বালক বয়সে এই কাহিনীটি আমার পিতামহের জেঠাতো ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম। তিনিও আমার দাদাজান হন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারতবর্ষজুড়ে তখন স্বদেশি আন্দোলন চলছিলো। বাংলায়ও তখন এ আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠেছিলো। অরবিন্দ ঘোষ, গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে আন্দোলন উচ্চ মাত্রা পায়। উল্লেখ্য এই স্বদেশি আন্দোলনে একটি গ্রুপ ছিল সশস্ত্র। তাদের সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কারণে এই আন্দোলন একসময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আমার এই দাদাজান সশস্ত্র গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ওনার নাম ছিলো শ্রীমান মফিজ উদদীন মন্ডল।
স্বদেশি আন্দোলন করতে যেয়ে সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কারণে প্রায় তেরো জনের একটি গ্রুপকে তৎকালীন বৃটিশ সরকার শাস্তি স্বরূপ কালাপানি অর্থাৎ আন্দামান দ্বীপে দীপান্তরিত করে। তার ভিতর আমার দাদাজান শ্রীমান মফিজ উদ্দিনও ছিলেন। আমার দাদাজান ছিলেন তৎকালীন এন্ট্রান্স পাশ শিক্ষিত সুদর্শন এক যুবক। আসুন তৎসময়ের সেই যুবক মফিজ উদদীনের মুখেই তার সেই দীপান্তর জীবনের কাহিনীটি শোনা যাক --
৭ই ডিসেম্বর, ১৯১১ সাল। এম.ভি মহারাজ যখন কোলকাতা বন্দর থেকে ভোরে ভেঁপু বাজিয়ে ছাড়ে তখনও ভোরের সূর্য ওঠে নাই। জাহাজটি বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে দক্ষিণ পূর্ব অক্ষরেখার দিকে চলতে থাকে। আমার হাতে হাতকড়া, জাহাজের দোতলায় ক্যাবিনের মতো একটি কামড়ায় আরো পাঁচজন আসামির সাথে আমিও বসে আছি। আমাদের রুমের দরজার সামনে দুইজন নিরাপত্তা রক্ষী দাড়ানো। বাইরে তখন রোদের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছিলো। আমার খুব ইচ্ছা করেছিলো বাইরের সূর্যোদয় দেখার । গভীর সমুদ্র থেকে সূর্যোদয় দেখা কয়জনেরই ভাগ্যে জোটে। আমি রক্ষী দুইজনকে বললাম -- 'আমাকে একটু রেলিংয়ের এই পাশে যেতে দাও। আমি জলে ঝাঁপ দিয়ে মরবোনা। এই সাগর, এই সূর্যোদয়, চারদিকে এতো আলো, সাগরের এই নিনাদ, ডানা মেলা গাংচিল পৃথিবীর এতো সুন্দরকে রেখে কেউ কোনো দিন মরতে চাইবেনা। আত্মহত্যা তো নয় -ই। '
মহারাজ চলতে চলতে দুপুরের মধ্যেই ভারত মহাসাগর টেরিটোরীতে ঢুকে যায়। আমি এর আগে দেখেছিলাম বালুকাবেলায় দাড়িয়ে সাগর কিন্তু কখনো দেখিনি গভীর সমুদ্রের মাঝে সমুদ্র। আমার হাতে শিকল পরানো, কিন্তু আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো দুই হাত তুলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে। এ আমার শাস্তি নহে গো, এ আমার পরম পাওয়া। আমি দেখতে পাচ্ছি সৃষ্টির অসীমত্ব। হে প্রভু তুমি আমাকে অমরত্ব দাও এই জলধিতে। আমাকে তুমি মহান করো। '
এই মহারাজ জাহাজে রাজপুত্তুরের মতো বেশ আছি। দুপুরে কোরাল মাছের তরকারি, ভুবনেশ্বরের মিহি আতব চালের ভাত। চারিদিকে জলরাশি! এতো সুখ এখানে, মনে মনে লুই মাউন্টব্যাটেনকে স্মরণ করছিলাম, বলছিলাম তোদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। শাস্তি স্বরূপ পাঠিয়ে দিচ্ছিস কালাপানিতে। কিন্তু আমিতো উপভোগ করছি জীবন। পৃথিবীর এই অপরূপ রূপ না দেখলে জীবন অপূর্ণ থেকে যেতো।
তারপর সমুদ্রে নেমে এলো সেই সন্ধ্যা। রক্ষীদের বলি --'তোরা আমায় এই রুমের ভিতর শিকল পড়িয়ে রাখিসনে। আমাকে একবার শুধু যেতে দে ঐ রেলিংয়ের পাশে। যেতেও দেয় ওখানে। পানিতে চেয়ে দেখি হাজার হাজার রূপালী মাছ লাফাচ্ছে। আহা! আমি যদি একটিবার এই জল ছুঁইতে পারতাম। যদি ধরতে পারতাম একটি রূপালী মাছের পালক। চিলগুলোর দিকে চেয়ে ভাবছিলাম - এখানে এই অতলান্তিকে এতো চিল আসলো কই থেকে? রাত হলে উড়ে ওরা কোথায়-ই বা চলে যাবে? কোথায় নেবে ঠাঁই? ওরা কি ক্লান্ত হয়না?
আস্তে আস্তে সমুদ্রে রাত নেমে আসে। সাগরের শোঁ শোঁ গর্জনে মন কেমন যেনো উচাটন হয়ে ওঠে। কেবিনের জানালার ফাঁক দিয়ে দেখি শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। গভীর সমুদ্রে এমন চন্দ্র দর্শনে আত্মা আমার হিম হয়ে আসে। এমন মায়া মুগ্ধ রাতে আমার দুই চোখে সেদিন আর ঘুম আসেনি।
তিন দিন ধরে সাগরে ভাসতে ভাসতে চতুর্থ দিনের সকাল বেলায় মহারাজ জাহাজটি যেয়ে পৌঁছে কালাপানিতে তথা আন্দামান দ্বীপে। মহারাজ যখন কূলে নোঙ্গর করে, তখন দ্বীপে তাকিয়ে দেখি আন্দামানের পারিপার্শ্বিক দৃশ্য। কি সুন্দর সমুদ্রসৈকত ও ম্যানগ্রোভ অরণ্য। মুহূর্তেই এক উত্তেজক আনন্দের উপলব্ধির ঢেউ খেলে গেলো অন্তরে। বিস্ময়কর ও চিত্তাকর্ষক অরণ্য, শ্বেত বালুকাময় সমুদ্র সৈকত ও সমুদ্রের কাঁচের ন্যায় স্বচ্ছ জলধারা এই দ্বীপকে মহিমান্বিত করেছে।
আমাদের প্রথম দিন নিয়ে যাওয়া হয় সেলুলার জেলে। গরাদের পিছনে কয়েকমাস বন্দী করে রাখা হয়। এই সেলুলার জেল একটি মহান অতীতকে জড়িয়ে ধরে আছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা যে কি অসহ্য দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে তাঁদের জীবন কাটিয়েছিলেন তার সাক্ষী আমিও হতে পেরেছিলাম।
আমার মাত্র পাঁচ বছরের দীপান্তরের শাস্তি হয়। আমি কোনো চোর বদমাশ ছিলাম না। আমি ছিলাম নিছক ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন তরুণ যোদ্ধা। আসামিদের আচরণ ভেধে সাগর দ্বীপেই শর্ত সাপেক্ষে মুক্ত জীবনে ছেড়ে দেওয়া হতো। সৌভাগ্যক্রমে আমি ছিলাম তাদেরই একজন।
মুক্ত জীবন পেয়ে সেলুলার জেল থেকে প্রায় পনেরো মাইল উত্তরে মায়া দ্বীপ নামে একটি ছোট্ট দ্বীপে চলে যাই। দ্বীপটি ভারত মহাসাগরের কোলে অবস্থিত। এই উর্বর সমভূমীয় দ্বীপটি নারিকেল গাছ দ্বারা আবৃত। সমুদ্রের অনবরত হুঙ্কারের নিনাদ মনকে পুলকিত করে তুলে। দ্বীপের প্রকৃতির হেঁয়ালিপূ্র্ণ সৌন্দর্য আমার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। ছোট্ট এই দ্বীপে দশ বারোটি নিকোবরী কুঁড়ে ঘর ছিলো। যেখানে কয়েকঘর শোমপেন আদিবাসি পরিবার বাস করতো। এরা দেখতে অনেকটা মঙ্গোলীয় জাতি গোষ্ঠীর মতো। নাক চ্যাপ্টা। গায়ের রং বাদামি। প্রায় নগ্ন হয়ে এরা বসবাস করতো। মেয়েরা শরীরে স্বল্প লতাপাতা জড়িয়ে রাখতো আর পুরুষগুলো জালের নেংটি পড়ে থাকতো।
দামোদর নামে এক জেলের সাথে আমি ভাব করি। এবং তার পরিবারের সাথে মিশে যাই। দামোদরের বউ ছিলো, একটি যুবক ছেলে ছিলো, ছেলে বউ এবং একটি চোদ্দ পনেরো বছরের মেয়ে ছিলো। এরা কোনো ধর্মব্রত পালন করতোনা। শুধু সন্ধ্যার সময় অগ্নি উপাসনা করতো এবং কি সব জপ করতো। আমি এদের ভাষা বুঝতাম না। প্রথম প্রথম ইশারায় কথা বলতাম। পরে ভাষা রপ্ত করতে পেরেছিলাম। ঠিক ধর্ম গ্রহণ নয়, আমি ওদের সাথে বসে অগ্নি উপাসনাও করতাম এবং জপ করতাম।
আমার সেই একাকী দীপান্তর জীবনে দামোদরের পরিবারটির সাথে আমি মিশে যাই। আমি দামোদরদের সাথে সাগরে মাছ ধরতে যেতাম। মনে হতো আমি দামোদরেরই একটি ছেলে। দামোদর, দামোদরের বউ, সবাই আমাকে আপন করে নেয়। আপন করে নিয়েছিল, দামোদরের মেয়ে চিনুপুদিও।
আমার যখন মন খারাপ লাগতো, তখন দূরে বহুদূরে হাটতে হাটতে চলে যেতাম। ভারত মহাসাগরের তীরে বসে বঙ্গোপসাগরের জলের নিনাদ শুনতাম। মন আর ভালো হতোনা। চলে আসতাম কুটিরে। এই কুঁড়ে ঘরে কখনোই সন্ধ্যা বাতি জ্বলতোনা। সন্ধ্যা হলেই সবাই শুয়ে পড়তো। কিন্তু আমি শুতামনা । বাইরে তালপাতা বিছিয়ে শুয়ে থাকতাম, না হয় বসে থাকতাম। একাকী আকাশ ভরা তারা দেখতাম। জ্যোৎস্না ঝরে পড়তো। তারপর একসময় ঘুমিয়ে যেতাম।
সেদিন ছিলো পূর্ণিমা সন্ধ্যা। পুন্জে ছিলো অগ্নি উপাসনার উৎসব। নাচ হবে। গান হবে। তাড়ি খাবে। নেশা করবে। স্ফূর্তি করবে। উৎসবের এই দিনে আমি উপস্থিত থাকিনা। মনটা খুব খারাপ লাগছিলো। একাকী চলে যাই সমুদ্র তীরে। বালুকাবেলায় বসে থাকি। শুনি সাগরের শব্দ। জলের কুলকুল ধ্বনি কান্নার শব্দের মতো মনে হচ্ছিলো। চাঁদের আলো এসে ভেসে গিয়েছিলো নীল জলে। হঠাৎ পিছনে ফিরে দেখি চিনুপুদি দাড়িয়ে আছে। আমি ছোট ডিঙ্গিটার কাছে চলে যাই। যেয়ে ডিঙ্গিতে বসি। চিনুপুদিও আমার পিছে পিছে এসে নৌকায় বসে।
আমি : তুমি চলে আসলে যে। ওখানে উৎসব হচ্ছে।
চিনুপুদি : আমার ভালো লাগছিলোনা, তাই চলে এলাম।
আমি : তোমাকে খুঁজবেনা?
চিনুপুদি : না। সবাই নেশায় চূর হয়ে আছে।
আমি : তুমি ওসব খাও নাই?
চিনুপুদি : না।
হঠাৎ সাগরে পূর্ণিমার জোয়ার শুরু হয়ে যায়। আমরা তখনও বিহবল হয়ে নৌকায় বসে আছি । ডিঙ্গিটি ভাসতে ভাসতে আরো কূলের দিকে চলে আসে। সাগরের ঢেউ আমাদের শরীরের উপরে আছড়ে পড়ছিল। চিনুপুদি ভয় পেয়েছিল কিনা জানিনা। সে আমাকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেছিল। সমুদ্রের ঢেউ আর জ্যোৎস্নার প্লাবনে আমরা সেই সন্ধ্যা রাতে আরো বেশি ভিজে স্নাত হয়েছিলাম।
এই মায়া দ্বীপে আরো চার পাঁচ মাস চলে যায়। এর মাঝে আমি চিনুপুদির আরো কাছে চলে আসি। ওকে একটু ভালোও বেসে ফেলি। এক পূর্ণিমা সন্ধ্যায় পুন্জের পুরোহিত কি এক মন্ত্র পড়িয়ে চিনুপুদিকে আমার হাতে সপে দেয়। এটি ওদের বিয়ের নিয়ম ছিলো কিনা জানিনা।
বন্দীদের শর্ত অনুযায়ী প্রতি মাসে মুক্ত বন্দীদের সেলুলার জেলে যেয়ে রিপোর্ট করতে হতো। এবার রিপোর্ট করতে যেয়ে জানতে পারি, গভর্নর লুই মাউন্টবাটেন যীশু খ্রিস্টের বড়ো দিন উপলক্ষে আন্দামানের কিছু বন্দীকে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি দেবে। সেই তালিকায় আমার নামও আছে। আমি খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠি। আগামীকাল সন্ধ্যায়ই মহারাজ ছেড়ে যাবে বন্দর থেকে। ঐ জাহাজে করেই চলে যেতে হবে কোলকাতা।
আমি ঐদিনই চলে আসি মায়া দ্বীপে। আজ রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ নেই। ভারত মহাসাগরের তীরে এই দ্বীপে আজ নেমেছে আঁধার। চিনুপুদি আমাকে জড়িয়ে থেকে সারারাতই কেঁদেছে। খুব ভোরে মায়া দ্বীপ থেকে ছোট নৌকায় করে পোর্ট ব্লেয়ারের সেলুলার জেলে চলে আসি। বিদায় বেলায় চিনুপুদি ওর পেটের কাছে কান পেতে আমাকে ওর বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে বলেছিল। আমি শুনেওছিলাম। আর ওর এক হাত থেকে পিতলের একটি রুলি বালা খুলে দিয়ে বলেছিল -- 'এটি আমার স্মৃতিচিহ্ন, ভুলে যাবেনা। এসো আবার। '
বিকেলে যখন সেলুলার জেলের অফিসে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সেরে বিদায় নিচ্ছিলাম, জেলার সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো -- 'এই দ্বীপের আমার সবচেয়ে বেশী কি ভালো লেগেছিলো? ' আমি উত্তরে বলেছিলাম, তিনটি জিনিস আমার ভালো লেগেছিলো -- এক. মায়া দ্বীপ, দ্বিতীয়ত: সাগরের শব্দ, আর তৃতীয় হচ্ছে, চিনুপুদি।
K.T
31/8/2017
স্বদেশি আন্দোলন করতে যেয়ে সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কারণে প্রায় তেরো জনের একটি গ্রুপকে তৎকালীন বৃটিশ সরকার শাস্তি স্বরূপ কালাপানি অর্থাৎ আন্দামান দ্বীপে দীপান্তরিত করে। তার ভিতর আমার দাদাজান শ্রীমান মফিজ উদ্দিনও ছিলেন। আমার দাদাজান ছিলেন তৎকালীন এন্ট্রান্স পাশ শিক্ষিত সুদর্শন এক যুবক। আসুন তৎসময়ের সেই যুবক মফিজ উদদীনের মুখেই তার সেই দীপান্তর জীবনের কাহিনীটি শোনা যাক --
৭ই ডিসেম্বর, ১৯১১ সাল। এম.ভি মহারাজ যখন কোলকাতা বন্দর থেকে ভোরে ভেঁপু বাজিয়ে ছাড়ে তখনও ভোরের সূর্য ওঠে নাই। জাহাজটি বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে দক্ষিণ পূর্ব অক্ষরেখার দিকে চলতে থাকে। আমার হাতে হাতকড়া, জাহাজের দোতলায় ক্যাবিনের মতো একটি কামড়ায় আরো পাঁচজন আসামির সাথে আমিও বসে আছি। আমাদের রুমের দরজার সামনে দুইজন নিরাপত্তা রক্ষী দাড়ানো। বাইরে তখন রোদের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছিলো। আমার খুব ইচ্ছা করেছিলো বাইরের সূর্যোদয় দেখার । গভীর সমুদ্র থেকে সূর্যোদয় দেখা কয়জনেরই ভাগ্যে জোটে। আমি রক্ষী দুইজনকে বললাম -- 'আমাকে একটু রেলিংয়ের এই পাশে যেতে দাও। আমি জলে ঝাঁপ দিয়ে মরবোনা। এই সাগর, এই সূর্যোদয়, চারদিকে এতো আলো, সাগরের এই নিনাদ, ডানা মেলা গাংচিল পৃথিবীর এতো সুন্দরকে রেখে কেউ কোনো দিন মরতে চাইবেনা। আত্মহত্যা তো নয় -ই। '
মহারাজ চলতে চলতে দুপুরের মধ্যেই ভারত মহাসাগর টেরিটোরীতে ঢুকে যায়। আমি এর আগে দেখেছিলাম বালুকাবেলায় দাড়িয়ে সাগর কিন্তু কখনো দেখিনি গভীর সমুদ্রের মাঝে সমুদ্র। আমার হাতে শিকল পরানো, কিন্তু আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো দুই হাত তুলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে। এ আমার শাস্তি নহে গো, এ আমার পরম পাওয়া। আমি দেখতে পাচ্ছি সৃষ্টির অসীমত্ব। হে প্রভু তুমি আমাকে অমরত্ব দাও এই জলধিতে। আমাকে তুমি মহান করো। '
এই মহারাজ জাহাজে রাজপুত্তুরের মতো বেশ আছি। দুপুরে কোরাল মাছের তরকারি, ভুবনেশ্বরের মিহি আতব চালের ভাত। চারিদিকে জলরাশি! এতো সুখ এখানে, মনে মনে লুই মাউন্টব্যাটেনকে স্মরণ করছিলাম, বলছিলাম তোদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। শাস্তি স্বরূপ পাঠিয়ে দিচ্ছিস কালাপানিতে। কিন্তু আমিতো উপভোগ করছি জীবন। পৃথিবীর এই অপরূপ রূপ না দেখলে জীবন অপূর্ণ থেকে যেতো।
তারপর সমুদ্রে নেমে এলো সেই সন্ধ্যা। রক্ষীদের বলি --'তোরা আমায় এই রুমের ভিতর শিকল পড়িয়ে রাখিসনে। আমাকে একবার শুধু যেতে দে ঐ রেলিংয়ের পাশে। যেতেও দেয় ওখানে। পানিতে চেয়ে দেখি হাজার হাজার রূপালী মাছ লাফাচ্ছে। আহা! আমি যদি একটিবার এই জল ছুঁইতে পারতাম। যদি ধরতে পারতাম একটি রূপালী মাছের পালক। চিলগুলোর দিকে চেয়ে ভাবছিলাম - এখানে এই অতলান্তিকে এতো চিল আসলো কই থেকে? রাত হলে উড়ে ওরা কোথায়-ই বা চলে যাবে? কোথায় নেবে ঠাঁই? ওরা কি ক্লান্ত হয়না?
আস্তে আস্তে সমুদ্রে রাত নেমে আসে। সাগরের শোঁ শোঁ গর্জনে মন কেমন যেনো উচাটন হয়ে ওঠে। কেবিনের জানালার ফাঁক দিয়ে দেখি শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। গভীর সমুদ্রে এমন চন্দ্র দর্শনে আত্মা আমার হিম হয়ে আসে। এমন মায়া মুগ্ধ রাতে আমার দুই চোখে সেদিন আর ঘুম আসেনি।
তিন দিন ধরে সাগরে ভাসতে ভাসতে চতুর্থ দিনের সকাল বেলায় মহারাজ জাহাজটি যেয়ে পৌঁছে কালাপানিতে তথা আন্দামান দ্বীপে। মহারাজ যখন কূলে নোঙ্গর করে, তখন দ্বীপে তাকিয়ে দেখি আন্দামানের পারিপার্শ্বিক দৃশ্য। কি সুন্দর সমুদ্রসৈকত ও ম্যানগ্রোভ অরণ্য। মুহূর্তেই এক উত্তেজক আনন্দের উপলব্ধির ঢেউ খেলে গেলো অন্তরে। বিস্ময়কর ও চিত্তাকর্ষক অরণ্য, শ্বেত বালুকাময় সমুদ্র সৈকত ও সমুদ্রের কাঁচের ন্যায় স্বচ্ছ জলধারা এই দ্বীপকে মহিমান্বিত করেছে।
আমাদের প্রথম দিন নিয়ে যাওয়া হয় সেলুলার জেলে। গরাদের পিছনে কয়েকমাস বন্দী করে রাখা হয়। এই সেলুলার জেল একটি মহান অতীতকে জড়িয়ে ধরে আছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা যে কি অসহ্য দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে তাঁদের জীবন কাটিয়েছিলেন তার সাক্ষী আমিও হতে পেরেছিলাম।
আমার মাত্র পাঁচ বছরের দীপান্তরের শাস্তি হয়। আমি কোনো চোর বদমাশ ছিলাম না। আমি ছিলাম নিছক ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন তরুণ যোদ্ধা। আসামিদের আচরণ ভেধে সাগর দ্বীপেই শর্ত সাপেক্ষে মুক্ত জীবনে ছেড়ে দেওয়া হতো। সৌভাগ্যক্রমে আমি ছিলাম তাদেরই একজন।
মুক্ত জীবন পেয়ে সেলুলার জেল থেকে প্রায় পনেরো মাইল উত্তরে মায়া দ্বীপ নামে একটি ছোট্ট দ্বীপে চলে যাই। দ্বীপটি ভারত মহাসাগরের কোলে অবস্থিত। এই উর্বর সমভূমীয় দ্বীপটি নারিকেল গাছ দ্বারা আবৃত। সমুদ্রের অনবরত হুঙ্কারের নিনাদ মনকে পুলকিত করে তুলে। দ্বীপের প্রকৃতির হেঁয়ালিপূ্র্ণ সৌন্দর্য আমার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। ছোট্ট এই দ্বীপে দশ বারোটি নিকোবরী কুঁড়ে ঘর ছিলো। যেখানে কয়েকঘর শোমপেন আদিবাসি পরিবার বাস করতো। এরা দেখতে অনেকটা মঙ্গোলীয় জাতি গোষ্ঠীর মতো। নাক চ্যাপ্টা। গায়ের রং বাদামি। প্রায় নগ্ন হয়ে এরা বসবাস করতো। মেয়েরা শরীরে স্বল্প লতাপাতা জড়িয়ে রাখতো আর পুরুষগুলো জালের নেংটি পড়ে থাকতো।
দামোদর নামে এক জেলের সাথে আমি ভাব করি। এবং তার পরিবারের সাথে মিশে যাই। দামোদরের বউ ছিলো, একটি যুবক ছেলে ছিলো, ছেলে বউ এবং একটি চোদ্দ পনেরো বছরের মেয়ে ছিলো। এরা কোনো ধর্মব্রত পালন করতোনা। শুধু সন্ধ্যার সময় অগ্নি উপাসনা করতো এবং কি সব জপ করতো। আমি এদের ভাষা বুঝতাম না। প্রথম প্রথম ইশারায় কথা বলতাম। পরে ভাষা রপ্ত করতে পেরেছিলাম। ঠিক ধর্ম গ্রহণ নয়, আমি ওদের সাথে বসে অগ্নি উপাসনাও করতাম এবং জপ করতাম।
আমার সেই একাকী দীপান্তর জীবনে দামোদরের পরিবারটির সাথে আমি মিশে যাই। আমি দামোদরদের সাথে সাগরে মাছ ধরতে যেতাম। মনে হতো আমি দামোদরেরই একটি ছেলে। দামোদর, দামোদরের বউ, সবাই আমাকে আপন করে নেয়। আপন করে নিয়েছিল, দামোদরের মেয়ে চিনুপুদিও।
আমার যখন মন খারাপ লাগতো, তখন দূরে বহুদূরে হাটতে হাটতে চলে যেতাম। ভারত মহাসাগরের তীরে বসে বঙ্গোপসাগরের জলের নিনাদ শুনতাম। মন আর ভালো হতোনা। চলে আসতাম কুটিরে। এই কুঁড়ে ঘরে কখনোই সন্ধ্যা বাতি জ্বলতোনা। সন্ধ্যা হলেই সবাই শুয়ে পড়তো। কিন্তু আমি শুতামনা । বাইরে তালপাতা বিছিয়ে শুয়ে থাকতাম, না হয় বসে থাকতাম। একাকী আকাশ ভরা তারা দেখতাম। জ্যোৎস্না ঝরে পড়তো। তারপর একসময় ঘুমিয়ে যেতাম।
সেদিন ছিলো পূর্ণিমা সন্ধ্যা। পুন্জে ছিলো অগ্নি উপাসনার উৎসব। নাচ হবে। গান হবে। তাড়ি খাবে। নেশা করবে। স্ফূর্তি করবে। উৎসবের এই দিনে আমি উপস্থিত থাকিনা। মনটা খুব খারাপ লাগছিলো। একাকী চলে যাই সমুদ্র তীরে। বালুকাবেলায় বসে থাকি। শুনি সাগরের শব্দ। জলের কুলকুল ধ্বনি কান্নার শব্দের মতো মনে হচ্ছিলো। চাঁদের আলো এসে ভেসে গিয়েছিলো নীল জলে। হঠাৎ পিছনে ফিরে দেখি চিনুপুদি দাড়িয়ে আছে। আমি ছোট ডিঙ্গিটার কাছে চলে যাই। যেয়ে ডিঙ্গিতে বসি। চিনুপুদিও আমার পিছে পিছে এসে নৌকায় বসে।
আমি : তুমি চলে আসলে যে। ওখানে উৎসব হচ্ছে।
চিনুপুদি : আমার ভালো লাগছিলোনা, তাই চলে এলাম।
আমি : তোমাকে খুঁজবেনা?
চিনুপুদি : না। সবাই নেশায় চূর হয়ে আছে।
আমি : তুমি ওসব খাও নাই?
চিনুপুদি : না।
হঠাৎ সাগরে পূর্ণিমার জোয়ার শুরু হয়ে যায়। আমরা তখনও বিহবল হয়ে নৌকায় বসে আছি । ডিঙ্গিটি ভাসতে ভাসতে আরো কূলের দিকে চলে আসে। সাগরের ঢেউ আমাদের শরীরের উপরে আছড়ে পড়ছিল। চিনুপুদি ভয় পেয়েছিল কিনা জানিনা। সে আমাকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেছিল। সমুদ্রের ঢেউ আর জ্যোৎস্নার প্লাবনে আমরা সেই সন্ধ্যা রাতে আরো বেশি ভিজে স্নাত হয়েছিলাম।
এই মায়া দ্বীপে আরো চার পাঁচ মাস চলে যায়। এর মাঝে আমি চিনুপুদির আরো কাছে চলে আসি। ওকে একটু ভালোও বেসে ফেলি। এক পূর্ণিমা সন্ধ্যায় পুন্জের পুরোহিত কি এক মন্ত্র পড়িয়ে চিনুপুদিকে আমার হাতে সপে দেয়। এটি ওদের বিয়ের নিয়ম ছিলো কিনা জানিনা।
বন্দীদের শর্ত অনুযায়ী প্রতি মাসে মুক্ত বন্দীদের সেলুলার জেলে যেয়ে রিপোর্ট করতে হতো। এবার রিপোর্ট করতে যেয়ে জানতে পারি, গভর্নর লুই মাউন্টবাটেন যীশু খ্রিস্টের বড়ো দিন উপলক্ষে আন্দামানের কিছু বন্দীকে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি দেবে। সেই তালিকায় আমার নামও আছে। আমি খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠি। আগামীকাল সন্ধ্যায়ই মহারাজ ছেড়ে যাবে বন্দর থেকে। ঐ জাহাজে করেই চলে যেতে হবে কোলকাতা।
আমি ঐদিনই চলে আসি মায়া দ্বীপে। আজ রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ নেই। ভারত মহাসাগরের তীরে এই দ্বীপে আজ নেমেছে আঁধার। চিনুপুদি আমাকে জড়িয়ে থেকে সারারাতই কেঁদেছে। খুব ভোরে মায়া দ্বীপ থেকে ছোট নৌকায় করে পোর্ট ব্লেয়ারের সেলুলার জেলে চলে আসি। বিদায় বেলায় চিনুপুদি ওর পেটের কাছে কান পেতে আমাকে ওর বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে বলেছিল। আমি শুনেওছিলাম। আর ওর এক হাত থেকে পিতলের একটি রুলি বালা খুলে দিয়ে বলেছিল -- 'এটি আমার স্মৃতিচিহ্ন, ভুলে যাবেনা। এসো আবার। '
বিকেলে যখন সেলুলার জেলের অফিসে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সেরে বিদায় নিচ্ছিলাম, জেলার সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো -- 'এই দ্বীপের আমার সবচেয়ে বেশী কি ভালো লেগেছিলো? ' আমি উত্তরে বলেছিলাম, তিনটি জিনিস আমার ভালো লেগেছিলো -- এক. মায়া দ্বীপ, দ্বিতীয়ত: সাগরের শব্দ, আর তৃতীয় হচ্ছে, চিনুপুদি।
K.T
31/8/2017
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন