শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০২৪

মুক্তগদ্য কবিতা ( পাণ্ডুলিপি )

১.


কিছু স্বপ্ন আছে কাছে রাখতে নেই। কিছু স্বপ্ন আছে যা দেখতেও নেই। ভাবছি, এগুলো সব যমুনার জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসবো। ওগুলো জলেই ভাসুক।


২.

কিছু মানুষ আলোর মতো তীব্র হয়, স্বচ্ছ হয়, পবিত্র হয়। কিন্তু কাছে গেলে তাদের অস্বচ্ছতা ধরা পড়ে। তাই তাদের ভেতর ডুবে যেতে হয় দূর থেকে, কাছে থেকে নয়...


৩.


তুমি আমার কান্না নেবে? আমার মন বেদনার মর্মরতা নেবে, এবং মন খারাপের অশ্রু সিক্ত কমলগুলি? নাকি ভাসিয়ে দিয়ে আসব এই সব মর্মবেদনা দূরের কোনও স্তব্ধ নির্জরিনীতে? কিংবা শত প্রস্ফুটিত কোনও উৎপল দীঘিতে?

সব দুঃখ কষ্ট কী ভাসিয়ে দেওয়া যায়? সব প্রেম? ভালোবাসার মধুরতম স্মৃতি, সুখময় কোনও অভিজ্ঞান চিহ্ন? 

না, যায় না।


৪.


কুসুমপুরের মাটি

ঘেঁটু ফুল আর তারা ফুল দেখেছিলাম আমার গ্রামে। কিন্তু গাঁয়ের নামটা যে কী ভাবে হয়েছিল নওদাফুল কোচা, সে নামের ইতিহাস আমার জানা নেই। ইছামতীর একটি উপনদী বয়ে গেছে নওদাফুল কোচা গ্রামের উপর দিয়ে। একসময় সারাবছর জল থাকত এই নদীতে। এখন এই নদী পুরাটাই ফসলের ক্ষেত হয়ে গেছে।

এই এক গাঁও। যে গাঁয়ে দিনে দুপুরে ঝিঁঝিঁ পোকার গান শুনতাম। সন্ধ্যায় ৰাড়ির খোলা ভিটায় চিৎ হয়ে শুয়ে খোলা আকাশ দেখতাম। আকাশ থেকে তারা নেমে আসত চোখের তারায়। পাশের আঁড়াবনে পেঁচা ডাকত কোতঁ কোঁত করে। কামাল মুন্সী খোলা কন্ঠে এশার আযান দিত মসজিদে। মুসুল্লীরা সারি বেঁধে চলে যেত নামাজ পড়তে। 

আমার গ্রামেই আছে মাঝি বাড়ি, ঘোষ বাড়ি। আছে ছোনগাছার হাট। পুঁজার মেলা আর চৈত্র সংক্রন্তির মেলা এই হাটেই বসে। মন্দিরও আছে। ঘটা করে দূর্গা পুজা, কালি পুজা এই গ্রামেই হয়।

আছে জারুল গাছের বন। বনের মাঝখানে খেলার মাঠ আছে। মাঠের ধারে কৃষ্ণচূড়া আর শিমুল গাছ আছে। বসন্ত অনুভব করতাম এই শিমুল কৃষ্ণচূড়া ফুলের দিকে চেয়ে থেকে। সন্ধ্যার বাতাসে মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত চারদিকে। 

বাঁশ ঝাড়ের ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতাম। আবার পুকুর পাড়ে যেয়ে ঘাটে বসে জলের ভিতরে চাঁদ ভাসতে দেখতাম। চাঁদও চেয়ে দেখত আমার গ্রামকে। এই গ্রামের উপরেই নীল আকাশ আছে। সবুজ ফসলের ক্ষেত আছে। জারি গান গায় কিষাণ ফসলের মাঠে। এই গ্রামের ছেলেরাই আলোমতি গানের দল বেঁধেছিল।

আবার কিছু স্মৃতি মর্মর বেদনাও আছে। একদিন সন্ধ্যায় জানালার শিকে কপাল ঠেকিয়ে দূরের প্রান্তরের দিকে তাকিয়েছিলাম। কোথা থেকে একটি ছোট্ট হলুদ প্রজাপতি আমার হাতে এসে পড়েছিল। এই রকম সুন্দর প্রাপ্তিতে মন ভাল হওয়ার কথা কিন্তু ভালো হয় নাই। সেইদিনই পৃথিবীর চেতনা থেকে আমার বাবা মুছে গিয়েছিল।

আজ কয়েকদিন ধরে এই শহরে থেকেও আমার গ্রামের মাটির গন্ধ পাচ্ছি। মহুয়ার গন্ধের মতো পাগল হয়ে থাকে মন। কেমন যেন কুসুম কুসুম সুবাস ভেসে আসে দূর বহুদূর থেকে। এই সুবাস অন্য কোথাও নেই। আছে আমার গ্রামেই। আজ কেন জানি  আমার সেই গ্রামকে 'কুসুমপুর' নামে ডাকতে ইচ্ছা করছে।

হায়!  কবে ফিরে যাব আমার সেই কুসুমপুরের মাটিতে।
ঐ মাটিতেই যে আমার মা ঘুমিয়ে আছে।


৫.


তার সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো শিশির কনার মতো ক্ষণকালের।বহুকাল পর আবার তার সাথে দেখা হলো। এবার আমাদের সম্পর্ক সাগরের দিকে গড়াবে।



বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৪

অণু কবিতা ( পাণ্ডুলিপি )

১.


বুকের ভিতর এখনও একাত্তর জেগে ওঠে।
কোথাও এখনও অসুন্দর এবং অসুররা রয়ে গেছে।
ফয়সালা দরকার। হয় অসুররা থাকবে, 
না হয় মানুষেরা থাকবে।
বুকের নীচে আমার বিশ্বাস -
মানুষদেরই জয় হবে একদিন।


২.


যতদুরে যাও তুমি  দৃষ্টিতে তত তুমি হও সমুজ্জ্বল -
যতকাছে রবে তুমি আউট অফ ফোকাসে তত তুমি অনুজ্জ্বল...।


৩.

তোমার জন্য চোখ টলোমলো, 
কবিতার অক্ষর এলোমেলো, কলম জুড়ে প্রকাশ পেল কেবলই শোক।

আত্মার আলো নিভে গেল
প্রদীপখানি জ্বেলে ধরো, স্মৃতির সাথে কথা বলো, মৃত্যু কেবল আমারই হোক।


৪.

বিহবল হয়ে শরীর বৃত্তে যখন আবিষ্ট হয়ে থাকো 
তখন তুমি অভিমানী হও
অন্তর দুয়ার খুলে প্রগলভতায় বলো--
'আমি কী শুধু বন্ধুই তোমার?'

আমি বলি-- ওগো হতচ্ছারি, তোমার কাছেই 
যখন যা চাই তখনই তা পাই 
এমন করে অনিঃশেষ ভালোবাসা বন্ধুই দিতে পারে 
তুমিও সেইরূপ বন্ধু আমার একজন। 


৫.



আমি নামাজ পড়ি আযান শুনে যখন যেখানে থাকি
গৃহকোণে,নমসজিদে, মাঠে, নদীর কূলে জমিনের উপর,
আমি ভালোবাসি ফসলের ক্ষেত, পাখি মানুষ আর মাটি
ধর্মের নামে তোমরা অধর্ম করো না-
হাতে তুলে নিও না তুমি বোমা গ্রেনেড কিংবা চাপাতি।


৬.


কত অন্তহীন পথ হেঁটে এসে শেষে দাঁড়ালাম তোমার দ্বারে। আমি পানি চাইলাম।
তুমি দেখালে নদী। এত জল কার? এত ঝিনুক সেখানে। জলে নামতেই দেখি,  শ্যাওলা দামের ভিতরে অসংখ্য মুক্তা। 

স্রোতে ভেসে যাই। ডুবে যাই।
আমার কোথাও কূলও নাই, কিনারা নাই।


৭.


কত পথ কত প্রান্তর, কত বন্দর কত লোকালয় ঘুরেছি,
কত অন্ধকারে চোখ রেখে এতকাল যাকে খু্ঁজছিলাম  --
আর তারই কী-না দেখা পেয়ে  গেলাম  সিরাজগঞ্জের জামতৈল স্টেশনের কাছে এক নির্জন শ্রান্ত শান্ত কুটীরে।


৮.

গল্পে কেউ থাকে কেউ থাকে কবিতায়
কেউ থাকে জনম জনম কেউ হয় ক্ষণিকা 
কেউ থাকে মেঘে ঢেকে
কেউ আবার নদী হয়ে অকূলে ভেসে যায়।






শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

মুক্ত গদ্য কবিতা ( পাণ্ডুলিপি )

১.  

মনে হয়, জগতের সকল অন্ধকার দিয়ে তোমাকে আমি ঢেকে রাখি। রাখিও তাই। কিন্তু কখন যে তুমি শত সহস্র আলোকবর্তিকা হয়ে অন্ধকার ভেদ করে জ্বলে ওঠো। আর মুহূর্তেই আমার অন্ধকার ঘরটি যেন আলোয় আলোয় আলোকিত হয়ে যায়।


২.


এখনও রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে, হঠাৎ মনে পড়ে যায়, কেউ একজন আসবে বলে আর আসেনি। কেউ একজন আসবে বলে আয়োজন করেছিলাম অনেক কিছুই।  তার পুরোনো চিঠিগুলোতে আছে  অনেক কবিতা, সুন্দরতম শব্দমালা।  আছে মুগ্ধ করা অনেকগুলো মূহুর্ত। অনেক হৃৎস্পন্দনের অনুরণন…

কেমন যেন হাহাকার বুকের মাঝে।  ঠিক কষ্টেরও না, কেমন যেন। সবাইকে লুকিয়ে একলা রাতে বালিশে মুখ গুঁজে রাখতে মন চায়। হাতের সব কাজ ফেলে দিয়ে মনে হয় স্টেশনের সেই কাঠের বেঞ্চিটাতে গিয়ে বসে থাকি। মনে হয় বসন্তের ঝরে যাওয়া পাতাগুলোর উপর মর্মর আওয়াজ তুলে হাঁটতে হাঁটতে দূরে কোথাও চলে যাই।


৩.


প্রায়শই পাশে থেকে অস্ফুট আর্তি শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখি রাতভর সে নির্ঘুম। চোখে চোখ ছুঁই। কপালে কপাল রাখি। বুকে কান পেতে শুনি ভিতরের মর্মরিত কান্না। ওর ব‍্যথাগুলো নিয়ে নেবার চেষ্টা করি আমার শিরায়, আমার রক্ত কণিকায়।


৪.


সংসার ধর্ম আর ভালো লাগে না। বৈরাগ্যই শান্তি। এসো এই বসন্তেই আমরা পথে বেরিয়ে পড়ি। সামনের বসন্ত নাও পেতে পারি। বাকী জীবন পথে প্রান্তরে, আশ্রমে আর আখড়ায় কাটিয়ে দিই।

৫.


'আমি তোমার জীবনেও আছি, মরণেও আছি।'
এই কথাটি যে বার বার বলত সে আজ আর জীবনে নেই। 

মানুষ কখন যে জীবনে আসে, আর কখন চলে যায়। কেউ বলতে পারে না। যে থাকতে চেয়েছিল জীবনে, সে এখন রয়ে গেছে মনে।


৬.


নি:সঙ্গ নাভি দেখি, নিসর্গ শোভা দেখি, চুপচাপ পুষ্পবৃন্ত দেখি, তৃণভূমি দেখি । দুহাতে ধরেছি অরণ্য, মুঠোয় ভরি এর সুগন্ধ । ছিঁড়ে যাচ্ছে মায়ার টান। উল্টে যাচ্ছে যতিচিহ্ন। ঠোঁটের স্পর্শে জেগেছে প্রেম ,জ্বলছে বহ্নিশিখা। ছিনিয়ে নিচ্ছি তার শেষ আলোটুকু, নিঃশেষ হচ্ছে স্বেদ কণিকা।


৭.


আমি আমার শরীরের সকল নিয়ম কানুন মেনে চলি, তারপরও কি আমাকে যেতে হবে?
যদি অচিন কেউ এসে আমাকে নিয়ে যেতে চায়, 
যাবে কি তুমি আমার সাথে ?
সেদিন তুমি আমায় কানে কানে বলেছিলে ---
'আমার সময় হয় নাই, সময় হয় নাই।'


৮.

এই সেদিনও শীতের সকালে রোদ্র খুঁজেছিলাম-
আজকের এই তপ্ত ফাল্গুনের খাঁখাঁ দুপুরে খুঁজি শীতল ছায়া।


৯.


কাল বিকালে দোয়েল চত্বর থেকে হেঁটে হেঁটে যখন বাংলা একাডেমির দিকে আসছিলাম, ঠিক তখনই ময়ুরাক্ষী বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ঝমঝমিয়ে পড়ছিল আমার গায়ের উপর। ভিজে যাই কাকভেজার মতো। মেলায় আর প্রবেশ করা হলো না।

সন্ধ্যায় যখন উবারে করে বাড়ি ফিরছিলাম তখন ঢাকার অলিগলি রাজপথ জ‍্যাম্। গাড়ি যেন দাবার রাজার মতো স্টেলমেট হয়ে আছে। চাল দেওয়ার কোনো জায়গা নেই।

শীতে কাঁপছিলাম খুব। বুকের নীচে ভাঙ্গা হৃদয় চেপে আসছিল। হ‍্যাপি ওর বৃষ্টি ভেজা শাড়ির আঁচলখানি  চিপে জড়িয়ে ধরছিল বারবার। যেন আমার বুকে ঠান্ডা না লাগে!

কেন জানি হ‍্যাপিকে কখনও কখনও আমার মায়ের মতো মনে হয়।


১০.


একটা স্বপ্ন দেখছিলাম।
কেমন কবরের মতো একটা ঘর। শুয়ে আছি চোখ মেলে। চারদিকে অন্ধকার। হঠাৎ দেখি, কে যেন দূর থেকে আলো হাতে এগিয়ে আসছে। যখন কাছে চলে আসে দেখতে পাই, সে একটি মেয়ে। চিনবার চেষ্টা করি কিন্তু চিনতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম মায়াবতী হবে।  মেয়েটি তার হাতের আলোকবর্তিকাটি পাশে রেখে আমার বুকের উপর কপাল রেখে বলে - 'স্পর্শটুকু মনে রেখ, ভুলে যেওনা।'
স্বপ্নটা ভেঙে যায়।

১১.


আমার  চোখ সেই পথের দিকে চেয়ে থাকে, যে পথের সকল লতা গুল্ম ঘাস পায়ে মাড়িয়ে তুমি চলে গেছ।তারপর আকাশে জমেছে মেঘ, ঝরেছে জল, সব পথ কা্দাজলে ভেসে গেছে কিন্তু মেঘের নীচে সেই কাদা পথে হেঁটে কেউ আর ফিরে আসেনি । এই যে এত জল, এত মেঘ --- যে জলে ভিজে ভিজে আমি একাই হাঁটছি, আমার এই বৃষ্টি ভেজা একাকী ভালোবাসা উপভোগ করল না কেউ।


১২.



এমন রাক্ষুসে জ্যোৎস্নার আলোর ঝর্ণাধারা এ জীবনে আর আসবে না।গৃহত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হওয়ার যে ক্ষণ আমি জীবনভোর খু্ঁজেছিলাম তা আজ রাতে আমারই দুয়ারের সামনে চলে এসেছিলো।কিন্তু সংসারের মানুষগুলোর মায়ার টানে আমার সেই লালিত গৃহত্যাগ করার স্বপ্ন আজ পূরণ হলোঁ না।


১৩.


মুহূর্তেই জীবন ফুরিয়ে গেল। আজ সকালে যে রং যে আভা দেখলাম, কাল সকালে তা খু্ঁজে পাওয়া যায় না।পলকেই সবকিছু বদলে যায়। জীবন যে রেখা থেকে শুরু হয়েছিল সে রেখায় ফিরে যাবার কোনো পথ নেই। চলতে চলতে পথের মাঝেই জীবন শেষ হয়ে গেল। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে পথের শেষ প্রান্তরেখাটি দেখা যায়।


১৪.


নদী যেমন চলতে চলতে এক জায়গায় এসে থমকে সরোবর হয়, তেমনি কোনও দেবতার মঙ্গল আলোকের মতো অসীম ভালোবাসা নিয়ে সে আমার কাছে এসে সরোবর হয়েছে। যেন পলাতকা কোনও ঝর্নার জল প্রতিদিন আঁজলায় ভরি। তার মনটি আজ সকালের শিশির ঝরার মতো ঝির্ ঝির্ করে কাঁপছে। 
সবাইকে ভোরের শুভেচ্ছা।


১৫.


আমি তোমার সব দুঃখ মুছে ফেলতে চাই, কি্ন্তু কিছু দুঃখ আছে মানুষ চাইলেই মুছে ফেলতে পারে না। এই ক্ষমতাটা ঈশ্বর তার হাতে রেখে দিয়েছে। 

আমি আমার অসীম ভালোবাসা দিয়ে তোমার জীবনটাকে ভরে তুলতে চাই। এটা আমি করতে পারব, কারণ এই ক্ষমতাটা ঈশ্বরের হাতে নেই, এই ক্ষমতা আমার হাতেই আছে।


১৬.


কি করে ভুলে থাকতে পারি এই আকাশ, ধরিত্রীর উষ্ণতা, বাতাসের সতেজতা, জলের ঝিকিমিকি। এই ধরিত্রীর প্রতিটি অংশই আমার কাছে সৌন্দর্যের --- পাইন গাছের  চকচকে ডগা, বালুকাময় সমুদ্রতট, অন্ধকার বনভূমিতে জমে থাকা কুয়াশা, আদিগন্ত ফসলের প্রান্তর, প্রতিটি পতঙ্গ, ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা  ঝিলিমিলি বাতাস,  অশোকের গাছ থেকে ঝরে পড়া পাতার শব্দ। এই সবই দেখার জন্য আমাকে ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে যায়।





১৭.

ঘর হতে বেরিয়ে আলোতে এসে দাঁড়াই। বাইরে এত আলোর ছ্বটা। ঝলমল করছে বৃক্ষরাজি, অ্ট্টালিকা, পশু, পাখী, পাহাড়, নদী, সাগর। মনে হচ্ছে এই আলো মেখে পরিপূর্ণ করি জীবন। আমাদের স্বপ্ন দেখা শেষ হয় নাই, জীবন পরিপূর্ণ হয় নাই। আমার সাথে তো একজন সাথী আছে, সে এখনও আমার হাত ধরে আছে। যে আলো আজ দেখছি সে আলোয় দু'জনে মিলে পথ চলে যেতে পারব অনেক দূর। জীবন কোথাও শেষ করতে চাই না। পথ চলাও না। এই জীবন, 'এই পথ চলা যেন কোনো দিন শেষ না হয়।'


১৮.


আমার দায়ভার যখন শেষ হবে, তখন অপেক্ষাই বা কেন করব? সেই উদ্দাম, আনন্দময় জীবন যদি আর নাই থাকে, অক্ষম আর বোঝা হয়ে থাকা এই সুন্দর পৃথিবীর কাছে গ্লানিকর। সব সু্ন্দর শেষ হবার সন্ধিক্ষণেই ঘরের জানালা দরজা সব খুলে রাখতে চাই। আত্মার প্রস্থানের সাথে মানুষের সকল দুঃখের নাকি পরিসমাপ্তি ঘটে। পৃথিবী থেকে চলে যাবার আনন্দটাই তখন অন্যরকম হয় ।


১৯.


সৃষ্টিকর্তা পরম যত্ন সহকারে আমাকে অতি ক্ষুদ্র সময়ের জন্য একটি জীবন দিয়েছে। সেই জীবনে তুমিই আমার একমাত্র সহচরী হলে। যার এলমেল চুলে মুখ লুকিয়ে নিঃশ্বাস নেই প্রাণ ভরে। যার বুকের পাঁজরে লেগে থাকে মহাকালের যত সুখ দুঃখ।  আমি তার কাছ থেকেই চলে  যেতে চাই জীবন নদীর ওপারে -- তাকেই ভালো বাসতে বাসতে।


২০.


যদি কোনো দিন পূর্ণিমা রাতে তুমি আর না থাকো, যদি আঁধার এসে ঘিরে ধরে আমাকে, 
'হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে' আমাকে তখন কে আর ভালবাসবে?


২১.


মাঝে মাঝে শব্দহীন কোনো জগতে চলে যেতে ইচ্ছা করে। যেখানে মেঘের শব্দ নেই, ঝিঁঝি পোকাদের গান নেই, নদীর জলের ছলাৎছল শব্দ নেই, মানুষের কোলাহল নেই, নেই কোনো বঞ্চনার মর্মরধ্বনি। আছে কী সত্যিই এমন কোনো জগৎ?

বড়ই ক্লান্ত হয়ে সেই পথ ও সেই নিঃশব্দলোকের ঠিকানা খুঁজছি।


২২.


আমার জন্ম যদি ফকির লালন শাহ্ এর সময়কালে হতো, তহলে আমি লালনের শিষ্য হতাম। লালনের আখড়ায় যেতাম, গাঁজা টানতাম। গান করতাম। সংসার বৈরাগী হয়ে  ঘরহীন জীবন যাপন করতাম। আহা! কী সুখ-ই-না পেতাম লালনীয় জীবন যাপনে !


২৩.



ভালোবাসায় অনিমেষ আর মাধবীলতা হতে হয়। দুজনেরই আরাধ্য ছিল একজন আরেকজনকে কাছে পাওয়া। পেয়েওছিল তারা। এর জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছিল তাদের। আসলে প্রেম এই রকমই হওয়া দরকার। একে অপরের বুক থেকে খুঁটে খুঁটে তুলে নিতে হয় আবেগ। আজন্ম ছিনিয়ে আনতে হয় কুসুমিত ভালোবাসা।



২৪.


মৃত্যুর জন্য কোন্ সময়টা শ্রেষ্ঠ সময় ? আমার কাছে সুবেহ্ সাদিক! একটা সময় আসবে আমি মরণেও থাকব না, জীবনেও থাকব না। ঐ মৃত্যু সন্ধিক্ষন সময়টুকুতে আমার স্ত্রী-সন্তানেরা আমার শয্যাপাশে বসা থাকবে। আমার নিষ্করুণ চোখ ওদেরকে  দেখতে দেখতে বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর আমার আত্মা বেরিয়ে যাবে। দূরে মসজিদগুলোতে তখন ফজরের আযান ধ্বনিত হতে থাকবে।


২৫.


জীবন কাটে না এ জীবনে আর, জীবন ভরেও না এক জীবনে। একি তৃষ্ণা আমার । একি ক্লান্তি নিয়ে বসে থাকি। অনেক কাছে থেকে দেখি অনেক দূরের আশার বিন্দু! আজ দক্ষিণের দুয়ার খোলা আছে। আসুক বাতাস আজ দক্ষিণ থেকেই।


২৬.      রক্তকরবী

আজ এই রাতে ঢাকার আকাশে মেঘ নেই। পশ্চিম দিকে রাস্তার উপর গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কুসুমপুরের মতো কোনও নিশাচর পাখিকে উড়ে যেতে দেখলাম না আলো অন্ধকারে। এই নিয়নের আলোর দেশে কোনও পাখির দেখা কী মেলে? তা না মিলুক। সামান‍্য পাখির জন্য মন খারাপ হয় নাকি কারোর?

ইউটিউবে শচীন দেব বর্মনের গান শুনছিলাম। 
'বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছো দোলা,/ রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে 
একি তব হরি খেলা,/ তুমি যে ফাগুন রঙেরও আগুন তুমি যে রসেরও ধারা, /তোমার মাধুরী তোমার মদিরা করে মোরে দিশাহারা।'

আমি কী করতে পারি? উদাস মন হলে হাত পা অবশ হয়ে আসে। যা করতে চাই, তা করতে পারি না। কিছু না করি সেও কম ভালো, বেশি যেন না ভাবি। ভালোলাগা বেঁচে থাক আমার রাতের সঙ্গে। এও এক অবুঝ অবোধ সঙ্গ।

গান শোনা বন্ধ হয়ে গেছে। যদি মেঘ হতো তাহলে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে আসত। এই ফাগুন ঋতু জানান দেয়, বৃষ্টি হতেও পারে। বারান্দায় হেঁটে হেঁটে ওপাশে চলে যাই। আকাশ দেখে ফিরে আসি আবার। আমি কী পেয়ে গেছিলাম নিরক্ষর চিরচেনা কোনো ফুলের গন্ধ?

তুমি কী উদ্বেলিত! আমি চন্দন যোগার করেছি ভালোবাসার জন্য। আমি গন্ধ বিলাব রাত্রি সহচরী রমণীর বুকে। পাখি হয়ে রোজ আকাশে উড়তে চাই। যেমন করে কোনো একলা যুবক অন্ধকারে ভালবেসে ভেসে যায়।

আমি নিমগ্নতা চাই। একজন রমণী এ ঘর ও ঘর হাঁটবে আমার সুখে সুখে। সে আনন্দ করুক রাতে ফুটে থাকা কোনো রক্ত করবীর মতো। সে যে নন্দিনী হবে আজ রাত্রিতে এই রঞ্জনের।


২৭.        সেই ঝড়ের রাতে


ধূলো ঝর আজ এই শহরে,
উদ্বাহু বাতাস আসছে তুরাগের তীর থেকে-
সেই শৈশবে একবার ঝড়ে পড়েছিলাম এক সন্ধ্যায়-
শৈলাভিটা নদীর খেয়াঘাটে- 
বাবা তার পাঞ্জাবীর নীচে আমার মাথা ঢেকে রেখেছিল
কি আপ্রাণ প্রচেষ্টা তার জল ঠেকাতে !
,তারপরেও বাবার কন্ঠ বেয়ে
বুক গরিয়ে বৃষ্টির জলে ভিজে চুপসে গিয়েছিল
আমার মাথার চুল- বাড়ীতে যেয়ে দেখি-
লন্ঠণ জ্বালিয়ে নামাজ পড়ছেন মা।

মা সেই ঝড়ের রাতে নিশ্চয়ই আমার জন্য
আর বাবার জন্যে মঙ্গল প্রার্থনা করেছিলেন।


২৮.          পরজনম


যেদিন আকুল হয়ে বইবে বসন্ত বাতাস, যেদিন সবুজ বৃক্ষরাজির পল্লব ঝিরি ঝিরি করে দুলে উঠবে, যেদিন পূর্ণিমা রাতের ধূসর ছায়া পড়বে পদ্মপুকুর জলে ---
সেদিন সেই দিনে, সেই রাত্রিতে আমি আসব তোমার কাছে, হাজার বছরের অন্ধকার রাত্রির পর হলেও আমি আসব।


২৯.


আমার নিজের ভিতরেই এক মহাবিশ্ব আছে। আর সেই মহাবিশ্বের নির্জন গভীরে মগ্নচারী হতে চাই। সেখানেই খুঁজব অনন্ত সুখ, সেখানেই হয়ত পাব এক আনন্দময় স্থিতি। 


৩০.


আমার আছে ল্যাপটপ, কীবোর্ড, দুটো চোখ, আঙুল। 
আছে ভাঁটফুল, আমি নিঃসঙ্গ হই নাই। সময় বহিয়া যাবে।


৩১.


তার প্রাণের কথা, মায়াবী কাজল চোখ , বহুদিনের চেনা গন্ধ, বালিশে লেগে থাকা সুগন্ধি, গল্প বলা অজস্র রাত্রি, অস্পষ্ট করে  মনে পড়া কত ডাক নাম -- আরও কত কিছু আষ্টেপৃষ্টে করে মনে জাগে , কত ভাবে যে প্রাণে জড়াতে চায় সারাক্ষণ -- 
'দেহমনের সুদূর পারে  হারিয়ে ফেলি আপনারে,
গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে।' 

সবই তোমার মায়ার টানে ......


৩২.

প্রেমে পড়া কাকে বলে?  এই যে আৃমি-
এই শহরটাকে ভালোবেসে পৃথিবীর অন্য কোনো  ঝলমলে শহরে থিতু হইনি, 
সন্ধ্যাবেলা বের হলে কোনো না কোনো বাড়ি হতে ধুপের গন্ধ পাই,
কবরস্থানে দাঁড়িয়ে নীল আকাশ যেমন দেখি
আবার বুড়িগঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখি বিকালের বিষণ্ণ সূর্যাস্ত, 
রেল স্টেশনে থেমে থাকা ট্রেনের জানালা দিয়ে কেউ না কেউ অপলক চেয়ে থাকে,
সকাল বেলা হাঁটতে গিয়ে সিভিল অ্যাভিয়েশনের বড়ো পুকুরটাতে কস্তরি ফুল ফুটে থাকতে দেখি -
বাঁশঝাড়ের তলায় যত নিঃশব্দেই হাঁটি না কেন, শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি শুনতে পাই,
বাড়ির সম্নূখে পিচঢালা রাস্তাটাতে হাঁটার সময় মনে পড়ে এখানে আগে মেঠোপথ ছিল,
প্রাইমারি স্কুলে নতুনকুঁড়িরা যখন হেঁটে যায়, তখন মনে পড়ে আমার কৈশোর কথা! 

আমি এইসবের  প্রেমে পড়ি, এইসব কী প্রেম নয়?


৩৩.

আমার সমস্ত তৃপ্তি অতৃপ্তি, আমার প্রেম অপ্রেম, অপূর্ণ সুখ, আমার তৃষ্ণা, আমার  সমস্ত উম্মাদনা তোমাকে ঘিরে। তুমি আমার চৈতন্যে অবচৈতন‍্যে। তোমাকে ছেড়ে আমি খুব বেশি দূরে কখনই যাব না।


৩৪.


জীবনের এই পথ চলতে কত বাঁক যে পেরুতে হয়। এক বাঁকে সুখ, আরেক বাঁকে দুঃখ। এক বাঁকে প্রেম, অন‍্য আরেক বাঁকে বিচ্ছেদ। বাঁকে বাঁকে কতো ব‍্যর্থতা, কতো গ্লানি, কত যে দীর্ঘশ্বাস।

কত ঘাত পেরিয়েই তবে এই জীবন। তবুও জীবনের জন্য কত মায়া, কত প্রবল আকুতি বেঁচে থাকার! এই পৃথিবীর ধূলোর উপরে পড়ে থাকবার কত যে প্রচেষ্টা।

অস্তাচলের শেষ আলোর উপর কোনও ধূসর ছায়া পড়ুক, তা চাই না। তারপরও আবছায়া এসে পড়ে অস্তযাত্রার পথের উপর। আমার যে পথ চলতে ইচ্ছে করে  ঐ অস্তাচলের আঁধারের দিকেই।


৩৫.


ক্লান্তির শেষে, ধূসর এই সন্ধ্যার গোধূলির উপর পড়ে থাকা অকৃপণ আলো সব… আমাদের  হোক। আমাদের  হোক।


৩৬.


এইসব অন্ধকার দিন, এইসব নিবিড়  তিমির রাত্রি  পেরিয়ে একদিন ঠিক দেখা হবে চাঁপাগন্ধ কোনো বসন্ত দিনে। তখনই খোঁপায় বেঁধে দেব নিশি চন্দন। সেই অপার্থিব সাক্ষাৎ মূহুর্তে আমি স্থানু হয়ে গ্রহণ করব পার্থিব যত সুখ.....


৩৭.


অস্তরাগের সন্ধ্যায় তুমি এসো-
ধান ধূপে জ্বলবে প্রদীপ, জ্বলবে তারার বাতি
তারপর দোঁহা জ্বলব রাত ভর
কেউ নেভাতে আসবে না, ছাই ভস্ম হবো বর্বর আদি অনলে।





শনিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২৪

গীতসুধারসে এসো ( পাণ্ডুলিপি )

২১.        গীতসুধারসে এসো



একদিন আমার হোয়াটসঅ্যাপে একটি ম্যাসেজ আসে। ম্যাসেজটি ছিল একটি মেয়ের। মেয়েটি লিখেছে -- "আমার নাম কঙ্কণা। কেউ কেউ আমাকে কঙ্কণ ও কঙ্কা বলে ডাকে। একজনই শুধু আমাকে কঙ্কাবতী বলে ডাকতো সে কোন্ জন তা পরে একদিন আপনাকে বলব।

তার আগে বলে নেই, আপনি আমাকে চেনেন না। কোনোদিন দেখেননিও। আমিও আপনাকে দেখেনি। ফেসবুকে আপনার লেখা আমি পড়ি। আপনি অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প লিখেন, আমি আপনার একজন মুগ্ধ পাঠিকা। আপনার অনেক গল্প আমি বহুবার পড়েছি। কত গল্পে আপনি যে আমাকে কাঁদিয়েছেন। সে কান্নার কথা কেউ জানেনা। আপনিও না।

আপনার গল্প পড়ে পড়ে মনে হয়েছে আমার কিছু কথা আপনাকে বলব। আমার জীবনের কিছু কথা আপনার গল্প হয়ে থাক্। আমি গল্পকার নই, নই কথাকারও। আপনার মতো করে গুছিয়ে আমি লিখতে পারব না আমার কথা। তাই আপনার কাছে এই লেখা, আমার এই নিবেদন।... "

আমি কঙ্কণাকে উত্তরে লিখলাম -- আমার কাজই তো মানুষের জীবন কাহিনি নিয়ে গল্প কিংবা উপন্যাস লেখা। আপনি বলতে পারেন দ্বিধাহীন ভাবে সব কথা। আমি আপনার জীবন কথা নিয়ে লিখব গল্পকথা।

কঙ্কণা লিখল -- " আমি হয়ত সব কথা একদিনে একই সময়ে লিখতে পারব না। দু একদিন পরপর বলব। আর আপনি যেন বিরক্ত না হন।... "

আমি বললাম -- আপনি যে রূপ মনে করেন, যেভাবে বলতে চান, সেইভাবেই লিখবেন। আর আমি লিখব আপনার কথা গল্পের মতো করে। সত্য বললে সত্য কথাই লিখব, মিথ্যা বললে মিথ্যা কথাই লিখব।

আমি কঙ্কণাকে আরও বললাম -- সবচেয়ে ভালো হয়, আপনি আপনার কথাগুলো এখানে লিখে রাখবেন আপনার সুবিধা মতো সময়ে। আর আমি আমার সুবিধা মতো সময়ে আপনার কথাগুলো পড়ে গল্পের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করব।

কঙ্কণা লিখল -- আচ্ছা, তাই হবে। তবে একটা ব্যাপারে আমাকে মার্জনা করবেন তাহলো -- আমার প্রকৃত পরিচয়টি আমি ইচ্ছা করে গোপন রাখছি আপনার কাছে। যদি কখনও মনে হয় আমার প্রকৃত পরিচয় আপনাকে বলা দরকার, -- তখন বলব আমার পরিচয়। আপনি যেন তার আগে জানতে না চান আমার পরিচয় । তাহলে আমি খুব বিব্রত হবো।

আমি কঙ্কণাকে বললাম -- তাই হবে। আপনি আমার কাছে শুধু কঙ্কণা। কঙ্কণ, কঙ্কা কিংবা কঙ্কাবতীও নন্। আমি আপনাকে আমার গল্প লেখা পর্যন্ত কঙ্কণা বলেই ডাকব, কঙ্কণা বলেই জানব। আপনার কথা বলা যেদিন শেষ হবে, আর আপনার কথাগুলো নিয়ে আমার গল্প লেখাও যেদিন সমাপ্ত হবে , সেদিন থেকে এই নাম, এই কঙ্কণা উপাখ্যানও আমার কাছে শেষ হয়ে যাবে। আপনি হারিয়ে যাবেন আপনার পৃথিবীর কোনো জনারণ্যে। আর আমি হারিয়ে থাকব, অন্য কোনো এক কঙ্কণার জীবন কাহিনি নিয়ে গল্প লেখার জগতে। আপনার সাথে এই কথকতা, রাত জেগে আপনার এই কথা শোনা, আর আপনাকে নিয়ে এই গল্প লেখারও পরিসমাপ্তি ঘটবে।

কঙ্কণা লেখে -- এমন করে বলবেন না। খুব কোমল প্রাণের মেয়ে আমি। কোনো কিছুতে একটুতেই আমার কান্না পায়।

আমি বললাম -- ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করব আমার কোনো আচরণে আপনাকে যেন কাঁদতে না হয়। তো, শুরু করুন আপনার জীবন কাহিনি বলা...।

কঙ্কণা লিখল -- ঠিক আছে, আমি লিখে রাখব আমার কথা এখানে। তবে জীবনের সব কথা তো লেখা সম্ভব না। আমি লিখে রাখব জীবনের কিছু খণ্ডিত অধ্যায়ের কথা। কিছু সুখ দুঃখের কথা, কিছু বঞ্চনা ও আক্ষেপের কথা।...

কঙ্কণার সাথে সেদিনের মতো ম্যাসেজিং শেষ হয়।

একদিন দেখি -- কঙ্কণা ওর কিছু কথা লিখে রেখেছে। অনেকটা পয়েন্ট আউট করে লিখেছে। কথাগুলো এলোমেলো ও অগোছালোও। অনেক কথার ইঙ্গিত আছে, কিন্তু বর্ণনা নেই। সংলাপগুলোও কেমন ভাঙা ভাঙা।

আমি কঙ্কণার সেদিনের কথাগুলো গুছিয়ে গল্পের মতো করে এখানে লিখলাম। কঙ্কণা যা লিখেছে সব ঠিক আছে। শুধু প্রকৃতি, নিসর্গ, মানুষ, স্থান, কাল, পাত্র একটু হেরফের করা হয়েছে। কঙ্কণা যা লিখেছে ঠিক তেমনটি নয়। আমার ধারণা কঙ্কণাও ইচ্চাকৃতভাবে অনেক কথা আড়াল বা গোপন করার চেষ্টা করেছে। আমি কেবল কঙ্কণার কথাগুলো, উত্তম পুরুষে কঙ্কণার হয়ে এখনে লিখলাম।

২.

মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়ের কোল থেকে ধিতাং ধিতাং বালিকার মতো এঁকেবেঁকে একটি নদী চলে এসেছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের দিকে। ওপারে ওর যেই নামই থাক, এপারে এই নদীটির নাম কর্ণঝরা। কর্ণঝরার আরও কতগুলো বোন আছে, যারা একই মায়ের গর্ভে জন্ম। ওদের মা'ও খাসিয়া পাহাড়। এই খাসিয়ার অন্য মেয়েরা হচ্ছে ভোগাই, কংস ও সোমেশ্বরী।

খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া থেকে মেঘ বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ে কত ঝর্ণা যে নদী হয়েছে। পাথর, বালু,মাটি, বৃক্ষ, লতাগুল্ম চিরে চিরে বয়ে এসেছে তারা সমতলের দিকে। কত হাজার বছর ধরে চলে এসেছে এই স্রোতধারা, কে তার কতটুকু জানে। এরই একটি ধারা কর্ণঝরা। এই কর্ণঝরা নদীর তীরে ছবির মতো একটি গ্রাম নাম তার হাঁসুলিগাঁও।

আমি সেই হাঁসলিগাঁওয়ের মেয়ে কঙ্কণা।

আমাদের বাবা চাচা'রা ছিলেন বিত্তবান কৃষক পরিবারের মানুষ। গোলাভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছ ছিল আামাদের। আমাদের বাড়ি ছিল ফুলে ফলে বৃক্ষ শোভিত। ছিল নানা জাতের ঔষধি গাছও। বাড়ির সামনে পুকুর। পুকুরের পর শস্য ক্ষেত। তারপর কর্ণঝরা নদী।

এই নদীর পারে আমি বেড়ে উঠতে লাগলাম। বালিকা এখানে গোল্লাছুট খেলতো। মাথার দু'বেণী দুলিয়ে এক্কা দোক্কা খেলতো। আমগাছের পাতা আর বাঁশ ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে আসা পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সন্ধ্যা রাত্রিতে 'পলাতকা' খেলা খেলতো খেলার সাথীদের সাথে। খেলতে খেলতে একদিন বালিকা তরুণী হয়ে উঠল।

আমাদের বাড়ির উঠোনের একপাশে ছিল ফুলের বাগান। ওখানে ছিল বিভিন্ন রকমের ফুল। জুঁই, কনকচাঁপা, রক্তজবা, কামিনী, গাঁদা, বেলী, গন্ধরাজ, সন্ধ্যা মালতী ও রংবেরঙের পাতাবাহার। লোকে বলত কঙ্কণা নাকি ঐ বাগানের একটি ফুল। কেউ বলত আমি নাকি কনকচাঁপার মতো দিনে দিনে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছি। কেউ বলত কঙ্কণা একদম রক্তজবার মতো রক্তিম। কেউ বলত সন্ধ্যামণির মতো সুবাসিত।

পড়তাম গ্রামের স্কুলে। কোনো বালিকা বিদ্যালয় তখন ছিল না ওখানে। আমাদের স্কুলে ছেলেমেয়ে একসাথে পড়াশোনা করত। তবে নিয়ম ছিল কঠিন। মেয়েরা কথা বলতে পারত না ছেলেদের সাথে। কমনরুম থেকে স্যারদের পিছে পিছে ক্লাসে যেতাম। ক্লাস শেষে আবার কমনরুমে ফিরে আসতাম। কোনো ছেলের সাথে কথা বললে অভিভাবকদের জানিয়ে দেওয়া হতো। স্কুল থেকে বের করে দেওয়ারও নিয়ম ছিল। তাই কারোর সাথে কথা বলার সাহস করতাম না আমি।

আমি যখন ক্লাস নাইনে উঠি তখন আমাদের ক্লাসে একজন নতুন ছাত্র এসে ভর্তি হয়। নাম মাইনুল ইসলাম। ছেলেটি দূর গ্রামের। ওর বাবা একজন গরীব দিনমজুর। প্রায় তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে এসে সে ক্লাস করত। ছেলেটি ছিল মেধাবী। ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছে। ছেলেটির গায়ের রং শ্যাম বর্ণ। চুল কোঁকড়ানো। লিকলিকে লম্বা ধরনের। চোখ দুটো মায়াময়। কেন জানি দূর থেকে দেখে ছেলেটিকে আমার খুব ভালো লাগল।

আমি ক্লাসে বসে ছেলেটিকে চুপিচুপি খুঁজতাম কোথায় কোন্ বেঞ্চে বসে আছে। হয়ত দেখতে পেতাম কোনো কোনো দিন। আবার দেখা পেতাম না কোনো দিন। যেদিন দেখতে পেতাম না সেদিন খুব মন খারাপ করে বাড়ি চলে আসতাম। পথে আসতে আসতে পা চলত না, পা অবশ হয়ে থেমে যেত পথের উপরে। মনে হতো, আহা! ঐ ছেলেটি এসে যদি আমার সাথে পায়ে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটত, তবে পথের উপর এমন করে পা আমার থেমে যেত না।

বাড়িতে খুব মনমরা হয়ে থাকতাম। কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করত না। মা জিজ্ঞাসা করত -- কঙ্কণ, তোমার কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগে? '
আমি বলতাম -- না মা, কিছু হয়নি আমার।

আমি যে ঘরে শুতাম, ঠিক আমার বিছানার পূর্ব দিকে একটি জানালা আছে। জানালার একপাশে লাগোয়া পড়ার টেবিল। আমি একদিন সন্ধ্যা রাতে হেরিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসেছি। পড়ার মন বসছিল না! জানালাটা খুলে দেই। দেখি - বাইরে আলো আর অন্ধকার একসাথে মিশে আছে। আঁধারের মাঝে যে আলো তা ছিল চাঁদের আলো। রাতের আকাশ যেন ছুঁয়ে আছে নিঃশব্দে আকন্দ গাছের ঝাড় পাতায়। জ্যোৎস্নার এই চন্দনমাখা স্বর্গীয় ক্ষণে চোখ মেলে অনেক দূরে আবছা আবছা দেখতে পেলাম ঐ ছেলের মুখ, রাতের তারার মতো চেয়ে আছে যেন আমারই দিকে। এই বিরাট আলো আঁধারের বিশ্বজগতে কতকিছুই অদৃশ্যমান, কত প্রাপ্তিতা অপ্রাপ্তি হয়ে হারিয়ে যায়। একজন অবুঝ তরুণী কোন্ অসতর্ক মুহূর্তে কী চেয়ে বসল বিধাতার কাছে, তা কী বিধাতা আমার করে দেবে?

দূরে কর্ণঝরা নদী থেকে বয়ে আসছিল শীতল বাতাস, জানালা দিয়ে প্রবেশ করছিল কাঁচা দুধের মতো ফিনকি দিয়ে জোছনা। কাউকে দু'কলম লিখতে ইচ্ছে করছিল খুব। কোনো কবিতা বা গানের পংক্তি নয়, ছোট্ট একটি চিঠি লিখতে ইচ্ছে করছে। ভাবছিলাম, একটি চিঠি লিখে রাখি কাছে। বইয়ের পাতায় সেই চিঠি গোপনে রেখে দেব। যদি কখনও সুযোগ আসে চিঠিখানি দিয়ে দেব ঐ ছেলেকে।

কল্যাণীয়ষু

খুব ভালো লাগে তোমাকে। এত ভালো লাগে যে, জনম জনম তোমাকে কাছে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছা করে। তুমি এসো গো আমার জীবনে। 'প্রাণের হিল্লোলে এসো'। জনম জনমকাল ধরে অপেক্ষা করব।

-- কঙ্কণা।

হেরিকেনের পুষ্পিত আলোয় কী লিখলাম! অক্ষরগুলোর গায়ে লেগে আছে যেন কনকচাঁপার পুষ্পবর্ণাভা। বাইরে তখন চাঁদ ডুবছে নিভছে। চরাচর জুড়ে বিষণ্ণ আঁধার আর ম্লান আলো। আকাশের তারা'রা জ্বলছে নিভছে। কর্ণঝরা নদী থেকে বয়ে আসা শীতল বাতাস হঠাৎ থমকে গেল যেন । কুমারী মেয়ের কুন্তলের মতো নৈঃশব্দ্য এসে ঘরটি ভরে গেল। বুকের তলায় দীর্ঘশ্বাস জট পেকে ধরল। আকাশে কোথাও আর দেখতে পেলাম না মণিনীল নক্ষত্র।

৩.

ছেলেটি অপার্থিব মাধুর্যের রূপ ধারণ করে ক্ষণে ক্ষণে ছায়ামূর্তি হয়ে আমার চোখের সামনে এসে ভাসতে থাকে। কখনও সন্ধ্যার আকাশের অপরূপ শোভায়, কিংবা কখনও দূরের খাসিয়া পাহাড়ের ধূসর মেঘের ছায়ায়, কর্ণঝরা নদীর কুলকুল কলতানের মধ্যে -- ওর অস্তিত্ব অনুভব করতে থাকি। মনে হয়, অনেক দূর থেকে সুর ভৈরবীর তানে হেঁটে হেঁটে সে আমার দিকে আসছে। আমি কান পেতে ওর আগমনের পদধ্বনি শুনছি। আমার অবুঝ অবলা মন কেন যে ওর মাঝে থিতু হলো, কী এমন ঐশ্বর্য দেখতে পেয়েছিলাম, যা আমি চাইলাম এমন আকুল করে।

মাইনুল ছিল পল্লী গ্রাম-নিবিড়ের প্রস্ফুট বন-কুসুম-গন্ধ ছড়ানো একটি সহজ সরল তরুণ। তাই তো ওকে আমি এমন পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলাম

আমার লেখা চিঠিখানি ভূগোল বইয়ের পাতায় পুরনো হয়ে পড়ে থাকে প্রায় দেড় দু'বছর। এতদিনেও মাইনুলকে চিঠিটি দেওয়া সম্ভব হয়নি। মাঝের সময়ে টুকটাক ওর সাথে যদিও কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে স্কুলের বারান্দায় কিংবা পথের উপরে। কিন্তু চিঠিটি ওকে দিতে পারিনি। আমার ভালোলাগার কথাও বলার সুযোগ হয়নি কখনও। সবসময় কেউ না কেউ আমাদের কাছাকাছি থেকেছে।

কেমন করে কখন স্কুল জীবনের এতগুলো দিন চলে গেল! কত বিরহে কত অপেক্ষায় সময় করেছি পার। মাঝে মাঝে অজানা আশঙ্কায় মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠত। ভাবতাম -- যা চাইছি তা পাব তো?

একসময় আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসে। ক্লাসও বন্ধ হয়ে যায়। স্কুল থেকে আমাদের ফেয়ারওয়েল দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সেই বিদায় অনুষ্ঠানে ছাত্র- ছাত্রীদের পক্ষ থেকে মায়নুল খুব সুন্দর বক্তৃতা দিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে বিদায়ী সহপাঠীদের সাথে আমাদের একে অপরের কথা বলার সুযোগ হয়। কথা বলি আমি মাইনুলের সাথেও --

-- পাস করার পর তুমি কোথায় ভর্তি হবে?
-- জানি না কোথায় ভর্তি হবো। পড়ার আর ভাগ্য হবে কী না তাও জানি না।
-- পড়া থামিয়ে রেখ না।
-- তুমি কোথায় ভর্তি হবে?
-- ময়মনসিংহ।
-- আচ্ছা। ভালো ভাবে লেখা পড়া করবে। ভালো থেকো। তো যাই এখন।

মাইনুল খুব তাড়াহুরো করছিল, অস্বস্তি ও বিব্রতও হচ্ছিল লজ্জায়। আমি আস্তে করে ওকে বলি -- 'যেওনা তুমি। একটু দাঁড়াও।' আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যাগ থেকে দু'বছর আগের লেখা সেই পুরনো চিঠিটি বের করে ওর হাতে দেই এবং বলি -- বাড়িতে যেয়ে এটি পড়বে।

বাড়িতে যেয়ে মায়নুল চিরকুটটি পড়েছিল হয়ত কোনো প্রদীপ জ্বালা সন্ধ্যার আলোয়। হয়ত পুলকিত হয়ে উঠেছিল আমার মতো একজন প্রস্ফুটিত রক্ত জবার উন্মত্ত ভালোবাসার এমন নিবেদন দেখে! একটি মেয়ের এমন প্রাণ হিল্লোল দেখে, এমন দ্যুতি ছড়ানো অরুণ আলো!

তারপর কর্ণঝরা নদীর জল গড়েছে ব্রহ্মপুত্র নদীর দিকে। কত বাঁকে স্রোত হয়েছে ধীর, খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড় থেকে বয়ে এসেছে কত হিমেল বাতাস, আমি ওকে পেয়েছিলাম আমার জীবনের সকল গ্লানি ও যাতনাকে হারিয়ে দিয়ে। সে যে সত্যি এসেছিল প্রাণের হিল্লোলে। সেই তরুণী বয়সের সপ্তরঙের রঙধনুর মতো অতীত দিনের কত কথা মনে পড়ে আমার। কত কম্পিত প্রেম দান। কেন যে মাইনুলের উপর মাঝে মাঝে এতটা নিষ্ঠুর আচরণ করতাম। সেসবের জন্য অনুশোচনাও করি। কত কথা মনে পড়ে, কত বেদনায়, কত দীর্ঘশ্বাসে চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু জল ঝরে পড়ে।

মাইনুলের সাথে আমার জীবনের প্রকৃত ঘটনাটা আমি ব্লাক আউট করলাম। মানুষের জীবনের কিছু অন্ধকার পর্যায় থাকে, সেই অন্ধকারের কথা একান্তই তার একার। সেই অন্ধকারের কথা কাউকে বলা যায় না। তারপরও যদি সম্ভব হয় আমি বলব সেই আঁধারের কথা।

শুধু এইটুকু বলছি -- আমার সেই অল্প বয়সের কুমারী জীবনের পূর্ণচ্ছেদ পড়েছে অনেকদিন আগেই। তবু সে-সব দিনের কিছু আনন্দ বেদনার মুহূর্তগুলোর জন্যে এখনও মাঝে মাঝে মন কেমন করে ওঠে। সেই সারল্যমুখর স্মিত মুখ, সেই পূর্ণিমা ঝালরের আলো মাখা স্বর্গীয় রাতের বিমুগ্ধ ক্ষণ, হারানো সেই সুখস্মৃতির জন্যে আক্ষেপ করি। শুধু ভাবি, যা পেয়েছিলাম তা সত্যি করেই পেয়েছিলাম। মানুষ অনেক কিছুই পায়, তা আবার ফুরিয়েও যায়। শূন্য হয়ে গেলে আবার পাওয়ার আশায় পথে নামে। কোনো অচেনা পথিক অকাতরে কিছু দেওয়ার জন্য হয়ত দাঁড়িয়ে পথের উপর আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

এখন শুরু করব আমার ইউনিভার্সিটি জীবনের কথা। 'পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি' র মতো কেউ কী আমার সেই জীবনে প্রাণের হিল্লোল তুলে এসেছিল? আবার কী ভেঙেচুরে রক্তক্ষরণ হয়েছিল আমার হৃদয় মন?

৪.

কর্ণঝরা নদীর স্বচ্ছ জলের উপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে আমি এসে পড়েছিলাম আরেক রূপবতী নদী ব্রহ্মপুত্রের উদ্দাম বুকে। নাহ্, ঠিক জলে নয়। এর কূলে একটি শহরে। জীবনের যত ঝড় ঝাপটা এর কূল দিয়েই বয়ে গেল আমার। গ্রামের একটি লাস্যময়ী তরুণীর জীবন হঠাৎ কঠিন দুর্মর ব্যাথা বেদনার ভরে উঠল। এক করুণ কাব্য গাঁথা রচিত হলো এই শহরে।

ময়মনসিংহের সরকারী মমিনুন্নিসা মহিলা কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। থাকতাম ছাত্রী হোস্টেলে। সারা শরীরে তখনও গ্রামের রোদ্র তাপের তামাটে দাগ। ভেজা চুল থেকে গন্ধ বের হতো কর্ণঝরার জলের। বেণীর ভিতর থেকে খুঁজে পাওয়া যেত হাঁসুলীগাঁওয়ের বন মল্লিকার শুকনো পাপড়ি।

এখানে এসে পড়াশোনা করছিলাম ভালোই। ইন্টারমিডিয়েট পাস করি ভালো রেজাল্ট নিয়ে। আর এখানেই কী না ঘটে গেল আমার জীবনের এক কলুষিত ঘটনা। কলুষিত হলো ব্রহ্মপুত্রের জল। আমার এই জীবন ব্যথার মর্মর কথা জেনেছিল ব্রহ্মপুত্র নদীর জল, নদীর উপরের রাতের আকাশ, আকাশের যত তারা। আর সেখানকার আঁধার।

কলেজের পাঠ শেষ করে এই শহর থেকে একদিন ট্রেনে করে ঢাকা চলে আসি। ভর্তি হই সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তখন আশির দশক। কী চমৎকার গ্রামীণ পরিবেশ, ছায়া ঢাকা, পাখিদের কলকাকলি মুখর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গন। দূরে দিগন্তের নীচ দিয়ে দেখা যেত কলধ্বনিতে বয়ে যাওয়া বংশী নদীর জল।

ভূগোল বিভাগের প্রথম দিনের ক্লাস। ক্লাসে যেতে আমার সেদিন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। স্যারের অনুমতি নিয়ে শ্রেণি কক্ষে ঢুকি। বুক হাত পা থরথর করে কাঁপছিল। ক্লাস রুমের মাঝখানের স্পেস দিয়ে হেঁটে যেতেই একটি ছেলের পায়ের গোড়ালিতে হোঁচট খেয়ে মেঝেতে ধাম্ করে পড়ে যাই। মুহূর্তে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। কেউই এগিয়ে এসে উঠাল না আমাকে। আমি একাই বই খাতা কুড়িয়ে নিয়ে পিছনের একটি খালি সিটে গিয়ে বসি।

ক্লাস শেষে করিডরে একাকী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। যার পায়ে লেগে হোঁচট খেয়েছিলাম, সেই ছেলেটি আমার কাছে এসে বিনম্র ভঙ্গিতে বলে -- "আমি একান্তভাবে দুঃখিত ও ক্ষমা প্রার্থী।"
আমি বলি -- আমারও তো পা লেগেছিল আপনার পায়ে। আমিও দুঃখিত।

এইভাবেই ঐ ছেলেটির সাথে আমার প্রথম কথা হয় এবং সখ্যতা ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ওর নাম-- আনিস রহমান।

আমার ভাগ্য কী এই রকমই হয়, জগতের যত সহজ সরল ছেলের সাথে পরিচয় হয়। তাদের জন্য মায়া লাগে। আর এই মায়ায় পড়ে তাদের সাথে এক অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে যাই।

আনিস এসেছিল ফরিদপুরের রাজবাড়ি থেকে। গোয়ালন্দের কাছে পদ্মাপাড়ে ওদের বাড়ি। আনিসকে আস্তে আস্তে চিনতে লাগলাম। ভালো লাগলো বন্ধুর মতো করে। একটু সতর্ক থাকলাম -- কোনো ভাবেই যেন দূর্বল হয়ে না যাই।

ছেলেটি ভালো কবিতা লিখত। নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, হেলাল হাফিজদের মতো সুন্দর সুন্দর কবিতা। ও প্রায়ই কবিতা লিখে এনে আমাকে দেখাত এবং পড়ে শোনাত। খুব ভালো লাগত ওর কবিতা। আনিসের একটাই দোষ ছিল, ও কবিতা কোথাও ছাপানোর জন্য পাঠাত না। বলত -- আমি কবি হতে চাইনা। আমি কবিতা লিখি আমার জন্য। ছাপিয়ে কী হবে।

-- শুধু তোমার জন্য?

-- আমার জন্য এতদিন লিখেছি, এখন লিখি তোমার জন্য।

আমি বলতাম, আমার জন্য কেন লেখ? আমি আবার কবিতা লেখার তোমার কেউ হয়েছি নাকি?

আনিস বলত -- তুমি আমার অনেক কিছু। তুমি পছন্দ করো, তাই লিখি।

একটা কবিতার কথা মনে আছে। একদিন ক্লাস শেষে করিডরে দাঁড়িয়ে আছি। আনিস আমার কাছে এসে বলে -- কঙ্কাবতী।
-- বলো।
-- চলো আজ বংশী নদীর পারে। ওখানে কূলে বসে নদীর জল, আর নীল আকাশ দেখে আসি।
আমি বললাম - চলো।

আমরা চলে যাই বংশী নদীর তীরে। তখন ছিল আষাঢ় মাস। নদী সবে মাত্র জলে ভরে উঠেছে। তখনও জল উপচে ক্ষেতে খামারে ঢুকে পড়েনি। চারদিকে আউশ ধানের প্রান্তর। ধানক্ষেত পার হলেই নদী। ঠিক নদীর কূল ঘেষে একটি কদম গাছ আছে। গাছ ভর্তি ডালে ডালে কদমফুল ফুটে আছে। অপরাহ্ণের রোদ লেগে ফুলগুলো থেকে তীব্র গন্ধ বের হচ্ছিল। আমরা যেয়ে কদমতলায় ঘাসের উপর বসি। নদীর জল বয়ে যাচ্ছিল ছলাৎছল করে। কিছু সময়ে নদীও কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়। আমরা দেখলাম- আষাঢ় মাসের এই ভরা নদী আমাদের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। নদীর কথা সবাই সবসময় শুনতে পায় না। কেউ কেউ কখনও পায়। আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম সেই কথা নির্জন সেই অপরাহ্ণ বেলায়।

আনিস ওর বুক পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে। সেই কাগজে লেখা আছে একটি কবিতা। পড়ে শোনায় সেই কবিতাটি। যেন নদী এসে কথা বলছিল নিভৃতে আমার কানে কানে।

আনিস কবিতাটি পড়ার পর আমাকে দিয়ে দিয়েছিল কাগজটি। আমি রেখে দিয়েছিলাম তা আমার বইয়ের পাতায়। পয়ত্রিশ বছর চলে গেছে। বইটি এবং কবিতাটি রেখে দিয়েছিলাম যত্ন করে একটি পুরনো কাঠের তোরঙ্গে। আনিসের লেখা সেই কবিতাটি ছিল ---

" একদিন এক নিরাভরণ আয়োজনহীন বিকালে আমরা হাঁটছিলাম, কাঁচা ধান শীষের নির্জন সেই পথ, পাশে দূর্বা ঘাসের উপর দুপুরের এক পশলা বৃষ্টির মুক্তো লেগেছিল। তখন আকাশ ছিল ধূসর নীল।

আষাঢ়ে কাশফুল ফোঁটার কথা না। দয়িত হারানো বিরহী রমণীর মত শেফালিকাও কোথাও নেই। ধুলোর পথ ছেড়ে দূর্বা ঘাসের উপর আমাদের চরণ পড়ে দূর্বাও রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল।

যে পাশে ছিল সে ছিল আমার আনন্দময়ী, আমার প্রাণাধিকা। বিকালের রোদ্র মেখে স্বর্ণপ্রভা হয়ে উঠেছিল সে। যেন কতকালের পরিচিত আরক্ত মুখশ্রী। দেখেছি কত সন্ধ্যার ছায়ায়, কত চন্দ্রালোকিত নিশীথে। সে প্রকৃতিভৈরবী হয়ে আমাকে ঘর থেকে কত যে বের করে নিয়ে আসে ।

কতদিন পর আজকে এই বিকালে এখানে এসেছি। পশ্চিম দিগন্তে আলো নেভে নাই, তখনও দিগন্তে কমলা রঙে ছেয়েছিল.. 
আমরা হেঁটে চলেছি ........
এমন কত পথ পাশাপাশি হেঁটেছি
হাঁটতে হাঁটতে কত দূর চলে গেছি
কত কথা বলেছি, কত কথা বলতে ইচ্ছা করত !
পথের পাশে অচ্যূত ঘাসফুলের দিকে চেয়ে
কত প্রাণের ছোঁয়া যে তাকে দিতে চেয়েছি।

আমি দেখেছি তার মাথার চুল উড়ছে আসন্ন সন্ধ্যার ধূপগন্ধ বাতাসে,
তাকে একাকার করে নিতে ইচ্ছা করত আমার সকল একাকীত্বে...

অন্তরের ভিতর তখন অন্য তরঙ্গ --

'জানি না কোথা অনেক দূরে বাজিল গান গভীর সুরে,
সকল প্রাণ টানিছে পথপানে
নিবিড়তর তিমির চোখে আনে।'"

সন্ধ্যায় যখন ফিরে আসি তখন আনিস ধরেছিল আমার একটি হাত। আমি কিছুই বলিনি ওকে। জগতে কিছু হাতের স্পর্শে অনুভব করা যায়, এই হাত বিশ্বাসের। আনিসের হাতটা ছিল তেমনই জাদু স্পর্শের মতো। গত একবছর ধরে ওকে আমি দেখে আসছি। এত ভালো ছেলে। ওর হাতে পাপ নেই।

কিন্তু আমার? এমন একটি ছেলেকে আমি কী নোংরা করে দিতে পারি? কিংবা নস্ট করতে পারি ওর আসন্ন নবীন জীবন? আমি আনিসকে সেদিন থেকে এমন আচরণ করতে থাকি, যেন ওকে বোঝাবার চেষ্টা করি, 'আমি কেবলই বন্ধু তোমার একজন। আর কিছু না। কিছুই হবো না তোমার কোনোদিন।'

৫.

আমার জীবন দুইদিক থেকে বয়ে আসা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ হাওয়ায় এলমেল হতে লাগল। যেন হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল তছনছ হয়ে গেল! আনিসের দিক থেকে বয়ে আসা ঝড়টি কেন জানি বেশি অমঙ্গলের মনে হলো। তাই এই ঝড়টিকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য প্রাণমনে চেষ্টা করতে থাকি।

এরপর থেকে আনিসকে বুঝতে দিতে চাইনি যে -- আমি ওকে ভালোবাসি। দূর থেকে দিনের পর দিন ভালোবেসেছি, কিন্তু কখনও বুঝতে দেইনি ওকে। নিজে নিজেই একটি সিদ্ধান্ত নেই -- মাইনুলই আমার জীবনের প্রথম পুরুষ। কত কিছু দিয়ে, কত অর্ঘ্য আর চোখের জলে ওকে জীবনে পেয়েছিলাম -- ও-ই আমার জীবনে চির জীবনের বাঁধন হয়ে থাক্।

সেমিনার কক্ষে বসে পড়াশোনা, লাইব্রেরি যেয়ে বসে বসে নোট করা, ক্যান্টিনে চা সিঙ্গারা খাওয়ার মধ্যেই আনিসের সাথে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের চলাফেরা সীমাবদ্ধ করে রাখলাম। এরপর মাঝে মাঝে আনিস অনেক কবিতা লিখে আমার কাছে নিয়ে এসেছে, কিছু তার শুনেছি, কিছু তার শোনা হয়নি।

মাইনুলের সাথে আমার গোপন অবৈধ সম্পর্ক, আমার গর্ভধারণ, গর্ভপাত এসব কিছুই আনিসকে কোনোদিন বলিনি। আমার এই গোপন অন্ধকার জীবনের গ্লানির কথা আনিসের কাছে অজানাই রয়ে গেছে।

অনার্স শেষ বর্ষের এক গ্রীষ্মের ছুটির দিনে বাড়ি গেলে অনেকটা অনাড়ম্বর করে মাইনুলের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়। এই বিয়ের কথাও আনিসকে আর বলিনি। ইতোমধ্যে আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়।

পারিবারিক ভাবে সিদ্ধান্ত ছিল -- আমার আর মাস্টার্স পড়া এখানে হবে না। আর আমারও ইচ্ছে করছি না পড়তে।

এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাব। এই স্মৃতিময় নবাব ফয়জুন্নেসা হল। এই সবুজ ক্যাম্পাস! দূরে বয়ে যাওয়া বংশী নদীর কলধ্বনিও আর শুনব না। এখানে আর সন্ধ্যা নামা দেখব না পাখিদের মুখর করা সন্ধ্যার গানে।

খুব ইচ্ছে হলো -- আনিসের সাথে একটি বিকাল কাটাতে বংশী নদীর তীরে। চলেই তো যাচ্ছি আনিসকে ছেড়ে চিরদিনের করে, আর কোনোদিন হয়ত দেখা হবে না। স্বামী - সংসার, সন্তান নিয়ে গদবাঁধা জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকতে হবে।

যেদিন চলে আসব - ঠিক তার আগের দিন আমি আর আনিস চলে যাই -- বংশী নদীর তীরে। কাকতালীয় ভাবে সেদিনও ছিল আষাঢ় মাস। কিন্তু এর আগে যে এখানে এসেছিলাম ঠিক সেই সবুজের ধানক্ষেত আজ দেখতে পেলাম না। নেই সেই কদমগাছটিও। কোনো বৃক্ষরাক্ষস সম্ভবত কদম গাছটি কেটে ফেলেছে। তবে নদীর দিকে চেয়ে দেখলাম, নদী কুলকুল করে বয়ে চলেছে ঠিক আগের মতোই।

আমরা নির্জন মেঠোপথে নদীর কূল ধরে হাঁটতে থাকি। একজায়গায় দেখতে পাই একটি বাবলা গাছ। সারা বাবলাগাছ ধরে হলুদ ফুল ফুটে আছে। আমরা দাঁড়াই এই বাবলা তলে। আনিস বলছিল -- তুমি কী এখানে বসতে চাও?

আমি বললাম, বসব, তোমাকে নিয়ে দেখব নদীর জল। হয়ত এমন করে আর তোমাকে নিয়ে নদী দেখা হবে না।

তখন সন্ধ্যা পূর্ব বিকাল। আমরা দুজন বসে আছি। টুকটাক করে অনেক কথা বলছি, আবার নীরবতায়ও কেটে যাচ্ছিল সময়। আজ আনিসের একটি হাত খুব ধরতে ইচ্ছা করল -- আমি ওর একটি হাত ধরি। হাত ধরে বলি -- এই হাতে একটি চুমু কী আমি দিতে পারি? আনিস বলল, দাও।

আনিস আমাকে ওর বাহুডোরে বেঁধে নিয়ে বলে, 'আমরা কী চিরদিনের জন্য দুজন দুজনের হতে পারি না?'

আমি আনিসের মুগ্ধ দুচোখের দিকে চেয়ে বলি -- না। আমি যে অনেক আগেই আর একজনের জন্য চিরদিনের হয়ে গেছি। আমার জীবন তোমার জীবনে নেই।

দেখলাম -- আনিসের বাহু মুহূর্তেই শিথিল ও নির্জীব হয়ে গেল। হাঁটুতে মাথা গুজিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সেদিনের অস্তবেলার শেষ সন্ধ্যা নেমেছিল নদীর বুকে। দুজন চেয়ে থেকে দেখছি -- কী ভাবে সোনালি আবীর মাখা রং আকাশ থেকে মুছে গেল।

ফিরবার পথে সন্ধ্যার সেই বিলুপ্ত মেঘের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম -- যাকে বেশি করে ভালোবাসা যায়, নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ বুঝি তার সাথেই করা যায়, আবার এই ভেবে মনে শান্তিও পেলাম -- আনিসের জীবনে আমি যে জড়াইনি এইটাই ওর জন্য চির কল্যাণ হয়ে থাক্। ওর সামনে যে অনেক কর্ম।

পথে আসতে আসতে আবারও মনে হলো ওর একটি হাত আমার হাত ধরে আছে -- কিন্তু কেমন যেন অসার সেই হাত। আমাকে কেমন মায়া করে ডাক দিল আনিস -- কঙ্কাবতী!

-- জ্বী।
-- তোমার সাথে আর কী কখনো দেখা হবে না আর?
-- না। লুকিয়ে রাখব তোমার থেকে নিজেকে বাকি জীবনকাল।

পথের উপর সেই সন্ধ্যার আঁধারে থেমে যাই। পা চলছিল না। কেমন যেন ব্যথা করছিল পায়ে। আমি আনিসকে বলি - তোমার বুকে একটু মুখ লুকোতে দেবে?

-- দাও।
-- একটু কাঁদতে দেবে?
-- কাঁদো।
তারপর আমার জীবনের কত পিঙ্গল পথ, কত পটে কত বর্ণের হয়ে জীবনের এই অস্ত পর্বে এসে দাঁড়ালাম। কত শুকতারার আলোকোজ্জ্বল রাত আঁধারে উড়িয়ে অদৃশ্য হয়েছে – প্রতিদিনই কোনো কোনো সন্ধ্যায়
সেই হারিয়ে ফেলা বংশী নদীর কূলের মতো হাসি আনন্দের সন্ধ্যা নেমেছে, আপন ভালবাসার রঙে আমার প্রাণ রাঙিয়ে তুলেছি কত। আমি শুধু অনুভব করেছি -- একজনকে ভালোবেসে পেয়েছি, আর একজনকে ভালোবেসে হারিয়েছি। একজনকে দেহ মন দিয়ে কেবল আনন্দ দিয়ে গিয়েছি, আর একজনকে জীবনভর মনে রেখে দুঃখ কুড়িয়েছি।

*** *** *** ****

তারপর চলে গেছে জীবনের পয়ত্রিশ বছর। আমি এখন বিগত যৌবনা এক রমণী। জানো! এই শহরেই আমি থাকি।

তোমাকে আমি অনেক কথাই বললাম, আবার অনেক কথা বলিনি। জীবনের এমন অনেক কথা আছে, লেখা যায় না, বলাও যায় না, চোখে এসে দেখতে হয়। তোমাকে কফি খাওয়ার নিমন্ত্রণ করলাম -- যদি আসো তাহলে তুমি দেখতে পাবে আমার জীবন ছবি। 

আমার ঠিকানা ঃ রোড নং ২৩,
বাসা নং ... , বনশ্রী, রামপুরা -- ঢাকা। 

আমি একদিন সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম কঙ্কণার বাড়িতে। বাসায় নক করতেই  একটি লোক এসে দরজা খুলে দেয়। লোকটি আমাকে দেখে বুঝতে পারে - আমি কে?  মনে হলো কঙ্কণা আমার কথা আগেই বলে রেখেছিল ওনাকে। পরে জেনেছি - লোকটি হচ্ছে কঙ্কণার স্বামী মাইনুল। 

ভিতরে শোবার ঘরে যেয়ে দেখি একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা অন্যদিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে। মাইনুল ওনাকে ডাকে -- দেখ কে এসেছে! 

কঙ্কণা  আস্তে করে ঘুরে আমার দিকে তাকায়, কী করুণ শীর্ণা রোগক্লিষ্ট মুখ। চোখের নীচে কালো দাগ। চোখের কোণে  বিন্দু বিন্দু জল। আমি ওকে দেখে আৎকে উঠি। আমি যে একে চিনি। বহু জন্মজন্মান্তরের সে যে আমার একজন ছিল। শুধু নামটি ভিন্ন, কঙ্কণা নয় -- ও যে দিলারা জাহান। 

এইরকম কতকিছু পরিবর্তন করে আমাকে লিখেছিল দিলারা -- বংশী নদী নয়, নদী ছিল বুড়িগঙ্গা, জাহাঙ্গীরননগর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর, আনিস রহমান সে নয়, সে ছিল রঞ্জন রহমান। 

দিলারা কর্কট রোগে আক্রান্ত ছিল। পৃথিবীর সমস্ত ঔষধ ও  চিকিৎসা অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল ওর শরীরে। ডাক্তার হাসপাতাল থেকে ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। 

সেদিন একটি সন্ধ্যাই কেবল দিলারার শিয়রে বসেছিলাম -- খুব আবছা করে দেখতে পাচ্ছিলাম অনেক দূরের একটি নদী। শ্রাবণের  বুড়িগঙ্গা বয়ে চলছিল যেন কুলুকুলু করে...  
দিলারা আমাকে একদিন বুকে মাথা রেখে বলেছিল, "
"জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো, সকল মাধুরি লুকায়ে যায় গীতসুধারসে এসো। "

গলা  রোধ হয়ে আসছিল -- অস্ফুট কণ্ঠে  দিলারাকে মনে মনে  বললাম  -- সেই  আমি এলাম, যখন কিনা তুমি চলে যাচ্ছ। 



২২.     লক্ষ্মীমতি



নাজিম উদ্দীন ছিল আমার স্বল্প সময়ের জন্য  একজন সহকর্মী। বছর তিনেক একটি সরকারি প্রকল্পে আমরা একসাথে কাজ করেছিলাম।  আমি তখন ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য পাশ করে বের হয়েছি। দক্ষিণখানে একটি বাংলো বাড়িতে একা থাকি।    

নাজিম উদ্দীন আমার চেয়ে সাত আট বছরের  বড়ো ছিল। বয়সে সে বড়ো হলেও খুব অল্প দিনের মধ্যে আমরা একে অপরে ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। নাজিম উদ্দীন থাকত ইন্দিরা রোডের একটি মেসে। ওর বাড়ি ছিল শ্রীপুরের কাওরাইদে। গ্রামের বাড়িতে বউ বাচ্চা থাকত। সাপ্তাহিক ছুটিতে সে ট্রেনে করে কাওরাইদে আসা যাওয়া করত। 

একদিন নাজিম উদ্দীন আমাকে বলছিল --  'তোমার ভাবীকে ঢাকায় আনতে হবে চিকিৎসার জন্য। সাত আট দিন থাকতে হবে।  আমি মেসে থাকি। ঢাকায় দুএকজন আত্মীয় স্বজন আছে কিন্তু সেখানে উঠতে চাচ্ছি না।  তুমি তো একা এক বাড়িতে থাকো। তোমার ওখানে তোমার ভাবীকে নিয়ে উঠতে চাই।'  

আমি বললাম -- তুমি উঠতে পারো,  আমার সামান্যতম অসুবিধা নেই। কিন্তু, আমার চাল চুলো কিছু নাই। খাওয়াব  কী !  আমি যেখানে থাকি, সেটি এখনও গ্রাম। কাছে একটা ইতালিয়ান হোটেল অবশ্য আছে। কিন্তু ঐ হোটেলে ভাবীকে নিয়ে বসে খাওয়া যাবে না। প্রেস্টিজ চলে যাবে।  যদিও আমি বিপদে পড়ে মাঝে মাঝে সেখানে খাই।  আর বেশির ভাগ সময় বাইরে এদিক সেদিক কোনো হোটেল থেকে খেয়ে তারপর বাড়িতে যাই । আবার এমনও ইতিহাস আছে, না খেয়েও রাতে ঘুমিয়ে পড়ি। অনেক সময় রুটি-পাউরুটি খেয়েও রাতের খাবার সারি।     

নাজিম বলছিল -- তা অসুবিধা হবে না।  এটা নিয়ে তুমি ভেবো না। আমরা ম্যানেজ করে নিব।  

-- আচ্ছা, তাহলে ভাবীকে নিয়ে চলে এসো। 

-- আমি এবার বাড়িতে যেয়ে আসার সময় তোমার ভাবীকে নিয়ে সোজা তোমার ওখানেই এসে 
উঠব।

সেদিন ছিল ছুটির দিন। সকাল এগারোটা বাজে আমি তখনও ঘুম থেকে উঠিনি। হঠাৎ শুনতে পাই --- বাইরের গেটে কে যেন নক করছে।  দরজা খুলে দেখি, নাজিম উদ্দীন তার স্ত্রীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।  

হেমন্তের রোদ্দুর তখন সারা আঙিনাতে মুখর।  নাজিম উদ্দীনের স্ত্রীর পরনে একটি সবুজ রঙের তাতের শাড়ি, হাতে চারটি চিকন সোনার চুড়ি, মুখে কোনো আবীর মাখা নেই।  অনেকটাই নিরাভরণ।  বয়স ত্রিশ বত্রিশ হবে। মাথায় ছোট্ট ঘোমটা দেওয়া।  আমায় দেখে ঘোমটাটা আরও একটু সামনের দিকে টেনে আনেন । হেমন্তের রোদ্দুর সেই ঘোমটার ভিতর দিয়ে আবছায়া রূপে প্রবেশ করে তার মুখখানিকে বেশ উজ্জ্বল করে তুলেছিল। নাজিম উদ্দীন আমাকে পরিচয় করে দেয় -- এই হচ্ছে তোমার ভাবী। তোমার শারমিন ভাবী। আমি তাকে সালাম দিলাম।   

নাজিম উদ্দীন ও শারমিন ভাবী ঘরে এসে বসলেন। আমার কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছিল। তখন আমি ইউনিভার্সিটির সদ্য  মাস্টার্স পাশ করা তরুণ এক , বয়স চব্বিশ পঁচিশ। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম। তখনও বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, মেঘদূতম, শকুন্তলা দুস্মমন্ত'রা মগজে ঘোরাফেরা করে। সুযোগ পেলেই কল্পনায় চলে যাই, দূর শিপ্রানদীর তীরে। সেই আমি দেখলাম আজ হেমন্তের রোদ্দুর ছোঁয়া একজন কুসুমিত রমণীর অনাবৃত দুটো হাত। আমার মনের ভিতর এক প্রকারের নূতন অনুভূতি, আমার বুকের রক্তের তালে তালে সেদিন এক প্রকার নূতন স্পন্দন স্পন্দিত হয়েছিল।  

রুমের ভিতর মৌনব্রত বসে আছি। ভাবছি, আগত এই অতিথিদের কী খাওয়াব? নাজিম উদ্দীন আমার বিব্রত মুখ দেখে বুঝতে পারে -- আমি কিছু দুশ্চিন্তা করছি।  সে বলে -- তোমার ভাবী মশাখালীর দেশী মুরগী, সুতিয়াখালীর নদীর বাইটকা মাছ আর ছোট ছোট আইর মাছ রান্না করে নিয়ে এসেছে।  আমরা সবাই এগুলো দুইদিন খেতে পারব।    

তরকারি না হয় হলো। কিন্তু ঘরে ভাত নেই। চাল নেই। চুলো নেই।  কী করব?  আজিজ মিয়ার টিনের চালার হোটেল থেকে ভাত কিনে এনে দুপুরে  তিনজন খেয়ে নিলাম।    

আমার বাড়িতে থাকার কোনো অসুবিধা ছিল না। পরিপাটি রুম।  আলনা, টেবিল, নিওন বাতি, ইলেকট্রিক ফ্যান সবই আছে৷  আমি নাজিম উদ্দীনকে বললাম -- 'যাও তোমরা এখন বিশ্রাম করো গে।' এই কথা বলে আমি আমার রুমে চলে আসি।    

বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিভূতিভূষণের 'উপেক্ষিতা' পড়তে থাকি। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বুঝতে পারিনি। যখন ঘুম ভাঙে, দেখি -- জানালার ওপাশে বাঁশ ঝাড়ের পাতাগুলো মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলছে।  অপরাহ্ণের মিহি আলোয় চিকচিক করছে মাধবীলতার গুচ্ছগুচ্ছ ফুল।  একটুপর  ছায়া ছায়া অন্ধকার নামবে। এই সময়ে খুব একা একা লাগে।  কিন্তু আজ লাগছে না। আজ আমার ঘরে দুজন অতিথি আছে। যাদের পদচারণায় নৈশব্দ ভেঙে গেছে।     

আমি উঠে মাঝখানে ড্রইং রুমে চলে আসি। সোফায় বসে নাজিম উদ্দীনকে ডাক দেই। -- 'নাজিম ভাই....। ' আমার ডাক শুনে পাশের রুম থেকে নাজিম ভাই চলে আসে, সাথে শারমিন ভাবীও। 

নাজিম ভাই বলছিল -- তোমার রান্নাঘর শারমিন ভিজিট করেছে। কিছু নাই। সব নাকি খালি। ঠনঠন করছে। তোমার ভাবী একটা লিস্ট করেছে। কী কী লাগবে। তুমি আমার সাথে চলো টংগী বাজারে। সব কিনে আনব।   

আমার কোনো 'না' তারা শোনেনি। বাধ্য হয়েছিলাম চলে যেতে। ভাতের পাতিল, তরকারির পাতিল,  কড়াই, খাবার প্লেট, গ্লাস, চামচ, খুন্তি, বটি, বালতি, গামলা থেকে শুরু করে যা যা লাগে সব কিনল নাজিম ভাই। আরও কিনল চাল, ডাল, লবন, পিয়াজ, কাঁচামরিচ, মসলাপাতিসহ কতকিছু। শারমিন ভাবী করে দিয়েছিল লম্বা ফর্দ। ফর্দের সবই কিনলেন তিনি। আমাকে একটা টাকাও দিতে দিল না।  আমি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু নাজিম ভাই বলেছিল -- ' তুমি যদি টাকা দাও তাহলে শারমিন আমাকে মারবে।' এই কথা শুনে আমি থেমে গেলাম।    
                                               
রাতে যখন খেতে বসি -- দেখি -- আজ অন্যরকম সব আয়োজন। এ যেন আমাদের দেশের বাড়িতে খাবার টেবিলে মার মতো করে সাজানো সব খাবারের  আয়োজন। 

শারমিন ভাবী পাশে দাঁড়িয়ে থেকে খাবার পরিবেশন করছিল আর বলছিল -- 'রঞ্জন ভাই, আমি যে কয়দিন এখানে আছি, আপনার সংসার টা সব সাজিয়ে দিয়ে যাব।  এরপর যদি কখনও আসি, এসে যেন দেখি -- একজন লক্ষ্মীমতি বউ ঘরে এনেছেন।'      

শারমিন ভাবীরা সাতদিন ছিলেন আমার বাড়িতে। ঐ কয়দিনে সত্যি সত্যি আমার বাড়িটা তিনি সাজালেন। ঘরের কোণে কোণে ধূলোময়লা জমেছিল সেগুলো তিনি নিজ হাতে পরিস্কার করলেন। বারান্দার চালে মাকড়সা বাসা বেঁধে অসংখ্য  ঝুলে  ভরে রেখেছিল, সেগুলোও ঝারলেন। পড়ার টেবিল গোছালেন। বিছানাপত্র সব পরিপাটি করে রাখলেন।  বাড়ির সামনের বাগানে আগাছাগুলো লোক ডেকে কাটিয়ে ফেললেন। মালিনীর মতো প্রতিদিন গোলাপ, বেলী, পাতাবাহারের গাছগুলোতে পানি ঢাললেন।   

 হঠাৎ করেই জমিদার পুত্রের মতো জীবন হলো আমার। বাড়িতে খাবার রেডি থাকত। হাতখান ধূয়ে শুধু খেতে বসতাম। শারমিন ভাবী খালি মুখে তুলে খাওয়ানোটাই বাকি রাখতেন।  বাকি সবই তিনি করতেন, তৈরি রাখতেন।    
                                               
শারমিন ভাবীকে ডাক্তার দেখানো, তাকে চেক-আপ করানো, রিপোর্ট নেওয়া এবং ডাক্তারের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ঔষধ কেনা,  সবই শেষ হয়ে যায়।  একদিন বিকালে ডাক্তারের কাছে থেকে ফিরে  এসে নাজিম ভাই বলছিল -- তোমার ভাবীকে ডাক্তার দেখানো শেষ। আগামীকাল সাড়ে বারোটার ট্রেনে আমরা চলে যাব।              

তখন ছিল বিকেল।  নাজিম ভাইয়ের কাছে থেকে তাদের চলে যাবার কথা শুনে মনটা খুব  খারাপ লাগছিল। ঘরের পিছনে বৃক্ষরাজিতে তখন  বসে থাকা পাখিদের কলকাকলি ক্রমান্বয়ে বিষাদের সুরের মতো হৃদয়ের তন্ত্রীতে অনুরণিত হতে লাগল। যে সুরের উদাস মাধুর্য প্রাণের মধ্যে কোনো সাড়া দেয় না।

বিকালগুলো কী এমনই বিষণ্ণতার হয়? মনে হতে লাগল -- জীবনটা এমন হয় কেন, এই এলমেল, এই সাজানো গোঋানো, আবার হয়ে যায় এলমেল। সেদিনের সেই অপরাহ্ণের রোদ্দুর বাশের পাতার উপর পড়ে আর চিকচিক করল না৷ মাধবীলতা গুলোও ম্রিয়মাণ হয়ে আছে। জানি আঁধার নামবে, জানি --  ' সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী ফুড়ায় জীবনের সব লেনদেন, তারপর থাকে শুধু অন্ধকার !'   
   
পরের দিন সকালে আমি অফিসে চলে যাই। যাওয়ার সময় নাজিম ভাইকে বলি -- তোমাদের ট্রেন তো ছাড়বার দেরি আছে। তোমরা পরে বের হইও। ঘরের তালা টিপ দিয়ে লক করে বেরিয়ে যেও। আমি চাবি নিয়ে যাচ্ছি। পরে এসে তালা খুলে ঘরে ঢুকব।                       

আমি যখন বেরিয়ে যাব -- তখন দেখি,  শারমিন ভাবী সেদিনের মতো ঘোমটা অর্ধেকটা খুলে স্থির শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হলো তার কালো চোখদুটির নীচে জগতের সকল অশ্রু ভার যেন গোপনে লুকিয়ে রেখেছে। ঈষৎ ভারী সেই চোখ দুটো তুলে বলেছিল -- 'আমি কিন্তু সব সাজিয়ে গুজিয়ে রেখে যাচ্ছি। কোনো এলমেল যেন না হয়। যদি কখনও আবার আসি -- ঘরে  যেন একজন লক্ষ্মীমতিকে দেখতে পাই।' 

সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এসে দেখি ঘরের দরজায় তালা দেওয়া। আপন পরিজনের মতো আজ আর কেউ অপেক্ষায় নেই। সারা ঘর অসীম শূন্যতায় খাঁ-খাঁ করছে। কয়টা দিনের সেই মুখর করা মানুষ দুজন নেই। বিছানার উপর জুতা না খুলে সটান হয়ে শুয়ে পড়ি। জানালা খুলতে ইচ্ছে হলো না। সন্ধ্যার আলো জ্বালাতেও মন চাইল না। ক্রমশ আঁধারের ভিতর  নারীকণ্ঠের একটি কথার প্রতিধ্বনি বাজছিল কেবল -- " যদি কখনও আবার আসি, ঘরে যেন একজন লক্ষ্মীমতিকে দেখতে পাই।''



২৩.     নীল আকাশের খোঁজেে


এই করোনা কালে মাধবীর সাথে আমার একবারই যোগাযোগ হয়েছিল। ও আমাকে লিখেছিল, আমিও ওকে লিখেছিলাম, লকডাউনের সময় কে কেমন আছি -- তা জানতে চেয়েছিলাম দুজন দুজনের কাছ থেকে।  তারপর আর কোনো খোঁজ খবর নেই। কারোর সাথে কোনো কথাও নেই।  আসলে মাধবী আর  আমার সম্পর্কটা এই রকমই। দীর্ঘদিন চলে যায় দীর্ঘ রাত্রি।  দুজনেই কোথায়  ডুব দিয়ে থাকি। কেউ কারোর খবর নেই না।    কিন্তু আমাদের দুজনের মাঝে এই নিয়ে কোনো মান অভিমান নেই। কোনো ভুল বোঝাবুঝিও নেই। আমরা জানি -- একে অপরকে ভুল বোঝার দুঃসাহস আমাদের কারোর নেই।  

দীর্ঘ প্রায় চার মাস পর মাধবী আমাকে লিখেছে ওর কথা ---
২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২০ ইং
ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।   

রঞ্জন,   

তুমি তো জানোই তোমার মন খারাপ থাকলে আমার মনখারাপ লাগে। কোনো কিছুতে তুমি কষ্টে থাকলে আমার অন্তর বীণার তার ছিঁড়ে য়ায়।  'পরানে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা-- দুখের মাধুরীতে করিল দিশেহারা, সকলই নিবে-কেড়ে,  দিবে না তবু ছেড়ে-- মন সরে না যেতে, ফেলিলে একি দায়ে।'

কয়দিন ধরেই মনটা তোমার জন্য আকুল হচ্ছিল খুব। কেমন যেন ভেতরটা ভারী হয়ে আসছিল। মন বলছিল -- তুমি ভালো নেই। তুমি কষ্টে আছ। তোমার মন যে কতখানি কোমল, তা এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে কে বেশি জানে !  আর সেই মনটি যদি যাতনায় থাকে, তাহলে আমি কী ভাল থাকি, বলো ? কী যে এক অনিঃশেষিত মায়ায় তুমি আমাকে জড়িয়ে রেখেছ চিরকালের জন্য, তা জানে বিধাতা, আর জানি আমি। 

এই শহরে করোনার বন্দীকাল জীবন আর নেই। তবুও মন কেন যে উচাটন হয়!  তুমি তো জানো -- সুখে হোক আর দুঃখে হোক, তোমার কথা মনে হলে আমি নিভৃতে চলে যাই। ঘর  হতে বেরিয়ে পড়ি। একাকী ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকি। আজ হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূর। টিলার মতো একটা উঁচু জায়গায়  একটি নিরিবিলি  ইতালিয়ান কফিসপে বসেছিলাম কফি খেতে। ওয়েটারকে অর্ডারও করেছিলাম এক গ্লাস  গরম কফি দিতে । কিন্তু এক চুমুক খাওয়ার পর আর খেতে ইচ্ছে করল না। হঠাৎ মনে পড়ল-- সেই কতবছর আগের একদিন শাহবাগের মৌলিতে বসে কফি খাওয়ার কথা।  গরম কফি চুমুক দিতে যেয়ে তুমি তোমার টি সার্টের উপর সব কফি ঢেলে ফেলেছিলে।   
 
কফিসপ থেকে বেরিয়ে একটি ট্যাক্সি কল করে চলে যাই আল্পস পাহাড়ের দিকে। ভেবেছিলাম রডোডেনডন গুচ্ছ দেখে মন ভরাব। গাড়ির উইন্ড গ্লাস খুলে দেখি -- কোথাও কোনো পাহাড়ের ঢালে  রডোডেনডন ফুটে নেই। এখানেও এসে স্মৃতি খুঁড়ে রক্ত ঝরালাম। একবার তুমি কী যে এক পাগলামি করলে ! একদিন একটি লোকাল বাসে করে আমাকে জোর করে  নিয়ে গেলে রাজেন্দ্রপুর শালবনে। ওখানে নাকি রডোডেনডন থোকায় থোকায় ফুটে থাকে। কিন্তু সেদিন সারা শালবন তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও একটি রডোডেনডন গুচ্ছের ঝাড়ও খুঁজে পাইনি।
                                                                           
ট্যাক্সি চালককে বললাম -- তুমি আমাকে দানিয়ুব নদীর তীরে নিয়ে যাও। গেলাম সেখানে, কিন্তু ওখানেও ভালো লাগল না। এত নির্জন, এত নির্মল জল, এত নৈঃশব্দ -- ভালো লাগছিল না। দানিয়ুবের তীর ধরে যখন হাঁটছিলাম-- তখন    মনে পড়ে গেল, একবার এক চৈত্রের  ভর দুপুরে তুমি বললে -- 'চলো বুড়িগঙ্গার পারে শ্মশান ঘাটে যেয়ে বসে থাকি। ঐ জায়গা নাকি খুব নির্জন হয়, ভয়ে কেউ ওখানে যায় না'।        
                       
কোথাও মন ভালো হলো না। সন্ধ্যার পর ভিয়েনা শহর আলোয় আলোয় ভরে উঠল। ঘরে ফিরে এসে আমার স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে কতক্ষণ কেঁদে নিলাম। বুকের ভার অনেকটাই  কমে গেল।  আমার আফসোস শুধু একটাই -- আমারও রক্তের গ্রুপ  AB Positive.. তোমার মায়াবতীর এই সংকটকালে আমিও তো ওকে রক্ত দিতে পারতাম। কিন্তু এত দূরে পড়ে রয়েছি যে -- আমার শরীরের প্রবাহমান সব রক্ত বেদনায় হিম হয়ে গেল।
  
কেমন আছ তুমি?  কেমন আছে তোমার মায়াবতী জানাইও। 
    
--- মাধবী।                                     
              

আমি মাধবীর লেখার শেষ লাইনটাই শুধু প্রলম্বিত করলাম। লিখে জানালাম ওকে --

চির কল্যাণীয়াসু, 

দার্জিলিং থেকে আনা ধবধবে সাদা শাড়িটা মায়াবতীর খুুব পছন্দ। সেই কতবছর ধরে একটি কাঠের  তোরঙ্গের ভিতর যত্ন করে শাড়িটি রেখে দিয়েছে সুগন্ধী আতর মেখে । আজ বিকালে পরেছিল সেই শাড়িটি।  

কতদিন ধরে বন্দী ঘরে রোগ শয্যায় শুয়েছিল কত কাতরতায়। এখন অনেক ভালো সে। ও নীল আকাশ দেখতে বের হবে। মায়াবতী তাই বলছিল-'তুমি আমাকে হাত ধরে একটি খোলা অটো রিকশায় নিয়ে বসাও। দেখে নিয়ে আসো উদাস কোনো প্রান্তরের উপরের নীল আকাশ।     

আমরা চলে যাই শিয়ালডাঙ্গার মাঠে নীল আকাশের খোঁজে। খুঁজে পেলামও মাথার উপর অসীম নীল আকাশ। সারা আকাশ  জুড়ে শরতের সাদা মেঘরাশি তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। রাস্তার দুপাশে  বিস্তির্ণ কাশবন। অজস্র শুভ্র কাশফুল ফুটে আছে থরে থরে। ঝিরিঝিরি বাতাসে দুলছে পাপড়িগুলো। পথের উপর নেমে খুঁজলাম আমাদের প্রিয় সেই বাবলা গাছটিও। যার তলে বসলে মনখারাপ ভালো হয়ে যায়।      

কত কথা আমাদের গল্পে ছিল। কী অদ্ভুত সন্ধ্যা এসেছিল ভৈরবীর অস্ত রাগে। আজ এখানেও তেমনই নেমে এসেছিল সন্ধ্যা -- গল্পের মতো, রাগ ভৈরবীর মতো । চুপচাপ আঁধার হয়ে আসছিল। পথে কাশবনের ঝাড়ে জোনাকিদের আলো জ্বলে উঠেছিল আর  নিভছিল।  এমন ক্ষণে মন আবার বিষণ্ণও হয়--- ' যে -জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা।'

তবুও মনে কত আশা জাগে , কত স্বপ্ন গাঁথা হয়ে থাকে চিত্রের মতো   .... 

---- রঞ্জন।                        
         
    
৩ আগস্ট, ২০২০ ইং
দক্ষিণখান, ঢাকা।


আরও  চিঠি --

( বারান্দায় বেতের ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে ছিলাম -- দেখি, তুমি দূর রোদ্র মলিন পথ ধরে হেঁটে হেঁটে আসছ আমার দিকে। তোমার আগমনী ছায়া ক্রমশ এগুতে থাকে। তুমি কাছে এসে জড়িয়ে ধরলে আমাকে! তুমি জানো, আমাকে জড়িয়ে ধরলে আমার সমস্ত মনখারাপ ভালো হয়ে যায়।

আসলে এটি ছিল ভ্রম!) 

ম্যাসেঞ্জারে টুং করে আওয়াজ হল। ওপেন করে দেখি লাস্ট মেসেজে লেখা আছে --

রঞ্জন, 

আজ কয়েক দিন ধরে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তোমার খুব মনখারাপ। তোমার মন খারাপ থাকলে আমি আজো এত দূর থেকে তা বুঝতে পারি। এ আমার টেলিপ্যাথিও বলতে পারো। আমি জানতাম, কী করলে তোমার মন ভালো হত। যা করতাম, তা খুব সামান্যই। একদম মূল্যহীন। কোনো দাম দিয়ে কিনতে হত না। আজ আমি এত দূরে যে, তা কোনো দাম দিয়েও করতে পারিনা।

সেদিন জোলারগেসীতে কফিমিকে বসে আমি আর আমার স্বামী কফি খাচ্ছিলাম। সুউচ্চ আকাশ ছোঁয়া ভবন। ঊনপঞ্চাশ তলায় কফি শপটি। কাচের জানালার কাছে বসেছিলাম। বাইরে তখন প্রচুর তুষারপাত হচ্ছিল। গরম কফি খাচ্ছিলাম আর জানালার ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম, দূরের আল্পস পাহাড়। সাদা বরফে ঢেকে আছে শৃঙ্গ। আমার স্বামী তার একটি হাত ধরে রেখেছিল আমার পাঁজরে।

ঐ দূরে ধবল মেঘ ভেসে যায়, তুলোর মতো উড়ে যায়।মন চলে যায় সুদূরে, সাকুরায়। জানালা দিয়ে সেদিন  তাকিয়ে দেখেছিলাম ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল। সেদিন আমি রাখতে চেয়েছিলাম একটি হাত তোমার পাঁজরে। তুমি একটু দূরে সরে গিয়ে দূরত্ব তৈরি করলে! 
আসলে আমি তোমাকে কখনোই বুঝতে পারিনি। মন আর রসায়ন দুটো আলাদা জিনিস। একটি অতৃপ্ত আর একটি তৃপ্ত। একটিকে ছোঁয়া যায়, আর একটিকে ছোঁয়া যায় না। 

তুমি বিচ্ছেদ পছন্দ করতে। বলতে- দূরে থাকলেই  সারাজীবন তুমি আমার হয়ে থাকবে। কাছে এলে আর মুঠো মুঠো নকলা তুলে ভোগ করলে তা সব শেষ হয়ে যাবে।  আর কথায় কথায় তোমার কী এক প্রিয় কবি আছে , নাম ভানু চক্রবর্তী!  তার কবিতা পড়ে আমাকে শোনাতে।

কোথায় থেকে কোথায় গেলাম!  ঐ যে মনখারাপের কথা বলছিলাম! তোমার মায়াবতীর সাথে আমার একবার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ওর সাথে কথা হলে ওকে বলে দিতাম- তোমার মন ভালো করে দেয়ার সিক্রেটটা। 

ব্যস্ততম এই শহরে আমার সকল কর্ম অবসরে হঠাৎ কোনো ফুরসতে তোমার কথা খুব মনে পড়ে। রঞ্জন, তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিয়ে আমার কাছে তুমি চিরকাছের হয়ে আছ এখনও। যেন 'যেথা আমি যাই নাকো, তুমি প্রকাশিত থাকো।' 

কী যে ধরতে ইচ্ছা করছে, কী যে ছুঁইতে করছে তোমার দেবযানীকে। এখানকার 'আমাজন ডট কম' কে বলেছি আমাকে এক কপি দেবযানী সংগ্রহ করে দেয়ার জন্য। ওরা বলেছে -- করে দেবে। 

------ মাধবীলতা।

৭ মার্চ, ২০২০ ইং
ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া। 



( ভিয়েনা শহরে এক ধরনের ঘোড়ার গাড়ি তাদের অনেক পুরোনো ঐতিহ্যকে এখনো ধরে রেখেছে।  ব্যাস্ততম এই শহর এখন অন্য সব যানশুন্য। নির্জন, জনমানবহীন রাজপথে কোথাও কিছু নেই- য়ের মধ্যে করোনা সময়ে যাত্রীহীন এই ঘোড়ার গাড়িই শুধু  দেখা যায়।)

মাধবী লিখেছে --

রঞ্জন,

পৃথিবীর এই অসুখের দিনে তুমি কেমন আছো?
ভালো যে তুমি নেই সে আমি বুঝতে পারি এত দূর থেকেও। তুমি যতই তোমার মনখারাপের কথা গোপন করে রাখো না কেন, আমি বুঝতে পারি -- আমার এই চিরকালের বন্ধুটি ভালো নেই। ঈশ্বর আমাকে এই বোঝার ক্ষমতাটুকু দিয়েছেন।

ঘরবন্দী জীবন আর কত ভালো লাগে, বলো? এই শহর এখন দিনের বেলায় ঘুমিয়ে থাকে। হঠাৎ মাঝে মধ্যে দুএকটি ঘোড়ার গাড়ির খট খট শব্দ কানে বাজে। আর কোনো শব্দ নেই। এই শব্দহীনতার মধ্যে হঠাৎ করুণ স্বরে এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বেজে ওঠে। তখনই মনে হয়, ঐ যানটি কোনো করোনা আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে, না হয় নিয়ে যাচ্ছে কোনো মৃত ব্যক্তির লাশ গ্রেভইয়ার্ডে।

করুণ এই করোনার মধ্যে তোমার কথা খুব মনে পড়ে। এই মনে পড়াটা কোনো সুখেও যায়না, দুঃখেও যায়না। কী এক অনির্বচনীয় বেদনা তুমি আমাকে দান করেছিলে জীবনের প্রথম প্রহরে, তা কোনো কিছু দিয়ে তোমাকে ফেরত দেওয়া হলো না। জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, তারপরও না। এই বেদনার ভার আমাকেই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। 

কোনো কর্ম নেই। যতটুকু কাজ তা শেষ হয়ে যায় ফুড়ুৎ করে। আমার স্বামী আমাকে অনন্ত সময় দেয় অসীম ভালোবাসায়। এই করোনায় একটা জিনিস পাচ্ছি উজার করে তাহলো-- প্রিয়তম স্বামীর আদর সোহাগ। হৃদয় ভরে সব জমা করে নিচ্ছি, খরচ করব তা বাকি জীবন ভরে। এত প্রেম!  তারপরও কোথায় যেন হাহাকার রয়ে গেল।

এখানে এখন সামারকাল। মনখারাপ হলে চুপিচুপি জানালা খুলে দেখি ভিয়েনার নীল আকাশ। এত নীল য়ে, কোথাও একটুও মেঘ নেই। যদি মেঘ থাকত, বুঝতাম সে মেঘের নীচে তোমার মুখখানি লুকিয়ে আছে। কিন্তু এত স্বচ্ছ নীল যে, কোথাও তোমাকে দেখতে পাই না। 

ভাবছি, এই করোনার দহনকাল শেষ হলে প্রথম যাব দানিউব নদীর তীরে। মনটা এত বিবাগী হয়ে উঠেছে যে, ঘরের বাহির হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছি। আমার স্বামীকে নিয়েই যাব। ও ধরে থাকবে আমার হাত, হাঁটব দুজনে সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে নদীর কূল ধরে। শীতল বাতাস মেখে নিব শরীর জুড়ে। দৃষ্টি মেলব অনেক দূর আল্পস্ পর্বতের শৃঙ্গের দিকে। ঐ ধূসর অচলায়তন পাহাড় যে তোমাকে আমার থেকে চিরকালের জন্য আড়াল করে রেখেছে।

তোমাকে দেখার কী যে তৃষ্ণা আমার!
পৃথিবীর এই অসুখ ভালো হোক। যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে একদিন, যদি বেঁচে না থাকি, হবে না। ভালো থেকো তুমি বন্ধু। ঘরে থেকো। একটুও ঘরের বের হবে না।

-----  মাধবী লতা।

৯ এপ্রিল, ২০২০ ইং
ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।


মাধবী 

একজনই তুমি আছ আমার পৃথিবীতে, যে আমাকে বুঝতে পারে একান্ত নিজের করে। যে আমাকে দেখে দূর থেকে অনেক কাছের করে। 

আজ কয়েকদিন ধরেই তোমাকে খুব লিখতে ইচ্ছে করছে।  যা-ই লিখি, তোমাকে পাঠাই না পাঠাই -- কিন্তু লিখতে ইচ্ছে করছে। আজ সকালে দরজা খুলে প্রথম যে রোদ দেখেছিলাম, সেখানে কোনো মেঘের ছায়া ছিল না, স্বচ্ছ ও ঝিলমিল রোদ্দুর ছিল। ধুলিমাখা দুর্বা ঘাসের মাঠের উপরে  একটি শালিক লাফিয়ে চলছিল  এদিক ওদিক।  কোনো শীষ নেই।  সেও কী বেদনাময় একা। সেও কী অভিমানী হয়ে একা একা ঘুরছে ফিরছে? 

তোমাকে লিখতে যেয়ে কিছুক্ষণ লেখা থামিয়ে দেই। বহু বছরের পুরনো একটি কাঠের তোরঙ্গ বের করি। অনেক জীর্ণ অভিজ্ঞান ভরা সে তোরঙ্গ । কয়েকটি বইও আছে। তার একটি "কুর্চি বনের গান"। প্রথম পাতা উল্টাতেই দুলাইনের তোমার লেখা --

"যতবার তোমার কাছে আসতে চাই,
ততবারই আমি দূরে চলে যাই, এত দূরে যাই যে সে এক অসীম অনন্তপুর। 
তুমি কখনোই অত দূরে আসবে না জানি।"

এই বৈশাখের সকালে এত সুন্দর রোদের ভিতর তোমার ছায়া খুঁজতে থাকি। পাতা ঝরে পড়ছিল বৃক্ষরাজি থেকে।  হঠাৎ কেমন বিবাগী মন হয়ে উঠেছে আমার। বইয়ের পাতাগুলো জীর্ণ পাতার মতো  মর্মর করছে। সেই কবেকার এক দুপুরের কথা মনে পড়ছিল --

সেদিন ছিল আমার জন্মদিন। কিন্তু আমার মনে ছিল না। তখন কেউ এইদিন আজকের দিনের মতো করে মনে রাখত না। কিন্তু তুমি মনে রেখেছিলে। তুমি তোমাদের বাসা থেকে পায়েস ও পরোটা করে এনেছিলে। আমার পকেটে একটি টাকাও ছিল না। হলের ক্যানটিনে না ঢুকে সোজা ক্লাসে চলে এসেছিলাম। হেনা স্যারের ক্লাস শেষ করে লাইব্রেরি বারান্দায় দুজন যেয়ে বসি, তুমি পরোটা ছিড়ে ছিড়ে পায়েস পুরে আমাকে দিচ্ছিলে। তারপর খাওয়া শেষে তুমি আমাকে দিলে -- "কুর্চিবনের গান"।

লেখার নীচে তোমার নাম নেই। তুমি আমার কেউ ছিলে না, তারপরও গোপন করে রেখেছিলে তোমার কথা। আমি ছিলাম একটা ইডিয়ট, অনেক গোপনের অর্থ বুঝতাম না। মানুষের অনেক নীরব অভিব্যক্তিও। তারপরও তুমি বলেছিলে সেদিন, কিছু একটা বলো। কিছুই বলিনি সেদিন।  আমি যেটি পারতাম তাহলো কবিতা -- লিখে এনেছিলাম না খাতায়। এমনি মুখে মুখে বলেছিলাম। সব কথা, সব শব্দ আজ আর মনে নেই। অনেকটা এমন ছিল মনে হয় -- নীচের এমনটাই হয়ত বলতে চেয়েছিলাম সেদিন, তা না বলে বলেছিলাম অন্য কথা, অন্য কবিতা ---

" চপল ঢেউয়ের মতো এঁকেবেঁকে
পুষ্প কানন থেকে মাধবীলতা আসলেন 
হঠাৎ সজল বাতাসে উন্মুখ হয়ে উঠল এক ভ্রমর।

মাধবী তার পদ্মযৌবন পাপড়ি মেলে ধরলেন
কোনো বিষাদ নেই, সে যেন উতলা হয়ে আছে
বিস্মরণের এক রমণীর মতো।

বহুকাল পরে ভ্রমর যেন প্রাণ পেলেন মাধবীর পুষ্পিত দেহ বল্লরীর সৌরভে, এবং স্নাত হলেন
তার অন্তঃপুরের সকল ধারায়।"

আজ নিজেকে বলছি স্বগোতক্তি করে -- হে আহম্মক, এই কথা তুই বলিসনি সেদিন। এই কথা বললে কী তোর মাধবী এত দূরে চলে যায়! 

কাউকে ভালোবাসতে চাইলে পরিকল্পনা করে ভালোবাসতে নেই। ভালোবাসা হতে হয় নদীর জলের মতো স্বচ্ছ ও গতিময়। চলবে স্রোতের টানে, ভেসে নিয়ে যাবে, যতদূরেই থাক মোহনা। তবে ভালোই করেছ, আমাকে ভাল না বেসে।   জীবনের কোনো সফল প্রাপ্তি পেতে না তুমি।  এ যে অপ্রাপ্তিতেই গড়িয়ে যেত। তার সব কিছুই আজ মূল্যহীন হয়ে যেত। ভালোই করেছ মূর্খ্যামী না করে। 

মাধুকরীতে বুদ্ধদেব গুহ লিখেছিল --  হুসের মানুষদের কপালে ভালোবাসা জোটে না। যারা হারাবার ভয় করে না কিছুতেই, একমাত্র তাঁরাই ভালোবেসে সব হারাতে পারে। অথবা অন্যদিক দিয়ে দেখলে মনে হয়, যাকিছুই সে পেয়েছিলো বা তাঁর ছিলো, সেই সমস্ত কিছুকেই অর্থবাহী করে তোলে ভালোবাসা। যে ভালোবাসেনি তাঁর জীবন বৃথা। তবুও বড় কষ্ট ভালোবাসায়। এমন মহা বোধ আর কি আছে?"

আজ আর কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না। মন কেমন উড়ো উড়ো লাগছে। জানি না তুমি এখন কী করছ?  আবারও স্বপ্নের কথা চলে আসছে। জীবন মানুষের দুবার আসে না। একবারই আসে ক্ষণকালের জন্য এই মহাকালের পৃথিবীতে। তুমি একবার তোমার একটি চিঠিতে লিখেছিলে, ".... যদি তুমি আসো একবার এখানে -- তোমাকে নিয়ে দানিয়ুব নদীর পাড়ে বেড়াতে নিয়ে যাব। একপাশে আছে পাহাড়, সেই পাহাড়ের ঢালে ফুটে থাকে অজস্র রডোডেনডন গুচ্ছ। আমরা দুজন বিমুগ্ধ হয়ে দেখব নদীর জল, পাহাড় আর রডোডেনডন। "

না গো মাধবী, এই জীবনে আমার আর রডোডেনডন দেখতে ইচ্ছে করছে না।  আজ এই অস্তবেলায় তোমাকে নিয়ে কুর্চিবনে যেতে ইচ্ছে করছে। তুমি জানাইও তোমাদের দানিয়ুব নদীর কূলে কোনো কুর্চিবন আছে কী না? 

ভোরের আলোয় পথ চিনে বেরিয়ে পড়েছি পথে। কোথা' থেকে ভেসে আসছে অচেনা সুবাস, কেমন এক অস্পর্শ ফুল ফুটে আছে কোন্ সুদূরের কুসুম কাননে।
আমি তার আরক্ত পরাগ রেণূতে ছুঁয়েছি ঠোঁট, যেন প্রজাপতি প্রথম পালক রেখে গেল পত্রপল্লবে। এমন লাজুক প্রস্ফুটিত পাঁপড়িতে বসেনি এর আগে কোনও উড়ন্ত মৌমাছি থামিয়ে দিয়ে ডানা, শুষে নিতে পারেনি এর মধুরিমা।

আজ আর কোনো পত্র লেখা হলো না তোমাকে। ভালো থেকো তুমি মাধবী। 

-- রঞ্জন। 
৪ মে, ২০২১ ইং, ঢাকা।



২৪.     প্রথম নিমন্ত্রণ  


আফছার ডাকাত প্রায় ছয় মাস পর আজ তার গ্রামের  বাড়িতে আসলো।  বাড়িতে সবাই জানত -- আফছার একটি কোস্টাল জাহাজে লোডারের চাকুরি করে। কিন্তু আসলে  তা নয়। সে একজন সক্রিয় ডাকাত দলের সদস্য।     

বাড়িতে তার স্ত্রী কন্যা ও মা থাকে। মা বৃদ্ধা।  চোখে ভালো মতো দেখতে পায় না। আবছা আবছা দেখে। সে সারাক্ষণ বারান্দায় ধারীর উপর শুয়ে বসে থাকে। ওখানেই খায়, ওখানেই ঘুমায়।   

আফছারের একটি গুণ -- সে নিজ জেলায় চুরি ডাকাতি করে না। সে করে ময়মনসিংহ ও সুনামগঞ্জের  গ্রাম  অঞ্চলে। বিশেষ করে হাওর এলাকায়। 
নৌকা করে তারা ডাকাতি করে বেড়ায়।  আফছারের যিনি ওস্তাদ, তার বাড়ি হচ্ছে ময়মনসিংহের গফরগাঁও - এ।   

আফছারের স্ত্রীর নাম মায়মুনা। সে গরীবের ঘরের মেয়ে। বাবা দিনমজুর। মায়মুনা  দেখতে বেশ সুন্দরী ছিল। খুব তাড়াতাড়ি কদম্ব ফুলের সুবাস ঝরে পড়তে থাকে তার শরীর থেকে। উষ্ণ নজর পড়ে তার দিকে। ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠা স্বর্ণলতিকার মতো মাত্র  চৌদ্দ বছর বয়সেই মায়মুনার বিয়ে হয়ে যায় এই আফছার ডাকাতের সাথে।  

আফছার অষ্টম শ্রেনী পাশ। সে জাহাজের একজন লোডার। মায়মুনা, তার আত্মীয় স্বজন এবং গ্রামবাসী এমনটাই জানে। আফছার  জাহাজে কাম করে। এমন একটি স্বামী পেয়ে মায়মুনাও  দারুণ খুশি হয়।    

আফছারের মেয়েটির বয়স তিন বছর। নাম পরী। দেখতে পরীর মতো। পরীর দাদী সোহাগ করে নাতনীর নামটি রেখেছিল তাই -- পরী।     

আফছার বাড়িতে আসার সময় ডাকাতি করা টাকা পয়সার  ভালোই ভাগ পেয়েছিল। সব মিলে হাজার সাতেক টাকা সে আনতে পেরেছিল। ট্রেন থেকে    সিরাজগঞ্জ বাহিরগোলা স্টেশনে নেমে  শহর থেকে  সে অনেক কিছুই কেনাকাটা করে। মায়মুনার জন্য ভালো দেখে একটি কমলা রঙের তাঁতের শাড়ি কেনে,  পরীর জন্য জামা কাপড়, জুতা, খেলনা, এবং  মায়ের জন্যেও ভালো একটা  পরনের কাপড় কেনে। তেল সাবান, পাউডার, স্নো, আতরও কেনে মায়মুনার জন্য। 

আফছার  আসার পথে যখন  শৈলাভিটার খেয়াঘাট পার হচ্ছিল, সে তখন দেখতে পায় এক লোক একটি বড়ো তাজা কাতল মাছ বিক্রি করার  জন্য ঘাটে  বসে আছে। আফছার বাড়ির জন্য সেই মাছটিও কিনে নিয়ে আসে।  

মায়মুনা অনেক খুশি। নিজের জন্য, মেয়ের জন্য, শ্বাশুড়ির জন্য নতুন কাপড় পেয়েছে। সে মহাধুম করে কাতল মাছ রান্না করে বেগুন আর নতুন আলু  দিয়ে। রাতে আফছার যখন কাতল মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছিল তখন সে মায়মুনাকে বলছিল, তরকারি খুব স্বাদ হইয়াছে। ফাস্ট ক্লাস রাঁধিয়াছো তুমি মায়মুনা। '                        
           
স্বামীর এমন প্রসংসা শুনে মায়মুনা মিটিমিটি করে হাসতে থাকে।   কেরোসিনের  কুপীর আলোয় তার সেই মুখের হাসিটি কেউ দেখতে পায় নাই। এমনকি  আফছারও না।    

মায়মুনা আজ তার শ্বাশুড়িকেও খুব যত্ন করে কাতল মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ায়। খাওয়ানোর সময় মায়মুনা শ্বাশুড়িকে বলেছিল --
'আম্মা, আপনার ছোয়াল আপনার জন্য একখান শাড়ি কাপড় কিনে এনেছে'।    

রাতে বিছানায় শোবার আগে আফছার পান মুখে দিয়ে  একটি গোল্ডলীফ সিগারেট ধরায়। সিগারেট টানতে টানতে  মায়মুনাকে সে বলছিল -- আমি বাড়িতে থাকি না, তোমার মনে হয় খুব দুঃখ কষ্ট হয়, তাই না?  
 
-- জ্বী। 

-- আমার কথা মনে পড়ে? 

-- জ্বী, খুব পরান পোড়ে।     

-- আমি এবার যেয়ে কিছুদিন পরেই  একেবারে বাড়িতে চলে আসব। ওখানে ঐ কাম কাজ আর ভালো লাগে না। খুব বিপদের কাজ। দরিয়া খুব উত্তাল হয়ে ওঠে। বড়ো বড়ো ঢেউ হয়। আমার শরীর কাঁপতে থাকে। তখন তোমার মুখখানির কথা খুব মনে পড়ে।

-- তুমি অমন বিপদের চাকুরি আর কইরো না। বাড়িতেই চইলা আইসো।    

-- হু। এবার চলে এসে এই গায়ে প্রয়োজনে  কামালা বেইচা খাব। তাও ভালো।        

-- খুব খুশি হইলাম। আমার খুব ভয় করে তোমাকে ছাড়া একা একা থাকতে । তুমি কাছে থাকলে আমার কোনো ভয় লাগব না।      

আফছার মায়মুনাকে জড়িয়ে ধরে। বুকের ভিতর  নিয়ে বলতে থাকে --  তোমার আর কখনও  ভয় পেতে হবে না। আমি  এমন করেই এরপর থেকে আমার বুকের মাঝে তোমাকে  সারা জীবন জড়িয়ে রাখব।    

আফছার সপ্তাহ খানেক বাড়িতে থাকে। সে যখন বাড়িতে আসে তখন তার ওস্তাদ মোবারক মোল্লা তাকে বলে দিয়েছিল -- 'আফছার, তুই তাড়াতাড়ি চলে আসবি। একটা ভালো দাইন আছে সামনে। তরে থাকতে হইব। ভালো ভাগ পাবি।  তুই এবার বাড়ি থেকে ঘুরে আয়। তরে আমি  সাত দিনের ছুটি মঞ্জুর কইরা দিলাম।'     

আফছার যেদিন বাড়ি থেকে চলে যাবে, তার আগেরদিন ছিল হাটবার। সে হাটে  যায়।  হাট থেকে খেজুর গুরের জিলাপি ও বাতাসা কেনে। হাটে ওর খাতিরা এক লোকের সাথে দেখা হয়। তার সাথে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত্রি হয়ে 
যায়।
 
আফছার  যখন বাড়িতে ঢুকছিল সেই মুহূর্তে সে দেখতে পায় --- এক যুবক  মায়মুনার ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল বাড়ির অন্য দিক দিয়ে।  আবছা অন্ধকারে ঐ যুবককে চিনতে পারল না -- যুবকটি কে? কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুধু দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন ভাবছিল সে। 
                                                         
হাটে যাওয়ার আগে আফছার মায়মুনাকে বলে গিয়েছিল -- তুমি আজ নতুন শাড়িটি পরবে। মুখে পাউডার স্নো মাখবে। চুলে দেবে সুগন্ধি নারিকেল তেল। আর গায়ে মাখবে আতর।  আফছার ঘরে যেয়ে দেখতে পেল --  মায়মুনা সেজেগুজে বসে  আছে। ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ।         

মায়মুনা আফছারকে রাতের খাবার খেতে দেয়। কিন্তু সে তেমন কিছু খেতে পারল না। মায়মুনা বলে -- তুমি খাচ্ছ না যে৷!  

---- কাল সকালে তোমাদের ছেড়ে চলে যাব। খুব মন খারাপ লাগছে,  এইজন্য খেতে ইচ্ছে করছে না।   

রাত অনেক হয়ে গিয়েছে তখন। আফছার বলছিল, তোমাকে নতুন কাপড়ে খুব ভালো লাগছে। এসো বুকের মাঝে।'

আফছার মায়মুনাকে  বুকে জড়িয়ে ধরে বলে --তোমার শরীর থেকে কেমন যেন উৎকট, কেমন যেন দুর্গন্ধময় গন্ধ পাচ্ছি।  

-- কেন, আমি তো তোমার দেওয়া আতর মেখেছি গায়ে।  সেই আতরের গন্ধ তুমি পাচ্ছ হয়ত। 

-- হয়ত তাই হবে। আতরের গন্ধটাই খারাপ।তোমার শরীর থেকে পাগলকরা সেই চেনা গন্ধটা পাচ্ছি না। যে গন্ধটা আমাকে মাতাল করে তোলে। আজ তোমার শরীর থেকে কেমন যেন একটা অপরিচিত গন্ধ 
আসছে । 

-- এমন করে বলছ যে ! 

--- এমনি বলেছি।  তোমার শরীর থেকে তোমারই সুগন্ধ পাচ্ছি। চলো না, একটু পুকুর পারে যাই। বাইরে রূপালি চাঁদের রাত।  সারা বিশ্ব জমিন আজ জোছনার চাদরে ঢেকে আছে । চলো -- সেই চাদরের উপর আমরা যেয়ে  শুয়ে থাকি। 

পরী ঘুমাচ্ছে। আফছারের  মা'ও খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সন্ধ্যা রাতেই । দরজা খুলে  দুজন  বেরিয়ে পড়ে। চলে যায় তারা পুকুর পারে।

সমস্ত পৃথিবী জোছনায় ডুবে আছে। কোথা থেকে যেন  কাঁঠালীী চাঁপার মাতাল  গন্ধ ভেসে আসছে। আফছার তার দুই হাত দিয়ে মায়মুনার দুই বাহু চেপে ধরে। এ যেন কাছে পাওয়ার প্রথম নিমন্ত্রণ।   মায়মুনা আবেশে বলছিল -- 
'ওগো তুমি আমাকে বুকে টেনে নাও , আমার বুক থরথর করে কাঁপছে। আফছার বলে -- ''আরও কাছে আসো।'     

মায়মুনা আরও নিবিড় হয়, এবং  বলছিল -- এই ঘাসের উপরে তুমি আমাকে শুয়ে দাও।   তোমার সমস্ত ভালোবাসা এই অলৌকিক  জোছনায় মেখে আমাকে আদর করো, ঢেলে দাও তোমার যত  অনন্ত সুখ । 

আফছারের দুটো হাত তখন মায়মুনার গলা পর্যন্ত চলে গেছে। সে শক্ত কঠিন করে  মায়মুনার গলা টিপে ধরে। তার প্রাণ নিঃস্পন্দন না হওয়া পর্যন্ত সে হাত চেপে ধরেই  থাকে ।

ভোর বেলা সবাই দেখতে পায় -- মায়মুনার নিথর দেহ পুকুরপারে ঘাসের উপর পড়ে আছে। শিশিরে সিক্ত হয়ে আছে তার পরনের কাপড় ও অমল দেহখানি৷ কোনো কোনো ভোর কোমল সুন্দর বিষণ্ণতারও হয়। সূর্যের কাঁচা হলুদ আলোয় মায়মুনার মুখটি রাঙাময় হয়ে উঠেছিল।              

আফছার নেই। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।   
                                                                             
কয়েকদিন পর একটি জাতীয় দৈনিকে ছোট্ট একটি নিউজ হয় তৃতীয় পাতায় -- কলমাকান্দার একটি গ্রামে ডাকাতি করতে যেয়ে গ্রামবাসীর টেঁটার আঘাতে আন্তঃ জেলা ডাকাত সর্দার মোবারক মোল্লা ও তার একান্ত সহযোগী আফছার ডাকাত সহ মোট পাঁচ ডাকাত নিহত হয়েছে। এই ঘটনায় স্থানীয় থানায় একটি মামলা রজ্জু করা হয়েছে।   
                                    


২৫.     আঁধারের গান

 
সেদিন দুপুরের পর থেকেই মনটা ভালো লাগছিল না। কেন যে ভালো লাগছিল না, তারও কোনো কারণ নেই। অকারণে মন খারাপ করে থাকাটা নাকি ফ্যাসানের পর্যায়ে পড়ে।  কৈশরে একবার এমন ফ্যাসান করে  আমি ও আমার বাল্যবন্ধু মুকুল পাকা ধানক্ষেতের পাশে মেঠোপথের ঘাসের উপরে চৈত্রের তপ্ত রোদের নীচে তিন ঘন্টা শুয়ে থেকেছিলাম। উদ্দেশ্য কিছুই না। পাগলামি। ফ্যাসান।  অনেক বছর পরে একবার বাড়িতে গেলে মুকুলের সাথে আমার দেখা হলে ওকে বলি, তোর কী সেই রোদ্রে পোড়ার কথা মনে আছে? 
-- আছে। 
-- আবার ইচ্ছা হয়? 
-- হয়। 
মুকুল এখন রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের অনেক বড়ো কর্মকর্তা।  
                                            
বারান্দায় যেয়ে বেতের ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে থাকি। কত আবোল তাবোল কথা ভাবনায় চলে আসে। আহা,, সৃষ্টিকর্তা যদি আর একবার  পুণর্জন্ম হওয়ার চাঞ্চ দিত। জন্মটা তাহলে কোথায় নিতাম!  পৃথিবীতে কত সুন্দর সুন্দর জায়গা নাকি আছে। বইয়ে পড়েছি। কত ভূসর্গ,, কত নয়নাভিরাম পাহাড়ের পাদদেশ, কত সুন্দর নদীর কুলে গ্রাম, কত শিল্পিত কারুকার্যময়  শহর। সৃষ্টিকর্তাকে বলে কয়ে সেখানে জন্ম নিতাম না হয়। কিন্তু নাহ্, ঐসব স্থানে নয়। জন্ম নিতাম আবার পল্লীর নিবিড় সবুজ সেই কুসুমপুর গ্রামে। আমাদের সেই টিনের চালা ঘরে, হেমন্তের আবছায়া সন্ধ্যা রাত্রিতে। একে একে জ্বলে উঠবে আকাশে সব তারা। ঝিঁঝি পোকার নিভু নিভু আলো জ্বলবে। অদূরে সেদিনও কুলকুল করে বয়ে যাবে যমুনার স্বচ্ছ জল। 

কিছু সময় আসে খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছা করে। যারা সিগারেট খায় তারাই বোঝে ব্যাপারটা। ডাক্তারের মানা আছে সিগারেট খেতে। আর আমার সিগারেট না খেতে দেওয়ার যম হচ্ছে আমার স্ত্রী। থাক্ সেই সব দুঃখের কথা। কখন অপরাহ্ণ হয়ে এল, কখন বাঁশঝাড়ের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর এসে মুখের উপর পড়েছে বুঝতে পারিনি। ট্রাউজার পরে, টি সার্ট গায়ে দিয়ে, পায়ে চপ্পল পরে ঘর থেকে বের হই। স্ত্রী বলছিল -- কোথায় যাও? 
-- স্টেশনের দিক থেকে একটু হেঁটে আসি। 
-- এই অসময়ে? 
-- যার কোনো কাজ নেই তার আবার কিসের সময় অসময়? 
আমার স্ত্রী একটু অসুস্থ। দেখলাম, কথা বেশি বাড়াল না।      

পথের উপরে বিপ্লবের চা'র দোকান। উল্টা পাল্টা গান বাজছে।  বিপ্লব জানে, আমি এইসব গান পছন্দ করি না। আমাকে দেখে ও গান বাজানো বন্ধ করে দেয়। আমি বসি চা'র দোকানে।  বিপ্লব বলছিল -- মামা, 'ওয়ান টাইম' কাপে চা দেই?
-- দাও। 
-- মামা, গান বাজাবো? 
-- বাজাও। 
-- লালন, না আয়নাল বয়াতি? 
-- কোনোটাই না। 
-- তাইলে কী বাজাবো? 
-- লতা।                                                          
‘বরষে ঘন সারি রাত সঙ্গ শো যাও’       

চা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই বিমান বন্দর স্টেশনে। লম্বা প্লাটফরমের উত্তর দিকের শেষ মাথায় বসার বেঞ্চ গুলো  সাধারণত খালি থাকে। আমি ওখানে গেলে যে বেঞ্চে বসে থাকি -- আজ দেখি ' বাউডান্ডা' টাইপের এক লোক ব্যাগ মাথার নীচে দিয়ে সেখানে শুয়ে আছে। দেখে মনে হলো, লোকটা এতক্ষণ ঘুমিয়েছিল, মাত্রই সে জেগে উঠল। আমি বেঞ্চের কাছে যেতেই সে শোয়া থেকে উঠে বসল।    

আমি ওনাকে বলি -- ভাইজান আমি একটু বসি? 
-- বসেন। 
-- ভাইজান, আপনি কোথায় যাবেন? 
-- সিলেট। 
-- সিলেট আপনার বাড়ি বুঝি? 
-- না। শাহজালালের দরগায় যাচ্ছি। 
-- বেশ।      

হঠাৎ আমার চোখে পড়ল লোকটার ব্যাগের পাশে হুমায়ুন আহমেদ-এর 'আধারের গান' বইটি পড়ে আছে। মনে হলো বইটি পড়তে পড়তে সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। লোকটার প্রতি আমার ধারণাটা একটু পাল্টে গেল। আমি ওনাকে বলি -- 'ভাইজান আমি আপনার পরিচয়টা কী একটু জানতে পারি?  মানে আপনার বাড়ি কোথায়, আপনার নাম কী, আপনি কী করেন? '   

-- আমার বাড়ি টাংগাইলের মির্জাপুর। নাম মোঃ আবদুল কাদের, আমি কিছু করি না। ঘুরে বেড়াই, খাই, ঘুমাই। তা আপনি কোথায় যাবেন? 

-- আমি কোথাও যাব না। এই স্টেশনেই এসেছি ঘুরতে।         

-- আপনার সাকিন কোথায়? 

-- দক্ষিণখান। এখান থেকে সামান্য দূর।  মন খারাপ থাকলে এখানে চলে আসি। এসে এই বেঞ্চের উপর বসে থাকি।

-- আপনার কী আজ মন খারাপ? 
-- জ্বী।       
-- কী জন্য মন খারাপ? 
-- তা বলতে পারব না। 
-- আপনি কী ধূমপান করেন? 
-- আগে করতাম। এখন করি না। ডাক্তার ও স্ত্রীর মানা আছে। 
-- একটাও খান না? 
-- বেশি মন খারাপ থাকলে চুরি করে এক দুইটা খাই। 
-- এখন একটা খান আমার সাথে। 
-- আছে? 
-- আছে। 

কাদের আমাকে একটি সিগারেট ওফার করল।  আমি সিগারেটটি ঠোঁটে নিলাম। সে  গ্যাস লাইটার জ্বালিয়ে  ধরিয়ে দিল।  এবং নিজেও একটা ধরালো।    

কাদের সিগারেট টানতে টানতে বলছিল -- ভাইসাব, আপনি কী করেন? 

-- আমি কিছু করি না। 

-- কিছুই করেন না?

-- একটু আধটু লিখি টিখি। আর আমার ছোট মেয়েকে বাংলা পড়াই।  

-- খুব ভালো।

-- আপনি হুমায়ুন আহমেদ- এর বই মনে হয় খুব পছন্দ করেন? 

-- জ্বী। আপনি তো লেখক মানুষ। তা আমার কিছু জীবনের কথা নিয়ে কিছু লিখেন না? 

-- আমার কাজই তো মানুযের জীবন কাহিনি নিয়ে লেখা। তা বলেন, আমি শুনি। 

-- দাঁড়ান। আমি আরও একটা সিগারেট ধরিয়ে নেই।  আপনি কী আরও একটা খাবেন?
 
-- না। আর খাব না। একটা খেয়েছি। তাই প্রতিশ্রুতি অনেকখানি ভঙ্গ হয়েছে। আর বেশি ভঙ্গ করতে চাই না।

আবদুল কাদের তার জীবন কাহিনি বলতে শুরু করল।  আমি ওর জবানেই এখানে লিখলাম। (অবশ্য কিছু পরিমার্জন করেছি। অপ্রয়োজনীয় কিছু অংশ বাদও দিয়েছি।  এবং কিছু সংক্ষিপ্ত করেছি।)    

আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন আমার বাবা মারা যায়। আমার বাবা একজন স্কুল মাস্টার ছিলেন। আমার দুই ভাই ছিলাম। আমি ছিলাম ছোট। আমার বড়ো ভাই আমার দশ বছরের বড়ো ছিলেন। মাঝে একটা বোন হয়েছিল সে জন্মের সময় মারা যান।                                                          
বড়ো ভাই ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কালিয়াকৈরে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান কেরাণীর চাকুরি নেয়। আমার পড়াশুনা ও  আমাদের সংসার চালানোর দায়িত্ব আমার  ভাইটির উপরেই পড়ে। ভাগ্যের এমনই পরিহাস, বাবা মরে যাওয়ার দুই বছর পরে আমার মা'ও এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।    

সংসারে যেহেতু কোনো মেয়ে মানুষ রইল না, তখন আমার ভাইটি বিয়ে করেন। সংসারে ভাবী এসে সংসারের হাল ধরেন। আমার ভাবী আমার থেকে তিন চার বছরের বড়ো ছিলেন। সে আমাকে তার ছোট ভাইয়ের মতো দেখতেন। আদর যত্ন করতেন। সে কখনোই আমার মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেয় নাই।      

আমি যখন বিএ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, তখন আমার ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সে ছিল নিঃসন্তান। তাদের কোনো ছেলে মেয়ে হয় নাই। তবে জানা গিয়েছিল আমার ভাইয়ের সমস্যার কারণে তাদের কোনো সন্তান হয় নাই। 

সবাই ভেবেছিল -- আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর ভাবী আমাদের সংসার ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু যায় নাই। আত্মীয় স্বজন সবাই বলেছিল -- আমাকে বিয়ে করতে। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হয় নাই। সে বলত, আমি কাদেরকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখি। ওকে আমার বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমি এই সংসারে ওর বড়ো বোন হয়ে থাকব।  কোথাও যাব না।      

তাছাড়া, আমারও মত ছিল না। যাকে নিজের বোনের মতো সেই কিশোর বয়স থেকে দেখে এসেছি, যাকে মায়ের আসলে স্হান দিয়েছি। তাকে কী করে বিয়ে করব?  ভাবীর সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাবটা চাপা পড়ে যায়।                                                                              
এই পর্যন্ত বলে আব্দুল কাদের থেমে গেল। আমি বললাম, তারপর কী হলো বলেন। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে -- একটু চা খেতে ইচ্ছা করছে, এবং  সিগারেট।  

আমি একজন ফ্লাস্কে চা সিগারেট বিক্রেতাকে ডাকলাম। কাদেরকে চা খাওয়ালাম। এবং এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিলাম। সে সিগারেট ধরিয়ে বলে -- আপনিও একটা ধরান। বললাম,  দেন।      

আবদুল কাদের আবার বলতে শুরু করল --

আমিও একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানেে ছোট্ট চাকুরি নেই। 
কয়েকমাস কাটছিল ভালোই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আশেপাশের লোকজন নানা গুঞ্জন করতে শুরু করতে লাগল।  একই বাড়িতে দুজন যুবক যুবতী থাকি। নানান জন নানা রসালো কথাবার্তা বলতে থাকে।  কিন্তু আমার ভাবী ছিল নির্বিকার। সে এইসব কানে তুলত না। আমিও খুব একটা তেয়াক্কা করতাম না। ভাবতাম -- নিজে ভালো তো জগৎ ভালো।   
                                                     
কিন্তু প্রকৃতি প্রভাবিত করেছে তার নিজস্ব চিরন্তন নিয়মে। জীবনের অনেক কিছুই এলোমেলো করে দেয় অসম্ভব  সুন্দর কিছু প্রকৃতি। প্রকৃতি জীবনকে যেমন সুন্দর করে, মন ভালো করে, তেমনই আবার জীবনকে তছনছ করে দেয়। কালিমাও মেখে দেয় ।            

সেদিন ছিল হেমন্তের পূর্ণিমার রাত। আমি আমার ঘরে শুয়ে আছি। চোখে ঘুম আসছি না। এমন উদাস করা জোছনা রাতে দুচোখ মুূদে ঘুম আসার কথা।  কিন্তু ঘুম আসছিল না। আমি জানালা খুলে দেখি -- অলৌকিক এক আলোর ভুবন। চারিদিকে মুখর করা জোছনার বন্যায় ভেসে গেছে।  আমি দরজা খুলে উঠোনে চলে আসি। কলপারের পাশে হাস্নাহেনার ঝাড় থেকে আকুল করা গন্ধ ভেসে আসছিল। ঘরের দরজা খোলার শব্দ শুনে ভাবী বের হয়ে আসে উঠানে। সে দেখতে পায় -- আমি উঠানে ফেলে রাখা একটি পুরানো বেঞ্চের উপর বসে আছি। সে বলে -- তুমি এখানে কী করছ? 

-- ঘুম আসছিল না। তাই এখানে এসে বসে আছি। 

ভাবী আমার কাছে এসে বলে -- যাও ঘরে যাও। 

-- তুমি ঘুমাওনি যে! 

-- ঘুম আসছিল না। জেগে ছিলাম। তোমার বের হয়ে আসার শব্দ শুনে আমিও চলে এলাম। 

-- ঘুম আসছিল না কেন? 

-- জানি না। 

ভাবী আমার হাত ধরে বলে -- কাল সকালে তোমাকে উঠতে হবে। অফিসে যেতে হবে। যাও, ঘরে যাও। ঘুমিয়ে পড়ো।                                     
                   
একবার ভাবীর খুব জ্বর হয়েছিল। এত জ্বর যে, ১০৩/৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর। তাকে ঔষধপত্র, পথ্য খাওয়ানো হয়। তবুও জ্বর কমছিল না। আমি সারারাত ভাবীর পাশে বসে থাকি। কপালে জলপট্টি দেই। মাথায় পানি দেই।  জ্বরের দ্বিতীয় রাতেও ভাবীর পাশে বসে থেকে  তাকে সেবা শুশ্রূষা করছিলাম, জলপট্টি দিতে দিতে  কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি নাই। হঠাৎ ভাবীর গোঙানির শব্দ শুনতে পাই। কপালে হাত দিয়ে দেখি -- জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সে অজ্ঞান হয়ে আছে।  আমি কপালে জলপট্টি ও মাথায় পানি দিতে থাকি।  তারপরও জ্বর নামছিল না।  সে অজ্ঞান হয়েই আছে।  কাপড়ে জল ভিজিয়ে সারা শরীরে স্পঞ্জ করে দেই। এবং আস্তে আস্তে একসময় তার জ্ঞান ফিরে আসে। ভাবী দেখতে পায় তার শরীর শীতল এবং জলে ভিজে আছে। পরনে ব্লাউজ অন্তর্বাস কিছু নেই। সে সলজ্জিত হয়। শরীরে জ্বরের উত্তাপ নেই।  তার চোখে মুখে স্নিগ্ধ হাসি তখন।   
                                                                             
আর একদিনের কথা। তখন বসন্ত সময়। সেদিন  হঠাৎ সন্ধ্যারাত থেকেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়। বসন্তের অসময়ের এমন উতল বৃষ্টির সাথে মাতাল হাওয়ায় প্রকৃতিও উতলা হয়ে উঠে। আমি আর ভাবী একই ঘরে খাটের উপর বসে আছি।  টিনের চালের উপর ময়ূরাক্ষী বৃষ্টির ফোঁটা ঝমঝম করে ঝরে  পড়ছে। এমন বৃষ্টির শব্দে হৃদয় বীণায় তখন অন্য গানের সুর। বিদ্যুৎ চলে যায়। সারা ঘর অদ্ভুত আঁধারে ছেয়ে গেছে।  শুধুই আঁধার নয় তখন। তখন আঁধারের গান বাজছিল বৃষ্টি নিশীথে।  আমরা পাপ পুণ্য ভুলে যাই। ভাবী কখনো কী বোন হয়?  দেবর কখনো কী ভাই হয়?  আমরা ভুলে যাই এই সম্পর্ক, এইসব অলিক অনুশাসন।  বৃষ্টির সুরে জলের নুপুরে আর আঁধারের গানে আমাদের দুটো প্রাণ একাকার হয়ে যায়। 
                                                                           
আবদুল কাদের এই পর্যন্ত বলে আবার থেমে যায়। আমি ওনাকে বলি -- থামলেন কেন?  বলেন।  সে আরও একটি সিগারেট ধরায়। এবং জোরে শ্বাস নিয়ে  সিগারেট টানতে থাকে।  একটু দম নিয়ে সে বলতে থাকে আবার ---

একসময় বৃষ্টি থেমে যায়।  আমি চলে যাই আমার ঘরে। সকালে ঘুম ভাঙ্গে একটু দেরিতে।  ঘুম থেকে উঠে দেখি -- ভাবীর ঘরের দরজা খোলা।  ভিতরে সে নেই। এবং কোথাও সে নেই। লজ্জায় আর গ্লানিতে সে সেই রাত্রিতেই  নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।   
                                                                               
আমি আবদুল কাদেরকে বলি -- তারপর ওনার আর কোনো খোঁজ পাননি? 
--- পেয়েছিলাম দশ বছর পর। 
--- বলুন কী ভাবে?  
--- একদিন একটা চিঠি পাই।  অজ্ঞাত কেউ একজন লিখেছিল।  চিঠিটা এইরূপ ছিল --

জনাব,  
আমি চট্টগ্রাম থেকে লিখছি।  সাহানা নামে কোনো একজন মহিলা সম্ভবত সে আপনার আত্মীয় হয়।সে এতদিন তার পরিচয় গোপন রেখেছিল। এই মেয়েটি আমাদের বাসায় ঝিয়ের কাজ করত। গত একবছর ধরে তার লিভার সিরোসিস রোগ হয়েছে। আগামী ২৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার একটি জটিল অপারেশন হবে। সাহানা কেঁদে কেঁদে বলছিল আপনার কথা। সে আপনাকে দেখতে চায়। পারলে আপনি চলে আসবেন। 
ইতি -- ইকবাল হাসান চৌধুরী।     
                                                                            
হাতে সময় ছিল না। তারিখ মিলিয়ে দেখলাম ---আগামীকাল সকাল দশটায় অপারেশন। রাতের ট্রেনেই চলে যাই চট্টগ্রামে। হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল এগারোটা বেজে যায়।   
                               
হাসপাতালের বারান্দায় দেখি কয়েকজন নারী পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে ইকবাল সাহেবও ছিলেন। আমি তাকে আমার পরিচয় দেই। ইকবাল সাহেব আমাকে বলেন -- সাহানা আপনার কী হয়?  আমি বলি -- আমার ভাবী হয়। 

অপারেশন থিয়েটারে তখন অপারেশন চলছিল। আরও ঘন্টা দেড়েক পরে একজন সহকারী সার্জন বের হয়ে এসে বলেন -- আমরা দুঃখিত, রোগিণীকে বাঁচানো গেল না।                                   
                           
আমি ডাক্তার সাহেবকে বলি -- ওনার কী জ্ঞান ফিরেছিল না ? 

-- ফিরেছিল তিরিশ সেকেন্ডের মতো। 

-- কোনো কথা বলেনি?    

-- বলেছিল, অস্ফুট স্বরে একটি শব্দ ! 

-- কী সেই শব্দ? 

-- ' কাদের। '      
      
          
কাদের তার জীবনের কাহিনি বলা থামিয়ে দেয়। চেয়েে দেখি -- তার চোখে জল। 

সিলেট গামী ট্রেনটি ততক্ষণে প্লাটফরমে ঢুকে পড়েছে। সে দ্রুত আমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে যেয়ে ওঠে। বেঞ্চের উপর সে ফেলে রেখে যায় ' আধারের গান '।    

 
২৬.          নীলাঞ্জনা


ফরিদুল ইসলাম অফিস থেকে যখন বাড়ি ফিরলেন তখন রাত্রি এগারোটা বেজে গেছে। ক্লান্ত পায়ে  হেঁটে  সিড়ি বেয়ে তিনি দোতালায়  উঠলেন। তালা খুলে ঘরে ঢুকেই তিনি দেখলেন, ঘর ভর্তি অন্ধকার।    

সকালবেলা ঘর থেকে বের হবার সময় মনের ভুলে জানালাটা সে খুলে রেখে গিয়েছিল।  খোলা জানালা দিয়ে বাইরের ল্যাম্প পোস্টের নিওন আলো এসে পড়েছে ঘরে। সেই আলো দেখে তিনি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন। ঘুমাবার জন্য তিনি শুয়ে থাকলেন না।  এমনিতেই শুয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। 

একটুপর বিছানা থেকে উঠে কাপড় চেঞ্জ করে সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে তাকিয়ে  দেখতে পেল -- আকাশ ভরা আজ তারা নেই। চাঁদ নেই। সজল বাতাস নেই।  শ্রাবণের মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ । ল্যাম্বপোস্টে জ্বলে থাকা বাল্বের চারপাশে উইপোকা ভিনভিন করছে।   
                       
বাইরে থেকে আসার সময় তিনরাস্তার মোড়ে  হেমায়েতের হোটেল থেকে দুটো তন্দুরি রুটি খেয়ে এসেছে। ইজি চেয়ারটা জানালার কাছে টেনে নিয়ে বসে তিনি একটি সিগারেট ধরালেন। সিগারেট টানতে টানতে ফরিদুল ইসলাম  ভাবছিলেন জীবনের অনেক কথা।
  
বাবা মরে গিয়েছিল একদম শিশু বয়সে। মা আর বিয়ে করেনি। ফরিদ' রা স্বচ্ছল ছিল না মোটেই। গ্রামের বাড়িতে কিছু জমিজমা ছিল। ফরিদের মা তাই থেকে কষ্ট করে ওকে লেখাপড়া করিয়ে বিএ পাশ করান।

ফরিদ একটি চাকুরি পায় রাবার  মিলে। চাকুরি পাওয়ার পরপরই ফরিদের মা ফরিদকে বিয়ে করায়। মেয়ে তখন নবম শ্রেণিতে পড়ছিল। গ্রামের মেয়ে। দেখতে সুন্দরী। মাথা ভর্তি কালো চুল। গায়ের রং গৌরীয়। টানা টানা চোখ। মেয়েটি ফরিদের মায়ের ফুপাত ভাইয়ের মেয়ে। মায়ের পছন্দেই ঐ মেয়েটাকেই ফরিদ বউ করে ঘরে নিয়ে আসে।            
                             
মেয়েটির নাম মোছাঃ  নীলা বেগম। 

বিয়ে করার পর নীলা বেগমকে ফরিদ  গ্রামের বাড়িতে মায়ের কাছেই রেখেছিল  কিন্তু ছয়মাস না যেতেই ফরিদের মা অকস্মাৎ তিনদিনের জ্বরে ইন্তেকাল করেন। ফরিদ নিরুপায় হয়ে তার বালিকা বউকে টংগীতে তার কাছে  নিয়ে আসে। টংগীর মধুমিতা রোডে দেড় রুমের একটি আধাপাকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে বসবাস করতে   থাকে।

ছোট সংসার। ফরিদ আর নীলা টংগী বাজারে যেয়ে ঘরের সব জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসে। একটি কাঠের খাট, একটা আলনা, চেয়ার টেবিল, লেপ তোশক, বালিশ, হাঁড়ি পাতিল সব।  ঘর সাজাতে সাজাতে নীলা ফরিদকে  বলেছিল -- 'ওগো তুমি একটা ছোট্ট বাড়ি করে দেবে না আমাকে?  আমি মনের মতো করে আমার সেই বাড়িটি সাজাব।'  ফরিদ বলেছিল -- তোমার বাড়ি হবে একদিন। তুমি তোমার মতো করে সে ঘর সাজিয়ে নিও।   
                                  
আর একদিন নীলা ফরিদকে বলে --  তুমি আমাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে? আমি সিনেমা দেখব।

 --- আচ্ছা, দেখাতে নিয়ে যাব। 

ফরিদ আনারকলি সিনেমা হলে নীলাকে নিয়ে গিয়ে একদিন  ' মনের মাঝে তুমি '  সিনেমাটি দেখিয়ে নিয়ে আসে।   

ছোট বাচ্চাদের মতো নীলা ফরিদের কাছে প্রায়ই  বিভিন্ন আবদার করতেই থাকে।  

আর একদিন নীলা বলছিল -- 'আমি চিড়িয়াখানা  দেখব। তুমি আমাকে চিড়িয়াখানা দেখিয়ে নিয়ে আসো।'  ফরিদ নীলাকে মিরপুরে নিয়ে গিয়ে চিড়িয়াখানাও দেখিয়ে নিয়ে আসে। 

আর একদিন ফরিদ অফিস থেকে এসে দেখে -- নীলা কোনো রান্না করে নাই।  ফরিদ নীলাকে বলে, রান্না করোনি যে। 

-- আমি আজ হোটেলে বসে খাব। আমাকে তুমি হোটেলে নিয়ে যাও। 
কী করবে ফরিদ ! অগত্যা  নীলাকে হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়ায়ে নিয়ে আসে।

আর একদিন অফিস থেকে ফরিদ এসে দেখে -- নীলা সেজেগুজে শাড়ি পড়ে বসে আছে। ফরিদ বলে, তুমি সেজেছ যে ! 

-- আমার ইচ্ছা করছিল খুব সাজতে।  তাই সেজে বসে আছি।  কেমন লাগছে আমাকে? 

-- খুব ভালো লাগছে তোমাকে । একদম চাঁপা ফুলের মতো।      

আর একদিন অফিস থেকে ফরিদ এসে দেখে নীলা বাসায় নেই।  নেই তো নেই কোথাও নেই। আশেপাশে বাসার সবাইকে  জিজ্ঞাসা করে। তারাও কেউ কিছু বলতে পার না। গ্রামের বাড়িতে এবং আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে খোঁজ খবর নেয় -- কোথাও নীলা যায় নাই।   

ফরিদ টংগী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে। তারা বিভিন্ন সূত্রে নীলাকে খোঁজাখুঁজি করে। পুলিশও কোনো হদিস করতে পারেনি নীলা কোথায় আছে। সে জীবিত আছে,  না সে মরে গেছে।                 

এরপর পাঁচ বছর চলে গেছে।  নীলাকে কোথাওে  খুঁজে পাওয়া যায়নি। নীলাকে হারিয়ে ফরিদ আর বিয়ে করেনি। চাকুরিতে সে মোটামুটি  সুনাম করেছে।  টংগীর মধুমিতা এলাকাতেই সে দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে একাই থাকে। ভাড়া  বাড়িটি তিনি সামনের মাসের এক তারিখে  ছেড়ে দিবে। গাজীপুরের শিমুলতলীতে জায়গা কিনে সে ছোট্ট একটি  বাড়ি করেছে। বাড়ির নির্মাণ কাজ সবে শেষ হয়েছে। ফরিদ তার নতুন বাড়িতেই উঠবে।         

ফরিদের খুব ইচ্ছা করছে তার এই ছোট বাড়িটার একটি নাম দিতে।  এই জগতে তার আর আপন কেউ নেই যে, তাদের কারোর নামে বাড়িটার  নাম দেবে।    সে রুমের ভিতর পায়চারি করছিল, আর ভাবছিল অনেক কথা। 

সে আবার জানালার কাছে যায়। আকাশ পানে চেয়ে দেখে, মেঘগুলো সরে গিয়েছে। একফালি চাঁদ দেখা দিয়েছে।  মনে পড়ে নীলার কথা। নীলা বলেছিল --   'ওগো তুমি একটা ছোট্ট বাড়ি করে দেবে না আমাকে?  আমি মনের মতো করে আমার সেই বাড়িটি সাজাব।'  

মাসের পহেলা তারিখেই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে জিনিসপত্র  নিয়ে শিমুলতলীর নতুন বাড়িতে গিয়ে ফরিদ ওঠে। কাকতালীয় ভাবে এইদিনই তাদের বিয়ে বার্ষিকী  ছিল।  খুব বেশি জিনিসপত্র নাই।  নীলা থাকতে যা কিছু কেনা হয়েছিল তাই-ই শুধু আছে --  একটি কাঠের খাট, একটা আলনা, চেয়ার টেবিল, লেপ তোশক, বালিশ, হাঁড়ি পাতিল।আর আছে একটি ট্রাঙ্ক, যার ভিতর নীলার এবং তার নিজের  কাপড় চোপড় রয়েছে। নীলার হালকা কয়েকটি গহনা ও বিয়ের শাড়িটাও ট্রাঙ্কে আছে।  নীলা যেখানেই যাক, যেভাবেই যাক, যাবার সময় সে এক কাপড় পরে চলে গিয়েছিল। কিছুই নেয় নাই। 
 
ফরিদ নতুন বাড়িতে যাওয়ার সময় টংগী থেকে ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড লিখে নিয়ে যায়।  সেই সাইনবোর্ডটি বাড়ির গেটের সামনে সে লাগিয়ে দেয়।  সাইনবোর্ডে বাড়িটির নাম লেখা আছে -- 'নীলাঞ্জনাা '।   

'নীলাঞ্জনা' বাড়িটা খুব নিরিবিলি।  আশেপাশে তেমন বাড়িঘর নেই,  চারদিকে ছায়াবীথিতে ঘেরা।  ফরিদ দুপুরে টংগীর এক  হোটেল থেকে খেয়ে  গিয়েছিল -- তারপর আর খায়নি।  এখানে আশেপাশে কোনো খাবার হোটেলও নেই। নতুন বাড়িতে সে কোনো কিছু রান্নাও করে নাই।  আসবাবপত্র এলোমেলো ভাবে মেঝেতে পড়ে আছে। সেগুলোও সে সাজায় নাই।  

একসময় সন্ধ্যা নামে নীলাঞ্জনাায়।  রাত হলো।  খাটটা জানালার পাশে পাতা ছিল। তোশকটা কোনো মতো বিছিয়ে ক্লান্ত ও অভুক্ত দেহ নিয়ে সে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘরে আলো জ্বালায়নি।  জানালা দিয়ে নবমীর চাঁদের আলো বৃক্ষপল্লব  ভেদ করে তার মুখের উপর এসে পড়ে।  ঐ মধুবন্তী চাঁদ, এই জোছনা, ঝিরিঝিরি কোমল স্পর্শের এই হাওয়ায় ফরিদের চোখে  ঘুম এসে যায়।  এবং সে ঘুমিয়ে  পড়ে। 

রাত তখন মধ্য প্রহর।  কে যেন তাকে ডাকছে -- 'ওগো তুমি ওঠো, চোখ মেলো। দেখো চেয়ে তুমি!  দেখো আমি এসেছি।'  ফরিদের ঘুম ভেঙে যায়। সে দেখতে পায় -- নীলা তার শরীর ছুঁয়ে বসে আছে তারই পাশে । কাঁদছে অঝোর ধারায়।  তার পরনে বিয়ের দিনের শাড়ি, গলায় তার মায়ের দেওয়া  মালাখানি,  হাতে চুড়ি, কানে ঝুমকা দুল। পা দুটো আলতা মাখা। কপালে  টিপ। নীলাকে আজ সেই বাসর রাতের মতো দেখতে লাগছে।     

নীলা বলছিল -- এমন করে কেউ নিজেকে কষ্টে রাখে। সময়মতো না খেয়ে শরীরটা কী করেছ !  আমি নেই দেখে তুমি এমন পাগলামি করবে?  কেউ কী চিরদিন থাকে নাকি?  কেউ না কেউ আগে চলে যায়। ওঠো লক্ষীসোনা,  আমি খাবার রান্না করেছি খেয়ে নাও।  

নীলা আরও বলে -- কী সুন্দর বাড়ি করেছ আমার জন্য।  নাম দিয়েছ নীলাঞ্জনাা।  আমি কী যে খুশি হয়েছি।  তুমি তোমার  কথা রেখেছ। ওঠো জান আমার। খেয়ে নাও। তুমি খেয়ে নিলেই  ঐ বারান্দায় যেয়ে দুজন দাঁড়াব। আকাশে এখনও নবমীর চাঁদ জ্বলছে। আমরা দেখব নক্ষত্রের রাত আধো 
অন্ধকারে।  

ফরিদ নীলাকে বুকে জড়িয়ে বলে -- ' বলো, তুমি -- কখনও আমায় ছেড়ে তুমি আর  চলে যাবে না।' 

--- আমাকে তুমি নেবে আবার ! তোমার নির্মল 
দেহ, কী করে তোমাকে ছুঁই !  আমি যে নরকে থাকি। নরকের শকুনরা আমার দেহের  রক্ত মাংস চেটেপুটে খায়।  আমাকে যদি চাও -- তবে  এই অভাগীকে....     
'খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে;
যেখানে রব না আমি, রবে না মাধুরী এই,
রবে না হতাশা,
কুয়াশা রবে না আর- জনিত বাসনা নিজে---বাসনার মতো ভালোবাসা.....
খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।’

ফরিদের স্বপ্নটা ভেঙে যায়।  নয়নের কোণে বিন্দু বিন্দু জলগুলো তখন  অঝোর ধারায়  ললাট পথগামি।    
 

         

২৭.            এক চন্দ্ররাত্রির কথা 



চরের নাম খানুরবাড়ি। এটি যমুনা নদীর একটি দূর্গম চর। সেই কত বছর আগে যমুনা বক্ষে এই চর জেগে উঠেছিল, কেউ বলতে পারে না। একসময় এই চর ধু-ধু বালুতে খা-খা করত। তারপর এখানে কাশবনে ছেয়ে  যায়। প্রতি হেমন্তে সাদা ফুলের সৌন্দর্যে ভরে উঠত চরের প্রাঙ্গণ। কিছু সৌন্দর্য তার অবলোকন করত দূরগামী লঞ্চের যাত্রীরা। আর কিছু এর শোভা  উপভোগ করত গয়না নৌকায় পারাপার হওয়া মানুষেরা।

কালক্রমে এই চরটিতে  নদী ভাঙনের ঘরহারা কিছু জেলে এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। এর সংখ্যা বিশ পঁচিশ ঘর জেলে পরিবারে দাঁড়ায়। ওরা বন্যা, জল জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা করে এখানে  বসবাস করে আসছে সে অনেক বছর যাবৎ। 

এই চরে যে জেলেরা বসবাস করে তারা সবাই নিম্ন বর্ণের হিন্দু শ্রেণির। এরা যমুনা থেকে মাছ ধরে নদীর ওপারে বিভিন্ন হাট বাজারে গিয়ে বিক্রি করে। এদের চলাচলের একমাত্র বাহন হচ্ছে ছোট ডিঙি নৌকা। এরা খুবই গরীব। খুবই দুঃখ দূর্দশার জীবন এদের। এবং সবাই অশিক্ষিত। 

সব অশিক্ষিতের ভিতর এই চরের জগাই মাঝির ছেলে কার্তিক একমাত্র শিক্ষিত ছেলে। কার্তিক ভূয়াপুর ইব্রাহিম খাঁ কলেজে বিএ পড়ে।  জগাই  মাঝি খুব কষ্ট করে ছেলেটাকে লেখা পড়া করায়। খানুরবাড়ি  চরে কোনো স্কুল নেই।  জগাই মাঝি  নিজে ডিঙি নৌকা বেয়ে  চর গাবসারা স্কুলে আনা নেওয়া করে ছেলেকে পড়িয়েছে। কার্তিক এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়। ভূয়াপুরে একটি দোকানে গোমস্তার কাজ করে, এবং সেখানে থেকে কলেজে ক্লাস করে।  ছুটিতে বাড়ি এলে সে বাবাকে সাহায্য করে।  নদীতে যেয়ে মাছ ধরে এবং  ডিঙি বেয়ে হাট বাজারে যেয়ে মাছ বিক্রি করে। যখন কার্তিক এসব করে তখন আর তাকে ছাত্রের মতো মনে হয় না।  মনে হয় কার্তিকও একজন জেলে। 

ছেলেটি খুবই লক্ষী। দেখতেও খুবই সুন্দর। চরের সবাই  ওকে পছন্দ করে এবং ভালোবাসে। জেলে পুঞ্জির নিতাই হালদারের মেয়ে কমলা কার্তিককে খুব পছন্দ  করে। কমলার নাম কমলা হলেও ওর গায়ের রং ছিল কালো। সে ছিল উঠতি যৌবনের।  ভরা বর্ষা মাসের উদ্দাম  যৃুমুনার মতো ডবকা শরীর গঠন তার। 

কমলা কার্তিককে দাদা ডাকত। একদিন চরের বালুকাবেলায় কার্তিক ছেঁড়া জাল সেলাই  করছিল। কাছাকাছি কেউ নেই। আষাঢ়ের রোদ্দুর এসে পড়ছিল কার্তিকের উদোম গায়ে। ওর শরীরের ধবল চামড়া চিকচিক করছিল। কমলা কার্তিকের কাছে চলে এসে পিছনে দাঁড়িয়ে ডাক দেয় -- কার্তিক দাদা। 
-- কী। 
-- তুমি আমাকে পছন্দ করো না? 
-- করি। 
-- আমাকে ভালো বাসো না? 
-- বাসি। 
-- আমাকে বিয়া করবা না? 
-- না। 
-- আমি দেখতে কালো এই জন্য? 
-- না। 
-- তো কী জন্য ? 
-- তোকে বিয়া করব এই কথা ভাবি নাই কখনও।
-- তোমার ছেলেবেলার কথা মনে নাই?
-- কী কথা? 
-- আমাদের খেলার সাথীরা খেলার ছলে তোমার সাথে আমার বিয়া দিয়েছিল। মাটির সিঁদুর তুমি আমাকে সিঁথিতে পরিয়ে দিয়েছিলে? মনে  নাই? 
-- ওটা ছিল খেলার ছল। 
-- কাশবনের আড়ালে আমাদের বাসর ঘর হয়েছিল,  মনে আছে তোমার ? 
-- খেলাঘরের বাসর। ভেঙে গেছে তা। 
-- তুমি আমার মন ভাঙতে পারো নাই। আমি সে কথা মনে রেখেছি। তুমি আমার মন ভেঙে দিওনা। 
-- আমার কিছু মনে নাই।  তুই এখান থেকে চলে যা। আমাকে  কাজ করতে দে। 

কমলা চলে যায়। 

আর একদিন  সন্ধ্যায় কার্তিক চরে নদীর কুলে কাঁকড়া ধরতে যায়। কমলা তা দেখতে পায়।  অনেক সময় গড়িয়ে যায়, কার্তিক আর ফেরে না। আস্তে আস্তে রাত হতে থাকে।  আকাশে ত্রয়োদশী চাঁদ ওঠে।  কমলা চুপিচুপি ঘর থেকে বের  হয়। সে কার্তিকের খোঁজ করে। রাতের নির্জনে চলে যায় যমুনা কুলে। পথে বন্যার মতো ফিরকি দিয়ে  পড়ছিল চাঁদের আলো। কমলা সে আলোয় পথ চিনে চলে যেতে থাকে নদীর কুলে। সে দেখতে পায় কার্তিক বাড়ির দিকে ফিরে আসছে। কমলা কার্তিকের পথ রোধ করে দাঁড়ায়।  কার্তিক কমলাকে বলে -- তুই এখানে? 
-- আমার ভালো লাগছিল না। তাই তোমাকে খুঁজতে  চলে এসেছি।
-- চল্ বাড়ি চল্। 
-- না, যাব না। 
-- পাগলামি করিস না। 
-- আমাকে মেরে দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে আসো। 
-- চল্ কমলা! 
-- এই রাত, এই জোছনা, আমার এই দেহ তোমার। তুমি নাও। 
-- না। 
 -- না, তোমার সব নিতে হবে। 

কার্তিক সেদিনের সেই সন্ধ্যা রাত্রিতে শিউলি ফুলের মতো স্নিগ্ধতাময় চাদের আলো আর কমলার উদ্দাম দেহ কোনোটাই উপেক্ষা করতে পারেনি। 

সে রাতে কার্তিক ঘরে ফিরতে ফিরতে কমলাকে বোঝায়েছিল -- এসব কিছুই মনে রাখিস না কমলা। সবই ক্ষণিক আনন্দ।  তুই আমাকে ভুলে যাস্। 

কয়েকদিন পর কার্তিক ভুঁয়াপুর চলে যায়। ওখানে ওর কলেজ খুলে যায়। কার্তিক পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে। তারপরও প্রায়ই মনে পড়ে কমলার কথা। মনে পড়ে তার এক উদ্ভাসিত চন্দ্র রাত্রির কথা।  দুরে থিরথির করে কাঁপছে  যমুনার জল। গন্ধ আসছিল জীর্ণ পঁচে যাওয়া কাশবনের পাতার ঘ্রাণ। সে ভাবছিল --- কমলা সত্যি কী কালো?  শরীর বৃত্তের কোনো কিছু আমি কালো দেখিনি তার । ভিতরের আনন্দ ধাম সব একই রকম। কালো গোলাপ আর শুভ্র-প্রস্ফুটিত গোলাপ দুটোর সুবাস একই। দুটোই সেদিনের সেই ত্রয়োদশী বিচ্ছুরিত জোছনার মতো পুন্যময়। 

প্রায় মাস দুয়েক পর কার্তিক খানুরবাড়ি চরে ফিরে আসে। ফিরে এসে প্রথম ওর মায়ের কাছে থেকেই জানতে পারে কমলার বিয়ে হয়ে গেছে।  খানুরবাড়ির চর থেকে একমাইল দুরে চর তেতুলিয়ার সুখেন মাঝি কমলাকে বিয়ে করে নিয়ে গেছে। সুখেন মাঝির আরও দুই বউ আছে।  বয়স তার পঞ্চাশোর্ধ্ব। 

কার্তিকের মা কার্তিককে বলে -- তুমি  স্নান করে আসো, খেয়ে নাও। 

কার্তিক স্নান করে এসে খেতে বসে। কিন্তু  পুরো ভাত খেতে পারল না। সে হাত ধুয়ে ঘরের ভিতর চোকিতে যেয়ে  শুয়ে পড়ে। সে ভাবছিল -- আমার কেন কমলার জন্য মন খারাপ লাগছে। আমি তো ওকে কখনোই ভালোবাসি নাই। কবে কোন্ এক সন্ধ্যা রাত্রিতে অসংখ্য তারার আকাশের নীচে, উচ্ছ্বসিত জোছনায় ভিজে একজন সামান্য কালো মেয়ে আমাকে না হয় একটু জৈবিক আনন্দ দিয়েছিল, আনন্দ তো আনন্দই -- ফুরিয়ে গেছে তা।  এই নিয়ে মনখারাপের কিছু নেই। এ তো আর প্রেম নয়। ওকে কী আমি হারিয়েছি? আফসোস করব না নির্বোধের মতো। 

বিকালে একাকী চরের মধ্যে কার্তিক হাটঁতে বের হয়। হাঁটতে হাঁটতে সে চলে যায় নদীর কুলে। নদীর তীরে বসে কিছুক্ষণ জলের ধ্বনি শোনে। কিন্তু  ভালো লাগছিল না জলের শব্দ।  উঠে চলে যায় বালুচরের তীর ধরে আরও  দুরে। চরের শেষ মাথায় একটি ছোনের কুঁড়ে ঘর দেখতে পায়। সেখানে ঘরের দুয়ার ধরে একটি যুবতী  জেলে বউ একাকী দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ব্লাউজ নেই। শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছে বুক।  কার্তিক তাকে চিনতে পারে না। যুবতী জেলে বউটি  কার্তিককে বলে -- তুমি আমাকে চিনতে পারছ না ঠাকুর পো?  আমি তোমাদের জুরান মাঝির 
বউ। 

-- ও আচ্ছা। চিনতে পারছি। তা জুরান দাদা কোথায়? 
-- সে মাছ বিক্রি করতে গঞ্জে গেছে । 
-- আচ্ছা, যাই। 
-- আসো না ঠাকুরপো ঘরে, এসে বসো। পান খেয়ে যাও। 
-- পান খাই না আমি । 
-- কাচা ডাঁসা পিয়ারা আছে। দুটো পিয়ারা খেয়ে যাও। 
-- পিয়ারাও খাই না। যাই। 

কার্তিক বাড়ির দিকে ফিরে আসে। পথে  ফিরতে ফিরতে সেদিনের মতো আজও রাত হলো। কিন্তু আজ আকাশে কোনো চাঁদ নেই।  কিছু তারা জ্বলছে একাকী বিচ্ছিন্ন ভাবে। আজ আর কেউ এসে পথের মাঝে পথ রোধ করে দাঁড়াল না।  বলল না -- 'ঘরে ফিরে যাব না।'  সেই একই পথ, একই বালিয়াড়ি। ঝিঁঝি ডাকছে সেদিনের মতোই। কী এক শুন্যতা চারদিকে।  মানুষের জীবনের ফেলে আসা দুএকটি আনন্দময় ক্ষণ এত বেদনার হয়ে ফিরে আসে?  

ঘন হয়ে রাত নামে আরও গভীর হয়ে।  সারা চরাচর আঁধার করে আকাশ যেন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। একি ! হৃদয় তন্ত্রীতে এ কেমন ব্যথার প্রদাহ হচ্ছে , দুচোখ বেয়ে কেন এমন জল বয়ে পড়ছে আমার। ভাগ্যিস এই রাত গভীর অন্ধকারে ঢাকা।  তাই এই জল কেউ দেখতে পেল না !

তারপর চলে গেছে পাঁচটি বছর। কার্তিক ইতোমধ্যে  বিএ পাশ করে  একটি সরকারি চাকুরিতে ঢোকে। ওর বাবা স্বর্গীয়  হয়ে যান। সে জেলে পেশা ছেড়ে দিয়ে মাকে নিয়ে চিরদিনের জন্য ঢাকায় চলে যায় । বিয়েও করে সে। ঘরে তার রূপময়ী স্ত্রী আছে।

এই শহরে বসে এখনও সে শুনতে পায় দুরের যমুনার কলকল জলের ধ্বনি। ছোট ডিঙি নৌকা বেয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছে মাঝ নদীতে। হয়ত এখনও খানুরবাড়ি চরে  প্রতি হেমন্তে কাশফুল ফুটে থাকে। হঠাৎ কখনও সব জলের শব্দ স্তব্ধ হয়ে যায় -- একটি কালো মেয়ে মলিন কাপড় পরে কাশফুল সরিয়ে সরিয়ে ঘাটের দিকে চলে আসছে -- সে হয়ত অপেক্ষায় থাকে কোনো এক জেলের ছেলে ডিঙি নৌকা ভাসিয়ে চলে আসছে এই চরে, এই ঘাটে ! 

ওই পুণ্যসলিলা যমুনা নদী, ওই শুভ্রনীল  দিগন্তরেখা,  ঐ কাশবনে এখনও হয়ত সেদিনের সেই ত্রয়োদশী চন্দ্রের স্নিগ্ধতার মতো রাত্রি নামে। কার্তিকের  জীবনে কমলা একটা মধুর স্বপ্নের মতো। বেদনায়, স্মৃতিতে, অনুভূতিতে নীরব দীর্ঘশ্বাসের মতো। নাহ্ -- এই সবই তার কোনো ভ্রম না।


২৮.      রুপালী আলো


রফিক লোকটা আদতে একটা খচ্চর। বয়স পয়ত্রিশ হবে। এই পর্যন্ত বিয়ে করেছে পাঁচটা। প্রথম চার বউ ছেড়ে চলে গেছে।  বর্তমানে যে বউ আছে -- ওর নাম রুপালী। বছর খানেক আগে রুপালীর বিয়ে হয়েছে এই খচ্চর রফিকের সাথে।  এখনও এই বিয়েটা  টিকে আছে। 

রফিক অটো চালাত রাজেন্দ্রপুর মাস্টার বাড়ি এলাকায়। রুপালীর সাথে ওর প্রথম দেখা এই অটো চালাতে গিয়ে। রুপালী কাজ করত চৌরাস্তায় একটি সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে। মাস্টার বাড়ি এক বাড়িতে ওরা কয়েকজন মেয়ে মিলে ভাড়া থাকত ।  রফিক প্রতিদিন ফ্রী তে আনা নেওয়া করত রুপালীকে।  আর এই ভাবেই রফিকের সাথে ওর প্রণয় হয়। এবং পরবর্তীতে বিয়ে হয়।

রফিক ছিল সুঠাম দেহের অধিকারী। সুদর্শনও বলা যায়। ওর এই সৌন্দর্যের কারণে মেয়েদেরকে সে প্রলুব্ধ করতে পারত।  ওর প্রধান অভ্যাস ছিল তারি খাওয়া। তারি খেয়ে মাতাল হয়ে ওর বউদের সাথে সে মাতলামি করত। অকারণে তাদের মারপিট করত।  ওর এই আচরণের কারণে ওর আগের বউরা ওকে ছেড়ে চলে যায়। 

রুপালীকে বিয়ে করার দুইদিনের মাথায় একদিন সন্ধ্যায় তারি খেয়ে মাতলামি করতে করতে রুপালীকে বলে -- 'তুই কাল থাইকা আর গারমেনে যাইতে পারবি না।'
রুপালী বলে -- ' ক্যান যাইতে পারুম না? '

-- আমি তরে কইলাম, যাবি না।  ব্যাস,  আর যাবি না। '

-- কারনডা আমারে কও। 

-- তুই তো রূপের ছেরি, ডবকা যৌবন, আরেক ব্যাডার লগে তুই  পিরিত করবি। এবং আমারে ছাইড়া চলে যাবি। এই জন্য। 

-- আমি গারমেন্টে কামে যামুই। 

রফিক রুপালীর এই কথা  শোনা মাত্র ওকে ধরে পেটাতে থাকে। সেকি তুমুল মাইর। চুল ধরে কিলাইতে কিলাইতে রুপালীকে বলে -- কী যাবি মাগী? ক। 

রুপালী ভয়ে  কাঁদতে কাঁদতে কাতর হয়ে বলে -- 'না, যাব না।'

শালবনের পাশে নান্দুয়াইন গ্রামে একটি ছোট্ট মাটির বাড়িতে রফিক ওর বউ রুপালীকে নিয়ে থাকে।  বনপাশে এমন নিরিবিলি বাড়িতে একা একা থাকতে রুপালীর ভালো লাগে না। রুপালীর মনে পড়ে ওর সহকর্মীদের কথা।  মনে পড়ে ফিরোজা, রুবী, খাদিজাদের কথা। মনে পড়ে আরও একজনের কথা, নাম -- শাহীন।  শাহীনও ওর সহকর্মী ছিল। শাহীন  একদিন ওকে বলেছিল, ' তোমাকে আমার ভালো লাগে রুপালী।' ঐ পর্যন্তই। শাহীনকে আর কিছু বলা হয়নি রুপালীর। এর মধ্যেই ওর বিয়ে হয়ে যায় খচ্চর রফিকের সাথে। 

রফিক একটা গোয়ার। তরকারিতে লবন কম হলে রুপালীকে ধরে পিটায়। ঘরের বাইরে  কোনো লোকের সাথে রুপালী একটু কথা বললেই -- ওকে ধরে পিটায়। রফিক রুপালীকে বাপের বাড়ি মির্জাপুর যেতে দিত না। যেতে চাইলে ধরে পিটাত।  রফিক ভাবত -- রুপালী বাপের বাড়ি চলে গেলে আর ফিরে  আসবে না। রফিক অনেক সময় রুপালীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনও করত। বাধা দিলে মারপিট করত। 

রুপালী হাঁপিয়ে ওঠে রফিকের সাথে ঘর করতে।  এক একসময় রুপালীর মনে হতো -- এই ঘর, এই সংসার ছেড়ে চলে যাবে সে। মনে হতো -- শাহীন যদি আবার এসে বলত,  'তোমাকে আমি ভালোবাসি রুপালী,  তুমি আমার ঘরে চলো।'  রুপালী ঠিকই শাহীনের হাত ধরে পালিয়ে যেত। এই পাষাণ স্বামীর ঘর করতে তার কিছুতেই আর ভালো লাগছে না। 

একদিন সন্ধ্যা রাত্রিতে রুপালী ঘরে বাতি জ্বালিয়ে বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়াতেই ছায়ার মতো কাকে যেন দেখতে পায়। কে যেন বরোই গাছ তলায় দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা এগিয়ে আসে রুপালীর কাছে।  এসে বলে -- আমি শাহীন রুপালী।  তুমি আমাকে চিনতে পারছ না ?'  তোমার খোঁজ জেনে তোমাকে দেখতে আসলাম। তুমি কেমন আছো ? '

-- 'আমি ভালো নেই।  কিন্তু তুমি এ কী করলে !  প্রতিবেশী কেউ দেখে ফেললে তারা আমার স্বামীকে বলে দেবে।  ঐ গোয়ার লোকটা আমাকে মেরেই ফেলবে।  তুমি এক্ষুনি চলে যাও।'

সেদিনের মতো শাহীন চলে আসলেও এর পরে 
প্রায়ই গোপনে রুপালীর সাথে সে দেখা করত।  দেখা করে কথা বলত। ওদের এই দেখা  করাটা খুব সাবধানে হতো। অল্প সময় কথা বলে চলে আসত শাহীন। ঘরে বসত না। দেরিও করত না।  

এরই মধ্যে ওদের সাথে প্রণয় গভীর হয়ে ওঠে। 
একদিন রুপালীর সাথে শাহীনের শলাপরামর্শ হয় -- ওরা দুজন রাতে দেখা করবে শালবনের ভিতর। ঘন বনের ভেতর চলে আসবে রুপালী একটি নির্দিষ্ট জায়গায়। শাহীন অপেক্ষা করবে ওর জন্য  সেখানে। যেখানে ওরা মিলিত হবে। 

কথামতো সেই রাতে শাহীন চলে যায় শালবনে। রাত ক্রমে গভীর হতে থাকে। শাহীন অপেক্ষা করতে থাকে রুপালীর জন্য।  বনের ভিতর ঝিঁঝি পোকারা ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে থেমে যেতে থাকে। জোনাকিদের আলো জ্বলা নিভে যেতে থাকে।  পঞ্চমীর চাঁদও ডুবে গেছে সেই  সন্ধ্যা রাতেই।  তারারা জ্বলছে, নিভছে। কেমন নীরব হয়ে আছে  বন নিভৃতে। বন জুড়ে তখনও স্তব্ধ অন্ধকার ।

হঠাৎ শুকনো পাতার মর্মর ধ্বণি শোনা গেল। পথের উপর পড়ে থাকা বনের  শুকনো পাতা  মাড়িয়ে নগ্ন পায়ে হেঁটে চলে আসে রুপালী।  রুপালী শাহীনকে দেখে বলে -- আমি দেরি করতে পারব না, এখনই যেতে হবে।  গোয়ার কসাইটা জেগে উঠতে পারে । '

সেই  স্বল্প সময়ের ভিতরই সেই বন নিবিড়ে দুটি মানব মানবী এক আশ্চর্য রাতের গভীরে মিলে গেল। বনতলে সেই আঁধারে দুজন হারিয়ে যেতে লাগল, হারিয়ে দিতে লাগল, ধরা দিল নিজেদেরকে, খুঁজে পেল একে অপরকে। মনে হয়েছিল ওদের -- রাতকে কখনও ভোর হতে দেবে না। শালবনের সব পাখি তখন ঘুমে বেঘোর। সব বৃক্ষ অন্ধকারের সাক্ষী হয়ে রইল অনেক কিছুর। সাক্ষী হলো আকাশ, আকাশের তারা, ঘুমন্ত জোনাকি আর বনশয্যার বিছানো শুকনো মর্মর পাতা। 

তারপর রুপালী  উঠে দাঁড়িয়ে শাহীন কে জড়িয়ে ধরে বলে -- তুমি আমাকে কবে নিয়া যাইবা। 

-- খুব শীঘ্রই। তুমি যখন যাবে, তখনই। 
 

রুপালী বাড়ির দিকে আসার জন্য পা বাড়ায়।  পা ফেলতেই তার খালি পায়ে কাঁটার মতো  কী যেন বিঁধে যায়। অন্ধকারে দেখতে পায় একটি মরা গাছের শুকনো চোখা গুরি বিঁধেছে। বেশ রক্ত ঝরছে।  রুপালী খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসে। বাড়িতে এসে দেখে ওর স্বামী তখনও  ঘুমিয়ে আছে। 

খুব ভোরে  রফিকের ঘুম ভাঙে।  সে বিছানা থেকে উঠে বাইরে আসে।  তখনও সূর্য দেখা যাচ্ছিল না বন প্রান্তরে।  কিন্তু ভোরের আলোয় সে দেখতে পেল উঠানে পায়ের ছাপে রক্তের দাগ। সেই  ছাপ ঘরের মেঝে পর্যন্ত চলে গেছে। সে ঘরের ভিতর যেয়ে রুপালীকে ডেকে তোলে। সে দেখতে পায় -- রুপালীর পায়ে থেকে তখনও  একটু  একটু করে  রক্ত ঝরছে। 

রফিক রুপালীকে বলে -- 'ওঠ্।  আমার সাথে বাইরে আয়।' রুপালী উঠে রফিকের সাথে উঠানে আসে।  রফিক পায়ের রক্তের ছাপ ধরে হাঁটতে হাঁটতে রুপালীকে নিয়ে  পিছনে শালবনে চলে যায়।  য়েখানে রুপালী শাহীনের সাথে দেখা করেছিল সেখান পর্যন্ত।  রফিক রুপালীকে বলে -' 'ক মাগী, রাইতে তুই কার সাথে দেখা করেছিলি এইখানে ?  কী করেছিলি, ক।'

রুপালী কোনো কথা বলে না।  চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।  রফিক ওর গলা চেপে  ধরে বলে -- 'ক মাগী,  তুই  কার সাথে দেখা করেছিলি?' রুপালী নিশ্চুপ।  রফিক শক্ত করে আরও জোরে গলা চেপে ধরে বলে -- 'ক মাগী।'  রুপালী ততক্ষণে নির্জীব হয়ে গেছে। 

একসময় ভোরের আলো শালবৃক্ষের পাতার ফাঁক দিয়ে নীচে  মরে পড়ে থাকা রুপালীর মুখের উপর এসে পড়ছিল। কী সুন্দর সেই রুপালী আলো, কী শুচি শুভ্র দেখতে লাগছিল রুপালীর মুখখানি। 



২৯.   হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো



একদিন কর্মহীন এক অলস অপরাহ্নে আত্ম পরিজনহীন আমার গৃহকোণে শুয়ে শুয়ে পড়ছিলাম শামসুর রাহমানের 'হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো' থেকে এই পংক্তিগুলো --

'... তোমার মদির চোখ, গোধূলি-রঙিন গ্রীবা,/জীবন স্পন্দিত টসটসে ঠোঁট/ অর্থাৎ তোমার সৌন্দর্যে সচকিত হয়েও/ শুধু সেজন্যেই আমার অনুরাগের আংটি/ পরিয়ে দিই নি তোমার আঙুলে।

তোমার হাসি, যা হতাশাকে করে তোলে দীপান্বিতা,
আমাকে নিয়ে গ্যাছে সেই ঘাটে, / যেখানে ফোটে মনোজ কহলার। / না, কেবলমাত্র সেজন্যেও
ভালোবাসি না তোমাকে।'

ঘরের পশ্চিম পাশে জানালাটা খোলা। বাঁশঝাড় থেকে দু'একটা করে শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে। এত নির্জন যে, আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। ঘুম আসতে চায় চোখে, মুদে আসছিল দুচোখ। তন্দ্রা, ঘুম ও স্বপ্ন নাকি পরপর আসে -- তন্দ্রায় বোঝা যায় আমি কী করছি, কী ভাবছি। কিন্তু ঘুম ও স্বপ্নে কিছুই বোঝা যায় না। 

মনে হলো কার যেন পদধ্বনি বাজছে বাইরে। শুধুই পায়ের শব্দ। নুপুর কিংবা চুড়ির শব্দ নয়। পদ শব্দ আস্তে আস্তে নিস্তব্ধ হলো। কে যেন দরজায় কড়া নারল একবার। আমি যেয়ে দরজা খুলে দেই। দেখি --সম্মুখে দাঁড়িয়ে জেবা সাহানি। পরনে তার টাংগাইলের হালকা নীল রঙের তাঁতের শাড়ি। ম্যাচিং করে ব্লাউজ, টিপ, কানে ইমিটেশনের দুল ও গলায় নীল পাথর বসানো লকেটের সোনার চেন পরেছে। মুখে স্মিত হাসি। হাসিটা শুধু মুখে নয়, হাসিটা চোখে এবং চোখের তারায়। মেয়েদের এমন হাসি দেখতে খুবই ভালো লাগে। জেবা সাহানিকেও খুব ভালো লাগছিল। 

জেবা আমার পড়ার টেবিলটার সামনে চেয়ারটাতে এসে বসে। জেবা বলছিল -- আমি হঠাৎ করে আপনার এখানে চলে এলাম আপনাকে কিছু না জানিয়ে। খুব অবাক হচ্ছেন বুঝি? 

-- জ্বী, একটু চমকিয়ে উঠেছি। তুমি আসবে জানলে ঘরটা ভালো করে গুছিয়ে রাখতাম। আলনার কাপড়গুলো ভাজ করে সাজিয়ে রাখতাম। পড়ার টেবিলের বইখাতাগুলো এত এলমেল থাকত না। ফুলদানিতে কোনো ফুল নেই। অন্তত কয়েকটি গাঁদাফুল এনে ফুলদানিটা সাজিয়ে রাখতে পারতাম। 

-- এই যে এলমেল সবকিছু এইটাই ভালো লাগছে। ছেলেদের ঘর সাজানো গোছানো মানায় না। সবকিছু পরিপাটি করে রাখে মেয়েরা।  ছেলেরা নয়। খুব বেশি মনে হয় সিগারেট খান। এ্যাসট্রেটা একদম ভরে ফেলেছেন। 

-- নাহ্ খুব বেশি খাই না। বেশ কয়েকদিনের এই ছাইগুলো। ফেলে দেয়া হয়নি।

-- বিছানার উপরে 'হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো'। তা কোন্ কবিতাটা পড়ছিলেন? 

-- ' কেন তোমাকে ভালোবাসি? ' কবিতাটি পড়ছিলাম --
".... দৈবাৎ এক রাতে ভুলক্রমে তোমার সঙ্গে আমার/ অদৃশ্য যোগাযোগ। এমনই আকস্মিক
সেই ঘটনা, আজো কেমন ধন্দ লাগে। / বস্তুত
মধুর এক ধাক্কা খেয়ে পথচলা
মেঘের আলপথে। / একটি ভুলের কুঁড়ি বিকাশের বাঁশির তানে/ চমৎকার এক ফুল হয়ে
দুলে উঠবে সত্যের মুখোমুখি, কে জানতো?...''

*****  *****  *****

( এখানে একটু বলি -- জেবার সাথে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। আমার এক বন্ধুর কাজিন সে। আমি বিয়ে করব, মেয়ে খুঁজছি। এই কথা জেনে আমার সেই বন্ধু বলেছিল-- আমার একটি কাজিন আছে, ইডেনে পড়ে। ট্রেডিশনাল সিস্টেমে বাংলা অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেবে।  তুমি ওকে দেখতে পারো। ' 

বললাম, ঠিক আছে দেখব। 

ধানমন্ডির একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টে আমরা তিনজন একদিন লাঞ্চ করি।  ঐদিনই জেবাকে আমি প্রথম দেখি। দেখে ওকে ভালো লাগল। 

আমি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  বাংলায় অনার্স এবং মাস্টার্স করেছি। জেবা তাই আমাকে অনুরোধ করে বলেছিল -- 'আমি মাঝে মাঝে  আপনার কাছে থেকে একটু হেল্প নেব।' আমি বলেছিলাম, অবশ্যই তোমাকে প্রয়োজনীয় হেল্প করব।'

শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি বারান্দায়, ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের লনে বসে আমি এবং জেবা সাহানি  একাডেমিক বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছি, এবং জেবাকে যতটুকু পারি, টিপস্ দিয়েছি। ব্যাস, এই পর্যন্তই। কিন্তু কোনো ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে পড়িনি কেউই।

একদিন আমার সেই  বন্ধুটির সাথে আমার দেখা হয়। এবং সে বলে -- 'জেবাকে কি তোমার পছন্দ হয় ?' আমি ওকে বলি -- 'জেবা খুব ভালো মেয়ে। ওকে নিয়ে ঘর করা যায়।'

আমার সেই বন্ধুটি বলে -- 'তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি।' আমি বললাম -- কী কথা? 

-- জেবার একটি বিয়ে হয়েছিল। ওদের বাসর রাতও হয়েছিল।  কিন্তু সেই একটি রাতই কেবল, কিংবা একটি দিনই বিয়ে টিকেছিল। তারপরের দিনই সে বিয়ে ভেঙে যায়। দুজনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কী জন্য বিয়েটা ভেঙে যায়, তা জানি না। জেবা সে কথা  কাউকে বলেনি কখনও। 

আমি শুধু কথাগুলো শুনলাম। এবং বললাম -- আমি আমার বাড়িতে আলাপ আলোচনা করে, তোমাকে মতামত জানাব। 

আমি বাড়িতে আলাপ আলোচনা করে -- আমার সেই বন্ধুকে নেগেটিভ মতামত জানিয়ে দিলাম। বললাম -- আমাদের বাড়িতে কেউই এই বিয়েতে রাজি নয়। ) 

*****  *****  *****

জেবা বলছিল -- আপনার কবিতার খাতাটি কই?  একটু দেখব। দেখি -- সর্বশেষ কোন্ কবিতাটি আপনি লিখেছেন, একটু পড়ব। 

টেবিলের উপরেই আমার কবিতার খাতাটি ছিল।  আমি খাতাটি জেবার হাতে দিলাম।  জেবা খাতাটি হাতে নিয়ে আমার লেখা শেষ কবিতাটা পড়তে লাগল --

" আমি একটি ছেলেকে চিনি
সেই ছেলে 

সন্ধ্যা আকাশের তারার আলো হতে চেয়েছিল
কিন্তু মেঘের ছায়ায় ঢেকে গেছে সেই তারা 
নিভে গেছে সেই আলো।

ছেলেটি একটি অসম্ভব সুন্দর স্বপ্ন ছুঁতে চেয়েছিল
কিন্তু অলৌকিক ঝরনাধারায় ভেসে গেছে সেই স্বপ্ন, জীবনের ক্যানভাসে সেই স্বপ্ন সে আঁকতে পারেনি। 

ছেলেটি চেয়েছিল একটি ঘর 
আনন্দলোক থেকে সুখ কুড়িয়ে আনতে চেয়েছিল
ফুলের রেণু থেকে অমৃত
মাধুকর হতে চেয়ে হারিয়ে ফেলেছে তার মাধবীকে।

সে চেয়েছিল কেউ একজন চিরকালের হোক,
নিপবনের পাখির বাসার মতো ঘর হবে তার
পূর্ণিমা রাতের উদ্দাম জোছনার প্লাবন বইবে ভাঙা অলিন্দ দিয়ে।

ছেলেটি একটা অমল সুন্দর প্রিয়তমা চেয়েছিল
যার কাছে  মন খুলে বলা যায় সব কথা
ইচ্ছে করলেই যাকে বুকে জড়িয়ে 
চুমু খেয়ে নেওয়া যায় একটার পর একটা
চোখে চোখ রেখে স্বপ্ন দেখা যায়
হাতে হাত রেখে সব ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়া যায়
কিন্তু সে পারেনি।

হাতের মুঠোয় সে ভরতে পারেনি প্রেম
চিরকাল যৌবনের মোহ ভেঙে খুঁজেছে তার শৈশব 
ময়ুরাক্ষী দিনগুলো কখন যে চলে গেছে সে বুঝতেই পারেনি।

এক একজন এভাবেই ভাবে
আর এভাবেই ভুল অঙ্কের খাতায় হারাতে থাকে
একের পর এক তার প্রিয়মুখ
দিনশেষে পড়ে থাকে শুধু অতৃপ্ত কিছু অভিমান।"

কবিতাটা পড়া শেষ হলে জেবা অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকে। কোনো কথা বলছিল না সে। মনে হলো ওর বুকের গভীর থেকে একটি লুপ্ত হয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল। 

জেবা বলছিল -- 'আমার কাজিন, অর্থাৎ আপনার বন্ধু আমাকে সব কথা বলে দিয়েছে।  তবুও আজ আসলাম আপনার এখানে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল আপনার ঘর, আপনার ঘরের এলমেল সব জিনিসপত্র। আপনার লেখার টেবিল যেখানে বসে আপনি কবিতা লেখেন। 

আজ এই বিষণ্ণ বিকালে খুব ইচ্ছে করছিল -- আপনাকে নিয়ে দূরে কোথাও নদীর কূলে একটু বেড়াতে যেতে। নদীর জলের ধ্বনি শুনতে আপনাকে নিয়ে। একটি সূর্যাস্ত দেখতাম হৃদয়ের পৃথিবীর সব আলো নিভিয়ে দিয়ে।' 

নাহ্ , সেইদিন সেই বিষণ্ণ বিকালে আমাদের নদীর তীরে যাওয়া হয়নি। দেখা হয়নি তীরে দাঁড়িয়ে শেষ সূর্যাস্ত। মনের ভিতর জীবনানন্দ দুঃখ তখন -- 
'সব পাখি ঘরে আসে -- সব নদী ফুরায় জীবনের সব লেনদেন, থাকে শুধু অন্ধকার।'

জেবা সাহানি সন্ধ্যার আগেই ফিরে চলে যায়। যাবার সময় একটুও সে পিছনে ফিরে তাকাল না। জানিনা,  ওর চোখে হয়ত জল ছিল, তাই  ফিরে তাকায় নি। 

জেবা আমার কেউ নয়, সামান্য  কিছুদিনের  পরিচয় ছিল মাত্র। তবুও সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যায় খুব  শূন্যতা বোধ করেছিলাম।



৩০.    রোড টু কুসুমপুর 



এই ঘটনাটির সময়কাল  গত শতাব্দীর আশির দশক। সালটি ছিল ১৯৮৯ ইং।  

সেদিন ছিল ছুটির দিন। আমি বাসায়ই ছিলাম। মনটা কেমন যেন এলমেল লাগছিল।  ঠিক সেই সময় আমাদের গাঁয়ের কালাম এসে খবর দিল-- মা নাকি খুব অসুস্থ। কালাম টঙ্গীতে একটি কারখানার ফোরম্যান এর চাকুরি করে । ছুটি কাটিয়ে ও বাড়ি থেকে আজই এসেছে। পরের দিন আমার অফিস। ছুটি নেবার সময় নেই। মায়ের অসুস্থতার কথা  শুনলে পৃথিবীর বাকি সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়।  তখন বেলা  দুইটা বাজে।  আমি আর দেরি না করে সোজা আব্দুল্লাহপুর বাস স্ট্যান্ডে চলে যাই। 

রোড টু কুসুমপুর,  সিরাজগঞ্জ।  

বাস ছাড়তে ছাড়তে তিনটা বেজে যায়। সময় হিসাব করে দেখলাম -- টাংগাইলের ভূয়াপুরের চর গাবসারা লঞ্চ ঘাটে পৌঁছতে সন্ধে সাতটা বেজে যাবে।  হলোও তাই। বাস যখন চর গাবসারা যমুনা নদীর তীরে এসে পৌঁছে তখন সাতটা পঁচিশ বাজে।  দিনের  শেষ লঞ্চ ঘাটে নোঙর করা আছে। আমি দোতালায় ছোট্ট কেবিনে যেয়ে বসি। 

রাত্রি আটটার দিকে লঞ্চ সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে চলে আসে। আশ্বিনের রাত্রি।  অন্য কোনো সময়ে হলে লঞ্চের ছোট্ট কাঠের কেবিন থেকে বেরিয়ে রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশে চাঁদ উঠেছে কী না দেখতাম, কিংবা অজস্র নক্ষত্রের আলোয় খুঁজতাম, চরে ফুটে থাকা কাশফুল। নদীর জল ছুঁয়ে দূর থেকে বয়ে আসা লি-লি হাওয়া লাগাতাম গায়ে।  আজ আর কোনোকিছু ইচ্ছে করল না। 

আজ এই রাত্রিতে নদীর জলের উপরে লঞ্চের কেবিনে চুপচাপ বসে আছি।  চোখ বন্ধ করে থাকি, দেখি মায়ের মুখ।  চোখ খুলে চেয়ে থাকি, দেখি মায়ের মুখ। জলের শব্দ শুনি -- মায়ের অসুখের ব্যথা বেদনার আর্তি শুনতে পাই। কেবিনের ভিতর আরও ক'জন যাত্রী আছে। কিন্তু তাদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। 

লঞ্চ চলছে ভটভট আওয়াজ করে। কেমন যেন কর্কশ মনে হচ্ছে শব্দ। কেবিনে বসে থাকা একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব লোক আমাকে বলে -- তুমি কোথায় যাবে?

-- কুসুমপুর।  সিরাজগঞ্জ শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে? 
-- এলাকাটা চিনি। তুমি কী এই রাতেই ওখানে যাবে?  নাকি শহরে থেকে যাবে? 
-- না, শহরে থাকব না। রাতেই চলে যাব। আমার মায়ের অসুখ। যেতেই হবে। 
-- অনেক রাত হয়ে যাবে। আধাপাকা খানিক পথ। তারপর বেশির ভাগ কাঁচা রাস্তা। মাঝে নদী। খেয়া পারাপার হতে হবে।  পথে বিপদ হতে পারে তো!  

-- বিপদ হোক।  আমি যাবই। 

লঞ্চ সিরাজগঞ্জ ঘাটে এসে যখন ভেড়ে তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে। বয়স্ক লোকটা আমার সাথে সাথেই লঞ্চ থেকে নামে। সে আবারও আমাকে বলছিল -- শহরের কালীবাড়িতে আমার বাসা।  তুমি ইচ্ছে করলে আমার বাসায় আজ রাতে থাকতে পারো। 

-- না। আমি আজ এই রাতেই চলে যাব। 
-- ঠিক আছে। তা না থাকলে, দুটো ডালভাত খেয়ে যাও। অনেকখানি পথ যেতে হবে।  তোমার খিদে লেগে যাবে। কষ্ট পাবে। 

-- না, আমার খিদে লাগে নাই। খেতে হবে না। 

দেখলাম লোকটি একটু হতাশ হলো। দুঃখও পেল মনে হয়। আমি ওনার কাছে থেকে বিদায় নেই। তারপর একটা রিকশা নিয়ে প্রথমে রহমতগঞ্জ কাঠের পুল চলে আসি। এখানে এসে দেখি -- কুসুমপুর যাওয়ার একটা রিকশাও নেই।  যে রিকশাওয়ালা আমাকে ঘাট থেকে নিয়ে এসেছে তাকে বলি -- ' তুমি কী আমাকে শালুয়াভিটা খেয়াঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাবে? ' রিকশাওয়ালা বলে -- 'না যাব না। আমার ভয় লাগে। ফকিরতলা পার হলেই  যে নিরিবিলি নির্জন জায়গা আছে, ঐ জায়গাটা ভালো না। আমি আমার রিকশাটা হারাতে পারব না।'

কী করব। রিকশাওয়ালা যাবে না।  অগত্যা আমি একাই হেঁটে রওনা হই। কাটাখালি নদী পার হয়ে আকাশের দিকে তাকাই। দেখি আধাভাঙ্গা চাঁদ। নবমীর চাঁদ হবে হয়ত। আবছা আলোয় পথ দেখা যাচ্ছে।  হেঁটে হেঁটে যখন রহমতগঞ্জ গোরস্তানের কাছে আসি দেখতে পাই , একটি বৃদ্ধা সাদা ধবধবে কাপড় পড়ে গোরস্তানের ভিতর থেকে হেঁটে হেঁটে আমার দিকে আসছে। সে ক্রমশঃ যত আমার দিকে আসছে তত তাঁর মুখখানি চিনবার চেষ্টা করি। নবমীর চাঁদের আলোয় বৃদ্ধার যে মুখচ্ছবি দেখলাম, তা অস্পষ্ট। কেমন স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। রাতের এই আঁধার, চাঁদের যে স্ফুরিত রশনি, আকাশ ভরা নক্ষত্রের যে ঝিলিমিলি আলো-- সেই আলোয় বৃদ্ধাকে যতটুকু দেখলাম,  মনে পড়ে গেল অনেক বছর আগে দেখা একটি মুখ ---

আমার বয়স তখন পাঁচ কী ছয় হবে। সেই শিশু বয়সে  একজনের মুখ আমার আজো মনে আছে।  সে আমার মাতামহীর মুখ। আবছা আবছা সেই মুখখানি আমি এখনও মনে রেখেছি। সে বেঁচে নেই। তার কবর হয়েছিল -- এই গোরস্তানেই। 

বৃদ্ধাকে দেখে কেন যেন মনে হলো সেই তারই মুখ, মাতামহীর সেই অস্পষ্ট আবছায়া মুখচ্ছবির মতোন। বৃদ্ধা যেন বলছে -- ' তুমি ভয় পেওনা। পথে তোমার কিছু হবে না। আমার রাবেয়াকে তুমি দেখতে যাচ্ছ, যাও। আমার আশীর্বাদ রইল।'

বৃদ্ধা আর কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে গোরস্তানের দিকে চলে গেল। তাকে চেয়ে দেখতে দেখতেই  সে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।  আমি শুধু অস্ফুট করে একবার ডাকলাম তাকে -- নানী মা। 

কেমন যেন একটা উদ্যোম পেলাম। সারা শরীর মনে এক স্বর্গীয় অনুভব অনুভূত হতে লাগল। আমি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা ধরে সামনের দিকে হাঁটতে থাকি।  আমার কাছে মনে হলো -- এই নিশীথ রাতে এই পথে আমি একাকী হলেও কে যেন আমার সাথে আছে। আকাশ ভরা তারার ছায়া, ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ, ঝিঁঝি পোকা, নিশি পাখি সব আছে। ঘেঁটুফুল ফুটেছে রাস্তার ধারে, আকুল করা গন্ধ পাচ্ছি তার। কী একটা পাখি ডাকছে নাম জানিনা,  আখ ক্ষেতের ভিতর শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছিল।  

জন কোলাহলহীন পথে নিঃশব্দচারীর মতো  আমি পথ চলতে থাকি।  ফকির তলা পার হয়ে আরও নির্জন পথ ধরে সামনে এগিয়ে যাই।  হঠাৎ পাশের শন ক্ষেতের ভিতর থেকে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের দুটো ছেলে  রাস্তার উপর উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। অনেকটা গম্ভীর ও ধমকের স্বরে আমাকে বলে  -- 'দাঁড়াও'। 

একজনকে নেতা মনে হচ্ছিল। আর একজন তার চেলা মনে হলো। নেতা ছেলেটি বলছিল -- বাড়ি কই তোমার? 
-- কুসুমপুর। তা তোমার নাম কী?
-- বক্কার।  এই নাম শুনেছ আগে? 
-- না। 
-- তেলকুপীর বক্কারকে সবাই চেনে। তুমি চেনো না? 
-- চিনি না। 
-- চিনবা একটু পরই !  

বক্কার ওর চেলাকে ডাক দিয়ে বলে -- 'এই সিদ্দিক মাল বের কর্।' সিদ্দিক ওর কোমর থেকে একটা চকচকা ডেগার বের করে। বক্কার ডেগারটি সিদ্দিকের হাত থেকে নিয়ে আমার চোখের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে -- 'কাছে কত টাকা আছে? 

-- হাজার বারো শ হবে। 
-- বের করো। 
আমি পকেট থেকে টাকাগুলো বের করে বক্কারকে দিয়ে দেই। বক্কার সিদ্দিককে বলে -- ঐ সিদ্দিক, ওর সবগুলো পকেট ভালো করে চেক কর্।  সিদ্দিক আমার সবগুলো পকেট চেক করে বলে -- 'আর নেই ওস্তাদ।'

বক্কার আমাকে বলে --  ' এবার চলে যাও।' 

আমি রাস্তার উপর মনখারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। সামনে আর এগুই না। বক্কার বলে -- তুমি যাচ্ছ না কেন? 
-- এমনই যাচ্ছি না। 

কেন জানি  আমার চোখ দিয়ে জল চলে এল। মার জন্য কিছু পথ্য কিনতে চেয়েছিলাম, যদি ঔষধ কিনতে হয়? ঔষধ কিনতাম। ছোনগাছা হাট থেকে মার জন্য পান শুপারী কিনতে চেয়েছিলাম। আমার আর মার জন্য কিছু কেনা হবে না। এই ভেবে কাঁদছিলাম। 

বক্কার বুঝতে পারে আমি কাঁদছি।  সে বলে -- এই তুমি কাঁদছ কেন? 

-- আমার মা খুব অসুস্থ।  মার অসুস্থতার খবর শুনে কত পেরেশান  হয়ে ঢাকা থেকে আসতেছি।  তোমরা আমার টাকাগুলো  নিয়ে  নিলে।  আমি মার জন্য ঔষধ পথ্য কিছুই কিনতে পারব না।  এইজন্য কাঁদছি। 

আমার কথাগুলো শুনে বক্কারের  মুখ কেমন যেন দুঃখী দুঃখী হয়ে গেল, একধরনের কোমল এবং মায়াময়। আমি সেই অন্ধকারে তা দেখতে পাচ্ছিলাম।

বক্কার আমার টাকাগুলো আমাকে ফেরৎ দেয়।  এবং বলে -- সামনে তো আরও বেশ কিছু পথ বাকী  আছে।  তুমি একা যাবে কী করে? এত রাতে? তোমার বিপদ হতে পারে।  আমরা তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব। 

বক্কার এবং সিদ্দিক আমাকে অনেকটা পাহারা দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসে। পথে ওদের সাথে আমার অনেক কথাই হয়, শুনি ওদের জীবন কাহিনি। আমিও বলি - আমার অনেক কথা।  

এইটুকু পথে আসতে আসতে একজন মানুষের সব কথা  কী শোনা হয়?  কিংবা বলা হয়? 'আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বক্কার  বলে -- তুমি ঘরে যাও। মাকে গিয়ে দেখো,  আমরা যাই। 

-- তোমরাও ঘরে চলো। আমার মাকে দেখে যাও। 

বক্কার বলে --  আর একদিন দিনের বেলায় এসে  তোমার মাকে দেখে যাব।  আজ আর এত রাতে  না।  আর একটি কথা,  আমার মার জন্য তুমি একটু দোয়া করবে।  আমার মাও তোমার মার মতো খুব অসুস্থ।  
তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি -- তোমার কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছিলাম সেই টাকা দিয়ে মার চিকিৎসা করতে চেয়েছিলাম। 

বক্কারের কথা শুনে আমার খুব কান্না পেল। আমার অসুস্থ মায়ের মুখের সাথে বক্কারের মায়ের মুখটি মিলে গেল। মনে হলো -- জগতের সব মা-ই এক। একই রকম স্নেহ একই রকম মায়া একই রকম মমতাময়ী। 

আমি আমার বারোশত টাকা থেকে  বক্কারের হাতে  ছয়শত টাকা দিয়ে বললাম -- এটি নাও --মায়ের চিকিৎসা করবে। 



৩১.     এক রাজকন্যার গল্প 



আমার মেয়ে আমার হাত পায়ের নোখগুলো নেইল কাটার দিয়ে কেটে দিতে দিতে বলেছিল-

'কাল আমার বিয়ে। কাল আমাকে শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে হবে। আমার যাবার সময় তুমি একটুও কাঁদবে না। তুমি কাঁদলে আমি কিন্তু হাউমাউ করে কেঁদে ফেলব। আমি তখন আর শ্বশুর বাড়িতেই যাব না।'

আমি মাথা নেড়ে বলছিলাম -- না মা, আমি কাঁদব না একটুও। তুমি দেখে নিও।

বিয়ের দিন সানাই বাজল। বর আসল। বর যাত্রীরা এল। কত হৈহুল্লর হলো। কত আনন্দ, কত রকম খাওয়া দাওয়া হলো। কোথাও কোনো দুঃখের লেশ নেই। চারিদিকে কেবল হাসি রাশি। কোথাও কোনো ক্রন্দন ধ্বনি নেই।

যথারীতি মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় হলো। বিদায়কালীন আমার মুখে কোনো বেদনার ছায়াপাত পড়ল না। চোখে মুখে আনন্দময় হাসি। আমার হাসি মুখ দেখে মেয়েও তার মুখখানিতে হাসি মেখে রেখেছে। কোনো কান্না নেই। চোখ থেকে একবিন্দু অশ্রুও ঝরে পড়ল না। আগত অতিথিদের কেউ কেউ সমালোচনা করল - কেমন বাবা মেয়ে! কারোর চোখে জল নেই।

মেয়েকে হাসিমুখে বিদায় দিয়ে ঘরে চলে আসি। 

বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছি। কেমন নিঝুম সারা ঘরময়। মুহূর্ত পরেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে মেয়ের কিছু কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। যে কথাগুলো গত চার পাঁচ দিন ধরে আমাকে বলে এসেছে। আমি খুব কানের কাছে থেকে ওর এই কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম --

' বাবা, তুমি ঔষধগুলো সময়মতো খাবে। ভুলে যাবে না। কখন কোন্ ঔষধ খাবে আমি কাগজে সব লিখে রেখেছি। সাজিয়ে রেখেছিও ঐ ভাবেই৷'

' মশারী টানাতে ভুলবে না। আমি সুন্দর করে মশারী টানানোর ব্যবস্থা করে রেখেছি। '

' সুমীর মাকে বলে গেছি, উনি তোমাকে গোসলের পানি গরম করে দেবে। কখনও ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করবে না।'

' বেশি রাত জাগবে না কখনও, সময় মতো ঘুমিয়ে পড়বে।'

' ট্রাঙ্ক খুলে পুরনো এ্যালবাম বের করে মা'র ছবি একাকী বসে দেখে দেখে কাঁদবে না।'

' ময়লা কাপড়গুলো বালতিতে রেখে দিও। সুমীর মাকে বলে গেছি -- দুতিন দিন পর পর সে পরিষ্কার করে রেখে যাবে। '

' খাওয়া নিয়ে অনিহা করবে না। সময়মতো খেয়ে নেবে।'

' এক দুটো সিগারেট খাওয়ার অনুমতি দিলাম। এর বেশি একটিও খাবে না। '

'আমি মাঝে মাঝে এসে তোমাকে দেখে যাব। তুমি কোনো অনিয়ম করেছ কী না, অনিয়ম করলে আমি কিন্তু তোমাকে দেখলেই ধরতে পারব।'

' হাত পায়ের নখ বড়ো হয়ে গেলে আমিই এসে কেটে দিয়ে যাব। তুমি কাটতে যেও না।'

' আর... পানি খেতে ভুলো না। শিয়রে জগের ভিতর পানি ভরে রাখবে সবসময়। '

' আমি যা বলে যাচ্ছি, সেই সব কথা মনে রাখবে এবং পালন করবে। আমার মাথা ছুঁয়ে তুমি দিব্বি দাও, বলো -- শুনবে সব কথা।'

এই রকম ওর আরও অনেক কথা শূন্য এই কক্ষের ভিতর ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। দেখলাম -- আমার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বালিশ ভিজে যাচ্ছে।

মেয়েটা আমার হারানো মা এবং স্ত্রীর শূন্যতা কখনো বুঝতে দেয়নি একটুও। আজ যেন মনে হচ্ছে -- ঐ দুজনসহ তিনজনকে আমি হারিয়ে ফেললাম।

এই পৃথিবীতে মেয়েরা বাবার কাছে রাজকন্যার মতো, আর বাবাও যেন মেয়ের কাছে রাজার মতো বেশ থাকে। পৃথিবীর কোনো রাজাই রাজ্য হারিয়ে মনে হয় কাঁদে না, কিন্তু রাজকন্যা হারিয়ে কাঁদে।

এই যেমন আমি কাঁদছি।



৩২.    ঘাস ফড়িং-এর রং



অনেক বছর আগের কথা। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি এসে দেখি -- আমার দূর সম্পর্কিত একজন মামু তার দশ এগারো বছরের একটি মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছে। এই মামুকে এর আগে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই একা আসতে দেখেছি। উনি সকালে আসত, এবং বিকালেই চলে যেত। এই প্রথম দেখলাম -- এবার উনি  ওনার মেয়েকে সাথে করে আমাদের বাড়িতে এসেছে।

মার কাছে শুনেছিলাম, তার এই ভাইটি দূর সম্পর্কের খালাত ভাই হয়। বয়সে মার থেকে অনেক ছোট। মেয়েটির জন্মের পরেই ওনার স্ত্রী মারা যায়। এর পরে আর বিয়ে করেনি। এই মেয়েকে নিয়েই থাকে। উনি খুব গরীব। অনেক অভাব অনটনের ভিতর জীবন নির্বাহ করে।

মেয়েটির নাম ফিরোজা। ক্লাস ফাইভ পাস করেছে। ওকে আরও পড়ানোর ইচ্ছে আমার সেই মামুর। তাদের গ্রামে আশেপাশে কোনো হাই স্কুল নেই। আবার অভাব অনটনও আছে। তাই এই মেয়েটিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। ওনার ইচ্ছে, এখানে থেকে তার মেয়ে লেখাপড়া করুক।

মার সাথে এই ব্যাপারে সে কী আলাপ আলোচনা করেছিল -- সে কথা আমি জানিনা। শুধু দেখলাম, ফিরোজাকে আমাদের বাড়িতে রেখে আমার সেই মামু বিকেলেই চলে গেল। যাবার সময় তার মেয়েকে ডেকে কাছে জড়িয়ে নিয়ে বলল - মা, তুমি ভালোভাবে এখানে থাকবে। সবার কথা শুনবে। সবাইকে মান্য করে চলবে।

ফিরোজা মাথা নেড়ে বলেছিল --' আচ্ছা। তুমি আবার আইসো, আমাকে দেখে যাইও।' দেখলাম, বাবা মেয়ে দুজনেই অশ্রু মোচন করছে।

মেয়েটি এখন থেকে এখানেই থাকবে, আমার খুব ভালোই লাগছে, মনে হলো-- একজন সাথী পেলাম। যে আমার ছোট বোনের মতো, খেলার সাথীর মতো। ঐ বয়সে ফিরোজা আমার প্রেমিকার মতো কেউ একজন হবে, এই কথা ভাবিনি।

প্রথম দিন সন্ধ্যা রাতে হেরিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসেছি, ফিরোজা আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। টেবিলের উপর রাখা আমার বইগুলো নেড়েচেড়ে বলে -- রতন ভাই, তুমি মনে হয় অনেক ভালো ছাত্র, ক্লাসে তোমার রোল নং কত?

আমি বললাম, 'আমার রোল নং চব্বিশ।' ফিরোজা শুনে খুব মন খারাপ করল। ও ভেবেছিল - আমার রোল নং এক হবে। আমি খুব ভালো ছাত্র।

টুকটাক করে কথা বলতে বলতে আমি ওকে বললাম, এখন থেকে তুমি তো আমাদের বাড়িতেই থাকবে, তাই না? ফিরোজা বলল, 'হে। তুমি খুশি হও নাই?' বললাম, 'খুশি হয়েছি।'

পরের দিন আমি স্কুলে গেলে স্কুলের ক্লাসগুলো কেমন যেন শেষ হচ্ছিল না। মন খুব আকুবাকু করছিল -- কখন ছুটি হবে, কখন বাড়ি যাব, কখন ফিরোজার সাথে গল্প করব?

স্কুল ছুটি হলে বাড়িতে আসতে আসতে পথে মনে হলো, ফিরোজাও নিশ্চয়ই আমার জন্য এমন ছটফট করছে, ভাবছে-- কখন আমি বাড়ি আসব, কখন আমাকে ও দেখতে পাবে, আমার সাথে গল্প করবে।

দ্বিতীয় দিন বিকালবেলা, ফিরোজাকে নিয়ে পাড়ার অন্যান্য খেলার সাথীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। ওদের বলি - ওর নাম, ফিরোজা, ও আমার বোন হয়। এখন থেকে ও আমাদের বাড়িতেই থাকবে। আমি ফিরোজাকে নিয়ে সারা আঙ্গিনা ঘুরে ঘুরে দেখাই। পুকুর পাড় ধরে হাঁটতে থাকি। কদমগাছ তলায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যায় জল থেকে উঠে আসা হাঁসগুলোর ঘরে ফেরা দেখি।

মাত্র দুতিনদিনেই ফিরোজা আমার সারাক্ষণের সাথী হয়ে ওঠে। আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে অন্য খেলার সাথীদের সাথে খুব বেশি মিশতাম না। ফিরোজাকে নিয়েই এ বাড়ি ও বাড়ি যেতাম। কোনো কোনো দিন পুকুর পাড় পেড়িয়ে আলপথ দিয়ে হাঁটতাম। তখন ছিল হেমন্তের দিন। সারা প্রান্তর জুড়ে ছিল সরিষার ক্ষেত। চারদিকে শুধু হলুদের সমারোহ। আমরা বিমুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখতাম হলুদ গালিচার মতো সরিষা ফুলের মাঠ। মৌ মৌ গন্ধ নিতাম নাক ভরে।

আমি চার পাঁচ দিনেই ফিরোজাকে খুব আপন করে নিলাম। ফিরোজাও আমাকে আপন করে নেয়। ভাবছিলাম, কবে ওকে ভর্তি করে দেবে স্কুলে। দুজন প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যাব। প্রতিদিন স্কুলে যেতে যেতে সারা পথে কথা বলব, গল্প বলব। গল্প করতে করতে, কথা বলতে বলতে -- কথা ফুরাবে না, গল্পও ফুরাবে না, কিন্তু পথ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে।

সেদিন ছিল বুধবার, গুনে দেখলাম ছয়দিন ধরে ফিরোজা আমাদের বাড়িতে এসেছে। আমি স্কুলে চলে যাই। সেদিনও ক্লাসে মন বসছিল না পড়ায়। খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘ হচ্ছিল ক্লাস। মনে হচ্ছিল, কখন ছুটি হবে, কখন বাড়ি যাব, কখন দেখব যেয়ে ফিরোজাকে।

ক্লাস শেষে ছুটির পর আমি খুব জোরে জোরে পা ফেলে বাড়ির দিকে আসতে থাকি। পায়ে পায়ে পথের ধুলি উড়িয়ে আসছিলাম, আর ভাবছিলাম কখন এই পথ চলা শেষ হবে।

যখন বাড়িতে আসি, এসে দেখি-- আজ ফিরোজা বাড়ির গলি মুখে দাঁড়িয়ে নেই। ওকে না দেখে মন খারাপ করে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করি। উঠোনেও কোথাও ওকে দেখতে পেলাম না। ঘরের ভিতর যেয়ে দেখি, ঘরেও নেই। ভাবলাম, হয়তো পাশের বাড়ি বেড়াতে গেছে।

মা আমাকে খেতে দিল। আমি ভাত খেতে খেতে মাকে বললাম -- ফিরোজা কোথায় গেছে? মা জবাব দেয় , ওর বাবা এসে ওকে আজ নিয়ে গেছে। আমি বললাম, কবে আবার আসবে? মা, বলল, এমনিতেই আর কখনও আসবে না, তবে বেড়াতে আসলে আসতে পারে।

ফিরোজার চলে যাবার কথা শুনে, আমি আর এক নকলা ভাতও মুখে দিতে পারিনি। আমার চোখে জল চলে আসে। আমি হাতে পানি ঢেলে হাতও ধুইনি। এঁটো হাতেই মাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে
থাকি। আমার সেই কান্নার অর্থ সেদিন মা কী বুঝেছিল, আমি জানিনা।

পরে শুনেছি -- ফিরোজার বাবাই ফিরোজাকে আমাদের বাড়ি থেকে ফিরিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল। মেয়েকে ছাড়া সে নাকি একদণ্ড একাকী থাকতে পারেনা।

সেই কত বছর চলে গেছে কত দিনকাল ক্ষণ। এত বছর পরেও সেই বালিকাকে আমি ভুলতে পারিনি। কী মায়া করেই না আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কথা বলত, স্মিত হাসি লেগে থাকত চোখে মুখে, সন্ধ্যার দীপশিখায় দেখতাম সেই মুখ, হাঁটত ছোট ছোট পা ফেলে আমাদের বাড়ির উঠোনে। ওর কিছু কথা এখনও ক্ষীণ করে আমার কানে বাজে। বিশেষ করে আদুরে কণ্ঠের সেই ডাক -- রতন ভাই।

খুব করে মন চায় রাঙা পথের ধুলো উড়িয়ে চলে যাই পল্লীর নিভৃত ওর সেই গাঁয়ে। যেয়ে যদি দেখা পাই ঐ বালিকার, কিংবা খুঁজতে খুঁজতে যদি দেখা মেলে ফিরোজা রঙের কোনো ঘাস ফড়িং কিংবা অপরাজিতার। দেখতে তো পাব তবু তার রূপ রং ঠিক অনেক বছর আগে দেখা ঐ বালিকার মতো। আম-কাঁঠালের ঝাড়ের উপর দেখতে পাব নীল আকাশ, দেখব রাতের নক্ষত্র বীথি, আলো আঁধারে চেয়ে দেখতে পাব হয়তো কারোর চোখের অশ্রু ছল ছল।…



৩৩.    চিত্রিতা



এই গল্পের কাহিনিকাল গত শতাব্দীর ষাটের দশকের। গল্পের নায়ক একজন ডাক্তার। আমি তার হয়ে উত্তম পুরুষে কাহিনিটি বর্ণনা করেছি মাত্র।

এলএমএফ পাস করার পর চাকুরি নিয়ে নবাবগঞ্জের একটি পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তার হিসাবে যোগদান করি। স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি ছিল ইছামতী নদীর তীরে। বান্দুরা-কলাকোপা থেকে কেন্দ্রটি বেশি দূরে না হলেও আসা যাওয়ার পথ ছিল খুবই খারাপ। সেই সময়ে গ্রামের কাঁচা পথে বৃষ্টিতে কাদা হতো, শুকনো দিনে ধুলো উড়ত আর বর্ষায় অথৈ পানিতে থৈথৈ করত।

আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয় কেন্দ্রের পিছনে একটি পুরানো আধা পাকা ঘরে। যেটিতে গত এক দেড়বছর ধরে কেউ থাকত না। অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। আমার কেন্দ্রের কম্পাউন্ডার শ্যামল গোমেজকে দিয়ে ঘরটি সাজ সজ্জা করিয়ে নেই। সেখানে তখন বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। আমাকে রাতে হারিকেন কিংবা লণ্ঠন জ্বালিয়ে থাকতে হতো।

শ্যামল ওখানকার স্থানীয় ছেলে। আমার চেয়ে তিন চার বছরের বড়ো হবে। বিয়ে করেছে। একটি বাচ্চাও আছে। বউ সন্তান নিয়ে থাকে। বাড়ি থেকেই ডিসপেনসারিতে আসা যাওয়া করে। শ্যামল আমার জন্য একটি কাজ করেছিল, তাহলো পাশের একটি বাড়ি থেকে আমাকে পেয়িং খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।

এলাকাটির নাম সোনাবাজু। নিভৃত গ্রাম। অদূরে বয়ে চলেছে ইছামতী নদী। আমি বিকাল হলেই হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম নদীর তীরে। জেলে পাড়া দিয়ে হাঁটতাম। ওরা আমাকে খুব মান্য করত। বলত - ডাক্তার বাবু এসেছে। কোথায় বসতে দেই! কী খেতে দেব! তারপরও কাঠের টুলে বসতে দিত। বেতের টুরিতে মুড়ি খেতে দিত নারিকেল দিয়ে, না হয় আখের গুড়। গাছের পিয়ারাও খেতে দিত।

আবার কোনো কোনো দিন একাকী হেঁটে নদীর কূল ধরে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেতাম। সন্ধ্যা নামত নদীর কূলেই। বক, পানকৌড়ি, বালিহাঁসের দল উড়ে চলে যেত মাথার উপর দিয়ে ওদের কুলায়। সন্ধ্যা ঘোর হয়ে রাত্রি নেমে এলে আমি ঘরে চলে আসতাম। ঘরে এসে নিজ হাতে সন্ধ্যা বাতি জ্বালাতাম।

সন্ধ্যার পরে কেউ থাকত না। মাঝে মাঝে শ্যামলকে বলতাম, তুমি কিছু সময় আমার এখানে থাকো, কথা বলো, গল্প করো আমার সাথে। শ্যামল আমার অনুরোধে প্রায়ই সন্ধ্যা রাত্রি পর্যন্ত থাকত, এবং গল্প গুজব করে চলে যেত।

আমি শুনতাম ওর অনেক গল্প কথা। বলত এখানকার অনেক পুরাণ কাহিনিও। দুইশত বছর আগের কলাকোপার কোকিলপেয়ারী জমিদার বাড়ির কেচ্ছা কাহিনিও শোনাত। বলত ব্রজেন নিকেতনের নানা রঙ্গ-লীলার কথা। ভালোই লাগত সেই সব কল্পকথা শুনতে। আমি শ্যামলকে বলতাম -- তুমি এসব কার কাছে থেকে শুনেছ? শ্যামল বলত, আমার পিতামহের কাছে থেকে। পিতামহ আবার শুনেছে নাকি তার পিতামহের কাছে। এইভাবেই শোনা কাহিনি। সবই কিংবদন্তি।

সারাদিন ডিসপেনসারিতে রোগীরা আসত, ভালোই লাগত। বিকালবেলা এদিক সেদিক ঘুরতে বের হতাম, সময় কেটে যেত। কিন্তু সমস্যা হতো সন্ধ্যা হতে রাত্রিতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। ঐ সময়টুকু কেমন যেন ভয় ভয় লাগত। যেদিন শ্যামল থাকত সেদিন ভালোই লাগত, যেদিন থাকত না, সেদিন খারাপ লাগত।

একদিন সন্ধ্যায় শ্যামল বহু বছর আগের কোকিলপিয়ারির জমিদার বাড়ির এক কাহিনি আমাকে শোনায়। পুরোটা বলেনি, আংশিক বলছিল। ওর গল্প শোনার পর আমি কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। একবার মনে হলো দরজা খুলে বাইরে যাই। এই নিশীথে সন্তর্পণে হেঁটে চলে যাই ব্রজেন নিকেতনে। কিন্তু পা থেমে গেল!

খুব অস্থির লাগছিল। পায়চারি করছিলাম কক্ষের ভিতর। কী মনে করে দরজা খুললাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি -- প্রাচীন বিধ্বস্ত নগরীর মতো নিকষ অন্ধকার, কেমন ভূতুড়ে লাগছিল চারদিকে। কেমন যেন হুহু করছে আঁধার। আমার হাত পা ভয়ে হিম হয়ে আসছিল। আমি আর বাইরে এগুলাম না। ঘরের ভিতর এসে দরজা বন্ধ করে দেই। বিছানায় শুয়ে থাকি চুপচাপ।

হারিকেন জ্বলছে টেবিলের উপর। নিভালাম না। কালিগঙ্গার কূলবর্তী সোনাবাজুর চরাচরে ক্রমে গভীরভাবে রাত নেমে আসছে। নিস্তব্ধতার ভিতর শুধু নিশি পোকাদের গুনগুনানি শুনছিলাম। ভয়ে ঘুম নেমে আসছিল চোখে। অবশে বুক থরথর করছিল। কেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। হয়ত ঘুমিয়েও পড়েছিলাম।

হঠাৎ বাইরে কার যেন পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। হারিকেন তখনও জ্বলছে। আমি চুপচাপ কান পেতে শুনছিলাম পায়ের শব্দ। একটুপর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। খুব ভয় লাগছিল। ঘড়িতে চেয়ে দেখি রাত ১.৪০ মিঃ। আমি দরজা খুলছিলাম না। কাঁপা কাঁপা পায়ে দরজার এপাশ থেকে বলছিলাম -- আপনি কে? কিছুক্ষণ নীরব। কোনো কথা নেই। আবার বলি-- কে আপনি? ওপাশ থেকে রমণীকণ্ঠে জবাব এল, 'আমাকে তুমি চিনবে না, দরজা খোলো, দেখলে আমাকে চিনবে, আবার নাও চিনতে পারো।'

আমি দুরুদুরু বুকে দরজা খুলে দেই। চেয়ে দেখি - বাইরে এক অপরূপ রমণী মূর্তি দাঁড়িয়ে। আমার কোনো অনুমতি না নিয়েই সে গৃহের ভিতর প্রবেশ করে। সোজা যেয়ে খাটের উপর বসে। হারিকেনের আলোয় দেখলাম - পরনে তার ধূসর রঙের ফিনফিনে ঢাকাই জামদানী শাড়ি। কানে সোনার ঝুমকা, গলায় সীতাহার। দুহাত ভরে সোনার চুড়ি। মৃদু রিনঝিন করছে। রমণীর মুখ অপার মাধুর্যে পরিপূর্ণা। গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরীয়। চোখ দুটো টানাটানা। কালো ভ্রুকুটি। নিরাভরণ মুখশ্রী, কিন্তু লাবণ্যময়। আমি ভয়মিশ্রিত বিস্ময়ে দেখছিলাম তাকে। রমণী আমাকে বলছিল - তুমি চেয়ে দেখছ আমাকে কিন্তু চিনতে পারছ না। 
আর চিনবে কী করে? এর আগে আমাকে কখনও দেখনি! আমার নাম চিত্রিতা। সবাই আমাকে চিত্রা বলে ডাকে।

আমি চিত্রাকে বললাম - এই নিঝুম রাত্রি নিশীথে আপনি আমার এখানে কেন এসেছেন? কেউ জানলে কেউ দেখলে আপনার বদনামি হবে, আমারও বিপদ হবে। আপনি চলে যান।

চিত্রা পরিহাস করে বলছিল - আমার একদণ্ড সান্নিধ্য পাবার জন্য কত পুরুষ হাহুতাস করে, আর তুমি কী না তোমার ঘরের মধ্যে এই নির্জন গভীর রাত্রিতে আমাকে একা পেয়েও তাড়িয়ে দিতে চাইছ। সত্যি তুমি এক আহম্মক তরুণ!

আমি বললাম - ঠিক আছে, আপনি আপনার পরিচয় দিন। কী জন্য এসেছেন, বলুন। দেখি, আপনার জন্য কী করতে পারি।

চিত্রা বলছিল -- আমি জমিদার বাড়ির বধু। জমিদারের বড়ো ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল চার বছর আগে। আমাদের কোনো সন্তান হচ্ছিল না। ডাক্তার কবিরাজ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছে -- আমার স্বামীই সন্তান প্রদানে অক্ষম।

-- এই রকম তো হতেই পারে। তো এই সমস্যার জন্য আপনি এত রাতে আমার এখানে কেন এলেন?

-- রাতে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। দিনের বেলায়, দিনের আলোয় জনসম্নূখ দিয়ে এসে আমার সমস্যা তোমাকে বলা সম্ভব হতো না। তাই এত রাতে নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে আসতে হলো।

-- তো কী সমস্যা আপনার?

-- আমি দেড়মাসের সন্তান সম্ভবা। আমার গর্ভে অন্য পুরুষের সন্তান এসেছে। যার সন্তান এসেছে তাকে আমি ভালোবাসি না। এটি ক্ষণিক আনন্দের একটি দূর্ঘটনা। আমি গর্ভপাত করার জন্য তোমার এখানে এসেছি। আমার এই অবৈধ গর্ভধারণের খবর জানাজানি হলে জমিদার বাড়ির মান সম্মান হানি হবে। তুমি আামাকে রক্ষা করো - আমাকে বাঁচাও।

-- কীভাবে সম্ভব হবে? আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি এখানে নতুন এসেছি। নতুন চাকরি। আমার খুব ভয় লাগছে। আমি এটা করতে পারব না।

চিত্রা আমার অপারগতার কথা শুনে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বলে - তুমি যত টাকা চাও, তাই দেব। তবুও করে দাও।

আমি বললাম -- টাকার লোভ আমাকে দেখাবেন না। আমার কোনো টাকা পয়সার দরকার নেই।

চিত্রা বলছিল -- তবে গর্ভপাত করাতে চাচ্ছ না কেন?

-- এটি একটি অবৈধ কাজ। গর্ভপাত করানো হবে আমার জন্য বেআইনি। তাই।

-- দেখো, তুমি বয়সে তরুণ। আমি তোমার চেয়ে বয়সে পাঁচ ছয় বছরের বড়ো হবো। তোমাকে আমি মিনতি করছি। তুমি আমার এই উপকারটা করে দাও। কী করবে না?

-- না, করব না। আমার খুব ভয় লাগছে। যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়, যদি বিপদ হয়। আমার চাকরি চলে যাবে।

চিত্রা এবার বলছিল -- আমি যৌবনবতী রূপসী রমণী। আমাকে তোমার ভোগ করতে ইচ্ছে করে না? আমার সৌকর্য, আমার গোপন রূপ তোমার দেখতে মন চায় না? আমি কালরাতে আসব। তুমি সব সার্জিক্যাল জিনিসপত্র নিয়ে রেডি থাকবে। ঘরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করবে। আমি আসব মধ্য নিশীথে একাকী। কাল পরব কালো রঙের তাঁতের শাড়ি। শরীরে গহনা পরা থাকবে আজকের গহনাগুলোই। তোমাকে আমি আজই প্রথম দেখলাম -- খুব সুদর্শন তুমি। তোমাকে খুব ভালো লেগেছে। কেন জানি জীবনে আর একটি ভুল করতে খুব ইচ্ছে করছে। তোমাকে এই রাত্রি নিশীথে হেরিকেনের ম্লান আলোয় যতটুকু দেখলাম- খুব ভালো লাগছে। অদ্ভুত সরল তুমি। এই কলঙ্কিত জীবন, এই দেহ এই মন তোমাকে দিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আবার! কী আমাকে নেবে তুমি!

আমি কোনো কথা বলছিলাম না। শুধু নিষ্পলক চেয়ে দেখছিলাম চিত্রাকে। কী মোহিনী রূপ! কী আবেদনময়ী! কী চুম্বক আমন্ত্রণ! এই চিত্রিত রাত থমকে যাচ্ছিল অসীমে!

চিত্রা এসে আমার একটি হাত ধরে বলে --  চলো, একটু বাইরে যাই। এই আঁধার রাতে আজ আকাশে চাঁদ নেই। কিন্তু কোটি কোটি তারা জ্বলছে। সেই কোটি তারার আলোয় তুমি আমাকে একবার দেখ প্রাণ ছুঁয়ে। দেখবে, আমাকে তোমার ভালো লাগবে। আমার শরীরের এক অলৌকিক গন্ধে পাগল হবে তুমি!  

চিত্রা আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসে। আকাশে জ্বলে থাকা কোটি কোটি তারার আলোয় দেখলাম চিত্রাকে! কী মাধুর্যময় ওর মুখ। কী নিষ্কলুষ মায়াভরা চোখ! কী যে স্বর্গীয় ক্ষণ ছিল তখন! অন্তরে আমার তখন অন্য অনুভব, যেন --
"আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,/ তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।"

বিমুগ্ধ হয়ে দুজনেই আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে থেকেছিলাম কতক্ষণ জানিনা। একসময়  চিত্রা বুক ছেড়ে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল -- কাল আসব। 

সকালে আমার  ঘুম ভাঙে নাই স্বাভাবিক নিয়মে। শ্যামল এসে ঘরের কড়া নাড়ছিল খুব জোরে জোরে এবং ডাকছিল 'স্যার, স্যার' ওঠেন।  আমি যেয়ে দরজা খুলে দেই।  শ্যামলের চোখ মুখ কেমন যেন ভয়ার্ত ও বিষাদময়!  

শ্যামল বলছিল - স্যার আপনাকে এখনই জমিদার বাড়িতে যেতে হবে। গতরাতে জমিদার বাড়ির বউ চিত্রিতা খুন হয়েছে। আপনাকে তার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। 


৩৪.    সেই মুখচ্ছবি 


আমার প্রতিদিনের কর্ম ব্যস্ততার ফাঁকে কিংবা রাত্রিতে ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে যখন শুয়ে পড়ি, সেই আঁধার হয়ে আসা ক্ষণে শৈশবের যে সব মুখগুলোর কথা মনে পড়ে, তার মধ্যে একটি মুখচ্ছবি প্রায়ই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কখনও সেই  মুখটি আবছা আবছা দেখি, কখনও আবার উজ্জ্বল রৌপ্যকান্তের মতো ঝলমলে দেখি। 

গ্রামে ফ্রী প্রাইমারি স্কুলে 'ক,খ' ক্লাস রুমে সেই মুখখানি আমি প্রথম দেখেছিলাম। পরনে ছিল হাফ প্যান্ট, গায়ে পুরনো জামা। খালি পা, কোনো স্যান্ডেল পরত না। পায়ে প্রায়ই ধুলোবালি লেগে থাকত।

ওর নাম আব্দুর রহমান। গরীব ঘর থেকে পড়তে আসা একটি ছেলে। ক্লাস রুমের এক কোণে নিরীহের মতো চুপচাপ বসে থাকত। ক্লাসেও সম্ভবত ও নিজেকে গরীব মনে করত। এই ছেলেটাই আমার অন্যান্য বাল্য সহপাঠী বন্ধুদের মতো একজন বন্ধু হয়ে উঠল। 

আব্দুর রহমানের বাড়ি আমাদের পাশের পাড়ায়। স্কুলে যেতে প্রায়ই ওর সাথে পথে দেখা হতো। আবার স্কুল ছুটি হলে ওর সাথে বাড়ি চলে আসতাম। সেই কৈশোর  বেলায় কতো কথা হয়েছে ওর সাথে, কতো খেলা করেছি উন্মুক্ত মাঠে, তার কোনো কথাই আজ আর মনে নেই। আজ এত বছর পর শুধু ওর মুখখানির কথাই আমার মনে পড়ে।

প্রাইমারি স্কুল পাস করার পর আমরা একই হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম।  আব্দুর রহমান নিয়মিত ক্লাস করতে পারত না। সপ্তাহে একদুই দিন কামলা বেচত। ওদের সংসারের ভরণপোষণেরও সহায়তা করতে হতো ওকে। খুব একটা ভালো ছাত্র আব্দুর রহমান তাই হতে পারেনি। তারপরও লেখাপড়া চালিয়ে নিয়েছিল। ও আমাকে প্রায়ই ওর আশার কথা বলত, স্বপ্নের কথা বলত। ওর ইচ্ছে ছিল -- ও একদিন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হবে। 

নাহ্, আব্দুর রহমান প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হতে পারেনি। কোনো মতো তৃতীয় শ্রেণিতে এসএসসি পাস করতে পেরেছিল। তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্য কলেজে ভর্তি হয়নি। 

আমি ঢাকা চলে আসি। এবং কলেজে ভর্তি হই। ঢাকা  থেকে যখন বাড়িতে যেতাম, তখন ওর সাথে আমার খুব একটা দেখা হতো না। শুনতাম আব্দুর রহমান পুরোপুরি কামলা হয়ে গেছে। সে কামলা বেচে তাদের সংসারের ভরণপোষণ  নির্বাহ করে।

আমি কলেজের পড়া শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। প্রতি ছুটিতে যখন বাড়িতে যেতাম তখনই অন্যান্য বাল্যবন্ধুদের মতো ওকেও খুঁজতাম বাজারে চা স্টলে আড্ডার স্থানে। কিন্তু ওর দেখা পেতাম না। 

তারও দুতিন বছর পর একবার  আব্দুর রহমানের দেখা পেয়েছিলাম গ্রামের পথের উপর। আমি ওকে দেখে চিনতেই পারছিলাম না। মলিন একটি লুঙ্গি পরে আছে। উদোম শরীর। ক্ষেতের ধুলোবালি সর্ব অঙ্গ মাখা। আমি ওকে বলি -- কেমন আছিস রহমান?  ও বলল -- ভালো। 
আমি আরও কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও কোনো কথাই শুনল না। হেঁটে অন্য দিকে চলে গেল।

তারপর চলে গেছে আরও কয়েক বছর। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে চাকুরিতে ঢু্কে যাই। বাড়িতে তাই একটু কম যাওয়া হতো।  অনেকদিন পরপর দুএক দিনের জন্য  বাড়িতে গেলেও আব্দর রহমানের কথা খুব একটা মনে করতাম না।  দেখাও হতো না। ভুলে যাওয়া যাকে বলে। 

তারও দু' বছর পর একবার বাড়িতে গেছি। কেন জানি আব্দুর রহমানকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে হলো। আমার আরেক বাল্য সহপাঠী সামাদকে বলি --' চল্ আব্দুর রহমানদের বাড়ি থেকে আজ একটু ঘুরে আসি।'
সামাদ বলে -- কেন যাবি? 
আমি  বললাম -- ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। 

সামাদ বিস্ময়ে বলে -- তুই শুনিসনি কিছু? 
আমি বললাম -- কী?  না তো!
সামাদ বলে --  'আবদুর রহমান তো মারা গেছে।  গত বছর যমুনার চরে নৌকা নিয়ে কাশ কাটতে গিয়েছিল। কী এক বাকবিতণ্ডায় প্রতিপক্ষরা ওকে লগি বৈঠা দিয়ে  পিটিয়ে মেরে ফেলে যমুনার জলে ভাসিয়ে দেয়। ওর লাশটাও পাওয়া যায়নি।'

তারপর আরও  কতো বছর চলে গেছে।  জীবনের কতো কর্ম ফাঁকে, কতো আঁধার হয়ে আসা রাত্রিতে বিছানায় শুয়ে  আব্দুর রহমানের মুখখানি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখেছি ... এমনই কতো রাত্রি পেরিয়ে যাবে।  এমন করেই আরও কতকাল দেখতে পাব ওর মুখচ্ছবি।


৩৫.    বাসনা কুসুম 


আশির দশকের মাঝামাঝির বৃষ্টিমুখর এক বিকেল।  তখন একলা জীবন আমার। সুখের মুহূর্তগুলো একলা উপভোগ করি। দুঃখের ক্ষণগুলো একাকী পাড় করি। আবার ভালো না লাগার সময়গুলো মন কেমন করে যেন কেটে যেত।

ঘরের চালে রুপোলী বৃষ্টির ফোঁটা ঝমঝম করে পড়ছে। একবার বিছানায় শুয়ে থাকি। আর একবার বারান্দায় যেয়ে বৃষ্টি দেখি। দাঁড়িয়ে থেকে জলের শব্দ শুনি। আবার ফিরে  এসে বিছানার উপর বসে থাকি। ভাবলাম, বই পড়ব। বুকশেলফের কাছে যেয়ে বই খুঁজি।  কোন্ বইটি পড়ব?  চোখে পড়ল বুদ্ধদেব গুহের 'বাসনা কুসুম'। বইটি পড়া ছিল আজ থেকে বছর চারেক আগে।  কেন জানি আবার পড়তে ইচ্ছে হলো। শেলফ থেকে বইটি বের করে পাতা উল্টাতে থাকি। পাতা উল্টাতে যেয়ে একটি চিঠি দেখতে পাই। চিঠির কাগজের রং হলদেটে হয়ে গেছে। চার ভাজ করা  চিঠিটি খুলে পড়তে থাকি --

দাদা ভাই, 

আপনি আমার বয়সে ছোট ছিলেন। তারপরও দাদা ভাই ডেকেছিলাম। আত্মপরিজনহীন এই শহরে  আপনার এখানে যে ক'টি দিন ছিলাম  খুব আপন করে নিয়েছিলেন। আমাদের জন্য অনেক করেছেন। চির ঋণী হয়ে থাকলাম। 

আজ চলে যাচ্ছি। আপনার সাথে আর কী কখনও  দেখা হবে ? যাবার বেলায় কেন জানি, এই চিঠিতে আপনাকে "তুমি" বলতে ইচ্ছে করছে। একবার হলেও আমাদের বাড়িতে তুমি এসো। আমি জানি, সময়ে অসময়ে তোমার কথা আমার খুব মনে পড়বে। তোমাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করবে। 

ইতি --
শারমিন ভাবী।

এই শারমিন ভাবী ছিলেন আমার ক্ষণকালীন এক সহকর্মী নাজিমউদ্দীনের স্ত্রী। নাজিম উদ্দীন ছিল আমার থেকে  প্রায় সাত আট বছরের বড়ো । উনি ওনার স্ত্রীকে ঢাকায়  চিকিৎসা করতে এনে আমার বাড়িতে সপ্তাহখানেক থেকেছিলেন।

ওনারা এসেছিলেন  তিন বছর আগে।  আমার মনে পড়ছে ওনারা যখন এসেছিলেন তখন এই "বাসনা কুসুম" বইটি  সদ্য পড়া শেষ করে টেবিলের উপর রেখে দিয়েছিলাম। শারমিন ভাবী যেদিন চলে যায় সেদিনই হয়ত চিঠিখানি লিখে বইয়ের ভাজে রেখে গিয়েছিলেন। আমি তা না দেখেই বইটি বুকশেলফের ভিতর রেখে দিয়েছিলাম।

এই ক'বছরে আমার কাছে শারমিন ভাবী অনেকটাই বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। আজ এই চিঠিটি পড়ার পর সেই শারমিন ভাবীকে আবার  নতুন করে মনে পড়ছে। কয়েকটি দিন উনি ছিলেন, কী আদর যত্নই না করে গিয়েছিলেন আমাকে। ঐ ক'টা দিন স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে উনি কানায় কানায় ভরে তুলেছিলেন।

মনে পড়ছে তাকে প্রথম দেখার সেই দিন। 

হেমন্তের রোদ্দুর তখন সারা আঙিনাতে মুখর।  নাজিম উদ্দীনের স্ত্রীর পরনে একটি সবুজ রঙের তাতের শাড়ি, হাতে চারটি চিকন সোনার চুড়ি, মুখে কোনো আবীর মাখা নেই।  অনেকটাই নিরাভরণ।  বয়স ত্রিশ বত্রিশ হবে। মাথায় ছোট্ট ঘোমটা দেওয়া।  আমায় দেখে ঘোমটাটা আরও একটু সামনের দিকে টেনে আনেন । হেমন্তের রোদ্দুর সেই ঘোমটার ভিতর দিয়ে আবছায়া রূপে প্রবেশ করে তার মুখখানিকে বেশ উজ্জ্বল করে তুলেছিল। নাজিম উদ্দীন আমাকে পরিচয় করে দেয় -- 'এই হচ্ছে তোমার ভাবী। তোমার শারমিন ভাবী।'

আমি তখন ইউনিভার্সিটির সদ্য  মাস্টার্স পাশ করা তরুণ এক , বয়স চব্বিশ পঁচিশ। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম। তখনও বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, মেঘদূতম, শকুন্তলা দুস্মমন্ত'রা মগজে ঘোরাফেরা করে। সুযোগ পেলেই কল্পনায় চলে যাই, দূর শিপ্রানদীর তীরে। সেই আমি দেখলাম আজ হেমন্তের রোদ্দুর ছোঁয়া একজন কুসুমিত রমণীর অনাবৃত দুটো হাত। আমার মনের ভিতর এক প্রকারের নূতন অনুভূতি, আমার বুকের রক্তের তালে তালে সেদিন এক প্রকার নূতন স্পন্দন স্পন্দিত হয়েছিল।

শারমিন ভাবীরা সাতদিন ছিলেন আমার বাড়িতে। ঐ কয়দিনে সত্যি সত্যি আমার বাড়িটা তিনি সাজালেন। ঘরের কোণে কোণে ধূলো ময়লা জমেছিল সেগুলো তিনি নিজ হাতে পরিস্কার করলেন। বারান্দার চালে মাকড়সা বাসা বেঁধে অসংখ্য  ঝুলে  ভরে রেখেছিল, সেগুলোও ঝাড়লেন। পড়ার টেবিল গোছালেন। বিছানাপত্র সব পরিপাটি করে রাখলেন।  বাড়ির সামনের বাগানে আগাছাগুলো লোক ডেকে কেটে ফেললেন। মালিনীর মতো প্রতিদিন গোলাপ, বেলী, গাঁদা ও পাতাবাহারের গাছগুলোতে পানি ঢাললেন এবং পরিচর্যা করলেন।    

হঠাৎ করেই জমিদার পুত্রের মতো জীবন হলো আমার। বাড়িতে খাবার রেডি থাকত। হাতখান ধূয়ে শুধু খেতে বসতাম। শারমিন ভাবী মুখে তুলে খাওয়ানোটাই শুধু বাকি রাখতেন।  বাকি সবই তিনি করতেন, সব তৈরি করে রাখতেন। কটা দিন ছিল শুধুই আনন্দময় দিবারাত্রি। 

শারমিন ভাবীরা যেদিন চলে যাবে তার আগের দিনের কথা। বিকালে অফিস থেকে এসে দেখি -- শারমিন ভাবী নতুন একটি শাড়ি পরে সেজেগুজে বসে আছে। অপূর্ব সুন্দর লাগছিল ওনাকে। কপালে টিপ পরেছিল। চোখে মেখেছিল কাজল। খোপায় বেঁধেছিল গাঁদা ফুলের মালা। শারমিন ভাবী আমাকে চুপিচুপি বলেছিল-- 'আামাকে দেখতে কেমন লাগছে?'

-- অপূর্ব সুন্দর লাগছে, একদম  দেবীর মতোন। 
-- কেন সেজেছি জানেন?
-- কী জন্য? 
-- আপনাকে প্রেরণা দিচ্ছি। যেন তাড়াতাড়ি বিয়ে করে একটি লক্ষ্মীমন্ত সুন্দরী বউ ঘরে আনেন। 
-- তাই? 
-- জ্বী।

চিকিৎসা শেষে শারমিন ভাবী যেদিন চলে যায়, সেদিন তাকে দেখি --  মাথার ঘোমটা অর্ধেকটা খুলে স্থির শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হলো কালো চোখদুটির নীচে জগতের সকল অশ্রুভার গোপনে লুকিয়ে রেখেছে। ঈষৎ ভারী সেই চোখ দুটো তুলে বলেছিল -- 'আমি কিন্তু ঘরের সবকিছু সাজিয়ে গুজিয়ে রেখে গেলাম । কোনো এলমেল যেন না হয়। যদি কখনও আবার আসি -- ঘরে  যেন একজন লক্ষ্মীমন্ত বউ দেখতে পাই।'

চিঠিখানা পড়ে ভাজ করে 'বাসনা কুসুমে'র পাতায় রেখে দেই। সেদিন আর বইটি পড়া হলো না। ধীর সন্তর্পণে হেঁটে  বারান্দায় চলে যাই। বাইরে তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। ঘরের চাল থেকে গড়ে পড়া স্বচ্ছ বৃষ্টির জল আঁজলায় ভরে চোখমুখ ধূয়ে ফেলি। চোখ দুটো ধুতে যেয়ে  মনে হলো -- কেনই ধুয়ে ফেললাম এই চোখ!  আমার চোখ থেকে তো কোনও গোপন অশ্রু ঝরে পড়েনি।

তিনটি বছর চলে গেছে। এই তিন বছরে  চিঠিটি আমার চোখে পড়েনি, এজন্য নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল । কী এক কোমল অনুভব নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন। ভাবলাম, শারমিন ভাবীকে দেখতে যাওয়া উচিৎ। 

আমার বিয়ের দিন তারিখও ঠিক হয়ে আছে। আমার এই বিশেষ  দিনে শারমিন ভাবী'রা আসুক। তাদেরকে  নিমন্ত্রণ করার জন্য তাই একদিন সকালবেলা একটি লোকাল ট্রেনে করে ঢাকার অদূরে শ্রীপুরের কাওরাইদ স্টেশনে গিয়ে নামি। 

নির্জন ছোট্ট একটি স্টেশন। কোনো জনকোলাহল নেই। একটি চা'র দোকানে চা খেতে খেতে দোকানীকে জিজ্ঞাসা করি -- ভাই, বেলদিয়া গ্রাম কতদূর? 

দোকানী বলল --  এখান থেকে মাইল দুই আড়াই হবে।
-- কীভাবে যাব? 
-- হেঁটে যেতে হবে। আপনি প্রথমে কাওরদীর ব্রাহ্ম মন্দির পর্যন্ত রিক্সায় যাবেন। তারপর সুতিয়া নদীর কূল ধরে মেঠো পথে হেঁটে হেঁটে চলে যাবেন। 

আমি তাই করলাম। একটি রিক্সা নিয়ে মন্দির পর্যন্ত চলে যাই। ওখানে নেমে প্রথমে মন্দির দর্শন করি। খুব ভালো লাগছিল ব্রাহ্ম্য ধর্মালোম্বীদের এই মন্দির। জনশ্রুতি আছে রবীন্দ্রনাথ নাকি এই মন্দির দেখতে এসেছিলেন।  পাশেই অতুল চন্দ্র সেনের সমাধি। সমাধি গাত্রে লেখা আছে  -- 'মোদের গরব মোদের আশা, আ-মারি বাঙলা ভাষা।'

মন্দির আর সমাধি দেখে পথে নেমে পড়ি।  নদীর তীর ঘেষে মেঠো পথ ধরে হাঁটতে থাকি সামনের  দিকে। কার্তিকের রোদ্রছায়ায় হাঁটতে কী যে ভালো লাগছিল! পথের একপাশে স্বচ্ছতোয়া সুতিয়া নদী।  নদীটির  জল স্থির। স্রোত নেই। বক ও পানকৌড়ি উড়ছে। অদূরে  সারি সারি  গ্রাম। গ্রামগুলো সবুজ শ্যামলিমায় ঢাকা। হাতের বামদিকে বিস্তৃর্ণ ধানক্ষেত। পাকা ধানের গন্ধ মিশ্রিত বাতাস মৌ মৌ করে ভেসে আসছিল।

মাইল দুই যাওয়ার পর দেখলাম, একটা হালট। হালটটি নদী থেকে চলে এসেছে।  ছোট্ট বাঁশের পুল।  সাঁকোটি পেরিয়ে আবার মেঠো পথে উঠি। ধানক্ষেতের আইল ধরে কিছু দূর যেতেই বনানী ঘেরা যে গ্রামটা দেখতে পেলাম, ঐটাই বেলদিয়া গ্রাম। ঠিক পূর্বপাশ দিয়েই সুতিয়া নদী বয়ে গেছে।

বেলদিয়া গ্রামে ঢুকতেই একজনকে জিজ্ঞাসা করে নাজিম উদ্দিনের বাড়িটি চিনে নেই ৷

নাজিমউদ্দীনের বাড়ির আঙিনায় যখন পৌঁছি -- তখন দুপুর গড়িয়ে যায়। বাড়িটি ছায়াঘেরা। চারপাশে আম কাঠালের গাছ। ছোট্ট একটি পুকুরও আছে। ঠিক অদূরে মাঠের পরে সুতিয়া নদী। আমাকে দেখে একটি আট নয় বছরের মেয়ে বাড়ির ভিতর  থেকে বের হয়ে আসে। 
আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করি -- তোমার নাম কী? 
মেয়েটি বলে -- নাজমা। 
-- তোমার বাবার নাম কী? 
-- নাজিম উদ্দীন দেওয়ান 
-- উনি বাড়িতে নেই? 
-- বাবা তো বেঁচে নেই। 

আমি স্তব্ধবাক হয়ে যাই। ওকে বলি -- কী বলো তুমি! মেয়েটি বলছিল -- আপনি জানেন না? 
-- জানিনা মা। 

নাজমা বিনম্র কণ্ঠে বলে  -- আপনি কোথা থেকে এসেছেন?  বললাম -- ঢাকা থেকে এসেছি। তোমার বাবা আমার বন্ধু। একসাথে আমরা চাকুরি করেছি দু'বছর ।

বললাম  -- তোমার মা বাড়িতে নেই? 
-- আছে। 
-- তুমি যেয়ে ওনাকে বলো -- ঢাকা থেকে রঞ্জন চাচু এসেছে। 
-- আচ্ছা।

মেয়েটি বাড়ির ভিতর চলে যায়। ভাবছিলাম -- এই জগতে আনন্দহাসিরাশি কত ক্ষণকালের। কোথায় কোন্  গ্রামের নিভৃতে এসে দেখতে পেলাম, কত ফুল অনাদরে ফুটে নির্জনে তা ঝরে যায়।  কতজন কত 
অশ্রু ঝরায়…কত স্বপ্ন ভেঙে যায়..কত আশার হাসি মিলিয়ে যায়! 

একটুপর বাড়ির ভিতর থেকে শারমিন ভাবী চলে আসে। আজও দেখলাম তাকে সেই প্রথম দিনের দেখার মতো করে। আজও মাথায় ঘোমটা দেওয়া ছিল।  কিন্তু কত পার্থক্য। হেমন্ত রোদ আমপাতার ফাঁক দিয়ে আজকেও পড়েছিল তার মুখের উপর। কিন্তু প্রথম দেখার মতো  সেই স্নিগ্ধ রূপ আজ নেই।  বিষাদমাখা মুখ তার.. ... কেমন শীর্ণকায় ও মলিন হয়ে আছে। তাকে দেখে আমার বুকের ভিতর অস্ফুট কান্না গুমরে ওঠে। 

শারমিন ভাবী কিছুটা বিস্ময় কণ্ঠে বলে -- 'দাদাভাই তুমি! আমাদের কথা তোমার মনে আছে?' পরক্ষণে আবার বলে -- 'সেই তুমি এলে! যখন তোমার নাজিম ভাই আর নেই।'

আমাকে বাড়ির ভিতর নিয়ে যায়। ভাবী বলছিল -- আমার এই জীর্ণ পর্ণকুটিরে তোমাকে যে কোথায় কীভাবে বসতে দেই। 

তিনি আমাকে একটি দুই হাতলের কাঠের চেয়ারে বসতে দেন। শারমিন ভাবীর কাছে থেকে জানতে পারি নাজিম ভাই পাঁচ মাস আগে হার্ট অ্যাটাক করে বাড়িতেই মারা যান। হাসপাতালে নেওয়ার সময় পায়নি।

শারমিন ভাবীর সাথে অনেক কথা হয়। নাজিম ভাইকে নিয়ে অনেক স্মৃতিকথা বলি।  ভাবী বলছিল -- 'তুমি কী তোমার ঘরে লক্ষ্মীমন্ত বউ এনেছ? ' বললাম -- না। এখনও আনিনি।  তবে আনব খুব শীঘ্রই।  দিন তারিখ ঠিক হয়ে আছে। 

-- খুব খুশি হলাম। দেখতে অনেক সুন্দরী নিশ্চয়ই। 
-- জ্বী, আপনার মতো মায়াময়ী! 
-- আমাকে দেখাবে না? 
-- দেখাব বলেই এখানে এসেছি। আমার বিয়েতে আপনি যাবেন।
-- তোমার নাজিম ভাই নেই যে! বরঞ্চ তুমি তোমার বউকে এখানে নিয়ে এসে আমাকে দেখিয়ে নিয়ে
যেও।

তখন  বিকেল ঘনিয়ে এসেছে। আমি শারমিন ভাবীকে বললাম -- সন্ধ্যায় একটি ট্রেন আছে। ঐ ট্রেনে আজই ঢাকা চলে যাব। 

তিনি  কিছুতেই আসতে দিলেন না। বললেন-- কাল সকালে একটি ট্রেন আছে, সেই ট্রেনে তুমি চলে যেও। আমি তার কথা ফেরাতে পারিনি। শারমিন ভাবীর ওখানেই সেদিন থেকে যাই।

তখন সন্ধ্যা আসন্ন। শারমিন ভাবীকে বললাম -- আমি একটু নদীর কূলে বেড়াতে যাব। ভাবী বললেন -- যাও। ঘুরে এস। ভালো লাগবে। 

আমি জানি, এই পল্লীগ্রামে শারমিন ভাবীকে সাথে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তাকে বললাম না সাথে যেতে। আমি একাই নদী দেখতে যাই।  নদীর কূলে একজায়গায় দেখি, একটি জারুল গাছ। পাতায় পাতায় অসংখ্য নীল রঙের ফুল ফুটে আছে।  আমি জারুল তলায় বসে নদীর শান্ত রূপ দেখতে থাকি। সন্ধ্যার হিমেল বাতাস বয়ে আসছিল নদী থেকে। একাকী নীরবে বসে থাকি কিছুক্ষণ। শারমিন ভাবীর কথা মনে পড়ছিল খুব । কেমন জনম দুঃখী সে। এমন মায়াময়ী একটি মেয়ের এত কষ্ট! এত যাতনা। আচ্ছা, কোনো প্রদীপ জ্বলা সন্ধ্যায়–আমার কথা সে কি মনে করবে,  আমার তো মনে পড়বে।

নদীর কূল থেকে ফিরে আসি। পথে আসতে আসতে রাত হয়। বাড়িতে এসে দেখি -- শারমিন ভাবী হারিকেন জ্বালিয়ে বাড়ির ফটকে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। 

ভাবী খুব যত্ন করে রাতের খাবার খাওয়ালেন। পাশের রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়। আমি শুয়ে আছি। চোখে ঘুম আসছিল না। নির্ঘুমে কেটে যায় অনেকটা সময়। তারপর ঘুমিয়ে যাই...। তারপর অদ্ভুত একটি  বিস্মরণেরও  স্বপ্ন দেখি --

শারমিন ভাবী কেমন যেন  মাধুর্যের রূপ ধরে কাছে আসে। রাতের আকাশের তারার মতো কারুকার্যময় সেই রূপ! সুতিয়া নদীর মতো স্নিগ্ধ সৌম্য দেহ। অনেক দূর থেকে সে প্রাণের হিল্লোলে কাছে চলে আসছে।
তার পায়ের শব্দ জল কলতানের মতো বাজছে... হঠাৎ সমস্ত পৃথিবী নতুন রঙে রঙীন হয়ে ওঠে। নিভৃত পল্লী  কোণে এক জীর্ণ পর্ণকুটিরে একজন মায়াবতীকে দেখছি বিমুগ্ধ হয়ে! কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে! চরাচর জুড়ে অদ্ভুত আলো আঁধার। সেই আলো আঁধারের মাঝে শারমিন ভাবী  আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছে ...। 

আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি কান পেতে থাকি। এ কী সত্যি!  আমি শুনতে পাচ্ছিলাম -- পাশের ঘরে শারমিন ভাবী গুমরে গুমরে কাঁদছে। 

বাকি সারারাত দুঃস্বপ্নের অনুভব নিয়ে  কাটিয়ে দেই। তারপর ভোর হয়।  

পরিশিষ্ট --

শারমিন ভাবী আমার কেউ হয়নি। সে ছিল একটা মধুর স্বপ্নের মতো, বেদনার মতো। হঠাৎ কোনো গানের সুরের মতো কানে কানে গান শোনার মতো.. আমার জীবন ছন্নছাড়া হয়নি। একটি লক্ষ্মীমন্ত বউ এনেছি ঘরে। সেই আমার ঘর দুয়ার সাজিয়ে রাখে। সন্ধায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে ধরে ....।

তারপরও মাঝে মাঝে মন কেমন করে ওঠে। এইসব দুঃখ নিয়ে আফসোস করি না। যা পেয়েছি অনেক পেয়েছি। তাই সত্য। তাই পরম পাওয়া। এ যে অসীম। ফুরায় না কখনও। আর, ফুরিয়ে গেলেও তার কাছে থেকেই আবার মুঠো মুঠো করে ভরিয়ে নেই  আমার  জীবন পাত্র।


৩৬.     তারা বানু


অনেক বছর আগে একবার বিকাল করে ঢাকা থেকে বাড়ি যাচ্ছিলাম। অফিস কর্মদিবসের সেদিন ছিল সপ্তাহের শেষ দিন।  অফিস থেকে বেরুতে বেরুতে মনে হলো আজ বাড়ি যাব। উদ্দেশ্য কিছুই না। মার কথা মনে হয়েছিল। ভাবলাম মাঝখানে একদিন ছুটি আছে, যাই বাড়িতে। মাকে দেখে আসি।

তখন টাংগাইলের ভূয়াপুর থেকে লঞ্চে যমুনা পার হয়ে সিরাজগঞ্জ যেতে হতো। আমি বাসে মহাখালী থেকে প্রথম ভুয়াপুর যাই, তারপর লঞ্চে সিরাজগঞ্জ। শহরে যখন পৌঁছি তখন রাত প্রায় আটটা বেজে যায়। আমাদের বাড়ি শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে। কোনো বাস চলত না তখন। আমি শহরের বাহিরগোলা থেকে একটি রিকশা নেই শালুয়াভিটা খেয়াঘাট পর্যন্ত। এরপর আর রিকশা যায় না।

খেয়াঘাট পর্যন্ত যেতেই বেশ রাত হয়ে যায়। খেয়াপার হয়ে আমি হেঁটে রওনা হই। যেতে হবে আরও তিন মাইল। গ্রামের রাস্তা সন্ধ্যার পর থেকেই জনমানবহীন হয়ে যায়। অনেকটা একাকী হাঁটতে থাকি বাড়ির দিকে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ধূলি সড়ক পথ ধরে।

সাহানগাছা পর্যন্ত যেতেই রাত প্রায় দশটা বেজে যায়। এখান থেকে আরও এক মাইল যেতে হবে মেঠোপথে ফসলের ক্ষেতের ভিতর দিয়ে। নির্জন পাথার পুরো প্রান্তর। কোথাও একটি বাড়িঘর নেই। রাত বিরাতে এই পথ দিয়ে যেতে মানুষ ভয় পায়। মাঝে একটা শ্মশান ঘাটও আছে। 

অন্ধকার রাত্রি। ঢাকা থেকে আসার সময় খেয়াল ছিল না এখন কৃষ্ণপক্ষ। আকাশে চাঁদ নেই। কিন্তু আকাশ ছিল তারায় তারায় ভরা। আখ ক্ষেতের ভিতর শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। নিশাচর পাখি ডানা ঝাপটে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে ঝোপে ঝাড়ে। কোথাও একজন মানুষও নেই। শরীরটা ভয়ে কেমন যেন ছমছম করছে। মনে পড়ে গেল -- একবার এমনই এক রাত্রিতে একাকী এই পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলাম, শ্মশান ঘাট পাড় হওয়ার পরই ঠাকুর বাড়ির উষা চক্রবর্তী আমার পিছু নিয়েছিল। ছোট পাকুড় গাছের তলে আমাকে নিয়ে গিয়ে গলা টিপে মারতে চেয়েছিল। সে যাত্রা দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিলাম। জানি না আজ কী হবে ! কী কপালে আছে।  হয়ত সেই পেত্নীটা আজও পাকড়াও করতে পারে।

কিন্তু যেতে তো হবেই। এই রাত্রি নিশীথে পথের উপর বসে থাকতে পারব না। ভয়ে ভয়ে আল্লাহ রসুলের নাম নিয়ে দোয়া দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা থেকে নেমে মরা নদীটা পাড় হলাম। নদীতে তখন হাঁটু পানি। জুতা খুলে হাতে নেই। পানি পেরিয়ে ওপারে উঠি। ব্যাঙ ডাকছে। একটা কাছিম ঝপাং করে ডাঙা থেকে জলে ঝাপ দিল। আৎকে উঠলাম। হাঁটতে থাকি মরা নদীর কূল ধরে মেঠো পথ দিয়ে। জোনাকির আলো জ্বলছে। অদূরে  আখ ক্ষেতের পাশে একটি খেক শিয়াল আমার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। কাছে যেতেই টুপ করে আখ ক্ষেতের ভিতর লুকিয়ে যায় ।

আমি একটু জোরে জোরেই হাঁটছি। সামনেই শ্মশান ঘাট। খুব ভয়ে আছি আজও না জানি ফাঁসিতে মরা সেই উষা চক্রবর্তী আমার পথ আগলে দাঁড়ায়। হাত পা কেমন যেন হিম হয়ে আসছিল। ডানে বায়ে তাকাচ্ছিলাম না। আবারও দোয়া দরুদ পড়ে সামনের দিকে এগুতে থাকি। এবং ভালো ভাবেই শ্মশান ঘাট পাড় হই।

আরও কিছুদূর যাওয়ার পর নির্জন পাথারের মাঝখানে পিটেসরা গাছটির কাছাকাছি চলে যাই।  শুনেছি এই জায়গাটাও খারাপ। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছিল। বুকের উপর  হাত রেখে দেখি ভিতরের আত্মাটা ধকধক করছে। চারদিকে রাতের নিঝুম আঁধার শনশন করছে। অন্ধকারে সামনের দিকে তাকিয়ে পথ চলতে থাকি।

হঠাৎ দেখতে পাই একটি স্ত্রীলোক পিটেসরা গাছটির তলায় মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঐ মেয়েলোকটিকে দেখে আমার হাত পা অবশ হয়ে যায়। আবার হয়ত উষা চক্রবর্তীর বাগে পড়লাম।  আজ আর আমার রক্ষা নেই।  মেয়েটি সন্তর্পণে আমার আরও কাছে চলে আসে। আমি পথের উপর দাঁড়িয়ে যাই। আমার পা থরথর করে কাঁপছে। মেয়েটি মাথা থেকে ঘোমটা সরায়। আমি মাটির দিকে মাথা নীচু করে থাকি।

মেয়েটি বলে -- 'তুমি আমার দিকে তাকাও।' কণ্ঠ শুনে মনে হলো এই মেয়ে উষা চক্রবর্তী নয়, অন্য কেউ। আমি মাথা তুলে তাকাচ্ছিলাম না। মেয়েটি আবার বলে-- তুমি ভয় পেওনা। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। তুমি আমারই গায়ের ছেলে। আমি জানি, তুমি অনেক ভালো  ছেলে। 

আমি ওনার অভয় পেয়ে আস্তে করে চোখ তুলে আঁধারের মাঝে মেয়েটির মুখের দিকে তাকাই। কিন্তু মুখ দেখে চিনতে পারলাম না উনি কে?  তবে মুখটি দেখে খুব অস্পষ্ট করে অনেক আগের একটি মুখের কথা মনে পড়ল। মনে হলো হয়ত সেই মেয়েটাই হবে। তারপরও বললাম -- আমি আপনাকে চিনতে পারছি না।

মেয়েটি বলল -- সে তুমি এত বছর পর আমাকে চিনতে পারবে না। তুমি যখন আমাকে শেষ দেখেছিলে তখন তুমি নিতান্তই একটি কিশোর বালক ছিলে। আমি খুব বেশি তোমাদের বাড়িতে যেতাম না। আমি আমার নামটি বলি, দেখ তো  মনে পড়ে কী না?

মেয়েটি কম্পিত কণ্ঠে বলে -- আমি তারা বানু।

আমি একটু ভয় পেলাম। হঠাৎ আৎকেও উঠলাম। আমি বললাম -- মনে পড়ছে আপনার কথা। সে তো অনেক বছর আগে তুমি মরে গেছ। 

তারাবানু আমার কথা শুনে একটি বিদ্রুপের অট্টহাসি দিল। সেই হাসির শব্দ সেদিনের সেই  নির্জন প্রান্তর ও আঁধারের আকাশ একধরনের ঘৃণার প্রকম্পে অনুরণন হতে লাগল। সে বলে -- আমি মরে গেছি? হা-হা, সত্যি কী আমি মরে গেছি!  তুমি মনে করে দেখ তো, আমি কী অভাবে কিংবা রোগে, শোকে, দুঃখে মরে গিয়েছিলাম ?

আমি মনে করার চেষ্টা করলাম --

সে এক অস্থির সময়ের কথা। আমার তখন কিশোর বয়স। আমাদের গ্রামের একটি গরীব মেয়ে অভাবের তাড়নায় পয়সার বিনিময়ে নাকি নিজের দেহ দান করত। একদিন সন্ধ্যারাতে জানতে পারলাম, ঐ মেয়েটিকে আজ রাতেই মেরে ফেলবে, গ্রামেরই কিছু যুবক শ্রেণীর মানুষ। মেয়েটির অপরাধ, সে  ছেলেদের চরিত্র নষ্ট করে ফেলছে।

খবরটি শোনার পর মনটা ভালো লাগছিল না। কেমন যেন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমি নিতান্তই একজন কিশোর বালক ছিলাম, কী-ই-বা আমি করতে পারি? মেয়েটি যেহেতু আমার গ্রামেরই, তাই ওকে দেখেছিও অনেক। মেয়েটার মুখচ্ছবি কেবল চোখে ভেসে উঠছিল। অনেক অজানা আশংকা ও ভয় নিয়ে সে রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সকালবেলা লোকমুখে জানতে পারি --  মেয়েটিকে রাতের প্রথম প্রহরে  ওদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে নেয়।পরে দূরে নির্জন নদীর কূলে একটি পিটেসরা গাছের তলায়  নিয়ে যায়। সেখানে প্রথমে সবগুলো যুবক পালাক্রমে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে এবং পরে চোখ বেঁধে বেওনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে এবং ঐ পিটেসরা গাছটির তলায়  গর্ত খুরে মাটির নীচে ওকে পুতে রাখে।

ধর্ষণ শেষে ওরা যখন মেয়েটির চোখ বাঁধবে, তখন নাকি মেয়েটি অনুনয় করে বলেছিল- 'তোমরা শেষবারের মতো একটিবার আমাকে এই পৃথিবীকে দেখতে দাও।' 

মেয়েটি অন্ধকারের মাঝেই চোখ মেলে দেখেছিল চারদিকের রাতের পৃথিবীকে, দেখেছিল তারাভরা আকাশকে। দেখেছিল অদূরে  আঁধারের ছায়ায় তার কুসুমপুর গ্রামকে। আমার মনে পড়ছে, ঐ মেয়েটির নাম ছিল তারা বানু।

****  ****  ****

তারাবানু বলছিল -- জানো রঞ্জন, আমি রাত হলেই ঘুরে  বেড়াই আমাদের সারা গ্রাম। দেখতে যাই আমাদের  ছনের পাতার জীর্ণ বাড়িটা। আমার গরীব মা বাবা রোগে শোকে দুঃখে অনাহারে মারা গেছে। আমার ছোট ভাইটা অনেক কেঁদে কেঁদে না খেয়ে শীর্ণকায় হয়ে  বড়ো হয়েছে। দেখেছি ভাইটা ভালো নেই। ছায়া ঢাকা  আমার এই গ্রামে বেঁচে থাকার কত সাধ ছিল। গায়ের কিছু ছেলে যাদের আমি স্নেহ করতাম, তারাই আমাকে বাঁচতে দিল না। 

তারাবানু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পথ ছেড়ে দাঁড়ায়। এবং আমাকে বলে -- তুমি চলে যাও। 

আমি তারা বানুকে পিছনে রেখে সামনের দিকে হেঁটে চলে আসতে থাকি। পথ চলতেই শুনতে পেলাম তারা বানু গুমরে গুমরে কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ শুনে মনটা মুহূর্তে খুব খারাপ হয়ে গেল। হাঁটা বন্ধ করে পথের উপর থেমে যাই। খুব দেখতে ইচ্ছে হলো তারা বানুকে। আমি পিছনে ঘুরে দাঁড়াই। দেখি -- তারা বানু নেই। শুধু তার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে।


৩৭.      একটি রুমালের আত্মকথা


শেষ পর্যন্ত চাকুরি একটি  পেলাম। পোস্টিং - চট্টগ্রামের এক পার্বত্য থানা শহরে। কালই  এই শহর ছেড়ে চলে যাব। পুরনো ঢাকার ঘিঞ্জি গলিতে মেসের জীবনের অবসান  হবে কাল থেকে।

চাকুরি পেয়ে মনটা খুশি লাগছে না। একটা আফসোস বোধ, আর একটি হারানোর বেদনা মনটাকে বড়ই বিষাদাচ্ছন্ন করে  রেখেছে। কেমন যেন হাহাকার লাগছে। ভাবছিলাম - এই শহরের  এই শেষ বিকালটা কোথাও যেয়ে  একাকী বসে থাকি।

আমি তো একাকী মানুষ। যেখানেই যাই না কেন সেখানেই চির একা। তাই একাকীই বের হলাম। 

চানখার পুলের মোড় থেকে একটি রিকশা নিয়ে চলে যাই পার্কে। লেকের পাড়ে একটি কংক্রিটের বেঞ্চ আছে। ওয়াক ওয়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাই বেঞ্চটির কাছে। বেঞ্চটি খালি। চৈত্রের দুপুরের রোদে তপ্ত হয়েছিল আগেই। দেখলাম -- তখনও বেঞ্চটি তপ্তই আছে। কড়োই গাছের ঝরা পাতা বেঞ্চের উপর পড়ে আছে। আমি ঝরা পাতার উপর বসে পড়ি। লেকের জলের দিকে তাকাই। পানিপোকা জলের উপর দৌড়াদৌড়ি করছিল। 

অদূরে চেয়ে দেখি -- এক জোড়া নবীন প্রেমিক প্রেমিকা ঘাসের উপর  বসে আছে। দুইজন দুইদিকে মুখ ফিরে  আছে। কোনো কথা নেই তাদের। হয়ত সব কথা বলা শেষ হয়ে গেছে। হয়ত বা কোনও অভিমানে তারা মুখ ফিরিয়ে বসে আছে।

আজ থেকে ছয়মাস আগে এক আশ্বিনের বিকালে 
ঠিক  এখানে এই বেঞ্চের উপর বসে শর্মিলী আমার সাথে অভিমান করেছিল। নাহ্,  ঘাসের উপর বসে থাকা ঐ দুটি ছেলেমেয়ের মতো আমরা মুখ ফিরিয়ে বসে ছিলাম না। শর্মিলী চির অভিমানে সেদিন চলে গিয়েছিল। যাবার বেলায়  আমার দিকে একটিবারও ফিরে তাকায়নি।

শর্মিলীকে আমি ডাকতাম মিলি বলে। সে আমার সহপাঠী বন্ধু ছিল। বড়ো লোকের মেয়ে। আমরা বন্ধু থেকে কখন প্রেমিক প্রেমিকা হয়ে উঠেছিলাম, সেই দিনক্ষণ কেউই নির্দিষ্ট করে মনে রাখতে পারিনি।  বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামপাস, এই শহরের কত অলিগলি রাজপথ, পার্ক, রেস্টুরেন্ট, নদীর কূলে আমরা চুটিয়ে প্রেম করে বেড়িয়েছি। সে এক বাঁধ ভাঙা জলের মতো কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রেম। বর্ষার সারারাত্রির বৃষ্টির মতো, তপ্ত রোদ্দুরেরর মতো, পাগল কাড়া জোছনার মতো আমরা  ভিজেছি, পুড়েছি, জ্বলেছি।

এই পার্কেও আমরা অনেকবার এসেছি। এই বেঞ্চে উপর বসে থেকে কত স্বপ্নের কথা বলেছি। অভিমান করে ঐ নতুন তরুণ তরুণীর মতো আমরাও মুখ ঘুরে বসে থেকেছি কত।  কথা বলতে বলতে কথা শেষ হয়ে গেলে চুপচাপ কেটে গেছে কত সময়।

কিন্তু সেদিনের সেই আশ্বিনের বিকালটা চির বিচ্ছেদের ক্ষণ হয়ে থাকল। অভিমানটা চিরকালের হয়ে গেল। মিলি বলেছিল -- "বাবা মা তোমার সাথে আমার বিয়ে দেবে না।  তোমার চাকুরি নেই। বেকার। টিউশনি করো। এমন ছেলের সাথে আমাকে তারা বিয়ে দিতে রাজি নয়। তারচেয়ে চলো আমরা একাকী কোর্টে যেয়ে বিয়ে  করে ফেলি।"

আমি না বলেছিলাম। আরও অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। মিলিকে বলেছিলাম -- 'একটি চাকরি পেয়ে নেই।  তারপর বিয়ে করব।'

মিলির বাবা মা পাত্র ঠিক করে রেখেছিল। মিলির পক্ষে সম্ভব ছিল না বাবা মাকে ফেরানো।

সেদিন আমি বুঝতে পারিনি কী বড়ো একটি বস্তু আমি হারাতে বসেছি। কী অসীম  মূল্য ছিল তার।  যা পেতাম সাগরের জলের মতো সুলোভে। সেই কী না হয়ে গেল দূর্লভ। পরে তা আমি কোনও দাম দিয়ে আর কিনে নিতে পারিনি। 

আমি দেখছিলাম মিলি অঝোর ধারায় কাঁদছে। এত চোখের জল এর আগে কারোর চোখ থেকে ঝরতে দেখিনি। আমি আমার পকেট থেকে শুভ্র একটি রুমাল বের করে মুছে দিচ্ছিলাম ওর চোখের জল। একবার মুছে ফেলি। দেখি আবার ঝরছে। আবার মুছে ফেলি। আবার ঝরে পড়ছে। অশ্রুধারা এমন অনবরত প্রবাহমান হয়! সত্যি বিস্ময়কর!  আমি স্তব্ধ চোখে তা চেয়ে দেখছিলাম শুধু । 

মিলি আর কোনও কথা বলল না। চোখের জল ঝরাতে ঝরাতে চলে গেল। একবারও ফিরে তাকল না। পরে শুনেছি, মিলি আর একজনের বউ হয়েছে। এই শহরেই সে থাকে। ওর সাথে আর দেখা হয়নি কোনদিন কোথাও।

উত্তর চট্টগ্রামের থানা শহর ফটিকছড়িতে একটি এনজিও অফিসে  আমার পোস্টিং হয়। প্রিয়  ঢাকা শহর ছেড়ে চলে এসেছি এখানে। সেও কয়েকদিন হয়ে গেল।

আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়  ছোট্ট একটি  নদীর তীরে একটি কাঠের বাড়িতে। অফিস থেকে বেশি দূরে নয় বাড়িটি। দুটো রুম ওখানে। একটি রুম বড়ো। আর একটি রুম ছোট।  ছোট রুমটিতে আগে থেকেই পিওন মোমিন আলী থাকে। বড়ো রুমটিতে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়।

পুরনো ঢাকায় একটি ঘিঞ্জি গলিতে থাকতাম। কী কোলাহল ছিল সেখানে।  কত মানুষ দেখতাম! কত হৈহল্লা হতো! কত চিৎকার চেচামেচি। ফেরিওয়ালার হাঁকঢাক। রিকশার বেলের শব্দ। কুকুরের ঘেউঘেউ। এখানে এইসবের কিছু নেই। কেন যেন মনে হতে লাগল শহরের ঐ কোলাহলই ভালো ছিল। প্রচণ্ড শব্দ তরঙ্গ  আমার মনকে ভুলিয়ে দিতে পারত অনেক দুঃখ বেদনা আর গ্লানিকে।

অফিসে যতক্ষণ থাকতাম ততক্ষণ মোটামুটি ভালোই লাগত। সময় বয়ে যেত কর্ম ব্যস্ততায়। বিকালে যখন ঘরে ফিরতাম তখন থেকেই  নিঃসঙ্গতা ধেয়ে আসত আমার দিকে। যখন সন্ধ্যা নামত তখন থেকেই মনে হতো এই ঘর, এই নদীর তীর, এই বনবিহার সব যেন প্রাগৈতিহাসিক এক ভূতুরে রাজ্য । 

প্রায়ই সন্ধ্যায় মোমিন আলীকে ডেকে কাছে বসিয়ে রাখতাম, অকারণে ওর সাথে গল্প গুজব করতাম অনেক রাত পর্যন্ত। তারপর শোবার আগে দেখতাম তারার আকাশ। আঁধার অরণ্যানী। রাতের শব্দে কুলু কুলু করে বয়ে যেত নদীর জলধারা। 

আমার কাছে  শর্মিলীর কোনও অভিজ্ঞান বা কোনও স্মৃতি চিহ্ন বা বস্তু নেই যে, তাই নিয়ে সময় কাটাব। ওর সাথে আমার কোনও চিঠিপত্র আদান প্রদান হতো না। তাই পুরনো কোনও চিঠি পড়ে সময় কাটাব।  এই নির্জন জনমানবহীন কোলাহলহীন নদীর কূলে এই বাড়িতে মিলির সমস্ত মধুময় স্মৃতিগুলো আমার মন মাঝে আক্রমণ করতে থাকে।

রাত হলেই ওর চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ শুনতে পাই। ওর পায়ের শব্দ কানে বাজে। ওর নিঃশ্বাস আমার ললাটে এসে পড়ে। যেদিন পার্কে লেকের ধারে ওর সাথে আমার শেষ দেখা হয়, নীরব শব্দহীন করে ও যে কেঁদেছিল, সেই কান্না আমি গুমরি গুমরি  শব্দের মতো শুনতে পাই। অনেক রাত পর্যন্ত আমার ঘুুম আসে না। কী যে অন্তর দাহ হয়! 

একদিন  কেন জানি বিকাল থেকেই শরীরটা অবশ লাগছিল। পা চলতে চাইছিল না পথ চলতে। সন্ধার পরই মোমিন আলীকে বলি -- আমাকে খেতে দাও। আমার কেমন যেন ঘুম পাচ্ছে। মোমিন আলী আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করে। আমি খেয়ে শুয়ে পড়ি। এবং ঘুমিয়ে যাই।

মাঝরাতে কীসের একটি শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখি -- জানালার পাল্লাগুলো নড়ছে। অথচ বাইরে কোনও ঝড়ও নেই, বাতাসও নেই।  আমি কক্ষে আলো জ্বালাই। তখনও জানালার পাল্লা দুলছে।  আমি মোমিন আলীকে ডাকি। ও শুনল না। আমি জানি মোমিন ঘুমকাতুরে ছেলে। ও হয়ত  নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে৷ 

আমি আস্তে আস্তে জানালার কাছে যাই। জানালার কাছে যেতেই শব্দটা আর শোনা গেল না। জানালা খুলে  চেয়ে দেখি -- বাইরে অপূর্ব জোছনার রাত। হারুয়ালছড়ির নদীর জল সোনালি রঙে রঙিন হয়ে আছে। নিভৃত নদীর কূল তাকিয়ে দেখছিলাম, আর দেখছিলাম  আরেকপাশের অরণ্য পথ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখি -- একটি মেয়ে সাদা শাড়ি পরে হেঁটে হেঁটে বনের দিকে চলে যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় দেখছিলাম সেই মেয়ের পিছন রূপ। এই যেন সেই শর্মিলী আমার। তেমনই উচ্চতা, তেমনই দেহ, তেমনই হাঁটার ধরণ তার।

সকালবেলা মোমিন আলীকে বলি -- রাতে  কে যেন এসেছিল জানালার ওপাশে। সে এক রমণী। আমার এক পরিচিতার মতো দেখতে । একাকী বনের গভীরে সে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। জোছনার বন্যায় মিলিয়ে গেল বন অভ্যন্তরে। মোমিন আলী আমার এই কথা শুনে বলছিল - এইসব কিছু না স্যার। এ আপনার মনের ভ্রম! এখানে কোনও ভূত প্রেত নেই। 

আর একদিনের কথা, সেদিন ছিল ছুটির দিন।  বিকাল থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। সন্ধার পর থেকে তা মুষলধারে নামতে থাকে। মোমিন আলী নেই। ও চলে গেছে রাঙ্গুনিয়ায় ওদের গ্রামের বাড়িতে। আমি খেয়েদেয়ে আগে আগেই শুয়ে পড়ি। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছিল। 

শুয়ে  আছি। মনে হলো আমার সারা শরীর হিম হয়ে আসছে। বুক ধড়পড় করছে। হৃদ স্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। দুচোখ ঘুমে মুদে আসছিল। একটুপর গভীর  ঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

আজও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। কান পেতে শুনি -- বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। সাথে দমকা বাতাস। ঘরের জানালার কপাট নড়ছে। কিন্তু জানালা বন্ধ। আমি উঠে বসি। শোয়ার সময় ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছিলাম না। ইচ্ছে করেই জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। জানালার পাল্লা নড়ার শব্দটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা!  

আমি জড়সড় হয়ে বসে আছি। হঠাৎ বাইরে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পাই। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দও কানে আসছিল।  ঠিক সেদিনের সেই মেয়ের মতো কারোর পায়ের শব্দ। এর পরপরই দরজার কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পাই। আমি দরজার কাছে এগিয়ে যেয়ে বলি -- কে তুমি? দরজার ওপাশ থেকে উত্তর আসে -- আমি শর্মিলী। 

আমি ভয় পেলাম না। চিত্ত আমার উৎফুল্ল হয়ে উঠল। মনে মনে ভাবলাম -- আমার হারিয়ে যাওয়া মহামূল্যের সেই নীলকান্তমণি আমারই দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। 
আমি দরজা খুলে দেই। দেখি -- বাইরে সত্যি সত্যি শর্মিলী দাঁড়িয়ে আছে।

শর্মিলীর পরনের শাড়ি ভিজে চুপসে গেছে। আমি মিলিকে বলি -- 'এত রাতে তুমি এখানে! ' আমার কোনও কিছু বলার আগেই মিলি আমার বিছানার উপর এসে বসে।
আমি ওকে বলি -- তুমি কাপড় চেঞ্জ করে নাও। মিলি বলে -- না। 
আমি বললাম -- ঠাণ্ডা লাগবে তো। 
-- লাগুক।  আমি দেরি করব না। আমি এখনই চলে যাব।
-- তুমি থাকবে না? 
-- না। আমি তো একসময় তোমার ঘরেই আসতে চেয়েছিলাম। তুমি আনো নি।
-- আমি এজন্য খুব অনুতপ্ত। তোমাকে হারানোর ব্যথা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি।
-- হ্যাঁ, তুমি বয়ে বেড়াচ্ছ আমি জানি।  আর আমি তোমার সেই ব্যথা সারিয়ে দেয়ার জন্যই এই বৃষ্টির রাতে ভিজতে ভিজতে তোমার কাছে চলে এসেছি। 

আমি মিলিকে বললাম -- তুমি আমার কাছে আমার ঘরে থেকে গেলেই আমার ব্যথা সারবে। 

-- না। আমি থাকতে আসিনি। তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়াও। 

আমি ওর সামনে মুখোমুখি দাঁড়াই। মিলি আমার টি-সার্টের পকেট থেকে একটি সাদা রুমাল বের করে  বলে -- এই রুমালে আমার চোখের জলে ভিজে আছে। আমার চোখ, মুখ, গাল ও পুরো মুখ মণ্ডলের স্পর্শ এই রুমালে লেগে আছে।  তুমি জ্ঞানে অজ্ঞানে এই রুমাল থেকে আমার শরীরের স্পর্শ অনুভব করো। গোপনে কেঁদে কেঁদে তুমিও তোমার চোখের জল মুছে ফেল এই রুমাল দিয়ে। জানো -- আমার খুব কষ্ট হয় এই জন্য। অনেক দূর থেকে আমি তা অনুভব করি। এই অভিশপ্ত রুমালটি তুমি আর তোমার বুক পকেটে রেখ না। তুমিও এজন্য কষ্ট পাও। আমিও পাই। এ যে অভিশপ্ত এক অভিজ্ঞান। এটা রাখতে নেই। তুমি তোমার কেচিখানি দাও। আসো-- আমরা দুজনে মিলে এই রুমালটি কুচিকুচি করে কেটে ফেলি। 

আমি আর মিলি সেইরাতে রুমালটি কুচিকুচি করে কেটে ফেলি। বাইরে তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছিল। যেন অনেকদিন আগের এক আশ্বিনের বিকালে রমনা পার্কের মিলির সেই গুমরে গুমরে কান্নার শব্দের মতো সেই বৃষ্টি।  

সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি -- শর্মিলী নেই। টি-শার্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখি --যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা রুমালটিও নেই । দরজার দিকে চেয়ে দেখি -- দরজা খোলা। আমি বাইরে চলে আসি। তখন উজ্জ্বল ভোর। সূর্য উঠি উঠি। বৃষ্টি থেমে গেছে। মনটা উদাস লাগছিল।  মনটা ভগ্নও হলো -- মূল্যবান কিছু পেয়ে আবার হারিয়ে ফেললাম। আমি হেঁটে হেঁটে নদীর কূলে চলে যাই -- জলের দিকে চেয়ে দেখি, রুমালের টুকরোগুলো নদীর জলে ভাসছে ।



৩৮.         নীলকমলের তীরে 



আজ থেকে শতবছর আগে কেমন ছিল বৈকুণ্ঠপুর গ্রাম? এর পথ, ঘাট, নদী? কেমন করে কুলকুল শব্দে বয়ে যেত ইছামতী নদীর জলের ধারা? নদীর পাড়ের  জারুল আর তাল তমালের বনে কেমন লাগত পূর্ণিমা রাতের নিশিছবি! আর কেমন ছিল এই গ্রামের এক বালিকা বউ? কেমন ছিল মণিবালা। 

শতবছর আগে এক কালি সন্ধ্যায় ইছামতীর নদীর তীরে হরেন মাঝির বাড়িতে চল্লিশোর্ধ্ব এক সন্ন্যাসীর মতো লোক এল। মুখে আাধাপাকা শশ্রূমণ্ডিত দাড়ি । পরনে গেরুয়া রঙের মলিন ধুতি। লোকটি সোজা গৃহে প্রবেশ করে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ায়। বারান্দায় হোগলা পাতার পাটিতে বসে সেই সময় হুক্কা টানছিল সত্তরোর্ধ্ব  এক বৃদ্ধ । সে ভালো করে চোখে দেখতে পায় না। সন্ন্যাসীর পায়ের শব্দ শুনে বলে -- ওখানে কে?

সন্ন্যাসী বৃদ্ধকে চিনতে পারে। সে বলে -- বাবা, আমি হরিপদ।

বৃদ্ধ হরেন মাঝি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বলে -- 
বাবা, তুই এত বছর পর আসলি। কোথায় ছিলি এতদিন? সেই  তুই এলি, যখন তোর মা নেই। তোর  মণিবালা নেই। আমি আধা অন্ধ হয়ে এই নদীর কূলে মরণের তীরে একা রয়ে গেছি।

হরিপদ এই বৈকুন্ঠপুর গ্রামে ফিরে এল  কুড়ি বছর পর।   সে অল্প বয়স থেকেই ছিল ভবঘুরে। ঘর সংসারে তার মন ছিল না। প্রায়ই সে উধাও হয়ে কোথাও চলে যেত। কখনও গানের দলের সাথে, কখনও যাত্রা দলের সাথে, কখনও সন্নাসীদের দলে। বিভিন্ন  আখড়ায় সে রাত কাটাত। তিনমাস, ছয়মাস, কখনও বছর পর ফিরে আসত সে। একবার হরিপদ এক ঝুমুর দলের সাথে বাঁকুড়া চলে গিয়েছিল । ওখানে নাকি -- গঙ্গা, ভাগীরথী, দারেকেশ্বর আর ময়ূরাক্ষী নদীর উপর নৌকায় নৌকায় ভেসেছে দুবছর । 

হরেন মাঝি বুদ্ধি করে হরিপদকে ঘরবন্দী করার জন্য বৈকুন্ঠপুর গ্রামেরই জুরান মাঝির দ্বাদশী রূপসী কন্যা মণিবালাকে ছেলে বউ করে ঘরে নিয়ে আসে। নদীর কূলে হরেন মাঝির ছোনপাতার ছিন্নঘর সেদিন থেকে  দ্বাদশী চান্দের আলোর মতো আলোকিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই বালিকা হরিপদকে ঘরবন্দী করতে পারেনি। বিয়ের কয়েকমাস পর এক শ্রাবণ রাতে কাউকে না বলে হরিপদ ঘর ছেড়ে নৌকায় উঠে ভেসে চলে যায়। সেই যে হরিপদ ঘর হতে বেরিয়ে গিয়েছিল, কুড়ি বছর পর এই বৈকুন্ঠপুর গ্রামে আজ সে ফিরে এল।

যে ছোনপাতার ঘর থেকে হরিপদ বের হয়ে  গিয়েছিল সেই ঘরটি বুড়ো হরেন মাঝি  এত বছর ঠিকঠাক করে রেখেছিল, কিন্তু বছর দুয়েক আগে মণিবালার অন্তর্ধানের পর সে আর ঘরটি ঠিক করে রাখেনি। ঘরটি জীর্ণ পর্ণকুটিরে রূপ নিয়েছে। বৃষ্টি হলে জল পড়ে। ঘরের চারপাশে আগাছায় ভরে গেছে। কখনও কখনও সর্পও দেখা যায়। 

হরিপদ আস্তে আস্তে পায়ে হেঁটে ঐ ঘরে গিয়েই ওঠে। কেমন গুমোট আঁধার হয়ে আছে ঘরটির ভিতর। অসীম শূন্যতা! কেমন মাটির সোদা গন্ধ! বাইরে থেকে অচেনা বৃক্ষ আর গাছগাছালির  গন্ধও আসছিল। কোনও দীপশিখা কেউ জ্বালায়নি। কাঠের চৌকিটা পড়ে আছে এক কোণে। বিছানাপত্তর নেই। হরিপদ অন্ধকারে চৌকির উপর বসে পড়ে। ঘরের চালের ফুটো দিয়ে আকাশ  দেখতে পায়।  গুচ্ছ গুচ্ছ তারা ঠিকরে পড়ছিল ঘরে।

বুড়ো হরেন মাঝি ডাকছিল -- হরি, তুই কোথায় গেলি? 

হরিপদ বাপের কাছে চলে আসে। বলে -- কেন ডাকছ বাবা? 

-- পাতিলে কটা ভাত আছে। খেয়ে নে। তোর  অনেক খিদে লেগেছে মনে হয়। হরিপদর পেটে খিদে ছিল। সে দুটো খেয়ে নেয়।

হরেন মাঝি ছেলেকে বলে -- তুই মণিবালাকে এত দুঃখকষ্ট ক্যান দিলি? একটি সরলমতি বালিকাকে ঘরে এনে দিয়েছিলাম তোকে। এতগুলো বছর মেয়েটি তোর জন্য অপেক্ষা করেছিল। কত গঞ্জনা  সহ্য করতে হয়েছে। কত লম্পটের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে মেয়েটির উপর। শেষ পর্যন্ত  আর রক্ষা করতে পারেনি ও । মেয়েটি কলংকিত হয়েছে। 

বুড়ো আরও বলছিল -- লজ্জা আর গ্লানি নিয়ে যেদিন মেয়েটি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, সেদিন বলেছিল -- ''বাপ, আমি যদি কখনও হারিয়ে যাই, কখনও যদি অনেক দূরে চলে যাই, আর আপনার ছেলে যদি ফিরে আসে-- ওকে বলবেন, আমাকে যদি তার দেখতে সাধ হয় -- তবে সে দেখতে পাবে আমাকে দূর বহুদূরে কোনও এক  নীলকমল নদীর তীরে।"

হরিপদ বাপের কাছে থেকে উঠে আবারও পাতার ঘরে চলে যায়। অন্ধকারে খালি চৌকির উপর গিয়ে শুয়ে পড়ে। বালিশ নেই। একটি হাত মাথার নিচে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। ঘুম আসছিল না চোখে। হরিপদর মনে পড়ে -- একদিন রাতে এই চৌকির উপর শুয়ে মণিবালা  জড়িয়ে ধরে বলেছিল -- আমাকে ছেড়ে তুমি আর কোথাও উধাও হয়ে যাবে না, আমাকে ছুঁয়ে কসম করে বলো, -- বলো, যাইবা না।" হরিপদর চোখ জল ভরে উঠে। 

সে পুনরায় চৌকির উপর বসে। কিছু ভালো লাগছিল না ওর। বাইরে নিঝুম আঁধার। হরিপদ বের হয়ে উঠানে আসে। আরেক জীর্ণ  ঘরে হরেন মাঝি ঘুমাচ্ছিল তখন। রাতের বৈকুন্ঠপুর গ্রাম ওর কাছে বড়ই অচেনা মনে হচ্ছিল। আকাশে কোনো চাঁদ নেই।  ঝিঁঝি পোকারা ডাকছে। নিশাচর পাখিরা পাখা ঝাপটে পতপত করে উড়ে যাচ্ছে। নদীর কূলের বন থেকে শিয়াল কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছিল।  হরিপদ উঠোন ছেড়ে নদীর দিকে হাঁটতে থাকে। নদীর কূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে জারুল আর তাল তমালের বনের দিকে চলে যায়৷ 

বনের ওধারেও নদী আছে। নদীর কূল আছে। হয়তো সেখানে কোনও ডিঙি নৌকা বাঁধা আছে। হরিপদ ভাবছিল, গত কুড়ি বছর কত নদীর উপর  সে ভেসেছে, কত জনপদে ঘুরেছে  কিন্তু কোথাও নীলকমল নদীর নাম শোনেনি। এই নামে নদীর উপর সে ভাসেনি কখনও। হরিপদ শূন্যে দৃষ্টি মেলে ভাবছিল, কোথায় এই নীলকমল নদী? আমাকে যে সেথায় পৌঁছতে হবে। মণিবালার দেখা পেতেই হবে। 

শতবছর আগের কোনও এক গরীব পল্লী জেলে বালিকা কেমন করে ভালোবেসেছিল ভবঘুরে এক  তরুণকে? কেমন ছিল তার স্নেহ মায়া মমতা প্রেম? সেই আঁধার রাতে নৌকায় উঠে হরিপদ মণিবালাকে দেখতে নীলকমল নদীর খোঁজে রওনা হয়েছিল এক অপার্থিব মায়ার  টানে। 

বুড়ো হরেন মাঝি সকালবেলা হরিপদকে ডাকতে থাকে-- 'হরি, ও হরি ওঠ্ বাবা!' কোনও সাড়া শব্দ পাচ্ছিল না। হরেন মাঝি ঘরের ভিতর যেয়ে দেখে ঘর শূন্য। হরিপদ নেই।

এই জনমে নীলকমল নদীর তীরে  মণিবালার দেখা পেয়েছিল কী হরিপদ? সেকি ধরতে পেরেছিল মণিবালার কোমল দুটো হাত? আবারও কী কাশফুলের মৌতাতের মতো তার আকুল করা বুকের গন্ধ নিতে পেরেছিল সে? এই কথা লেখক আজও জানিতে পারে নাই। 


৩৯.         বেস্ট ফ্রেন্ড  


আমার ছোট মেয়ে ঐশ্বর্যময়ী  তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ত। স্কুলে যেতে ওর খুব অনাগ্রহ ছিল। নানা ছলাকলা করে সে স্কুলে না যাওয়ার ছুতো খুঁজত।  এই যেমন, ওর মাকে সকালবেলা  বলত -- মা, আমার পেটে ব্যথা করছে। কিংবা বলত -- 'আমার বমি বমি লাগছে, ক্লাসের ভিতর বমি করে ফেলব।' এই রকম নানান বাহানা সে করত।  

আসলে পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার জন্য সে এসব 
করত না। আমরা যেটা বুঝতে পেরেছি, তাহলো  ক্লাসে সে কোনো ভালো বন্ধু খুঁজে পায়নি। এমন কাউকে বন্ধু করতে পারেনি, যার সাথে সময় কাটাবে, তার সাথে গল্প করবে। এটা ওরও সীমাবদ্ধতা হতে পারে। ও হয়ত কাউকে বেস্ট ফ্রেন্ড করে নিতে পারেনি।     

একদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে ঐশ্বর্যময়ী খুব খুশি। ওর সারা মুখে চোখে এক অপূর্ব হাসির ঝিলিক। সে নিজে থেকেই বলছিল -- বাবা, আমাদের ক্লাসে একটা নতুন মেয়ে ভর্তি হয়েছে। ওর নাম রুম্পা। ও খুব ভালো। রুম্পা আমাকে বলেছে -- 'তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হবে?' আমি ওকে বলেছি -- 'হবো।' তারপর, ওর থাম্ব আমার থাম্বে মিলিয়ে বলেছে -- 'আজ থেকে আমরা দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড।'     

এরপর থেকে দেখলাম ঐশ্বর্যময়ী স্কুলে যেতে আর কোনো টালবাহানা করছে না। ও খুব উৎসাহ নিয়ে স্কুলে যায়। কোনো ক্লাস মিস করে না। পড়াশোনাও খুব আগ্রহ সহকারে করে। বাসায় আমার কাছে, ওর মায়ের কাছে, ওর বড়ো বোনের কাছে সারাক্ষণ রুম্পার প্রসংশা করে।    

স্কুলে ওরা দুজন টিফিন শেয়ার করে খেত। এইজন্য ওর মাকে স্পেশাল নাস্তা করে  দিতে হতো। কেক, ন্যুডুল, পুডিং, ফলমূল, এটা ওটা একটু বেশি করেই দিয়ে দিত। আবার রুম্পাও ওর জন্য অনেক রকম খাবার নিয়ে আসত।     

ঐশ্বর্যময়ীর স্কুলে যাওয়া নিয়ে আমাদের আর কোনো টেনশন করতে হতো না।  ও নিজে নিজেই ওর ব্যাগ গুছিয়ে রাখে। হোমটাস্ক গুলো ঠিকমতো করে নিয়ে যায়। 

একদিন ঐশ্বর্যময়ী স্কুল থেকে খুব মন খারাপ করে বাসায় আসে।  আমি ওকে বলি -- 'মামণি, তুমি মন খারাপ করে আছ কেন? কী হয়েছে?'  ঐশ্বর্যয়ী বলে -- 'বাবা,  আজ রুম্পা ক্লাসে আসেনি।' আমি ওকে বললাম -- 'রুম্পার কোনো অসুবিধা ছিল হয়ত, তাই আজ আসেনি। দেখবে কাল আসবে।'

পরের দিন মেয়ে আবারও মন খারাপ করে স্কুল থেকে এসে বলে -- 'বাবা, আজও রুম্পা ক্লাসে আসেনি। আমি বললাম --' হয়ত ওর জ্বর হয়েছে তাই ক্লাসে আসছে না।  তুমি মন খারাপ করো না।  রুম্পার অসুখ ভালো হলে ঠিকই স্কুলে চলে আসবে। 

এক সপ্তাহ মতো রুম্পা যখন স্কুলে আসছে না, তখন ঐশ্বর্যময়ীর পীড়াপীড়িতে স্কুলে অফিস থেকে খবর নিয়ে জানতে পারলাম -- 'রুম্পার আসলেই জ্বর। তাই স্কুলে আসছে না।' এদিকে, ঐশ্বর্যময়ী প্রতিদিনই মনখারাপ করে বাসায় ফেরে এবং আগের মতো স্কুলে যেতে অনিহা প্রকাশ করতে থাকে । কোনো উৎসাহ নেই।         

আরও বেশ কিছুদিন পরে একদিন  ঐশ্বর্যময়ী স্কুল থেকে বাসায় এসে ফুপিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে -- 'জানো বাবা, আজ রুম্পাকে ওর বাবা মা স্কুলে নিয়ে এসেছিল।  ওর নাকি অনেক অসুখ। ও আমাদের দেখতে চেয়েছিল। তাই ওকে স্কুলে নিয়ে এসেছিল।'

পরে খবর নিয়ে জানতে পারলাম রুম্পার লিউকেমিয়া হয়েছে। রক্তে ক্যান্সার। ডাক্তার বলে দিয়েছে -- ও বেশি দিন বাঁচবে না। রুম্পা আর বাঁচবে না জেনেই ওর বাবা মা রুম্পাকে স্কুলে এনে  ওর সহপাঠী বন্ধুদের  দেখিয়ে নিয়ে গেছে।                                                                 

আরও কয়েকদিন পর ঐশ্বর্যময়ী আমার কাছে খুব কান্নাকাটি করে বলতে থাকে -- বাবা, আমাকে রুম্পার কাছে নিয়ে যাও, আমি ওকে দেখব।' 

ওকে কিছুতেই বুঝিয়ে রাখতে পারা যাচ্ছিল না।

ঐশ্বর্যকে নিয়ে আমি এবং ওর মা রুম্পাকে দেখতে একদিন ওদের বাসায় যাই। বাসায় যেয়ে শুনি -- রুম্পা হাসপাতালে।  আমরা ওখান থেকেই হাসপাতালে চলে যাই    

হাসপাতালে রুম্পা ওর বেডে শুয়ে আছে। মেয়েটা শুকিয়ে একদম কালচে হয়ে গেছে। শুধু  প্রাণটাই যেন আছে।  দেখলাম -- স্যালাইন চলছে। নাকে পাইপ লাগানো। ঐশ্বর্যময়ীকে খুব মায়া করে ও দেখছিল।  রুম্পা ওর একটি হাত এগিয়ে দেয় ঐশ্বর্যময়ীর দিকে।  ঐশ্বর্য ওর হাত ধরে -- এবং বলে -- 'তুমি আবার কবে স্কুলে যাবে?  আমি ক্লাসে  তোমাকে খুব মিস করি।'            
           
রুম্পা বলছিল -- যাব।  আমিও তোমাকে খুব মিস করি মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।      


৪০.             সুপ্রভাত 


এই গল্পের কাহিনিকাল ও চরিত্রসমূহ গত শতাব্দীর আশির দশকের।

ট্রেনটি যখন লাহিড়ী মোহনপুর এসে পৌঁছে তখন শেষ বিকাল। একটুপর সূর্য ডুবে যাবে। আশ্বিন মাস। তখনও বন্যার পানি মাঠে খালে বিলে নদীতে থৈথৈ করছে। বাড়িতে যাওয়ার অন্য কোন পথ নেই। মতিন স্টেশনের অদূরে ঘাট থেকে একটি ছোট নৌকায় করে  তার গ্রামের বাড়ি কৈবর্তগাঁতী রওনা হলেন। 

 আবদুল মতিন চাকরি করে ঢাকার লালবাগে একটি এ্যালুমেনিয়াম কারখানায়। সে ঐ কারখানার একজন ফোরম্যান । ছুটিছাটা খুব কম পায়। বছরে এক দুইবার বাড়ি আসে। এবার সে বাড়ি আসছে তার স্ত্রীর অসুখের  খবর পেয়ে।

শেষ বিকালের আবছা আলোয় নৌকাটি চলতে থাকে ছলাৎছলাৎ করে। ভরা জলের  মাঠ পেরিয়ে নৌকাটি চলছে ধীরে। মতিন মিয়া পাটাতনের উপর চুপচাপ বসে আছে। বালিহাঁস মাথার উপর দিয়ে শোঁ-শোঁ করে উড়ে চলে যাচ্ছে তাদের কুলায়।  জলের উপর আমন ধানের ডোগাগুলো ভাসছে। জল কমবে, ডোগাগুলোও আস্তে আস্তে নুয়ে পড়বে। জায়গায় জায়গায় সাদা রঙের শাপলা  ফুল ফুটে আছে। ঢেউ লেগে জলে ভিজছে পাপড়িগুলো।

এখানে জলের প্রান্তর দেখতে সাগরের মতো লাগে। বিশাল পাথার পেরুলেই তারপর নদী, তারপর গ্রাম। মতিন সামনে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। মনটা খুবই বিষণ্ণ। সে এখনও জানে না, তার স্ত্রী এখন কেমন আছে? 

নৌকার ভিতর আরও কয়েকজন মানুষ আছে। কারোর সাথে তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাদের কাউকেই সে চেনেও না। ভিন গাঁয়ের মানুষ।  তারা বিভিন্ন ঘাটে নেমে যাবে। 

সন্ধ্যা নামছে জলের উপর। ক্রমে আঁধার হয়ে আসছে। দূরের কোন গ্রাম দেখা যাচ্ছিল না। একসময় নৌকাটা কোমলা নদীতে এসে পড়ে। প্রচণ্ড ভাটি স্রোত। নৌকাটি বেগ পেল। মতিন মিয়া খোলা আকাশের দিকে চেয়ে দেখে -- তারায় তারায় আকাশ জ্বলজ্বল করছে। চাঁদও উঠেছে। এমন তারাভরা আকাশ আর চাঁদ দেখলে যে কারোর মন ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু মতিন মিয়ার মন ভালো হলো না। তার মন নিমগ্ন হয়ে পড়ে আছে তার ঘরে। 

একটু পর নৌকার মাঝি মতিন মিয়াকে বলল -- কৈবর্তগাঁতী এসে গেছি।  কোন্ ঘাটে নৌকা ভিড়াব? 
মতিন মিয়া বলল -- হরি মন্দির ঘাটে।

আব্দুল মতিন নৌকা থেকে ঘাটে নামে। চাঁদের আলোয় হেঁটে হেঁটে সে বাড়ির দিকে যেতে থাকে। বাড়িতে এসে দেখে -  ঘরের দরজা বন্ধ।  ভিতরে হারিকেন জ্বলছে।  সে দরজায় কড়া নাড়ে। ভিতর থেকে এক বৃদ্ধা দরজা খুলে দেয়। সে ছিল  মতিনের মা। 

চৌকির উপর তার স্ত্রী ফাতেমা শুয়ে আছে। প্রায় সাত মাস পর মতিন তার স্ত্রীকে দেখল। ফাতেমা তার স্বামীকে দেখে চোখের জল আটকাতে পারল না। সে ঝরঝর করে কাঁদছে। মতিন তার স্ত্রীর হাতখানি ধরে, এবং বলে -- তোমার কী হয়েছে? শরীর এত শুকিয়ে গেছে যে! 

ফাতেমা বলে -- বঙ্কিরাটের সাইফুল ডাক্তারকে দেখিয়েছি। সে বলেছে -- আমার নাকি  কলিজায় কঠিন অসুখ হয়েছে। ঔষধও খেতে দিয়েছে। উনি বলেছেন,  সদর হাসপাতালে যেয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে হবে । 

-- তুমি যাও নাই? 

-- না। ভেবেছিলাম তুমি এলে তোমার সাথে যাব। 

-- কতদিন ধরে এই সমস্যা? 

-- তিনমাস হবে। 

-- আমি কালই তোমাকে  সদর হাসপাতালে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।

মতিনকে দেখার পর থেকেই ফাতেমা যে কাঁদছে, তা থামছিল না। সে বলছিল -- কতদিন তোমার আসার পথের দিকে চেয়ে থেকেছি। প্রায়দিনই হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম নদীর ঘাটে। চেয়ে দেখতাম স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা নৌকাগুলির দিকে। কিন্তু কোনও নৌকায়ই তোমাকে দেখতে পেতাম না।

মতিন ফাতেমাকে বলে -- তুমি এত শুকিয়ে গেছ কেন?  খেতে পারো না? 

-- না। খেলেই বমি করে ফেলি। বমির সাথে রক্তও আসে। পেট খুব ব্যথা করে। চিৎকার করি। আল্লাহকে ডাকি। তোমাকে ডাকি।

-- টুটুল কই? 

-- ওর ফুপু এসে নিয়ে গেছে আমার এই অবস্থা দেখে। ফাতেমা কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠছিল । খুব কষ্ট হচ্ছিল। কথাও ঠিক মতো বলতে পারছিল না।

মতিনের মা ভাত খেতে বলে ছেলেকে। মতিন খেতে চায় না। তবুও জোর করে সামান্য কটা ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করে । মতিন খেতে পারে না। ওর চোখে জল চলে আসে। ফাতেমাকে বলে -- তুমি খাবে না? 

ফাতেমা মাথা নেড়ে বলে -- না৷ খেলেই রক্ত বমি করে ফেলব।

মতিন ফাতেমাকে বলে -- তুমি ঘুমাও। আমি তোমার শিয়রে সারারাত বসে থাকব। ভোর হলেই আমরা নৌকা করে চলে যাব সদরে।  ফাতেমা তার স্বামীর হাত ধরে বলে, আমাকে ধরে একটু বাইরে নিয়ে যাও। উঠোনে তোমার হাত ধরে হাঁটব।

মতিন ফাতেমাকে ধরে উঠোনে নিয়ে আসে। সারা গ্রাম তখন নিঝুম হয়ে গেছে। চাঁদের আলোয় ভেসে আছে আঙিনা। ফাতেমা ওর স্বামীকে বলে -- আমাকে ধরে একটু পুকুর পাড়ে বকুলতলায় নিয়ে যাবে?  মতিন তার স্ত্রীকে পাঁজরে জড়িয়ে বকুলতলায় বাঁশের মাঁচার উপর  নিয়ে বসিয়ে দেয়।

ফাতেমা বলে -- আমি একটু তোমার গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকি? 

-- থাকো। 

-- তোমার মনে আছে?  আমাকে যেদিন তুমি তোমাদের বাড়িতে প্রথম  নিয়ে এসেছিলে, প্রথম সেই রাতে তুমি আমাকে এই বকুলতলায় এনে বসিয়েছিলে। সেদিনও ছিল আজকের মতো এমনই চাঁদের রাত। বকুলের গন্ধে আমরা দুজন কী যে  আকুল হয়ে উঠেছিলাম!  ওগো, তুমি আমাকে তোমার বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো না!  আমাকে ছেড়ো না। আমি মনে হয় দূরে কোথাও চলে যাব। আমাকে তুমি যেতে দিও না। তোমার বুকের মাঝে আমার বহুদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে ।

মতিনেরও মনে পড়ছিল কত কথা। ফাতেমা  সব দুঃখ, গ্লানি ভুলিয়ে দিয়েছিল– ও যখন এল তখন জীবনে আর কিছু চাইবার থাকল না, তার সব চাওয়া  পূর্ণ করে দিলো। মনে করত -- তার মতো সুখী মানুষ জগতে আর কেউ নেই।

ফাতেমার শরীর কাঁপছিল খুব। সারা শরীরে প্রচণ্ড জ্বর। মতিন ফাতেমাকে পাঁজরে জড়িয়ে ঘরে নিয়ে আসে।  এবং বিছানায় শোয়ায়ে দেয়। 

ফাতেমা আরও কিছুক্ষণ জেগে ছিল। সে অস্ফুট করে মতিনকে বলছিল -- তুনি নৌকায় করে আমাকে লাহিড়ী মোহনপুর স্টেশনে নিয়ে যাও। তারপর ট্টেনে করে তোমার ওখানে নিয়ে যাবে।  হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছাড়বে। ঝিকঝিক করে চলতে থাকবে  ট্রেন! জানো, তোমার কাছে আমার  জনম-জনম-কাল থাকতে ইচ্ছে করে। 

ফাতেমা একটু ঘুমের মতো হয়ে যায়। মতিন হারিকেন জ্বালিয়ে স্ত্রীর শিয়রে বসে থাকে। সারারাত  চোখের পাতা ক্ষণতরেও বন্ধ করল না। 

শেষ রাতের দিকে হঠাৎ ফাতেনার হেচকি ওঠে। কথা বন্ধ হয়ে যায়। মতিন ওর মাকে ডাকে। ওর মা উঠে এসে ফাতেমার শিয়রে বসে। ফাতেমা মতিনের দিকে এক দৃষ্টিতে নীরবে তাকিয়ে থাকে। কি অপূর্ব স্নেহ-মমতামাখা দৃষ্টি ওর চোখে! মতিন দেখতে পায় ফাতেমার চোখের কোনায় বিন্দু বিন্দু অশ্রুজল জমে আছে। 

তখন সুপ্রভাত সময়। ভোরবেলার পাখিরা কিচির মিচির করছে। দূরে মসজিদে আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ঠিক অকস্মাৎ, ফাতেমা তার স্বামীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে দু'চোখ বন্ধ করে ফেলে। মতিন কেমন একটি আর্ত শব্দ  করে ফাতেমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে ওকে জড়িয়ে ধরে।

মতিন  দরজা খুলে  বাইরে এসে দাঁড়ায়। দূর থেকে ভোরের হাওয়া এল কোমলা নদীর শীতল জল  ছুঁয়ে। ধীরে ধীরে রোদ্দুর উঠছে ঝলমল করে। ছায়া পড়েছে উঠোনর উপর বৃক্ষ- পল্লবের। এই পৃথিবীতে কে যে কখন চলে যায়, কে যে খালি করে সব নিয়ে যায়, কে তার খোঁজ রাখে। 

সময় বহিয়া যায়।  নদীর স্বচ্ছ জলের স্রোতধারায়, আঁধার রাতের অনন্ত নক্ষত্রবীথির ঋজু আলোয়… সুদীর্ঘ যুগসমূহের মধ্যে… যা-কিছু মনের শক্তি, স্মৃতি বিস্মৃতির যতটুকু আনন্দ-বেদনা আছে  তাই  নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। 

মতিনও এমনি কোন শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকবে তার বাকী জীবনকাল। 



৪১.          পথের বাঁধন 



অনেক বছর আগে রাউজানের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম  কলমপতি থেকে রিকশায় করে ফিরছিলাম থানা সদরে। তখন ছিল সন্ধ্যা পূর্ব বিকেল। শুকনো কাঁচা রাস্তা ছিল। পথের দুপাশে উঁচুনিচু টিলা। টিলার গায়ে লতাগুল্ম, কোথাও আবার বাঁশঝাড়। শাল, মেহগনি, জারুল ও বনফুলসহ মহুয়া গাছের বিস্তীর্ণ সারি। ঐসব বৃক্ষ আর লতাপাতার উপর বিকেলের সোনা রোদ ঝলমল করছিল।

ঠিক পিছনেই অস্তমিত সূর্য। রোদের রঙ দেখে মনে হচ্ছিল এখন সময় শুধু লাল আভা বিচ্ছূরণের! এই রকম স্বর্ণালি রোদ্দুর গায়ে মেখে  রিকশার হুডি ফেলে আসছিলাম আমি আর সীমা ভাবি। সামনে পথের উপরে আমাদের দুজনের ছায়া পড়েছিল। রিকশাটি চলছিল সদর থানার দিকে। 

সীমা ভাবি আমার ক্ষণকালীন সহকর্মী ছিল। বিয়ে হয়েছে মাত্র বছর দুয়েক আগে। শরীর ও মননে তখনও তারুণ্যের ছোঁয়া বিরাজমান ছিল। কখনও সে চঞ্চলা উচ্ছ্বলা হরিণীর মতো একটি মেয়ে । আবার মুহূর্তেই সে গম্ভীর, দায়িত্ববান রমণী। কখনও সে বন্ধুর মতো একজন। আবার কখনও সে কারোর প্রেমময়ী স্ত্রী। আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় ছিল সে। বন্ধু হলেও  তাকে সীমা ভাবি বলে ডাকতাম।

আমরা কয়েকজন ছেলেমেয়ে সেইবার রাউজানে গিয়েছিলাম একটি অফিসিয়াল ডাটা উপাত্ত সংগ্রহের কাজে। আর এই কাজ করতে যেয়েই আমাকে আর সীমা ভাবিকে ঐদিন যেতে হয়েছিল সেখানকার একটি পাহাড়ি গ্রাম কলমপতিতে।

আমরা দুজন পথ দিয়ে আসতে আসতে দেখছিলাম পথের ধারে  সাদা ও লাল রঙের মর্নিং গ্লোরীর মতো ছোট ছোট ফুল। সারি সারি টিলার ফাঁক দিয়ে হুহু করে বয়ে আসছিল বাতাস। আর সেই বাতাসে ভেসে আসছিল যত নাম না জানা বনফুলের গন্ধ! আমি সীমা ভাবিকে বলছিলাম -- 'এখন তো গানের সময়, একটা গান গাও তুমি ।'

সীমা ভাবী বলছিল -- 
'এখন কোনও গান নয়, কোনও কথাও নয়। এখন শুধু চুপচাপ করে সব দেখবার সময়। তুমি আমলকী পিয়ালি আর মহুয়া বন দেখতে থাকো।'

আমি বললাম --
'কী উজ্জ্বল বিকেল আজ! কমলা রঙের রোদ্দুর এসে পড়েছে বৃক্ষরাজির সবুজ পাতার উপর! অপূর্ব  লাল আভায় ভরে উঠেছে চারদিকে। এই রোদ্দুর, এই বিকেল ভালো লাগছে না তোমার ? কেন গাইবে না তুমি গান , বলো? '

-- তোমার নাম রঞ্জন না হয়ে যদি অমিত হতো, তাহলে বলতাম -- গান নয় আজ, একটি কবিতা আবৃত্তি করো তুমি অমিত রায়ের মতো। '

-- তুমি গান গাইবে না বলে আমি কবিতা আবৃত্তি করতে পারব না! এত সুন্দর মহুয়ার গন্ধের বিকাল আজ! আর তোমাকে একটি কবিতা শোনাব না, তাই কী হয় কখনও? ভানু চক্রবর্তী শুধু অমিতের জন্যই কবিতা লেখেননি, সে আমাদের জন্যও লিখেছিল --

পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে
দিগঙ্গনার নৃত্য,
হঠাৎ-আলোর ঝল্‌কানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত।

আমার মুখ থেকে কবিতা কেড়ে নিয়ে সীমা ভাবি নিজেই বাকি অংশ আবৃত্তি করতে থাকে  --

নাই আমাদের কনকচাঁপার কুঞ্জ,
বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ।
হঠাৎ কখন্‌ সন্ধ্যাবেলায়
নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,
প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে
অরুণকিরণে তুচ্ছ
উদ্ধত যত শাখার শিখরে
রডোডেন্‌ড্রন্‌ গুচ্ছ।

কখনও চুপচাপ, কখনও কথা বলতে বলতে আমরা  অনেকটা পথ চলে আসি। জনশূন্য বনভূমির সেই পথ। সীমা ভাবি বলছিল -- 'রঞ্জন, রিকশাটা ছেড়ে দাও। বাকি পথটুুকু আমরা হেঁটে হেঁটে চলে যাই!' 

রিকশা থেকে নেমে আমরা সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। চারদিকে সারি সারি টিলা। সন্ধ্যা হয়নি তখনও। কেমন যেন চাপা বাতাস বইছিল। এক জায়গায় দেখলাম - ছোট বড় নুড়ি বিছানো পথ। পা ফসকে পড়ে যাবার আশঙ্কা আছে। সীমা ভাবি বলছিল -- 'রঞ্জন তুমি আমার হাত ধরো।' 

আমি সীমা ভাবির হাত ধরি।
বাকি পথটুকু আমার হাত সে আর ছাড়ল না। পথ চলতে যেয়ে কিসের যেন এক ভয় পাচ্ছিল ভাবি! নির্জন বন লোকালয়ে কণ্ঠরোধ হয়ে আসার মতো সন্ধ্যা নামছিল তখন। এক লাবণ্যময় আঁধার হয়ে আসছিল ঐ পথের উপরে। 

আরও কিছু পথ আসার পর দেখি, পাশে একটি ছোট্ট পাহাড়। একটি মৃত ঝর্ণাও দেখতে পেলাম। বৃষ্টির স্বরূপে ঝিরঝির করে জল ঝরে পড়ছে। সঙ্গীতের মতো পানিরও এমন কলকল শব্দ হয়! জলের এমন সিম্ফনি কানে আসতেই ক্ষণিক বিমোহিত হয়ে পড়ি আমরা। টপটপ জলপতন শুনে বিষণ্ণ হলো মন। আবার প্রশান্তি জাগানিয়াও মনে হলো। অনেকটা পথ ঝর্ণার ঐ কলকল শব্দ শুনতে শুনতে চলে আসি। 

আমরা চলতে থাকি সামনের দিকে। তখন সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার হয়েছে! বন মোরগ আর টুনটুনির ডাক শোনা যাচ্ছিল। নাম না জানা আরো পাখির ডাকও শুনতে পাচ্ছিলাম। মাঝে এক ফাঁকে পিছনে ফিরে দেখেছিলাম সূর্যাস্ত। সে এক অপূর্ব দৃশ্য । নির্জন বন ক্রোড়ে কিছু  অপার্থিব সৌন্দর্য আস্বাদন করে নিতে হয়। আমরা নিয়েছিলাম তাই। নিজেদের বঞ্চিত হতে দিইনি।

পথ যখন ফুরিয়ে আসছিল, তখন সীমা ভাবি আরও নিবিড় করে আমাকে জড়িয়ে নিচ্ছিল। নিঝুম স্তব্ধতার মাঝে আমি বলেছিলাম -- 'আজিকার মতো এমন সন্ধ্যা, এমন মায়াময় আঁধার আর কোনদিন পাবো না। পৃথিবীতে কিছু স্বর্গীয় ক্ষণ মানুষের জীবনে আসে, যা থেকে মণিরত্ন কুড়িয়ে নিতে হয়।' 

এই পথ চলতে তেমনই কিছু উজ্জ্বল মুহূর্ত পেলাম। এবং তা একান্ত করে নিলাম। হয়তো এটা কোনও পরম পাওয়া নয়। কিন্তু যা পেলাম তা সারা জীবনকালের জন্য পরম হয়ে থাকল। 

সব পরম পাওয়া কাউকেই দেবার হয় না , সেই সত্য কথা বুঝতে পেরে মানুষ নাকি কাঁদে। সীমা ভাবি সেই সত্য কথাটি বুঝতে পেরেছিল। তাই  সেদিন সেই সন্ধ্যায় পথের উপর দাঁড়িয়ে  ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছিল সে। 'চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে/ পরানে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা--দুখের মাধুরীতে করিল দিশাহারা....।'

আমাদের সেই কর্মকাল একদম ক্ষণকালের ছিল। সীমা ভাবি চলে গিয়েছিল অন্য কর্মে, আর আমি থেকে গিয়েছিলাম  আমার কর্মলোকে। 

তারপর কত বছর চলে গেছে! আমার সমগ্র জীবন কালের উপর কত রাত্রির ছায়া এল, কত সন্ধ্যা! কত কর্মে , কত ভাবনায়, কত বিভ্রমে ভেসে উঠত সীমা ভাবির মুখ! কত পথ পেরিয়ে এলাম এই জীবনে! কোথাও কোনও অপার্থিবে সীমা ভাবির সেদিনের সেই কান্নার শব্দটি নিঃশব্দ হলো না !