মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০২০

আরক্ত সুন্দর মুখ (কবিতার বইয়ের পান্ডুলিপি)

উৎসর্গ পত্র

কেন যে কিছু মুখে পৃথিবীর মায়া লেগে থাকে
কেন যে কিছু মুখে পাই শুকপাখির পালকের ঘ্রাণ 
কেনই আবার দুঃখ কাতরতা দেখি সেই মুখখানিতে।
সেই মুখেই  --
জীবন মৃত্যুর খেয়া পারাপার দেখি।
হ্যাপি কে। 


ভূমিকা -- আরক্ত সুন্দর মুখ

বহুবছর আগে কুসুমপুরে সেদিন হিমশীতল সন্ধ্যা নেমেছিল, অস্তমিত সূর্য ডুবে যাচ্ছিল অস্তাচলে
কোনো এক গৃহকোণে পিতলের কুপি জ্বলে উঠেছিল
সেই আলো দেখে এক নবজাতক কেঁদে উঠেছিল।

কত বড়ো পৃথিবীর কত প্রাসাদ কতখানে --
আর সে কী না এল একটি মাটির গৃহকোণে!
কাঁদবেই তো সে!

সেদিন দীপশিখার আলো কার মুখের উপর পড়েছিল? 
কার মুখ দেখেছিল সে প্রথম? মা'র নাকি ধাত্রীমা'র?
কেন জানি মনে হয়, জননীকেই দেখেছিল পৃথিবীতে 
সে প্রথম।

নবজাতক সেদিনের প্রথম ভোরে হয়ত দোয়েলের 
শীষ শুনেছিল, পাখিটিকে সে কী দেখেতে পেয়েছিল?
জননী খুলে রেখেছিল অলিন্দ,  
অতটুকুন ছোট দৃষ্টিতে দেখতে পেরেছিল কী সেদিনের  নীল আকাশ?

কত পাখিদের কলতান শুনেছে সে শৈশবে 
আকাশ ভেদ করে কত বৃষ্টি হয়েছে
খোকশা গাছে টুনটুনিদের বাসা বাঁধতে দেখেছে
বাঁশঝাড়ে বসে ডেকেছে ঘুঘু বিষণ্ণ দুপুরে 
বর্ষার বকুল সুবাস বিলিয়েছে অকাতরে 
ঝরেও পড়েছে সে ফুল মৃদুমন্দ বাতাসে।

বালক হেঁটেছে কত মেঠো পথে পথে 
ধানের কচি সজল পাতা ছুঁয়েছে সে 
ভিজিয়েছে পা ভোরের শিশিরে
কত রাত্রিদিন কেটে গেছে জননীর স্নেহছায়াতলে।

সে কী এপিটাফ লিখতে চেয়েছিল এমন করে কলাপাতার ছিন্ন পাতায় ! 

'আমি কোয়েল তালুকদার, যার জন্ম শীতের এক মায়াবী সন্ধ্যায়, 
সিরাজগঞ্জের যমুনার পাড়ে বড় হতে হতে....... 
হতে চেয়েছিলাম নামযশহীন কবি। 
মা আমার বাংলাদেশের মানচিত্রের মতো রাবেয়া খাতুন, 
মাটি ও মানুষের আমার পিতা হারুন অর রশিদ তালুকদার।'

নাহ্! 
সে কখনোই কবি হতে পারেনি এই বঙ্গের........


এক চন্দ্রালোকিত শীতের রাতে কানের কাছে মুখ রেখে কানে কানে  কেউ একজন বলেছিল ---

আমি একটি ছেলেকে চিনি
সেই ছেলে 

সন্ধ্যা আকাশের তারার আলো হতে চেয়েছিল
কিন্তু মেঘের ছায়ায় ঢেকে গেছে সেই তারা 
নিভে গেছে সেই আলো।

ছেলেটি একটি অসম্ভব সুন্দর স্বপ্ন ছুঁতে চেয়েছিল
কিন্তু অলৌকিক ঝরনাধারায় ভেসে গেছে সেই স্বপ্ন 
জীবনের ক্যানভাসে সেই স্বপ্ন সে আঁকতে পারেনি। 

ছেলেটি চেয়েছিল একটি ঘর 
আনন্দলোক থেকে সুখ কুড়িয়ে আনতে চেয়েছিল
ফুলের রেণু থেকে অমৃত
মাধুকর হতে চেয়ে হারিয়ে ফেলেছে তার মাধবীকে।

সে চেয়েছিল কেউ একজন চিরকালের হোক,
নিপবনের পাখির বাসার মতো ঘর হবে তার
পূর্ণিমা রাতের উদ্দাম জোছনার প্লাবন বইবে ভাঙা অলিন্দ দিয়ে।

ছেলেটি একটা অমল সুন্দর প্রিয়তমা চেয়েছিল
যার কাছে  মন খুলে বলা যায় সব কথা
ইচ্ছে করলেই যাকে বুকে জড়িয়ে 
চুমু খেয়ে নেওয়া যায় একটার পর একটা
চোখে চোখ রেখে স্বপ্ন দেখা যায়
হাতে হাত রেখে সব ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়া যায়
কিন্তু সে পারেনি।

হাতের মুঠোয় সে ভরতে পারেনি প্রেম
চিরকাল যৌবনের মোহ ভেঙে খুঁজেছে তার শৈশব , 
ময়ুরাক্ষী দিনগুলো কখন যে চলে গেছে সে বুঝতেই পারেনি।

এক একজন এভাবেই ভাবে
আর এভাবেই ভুল অঙ্কের খাতায় হারাতে থাকে
একের পর এক তার প্রিয়মুখ
দিনশেষে পড়ে থাকে শুধু অতৃপ্ত কিছু অভিমান।

নাহ্ কোনো অভিমান নেই ছেলেটির, 
সে একটি আরক্ত সুন্দর মুখের দেখা পেয়েছিল -- নাম তার মায়াবতী। 

মায়াবতী, 
তোমাকে নিয়ে একদিন কুসুমপুরের পথে পথে হাঁটবো, যে পথ চলে গেছে গগনশিরীষ বনে 
যেখানে সন্ধ্যা রাতে জোনাকিদের মিটিমিটি আলো জ্বলে ওঠে

দোয়েলশীষের ভোরে দূর্বাঘাসের শিশিরে পা ধুয়ে নিও তুমি হেঁটে হেঁটে চলে যাবে ধনিদহ বিলে
সেখানে কাদার ভিতর মুক্তা লুকিয়ে থাকে

বসন্তের মধ্য দুপুরের রোদ্রে পুড়বে 
ফুটে থাকা অজস্র আম্রমঞ্জরির গন্ধ মেখো, 
বাঁশ ঝাড়ের নীচে পড়ে থাকা মরা পাতার মর্মর শুনো
হঠাৎ কোনো দূর্মর বাতাস এসে এলমেল করে দেবে তোমার মাথার চুল 

পড়ন্ত বিকালে পাশাপাশি হাঁটবে তুমি 
আমার ছায়া পড়বে তোমার উপরে 
তুমি বলবে -- 'ছায়া নয় গো, তোমার পাঁজরে জড়িয়ে নাও, যেমন করে ইছামতী নদী জড়িয়ে গেছে মাঠ পেড়িয়ে গ্রাম ছাড়িয়ে দূরের মোহনায়।'

সেখানে রাতের আকাশ সামিয়ানার মতো ছাতা ধরে রাখে, কত নক্ষত্রবীথি জ্বলে --
কালপুরুষ, বিশাখা, অরুন্ধতীরা দেখবে তোমাকে
সে এক অনন্ত ভালোবাসাবাসির রাত্রি , স্বপ্ন মোড়ানো সে রাত্রি শেষ হয় না।

কোন্ আলোয় দেখেছিলাম তার মুখখানি!
ক্ষণকালের দেখায় চিরকালের ভালোবাসা হলো
তার সেই আরক্ত সুন্দর মুখ।

কেন যে কিছু মুখে পৃথিবীর মায়া লেগে থাকে
কেন যে কিছু মুখে পাই শুকপাখির পালকের ঘ্রাণ 
কেনই আবার দুঃখ কাতরতা দেখি সেই মুখখানিতে। 

সেই মুখেই --
জীবন থেকে মৃত্যুর খেয়া পারাপার দেখি।


কোয়েল তালুকদার
দক্ষিণখান, ঢাকা। 
তারিখ -- ৩ নভেম্বর, ২০২০ ইং



১. দিন যাপনের গল্প

আমি কারোর ভালোবাসা নিতে চাই না
নিতে চাই না বিষণ্নতাও 
কেউ আমাকে উষ্ণতা দিক ভালোবেসে
হরিণী কবোঞ্চ তুলতুলে বুকে ভরে নিক আদর
কিংবা উদ্দাম নদীর মোহনায় সাঁতারে তার উদ্ভ্রান্ত চুল। 

আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাই না 
সবাই ভুলে যাক তাদের ভুল প্রেমিককে
ভুল রাগে বেজে ওঠা পিয়ানোর সুরকে
সবার গান হোক সঠিক সুরে সাধা
অহেতুক কোনো দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতম না হোক। 

আমি কাউকে বিষণ্ণ করতে চাই না 
হেমন্ত চাঁদনী রাতে সবাই প্রেমে পড়ুক
চরাচর জুড়ে গানে ভাসুক
দোতারায় তাল তুলুক কোনো বিরাগী বোষ্টুমী।

আমি কাউকে গ্লানি দিতে চাই না
অন্তরের গহীন থেকে উড়ে যাক একাকীত্ব  
হৃদয় মন পুষ্পমঞ্জরীত হোক। 
কিছু কিছু কথা কবিতার শব্দে হেঁটে যায় 
তাদের ওপরে আলো ফেলে আরো আলো খুঁজি। 

তবুও দিন চলে যায় পুরোনো পাতা ঝরে মর্মরে,
বিষণ্ণ হয়ে পথের উপর হাঁটতে থাকি
চলে যেতে চাই অজ্ঞাতে দূরে বহুদূরে ---
আমি যে অচেনা পথের পথিক একজন ।

২.  তারপর 

তারপর আমাদের আর হাঁটতে যাওয়া হয়নি 
সব পথ অচেনা হয়ে গেছে
পথের উপর থেকে মুছে গেছে আমাদের 
সব পায়ের চিহ্ন। 

তারপর
তারপর কলোনির রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা ফুসকাওয়ালা রফিক মিয়া হয়ত আর আমাদের  চিনতে পারবে না
কোঁকড়াচুলের সেই বালক মন্টু আর এসে বলবেনা-  'স্যার, চুইংগাম, চকলেট লাগবে?'

তারপর 
তারপর রেললাইনের পাশে পুকুরে ভেসে থাকা হাঁসগুলো আর দেখা হয়নি 
পালকের পানি ঝেড়ে ওরা এখনও হয়ত 
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে যায়।

তারপর 
তারপর আর শোনা হয়নি ট্রেনের হুইসেল
শুন্য স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে এখনো কী মারফতি গান গেয়ে যায় উদাসীন সেই গায়েন?

তারপর 
তারপর কখনোই আর ল্যাম্পপোস্টের আলোর নীচে ফুটপাত ধরে হেঁটে যাইনি কফিশপে 
আকাশের দিকে চেয়ে দেখিনি আর হাজার তারা।

তারপর
তারপর আামাদের ছোট মেয়ে ঐশ্বর্যময়ী কখনও 
আর বলেনি--'বাবা, আমাকে তুমি কেএফসির চিকেন এনে দাও।'
প্রতিদিন দেখি ওর মনখারাপের মায়াবী মুখ।

তারপর 
তারপর পার্কের কড়ই গাছের পাতাগুলো মর্মর করে ঝরে পড়ে গেছে, শালিকগুলো উড়ে গেছে 
পড়ে রয়েছে সেখানে বৈশাখের চৌচির রোদ। 

তারপর 
তারপর আমরা আর ভুল করেও একসাথে
পথ চলিনি , 
যে পথে চলতাম সেপথে পায়ের ছাপ খুঁজিনি
এক মায়া জড়ানো স্মৃতি বাড়ির উঠোনে ুপদপৃষ্ট করেছি।

তারপর 
তারপর নিজেকেই সান্ত্বনা দেই , বাড়ি হয়ে গেছে মসজিদ, সৃষ্টিকর্তার কাছে মুখ  ফিরে দুহাত তুলে প্রার্থনা করি, যদি বেঁচে থাকি জীবন মরণের মাঝখানের সময়টটকু সুন্দর করে রাখব।

তারপর 
তারপর আবার একদিন দিয়াবাড়ির বালির প্রান্তরে
নুয়ে পড়া শুকনো কাশবন দেখতে যাব, 
সেখানে হয়ত এখন বৃষ্টিতে জন্মেছে সবুজ ঘাস, 
হয়ত ফুটে আছে অজস্র ঘাসফুল।

তারপর 
তারপর যমুনা সিনে কমপ্লেক্সে একদিন  সিনেমা দেখতে যাব, একটি খোলা অটোরিকশা করে
তিনশত ফুট রাস্তা দিয়ে নীল আকাশ দেখতে দেখতে চলে যাব পূর্বাচল

তারপর
তারপর আবার একদিন একটি বড়ো লঞ্চে করে মেঘনা নদীতে ভাসতে যাব, ঝাঁকে ঝাঁকে রুপালি ইলিশ ধরতে দেখব জেলেদের জালে 

তারপর 
তারপর কোনো এক বিকেলে তুরাগ নদীর পাড়ে 
গিয়ে দাঁড়াব,  দেখব পশ্চিমের দিগস্তবেলার লাল আভার স্বপ্নীল আকাশ 
সন্ধ্যার কথাকলিরা তখন রূপকথা হবে, কূলায় ফিরে আসতে চাইব না আর

তারপর 
তারপর আমাদের সবকথা পৃথিবীর গান হবে 
এত সুন্দর এই ভূবনে কোরাস করে গাইব তখন --  আমাদের হবে জয় একদিন।

কোয়েল তালুকদার 

২৪ এপ্রিল, ২০২০ ইং
দক্ষিণখান, ঢাকা।

৩.  আমার সকল একাকীত্বে

একদিন এক নিরাভরণ আয়োজনহীন বিকালে আমরা হেঁটেছিলাম,
পিচ ঢালা নির্জন সেই পথ, পাশে দূর্বা ঘাসের উপর দুপুরের এক পশলা বৃষ্টির মুক্তো লেগেছিল। তখন আকাশ ছিল ধূসর নীল।

শ্রাবণে কাশফুল ফোঁটার কথা না। সন্তান সম্ভাবা রমণীর মত শেফালিকাও কোথাও নেই। পিচের পথ ছেড়ে দূর্বা ঘাসের উপর আমাদের চরণ পড়ে দূর্বাও রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল।

যে পাশে ছিল সে ছিল আমার আনন্দময়ী, আমার প্রাণাধিকা। বিকালের রোদ্র মেখে স্বর্ণপ্রভা হয়ে উঠেছিল সে। কতকালের পরিচিত মুখশ্রী। দেখেছি কত সন্ধ্যার ছায়ায়, কত চন্দ্রালোকিত নিশীথে। সে প্রকৃতিভৈরবী হয়ে আমাকে ঘর থেকে কত যে বের করে নিয়ে গেছে।

কতদিন পর আজকে এই বিকালে এখানে এসেছি। পশ্চিম দিগন্তে আলো নেভে নাই, তখনও দিগন্তে কমলা রঙে ছেয়েছিল..
আমরা হেঁটে চলেছি ........
এমন কত পথ পাশাপাশি হেঁটেছি
হাঁটতে হাঁটতে কত দূর চলে গেছি
কত কথা বলেছি, কত কথা বলতে ইচ্ছা করত!
পথের পাশে অখ্যাত ঘাসফুলের দিকে চেয়ে
কত প্রাণের ছোঁয়া যে তাকে দিতে চেয়েছি।

আমি দেখেছি তার মাথার  চুল উড়ছে আসন্ন সন্ধ্যার ধূপগন্ধ বাতাসে,
তাকে একাকার করে নিতে ইচ্ছা করত আমার সকল একাকীত্বে..

অন্তরের ভিতর তখন অন্য তরঙ্গ --

'জানি না কোথা অনেক দূরে   বাজিল গান গভীর সুরে,
           সকল প্রাণ টানিছে পথপানে
           নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।'


৪.   তোমাকে হারিয়ে খুঁজি 

ময়ূরাক্ষী বৃষ্টির মতো তোমার চোখ জলে ভিজে
কী দুঃখ জাগিয়ে দিলে,
আজন্ম ঋণী হলাম তোমার ঐ সিক্ত চোখের কাছে, 
আমার চোখও জলে ভিজল, চৌচির এই জলাভুমিতে অকাল বন্যা হলো,
তারপরও তোমাকে পাওয়া হলো না।
 
তোমাকে হারিয়ে খুঁজি অরণ্যানীতে, ধুলি পথের উপরে, দিগন্তলুপ্ত প্রান্তরে, শীর্ণাকান্ত তটিনী তীরে, পর্বত গুহার আঁধারে, ধাবমান উত্তর মেঘে -- 
লিখি শ্লোক, লিখি গল্পকথা, লিখি একাগ্রভাবে আমার গ্লানিবদ্ধ যত প্রেম কাহিনি ।


৫.       অপার্থিবর অন্ধকারে 


বহু সহস্র কাল ধরে কত জনপদ কত জনপথ পেড়িয়ে 
সেই তুমি আসলে যখন, 
যে পার্থিবে যে পর্ণকুটিরে তুমি এসে দাঁড়ালে 
তখন আর আমি সেখানে নেই.... 

সেই শান্ত তুমি অপলক চেয়ে রইলে উদাস
এবং ক্লান্তিহীন,  চুপচাপ খুঁজতে থাকলে আমাকে অপার্থিবের অন্ধকারে।


৬.       মায়া

চাঁদ আছে কী নেই, তারা জ্বলছে কী জ্বলছে না
কে দেখবে তা আজ আলোহীন এই ছায়ার নীচে দাঁড়িয়ে?

কে আকাশের গায়ে লিখে গেল -- 
'চলে যে যায়, সে চলে যায় দূরে বহু দূরে, নিস্প্রভ পদচিহ্ন ফেলে, 
কে কোথায় ক্রন্দনধ্বনি মিশিয়ে দিচ্ছে এই শহরে
অযুত গাড়ির হুইশেলের শব্দ তরঙ্গে ....'

কোথায় কার ছায়া পড়ে থাকলো, 
কোথায় কোন্ পাতা মর্মর শুষ্ক হাওয়ায় কার দীর্ঘশ্বাস মিলিয়ে গেল...
শুধু মায়াগুলো তার পড়ে থাকলো, লুকানো গেল না  কোথাও।


৭.       কুর্চিবনের গান

এখনও তুমি আছ,
এখনও তোমাকে ছুঁয়ে দেখি তোমার হাতের এপিঠ ওপিঠ, স্পন্দিত আঙুল --
বারান্দায় রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে তুমি শুকাও মাথার চুল 
বাতাসে ভেজা চুলের গন্ধ ভেসে আসে
এখনও হৃদয়ে স্রোত বয় মদিরার মোহনায়। 

এখনও ছুঁয়ে দেখি 
তোমার চোখের পাতা, ললাটে চুম্বনের দাগ, শরীর জেগে ওঠে পলল মাটির ঘ্রাণে,
এখনও ঘুমঘোরে স্বপ্ন দেখি -- কুর্চিবনে ফুটে আছে  ফুল, অদূরে বইছে জল ছ্বলাতছল,
এখনও নদীর মতো জড়িয়ে থাকো বাহুডোরে।

এই তাে সে-দিন
তুরাগ নদীর পাড়ে কাশবনে লুকিয়েছিলাম আমরা,
বিকালের অস্তরাগের সোনালি আলো পড়েছিল তোমার  মুখের উপর, বাবলা ফুলের গন্ধে নেমেছিল মৌন সন্ধ্যা-- 
ঘাসের উপর উড়ছিল ফড়িং, উড়ছিল হলুদ  প্রজাপতি রঙবেরঙে।
 
ঘন রাত্রি নেমেছিল, তারা উঠেছিল আকাশে , জোনাকিরা আলো জ্বেলে ধরে বলেছিল  -- ''তোমরা থেকে যাবে নাকি?' 
আমরা তখন কুর্চিবনের গানের মতো বিভোর 
কী এক অচিন বিমুগ্ধ উত্তেজনায় সেই রাত্রিতে বাড়ি ফেরার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।



৮.         অস্তিত্ব 

গতরাতে রাতের মাঝখানে ঘুম ভেঙ্গে যায়
আজও দেখলাম তোমার একটি নিষ্কলুষ হাত আমার বুক ছুঁয়ে আছে
এটাই তোমার বার্তা, এইটাই তোমার অস্তিত্বের জানান-- তোমার থেকে যেন দূরে চলে না যাই।

কোনো দিন কোনো বিদায়ের ক্ষণে 
ক্ষণ তরে যদি তোমার ও দুটি হাত, না ছুঁইতে পারে আর,

তখন তুমি  দারজা লাগিয়ে দিয়ে চলে যেও, 
আমার অশ্রুবিন্দুর মাঝে, তোমার মুখচ্ছবির কোনো ছায়া যেন ফেলে না যাও।


৯.        দাঁড়াও সুন্দর 

যেদিন শেষ বারের মতো চলে যাব, সেদিন পথ 
ডেকে বলবে , দাঁড়াও তুমি-- ধূলি মেখে যাও পায়ে।
শূন্য নীল আকাশ বলবে, এস তোমাকে নীলাদ্রি করে দেই। রাতের তারা মন্ডল বলবে --- কোথায় আর যাবে? তারা হয়ে জ্বলে থাকো আমাদের পাশে।
দখিনা সজল বাতাস দোলা দিয়ে বলবে -- তোমার আতর মাখা শরীরের গন্ধ ছুঁয়ে দাও।
ফুল বলবে, আজ তোমার জন্য ফুঁটেছিলাম, সুবাস নিয়ে যাও। পাখি বলবে -- যাবেই যখন আমার একটি পালক পরে নাও।
নদী বলবে, এস আর একবার, অবগাহন করো, পুণ্য হয়ে যাও।
নারী বলবে, প্রেম দিব তবু তুমি যেওনা।

খরতাপে চোখ পুড়ে তপ্ত মাঠ পেরিয়ে চলে যাব।
ধুনো ধূপের গন্ধ পাব আকুল করা আশ্বিন সন্ধ্যায়। হাঁটব যতক্ষণ না তারা ফুটে উঠবে আকাশে। চলব যতক্ষণ না আলো নিভে মেঠো পথে। অন্ধকারে যতক্ষণ না দেখতে পাব জোনাকিরা উঠছে, পড়ছে, জ্বলছে, নিভছে।


১০.      যাবার বেলায় ওগো তুমি একবার শুনে যেও ---

চরাচরের ধাঁধানো রোদ্র থেকে
পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘরাশি থেকে
অমাবস্যার নিগুঢ় অন্ধকার থেকে 
শরতের নীল আকাশ থেকে ---

পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য কুড়িয়ে এনে  
আমরা যে জীবন শুরু করেছিলাম
এই ভূবনের বুক চিরে যে ভালোবাসা দুজনের যৌথ হাতের আঁজলায় ভরে তুলে নিয়েছিলাম 
অশ্রুতে দীর্ঘশ্বাসে স্বর্ণচ্ছটা যে ভবিষ্যৎ আমরা নির্মাণ করেছিলাম ---

সেই সব সুন্দর, সেই সব আলোকিত রোসনাই
তুচ্ছ করে দিয়ে তুমি একাই  চলে যাবে 
তা হয় না।


১১.       একাত্মা 

তুমিও জানো আমিও জানি-- নদী কীভাবে আকুল হয়ে  সাগরে মেশে
সাগরও জানে নদীও জানে-- কীভাবে কাছে টানতে হয় ভালোবেসে।
তারাও জানে চাঁদও জানে -- কীভাবে আলো ঢালতে হয় পৃথিবীর উপরে
রাত্রিও জানে ভোরও জানে -- কীভাবে শিশির ঝরাতে হয় ঘাসের 'পরে।
আকাশ জানে মেঘও জানে -- কীভাবে  বৃষ্টি নামাতে হয় শীতল জলধারায়
মুক্তাও জানে শুক্তিও জানে -- কীভাবে ঝিনুকের বুকে জড়িয়ে থাকতে হয়
রূপকথা জানে গল্পও জানে -- কীভাবে লেখা হয়ে যায় অমর প্রেম কাহিনি 
হৃদয়ও জানে শরীরও জানে --  কীভাবে একাত্মা হতে হয় মদিরায় মোহিনী।

কেউ না জানুক আমরা জানি -- কে কাকে কতটুকু চির মমতায় ভালোবাসি 
তুমিও জানো আমিও জানি  -- একজন ছাড়া আরেক জন অকূলে ভাসি।


১২.     কোথায় সে জন

কোথায় সেই ভাঁটফুল, ভেরেন্ডার পাপড়ি, আকন্দের ঝোপঝাড়। কোথায় হিজলের বন, মহুয়া মাতাল নদীর কূল। যে নারীকে নদী মনে করতাম, সেই একদিন পরিবর্তনের স্রোতে হারিয়ে গেল।

দিনের অন্তিম সায়াহ্নবেলায় আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে নক্সীকাঁথার পথ ধরে। যেখানে অসংখ্য দূর্বাঘাসের উপর অপরাহ্ণের রোদ্দুর পড়ে ঝিকিমিকি করে। দূর্বা ঘাস পায়ে মারিয়ে হেঁটে  চলে যাব, নদীর কাছে। বলব--   'তোমার কাছে থেকে  কিছুই নেব না, সব ফিরিয়ে দিতে এসেছি।'

যখন চাঁদ উঠবে, যখন রাতের আঁধার জুড়ে ফুটে উঠবে থোকা থোকা তারা, তখন ফিরে আসব জীবনের উপত্যকায়। জ্যোৎস্নায় নেশাচ্ছন্ন পায়ে নগ্ন হয়ে নেমে পড়ব মৃত্যুনদীর জলে। আর উঠব না।

তুমি একাকী দাঁড়িয়ে তখন খুঁজো আমাকে, শীর্ণা নদীর কূলে বসে তার জলে।


১৩.        সেই

কতদিন ধরে কত বিকেল হাঁটতে যাওয়া হয়না 
তোমার হাত ধরে...... 
কেমন আছে শিয়ালডাঙার নির্জন পথের দুপাশের ঘাস? কেমন আছে মনুষ্যহীন রেল স্টেশন?
কাওলার নিবিড় আম বাগানের কস্তরি পুকুর? ফুল কী ফুটে থাকে জলে?

আহা!
কতদিন ধরে অস্তাচলে ডুবে যাওয়া সূর্যাস্ত দেখিনা!

এখন কেবলই,
অন্তিম সন্ধ্যায় জানালা খুলে দুজন চোখ মেলে সময় করছি পার! 
শব্দহীন নিস্ফল চেয়ে থাকি, কত আঁধার নামতে দেখি এই ঘরে এই আঙিনায়! 

তবুও,
প্রাপ্তি তো আছে!  তুমি স্নানঘর থেকে সদ্য স্নান করে আসো, মেলে ধরো ভেজা চুল,  টপটপ করে ঝরে পড়ে জল, যদিও জড়িয়ে ধরতে পারিনা তোমাকে, শুধু গন্ধ নেই দূর থেকে।

এখনও,
আমাদের স্বপ্নগুলি স্বযত্নে রেখে দিয়েছি বুকের ভিতর,  আবার একদিন প্রথম ভালোবাসার মতো শুরু করব আমাদের দিন


১৪.      দুহাত পাতি

সকাল থেকে বর্ষার মতো বৃষ্টি। 
এসো দুহাত পাতি বৃষ্টির কাছে, আকাশের কাছে,
ঈশ্বরের কাছে --
আর কতো জড়া আছে? আর কত মৃত্যু আছে? 
এসো আর একটি বার, সবাই মিলে চিৎকার করে কেঁদে বলি -- মানুষ আর কতো মৃত্যু দেখতে পারে?

এসো ভালবাসার কাছে দু হাত পেতে দাঁড়াই, 
আর একটিবার সবাই মিলে দু হাত পেতে বলি-- 
আর না মৃত্যু, পৃথিবীকে তুমি ক্ষমা করো প্রভু, 
ক্ষমা করো এর মানুষদের।


১৫.     পৃথিবীর অসুখ 

'জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণাধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
গীতসুধারসে এসো।'

চোখের ভিতর অনেক জল ছপ ছৃপ করছে। কিন্তু সব জল স্থির করে রেখেছি। কারোর জীবন দীপ নীভে গেছে, এমন কোনো আঁধার হওয়ার করুণ-সুধারসের কথা আজ বলব না।

রাতভোর নাকি বৃষ্টি হয়েছে। অন্য কোনো দিন হলে 
জানালা খুলে বৃষ্টির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বৃষ্টির ছাটে ভিজে শীতল হত বক্ষ। এক অদ্ভুত ভালোলাগার আবেশে ভরে উঠত শরীর মন।

কী যেন ভাবনা এল। খুব চেনা এক দীঘিতে ছোট ছোট সাদা, লাল, নীল কাগজের নৌকা ভাসছে। কৃষ্ণচূরার রক্তিম ফুল  সব ঝরে ঝরে পড়ছে । সেই  ফুলগুলো শ্যাওলার মতো করে জ্বলে ভাসছে। পানিপোকা ছুটোছুটি করছে। ওরাও নাকি জলের কানে কান লাগিয়ে  জলের গান শোনে।

কী যে ইচ্ছে করে বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ নিতে। কতকাল সাদা টগর ফুল স্পর্শ করিনি। উন্মুখ হয়ে আছি রাধাচূড়ার তলে যেয়ে হাঁটতে। মৌ মৌ গন্ধ ভাসবে বাতাসে। অনেকদিন রাধিকার পাপড়ি ছুঁয়ে দেখিনি। ভিতরটা কেমন চঞ্চল হয়ে আছে। 

এই পৃথিবী দূষণ মুক্ত হলেই আমি পথে পথে হাঁটব। যদি পথে বৃষ্টি নামে, নামুক। আকাশ কালো করে মেঘ হয়, হোক। তুমুল ঝড় উঠুক। উদ্দাম বৃষ্টি ঝরুক। আমি বেশি কিছু চাইনা। শুধু  দুহাত খুলে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখতে চাই।

হায়! পৃথিবীর এই অসুখ কবে সেরে উঠবে!! 



১৬.        পৃথিবী 

পৃথিবী কি আর জেগে উঠবে না? কেমন নিঝুম হয়ে আছে! এমন নিস্তব্ধতা কী পৃথিবীর মানায়? 
কোলাহলের কাছে যেতে চাই। আর ভালো লাগে না বন্ধ ঘরে বসে। কী যাতনার নির্জনতার এই অন্ধকার! এসো গো কেউ, প্রদীপখানি জ্বালিয়ে দিয়ে যাও বিজন
এই ঘরের কোণে।

আমি জানি কোলাহলেও অনেক কবিতা লুকিয়ে থাকে। কোলাহলের গায়ে আঁচড় কেটে ফুটে ওঠে নির্জন নক্ষত্র।

আজ কোলাহল আসুক।
কাল নির্জনতা ভেঙে সারা পৃথিবী আবার গেয়ে উঠুক-- 
'মোরা যাত্রী একই তরণীর'।

রচনাকাল --- ১৭ এপ্রিল, ২০২০ ইং


১৭.          আগুন পাখি

আমাকে বুঝতে পারবে না তুমি কোনোদিন 
এখন সুন্দর করে লিখতেও ভয় হয়
মিথ্যে কথা লিখে অভিশাপও নিতে চাই না,
গুহামানবও পারেনি অন্ধকারে কোনো শিল্প আঁকতে
যদি না কেউ প্রদীপ জ্বালিয়ে ধরে।

আমি সেই আগুন পাখি
যার কাছে আসলে শুধু দহনই হবে, আমার উড়ে চলা যে আগুনের দিকে,
বিমুগ্ধ চুম্বনগুলো শুধু শুকোতেই থাকবে মহাকালের দেয়ালে, এই অনিত্য ভুবনের  চৈত্র বৈশাখের রৌদ্রতাপে।

তুমি ধরো না তাই কোনো আগুন পাখি।


১৮.         একজন মায়াবতী 

অফিসে পরিশ্রম করে বাসায় আসলে রাতে পাশে থেকে  জড়িয়ে ধরে কেউ যখন বলে - 'খুব কষ্ট করো!'
এমন একজন মানুষ 

মনখারাপের সময় স্মিত হেসে পাশে বসে যখন কেউ 
বলে ' তোমার কী হয়েছে? আমাকে বলো,না!' 
এমন একজন মানুষ 

১০৪ ডিগ্রি জ্বরের সময় সারারাত সিয়রে বসে নির্ঘুম চোখে মাথায় যে জলপট্টি দেয়, 
এমন একজন মানুষ 

ঘুম ভেঙে গেলে যখন চেয়ে দেখি -- হাসি মুখে চা হাতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে,
এমন একজন মানুষ 

ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার পর ছোট ভাই মারফত যে চিরকুট লিখে পাঠায়, ' তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, এসে নিয়ে যাও' 
এমন একজন মানুষ 

শতবার রাগ করে মুখ ঘুরিয়ে রাখে, কিন্তু পরক্ষণেই  রাগ ভেঙে সহস্রবার এসে যে জড়িয়ে ধরে,
এমন একজন মানুষ 

রাস্তায় হাঁটার সময় তুমুল বৃষ্টি নামলে নিজের শাড়ির আঁচলখানি যে আমার  মাথায় বিছিয়ে দেয়,
এমন একজন মানুষ 

অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে যে আমাকে সারা জীবন আগলে রাখে গভীর মমতায়, 
এমন একজন মায়াবতী আমার জীবনে হোক ।


২০.       মানুষ রবে না স্বপ্ন রবে না

আমি সূর্যকে
ছুঁইতে পারিনি রৌদ্র আমাকে ছুঁয়েছে 
আমি চাঁদকে 
ছুঁইতে পারিনি জোছনা আমাকে ছুঁয়েছে 
আমি আকাশকে
ছুঁইতে পারিনি মেঘ আমাকে ছুঁয়েছে।

আমি তোমার 
দেহকে ছুঁবো না প্রেমকে আমি ছুঁয়েছি
তোমার ঠোঁটকে
আমি ছুঁবো না লাল শিমুল আমি ছুঁয়েছি 
তোমার চোখের 
কাজলে আমার চোখের পাতাকে ছুঁবো না
আমার চোখের মণি 
তোমার অন্তরকে আলোকিত করেছে।

ধরো, আমি তোমাকে ছুঁবো না আর,
কীভাবে হবে জন্ম, প্রজন্ম
কোনো নব শিশুর জন্ম চিৎকার কেউ শুনবে না 
একদিন এই পৃথিবী হবে মনুষ্যহীন --

পাখি, পতঙ্গ, ব্যাঙ, সরীসৃপ, গিরগিটি, পিঁপড়া, বন্যপ্রাণী সবই থাকবে,
থাকবে ডলফিন, গাঙচিল, হাঙর ও কচ্ছপ... 

বৃক্ষ থাকবে , সাগর, নদী, পাহাড় থাকবে , প্রোতাশ্রয়, ঝরনা থাকবে --
জ্বলবে সূর্য, আলো দিবে চাঁদ, নিভবে তারা......
কিন্তু মানুষ থাকবে না কোথাও,
মানুষ থাকবে না তাই স্বপ্ন থাকবে না।

কিন্তু, 
মানুষই স্বপ্ন দেখে, হাঙর কচ্ছপ'রা দেখেনা...

রচনাকাল -- ২৮ এপ্রিল, ২০২০ ইং


২১.     তুমি 

চোখ খুলে দূরের যে মেঘ দেখি সেখানে তুমি
সে মেঘের ছায়াপথে আমার যে চোখের তারা
সে তারায়ও মিটিমিটি জ্বলছো তুমি। 

ঝিরিঝিরি যে বৃষ্টির ধারা বইছে ভূবন জুড়ে 
সে জলপতনের শব্দেও তুমি
জলে জলে ভরে যায় যে নদী সেই স্রোতধারাও তুমি।

সকালে পাখিদের যে গান বাজে সেই গানে তুমি
অলিন্দে বসে ডাকে যে কাকাতুয়া তার সুরেও তুমি 
সেই কাকাতুয়ার বিষন্ন চোখের মায়াতেও তুমি।

বুকের গভীরে তুমি মিশে গেলেই নির্জনতা বাড়ে,  আকুল হয়ে ওঠে যে বিন্দু বিন্দু রক্ত কণিকা--
স্তব্ধ হয়ে যায় যে শ্বাস প্রশ্বাস সেই দীর্ঘশ্বাসেও তুমি।

এলোমেলো যে স্বপ্ন আসে রাত্রির গভীরে থেকে 
হৃৎপিণ্ডের দু'পাশে যে স্পন্দন শুনি --
যে ঝড় আসে বুকের অতল থেকে সে ঝড়েও তুমি।

জীবন আর কালের কপোলের যে অন্ধকার, 
সে অন্ধকারের ওপাশে দেখি যে আলোর ছ্বটা --
সেই নিঃশেষিত আলোক বিন্দুতেও তুমি। 


২২.         যেদিন প্রথম এলে

আমার বাড়ির আঙিনায় যেদিন তুমি 
প্রথম পা ফেলেছিলে
কোথা থেকে সেদিন শুকপাখিরা উড়ে এলো দলে দলে
সাদা মেঘের মতো গন্ধরাজ ফুলগুলো ফুটে উঠল 
মেঘ ভেঙে বৃষ্টিও হলো অঝোরে । 

কবিতার খাতার সাদা পাতায় কত অজস্র 
কবিতা লেখা হলো-- লেখা হলো তোমার কত নাম, 
কত মধুবন্তী গানের চরণে খাতা ভরে গেল, 
ভরে গেল কত সঞ্চারীতে ....

লিখে রাখা হয়ছিল মেহেদী মাখা তোমার হাতের কথা
মায়াবী রাতের কথা, চাঁদের কথা--
চাঁদমুখী কুঞ্চিত মুখের কথা, কত যে আরও রূপকথা!


 ২৩.          আমার নামে কাজল দিও চোখে 


পার্ক রোড ধরে হাঁটতে হাটঁতে আজ যখন বাসায় ফিরছিলাম, তখন মনে মনে কয়েক লাইন কবিতা লিখেছিলাম। 

লিখেছিলাম চমৎকার কিছু পংক্তি !

বাসায় এসে যখন খাতায় লিখতে বসি, তখন সেই পঙক্তিগুলি আর মনে করতে পারছিলাম না। 

কী লিখেছিলাম আমার মনের সেই খাতায়?

একদিন তপ্ত দুপুরবেলায় তুমি আগুন পলাশ বনে এসে দাঁড়াবে। রাঙা পলাশের আবীর মাখবে তোমার গালে।  তোমার বুক দুরুদুরু। আমার নামে কাজল দিবে চোখে, আদর মেখে নেবে তোমার ঠোঁটে। জুঁই ফুল দিয়ে তুমি চুলের বিনুনি গাঁথবে, খোঁপায় গুজবে হলুদ গোলাপ। 

এই কথাগুলো তখনকার কবিতার নয়। মন থেকে সেই অপূর্ব সুন্দর কথাগুলি মুছে গেছে।

আমি কবিতার খাতা বন্ধ করে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াই। কী আশ্চর্য! দেখি, তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছ।  বেনীতে জুঁই, খোঁপায় তোমার হলুদ গোলাপ, মুখে পলাশ রেণু। 

এ যে সত্যি!
বসন্ত যে এসে গেছে। আগুন পলাশ ফুটে আছে আমারই দরজার সামনে।


২৪.         তুমি  উদ্বাস্তু নও


তুমি উদ্বাস্তুও নও, গৃহহীনাও নও তারপরও বললে-- ঠাঁই দাও তোমার গৃহকোণে।
আমি বললাম, স্থান নেই, ঘর পরিপূর্ণ। 

তুমি বললে -- দিগন্ত পেরিয়ে, মাঠ পেরিয়ে, ঐ দূরে  
অশ্বত্থ ছায়াতল আছে, নদীর কূল আছে, ভাঙা নাটশালা আছে,
লতা গুল্মের ছায়া আছে, তারার আচ্ছাদনের আকাশ আছে , আকুল করা জোছনা ধারা আছে... ... 
সেথায় দাও স্থান।

এইসবের কাছে আমাকে নিওনা, উন্মাতাল হই, 
লোভ হয়! পরিপাটি সব ফেলে এই গৃহত্যাগ করে চলে যেতে ইচ্ছে করে।

পাহাড়, টিলা, মহুয়াগাছ, ঘেঁটুফুলের গন্ধ, শান্ত জলের নদী, সবাক জারুল বৃক্ষ, বসন্তের পাতা মর্মর, এইসবই আনন্দ দেয়,..... আমাকে ঘরের বাহির করে... 


২৫.    এমন একজন মানুষ 
        

সবার জীবনে এমন একজন মানুষ থাকা দরকার, যে তাকে বেলা করে ঘুমিয়ে থাকলে বলবে --  'ওঠো। ঘুমিওনা। অফিসের সময় হয়ে গেছে।'
তপ্ত দুপুরের রোদে হাঁটলে বলবে -- 'রোদে হাঁটবে না, শরীর পুড়বে'। বৃষ্টিতে ভিজলে বলবে -- 'বৃষ্টিতে ভিজো না, ঠান্ডা লাগবে, জ্বর আসবে।'
আর জ্বর আসলে বলবে -- 'মনে করে ঔষুধটা খেয়ে নিও।'
রাতে মশারীটা ঠিক করে দিতে দিতে বলবে -- 'হাতটা যেন বাইরে না থাকে, মশা কামড়াবে।'
বলবে -- মোবাইলটা অফ করে ঘুমাইও। ঘুুম না এলে বলবে -- চোখ বন্ধ করে রাখো।'

বাইরে যাবার সময় বলবে -- 'সাবধানে রাস্তা পার হইও।' বিপদে পড়লে সবসময় আল্লাহ কে স্মরণ করবে।
তেষ্টা পেলে -- পানি খেয়ে নিও । আর, খিদা লাগলে, কিছু খাবার কিনে খেয়ো।

আরও বলবে -- 'কখনোই সিগারেট খাবে না। 
হাতখানি টেনে নিয়ে তার মাথায় দিব্বি নিয়ে বলবে -- শুনবে তো আমার সব কথা? বলো, দিব্বি!'

বলব -- জ্বী, শুনব তোমার সব কথা। দিব্বি।


২৬.        মনেই পড়ে না

আজ হয়ত তোমার মনেই পড়ে না, একবার সাত রাস্তার মোড়ে  মারাত্মক ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়াতে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছিল, আর এজন্য তুমি রেগে ভূত হয়ে গিয়েছিলে। ভেবেছিলে, আমি বুঝি অন্য কারোর সাথে ডেটিং করেছি। 

আজ হয়ত তোমার মনেই পড়ে না, আমাদের ঝগড়া ও খুনসুটি করার কথা। তুমি রাগ করে বাক্স পেটরা গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে যেতে। পরে খোঁজ নিয়ে জানতাম, তুমি বাপের বাড়ি না যেয়ে আমার বড়ো বোনের বাসায় চলে গেছ এবং আমার বিরুদ্ধে দুনিয়ার  নালিশ করেছ।

আমার বোন তোমাকে যখন বুঝিয়ে আমার কাছে রেখে যেত, তখন তুমি নতুন করে আমার প্রেমে পড়তে। কী সব নতুন নিয়মের মধুর প্রেমে বাঁধতে আমাকে!  

আজ কতো কথা মনে পড়ে, পাড়ার ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম রেল স্টেশনে। অকারণে ট্টেনের হইসেল শুনতাম প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে। 

কিংবা পার্কের সেই ঘাসের কোণ্। কোনো কথা না বলে অহেতুক বসে থাকতাম সারা দুপুর।  গেটে দাঁড়িয়ে ফুচকার দোকানে ফুচকা খেতাম। অসময়ে কোকিলের ডাক শুনেছি পার্কের বেঞ্চে বসে। আর ওদিকে মরা পাতা ঝরে পড়ত তোমার চুলের উপর। 

মনে কী পড়ে বই মেলার কথা। প্রাঙ্গণে হাঁটতে হাঁটতে  নিঃশ্বাস নিতে নতুন বইয়ের। স্টলে ঢুকে খুঁজেে খুঁজে বের করতে হুমায়ুন আহমেদের একজন মায়াবতী। জানো, আজ অনেকেই কোথাও নেই।

কেউ আর ডাকে না। মনে রাখেনি কেউ। তোমার মতো কেউ আর ভালোবাসে না। আজ এমন হয়েছে দিন, কারোরই কোনো দায়ভার নেই ভালোবাসার! যারা হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যায় , তারা কেউ আার ফিরে আসে না।


২৭.          তোমাকে খুঁজি আমি--

স্বপ্নের ভিতর নয় স্মৃতি হাতড়িয়েও নয়
পুরনো শ্যাওলা পরা প্রাচীরের গায়ে তোমার নাম লেখা খুঁজি, যে নামটি আগাছায় ঢেকে গেছে।
বহুকাল আগের ছেঁড়া কবিতার খাতায় কেঁপে কেঁপে লেখা পঙক্তিমালায় তোমার রূপ লাবণ্য খুঁজি,
খুঁজি উদ্বেগ হয়ে অ্যালবামে রাখা ধুসর মলিন তোমার  সাদাকালো ছবি।

এই শহর দিনে দিনে অচেনা হয়ে যায়, চেনা নদী দূরে সরে যায়
অপরাহ্ণ বেলায় অকাল সন্ধ্যা নেমে আসে, অসময়ে দুচোখ ভরে ঘুম চলে আসে। 

কেউই ফিরিয়ে দিতে পারেনা আর ভোরের আকাশ 
নিঝুম দুপুরের বিমুগ্ধ কথকতা
নিশুতি রাতের সুখ প্রণয় কথা,
ক্লান্ত অবসাদে জড়িয়ে ধরা সেই অনিঃশেষ শান্তি।

রাত্রির মধ্যাহ্নে ঘুম ভেঙে যায়, জেগে দেখি প্রিয় মুখ, 
মায়া করা সেই চোখ, সেই আনত চেয়ে থাকা,
শহরের রুক্ষ বৃক্ষরাজি বলে- সেই ছায়া-মায়া তুমি 
আজ পাইবে কোথায়? 

আমার জাগরণে, আমার চৈতন্যে দূর বহুদূর থেকে  পায়েলের শব্দ শুনতে পাই, সন্তর্পণে তুমি হেঁটে আসো, 
যাকে দেখি-- সে তোমাকে চিনিতে পারি না যে!
যারে খুঁজি দেখিতে আমি পাই না তারে!


 ২৮.          রাগ মধুবন্তী

যে রাত গানের হবে সে রাতে কোনো ক্রন্দন করো না
হাহাকারও করো না, প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখ,
যদি তারার আকাশে হঠাৎ তারা নিভে যায়।

পাখিরা পালক ঝরে ফেলে যায়, 
তুমিও খুলে ফেলো রাত্রিবসন, যেমন করে মেঘ সরে যায় চাঁদের উপর থেকে।

কান থেকে ঝুমকা খুলে যায় ঝনঝন করে,
খোপা থেকে খুলে পড়ে চুলের কাঁটা, এলমেল চুল এসে ঢেকে দেয় তোমার কাজল ফোঁটা, কাঁকন বাজে হাতে, কাঁচের চুড়ি ভেঙে যায়, পুড়ে যায় গতরের সুগন্ধী।

ভেষজ সুবাস ভেসে আসে দূর্বার গন্ধের মতো,
কোন্ নদীর স্রোত ছুঁয়ে বহে সমীরণ, ঘরেই তুমি হয়ে ওঠো রুপালি নদী।

বিষাক্ত বৃশ্চিক কামড় দেয় বারংবার, 
নীল হয়ে যায় রাতের রং, ঝর্নার মতো ঝরে পড়ে সফেদ জল, জোছনা দ্যূতি ছড়ায় রত্নমঞ্জুষার মতো।

কত রাত্রি এমন ধ্রুপদী গান হয়, কত গান শুনি মধুবন্তী রাগে, কত সুর বাজে, কত সুর থেমে যায়।


২৯.         ঐ চাঁদ ঐ জোছনা     


তুমি কি অফিসে যাবার সময় প্রিয় মানুষটিকে চুমু খেয়ে বের হও?
তাকে বুকে জড়িয়ে ধরো ?
একাকী দুপুরে সে খেয়েছে কী না? খোঁজ নাও?
তুমি কী ভাবো? ঘরে আর তুমি ফিরে নাও আসতে পারো।

বিকালবেলা বাসায় এসে তুমি কি হাটঁতে বের হও তাকে নিয়ে?
সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করো কি, খোলা দিগন্তে কমলা রঙের অস্তগামী সূর্য দেখতে? 
তুমি কী ভাবো? এইটি তোমার শেষ  সন্ধ্যা হতে পারে।

রাতের নির্জনে তুমি কতটুকু কাছে টেনে নাও তাকে?
কতটুকু ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে পারো নিজেকে খালি করে? 
তুমি কী জানো? আজকের এই রাতে -- 
ঐ চাঁদ, ঐ জোছনা শেষ কিরণে ভিজিয়ে দিতে পারে তোমাকে!

৩০.      কুসুমপুরের পথে 

তোমাকে নিয়ে একদিন কুসুমপুরের পথে পথে হাঁটবো, যে পথ চলে গেছে গগনশিরীষ বনে 
যেখানে সন্ধ্যা রাতে জোনাকিদের মিটিমিটি আলো জ্বলে ওঠে

দোয়েলশীষের ভোরে দূর্বাঘাসের শিশিরে পা ধুয়ে নিও তুমি হেঁটে হেঁটে চলে যাবে ধনিদহ বিলে
সেখানে কাদার ভিতর মুক্তা লুকিয়ে থাকে

বসন্তের মধ্য দুপুরের রোদ্রে পুড়বে 
ফুটে থাকা অজস্র আম্রমঞ্জরির গন্ধ মেখো, 
বাঁশ ঝাড়ের নীচে পড়ে থাকা মরা পাতার মর্মর শুনো
হঠাৎ কোনো দূর্মর বাতাস এসে এলমেল করে দেবে তোমার মাথার চুল 

পড়ন্ত বিকালে পাশাপাশি হাঁটবে তুমি 
আমার ছায়া পড়বে তোমার উপরে 
তুমি বলবে -- 'ছায়া নয় গো, তোমার পাঁজরে জড়িয়ে নাও, যেমন করে ইছামতী নদী জড়িয়ে গেছে মাঠ পেড়িয়ে গ্রাম ছাড়িয়ে দূরের মোহনায়।'

সেখানে রাতের আকাশ সামিয়ানার মতো ছাতা ধরে রাখে, কত নক্ষত্রবীথি জ্বলে --
কালপুরুষ, বিশাখা,অরুন্ধতীরা দেখবে তোমাকে
সে এক অনন্ত ভালোবাসাবাসির রাত্রি , স্বপ্ন মোড়ানো সে রাত্রি শেষ হয় না।


৩০.         নদীতমা

যদি একদিন কোনো পাথুরে রাস্তায় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নামে, ভিজবে পথের পাশের অতসী ফুল, 
ভিজবে সোনালের ঝাড়, ভিজবে শালিক ও লাবণ্য দোয়েল।

কোনো বসন্ত পূর্ণিমা রাতে 
যদি জ্যোৎস্নায় ভিজে শাল পিয়ালের বন, 
যদি দিগন্তে ভাসে পলাশ শিমুলের গন্ধ 
যদি উতলা হয়  দখিনা বাতাস।

যদি কোনো হেমন্ত সন্ধ্যায় 
পথ চলতে চলতে পথ হারিয়ে ফেলো পথে 
কোনো দিশা খুঁজে আর না পাও
কোনো অচেনা পথিক যদি তোমার হাত ধরে 
তুমি কী কুঞ্চিত করবে তোমার চোখ?

চৈত্রের রোদে পুড়ে চলে যাবো ভূবনডাঙ্গার মাঠে,
তুমি কী আসবে সেখানে?
তোমার খোঁপা খুলে সারা চুলে রোদ্র মেখে দেব
নিয়ে যাবো যমুনা কূলে সেখানেই তুমি আমার নদীতমা হবে।


৩১.       সুন্দর চোখ 

কোনো কোঁকড়া চুলের মেয়েকে চুল খুলে রাখতে দেখলে মনে হয়, ও কেন চুল বেঁধে রাখে না,
কেমন কাকের বাসার মতো মাথার চুল!

ঐ কালো মেয়েটি 
কেমন গাঢ় রঙের শাড়ি পরে থাকে 
ও কেন হালকা নীল রঙের শাড়ি পরে থাকেনা,
কেমন কিম্ভূত ওর কৃষ্ণ কালো শরীর!

আর ঐ মেয়েটি অরক্ষণীয়া,
যত ছেলে দেখতে আসে বিয়ে হয়না তার 
মেয়েটির পায়ে আলতা পরা হয় না
হাতে মেহেদি দেয়া হয় না, কপালে দেয় না টিপ!

আচ্ছা যদি এমন হয়, 
ঐ কোঁকড়া চুলের মেয়েটিকে বনলতা সেনের মতো অসাধারণ লাগছে!
ওই শ্যামলা মেয়েটাকে গাঢ় শাড়িতে মোহময়ী
লাগছে!
আর ঐ অরক্ষণীয়া মেয়েটিকে কোনো এক রাজপুত্র এসে 'রাজরানী' করে ঘরে তুলে নিয়ে গেছে।

চাই শুধু দেখার জন্য  সুন্দর চোখ!


৩২.           ফেরা

একবার এক অস্তরাগের সন্ধ্যাবেলায় খুব কাছে থেকে সন্ধ্যা মালতী ফুলের গন্ধ নিয়েছিলাম 
তারপর কত সন্ধ্যা অন্ধকারে ডুবে গেছে
আর কোনো সন্ধ্যা মালতীর গন্ধ নেওয়া হয়নি।

আর একদিন এক চন্দ্রালোকিত রাত্রি দুপুরে 
জোছনা ভেজা কামিনীর সুবাস গায়ে মেখেছিলাম, 
তারপর কত জোছনা বুভুক্ষু রাত্রি চলে গেছে 
আর কোনো কামিনীকে ছুঁয়ে দেখা হয়নি।

তারও বহুদিন পরে এক অষ্টাদশীর মাথা ভর্তি কালো কুন্তলের গন্ধ নিয়েছিলাম,
আর একবার কুড়ি বয়সের এক রমণীর বুকের গন্ধ নিয়েছিলাম হেমন্ত গোধূলির ধূসরে , 
অষ্টাদশীর চুলের গন্ধ আর সেই রমণীর বুকের গন্ধের সাথে,  
সন্ধ্যা মালতী ও কামিনী ফুলের গন্ধের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাইনি।

পথ চলতে চলতে একবার পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম, 
চেনা সেই পথ দিয়ে আর বাড়ি ফেরা হয়নি...  
ক্লান্ত পথিকের মতো পথের মধ্যে একাকী বসে থেকেছি বহুদিন,
আর একবার আমার মানিব্যাগটা হারিয়ে ফেলেছিলাম 
সেই ব্যাগে ছিল প্রেমিকার পুরোনো চিঠি, 
একথা শুনে সেই প্রেমিকা চিরতরে মুখ ফিরিয়ে যে চলে গেল, তারপর সে আর ফিরে আসেনি।

এখন প্রায়ই পাতা ঝরা দেখি 
কোথাও কেউ নেই আর, কখন কোন্ সন্ধ্যাবেলায়  সন্ধ্যা মালতী ফুটে থাকে অগোচরে , 
কোথায় বর্ষারাতে কামিনী তার গন্ধ  বিলায় ঝিরিঝিরি, অষ্টাদশী সেই মেয়েটি কার ঘরের বউ এখন?
আর সেই কুড়ি রমণী এখন কী বিগত যৌবনা! কে তার খবর রাখে! 

কত প্রতিক্ষার মৃত্যু হলো, পথ চেয়ে চেয়ে কত বসন্তকাল চলে গেল
কোনো পথ দিয়েই সেই অভিমানীরা আর ফিরে এল না।


৩৩.          কুসুম

তোমাকে যেদিন আমার ঘরে আনলাম 
আমার নির্জন আঁধার ঘরে জ্যোৎস্না ঝরালে তুমি 
অনন্ত দীপ্ত এক প্রদীপ শিখা জ্বলে উঠল যেন।

কতকাল দেখিনি আমি এমন উতল-জ্যোৎস্না
কতরাত্রি বন্দী ছিলাম এমনই এক বদ্ধ গুহায় 
সেই তুমি প্রদীপ জ্বালিয়ে ধরলে আঁধার সরাতে।

এলমেল এক তরুণকে ঘরমুখো করলে তুমি  
স্বর্গ রচিলে তুমি, ঘরকে বানালে মায়াপুরী --
মুখের নেকাব সরিয়ে বললে, দেখো মায়াবতী। 

বুকের ওড়না ছুঁয়ে বলেছিলে, এখানে তুমি গোলাপের 
সুবাস পাবে, গন্ধ নেবে তোমার বুকে--
আমি ভুল করে দূর্বা ঘাসের নীচে খুঁজেছি রক্তকনক, আবার রক্ত কনককে ভেবেছি হেমলক। 

কতখানি ভালোবাসলে মানুষ অমরতা পায়
অন্তরের অমৃত-কক্ষে অনন্তবার দেখা হয়
স্বর্গ থেকে উড়ে আসা তুমি সেই মন্দার-কুসুম
যে কুসুমটি চিরদিনের আমার হলো।


৩৪.          যে চলে যায় 

যে চলে যায় সে কোনো কারণ ছাড়াই চলে যায়
সন্ধ্যার দোলনচাঁপার রূপ সে দেখেনা, রাতের অপরূপ তারামন্ডল দেখেনা, নিঝুম রাত্রির স্বপ্নগুলো দেখে না।

যে চলে যায় সে আরক্ত সুন্দর ঠোঁট দেখে না, চোখের নীচে আদ্রতা দেখে না, হৃদয়ের ভিতর কমল গান্ধার দেখে না, বুকের মর্মরিত আলিঙ্গনের টান দেখে না।

যে যায় সে অকারণে মাদল বেজে হাওয়ায় ভেসে যায়, অচিন পাখির মতো নীলিমায় উড়ে যায়, ক্ষমা করার অসীম মন বোঝে না, অনিঃশেষ ভালোবাসা বেঝে না।

যে চলে যায় সে কোনো গুমরি গুমরি ক্রন্দনধ্বনি শোনে না, দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনেনা, ভোরের প্রার্থনা শোনে না, পিছুপিছু হেঁটে যাওয়ার পথচলা শোনে না।

যে চলে যায় সে ফতুর করে দিয়ে চলে যায়, পথে পথে অনাদর রেখে চলে যায়, শরীর সুধাগুলো কেড়ে নিয়ে যায়, ভালেবাসার অভিজ্ঞান দলিত করে চলে যায়।

যে চলে যায় সে স্বপ্নের ঘরটি ভেঙে দিয়ে চলে যায়, স্বার্থপরের মতো নিজের পাওনা বুঝে নিয়ে যায়, তঞ্চকের ন্যায় সে পিছনের দিকে ফিরেও তাকায় না। 

৩৫.           আমাদের মুহূর্তগুলি


আমি তোমাকে নিয়ে পাড়ি দিতে পারি  দীর্ঘ রাস্তা
যেখানে গিয়ে দিগন্ত জুড়ে রংধনুর রঙ দেখতে পারো,
অথবা তুমি ধরতে পারো আমার হাত, 
তোমাকে দিতে পারি দারুণ কিছু মুহূর্ত। যে মুহূর্তগুলো স্মৃতি হবে একদিন।

যখন এই শহরে ভীষণ রকম সবাই প্রেমে পড়বে 
যখন উৎসবে মেতে উঠবে অর্ঘ্য দিতে সবাই, 
তখন এই শহরের দেয়ালে দেয়ালে লিখব আমাদের নাম, 
যেমন করে কৈশোরে এক বালিকার নাম লিখেছিলাম ডুমুর গাছের বাঁকলে।

শরীরের মুগ্ধতা নেব না, জলে নেমে জলক্রীড়া করব না, 
একজন অপরজনের চুলের গন্ধ নেব কেবল, 
কানে আটকে দেব রক্ত জবার পরাগ, 
আর কপালে দেব অস্তরাগের সোনালি টিপ
শরীর ছুঁয়ে নয়, মুগ্ধ হব দেখে তোমার চোখের কালো কাজলে।

তোমাকে মনে পড়বে। তুমিও মনে করবে আমাকে, কীভাবে আমি তোমার দিকে তাকাতাম আর ধরতাম  হাত। আমাদের সেই দারুন দারুন মুহূর্তগুলি দিয়ে যেতে পারি। যদি চলে যাই স্মৃতি পাবে। তোমার যেটা চাই, তুমি তাই নিও। 


৩৬.            আক্ষেপ 

কোনো এক চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে, আকাশ থেকে নাকি ঘরের চালের উপরে টুপ টুপ করে সাদা মুক্তার মতো জোছনা ঝরে পড়বে, আমি সেই মুক্তাঝরা জোছনার রোশনি দেখতে পাব না।

কোনো এক বর্ষার দিনে, পৃথিবীর সমস্ত কদমফুল নাকি প্রেয়সীদের খোঁপায় ফুটে থাকবে, খোঁপায় ফুটে থাকা সেই ফুলের শোভা আমার দেখা হবে না।

কোনো এক শীতের রাতে, রাতভর বিসমিল্লা খাঁর সানাইয়ের সুরের মতো নাকি শিশির ঝরবে, আমার সেই শিশির ঝরা সানাইয়ের সুর কখনও শোনা 
হবে না।

কোনো এক শরতে যমুনার চরে এমনভাবে কাশফুল ফুটে থাকবে, আকাশ আর নদী কাশফুলের রঙে একাকার হয়ে যাবে, সেই শ্বেত শুভ্র আকাশ আর নদী দেখা হবে না।

নিঝুম সন্ধ্যার শেষে রাত্রি নামবে চরাচরে , বেতস লতার ঝাড়ে নাকি লক্ষ লক্ষ জোনাকি জ্বলে উঠবে সেদিন , নীলাদ্রি হবে লোকালয় , আমি সেই নীল আলোয় ভরা জনপদ দেখতে পাব না।  

এক বসন্তদিনে শিমুল পলাশের বনে নাকি লাল ফুলকির মতো আগুন জ্বলে উঠবে, আকাশ জুড়ে গাইবে গান খঞ্জনা পাখি,  মুখর করা সেই গান আমার শোনা হবে না। 

এক মেঘ বৃষ্টি রোদ্রের দিনে হঠাৎ ময়ূরাক্ষীর মতো রুপোলি জল ঝরে পড়বে উঠানের উপর , ভিজবে সেই জলে নবীন যুগলেরা, শীতল করা সেই জলে আমার ভেজা হবে না। 

আমি থাকব না, আমার স্বপ্ন থাকবে না, দেখতেও 
পাব না সেদিনের এইসব রূপ রং সৌন্দর্য, কিন্তু আমার আক্ষেপগুলি সকরুণ  দীর্ঘশ্বাস ফেলবে পৃথিবীর বুকের  উপর। 




৩৭.         আমার পূর্ণতা গুলি

লিখেছি রাতের কথা, জোনাকির কথা, 
অরণ্যের কথা, উর্বর পলিমাটির কথা
নদী ও পাহাড়ের কথাও লিখেছি।

লিখেছি পূর্ণিমার কথা, ঝিলমিল তারার কথা
থৈ থৈ জ্যোৎস্নার কথা 
অরুন্ধতি অত্রি কালপুরুষের কথাও লিখেছি।

লিখেছি দীপ জ্বেলে রাখা সন্ধ্যার কথা
পাখিদের নীড়ে ফিরে আসার কথা
দোলনচাঁপার সুবাস ঝরানোর কথাও লিখেছি।

লিখেছি কিন্নরীর কথা, ঘন মেঘের চুলের কথা,
কমলা রঙের ঠোঁটের কথা, চুম্বনের কথা, 
মৃগ নাভির সুগন্ধির কথাও লিখেছি।

লিখেছি রমণীর কথা, তার শরীর বৃত্তের কথা
বালিকা থেকে নারী হয়ে ওঠার কথা 
তার অভিসারিকা হয়ে ওঠার কথাও লিখেছি। 

লিখেছি গানের কথা, কবিতার কথা 
জ্যোতির্ময় এই চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্রের কথা, 
ভালবাসার সব পূর্ণতার কথাগুলিও লিখেছি।


৩৮.           তুমি ও নদী 

বলেছিলাম আমি স্বর্গের দেবী দেখব, 
তুমি তোমার মুখ দেখিয়ে বললে --
দেবী দেখ।

বলেছিলাম পূর্ণিমার চাঁদ দেখব,
তুমি ধবধবে শাড়ি পড়ে রাতের নিঝুমে
দাঁড়লে বারান্দায়,
বললে -- পূর্ণিমার চাঁদ দেখ।

বলেছিলাম মেঘে ঢাকা তারা দেখতে ইচ্ছা করছে,
তুমি তোমার শাড়ির ভাঁজ সরিয়ে বললে --
দেখ মেঘে ঢাকা তারা।

বলেছিলাম কেমন করে শুনব জোনাকির গান,
তুমি তোমার হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ তুলে বললে, 
শোনো জোনাকিদের গান।

বলেছিলাম কেমন করে শিখর ছোঁব,
বললে স্মিত স্পর্শ রাখো আঙ্গুলে --
গিরিপথ খুঁজে পাবে।

বললাম -- নদী?
বললে ঐ গিরিপথ ধরেই হাঁটতে থাকো,
দেখতে পাবে নদী।

বলেছিলাম কিভাবে তোমাতে নিমগ্ন হবো, 
তুমি তোমার নদীর জল দেখিয়ে বললে --
এখানে এসে ডুব দাও, 
দেখবে কেমন করে নিমগ্ন হয়েছ।


৩৯.       চেতনার ওপারে 


একদিন পবিত্র কোনো সকালে চলে যাব এই জনপদ শূন্য করে,
চিরকালের পথগুলি তখন হয়ে থাকবে নিরব,
যে পথে ধ্বনিত হবেনা আর আমার পায়ের শব্দ।

কোনো নদী বা সাগর তীরের
বা পাহাড়ের পাশের কোনো শান্ত লোকালয় থেকে
প্রিয়জনরা আসবে সেই পবিত্র সকালে 
কেউ আর রবে না বলার
কেন আমি শুন্য করে চলে যাচ্ছি, সব ক্রন্দনধ্বনি স্তব্ধ করে, যে কখনও ফিরবে না আর।
                      
বৃক্ষ শাখা থাকবে, বনের মাধবীলতা জড়িয়ে থাকবে,
নিস্তব্ধতার প্রতিমূর্তি তখন আমি! বয়ে নিয়ে যাব তোমাদের ভালোবাসা চেতনার ওপারে, অনন্তের যত কথা হিম-শীতল করে।

এই বংশ পরম্পরা নিঃশেষ হয়ে যাবে একদিন ---
আমি রয়ে যাব তখন মানুষের বেদনার মাঝে,
স্পন্দিত হবে আমার আত্মা অন্য কোনো শিশুর বুকে।


৪০.         মনখারাপের কারণ তুমি 


মেঘ ঝর ঝর বৃষ্টি , বৃষ্টি ভেজা রোদ্দুর, রংধনু 
আছে কী নেই, এইসব কোনো মনখারাপ করে না, মনখারাপ করে দাও তুমি।

তুমি আসো বা না আসো, তোমাকে পাই বা না পাই
ভালো বাসো আর না বাসো, এই সবের আক্ষেপ না আক্ষেপের যত কারণ হচ্ছ তুমি।

শিউলি ফুলের রেণুর গন্ধের জন্য না
স্নানের পর ভেজা চুলের সুবাসের জন্য না
রুপালি কোনো জলের জন্য না
শরীরের কোনো গোপন ঝিনুকের জন্য না, 
আমার সকল মনখারাপের কারণ হচ্ছ তুমি।

রাতবিরেতে জ্যোৎস্না তলায় একাকী হাঁটি
নির্জন সেই পথ, ঘুম আসে না
ঘুমের বাইরে, স্বপ্নের বাইরে কাউকে খুঁজি না।

অন্য কাউকে চাইও না,পাইও না, জীবনের মর্মমূলে তুমি, তোমার জন্যই আমার যত মনখারাপ।


৪১.          হে পুণ্যশীলা 

কতটা কালনাগের ছোবল দিলে শরীরের 
শ্বেত কমলের পাপড়িগুলো নীল হয়ে ওঠে
শাড়ির রং বদলে যায় ঘাম জলে।

কপাট খুললেই প্রথম উদ্ভিদ প্রান্তর, মুগ্ধতার নজর 
পড়ে উচ্ছ্বসিত লতাগুল্মে
রুপালি জল গড়িয়ে পড়ে তরঙ্গায়িত নদী থেকে।

তুমি লজ্জাস্পর্শে সাঁতরাতে থাক ঈর্ষার জলে
প্রতিটি ডুবে হারিয়ে ফেল পরিধেয় অলঙ্কার
অবলীলায় নিরাভরণ হয়ে যাও।

আমি তোমার অস্তনদীর জলে নেমে অবগাহন 
করি তখন, শুদ্ধ করি পাপ, 
পূণ্যবাণ হয়ে উঠি পূণ্য জলে, হে পূণ্যশীলা।।


৪২.          স্বৈরিণী

স্বৈরিণী, আমি তোর চোখের মধ্যে বসবাস করি,
এ কথা আমার সকল ছন্নছাড়া কবিতার শরীরে লেখা আছে।
আমি জেনে গিয়েছিলাম তা নিশ্চল সন্ধ্যা রাত্রিতে সপ্তপর্ণী পাতা ছিঁড়তে গিয়ে !
তুই পাশেই পড়ে থেকেছিলি কালিদাসের নায়িকা শকুন্তলার মতো। 
তখন কুমারসম্ভব উপাখ্যানের পাতা ছিন্নভিন্ন হয়েছিল, তখন শীতঘুম ভেঙ্গে পড়ছিল দুচোখে,
কী যে আশ্চর্য ছিল সেই রাতের সব প্রেমকাহিনী। 

স্বৈরিণী, তোর চোখে কি কোনও হাওয়া রাতের দোল খেলেনা?  উন্মত্ত হাওয়ার মেঘ কী আদর করে কাছে টানে না তোকে?
স্বৈরিণী, তুই আর একবার আয়, 
তুই এলেই গল্প হবে বৃষ্টি হবে শিউলি ফুল ফুটবে। খুনসুটি হবে রিমঝিম শিশির মাখা আদরে।


৪৩.           গতস্য শোচনা নাস্তি

যারা একদিন ভালোবেসে ভালেবাসা পায়নি, তারা অনেকেই নক্ষত্রের আড়ালে চলে গেছে। কত অসমাপ্ত চুমুর দাগ পড়ে আছে নির্গন্ধ হীন। রাতে সারা ঘর অন্ধকার হলে পাশে ঝোপের ভিতর জ্বলে ওঠে দু-একটি জোনাকি। কবেকার নির্মাল্য ভালেবাসার কথা মনে পড়ে যেয়ে মনখারাপ হয়।

স্টেশনের হুইসেল বাজে দূর থেকে। শুনি বাঁশি। এমন গভীর রাতে, অনেক দূরের সুর ভেঙে হঠাৎ গান জেগে ওঠে। কথা বলে। বলে, ঘুমালে নাকি?

কে যে বাঁশি বাজায়? যেই বাজাক বাঁশি। 
মনে পড়ে প্রেমিকার ঠোঁট। ঠোঁট কাঁপছে তার। চোখ বন্ধ করি। এই আঁধারেও  অজস্র ঘাসফড়িং উড়ে চরাচরে। 'সুরে সুরে বাঁশি পুরে তুমি আরও আরও আরও দাও তান...।' 

শিউলিবনে ভালোবাসার মানুষ কোমল গান্ধারে কাকে যেন কী বলে। বলে -- তোমার ঠোঁটে ধানের ছায়া। কুসুমপুরের আম ছায়ার মতো সুনিবিড়। সেই নিবিড় গহিন ছায়ায় হারিয়ে যায় এই শহরের এক রাখাল বালক।

জীবনের কতো হাস্নাহেনা সুরভিত দিন গ্লানিতে ভেসে গেছে। গতস্য শোচনা নাস্তি।


৪৪.           মৃত্যু


মানুষ মরে গেলে আর ফিরে আসে না, এ কেমন প্রস্থান মানুষের ?
নদীর জল শুকিয়ে গেলেও বৃষ্টিতে ভরে নদী
পানকৌড়ি'রা আবার ফিরে আসে জলে, মানুষ কেন ফেরে না
আমি অমরত্ব চাই, কি ভাবে রুখবো মৃত্যু ?
কিভাবে ফিরাব আযরাইলের থাবার পবিত্র হাত,
প্রেমিকাও কেঁদে কেঁদে ফিরে পায় প্রেমিককে
বাতাস না থাকলেও ঝড় এসে বন্ধ করে দখিনের জানালা,
মানুষ মরে গেলে কেন সে ফেরে না।

এই যে আমি এখান থেকে একদিন চলে যাব
আমার শোবার পালঙ্কও বেঁচে থাকবে অনেকদিন
আমার বসার চেয়ার, আমার পড়ার টেবিল, 
পুরু লেন্সের চশমা
আমার কবিতার খাতা, অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি,
সব থাকবে
আমি কেন থাকতে পারব না ---
আমি কেন আর ফিরে আসতে পারব না ?

চাঁদ ডুবে গেলে চাঁদ ওঠে, জ্যোৎস্নায় ভাসে পৃথিবী
আকাশ থাকে না খালি, শূন্যস্থান ভরে দেয় মেঘ এসে,
মানুষ মরে গেলে আর ফেরে না, কেনো শূন্য হয়ে থাকে তার স্থান।


৪৫.           সেই চোখ

ছোট কাঠের জানালার মধ্য দিয়ে একটি অচিন মুখ দেখতে পাই
মনে হয় তারই মুখ যাকে দেখেছিলাম দেবদারু গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এক বিকালে, রোদ পড়া লজ্জা মাখা এক আচমকা ক্ষণ ছিল তখন।

তার মুখ মাঝে মাঝে সত‍্যি দেখতে পাই 
আসলে সেই মুখ কী আমি দেখি? নাকি কোনও দিন তাকে দেখি নাই,
অন‍্য কোনো মুখের সাথে না হয় মিলিয়ে নেব সেই মুখ
এই জীবনে। 

কত মলয় বাতাস বহিতেছে, কত মানুষ আসে এই শহরে, কত ট্রেন চলে যায়, কত চিঠি নিয়ে আসে ডাক পিয়ন রঙিন খামে।

সময় পুরনো হয়ে স্নান হয়ে আসে
ঝাপসা হয়ে আসে চোখ, মনে হয় সেই চোখ কোথাও কাঁদছে।


৪৬.       ভালোবাসার পাগলামিগুলি

সকালবেলা হয়ত আমার আগে ঘুম ভেঙেছে, 
তখনও যদি ঘুমিয়ে থাকে তার সারারাতের
নির্ঘুম দুটি চোখ
আমি তার চোখের পাতায় স্পর্শ দিয়ে বলি ---
জাগবেনা? আমাকে দেখবেনা? ভালোবাসবে না? 

ঘর হতে বেরিয়ে যাব, 
সে আমার টাইয়ের নট ঠিক করে দিচ্ছে,
বোতাম লাগিয়ে দিচ্ছে কোটের,
চুলের গন্ধ আসছিল আমার নাকে,
মাথা ভর্তি চুলে মুখ রেখে বলি ----
যেতে ইচ্ছা করছে না, এসো ভালোবাসি।

স্নানের পর হয়ত সে চুল শুকা্চ্ছে 
তখনও টপ টপ করে চুল থেকে ঝরে পড়ছে জল
আমি হয়ত এসেছি বাহির থেকে, 
শরীরে আমার ঘামের গন্ধ, সার্টে লেগে আছে ধূলো
তার শীতল বুকে তখন উষ্ণতা রেখে বলি ----
এসো ভালেবাসি, আবারও স্নান করো আমার সাথে।

বিকেল বেলা পার্কে হাঁটছি 
ইউক্যালিপটাসের পাতা ঝরে পড়ছে তার শাড়ির উপর, দুটো শালিক বসে আছে ঘাসে
মাধবীলতা জড়িয়ে আছে সোনালের ডালে
ছাতিমগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে মুখে পড়ছিল  বিকেলের রোদ, 
সেই মৌন বিকেলে কানের কাছে মুখ রেখে বলি ----
চল যাই ঐ হাস্নাহেনার ঝাড়ে
ভালোবাসো শালিকের মতে, মাধবীলতার মতো জড়িয়ে।

সন্ধ্যায় জ্বালাতে দেইনা সন্ধ্যা বাতি
আঁধার নামে দুজনের মাঝে, কথা সব থেমে যায়
নৈঃশব্দ ঝুমঝুম করে ঘরের ভিতরে 
পাখিদের গান বন্ধ হয় তারও আগে, 
আমি তার চোখে দেখি তারার আলো,
বিমুগ্ধ মুখ তুলে তাকে বলি ---- 
আঁধার নামতে দাও, রাত আসতে দাও, আমাদের ভালোবাসাবাসি হবে।


৪৭.          অহংকার ছিল যৌবনের

তোকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, অহংকার ছিল যৌবনের
অহংকারে হেঁটেছিস তোর বাড়ির উঠানে
কাঁদা লাগাসনি পায়ে, জলে ভিজাসনি শাড়ি
বলেছিলাম তোকে --- বু্ঁনো জ্যোৎস্নায় স্নান করতে এক সাথে
তুই খুলেসনি শাড়ি, খুলেসনি অন্তর্বাস,
কিসের এতোল অহংকার ছিল তোর ?

যৌবন তো শুকিয়ে ফেলেছিস, অহংকার চূর্ণ করেছিস বলিরেখায়
নদীর জল শুকিয়ে ফেলেছিস
কোথায় সেই ফেনায়িত ঝর্নাধারা ?
অনুর্বর ভুমি, শুকিয়ে চৌচির হয়েছে মৃৃত্তিকা
এমন অনুর্বর ভুমি এমন জলহীন নদী পছন্দ করি না

যদি পারিস আবার নদী হ, আবার জলে ভর্ নদী
আবার উর্বর কর্ ভূমি
তবেই আমি লাঙ্গলের ফলা চালাব, সাঁতরাব নদী।


৪৮.          রমণী

আমাদের দেহ নদীর মতোন, নুড়ির মতোন, বালিয়ারীর মতোন, ঝর্নার মতোন
রিমঝিম ঝরে, এ কূলে ভাসে, ও কূলেও প্লাবিত হয়।

আমাদের চান্দ্র চুম্বনগুলি চিক চিক জলের মতোন,
সমুদ্রের ফেনার মতোন, হাঙরের কামড়ের মতোন আশ্লেষ লেগে থাকে ঠোঁটে ও চিবুকে।

আমাদের দেহ স্বচ্ছ আয়নার মতোন, বিধৌত চরাচরের মতোন বিবশ, 
আমাদের আঙ্গুলের আচরগুলো রক্তক্ষরিত, কোনো করুণা নেই, কোনো মমতা নেই।

প্রতিক্ষণ ক্ষত হই, খুলে যায় সকল বন্ধন, সকল বন্ধনী, উপত্যকা চূর্ণ হয়, চাঁদ বিক্ষত হয়, 
তারা খসে পড়ে, 
কে যে তুমি, কে যে প্রেমিকা, কে যে কুল বধূ ---
সবই রমণী।


৪৯.           সাগর সঙ্গমে

বিয়ের পর নতুন বৌকে বলেছিলাম- সাগর দর্শনে যাবে, নাকি নীলগিরি পাহাড়ে উঠে নীল মেঘ ছুঁবে ? সে বলেছিল --- 'সাগর দর্শনে যাব।' আমরা গিয়েছিলাম, সাগর সৈকতে।

সাগরের তীর ধরে দু'জন হেঁটেছিলাম। প্রথম সাগর দর্শন ছিল ওর, আবেগ আপ্লূত হয়ে উঠছিল তার প্রাণ, বিহবলতায় কেঁপে উঠেছিল ওর দেহ মন !

আমি ধরতে চেয়েছি তার হাত, সে কুঁড়াতে চায় ঝিনুক।
আমি নামতে চাই জলে। সে হাঁটতে চায় বালিয়ারীতে।
আমি কান পেতে রাখি তার বুকে। সে তখন গুনে সাগরের ঢেউ।
আমি ভাসতে চেয়েছি জলে। সে ঘুরতে চেয়েছে সাগর বেলায়।
আমি খুঁজেছি মুক্তা, সে খুঁজেছে প্রবাল দ্বীপের ঘাস ।
আমি তাকে বলি --- সাগরের শব্দ শুনতে, সে তখন শোনে সাগরের গান ।
আমি বলি --- চলো সাগর সঙ্গমে যাই।
সে তখন বলে --- চলো জলের তলে হারিয়ে যাই।

আমরা  নেমেছিলাম জলে, উত্তাল ঢেউ এসে ঢেকে দেয় শরীর । আমরা তখন ডুবতে থাকি, ধরি ওর কোমর, খুঁজি ছোট ছোট ঢেউ শরীরের বাঁকে বাঁকে। সে জড়িয়ে রাখে তার বূক আমার বুকে, খোঁজে শ্বেত প্রবাল । ও বলেছিল --- তার নাকি মরতে ইচ্ছা করছে। আমি বলেছিলাম --- তুমি একাই মরবে ? সে বলেছিল --- না, দু'জনে মিলে।


৫০.          চলে গেলে চলে যাবি

চাল নেই চুলো নেই ছাদ নেই গাছতলাও নেই
খোলা আকাশ দেখি ---
কি সুন্দর তারা ঝরে পড়তে দেখি
তুই এই সবের মধ্যে থাকলে থাকতে পারিস
না হলে চলে যাবি।

বুক চিন চিন করবে, সিগারেট খাব 
তারা গুণব রাতভোর
ঘাসের বিছানায় ঘুম পাবে
তোকে মনে পড়লে পড়বে, তারপরেও
তুই চলে গেলে -- চলে যাবি।

তুই চলে গেলে একা লাগবে
ফার্মেসীতে আসা যাওয়া বাড়বে
না খেয়ে ঘুমিয়ে থাকব
উদ্বাস্তু বাড়ির চারদিকে জোনাক জ্বলবে
তারপরেও তুই চলে গেলে, চলে যাবি।


৫১.         প্রেমাংশুর আগুনে জ্বলে 

এক বিকেলে আমরা হঠাৎ প্রেমিক প্রেমিকা 
হয়ে গেলাম 
আমি প্রথমেই ছুঁয়ে দেখলাম তোমার হাত
তুমি চোখ বন্ধ করে থাকলে।

আকাশের বিনম্র মেঘ সরে গেল
আমি মুহূর্তে বুঝতে পারি দীপ্তমান মানব অস্থি
তোমার ভিতরের সব বিন্যাস
যেখানে অলকানন্দার জল বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়ছে। 

আমার শক্ত উদ্বাহু হাত 
ধীরে ধীরে ধাবমান হলো তোমার দিকে
তুমি নৈঃশব্দে আসমানের ছায়ায় শুয়ে থাকলে 
তোমার শরীরের কোমল কিনারায় পার ভাঙ্গছে। 

আমার হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসে 
তোমার আন্তঃসিমানা থেকে বহিঃসিমানায়
তোমার সকল কক্ষপথ পেরিয়ে সুনির্মল নাভি তলে 
সকল গোপন প্রান্ত রেখায়।

আমি অনুভব করি দেহের সকল তপ্ত দাহে
শীৎকারের সকল ধ্বনিতে
প্রেমাংশুর আগুনে জ্বলে  আমাদের সকল শৌর্য বীর্য  একসময় পুড়ে খাক হয়ে গেল।


৫২.        প্রেম ক্ষুধা

হে আমার জন্ম আজন্ম প্রিয়তমা 
আমার সর্বগ্রাসী প্রেমিকা এৰং সকল অবাধ্য রমণীকূল
তোমরাও প্রেমজ, তোমরাও মন ভোলাও সকল পুরুষদের, তোমাদের মত করেই বশ করো সকল প্রেমিককে, তারা সহজেই নতজানু হয়
তোমাদের কাছে। 

হে আমার স্ত্রী পরস্ত্রী যুবতী স্বৈরিণীরা 
যদি তোমাদের প্রেম মিথ্যা হয়
যদি তোমাদের মুখ মিথ্যে কথা বলে,
যদি তোমাদের শরীরের সমস্ত দৃশ্যপট মিথ্যে হয়, 
যদি পিকাসোর আঁকা নারীদের মত তোমাদের
সৌন্দর্যগুলো সৌন্দর্যের না হয়
যদি তোমাদের প্রগাঢ় চুম্বনগুলো
গভীর আলিঙ্গনগুলো
যদি স্বপ্নলোকের গানগুলো বেসুরো হয়
যদি প্রতারণা করো 
যদি সন্ধ্যারাতের তারাগুলি আর না জ্বলে, 
দিনের রোদ্রশুলি যদি আঁধারের হয় 
যদি হৃদয়ের স্পন্দনগুলো স্পন্দিত না হয়
যদি চোখের তারা অনুজ্জ্বল হয়
যদি সব স্বপ্নসৌধ ভেঙে খানখান হয়ে যায়
তাহলে মনে করব জগতে কোনো প্রেম নেই।

তোমাদের শরীরের সকল ঐশ্বর্যগুলি যদি
অব্যবহৃত থাকে 
যদি আলোগুলো আলেয়া হয়ে যায়
যদি প্রাচীন নগরীর সকল আঁধার নামে এই ভূলোকে
যদি হঠাৎ সমস্ত মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে যায়
যাতে তোমাদের প্রবঞ্চনাগুলি কখনো আর
ফাঁকি দিতে না পারে 
যেন কোনদিনই প্রেম মুছে না যায় এই পৃথিবী থেকে।

হে রমণীকুল হে আমার জন্ম আজন্ম স্বৈরিণীরা তোমরাই আমার সকল বৈভব, আমার প্রেম ক্ষুধা
যদিও আমি স্ত্রৈণ নই।


৫৩.         অজ্ঞাত যাত্রা 
   
আমি আগে কখনও প্রেম বুঝিনি 
তাই তো ঠোঁটকে মনে করতাম রক্তকরবী 
চোখকে মনে করতাম সন্ধ্যা তারা 
শরীরকে শরীর মনে হতো না
মনে হতো মনি খচিত সর্প এক, এঁকেবেঁকে চলেছে
নদীর মতো।

সবকিছু রহস্যময় মনে হতো, বুঝতাম না গন্তব্য কী! 
সালভাদর দালির তুলির মতো হাতের আঙ্গুল 
উপত্যকা ছুঁয়ে চলে যেত অরণ্যপথে,
সেই পথ চেনা ছিল না কখনও আগে
আ়ফ্রোদিতিও এসে শেখায়নি কোনো প্রেম শাস্ত্র 
কোনো কলাকৌশল।

আমার ছিল না কোনো বোধ কিভাবে সন্ততি হয়
জানতাম না কিভাবে সভ্যতার বিস্তার হয় 
কিভাবে জল ভেঙে জলধি তল থেকে মুক্তা তুলে আনতে হয়
তারপরেও সাগরতলে অজ্ঞাত যাত্রার অভিযাত্রী আমাকে হতে হয়েছিল।


৫৪.    পদ্ম কুসুম 



পদ্ম কুসুম 

তুমি শুধু একবার খুলে দাও হৃদয়ের কপাট
এই উচ্ছ্বল যুবকের সামনে বন্ধ করো না দরজা
একবার খুলে ফেলো লজ্জার অবগুন্ঠণ।

তোমাকে শেখাবো কীভাবে ভালোবাসতে হয়
সব তছনছ করে, সব ভেঙ্গেচুরে কীভাবে গড়তে হয় শরীর শিল্প, হৃদয় ভাঙ্গতে হয় হৃদয়ের গহীনে 
যেয়ে।

আমি হাঁটু মুড়ে দু'হাতে স্পর্শ করতে চাই স্বর্ণরেণু
ভুলে যাওয়া ঢের ভাল স্মৃতি কাতর যন্ত্রণা
তুমি এই উন্মূল যুবকের বুকে মাথা রাখো
তোমার সব মণিকাঞ্চন বিলিয়ে দাও অকাতরে।

আমরা মিলব নদীর মতো, অন্তঃশীল স্রোত ধারার মতো -- ভেসে ভেসে তুলে আনব অলক্তমাখা পদ্ম-কুসুম। 


৫৫.          এখন ভালবাসার সময়

মন শোনে না মনেরই কথা, তোমার কথা কি 
শুনব আমি? 
আমি যে অবাধ্য এখন তোমার প্রেমে।

তুমি যখন তখন এসো নেমে
গ্রীবায় লাগাও এসে তোমার সূর্যের ঝলক
অগ্ন্যুৎসব হয় তখন দুজনের মর্মরে মর্মরে।

অবাধ্য হই সকল নিয়ম বিধি নিষেধে
পৃথিবীর সকল ধর্মগ্রন্থ দূরে সরিয়ে রাখি 
আমার যে তখন ভালোবাসবার সময়।

ডাক্তার চলে যাক হাসপাতালে
উকিল চলে যাক কোর্টে
বিচারপতি বসুক তার এজলাসে 
সাংসদেরা চলে যাক সংসদে
আইন তৈরি করুক, আমার বিরুদ্ধে প্রেমে।

আমি এসব আইন মানিনা --
আমার যে এখন ভালোবাসার সময়।


৫৬.           তুমি এসেছিলে

হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় তাকে --
চেয়ে দেখি সে যে নান্দী মুখ আবার ভৈরবীর
ঠুমরির সুরও যেন ভেসে আসে
মেঘদূতম্ শ্লোকও শোনা যায়
যেন যমুনা তীরে অকালে বান এসেছে। 

'বর্ষণ মন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি তোমারি এ দ্বারে, 
পথিকেরে লহ ডাকি তব মন্দিরের এক ধারে।'
এই গান গেয়েছিলো কে প্রথম --
এখন সে কোথায়? 
এখন আছো তুমি, এখন সে আহ্বানও দাও তুমি। 

সেই কোন জনমে শিউলী ফুটেছিল বাগানে 
আগে মাতাল হতাম এর গন্ধে , এখনও হই --
এখন হাত বাড়ালেই তোমাকে ছুঁই
যেন সায়গল এসে থামে 'পিয়া নাহি আয়ে'।
নাহ্! তুমি এসেছিলে আমারই গানে।


৫৭.      বয়স যখন একুশ

ভালোবেসেছিলি ঠিক ছিল
ভালোবাসা দিয়েছি।
কেন আবার বিয়ে করতে চাস?
অভাব সন্তাপ সইতে পারবি তো?

অবহেলা করবি না জানি
অযত্নও করবি না তুই
চোখের জল রাখার মতো আছে তোর যমুনা চোখ?
নিতে পারবি শোক?

হাওয়ায় তোর আঁচল উড়ে 
প্রজাপতি উড়ে এসে বসে তোর চুলে
তুই আকাশের নীল দেখিস
স্বপ্ন দেখিস স্বপ্নখোর  তোর দুচোখ ভরে
তুই কি ঘর করতে পারবি এই উড়নচণ্ডীর?

আচ্ছা, আসবি যখন আয়
আগুন যখন লাগিয়েছিস লাগুক
তুই যদি জ্বলতে পারিস আমিও জ্বলব
তুই যদি ছাই ভস্ম হতে পারিস আমিও হব
ভালোবাসা পুড়ুক।

ঘর নেই, নেই!
দুজনেই খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকব। 
রৌদ্র ঝড়ুক। বৃষ্টি পড়ুক। 
পাখি হয়ে উড়ে যাব শূন্য দিগন্তে। ফুল হয়ে ফুটে থাকব কোনো পুষ্প কাননে।

( এই কবিতাটি যখন আমি লিখেছিলাম, তখন আমার বয়স ছিল একুশ। পুরোনো জীর্ণ খাতা থেকে উদ্ধার করা। লেখার তারিখ ছিন্ন। সামান্য  সংশোধিত। )

৫৮.      অনারাধ্য পুরুষ 

হে আমার বিষাদ ক্লীষ্ট রমণী'রা, আমার অনন্ত গ্লানি, এখানে এই কবিতায় তোমাদের আক্ষেপের কথা লেখা থাকবে।

লেখা থাকবে অতৃপ্ত বাণীবদ্ধ দীর্ঘশ্বাসের কথা, হাজার নিশীথের না পাওয়ার ক্রন্দনের কথা।  নির্ঘুম চোখের ক্লান্তির কথা।

তুমি জেগে রও আরও দীর্ঘ রাত্রিকাল, মৌনতার আকাশ থেকে তারা'রা খসে পড়বে যখন,  নীভে যাবে আকাশ প্রদীপ ---
ঠিক তখনই তোমাদের অনারাধ্য পুরুষদের আগমনের পথ উন্মুক্ত হবে।



কবিতা গুচ্ছ 

১.
দূরে চলে যেয়ে হয়েছ সুদূরিকা
দুরেও থাকে নীহারিকা। 
যত দুরেই থাকো- 
দু'হাতের বন্ধনে নয় বুকের ভিতর রেখো
চিরজনমের সখা হয়ে ভালোবেসো।

২.

ফিরে যেতে বলেছিলে -- তাই মুখ ফিরিয়ে চলে গেছি। পৃথিবীর সমস্ত কক্ষপথ ঘুরে এসে দেখি, তুমি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছ দুহাত পেতে। 
ঐ হাত আমি ফিরিয়ে দেই কী করে ?

৩.   

উপেক্ষা করে দূরে  দূরে সরিয়ে রেখেছি যাকে
দিনশেষে সেই  আমার জন্য  অপেক্ষায় থাকে
আদর তো দূরের কথা হাতখানিও ধরিনি যার 
সেই আমায় ভালোবাসা করে দিয়েছে উজাড়।

৪.       

পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরি
কত কাঁটা পড়ে থাকতে দেখি পথের উপর
কত বুনোফুল ফুটে থাকে ঝোপেঝাড়ে
কত ঘাসফড়িং উড়ে ঝিলিমিলি 
কত আনন্দময় আমন্ত্রণ করে প্রজাপতি
তারপরও জোনাকজ্বলা মৌন সন্ধ্যার আগেই 
সব ফেলে ফিরে আসি তোমার কাছেই...

৫.        

বুকের ভিতর অসুখ রেখে  প্রেমটুকু  
দিও
এই পার্থিবেই তুমি আমার শুভাশিস 
নিও 
যেথায় তুমি যাও -  সাঁজ আকাশেই
থেকো
অপার্থিবের তারা হয়ে  আমায় মনে 
রেখো।

৬.

জীবন ফুরালো ভালোবাসা করে দিয়ে  উজাড়
ফতুর আমি কোনো কিছু নেই যে  আর দেবার

কত চেয়েছিলাম তোমাকে চিরদিনের  করে 
চলে গেলে তুমি একলা ফেলে  একলা  ঘরে।

৭.

তুমি দাঁড়িয়ে আছো আমার চোখের পাতার কাছে 
চেয়ে দেখি তোমার চুলে আমার চোখ ঢেকে আছে

চোখের উপর রেখেছ তোমার চোখ
জল ঝরে নাই ছিলনা কোনো শোক , 

তোমার চোখেই আমার ভালোবাসা জেগে আছে।

৮.

চিরকালের তরে  ধরে রাখতে চাই নিজের করে তারে 
আহম্মক য়ে সে জন মরে সে যায় নিজের দুঃখ ভারে। 

তার জন্যই যত করি আমি আঁখি ছলোছল
সকল কর্ম ফেলে দূরে রাখি যত কোলাহল

করব অশ্রুপাত নির্জনে সেথায় জীবন নদীর ওপারে।

৯.    
   
আমার জন্যই আজ তোমার যত অসুখ বিসুখ
বিসর্জন দিয়েছ তুমি অপাত্রে তোমার যত সুখ 

দায়ও নিয়েছ যত গ্লানি আর ব্যর্থতা আমার
তারপরও ভালোবাসো তুমি  অজস্র  অপার

আমার ছায়ার সাথে তোমার ছায়া রেখেছ মিশে 
শিকড়ে তোমার অস্তিত্ব  মন বোঝে তা অহর্নিশে।


১০.

তুমি কাছে থাকলেও তোমাকে মনে রাখব, দূরে চলে গেলেও তোমাকে মনে রাখব। এমনকি জীবন নদীর  ওপারে চলে গেলেও মনে রাখব। 
তাই বলো না -- আমাকে তুমি  মনে রেখ না। কাউকে মনে রাখার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ  আমার মনের। এখানে  তোমার খবরদারি চলে না।

১১.

কাল সারারাত ছিল তারা ভরা রাত,
কিন্তু হায়! নির্জন নির্ঘুম ঘুমের মধ্যে কেউ স্বপ্ন দেখাতে  
আসেনি!

১২.

তুমি চলে গেছ, বিচ্ছিরি সময়গুলো পার করছি, 
খারাপ লাগে না তবুও তেমন --
খারাপ  লাগে তখন, যখন সন্ধ্যা বেলায় হাঁটতে যাই,  পথের পাশে অলকানন্দা ফুল, কূলায় ফিরে যাওয়া উদ্যত শালিক, আর আকাশে সদ্য জ্বলে ওঠা তারাগুলো তিরস্কার করে হেসে বলে -- তুমি এখন একা, ভীষণ একা।

১৩.

কড়মচা গাছের ডালে সবুজ পাতার উপর বৃষ্টির ফোঁটা কান্নার মতো ঝরে পড়ে বলছে যেন -- 
এত সুখ ছিল যার জীবনে, সেই জীবনই যে শেষ হয়ে গেল।

১৪.

তুমি থাকলে কোলাহল, না থাকলে নির্জনতা। 
তুমি থাকলে মুখর সব , না থাকলে মন খারাপ লাগে।
তোমার পায়ের শব্দে আনন্দ ভৈরবী বেজে ওঠে  
পথে পথে। 
তুমি আর কখনও আসবে না জেনেও, 
দৌড়ে চলে যাই পথের দিকে। যেয়ে দেখি-- পথের উপর নির্জনতা'রা ক্রন্দন করছে।


১৫.

শত বছর পরে এমন বৃষ্টি বৃষ্টি সন্ধ্যা রাত্রিতে মাটির ফোড়া কাটা ঝোপে ঝাড়ে লুকিয়ে ঝিঁঝি পোকা ডাকবে।  বাঁশঝাড়ের আড়ালে আঁধার করা বনমৌরির গন্ধে যখন রাতের জোনাকিরা আকুল হবে -- সেই রাতের  গোপনে আমি ফিরে আসব ওদের মতো করে।
  
চেনার মতো আজিকার কোনো মানুষ হয়ত তখন থাকবে না।      

এই পৃথিবী নামে গ্রহে আবার যে  ফিরে আসতে ইচ্ছে করে, তা যে রূপেই হোক, যত তুচ্ছ কিছু হয়ে হলেও --- ঝিঁঝি পোকা কিংবা জোনাকি।    

১৬. 

ভীষণ ক্লান্তি হৃদয়ে আমার, আত্মাও ক্ষীণ স্পন্দনহীন,
শুক্লা যামিনীতে যদি তুমি আসো -- দেখতে পাবে না ঠিক আগের মতো
দূরে কোথাও হাস্নাহেনা'রা ফুটে আছে।


১৭..

তোমার অকম্পিত হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলে -- ধরো।  পরম নির্ভর বাহু, ছায়াবীথির মতো বুক দেখিয়ে  বলেছিলে -- এখানে হৃদয়।  জমাট বেঁধে আছে লাল রক্তের ছোপ ! 
যত্ন করো, পরিচর্যা করো, নিজের স্থানকে পবিত্র করে রাখো.....

১৮.

ঘর থেকে বের হলে উঠোন।  উঠোন পেরোলেই পুকুর। পুকুর পাড়ে কলাগাছের সারি। সারা বাড়ির আঙিনায় গাছগাছালি। তারপর ধানক্ষেত।       
এইটুকুর ভিতরে সব আছে। নির্মল বাতাস আছে ।  নীল আকাশ দেখা যায়। পাখির কলকাকলি শোনা যায়। রোদ্দুর পাওয়া যায় ।  ছায়া পাওয়া যায় ।

১৯.

মুছে যাওয়া চাঁদ, ঐ ছায়াপথ, নিভে যাওয়া নীল আলো।
সব মিথ্যুক, অমর তারাই যারা বেসেছিল 
ভালো।

২০.

আমার একটা স্বপ্ন আছে। আমার দেশের প্রতিটি নদীর কাছে আমি যেতে চাই। স্পর্শ নিতে চাই সব নদীর জলের।
সেরে ওঠো প্রিয় দেশ। 
আমাকে যে যেতে হবে সবগুলো নদীর কাছে।

২১.

এই কী নিয়তি তবে, চলে গেলে  অন্ধকারে
ওপারে, সেই অসীম যাত্রা তোমার কতদূর....? 
কান্নাটুকু রেখে গেলে, থামিয়ে দিয়ে তোমার 
জীবন বীণার সুর।


২২..

বলো, আর কত আঁধার হওয়া 
আছে বাকি?
আর কত আঁধার হলে জ্বলে 
উঠবে জোনাকি
আলো হবে, আলো আসবেই 
তোমরা শোনো
মানুষ আঁধারে থাকবে তাই কী 
হয় কখনো?

২৩.

একদিন গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি পরে হিজল বনের পাশে এসে তুমি দাঁড়িও। লুকিয়ে থাকবে সেখানে  পাতার রঙে। সবাই দেখবে সবুজ পাতা, আমি জানব সেখানে তুমি দাঁড়িয়ে।

ঠিক তখনই সবুজ প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাব। ঢুকে পড়ব তোমার আঁচলের নীচে। ঘুরব, দেখব চির হরিৎময় আর এক স্বপ্নের জগৎ। 
'নয়ন আমার রূপের পুরে
সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে, শ্রবণ আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন।'
'জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।'

২৪.

তুমি নও 
তোমার ছায়া পড়ুক আমার প্রাণে
স্পর্শ নয় 
তোমার চেয়ে থাকা তান তুলুক আমার গানে।

এখন একটু দূরেই থাকো--

আবার একদিন 
বকুল ঢাকা বনে হাঁটব দুজনে
আবার একদিন  
শ্রাবণ আকাশ নীলাদ্রি হবে হৃদ স্পন্দনে।

২৫.

কোথায় সেই রহস্যময় রাত
কোথায় সেই হৃদয় দুয়ার খুলে দেওয়া আশ্চর্য সন্ধ্যা... 
কোথায় সেই অনাস্বাদিত মখমলের সমুদ্র জল!
কোথায় সে দাঁড়িয়ে অমৃত সুধা পাত্র হাতে 
'দাও ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে....'

২৬.

তোমার জন্য চোখ টলোমলো, 
কবিতার অক্ষর এলোমেলো, কলম জুড়ে প্রকাশ 
পেল কেবলই শোক।

আত্মার আলো নিভে গেল, 
প্রদীপখানি জ্বেলে ধরো, স্মৃতির সাথে কথা বলো
মৃত্যু কেবল আমারই হোক।

২৭.

আমার ছিল বৃষ্টি নামানোর দায়, 
তুমি মেঘ করেছ যত
এই শ্রাবণে তোমার আকাশ ভার,  
বৃষ্টি কী হবে অবিরত?

এই শহর থেকে তুমি আজ
থাকো অনেক দূরে 
বদ্ধ ঘরে বন্দী আমি মন যে  
কেমন ভবঘুরে।

পায়ের পাতায় লেগে আছে 
যাযাবরের বালি 
উদাস চোখে মেঘরাগে তোমায়
মনে পড়ে খালি।

২৮.

জানালা খুলে রেখেছি, পুকরপাড় থেকে ছাতিমগন্ধের
সন্ধ্যা আসুক কবরচাপা নিঃশব্দের মতো,
কত গল্প কবিতাই তো লিখেছি, এই দমবন্ধ দিনে  কবিতা তোমাকে ঘুমের দেশে পাঠিয়ে দিলাম। আর কোনো গল্প লিখতে চাই না কোনো বঞ্চিতের,, সব কোলাহল থেমে যাও, কীবোর্ড তুমিও।

চন্দ্রমাস গুনতে ভুলে গেছি, আজ রাতে কী ধরনের চাঁদ উঠবে তাও জানি না, যেই চাঁদই উঠুক, বন্ধ জানালা খুলে দেখব তোমাকে। 

কেউ কী বাজাবে কোনো শরোদ, কিংবা গীটার দূরে কোথাও বেবাগী সুরে....


২৯.

আজিকার সূর্যের এমনই আলো সে শুধু মনখারাপের রোদ ছড়ায়
কুসুমপুরের পাতার বাঁশিওয়ালা সেই বালককে ডেকে আনো, ও আজ গান শোনাক......

মানুষই যদি না থাকে কে শুনবে তার গান আকুল করা 
কে গায়ে মাখবে অমিত সূর্য কিরণ,
কে দেখবে রাতের গগন জুড়ে লক্ষ লক্ষ তারা..


৩০.

ক্লান্তির শেষে, এই অন্ধকারের পর, সমস্ত ধূসর গোধূলির পরেও অকৃপণ আলো সব… আমাদের  হোক। আমাদের  হোক।

৩১..

দুজনেরই জেগে থাকার কথা ছিল --
কথা ছিল দুজনেই একসাথে ঘুমিয়ে পড়ব,
একসাথে স্বপ্ন দেখব বলে প্রতিশ্রুতি ছিল।

আর তুমি কী-না আগেই ঘুমিয়ে গেলে!
কত স্বপ্ন দেখার ছিল --

আমি নাকি বিশাল আকাশ হবো, সেই আকাশ জুড়ে তুমি পাখি হয়ে উড়বে। উদ্দাম নদীর মতো জল হবো আমি। সেই জলস্রোতে তুমি ভেসে যাবে।


৩২.

তার প্রাণের কথা, মায়াবী কাজল চোখ , বহুদিনের চেনা গন্ধ, বালিশে লেগে থাকা সুগন্ধি, গল্প বলা অজস্র রাত্রি, অস্পষ্ট করে  মনে পড়া কত ডাক নাম -- আরও কত কিছু আষ্টেপৃষ্টে করে মনে জাগে কত ভাবে যে প্রাণে জড়াতে চায় সারাক্ষণ -- 
'দেহমনের সুদূর পারে  হারিয়ে ফেলি আপনারে,
গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে। ' 

সবই তোমার মায়ার টানে ......


৩৩.

কখনো আর হবে না দেখা কখনো আর মিলব না দুজন দুজনে,
আমাদের ভালোবাসা ছিল ভুল অঙ্কে ভরা ভুল বিয়োগ  বিভাজনে
তাইতো আজ দুজন দুদিকে কখনো আর হবে না মিল
কোনো যোগ পূরণে।

৩৪.

চলে যাব সব ফেলে, এই অবগুণ্ঠিত নীলাকাশ, 
জলে ভরা টইটম্বুর এই নদী, স্মৃতির বসতবাড়ি, শ্রাবন কদম্ব ফুল।
রেখে যাব লুকিয়ে রাখা জীর্ণ প্রেমপত্র আর তোমাকে দেওয়া নাকফুল।

৩৫.

তোমার মনে বসন্তের আগুন লেগেছে। এই আগুন আমিই নিভে দিতে পারি। যদি চাও আমার জল বৃষ্টি মেঘ।


৩৬ 

তোমাকে ভালোবাসি।
এই কথাটি আর কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না।

তোমাকে ভালোবাসি। 
এই কথা আর কারোর কাছ থেকে শুনতেও ইচ্ছে করে না।

তোমাকে ভালোবাসি। 
এই কথা বলার পর কথা না রেখে চলে যায় শেষমেশ।

যারা কথা রাখবে বলে মনে করি তারা বলেও না ---
তোমাকে ভালোবাসি।

৩৭.

আজ প্রথম কোকিল ডাকল। তাও আমার বাড়ির কাঁঠাল গাছের ডালে। এসো উদযাপন করি আসন্ন বসন্তদিন।

'আজ চাঁদ খাবলে জ্যোৎস্না রাখব তোমার বুকে। ফিনফিনে জ্যোৎস্না। তার পর নক্ষত্রেরা বসবে উবু হয়ে। আমি কাকে দেখব? তোমাকে না নক্ষত্রকে? আজ কোকিল ডেকেছে।

আজ ভালোবাসার উন্মোচন। ফুলের কুঁড়ি চেয়ে আছে। কোকিলের ঠোঁটে দিগন্তের ঘুঙুর। সব নদী একসঙ্গে ছুটছে। তুমিও কি ছুটে আসছ আমার দিকে? যেমন করে নক্ষত্র ছিটকে আসে বকুলের ডালে!

এসো কিন্তু। আজ কোকিল ডেকেছে।'


৩৮. 

নদীর মতো
সন্ধ্যার মতো
নির্জনতার মতো 
অন্ধকার হয়ে তুমি কোথায় চলে যাও
আমি দেখতে পাই না...

৩৯.

জানি না। কী বলেছিলে। 'জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে...।' কেমন সেই ভালোবাসার অরূপ রূপ । কী আশ্চর্য লাবণ্যে ভরা তোমার মুখ! 'দিয়ো গো আমারে নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে, তুমি।'

আমার এপিটাফ  লিখে রেখে যেও তুমি 
শিমুলতলার টিলায়। ঐ মাটির বাড়িটার শ্বেতপাথরের ফলকে।
ফেলো না আমারে ছড়ায়ে।


৪০.      

যত দূরে যাও, তত তুমি দিগন্ত বিস্তৃত হয়ে যাও, 
নদী যেমন করে দূরে চলে যায়,
অথৈ সাগর হয়ে যায়।


৪১.

যখন খুব একা লাগে, যখন মনে হয় এ জীবন আর চলছে না, তখন কারো কাঁধে একটু মাথা রাখতে ইচ্ছা করে, মনে হয় কেউ এসে একটু জড়িয়ে ধরুক। কিন্তু কেউ আসে না কাছে। কেউ নেয় না জড়িয়ে। 

তখন নিজের কাঁধে নিজেই মাথা রাখি, নিজেকে নিজেই জড়িয়ে ধরি।


৪২.

তোমাকে ভালোবাসি এই কথাটি তোমাকে আমি  বোঝাতে পারিনি। 
যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানবিলাস ফুল ছুঁয়ে বলেছিলাম, ভালোবাসি। সেই  কথাটি বিশ্বাস করলে না তুমি। 
ভালোবাসি এই কথাটি বিশ্বাস করেছিল সেদিনের  ঝাউবনের হরিৎ পাতা, গাঁদা ফুল, শিশির ভেজা ভোরের হাওয়া আর হলুদ প্রজাপতি। 

যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোমাকে বলেছিলাম ভালোবাসি, সেই বারান্দায় এখন দেখি-- সেখানে অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

সেই বারান্দাটি এখন আর আমাদের নেই।


৪৩.

'ভালোবাসি। কোনো দিন ভুলব না। ছেড়ে যাব না।'
কত প্রতিশ্রুতি!

সেই তুমি কিসের টানে চলে গেলে, ফেলে রেখে গেলে তোমার স্মৃতি। 

কথা রাখলে না, ফিরে আর আসলে না, ভেঙে ফেললে সকল প্রতিশ্রুতি।


৪৪. 

ভালোবেসে কাছে আসতে পারোনি যখন
তখন বিচ্ছেদই অনন্ত হয়ে থাক,
তোমার জন্য রোগে শোকে জ্বলবে শরীর
স্মৃতিগুলো পুড়ে খাক হয়ে যাক।


৪৫.

স্বপ্নে স্বপ্নে চলি। স্বপ্ন দেখে চলি। মনখারাপ থাকলে এর ওর সাথে কথা বলি। এ বাড়ি ও বাড়ি যাই। কখনো কখনো কারোর কাছ থেকে জীবনের গল্প শুনি। নিজের কথা বলি। মেঘে ঢাকা সূর্য ছায়ার নীচে একা একা পায়ে পায়ে হাঁটি। 

চলতে চলতে আবারও মনখারাপ হয়ে যায়। ভাবি, সবই মিথ্যা হাসি হাসা। সবই মিথ্যা ভালো থাকা। 

হায়! এই আমার প্রতিদিনের ভালোথাকা।


৪৬.          

মৌনতা দিয়েই ঢেকে থাক
তোমার মুখখানি 
বিস্মৃতির মেঘে ঢেকে যাক আকাশটিও।

প্রতিরাত বেঘোর ঘুমের মাঝে কোনো 
স্বপ্ন দেখা হয় না
শোনা হয় না আর কারোর গল্প কথাও।

৪৭.

কাল আমার পুরোনো এই বাড়িটায় একটি দোয়েল নেমে এসেছিল ঝাঁঝা দুপুরে,
সে ডানা ঝাপটালো, পালক ফেলল, ঘুরে ঘুরে দেখল আঙ্গিনাটা।
ভালো লেগেছিল তার নরম পালক, পিপাসিত চঞ্চু, ভৈরবী রাগের মতো শিস।

কে    রজনীগন্ধার লজ্জাহীন গোপন সুবাস ছড়িয়েছিল ! ভালো লেগেছিল তার রাতের বেলার  বুভুক্ষু গন্ধ নিতে, 
ভালো লেগেছিল তাকে পুণ্য জল ধারায় ভিজিয়ে দিতে, পৃথিবীর নির্জনে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলতে পাপড়ি। 

কে   অমৃত জলের প্রস্রবণে ভেসেছিল , কে দিয়েছিল প্রথম প্রস্তাব দ্বিধা উপেক্ষা করে, তা জানবে কী করে মূর্খ দোয়েল, আর অপ্রেয়সী এক রজনীগন্ধা!

৪৮.

হাতটা এগিয়ে দাও। বকুল ডালের মতো আঙুলে কালি লাগিয়ে লিখি তোমার নাম। লিখি তুমি আমার যা হও তাই। 

নাম লেখালিখি  ছিল আমার ছোটবেলার অভ্যাস। মাটিতে আঁচড় কেটে লিখতাম প্রিয় ফুলের নাম, পাখির নাম, নদীর নাম। মনে মনে কতজনকে যে ছদ্মনাম রেখেছিলাম। জানত না কেউ-ই তারা। 

মা বলত, মাটিতে আঁচড় কাটতে হয় না। অমঙ্গল হয়। মা এখন নেই। কোথায় কোন  মঙ্গল আলেকে সে ঢেকে আছে কে জানে!

এখন কিন্তু একটাই নাম। তাকেই শতো নামে ডাকি। কখন কোন নামে ডাকি মনেও থাকে না। যে সব নামে ডাকি, সেই নামগুলোই লিখে দেই তোমার হাতে।
এসো। হাত পাতো।


৪৯.       

তপ্ত দুপুরবেলা কিংবা পরন্ত বিকেলে, সন্ধ্যায়, বা নিশীথ রাত্তিরে যখনই ঘরে ফিরি না কেন, দরজার কড়া নাড়লেই একজন মায়াবতী এসে দরজা খুলে দেয়। আমাকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না । টেবিলে খাবার রেডি পাওয়া যায়। পরিপাটি থাকে বিছানা।  ফুলদানিতে ফুলের সুবাস ঝরতে থাকে। শোবার সময় মশারিটাও টানাতে হয় না ।

অথচ শুক্লপক্ষ কোনো জ্যোৎস্না রাতে এই মায়াবতীর জন্য কখনো আনিনি একটি রজনীগন্ধার বৃন্ত ! কিংবা নীলকন্ঠ পাখির একটি পালক।


৫০.   

যদি প্রেমহীন হয়ে থাকো, মেঘদূতের সম্ভোগের শ্লোক পড়েও যদি নির্বিকার থেকে যাও           
যদি না থাকে তোমার রাগ-অনুরাগ-
যদি বিহ্বল না হয় কস্তরী নাভি, যদি সুর  না ওঠে কোমলগান্ধার,                                           
যদি কেঁপে না ওঠে তোমার শরীর, রক্তে শোনিতে যদি না ভেজে তোমার পরনবাস,                            তাহলে তুমি আমার কবিতা পড়ো না।


৫১.

অন্ধকার পছন্দ করো, বুকের খাঁজে তাই তোমাকে রেখেছি
তা দেখে রাত্রিও হিংসা করে-
শরীরের ঘ্রাণ পেয়ে আহলাদী হয়ে ওঠো
আমিও তখন স্বপ্ন   বীজ বুনি তোমার উর্বর মৃত্তিকায়।

৫২.   মৃত্যুর পরে

আমার ঠিকানায় এসে আমাকে পাবে নাকো আর
শুধু নামটি লেখা আছে, 
যেথায় গিয়েছি চলে    সেথায় কেউ পারেনা যেতে
পারেনা  থাকতে  কাছে,
যে জীবন ছিল ভাঁটফুল মহুয়ার কাছে, চলে গেছে 
সে নক্ষত্র বীথির দেশে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন