েটি ঢাকায় এসেছিল মধুমতি নদীর তীরের সুদূর নড়াইল থেকে। অদিতি আমার সহপাঠী ছিল। সহপাঠী থেকে বন্ধু।  অদিতিই প্রথম বলেছিল কথা। কোরিডোরে দাঁড়িয়ে একদিন বলেছিল আমাকে-- 
" তোমার নামটি খুব সুন্দর! "অমিত!"  আমার নামের সাথে তোমার নাম মিল আছে।  আমি অদিতি। কিন্তু  আমি লাবণ্য নই।'

তারপর থেকে অদিতি আমার বন্ধু হলো। ভাবতাম ভালোই হলো। লাবণ্য না হলেও লাবণ্যের মতো চেহারা ওর।  চোখ দুটো উদ্বেলিত করত আমাকে। এ্যাথলেট দেহবল্লরী! সুচিত্রা সেনের মতো মায়া করে যখন  তাকাতো আমার দিকে, তখন আমার বুক কেঁপে উঠত। মনে একটা আকাঙ্খা তৈরি করে রেখেছিলাম -- আহা! এই মেয়ে আমার বউ হলে ভালোই হবে। 

কিন্তু ও যে বিবাহিত ছিল তা জানতাম না। জেনেছি পরে। ওর স্বামী ট্রেনিংএর জন্য দেশের বাইরে ছিল দীর্ঘ দিন। অদিতি থাকত হোস্টেলে। ওর একাকীত্বের সময়ে আমি ওর পাশে বন্ধু হয়ে থাকি। 

অদিতির স্বামী বিদেশ থেকে ফিরে এলে অদিতি হোস্টেল ছেড়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছে ভজহরি লেনে একটি বাসা  ভাড়া নেয়।  একদিন অদিতি বাসার ঠিকানা দিয়ে বলেছিল - 'বাসায় এসো'। যেন রবি ঠাকুরের ঐ গানের কথার মতো আহবান -- 'দুঃখসুখের দোলে এসো,  প্রাণের হিল্লোলে এসো।'

কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছিল না। যাইওনি অনেক দিন। অদিতি অনুযোগ করে প্রায়ই বলত-- 'তুমি আর এলে না। '

আমি বলেছিলাম -- ' যা হারিয়ে যায় তা আগলে রইব কত আর? '

কী মনে করে, একদিন সন্ধ্যায় হোস্টেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই অদিতির বাসায়।  দোতালায় ওরা থাকে। আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠি। বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ভিতর থেকে অদিতি ও অদিতির স্বামীর খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। একটু পর শুনতে পেলাম অদিতি গান গাইছে -- ' আমরা – মলয় বাতাসে ভেসে যাবো শুধু কুসুমের মধু করিব পান;
ঘুমোবো কেতকী সুবাস শয়নে চাঁদের কিরণে করিব স্নান।'

এই গানটি আমাকে একদিন অদিতি গেয়ে শোনায়েছিল বুড়িগঙ্গার পাড়ে। আমি আর  ভিতরে ঢুকলাম না। কেন জানি মনটা খুব খারাপ লাগছিল। সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসি। পথে নেমে পথের উপর হাটঁতে থাকি। পা  চলছিল না। কেমন যেন থেমে থেমে যাচ্ছিল!
মনের গভীরে মর্মরিত ব্যথা অনুভব করছিলাম আর ভাবছিলাম -- এই পৃথিবীতে অনেক সত্যই মিথ্যা। অনেক বস্তু আছে যা একান্তই  নিজের মনে হয় , কিন্তু সেইসব বস্তু  আমার নয়। সেই সব বস্তু যতই প্রিয় হোক না, তা নিজের অধিকারে রাখা ঠিক নয়।

পরিশিষ্ট --
তারপর আমার লেখাপড়ার জীবন শেষ হয়। বিয়ে করি। ঘরে একজন মায়াবতী আসে। আনন্দ বেদনার সংসার করতে থাকি।  অদিতির সাথে মাঝে মাঝে কথা হতো, দেখাও হতো। পরে আস্তে আস্তে ওকে দূরে সরে রাখলাম। দূর থেকে শুধু বন্ধুটাই সে রইল। আর সব ঢেকে থাকল গোপন দীর্ঘশ্বাসের নীরব শব্দহীনতার মধ্যে..।

অদিতির ম্যাসেজটি দেখে ইচ্ছে হলো - দেখে আসব ওকে। এতদিন শুধু শুধু অভিমান করে থেকেছিলাম ওর উপর। দেখা করে  ওর কাছে যেয়ে ক্ষমা চেয়ে নেব। কিন্তু পোড়ামুখী সে সুযোগ আমাকে দেয়নি।  ব্যস্ততার কারণে  হাসপাতালে যেতে ক'টা দিন  দেরি করে ফেলেছিলাম। পরে জানতে পারি -- অদিতি  পরপারে চলে গেছে।


৬.          ঝুমকা


মধ্য কার্তিকের এক মৌন অপরাহ্ণে  বাড়ির পুকুরপাড়ে একাকী বসেছিলাম। পুকুরপাড় থেকে একটি মেঠো পথ  চলে গেছে দক্ষিণ দিগন্তের দিকে। যতদূর দৃষ্টি যায়  চোখ মেলে চেয়ে দেখছিলাম আদিগন্ত । পথের দুপাশে আধাপাকা ধানগাছ ঈষৎ নুয়ে পড়েছে। সরিষার ক্ষেতগুলো দেখতে লাগছিল হলুদ গালিচার মতো। হঠাৎ দেখতে পাচ্ছিলাম- দিগন্ত ভেদ করে ছায়ার মতো কেউ একজন মেঠো পথ ধরে এগিয়ে আসছে সামনের দিকে। একটু পর দেখি, একজন নয় দুজন। আরও একটু পরে দেখি, দুজনের একজন পুরুষ আর একজন  মেয়ে। ওরা আস্তে আস্তে  আমাদের বাড়ির  দিকে এগিয়ে আসছে। যখন কাছে চলে আসে- তখন ছেলেটিকে দেখে চিনতে পারি। ও আমাদের গায়েরই ছেলে। ওর নাম আমজাদ।  পশ্চিম পাড়ায় থাকে। কিন্তু মেয়েটিকে দেখে চিনতে পারছিলাম না। ওকে এর আগে কখনও দেখিনি। 

আমজাদ একটা বাউণ্ডুলে ছেলে। ফ্রী প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছিল। তারপর আর পড়ে নাই। সংসারে ওর মন ছিল না। ওরা খুব গরীব। ছোনের চালা আর পাট সোলার বেরার ছোট দুটি ঘর ওদের। কোনো চাষের জমি নেই । আমজাদের আরও তিনটি ছোট  ভাই বোন আছে। বাবা শারীরিক অক্ষম। কোনো কাজ করতে পারে না। মা অন্য বাড়িতে ঝীয়ের কাজ করে দুঃখে কষ্টে  কোনো মতো সংসার চালায়।

আমজাদ ছোটবেলা থেকেই উড়নচণ্ডী স্বভাবের । কাউকে না বলে প্রায়ই উধাও হয়ে কোথাও চলে যেত। ছয় মাস একবছর নিরুদ্দেশ হয়ে থাকে। কখনও আরও বেশি। দুই তিন বছর ওর কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যেত না। 

শুনেছি আমজাদ যাত্রা দলে যোগ দিয়েছে। গ্রামে গঞ্জে হাটে বাজারে সে ঘুরে বেড়ায়। যাত্রা দলের লোকজনদের ফয়ফরমাশ করে। মাঝে মাঝে যাত্রা পালায় ছোট খাটো চরিত্রে অভিনয়ও করে। 

ওর বয়স  উনিশ কুড়ি হবে। দেখতে সুঠাম ও সুূদর্শন। সাথের মেয়েটিকে আমজাদ পরিচয় করে দিয়ে বলে - 'ওর নাম পাপিয়া। আমার স্ত্রী'। বয়স ওর চেয়ে তিন চার বছরের বড় হবে। মেয়েটিকে দেখতে বেশ রূপবতী  লাগছিল। একটি সুতি শাড়ি পরে আছে। কানে ইমিটেশনের ঝুমকা দুল। দু'হাত ভরা চুড়ি। চোখ দুটো মায়া করা। বেশভূষা দেখে  বোঝা যাচ্ছিল - মেয়েটি যাত্রা দলের সহশিল্পী কেউ একজন হবে।

পুকুরপাড়ে আমজাদ বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। পাপিয়াকে নিয়ে ওদের বাড়ির দিকে চলে যায় । যাওয়ার সময় আমাকে বলে যায়- 'কাল তুমি আমাদের বাড়িতে এসো। তখন নাহয় গল্প করা যাবে ।' আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম -  মুখে ছিল তার  অদ্ভুত রহস্যময়  হাসি।  মনে হলো,  এই বুঝি আমাকে ' ভ্রূ পল্লবে ডাক দিয়ে নিয়ে যাবে চন্দনের বনে।' মনে হলো মেয়েটি আমার সাথে অনেক কথা বলতে চায়। আমারও খুব ইচ্ছে করছিল ওর সাথে কথা বলতে।

রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবছিলাম অনেক কথা  -  আমজাদ বাউণ্ডুলে একটি ছেলে, সে কিছু করে খায় না , ওদের থাকার ঘরটাও জরাজীর্ণ। দু'বেলা ঠিকমতো ভাত জোটেনা। আর সেই কী না সুন্দরী একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে । মেয়েটিই বা কী দেখে ওর ঘরে এল! ওকে কোথায় থাকতে দেবে, কী খাওয়াবে? আমার উঠতি তরুণ মন উদ্বেগে ভাবছিল সেই সব কথা।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কী না, জানিনা। আমি চেতনে না অবচেতনে আছি, তাও বুঝতে পারছিলাম না। রাত অনেক হবে। হঠাৎ  মনে হলো কে যেন আমার ঘরের দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। আমি উঠে দরজা খুলে দিই। দেখি পাপিয়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । সে আমার  কাছে চলে আসে। এবং  বলে - চলো পুকুর পাড়ে। অনেক কথা আছে তোমার সাথে। 

রাতের গায়ে নিঝুম নীরবতা তখন।। পুকুর পাড় নির্জন, কেউ নেই।  আকাশভরা তারার আলোছায়া পড়েছে জলের উপর । পাপিয়া  আমাকে জড়িয়ে ধরে। বুকের ভিতর মুখ রেখে আবিষ্ট হয়ে বলে -- আমি তোমার হতে চাই। আমাকে তুমি তোমার করে নাও।

মধুৃময় কিছু মুহূর্ত আসে স্বপ্নের ভিতর। মানুষ কত সুখানুভুতিই না পায় সেই স্বপ্ন থেকে। আমিও সেই সুখই পেলাম পাপিয়ার কাছে থেকে।  ভালোলাগার এই স্বপ্নের ঘোর সারা জীবনকালেও কাটবে না। 

আমি পাপিয়াকে বুঝিয়ে বলি - তুমি আমজাদের কাছে ফিরে যাও। ও বাউণ্ডুলে হলেও খুব ভালো ছেলে। ওকে তুমি  মনঃকষ্ট দিও না। তুমি চলে যাও। পাপিয়া মনখারাপ করে চলে যায়।

সকালে ঘুম ভাঙে একটু দেরীতে। বিছানায় স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি। মনে পড়ছিল রাতের ঘটনাটির কথা। যা পেয়েছিলাম তা কী স্বপ্নে পাওয়া ছিল? নাকি বাস্তবে পেয়েছিলাম অনুপম মণিরত্নম! কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না।  খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল পাপিয়াকে। ইচ্ছে করছিল ওকে গিয়ে আর একবার নতুন করে দেখে আসি।

পূর্ব আকাশের উজ্জ্বল  সূর্যকে পিছনে রেখে হেঁটে হেঁটে চলে যাই আমজাদদের বাড়ি। গিয়ে দেখি - আমজাদ বারান্দার খুটিতে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। খুবই বিষাদে ভরা ওর মুখখানি।  আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি - মনখারাপ কেন তোমার? ও বলে -

--  পাপিয়া নেই। 
--  নেই মানে? 
-- সকালে ঘুম ভেঙে দেখি, পাপিয়া চলে গেছে। 

আমি আমজাদকে বলি - কী হয়েছিল তোমাদের ভিতর? একটা দিনও পাপিয়া থাকল না।
- কিছু হয়নি। 
- তাহলে পাপিয়া চলে গেল কেন? 
- আমাদের দারিদ্র ও অভাব অনটন দেখে হয়তো 
সে চলে গেছে। 

ওদের বাড়িটিতে যা দেখলাম তা অবর্ণনীয়। ঘরের চালের ছোনপাতা জায়গায় জায়গায় ছিন্ন। শোবার জন্য  কাঠের চোকি নেই। ঘরের মেঝেতে ও বারান্দার  ইঁদুর মাটি তুলে ঢিঁবি করে রেখেছে। একটি নেড়ি কুকুর উঠোনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াচ্ছে। চালহীন রান্না ঘরে খালি দুটো হাড়ি কাত হয়ে পড়ে আছে। একটি মা মুরগী কয়েকটি বাচ্চা নিয়ে উঠোনে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। বারান্দায় ছেঁড়া মাদুরের উপর শুয়ে ওর ছোট ভাইটি কাঁদছে। 

আমি  বাড়ির দিকে ফিরে চলে আসি। পথে আসতে আসতে পূর্ব আকাশের সূর্যের আলো আমার চোখে মুখে এসে পড়ছিল। কিছুই ভালো লাগছিল না । বাড়িতে এসে ঘরের ভিতর না গিয়ে পুকুর পাড়ে চলে যাই। ভাবছিলাম, পুকুরপাড়ে বসে মেঠো পথটির দিকে একটু চেয়ে থাকব। যদি ভ্রম করেও দেখতে পাই - 
ঐ  পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে পাপিয়া আবার  ফিরে চলে আসছে। 

এইসব ভাবতে ভাবতে পুকুর পাড়ে ঘাসের উপর গিয়ে বসি। বসতে গিয়েই ঘাসের উপর দেখতে পাই একটি ঝুমকা পড়ে আছে। আমি চিনতে পারি ঝুমকাটি। এই ঝুমকাটিই যে গতকালকে পরা দেখেছিলাম পাপিয়ার কানে।


৭.        রাধা, কৃষ্ণ কও 


১৯৭১ সাল।
আগস্টের শেষের দিকে হবে। চারিদিকে বর্ষার পানি থৈথৈ করছে। একদিন বিকেলের দিকে নৌকা করে আমাদের বাড়িতে একজন পঞ্চাশার্ধো লোক আসে। লোকটি আমার বাবার পূর্ব পরিচিত। কিন্তু কেউ আমরা তাকে চিনিনা। আগে কখনও দেখিনিও। 

লোকটি আমাদের বাহিরবাড়ির কাচারি ঘরে বসে বাবার সাথে কী যেন আলাপ আলোচনা করেন। আমরা কেউ সে কথা শুনতে পারিনি। লোকটি প্রায় ঘন্টাখানেক বাবার সাথে কথাবার্তা সেরে  নৌকা করে আবার চলে যান।

লোকটি চলে যাবার পর বাড়ির ভিতর বাবা এসে মাকে বলেন - কাল একটি শরণার্থী পরিবার আমাদের বাড়িতে উঠবেন। তাকে আশ্রয় দিতে হবে। উনি খুব বিপদে আছেন। প্রত্যান্ত গ্রামে ওনার কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। এর আগে অন্য একটি গ্রামে অন্য একটি বাড়িতে ওনারা কয়েক মাস ছিল। কিন্তু সেখানে থাকাটা নিরাপদ মনে করছেন না। তাই আমাদের বাড়িতে ওনারা হয়তো কটা মাস থাকবে।

বাবার মতামতের উপর কারোর কোনও দ্বিমত পোষণ করার ক্ষমতা নেই। আমাদের বাড়িতে বেশ কয়েকটি ঘর আছে । তারই একটি ঘরে ঐ পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।

পরের দিন সকালবেলা একটি ছইওয়ালা ছোট নৌকা করে ঐ ভদ্রলোক তার পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। সাথে ওনার স্ত্রী এক মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েটির বয়স আঠারো ঊনিশ হবে। আর ছেলেটির বয়স আট নয়। 

ভদ্রলোকের নাম শওকত হোসেন। সে নাকি  মহুকুমা অফিসের একজন কেরানী। কিন্তু বাবা আমাদের তার পূর্ণ পরিচয়, পেশা, এগুলো সবার কাছে  বলে বেড়াতে নিষেধ করলেন। 

আমি তখন অষ্টম ক্লাসে পড়ি। নিতান্তই গ্রামের ছেলে। শহরে অত যেতাম না কখনও। শহরের কাউকে দেখলে একটু বিস্ময়ে তাকিয়ে  দেখতাম। যেমন বিস্ময় চোখে দেখেছিলাম ওনাদের। বিশেষ করে সাথে আসা মেয়েটিকে। মেয়েটি দেখতে কেমন যেন 'রূপ লাগি আঁখি ঝুরে', বেতস পাতার মতো কোমল মুখশ্রী। মায়াকাটা চোখ, নির্মোহ চাহনি। মার্জিত পরিধেয় পরনে।

ওনারা আসার সময় কোনও কিছু আনেনি। না কোনও বিছানা পত্তর, না কোনও হাড়ি পাতিল। আমার মা সবকিছু ব্যবস্থা করে দিলেন। বাবার সাথে শর্ত ছিল তারা নিজেরাই রান্নাবান্না করে খাবেন।

মেয়েটির নাম আলেয়া। শহরের গার্লস কলেজে ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। আমি ওনাকে আপু বলে ডাকি। আপু খাঁচায় করে একটি ময়না পাখি নিয়ে এসেছিল। এই পাখিটিকে সে খুব ভালোবাসে ও আদর করে। শহরের বাড়ি থেকে ওনারা যখন পালিয়ে গ্রামে আসে তখন আলেয়া আপু অন্য কিছু না আনলেও এই পাখিটিকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল।

একদিন আমি আপুকে বলি - পাখিটি কথা বলে না? 

- বলে। কিন্তু পাখিটি অভিমান করেছে। সে এখন আর কথা বলে না।
- ও কী কখনও আর কথা বলবে না? 
- বলবে একদিন। 
- কবে? 
- যেদিন দেশ স্বাধীন হবে সেই দিন।

২.

ওনাদের ভিতর একটি রক্ষণশীলতা দেখতে পাই। আশেপাশে মানুষের সাথে খুব একটা মিশত না। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেশি বের হতো না। শওকত চাচার স্ত্রী মার সাথে প্রয়োজনীয় সুবিধা অসুবিধার কথা ছাড়া বেশি কথা বলত না। শওকত চাচাও তাই। উনি একটি রেডিও এনেছিলেন সাথে করে। রেডিওটি কানের কাছে নিয়ে আস্তে আস্তে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনত। আর শুনত আকাশবাণী ও বিবিসির খবর। আর মাঝে মাঝে ভিতর বাড়ির বারান্দায় বসে বাবার সাথে গল্প গুজব করত। ওনারা কী কথা বলত আমরা তা শুনতে পেতাম না।

আলেয়া আপু আমাকে খুব পছন্দ করত। আমিও তাকে খুব পছন্দ করতাম।  আমি তার চেয়ে প্রায় চার পাঁচ বছরের ছোট ছিলাম। আলেয়া আপু ছিল শহরের মেয়ে। কী সুন্দর করে কথা বলত। গুনগুন করে গান গাইত। আমি একদিন আপুকে বলি - তুমি গান গাইতে পারো? 

- পারি।
- আমাকে একটি গান শোনাও না।
- আমি যে হারমোনিয়াম আনিনি। খালি গলায় শোনাতে হবে। 
- খালি গলায়ই  শোনাও। 

আলেয়া আপু গাইছিল --

'গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে, 
বলো কী হবে 
জীবন পাতার ছিন্ন পাতায় শুধু 
বেহিসাবে পড়ে রবে।'

আলেয়া আপু প্রায়ই আমাকে গান শোনাত। আমি গ্রামে থাকতাম । অনেক ভালো গান তখন কখনও শুনিনি, জানতাম না অনেক গানের কথা। মনে পড়ে একদিন কালি সন্ধ্যায় আলেয়া আপু বলেছিল, চলো পুকুর ধারে যাই। জলের শব্দ শুনব। জলের উপর দেখব  চাঁদের ছায়া। আমি বললাম, পুকুর তো বন্যার জলে ভেসে গেছে। 

তবুও চলো, দেখব।

সেদিন আকাশে উঠেছিল ত্রয়োদশী চাঁদ। সত্যি অপূর্ব জোছনায় ভাসছিল জল। কাঁঠাল গাছের গুড়িতে বসে আমরা জলছবি দেখি। আলেয়া আপু আবৃত্তি করছিল -

"কেন মিছে নক্ষত্রেরা আসে আর? কেন মিছে জেগে ওঠে নীলাভ আকাশ?
কেন চাঁদ ভেসে ওঠেঃ সোনার ময়ূরপঙ্খী অশ্বত্থের শাখার পিছনে?
কেন ধুলো সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে শিশিরের চুমো খেয়ে- গুচ্ছে গুচ্ছে ফুটে ওঠে কাশ?'"

৩.

আলেয়া আপু প্রতিদিন সকালে উঠে ময়না পাখিটিকে খাবার খাওয়াতো। হাতের আঁজলায় জল নিয়ে ময়নার ঠোঁট খুলে জল ঢেলে দিত মুখে। আমি আমাদের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম সেই দৃশ্য। কোনও কোনদিন কাছে গিয়ে বলতাম -
ময়নাটা কেমন কিচিরমিচির করছে। তোমার সাথে কথা বলতে চায়। 

- ও বলবে না কথা। রাগ করেছে। 
- রাগ ভাঙাও। 

আমি বললাম, আমি যদি তোমার ময়না পাখি হতাম ঠিকই তোমার সাথে কথা বলতাম। কখনোই রাগ করতাম না! 
আলেয়া আপু আমার থুতনিতে টোকা দিয়ে বলে-- ও আমার ময়না পাখিরে! তাই ! 

আমাদের বাড়িতে পিয়ারা গাছ ছিল। আমি কাঁচা ঢাসা পিয়ারা পেড়ে এনে আলেয়া আপুকে খেতে  দিতাম। মাঝে মাঝে কাঁচা পিয়ারায় কামড় দিয়ে আপু বলত, এটি আমি খেতে পারছি না। এটি তুমি খাও।' আমাদের একটি জাম্বুরা গাছও ছিল। জাম্বুরা পাকলে ভিতরের কোয়া গুলো টকটকে গোলাপি রঙের হতো। আলেয়া আপু জাম্বুরার কোয়াগুলো খেয়ে ঠোঁট ও জিহবা গোলাপি রঙ করে ফেলত। আমি বিস্ময় চোখে তাকিয়ে দেখতাম তা। আলেয়া আপু বলত - আমার ঠোঁট তোমার ভালো লাগছে! বলতাম, হ্যাঁ। 

আলেয়া আপু বলে - তুমিও কী রাঙাবে তোমার ঠোঁট? এস, রাঙিয়ে দিই। 

আর একদিন বিকালবেলা বাবাকে বলে নৌকায় করে ধনিদহ বিলে আমি আলেয়া আপু ও আলেয়া আপুর ছোট ভাই আদিব শাপলা আর কলমীলতা দেখতে যাই। নৌকা বাইছিল আমাদের বাড়ির কৃষি কর্মী সমীর আলী। দিগন্ত জুড়ে পানি থৈথৈ করছে। উপরে নীল আকাশ। সমীর আলীর বৈঠার শব্দে পানি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হচ্ছে। গাংচিল উড়ছে আকাশে। আমাদের নৌকা বিলের শাপলা ফুলের ভিতর দিয়ে চলছিল।  আলেয়া আপু শাপলা ফুল ছিঁড়ছিল আর জল ছুঁইছিল দুহাত দিয়ে।  কী অদ্ভুত করে নেমে আসছিল সেদিন সন্ধ্যা। আলেয়া আপু আমাকে ডাক দেয় - রঞ্জন! 
বললাম - জ্বি। 
- এখন তো গানের সময়! গান শুনবে না? 
- শুনব, গাও। 
আলেয়া আপু খালি কণ্ঠে গাইতে থাকে --

এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু
কোন রক্তিম পলাশের স্বপ্ন
মোর অন্তরে ছড়ালে গো বন্ধু!
....…
বাতাসের কথা সে-তো কথা নয়
রুপকথা ঝরে তার বাঁশিতে
আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই
শুধু দু'টি আঁখি ভরে রাখি হাসিতে।

আলেয়া আপুর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমিও তার সাথে গাইছিলাম --

'কিছু পরে দূরে তারা জ্বলবে
হয়ত তখন তুমি বলবে
জানি মালা কেন গলে পড়ালে গো বন্ধু।'

৪.  

দেখতে দেখতে দুই আড়াই মাস চলে যায়। দিনে দিনেই যুদ্ধের মোড় বদলাতে থাকে। বন্যার পানি সরে গিয়ে চরাচর জাগতে থাকে।  মনে হচ্ছিল বিজয় আসতে এখন  শুধু সময়ের ব্যাপার  মাত্র। মন প্রফুল্ল হওয়ার পাশাপাশি মনটা বিষাদেও জড়াচ্ছিল খুব । মন বলছিল - এই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে আলেয়া আপু'রাও শহরে চলে যাবে। কতদূর সেই শহর! 

আমি আর আলেয়া আপু দুজন ইতোমধ্যে খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। কত খুনসুটি, কত লেনদেন। কত কথা বলতাম চাঁদনি রাতে উঠোনে শীতল পাটিতে বসে। আলেয়া আপু গুনগুন করে সুর তুলত -- 'আকাশে ঐ মিটিমিটি তারার সাথে কইব কথা, নাইবা তুমি শুনলে।'  যদিও অসম বয়স ছিল আমাদের। বিজয় ধেয়ে আসছে ভেবে মনবীণার তারে কেমন যেন টান লাগতে থাকে। মনে হচ্ছিল এই তার বুঝি ছিঁড়ে যাবে যে কোনও দিন, যে কোনও ক্ষণে। 

সেদিন ছিল হেমন্তের সন্ধ্যা। আমাদের কুসুমপুর গ্রাম ছিল গাছপালায় আশ্চর্য ছায়াছন্ন। প্রসন্ন নির্জনতায় আঁধার নেমে আসছিল তখন। বাড়ির পূর্বদিকে পুকুরপাড়। ঠিক তার পিছনটায় বাঁশ ঝাড়। রাত্রি আগমনের পদধ্বনি বাজছিল পাখিদের গানে। বুলবুলি, দোয়েল, হাঁড়িচাচা শিস দিচ্ছিল। আমি আর আলেয়া আপু হাঁটছিলাম বাঁশবনের পথে। পায়ের স্পর্শ লেগে শুকনো পাতাগুলো মর্মর করে শব্দ হচ্ছিল। দুজনেই নিশ্চুপ ছিলাম কিছুক্ষণ। আমি কম্পিত স্বরে আলেয়া আপুকে ডাকি - আপু। 

- কী! 

- তুমি চলে গেলে আমি খুব কাঁদব। 

- পাগল ছেলে, কাঁদবে কেন? 

আলেয়া আপু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। গভীর মমতায় আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রাখে অনেকক্ষণ। 
সেই সজলঘন নির্জনতায় বুকের সঙ্গে বুক জড়িয়ে নিবিড় গাঢ় স্বরে আপু  বলে -- 'তুমি কী আমাকে ভালোবাসো?'

- হ্যাঁ, আপু। তোমাকে অনেক  ভালোবাসি।

-  এখনও তুমি অনেক ছোট। এত ছোট বয়সে বড়ো করে ভালোবাসতে নেই। কষ্ট পাবে। তোমার স্পর্শ  বুকে নিয়ে কেবল বয়ে বেড়ানো যায়। অন্য কিছু না। তুমি আরও বড়ো হও। বড়ো হয়ে যেদিন আমায় অনেক ভালোবাসা দিতে পারবে সেদিন আমি নিজেই উন্মুখ হয়ে আমার সবকিছু তোমাকে দিয়ে দেবো।

****

অবশেষে চলে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! 
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ইং, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বারবার ঘোষণা হচ্ছিল --

'পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশি যৌথ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে, পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সব সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। "

বিজয়ের সেই ক্ষণে কুসুমপুর গ্রামের মানুষেরা আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে। জয়বাংলা শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠতে থাকে। রেডিওতে গান বাজতে থাকে -"পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল রক্তলাল! প্রলয় এসেছে কোন্ সমুদ্রে রক্তলাল রক্তলাল" 'জয় বাংলা বাংলার জয়।"

তখন অপরাহ্ন সময়। আলেয়া আপু রেডিওতে ঘোষণা শুনে  দৌড়ে ঘরের ভিতর চলে যায়। ভিতর থেকে  ময়না পাখির খাঁচাটি উঠোনে নিয়ে আসে। তা ধিন্ ধিনের মতো নেচে নেচে ময়না পাখিকে সে বলে - "রাধা, কৃষ্ণ কও।" 
ময়না পাখিও বলে ওঠে - "রাধা, কৃষ্ণ কও।"

আলেয়া আপু'রা ছিল হিন্দু পরিবার৷ এই কথা বাবা ছাড়া কেউ জানত না।

আলেয়া আপু'রা আরও দুই দিন আমাদের বাড়িতে ছিল। যেদিন আপু'রা চলে যাবে সেদিন  সকালবেলা একটি ঘোড়ার গাড়ি এসে আমাদের বাড়ির পাশে এসে থামে। দেখলাম - শওকত চাচার পরনে সাদা ধূতি ও পাঞ্জাবি। চাচীমার সিঁথিতে সিঁদুর। আলেয়া আপু পরেছে লাল সবুজ সালোয়ার কামিজ। ওনারা সবাই টমটমে গিয়ে উঠে। যাবার সময় আলেয়া আপু আমাকে কাছে ডেকে বলে -' তুমি তোমার এই জয়ন্তী দিদিকে কখনও ভুলে যাবে না।'

পরিশিষ্ট -

জয়ন্তী দিদি'রা চলে যাবার তিনমাস পর বাবা একদিন শহরে যান। মহুকুমা অফিসের সেরেস্তায় গিয়ে জানতে পারেন - শ্রী সুবিমল রায় ( শওকত চাচা) বদলি হয়ে চলে গেছেন দূরের অন্য আর এক শহরে। 

এরপর কত বছর চলে গেছে। কতদিন কত রাত্রির উপরে চুপিসারে আমার দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়েছে। মহাকালের ললাটের উপর ঝরেছে অশ্রুবিন্দু। অস্ফুট করে জয়ন্তী দিদিকে কত ডেকেছি বেদনা মর্মর মুহূর্তে। বলেছি - 'দিদি, আমি কত বড়ো হয়ে বুড়ো হয়ে গেলাম। কই, তুমি উন্মুখ হয়ে আমাকে আর ভালোবাসা দিতে এলে না তো।'


৮.          অন্য রকম দিন 

একটি অন্তীম ইচ্ছে - জীবনের শেষ দু'একটা বছর যেন কুসুমপুরে কাটাতে পারি। সেই ইচ্ছেরই আর একটি কথা - মৃত্যুর আগের দিনটা ঠিক কেমন হবে আমার ! 

দু'একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া মানুষ ঠিক কবে কখন কোন্ দিন মারা যাবে, বেশির ভাগ মানুষই তা জানে না। আমিও জানতে পারব না, ঠিক কোন্ দিনটিতে মারা যাব। আর মৃত্যুর আগের দিনটাই বা কেমন হবে, কেমন করে কাটবে সেই দিনটি।

ধরুন - আমার মৃত্যুর আগের দিনটা যদি এমন করে কাটে --

আগের রাতে শেষ প্রহরে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরবেলা যখন ঘুম ভাঙে তখন শুনতে পাই - আজান হচ্ছে। পাখির ডাকও শুনতে পাচ্ছিলাম। 

ফজর নামাজ পড়ে আর ঘুমাই নি। টেবিলে গিয়ে বসি। ল্যাপটপ অন্ করি। উপন্যাসের কয়েকটি পরিচ্ছদ লেখা বাকি। লিখে ফেলি আরও দু'একটা পরিচ্ছদ। কেন জানি, একটি কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছিল। কয়েকটি পংক্তি কাল থেকেই মাথায় ঘুরঘুর করছিল।  কথাগুলো লিখছিলাম কীবোর্ডে আঙুল চেপে। তবে কবিতায় নয় গদ্যে। 

কত লোভের জিনিস আছে এই পৃথিবীতে। কত দামী বস্তকে পেতে প্রবল আকাঙ্খা করেছি। কত পথ চলেছি উদাস সঙ্গীত শুনে শুনে। শত পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার মতো কত আলো দেখে পথ চলেছি, খুঁজেছি কত জ্যোৎস্নাবরণী অনিন্দ্য তরুণী! শেষে কোথায় গিয়ে দেখে ফেললাম এক অর্বাচিনীকে! তাকে চিনিনা। দেখিও নাই কোনদিন। কেমন করে যেন ছুঁয়ে ফেলি সেই অপরিচিতার কৃষ্ণ কেশদাম, কী অপূর্ব ছিল তার গ্রীবাভঙ্গি! কী মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছিল সেই  মায়াবতী।

এই মেয়ে যখন কাছে আসে তখন কোনও কিছু লেখা হয় না। না কবিতা, না গদ্য। সে কাছে এসে বলে - 'চলো হেঁটে আসি তোমার প্রিয় মেঠো পথ দিয়ে। যেথায় দুপাশে ফুটে আছে  তোমার অনঙ্গ  ভাঁটফুলের প্রেয়সীরা।'

বহু বছর আগের বাবার তৈরি টিনের চালের ঘর। জীর্ণ হয়ে গেছে চাল। বৃষ্টিতে জায়গায় জায়গায় জল পড়ে। শুয়েছিলাম বাবার পালঙ্কে। ঘরের পূর্ব দিকে দরজা আছে, আবার পশ্চিম দিকেও দরজা। পূর্ব দিকের দরজাটা খুলি।  কী উজ্জ্বল রোদ্রে ছেয়ে আছে বাইরের আঙিনা!

আমরা দুজন ঘর থেকে নেমে বাইরে  আসি । আমগাছ আর কাঁঠাল গাছের ছায়াতল দিয়ে হেঁটে গিয়ে পুকুরপাড়ে চলে যাই। সকালবেলার জল দেখে মনে পড়ে - সেই ছেলেবেলার কথা।  জলের উপরে সকালবেলায় দেখেছি সূর্যের ছায়া। জলে ভাসত আরও একটি সূর্য!  রোদ্রের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ত সারা জলে। আজও দেখলাম সেই দৃশ্য! পার্থক্য এইটুকু, ঢিল ছুঁড়ে দিয়ে জলকে আজ আর আলোড়িত করলাম না।

পুকুরের কিনারে ঢোল কলমি লতাগুলো নেতিয়ে পড়ে আছে জলে। এই কার্তিকে ফুল ফোটেনি একটিও । মনটাকে খারাপ হতে দিলাম না। পুকুরপাড় থেকে হেঁটে চলে যাই মাঠের দিকে। যেতেই রাস্তার দু'ধারে দেখা পেলাম ভাঁটফুলের। সাদা ফুল ফুটে আছে থরে থরে। স্পর্শ করি রেণু।  বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে সরিষার ক্ষেত ৷ হলুদ ফুলে ফুলে শুয়ে আছে গালিচার মতো। অবারিত পাগল করা গন্ধ চারদিকে। আমরা মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে চলে যাই বহুদূর পর্যন্ত। আবার হেঁটে হেঁটে ফিরে আসি বাড়ির দিকে।

দুজনের সংসার। পাশের বাড়ির নয়নী এসে মায়াবতীকে কাজে সাহায্য করে। মাটির চুলোয় পাট সোলা দিয়ে সে রান্না করছে। আমি এসে বলি - কী রান্না করছ আজ। 

- ধনিদহ বিলের ছোট আইর মাছ। ময়নাল চাচাকে দিয়ে  কিনে এনেছি আজ।

- কলমীর শাক রেখ। সাথে মাসের ডাল। মা থাকলে সাথে একটি মুরগীও রান্না করত।

- ময়নাল চাচাকে দিয়ে এক সের দুধও কিনে এনেছি ছোনগাছা বাজার থেকে। সাথে সরবি কলা। 

- আমি ঢাকা থেকে বাড়ি আসলে মা দুধ ভাত খাওয়াতো। 

- আমি জানি, তাই তো দুধ কিনে এনেছি।

- হুম, তুমি আমার মায়ের মতো, মায়ের অভাব বুঝতে দাও না।

- যাও, পুকুর থেকে স্নান করে এস।

আমি একাকী গিয়ে পুকুরে নামি। কী স্বচ্ছ টলটলে জল৷ কেমন যেন অন্য রকম শীতল মনে হচ্ছে আজ। অদ্ভুত ঠাণ্ডায় দেহখানি হিম হয়ে আসছিল। বারবার ডুব দিচ্ছিলাম জলে। দু'হাতের  আজলায় জল তুলে নিয়ে চোখে মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছিলাম। 

স্নান সেরে বাড়ির ভিতর চলে আসি। 

মেঝের উপর শীতল পাটিতে বসে দুপুরে ভাত খাচ্ছিলাম। মায়াবতীকে বলি - তুমিও আমার সাথে বসে খাও। সে খেলো না। বলল, তুমি খাও।আমি বেড়ে দিচ্ছি। 

সে যেন মায়ের ভূমিকা পালন করছে।  মা'ও এমন করে সামনে বসে বেড়ে খাওয়াতো আমাকে।

বিকালবেলা পিয়ারা গাছতলায় বাবার পুরনো হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ারটাতে বসে ছিলাম। মায়াবতী নলিন গুড় দিয়ে মুড়ি মেখে নিয়ে আসে বেতের ডালায় করে৷ আমিও খাচ্ছিলাম, মায়াবতীও খাচ্ছিল। 

দুজন বসে আছি দুজনের মুখোমুখি চেয়ে। কখনও কথা বলছি, কখনও না। উঠোনে আর কেউ নেই। নিম গাছের ডালে একটি বুলবুলি এই ডালে ঐ ডালে উড়াউড়ি করছিল। ঘরের চালের কার্নিশে কবুতর বাকুম বাকুম করে  ডাকছে। মায়াবতীকে বলি - আজ উঠোনটা এত পরিপাটি লাগছে যে! সে স্মিত হেসে বলে - আজ আমি নিজ হাতে উঠোন ঝাড়ু দিয়েছি। নয়নীকে ঝাড়ু দিতে দিই নি। 

পরিপাটি উঠোনের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম - 'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।'

আমাদের বাড়ির উঠোন থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায় না। অস্তাচলের আকাশ ঢেকে থাকে বৃক্ষরাজিতে। যখন সন্ধ্যা নামে তখন পিছনের বাঁশ ঝাড়ের পাতায় এসে পড়ে অস্ত সূর্যের লাল আভা। আঁধার ঘনিয়ে আসতে থাকে ধীরে কাজল চোখের মতো কালো করে। আগে সন্ধ্যা হলে প্রতি ঘরে পিতলের কেরোসিন দীপশীখা জ্বলে উঠত। মুখর হয়ে থাকত সারা বাড়ি। আজ সব নিঝুম। কেউ নেই। একে একে কতজন পরপারে চলে গেছে। কতজন চলে গেছে কত দূরে। ভাই বোন যারা আছে - তারা কেউ কাছে নেই। কেন জানি, চোখটা জলে ভরে ওঠে। মায়াবতী বলছিল - 'তুমি যে কেমন শিশু এখনও!  চলো, পুকুরপাড়ে। আজ আকাশে অনেক বড়ো  চাঁদ উঠেছে। সারা চরাচর বিগলিত জোছনায় ভাসছে। আশ্চর্য সুন্দর এই পৃথিবী। চলো, দুজনে মিলে দেখব এই পৃথিবী ।

রাতে বাবার পুরনো পালঙ্কে দুজন পাশাপাশি বিছানার শুয়ে আছি। পূবের জানালাটা খোলা। আম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঠিকরে চাঁদের আলো পড়ছিল বিছানায়। নীরব রাতে মুখর করছিল ঝিঁঝি পোকার গান। মায়াবতী বলছিল - জানালাটা কী বন্ধ করে দেবো?  বললাম, বন্ধ কোরো না। খোলা থাক্। কোথাও থেকে কুন্দ ফুলের গন্ধ আসছে। আসছে দূর থেকে যমুনার হিম বাতাস। দেখলাম, চাঁদের আলো ওর মুখের উপর এসে পড়ছে।  নির্মল আরক্ত সুন্দর মুখশ্রী! কেমন  মায়ামলিন করে চেয়ে আছে আমার দিকে। ওকে বলি - আমার হাতটা একটু বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমাও। ঘুম ঘোরেও ছেড়ে নিও না হাত। যদি দূরে চলে যাই! 

আর কোনও কথা নেই।  কত মায়া করেছি দুজন দুজনের জন্য । জীবনের অনেক কিছুই মিছে হয় নাই। অপরূপ অনেক প্রাপ্তি মায়াকাজল জলস্রোতে ভেসে গিয়ে বিলীন হয়ে যায় নাই। কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। দীর্ঘশ্বাসের তপ্ত বাতাস বেগ পাচ্ছিল নিবিড় আঁধারে। মনে হচ্ছিল মায়াবতী বুকের উপর মাথা রেখে আকুল নয়নে  ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। 


৯.         পারাপার 


আশির দশক। অক্টোবরের এক বিষণ্ণ অপরাহ্ণ বেলায় ভিক্টোরিয়া পার্কে কংক্রিটের বেঞ্চের উপর বসে ভাবছিলাম অনেক কথা। পার্কে তখন তেমন জনসমাগম ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ বসে গল্প করছিল। কেউ কেউ বাদাম, চানাচুর ও এটা সেটা খাচ্ছিল। পার্কের এক গেট দিয়ে ঢুকে অন্য গেট দিয়ে কেউ কেউ হেঁটে বের হয়ে যাচ্ছিল। আমি একাকী বসে আনমনে একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছিলাম। ধূয়াগুলো উড়ে যাচ্ছিল সেদিনের ম্লান বাতাসে।

কুমু আজ চলে গেল। আজও ওকে খেয়া নৌকায় করে  বুড়িগঙ্গার ওপারে নামিয়ে দিয়ে এলাম। ওপারের ঘাট থেকে ওর কাছে থেকে যখন বিদায় নিয়ে চলে আসছিলাম, তখন কুমু আমার একটি  হাত টেনে ধরে। জল টলমল চোখে চেয়ে থেকে বলে- 'কথা দাও, বেশি সিগারেট খাবে না। সময়মত খাবে। রাত জাগবে না। আমি চলে যাচ্ছি , তার মানে এই না- তোমার সাথে আর কখনও কোনও দিন দেখা হবে না! তুমি আমার বন্ধু। বন্ধু হয়েই থাকবে চিরকাল।'

কুমু ওয়াইজঘাটে একটি ললিতকলা একাডেমিতে গীটার বাজানো শিখত। আমিও শিখতাম। ওখানেই ওর সাথে পরিচয়। ও আসত বুড়িগঙ্গার ওপারে খেজুরবাগ থেকে। গীটারের তারে আঙুল ছোঁয়ার সময় চুপিচুপি ওকে দেখতাম। মেয়েটির গায়ের রং গৌরীয়। চন্দ্রমুখ। টিকালো নাক। মাথাভর্তি কার্ল কালো চুল। নয়নতারার মতো বিনম্র চোখ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রথম একদিন ওর সাথে কথা হলো। কথা বলতে বলতে দুজন দুজনকে জানলাম। তারপর দুজন বন্ধু হয়ে উঠি। 

গত একবছর প্রতি শুক্রবার শনিবার  ছুটির পরে ওয়াইজ ঘাট থেকে খেয়া নৌকায় কুমুর সাথে আমিও চলে যেতাম ওপারে। ওপারের ঘাটে  ওকে পৌঁছে দিয়ে আমি আবার ফিরে আসতাম এপারে। নদী পার হওয়ার সময় ওর সাথে আমার যত কথা হতো। নদী পারাপারের সময়ই ওর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। নৌকায় পাটাতনের উপর  দুজন পাশাপাশি বসতাম। কথা বলতাম খুব কাছে থেকে। চুপচাপ বসে বসে দেখতাম নদীতে ভেসে যাওয়া অজস্র নৌকার সারি। দেখতাম জলের উপর আকাশের ছায়া। শুনতাম জলের কলধ্বনি।  

কত স্মৃতি মস্তিষ্কের শিরায় তোলপাড় করে। একবার নদী পার হওয়ার সময় হঠাৎ আকাশ মেঘে কালো হয়ে আসে। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামতে শুরু করে। ভিজে চুপসে যাচ্ছিলাম দুজনেই। আমার ফুসফুসে প্রদাহ ছিল। প্রায়ই খুসখুস করে কাশতাম। ওর সামনে সিগারেট খেতে পারতাম না। ঠোঁট থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে ফেলে দিত। কুমু সেই বৃষ্টির সময় ওর বুকের খাঁজে আমার মাথা লুকিয়ে নিয়ে ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখে। যেন আমার ঠাণ্ডা না লাগে। কুমুকে সেই মুহূর্তে অপার্থিব সুন্দর লাগছিল। কিছু স্পর্শ একটুও পাপের মনে হয় না। কোনো অলৌকিক দেবীর পুণ্যের ছোঁয়ার মতো মনে হয়।

কুমুর একজন প্রেমিক ছিল। তারপরও ও মনে হয় আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। কেমন যেন জটিল মনে হতো অনেক কিছু। একবার সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকারে বুড়িগঙ্গার কূলে দাঁড়িয়ে কুমু আমাকে বলেছিল - মানুষের দেহমন কেন যে একটা হলো। দুটো কেন হলো না? দুটো হলে একটা তোমাকে দিয়ে দিতাম আর একটা আমার ভাবি স্বামীকে দিতাম।

আমি কৌতুকছলে বলেছিলাম - 'তোমার যে একটা দেহ মন আছে সেটিই নাহয় আামাকে দিয়ে দাও।'

- তুমি এত ভালো ছেলে তোমাকে আমি ঠকাতে চাই না। কত মানুষ আছে শুধু আনন্দের জন্য মেয়েমানুষের শরীর খোঁজে। তুমি তো সেই রকম নও। শুধু আনন্দ করার জন্য যদি কখনও আমায় তোমার প্রয়োজন হয়, তবে তুমি আমাকে স্মরণ কোরো।

 - না, প্রয়োজন হবে না। আমি তোমাকে অনেক  ভালোবাসি কুমু। 

একবার ক্লাস ছুটির পর, আমি আর কুমু যাব নবাববাড়ির গেটে। কুমু কিছু কেনাকাটা করবে। ফুটপাতের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম ইসলামপুর রোডের দিকে। দেখি - গঙ্গাজলির  কয়েকটি মেয়ে চোলি পরে সেজেগুজে আমাদের সামনে দিয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে স্টার সিনেমা হলের দিকে চলে যাচ্ছে। আমি ওদেরকে দেখিয়ে কুমুকে বলি- পয়সা দিলে ওরা দেহের আনন্দ দেয়।' কুমু বলছিল, তুমি কখনও ওদের দেহের আনন্দ নেবে না। আমার মাথার দিব্বি রইল। 

কুমুর সাথে আমার সম্পর্ক একসময় বন্ধু ও প্রেমিকার মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে রূপ নেয়। কিন্তু  চির আক্ষেপ- স্ত্রী আর সে হলো না।

আজ ছিল শেষ পারাপার। আমাদের গীটার শেখার কোর্স শেষ হয়ে গেছে আরও দুই দিন আগে। কুমু আর আসবে না একাডেমিতে। ওকে রেখে যখন নৌকায় উঠি, নৌকা যেন মাঝ নদীতে থেমে যাচ্ছিল। মাঝির বৈঠা যেন চলছিল না । 
নৈর্ব্যক্তিক মনে হচ্ছিল নদীর জল। কেমন যেন বিধুর লাগছিল নিজেকে। নদী পার হওয়ার সময় আর কখনও নামতে দেখব না সন্ধ্যা। দেখা হবে না অস্তবেলার লাল আবীর মাখা সূর্য। বুড়িগঙ্গার জল নীরবে ছলছল করবে। ভেঁপু বাজিয়ে লঞ্চ চলাচল করবে। ঢেউ উঠবে। ঢেউ ভাঙবে। ঢেউ মিলিয়ে যাবে।

****

পার্কের লোকজন আস্তে আস্তে কখন সবাই চলে গেছে জানি না। আমি তখনও সিগারেট খেয়েই  যাচ্ছিলাম। লাইটপোস্টের বাতির চারপাশে উইপোকা ভিনভিন করছিল। আধো আঁধারে একটা মধ্যবয়সী লোক আমার দিকে এগিয়ে আসে। কাছে এসে  বলে - ছোট ভাই তুমি কেমন আছ? 

- ভালো আছি। 

- মনে হয় তুমি ভালো নেই। অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে আমি অনুসরণ করছি। তুমি একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছ। এত অল্প বয়স তোমার , তুমি নবীন। একদম তরুণ প্রাণ। শরীর খারাপ হয়ে যাবে! 

- খারাপ হবে না। এমনই খাচ্ছিলাম। 

- নাহ্, এমনই খাচ্ছ না। তোমাকে দেখে দেবদাসের মতো লাগছে।  তা, আমার সাথে একজায়গায় তুমি যাবে? 

- কোথায়? 

- জিন্দাবাহার তৃতীয় লেন। 
- ওখানে কে আছে?  
- লখনৌর বেগমজানের বংশদ্ভূত অপূর্ব সুন্দর  নাজমুন বাঈ। ভৈরবী রাগে গান ধরে সে ‘রসিয়া তোরি আখিয়ারে, জিয়া লাল চায়’ ঠুংরী ঠাটের গানের এ কলিতে জিন্দা বাহার গলির ওর জলসা কানায় কানায় ভরে উঠে।

আমি বললাম, টাকা দিতে হবে?  
- হুম।  টাকা দিতে হয়। 
লোকটাকে বললাম, আমি ছাত্র মানুষ। আমার কাছে  টাকা নেই। 

লোকটি হতাশ হয়ে চলে গেল।

আমি আরও একটি সিগারেট ধরাই৷ কুমুর কথা মনে পড়ল আবার। ও আমায় বলেছিল-- 'তুমি কখনও যদি দেহের আনন্দ চাও তবে আমার দেহ থেকে নিও। ঐসব মেয়েদের থেকে নেবে না।'

সেই সন্ধ্যারাতে পার্ক থেকে বেরিয়ে আসছিলাম নীরব পদচিহ্ন ফেলে। পায়ের নিচে কংক্রিট না ঘাস, না মাটি- বুঝতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম কেবল, আমার দিন কাটবে কুমুরও দিন কাটবে। যতদিন জীবন আছে ততদিন এই জীবন চলবেই। একটি ক্ষীণ আশা জাগিয়ে হাঁটছিলাম নিবিড় আলো আঁধারে- আর একবার কী দেখতে পাবো না কুমুকে সাথে নিয়ে নদীতে নৌকায় ভেসে সন্ধ্যার সূর্যাস্ত! ডানা ঝাপটে কুলায় ফিরে যাবে পাখি। অস্ত দিগন্তে মিলিয়ে যেত জীবনের সব অপ্রাপ্তির বেদনা চিহ্ন।


১০.        সুতাং নদীর পাড়ে 

কিছুদিন ধরেই একটা ব্যাপার মাথার ভিতর  ঘুরপাক খাচ্ছিল। তা হলো নদী। এই জীবনে কত নদী যে দেখেছি।  কত নদীর জল ছুঁয়ে দেখেছি। নৌকায়, লঞ্চে, ইস্টিমারে কত রাত্রিদিন নদীতে ভেসেছি। আবার অনেক নদী আছে আজও  দেখা হয় নাই। নামও জানি না। আজ কয়েকদিন ধরে মন বলছিল কোথাও গিয়ে একটু নদী দেখে আসি।

কিন্তু কোথায় যাব? কোন্ নদীর কূলে গিয়ে দেখব জল? কোনোই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। 

কাউকে কিছু না বলে একদিন ভোরবেলা বিমানবন্দর স্টেশনে চলে যাই। একটি ট্রেন তখন  স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পাই। কাউন্টারে টিকিট মাস্টারকে বলি - এই ট্টেনটি কোথায় যাবে? 

-  এটি পারাবত এক্সপ্রেস। সিলেট যাবে। 
-  আমাকে এই ট্রেনের একটি টিকেট দেন।
-  কোন্ ক্লাসের টিকেট দিব? 
-  শোভন ক্লাসের। 

সিলেট পর্যন্তই টিকেট কাটলাম। ভাবলাম, ট্রেনে যেতে যেতে নদী খুঁজব। যে নদীটা দেখতে ভালো লাগবে সেই নদীর কাছাকাছি কোনও একটি  স্টেশনে নেমে পড়ব।

ট্রেন চলছে। আন্তঃনগর ট্রেন। খুব দ্রুত চলছে। জানালার কাছে সিট। খুব ভালো লাগছে। মাঠ ঘাট খালি প্রান্তর পেরিয়ে ট্রেনটি ছুটে চলেছে। মনে পড়ছিল সেই কবে ইন্টার ক্লাসে রবার্ট লুইস স্টীভেনশনের একটি কবিতা পড়েছিলাম -
'Faster than fairies, faster than witches, Bridges and houses, hedges and ditches; And charging along like troops in a battle, All through the meadows the horses and cattle...'

কিছুক্ষণ পরেই দেখি - ট্রেনটি বিকট শব্দ করে একটি ব্রিজ ক্রস করছে। নীচে চেয়ে দেখি নদী। নদীটির নাম শীতলক্ষ্যা। এই নদী এর আগে অনেক দেখেছি নারায়নগঞ্জের নিতাইগঞ্জে। নদীটা ভালো লাগলো। কিন্তু মন টানলো না তেমন। আর ট্রেনটা ছিল দ্রুতগামী। ঘোড়াশাল ফ্লাগ স্টেশনে ট্রেনটি থামল না। 

হঠাৎ মনে পড়ল আমার এক ফেসবুক বান্ধবীর কথা। কাকতালীয় ভাবে ওর নাম ছিল 'নদী'। পুরো নাম নদী ইসলাম। এখানে পলাশে ওদের বাড়ি। সে এখন আয়ারল্যান্ডে ডাবলিন শহরে থাকে। ও ইনবক্সে আমাকে বলেছিল- ওদের বাড়ির কাছে নাকি 'হাঁড়িধোয়া' নামে একটি নদী আছে। নদীটা নাকি দেখতে খুব সুন্দর! আঁকাবাঁকা সর্পীল। ও এও বলেছিল যদি পারো কোনও একদিন গিয়ে এই নদীটা  দেখে এসো। ট্টেনটা এখানে যদি থামতো তাহলে নাহয় নেমে এই হাঁড়িধোয়া নদীটাই দেখে যেতাম।

ট্রেনটি একসময় ভৈরব জংশন পার হয়ে আরও একটি সেতু অতিক্রম করছিল। ট্রেন থেকে নীচে চেয়ে দেখি, এ যে মেঘনা। এই নদীও দেখেছি এর আগে অনেক বার। ট্রেনটি ছুটছে দ্রুত গতিতে আখাউড়ার দিকে। এখানে কাছাকাছি কোনও স্টেশনে থামবে না।  তাই এখানে আর নামা হলো না। তাছাড়া নামতামও না এখানে। কারণ  আমি খুঁজছি স্বচ্ছতোয়া ছোট কোনও নদী। 

ট্রেনটি একসময় আখাউড়া গিয়ে পৌঁছে। ট্রেন থেকে প্লাটফরমে নামি। একটি চা'র দোকানে বসে  চা খাই। একবার ভাবছিলাম, এই ট্রেনটি ছেড়ে দিয়ে অন্য আর একটি ট্রেনে নাহয় চট্টগ্রামের দিকে যাব। কিন্তু তা আর হলো না। ট্রেন ছাড়ার সাইরেন বেজে উঠে। আমি দৌড়ে গিয়ে ট্টেনে উঠে পড়ি।

ট্রেনটি শায়েস্তাগঞ্জ জংশন পৌঁছার আগে কোথাও কোনও স্টেশনে আর থামল না। এরই মাঝে ছোট বড় দু-তিনটে নদী দেখলাম। ভালোও লেগেছিল। কিন্তু নেমে আর দেখা হয়নি। 

শায়েস্তাগঞ্জ জংশনেও ট্রেন থেকে একটু নামলাম। ইতস্ততভাবে ঘোরাঘুরি করছিলাম প্লাটফর্মের উপর দিয়ে। একটা টং দোকানে বসে চা খেলাম। সিগারেটও খাই। মনে পড়ছিল অনেক বছর আগের কথা। 

আশির দশকের হেমন্তকাল। সেবার আমরা কয়েকজন তরুণ কর্মকর্তা একটাি অফিসের কাজে এসেছিলাম হবিগঞ্জ ও চুনারুঘাট। আমাদের সাথে দুটো মেয়েও ছিল। মনে পড়ছিল এই স্টেশনের কাছে কোথাও একটি হোটেলে আমরা লাঞ্চ করেছিলাম। আরও মনে পড়ছিল অনেক কথা। একটি নদীর কথা। অনেক স্মৃতি ধেয়ে আসছিল অস্পষ্ট করে অনেক পিছনের পুরনো  জীবন থেকে। 

আরও একটি সিগারেট ধরাই। ইতোমধ্যে ট্রেন ছাড়ার সাইরেন বাজতে থাকে। আমি নির্বিকার চেয়ে থাকি ট্রেনটার দিকে। ট্রেনটি ছেড়ে চলে গেল। আমি বসেই রইলাম চা' র দোকানের সামনে বেঞ্চের উপরে। 

তখন দ্বিপ্রহর হয়ে গেছে। চা'র দোকান থেকে উঠে আস্তে আস্তে হেঁটে স্টেশনের বাইরে আসি। সেই খাবার হোটেলটি খুঁজতে থাকি। কত বছর আগের কথা। নামও মনে নেই হোটেলটির।
শেষ পর্যন্ত হোটেলটি খুঁজে পেলাম। তখন ছিল টিনের চালার হোটেল। এখন সেটি পাকা। দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম হোটেলটিতে। 

হোটেল থেকে বেরিয়ে স্থানীয় একজন লোককে জিজ্ঞাসা করি, আচ্ছা,  সুতাং যাব কীভাবে?  আমি নিজেই বললাম, আগে তো ট্রেনে যাওয়া যেত। 

লোকটি বলল - ঐ সেকশনে এখন আর ট্রেন চলে না। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। আপনি লোকাল বাসে অথবা অটোতে করে সুতাং বাজার যেতে পারবেন।

আমি বাসে না উঠে একটি খোলা অটোতে করে চলে যাই সুতাং রেল স্টেশনে। কেমন অপরিচিত লাগছিল স্টেশনটি। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। কোনও কর্ম চাঞ্চল্য নেই। টিকিট ঘরটি আছে। স্টেশন মাস্টারের ঘরটিও আছে । কিন্তু কোনও কর্মচারী নেই। ছোট্ট একটি স্টেশন। শুধুমাত্র লোকাল ট্রেন এখানে থামত। 

সেবার অফিস ট্যুরের সময় আমার আর নমিতার উপর দায়িত্ব পড়েছিল সুতাং নদীর পাড়ে খাসিয়া পুঞ্জিতে গিয়ে কয়েকটি পরিবারের সাথে আর্থ সামাজিকের উপর কিছু তথ্য জেনে নেওয়া। আমি আর নমিতা চুনারুঘাট থেকে একটি লোকাল ট্রেনে করে এসে নেমেছিলাম এই সুতাং স্টেশনে।

এই সুতাং স্টেশনের অদূরেই সুতাং নদী। কেমন যেন প্রকৃতিকালও মিলে গেল আজকেও। সেবার ছিল হেমন্ত সময়। আজকেও হেমন্ত।  ঝকমকে রোদ চারদিকে ঝিকমিক করছে । কিন্তু মনটা প্রফুল্ল লাগছে না। সেবার আমার সাথে ছিল নমিতা ৷ এবার কেউ নেই। কী উচ্ছ্বল ছলছল ছিল মেয়েটা। জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য ভূগোলে স্নাতকোত্তর করে এসেছিল । লম্বা লম্বা চুল ছিল ওর। চুলের গোছা ছড়িয়ে পড়ত  কটিদেশের উপরে। আমি ওকে বলতাম - এই যে কাজল কালোকেশী মেয়ে! কখনই চুল বাঁধবে না তুমি! নদী যেমন বুক উজার করে জল কলকলিয়ে চলে তেমনি তোমার চুল ছড়িয়ে দেবে আদিগন্ত তোমার পিঠের উপরে।

আমরা সেদিন হাঁটছিলাম সুতাং নদীর পাড় ধরে। 
কোথাও পাহাড়ি পথ, কোথাও আঁকাবাঁকা সমতল। আবার কোথাও উঁচু-নিচু পথ। সব পথের ধুলোয় লুটিয়ে থাকে পাহাড়ি লাল মাটি ও ঝকঝকে বালি। যেতে যেতে সবুজ প্রকৃতির মাঝে দেখা মেলে দূরের পাহাড়। নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ের থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশে এসেছে।

পথে চলতে চলতে পড়ছিল টিলা। পথের দুপাশে কত নাম না জানা জংলী ফুল ফুটে আছে। বিচিত্র সব সুবাসে বাতাস ভরে আছে। সুতাং এর স্বচ্ছ জল ছোঁয়ার জন্য নমিতা আকুল হয়। পাড়ে থেকে জলের কাছে যেতে ও ভয় পাচ্ছিল। নমিতা আমাকে কুসুমে কোমলে ডাকে - রঞ্জন, তুমি আমার হাতটি ধরো। 

কি পাগল মেয়ে যে নমিতা! আমার একটি হাত ওর পাঁজরে জড়িয়ে নিয়ে জলের কাছে চলে যায়। ও বলছিল - এত টলটলে জল, এত স্বচ্ছ রূপ ! এত পবিত্র! আমার সাথে তুমিও এই জল স্পর্শ করো। আমাকে তুমি অশেষ করো। দাও জগৎ  দাও। দাও তোমার মঙ্গল ছোঁয়া। তুমি  নিয়ে নাও আমার ধনদৌলত, সকল ঐশ্বর্য। সেই কত যুগের আগে তোমাকে দেখেছিলাম। সেই কতকাল ধরে এমনই ক্ষণ আমি চেয়েছিলাম। এমনই একটি নদীর কাছে তোমার মতো কাউকে আমার সমস্ত কিছু দান করতে ইচ্ছে জাগত। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে আমার জীবনে। তুমি ফিরিয়ে দিও না।

কী বিমুগ্ধ জীবন পায় মানুষ! হিরণ্য আখরে দাগ কেটে রয় তা জীবনের পরতে পরতে। 

নদী থেকে চলে আসি ঝর্ণার ঝিরিপথের বাঁকে।  এযে রবি ঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গের গান এখানেও। কেমন ভয়ংকর নির্জনতা চারদিকে! নমিতার বুক ধকধক করছিল। ও বলছিল - এ তুমি কোথায় নিয়ে এলে!  এ যে স্বর্গ এখানে নেমে এসেছে! সবকিছু স্বপ্ন নয় তো! 

তখন ছিল অপরাহ্ন সময়। সুতাং নদীর জল ছিল স্থির। ডাহুক উড়ছিল। পানকৌড়িরা বসেছিল শিয়ালপোতা গাছের ঝাড়ে। তখনও রৌদ্র করছিল ঝিলমিল। নমিতা ওর বুকের পাঁজর থেকে আমার হাত সরে এনে আমার বুকের ভিতর ওর বুক সমর্পণ করে। আবারও বিহ্ববলতা!  দীর্ঘ আলিঙ্গন যেন শেষ হতে চায়নি সেদিনের সুতাং নদীর পাড়ে মনুষ্যহীন নির্জন সেই অপরাহ্ন বেলায়।

আজ এত বছর পরে সুতাং নদীর কূল ধরে যখন হাঁটছিলাম তখন চারদিক থেকে কী এক নস্টালজিক বেদনা এসে মনকে আচ্ছন্ন করছিল। সুতাং নদীতে জল বয়ে চলেছে আগের মতোই কিন্তু কেমন যেন বিষাদ হয়ে আছে সে জল।  পায়ে পায়ে চলছিলাম ধীরে। কিন্তু পা চলছিল না।  পথ চলতে ব্যথা করছিল দু'পায়ে।

আরও কিছু দূর চলে যাই সেই টিলাটার কাছে।  টিলার গায়ে লতাগুল্মে ভরে আছে। শুধু পাশের ঝর্ণার জল আজ আর ঝরে পড়ছে না ৷ সব আজ শব্দহীন।  ভাবছিলাম আর এগুবো না সামনের দিকে। মনও চাইছিল না এগুতে । ফিরে চলে আসতে থাকি পরিত্যক্ত সুতাং স্টেশনের দিকে। 

পথ দিয়ে ফিরছিলাম আর ভাবছিলাম সেই তরঙ্গায়িত যৌবন সময়ের কথা। কতজনকেই তো ভালো লেগেছিল। নমিতা ছিল তাদেরই একজন।  মনে হতো মেয়ে তুমি আমার কিছু একটা হও। স্বপ্নও দেখতাম ওকে নিয়ে। এ রকম কত স্বপ্ন যে ভেঙ্গে গেছে সেই সময়ে। সেই ভাঙ্গা গড়ার সময়কাল কখন যে শেষ হয়ে গেছে তাও বুঝতে পারিনি। আমার গত জীবনকাল ধরে নমিতার মুখচ্ছবি যে মনে ভেসে উঠেনি তা নয়। এই সুতাং নদীর পাড়ে ওর বুকের সেই উষ্ণতা আজও আমাকে বিচলিত করে। কখনও কখনও নিজেকে  খুব খালি খালি লাগে। ওর মায়াময় মুখখানি  সুতাং নদীর জলের মতো হৃদয়ের ক্যানভাসে এখনও অস্পষ্ট জলছবি হয়ে আছে। সৌম্য বাতাসে কান পাতলে তার পায়ের ধ্বনি বাজে। সেই কবে নমিতা আমার হতে চেয়েছিল এক হৈমন্তিকা দিনে। ঝরা পাতাচিহ্ন ফেলে সে আর পুনরায় ফিরে  আসবে না কোনোদিন। অথচ বনফুলের বিজরিত গন্ধ  বাতাসে আকুল হবে এই সুতাং নদীর পাড়ে শতসহস্র বছর কাল।

কত যে ভ্রম আজও হয়! সুতাং স্টেশনে গিয়ে টিকেট ঘরের দিকে এগিয়ে যাই। মাস্টার মশাইকে বলি - ঢাকার বিমানবন্দর রেলস্টেশনের দুটো টিকেট দেন আমাদের । কেউ কোনও উত্তর দিচ্ছে না। টিকেট ঘরটি যে তালাবন্ধ ! ভিতরে কেউ নেই। পাশে চেয়ে দেখি - নমিতাও নেই। 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন