তখন ভরা বর্ষাকাল। খাল,বিল,নদী,মাঠ, ঘাট সব জলে ভেসে গেছে। মা'র হাতের কড়া করে লেখা একটি পত্র পেলাম। আমাকে বাড়ী যেতে হবে। কি জন্য বাড়ী যেতে হবে পত্রে তার কোনো উল্লেখ নাই। শুধু বলেছে 'পত্র পাওয়া মাত্র চলিয়া আসিবে। কোনো রূপ দেরী করিবেনা।' আমি নতুন চাকুরী নিয়েছি। তারপরেও মায়ের ডাক ,যেতেই হবে। চাকুরী চলে গেলেও যেতে হবে, চাকুরী থাকলেও যেতে হবে। তবে এরূপ কোনো কিছু হয়নাই। কর্তৃপক্ষ আমাকে পাঁচ দিনের ছুটি দিয়েছে।
আমি ভূয়াপুর থেকেই দেখতে পাই রাস্তার দু'পাশে বানের জলে থৈথৈ করছে। ভরা যমুনার উপর লঞ্চ চলতে চলতে যখন সিরাজগঞ্জ শহরে পৌঁছি তখন বিকাল হয়ে যায়। শহরের বাহিরগোলা থেকে কাটাখালী নদীর উপর দিয়ে নৌকায় আমাদের বাড়ী যাওয়া যেতো। আমি ছইওয়ালা ছোট্র একটি ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করি। অথৈ জলের উপর দিয়ে ডিঙ্গিটি ভাসতে ভাসতে যখন বাড়ীতে পৌঁছে তখন সন্ধ্যা গত হয়ে গিয়েছে।
রাতে যখন মা আমাকে খাবার খাওয়াচ্ছে তখন তিনি বললেন- ' ইউনুস ঘটক একটি পাত্রীর অনুসন্ধান দিয়াছে। বংশ মর্যাদা নাকি ভালো। শুনিয়াছি মেয়ে খুবই দর্শনদারী। কালকে তোমাকে নিয়া সে মেয়ে দেখিতে যাইবো। আমি মনস্থির করিয়া রাখিয়াছি, মেয়ে যদি পছন্দ হয়, তবে এই মেয়ের সাথেই তোমার বিবাহের কথা পাকাপাকি করিয়া আসিবো।' আমি বিদ্যাসাগরের মতো মাথা নেরে মাকে সম্মতি জানিয়ে দিলাম।
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম- মা'কে তো সম্মতি জানিয়েই দিলাম। মেয়ে দেখতে না জানি কেমন হয়, সেই কথাই ভাবছিলাম। যদি পছন্দ না হয়, যদি দেখতে অসুন্দর হয়, তখনতো মার উপর দিয়ে কথা বলতে পারবো না। মা যাই পছন্দ করবে তাই আমাকে বিবাহ করতে হবে। জীবনে বড়ো আশা করেছিলাম- আমার বউয়ের চোখ হবে বনলতা সেনের মতো স্নিগধতাময়, কুচবরণ কন্যার মতো কালো লম্বা চুল হবে, অনঙ্গ বউয়ের মতো লাবন্যময় মুখ হবে, চাঁপা ডাঙ্গা বউয়ের মতো লক্ষ্মী হবে, আর আনোয়ারা উপন্যাসের নায়িকার মতো সতি সাধবী হবে। এই সব কথা ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে যাই।
পরের দিন একটি পানসি নৌকা এসে ঘাটে ভিরে। নিকট পরিজনদের মধ্যে একটি সাজ সাজ রব উঠলো। আমার বিয়ের কন্যা দেখতে যাবে। সবাই সুন্দর সুন্দর কাপড় পরিধান করলো। মা, বড়ো বোন, ভাবীসহ আট দশ জন হবে। যেহেতু এটা শুধুই কন্যা দেখা তাই আমাকে কেবল পায়জামা আর পাঞ্জাবী পড়তে হলো। আমরা সবাই যেয়ে নৌকায় উঠি, তারপর নৌকা ছেড়ে দেয়।
কখনো মাঠের জলের উপর দিয়ে, কখনো খাল দিয়ে, কখনো নদী পথ দিয়ে আমাদের নৌকা পৌঁছে যায় ব্রহ্মগাছা গ্রামে। এই গ্রামের পাশ দিয়ে যমুনার একটি শাখা নদী বয়ে গেছে। যার নামও ব্রহ্মগাছা নদী। ভরা বর্ষার মৌসুমে নদীটি খরস্রোতা থাকে। দুপুরের ঠিক পরপরেই আমাদের নৌকাটি শেখ বাড়ীর ঘাটে পৌঁছে যায়। বাড়ীর অন্দরমহলে তখন উৎসবের আমেজ। আমাদের বসবার ব্যবস্থা বাড়ীর খাস মহলেই করা হয়েছে। খাওয়া পর্ব শেষ হয়েছে। এবার কন্যা দেখানোর পালা।
আমরা ঘরের মধ্যে বসে আছি। জরি করা লাল রংয়ের জর্জেট শাড়ী পড়ে ঘোমটা টেনে একটি মেয়েকে আমাদের সামনে আনা হলো। কেউ একজন তার ঘোমটা খুলে দিলো। উন্মোচন হলো ওর মুখখানি। কেউ দেখছে চুল, কেউ দেখছে নাক, কেউ দেখছে ভ্রূ। কেউ দেখছে চোখ, কেউ দেখছে ওর উচ্চতা- কেউ দেখছে মেয়ে কেমন করে হাটে। দেখছে গায়ের রং কেমন, দেখছে হাসিতে গালে টোল পড়ে কিনা, দেখছে মুক্তার মতো দাঁত কিনা। আমিও দেখলাম মেয়েটিকে। ওর নাম শোভা। শোভা দেখতে বেশ সুন্দরী, ওর হাসিতে মুক্তা ঝরে, ডাগর ডাগর চোখ, নির্মল ওর মুখশ্রী। কিন্তু আমার চেতনার রং এর সাথে ওর রং মিললো না। আমি যাকে এতোদিন খুঁজছি, এই পৃথিবীর পথে পথে- এই মেয়ে সেই মেয়ে নয়। আমার চোখ বিনম্র হলো। আমি কোনো কথা বলছিলামনা। আমি মাঝে মাঝে দেখছিলাম- শোভার পাশে বসে থাকা ওর ছোট বোন প্রভাকে। আমার চেতনার রংএর সাথে এই মেয়ের রং মিলে গেছে। এ যে দেখছি সেই মেয়ে- যাকে আমি এতোদিন বিভিন্ন জনারণ্যে খুঁজে বেড়েয়েছি।
আজ আর কোনো মতামত মেয়ে পক্ষকে জানানো হলোনা। সন্ধ্যা রাতের মধ্যেই আমাদের নৌকা বাড়ীর ঘাটে এসে পৌঁছলো। আমি ঘরে যেয়ে শুয়ে পড়ি। ভাবী এসে টিপ্পনী মারলো- 'হায় আল্লাহ, দেখতে না দেখতে ধ্যান শুরু হয়েছে।' আমি কিছুই বললাম না। রাতে যখন খেতে বসেছি মা তখন বললো- 'কন্যা আমার ভারী পছন্দ হইয়াছে। আমি এই মেয়েকে আমার বউমা করিয়া ঘরে তুলিয়া আনিবো।' আমার মন খারাপ দেখে মা প্রশ্ন করে - 'তোমার কি কন্যাকে দেখিয়া পছন্দ হয়নাই ?' তখন আমার খাবার খাওয়া শেষ হয়েছে। হাত ধুতে ধুতে বললাম- 'তোমরা যে মেয়েকে পছন্দ করেছো, তাকে আমার পছন্দ হয়নাই। পছন্দ হয়েছে প্রভাকে। 'এই বলে আমি আমার ঘরের ভিতর চলে আসি।
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম সেই ত্বন্নী তরুণী প্রভার কথা-
কি চঞ্চলা হলো তোমার চোখ, বাঁকা চোখে চেয়ে তুমি কাকে দেখেছিলে মেয়ে ?
এমন এই চোখেই বনলতা সেন কে আমি দেখলাম
আমার সারা জনমের চাহনী তোমার চোখেই স্থির হয়ে গেলো
আকাশে মেঘ ছিলোনা তবু বূষ্টি ঝরছিলো তখন-
এতো অথৈ জল ভেঙ্গে আমি যেয়ে তোমাকেই দেখলাম
মনে হয়েছিলো এই মেয়ে তো আমার জন্ম জন্মান্তরের,
এই ছায়াশীতল ব্রহ্মগাছা নদীর তীরের এই গ্রামে-
জলবতী মায়াবতী এই মেয়ে আমার জন্যই জন্মেছে।
আবার মনটা এই ভেবে বিষন্ন হলো শোভা'র জন্য । ওতো কোনো অন্যায় করে নাই। আমি রাজি হলেই শোভা'ও তো আমার বউ হতে পারে। ওতো স্বপ্ন দেখতে পারে এই রকম-
এ কোন্ ধ্রুবতারার ঔজ্জাল্য নিয়ে আমার আকাশে তুমি আবির্ভূত হলে
তুমি কি দেখতে পাচ্ছো তোমার পাশে একটি নিষ্প্রভ স্বাতি জ্বলে আছে
তুমি অরুন্ধতিকে কেনো খুঁজে বেড়াও-
এতো অথৈ জলে নৌকা ভাসিয়ে তুমি আমাকেই দেখতে এলে
তুমি আছো আমার চোখে, আমার চোখের তারায়-
তুমি দেখেছো ব্রহ্মগাছা নদীতে এখন কতো জল,
সে জলে ভেসে ভেসে এক রাজপুত্রের বাড়ী আমার যেতে ইচ্ছা করে।
একবার মনে হলো, মাকে বলে দেই- শোভাকেই আমার পছন্দ হয়েছে। ওর সাথেই আমার বিবাহের ব্যবস্থা করো। কিন্তু তা আর হলোনা। পরের দিন সারাদিন বাল্য বন্ধুদের সাথে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। আমাদের বাড়ীর সাথে ঐ একই নদী বহমান, সেই নদীর তীরে আনন্দেই সারাদিন ঘুরে বেড়ালাম। তাই মাকে আর কোনো কথা বলা হলোনা। মনে করলাম মা যা করে, আমি তাই করবো।
রাতে খেতে বসেছি। মা তখন বললেন- 'আমি আজকে ইউনুস ঘটককে শেখ বাড়ী পাঠিয়াছিলাম। প্রভার সাথেই তোমার বিবাহের তারিখ পাকাপাকি করিয়া আসিয়াছে। আমি বেশী দেরী করিবোনা। আগামী পরশু দিনই বিবাহের তারিখ ধার্য্য করা হইয়াছে।'
বিয়ের দিন সকালবেলা লাহিড়ী মোহনপুর এলাকা থেকে বড়ো বড়ো দু'টি দক্ষিনা পানসি নৌকা বাড়ীর ঘাটে এসে ভিড়লো। নৌকা দুটিকে রঙ্গিন কাগজ দিয়ে সাজানো হলো। সানাই আর ব্যান্ড পার্টি আনা হোলো। শহর থেকে কলের গানও নিয়ে এসেছে। ফেরদৌসি রহমানের একটি গান বাজছে। 'ওকি বন্ধু কাজল ভ্রোমারে,কোন্ দিন আসিবেন বন্ধু কইয়া যাও, কইয়া যাওরে।'
বিয়ের দিন আকাশে নির্মল রোদ ছিলো। আমাকে শেরওয়ানী ও টুপি পরানো হলো। নৌকায় যেয়ে উঠলাম। দখিন দিক থেকে বাতাস বয়ে আসছে। নৌকায় বাদাম টানানো হলো। মাঝি মাল্লারা গান ধরলো। সানাই বাজছে। কলের গান বাজাচ্ছে। ব্যান্ড পার্টির ঢোলের শব্দে আকাশ বাতাশ মুখরিত হয়ে উঠলো।
শেখ বাড়ীতে বিকালের আগেই বরযাত্রীরা যেয়ে পৌঁছে। এখানেও সানাই বাজছে। চারিদিকে হাসি রাশি রাশি, চারিদিকে উৎসবের আনন্দ। কাজী এসে বিবাহ পড়ালেন। সন্ধ্যার সময় আমাকে নিয়ে প্রভার পাশে বসানো হলো। বাড়ীর বৌঝিরা আনন্দ করছে। আয়নাতে প্রভার মুখ দেখানো হলো। এই সেই মুখ যাকে আমি হাজার বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, তাকেই আজ পেয়ে গেলাম এই ব্রহ্মগাছা নদীর তীরে।
রাতেই নতুন বউকে নিয়ে বাড়ীতে ফিরি। ধান দূর্বা সোনা পানি ছিটিয়ে নববধুকে বরন করে ঘরে তোলা হলো। রাত ততোক্ষণে অনেক হয়ে গেছে। সানাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কলের গান আর বাজছেনা। ঢাকের বারিও থেমে গেছে। ভাবী কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন- 'নাও, এখন থেকে আমার কোমড়ের বাঁকের উপর তোমার আর তাকাতে হবেনা। আমার তুলতুলে গালও তোমার আর টিপতে হবেনা। এবার দরজাটা বন্ধ করে দাও।'
সকালবেলা পাখীর ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তার আগে আযানের সুরও ধ্বনিত হয়েছে। প্রভারও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। বাড়ীর ঘাটে লোকজনের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। সবাই বলাবলি করছে কোথা থেকে এক মেয়ের লাশ এসে ঘাটে ঠেকে আছে। আমি এবং প্রভা ঘাটের দিকে এগিয়ে যাই। লাশটি তখন ঘাটের উপর মাটিতে শুয়ে রাখা হয়েছে। আকাশ বাতাশ বিদীর্ণ করে প্রভা চিৎকার করে তখন বুবু বলে লাশটিকে জড়িয়ে ধরে।
এরপরে পঁচিশ বছর চলে গিয়েছে। আমার জীবনটাকে পুরাপুরি সুখী করতে পারি নাই। একটা অপরাধবোধ আমাকে প্র্তিনিয়ত দহন করে। যদি কখনো বাড়ীতে যাই, যদি তখন ভরা বর্ষার দিন থাকে, যদি সারা নদীর বুকে জুড়ে অথৈ জল থাকে, যদি তখন পূর্ণিমার তিথী হয়- ব্রহ্মগাছা নদীর কুলুকুলু জলের শব্দে তখন শোভার কান্নার ধবনি শুনতে পাই।
ডিসক্লেমেয়ার: এই কাহিনী আমার নিজের জীবনের নয়।
আমি ভূয়াপুর থেকেই দেখতে পাই রাস্তার দু'পাশে বানের জলে থৈথৈ করছে। ভরা যমুনার উপর লঞ্চ চলতে চলতে যখন সিরাজগঞ্জ শহরে পৌঁছি তখন বিকাল হয়ে যায়। শহরের বাহিরগোলা থেকে কাটাখালী নদীর উপর দিয়ে নৌকায় আমাদের বাড়ী যাওয়া যেতো। আমি ছইওয়ালা ছোট্র একটি ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করি। অথৈ জলের উপর দিয়ে ডিঙ্গিটি ভাসতে ভাসতে যখন বাড়ীতে পৌঁছে তখন সন্ধ্যা গত হয়ে গিয়েছে।
রাতে যখন মা আমাকে খাবার খাওয়াচ্ছে তখন তিনি বললেন- ' ইউনুস ঘটক একটি পাত্রীর অনুসন্ধান দিয়াছে। বংশ মর্যাদা নাকি ভালো। শুনিয়াছি মেয়ে খুবই দর্শনদারী। কালকে তোমাকে নিয়া সে মেয়ে দেখিতে যাইবো। আমি মনস্থির করিয়া রাখিয়াছি, মেয়ে যদি পছন্দ হয়, তবে এই মেয়ের সাথেই তোমার বিবাহের কথা পাকাপাকি করিয়া আসিবো।' আমি বিদ্যাসাগরের মতো মাথা নেরে মাকে সম্মতি জানিয়ে দিলাম।
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম- মা'কে তো সম্মতি জানিয়েই দিলাম। মেয়ে দেখতে না জানি কেমন হয়, সেই কথাই ভাবছিলাম। যদি পছন্দ না হয়, যদি দেখতে অসুন্দর হয়, তখনতো মার উপর দিয়ে কথা বলতে পারবো না। মা যাই পছন্দ করবে তাই আমাকে বিবাহ করতে হবে। জীবনে বড়ো আশা করেছিলাম- আমার বউয়ের চোখ হবে বনলতা সেনের মতো স্নিগধতাময়, কুচবরণ কন্যার মতো কালো লম্বা চুল হবে, অনঙ্গ বউয়ের মতো লাবন্যময় মুখ হবে, চাঁপা ডাঙ্গা বউয়ের মতো লক্ষ্মী হবে, আর আনোয়ারা উপন্যাসের নায়িকার মতো সতি সাধবী হবে। এই সব কথা ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে যাই।
পরের দিন একটি পানসি নৌকা এসে ঘাটে ভিরে। নিকট পরিজনদের মধ্যে একটি সাজ সাজ রব উঠলো। আমার বিয়ের কন্যা দেখতে যাবে। সবাই সুন্দর সুন্দর কাপড় পরিধান করলো। মা, বড়ো বোন, ভাবীসহ আট দশ জন হবে। যেহেতু এটা শুধুই কন্যা দেখা তাই আমাকে কেবল পায়জামা আর পাঞ্জাবী পড়তে হলো। আমরা সবাই যেয়ে নৌকায় উঠি, তারপর নৌকা ছেড়ে দেয়।
কখনো মাঠের জলের উপর দিয়ে, কখনো খাল দিয়ে, কখনো নদী পথ দিয়ে আমাদের নৌকা পৌঁছে যায় ব্রহ্মগাছা গ্রামে। এই গ্রামের পাশ দিয়ে যমুনার একটি শাখা নদী বয়ে গেছে। যার নামও ব্রহ্মগাছা নদী। ভরা বর্ষার মৌসুমে নদীটি খরস্রোতা থাকে। দুপুরের ঠিক পরপরেই আমাদের নৌকাটি শেখ বাড়ীর ঘাটে পৌঁছে যায়। বাড়ীর অন্দরমহলে তখন উৎসবের আমেজ। আমাদের বসবার ব্যবস্থা বাড়ীর খাস মহলেই করা হয়েছে। খাওয়া পর্ব শেষ হয়েছে। এবার কন্যা দেখানোর পালা।
আমরা ঘরের মধ্যে বসে আছি। জরি করা লাল রংয়ের জর্জেট শাড়ী পড়ে ঘোমটা টেনে একটি মেয়েকে আমাদের সামনে আনা হলো। কেউ একজন তার ঘোমটা খুলে দিলো। উন্মোচন হলো ওর মুখখানি। কেউ দেখছে চুল, কেউ দেখছে নাক, কেউ দেখছে ভ্রূ। কেউ দেখছে চোখ, কেউ দেখছে ওর উচ্চতা- কেউ দেখছে মেয়ে কেমন করে হাটে। দেখছে গায়ের রং কেমন, দেখছে হাসিতে গালে টোল পড়ে কিনা, দেখছে মুক্তার মতো দাঁত কিনা। আমিও দেখলাম মেয়েটিকে। ওর নাম শোভা। শোভা দেখতে বেশ সুন্দরী, ওর হাসিতে মুক্তা ঝরে, ডাগর ডাগর চোখ, নির্মল ওর মুখশ্রী। কিন্তু আমার চেতনার রং এর সাথে ওর রং মিললো না। আমি যাকে এতোদিন খুঁজছি, এই পৃথিবীর পথে পথে- এই মেয়ে সেই মেয়ে নয়। আমার চোখ বিনম্র হলো। আমি কোনো কথা বলছিলামনা। আমি মাঝে মাঝে দেখছিলাম- শোভার পাশে বসে থাকা ওর ছোট বোন প্রভাকে। আমার চেতনার রংএর সাথে এই মেয়ের রং মিলে গেছে। এ যে দেখছি সেই মেয়ে- যাকে আমি এতোদিন বিভিন্ন জনারণ্যে খুঁজে বেড়েয়েছি।
আজ আর কোনো মতামত মেয়ে পক্ষকে জানানো হলোনা। সন্ধ্যা রাতের মধ্যেই আমাদের নৌকা বাড়ীর ঘাটে এসে পৌঁছলো। আমি ঘরে যেয়ে শুয়ে পড়ি। ভাবী এসে টিপ্পনী মারলো- 'হায় আল্লাহ, দেখতে না দেখতে ধ্যান শুরু হয়েছে।' আমি কিছুই বললাম না। রাতে যখন খেতে বসেছি মা তখন বললো- 'কন্যা আমার ভারী পছন্দ হইয়াছে। আমি এই মেয়েকে আমার বউমা করিয়া ঘরে তুলিয়া আনিবো।' আমার মন খারাপ দেখে মা প্রশ্ন করে - 'তোমার কি কন্যাকে দেখিয়া পছন্দ হয়নাই ?' তখন আমার খাবার খাওয়া শেষ হয়েছে। হাত ধুতে ধুতে বললাম- 'তোমরা যে মেয়েকে পছন্দ করেছো, তাকে আমার পছন্দ হয়নাই। পছন্দ হয়েছে প্রভাকে। 'এই বলে আমি আমার ঘরের ভিতর চলে আসি।
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম সেই ত্বন্নী তরুণী প্রভার কথা-
কি চঞ্চলা হলো তোমার চোখ, বাঁকা চোখে চেয়ে তুমি কাকে দেখেছিলে মেয়ে ?
এমন এই চোখেই বনলতা সেন কে আমি দেখলাম
আমার সারা জনমের চাহনী তোমার চোখেই স্থির হয়ে গেলো
আকাশে মেঘ ছিলোনা তবু বূষ্টি ঝরছিলো তখন-
এতো অথৈ জল ভেঙ্গে আমি যেয়ে তোমাকেই দেখলাম
মনে হয়েছিলো এই মেয়ে তো আমার জন্ম জন্মান্তরের,
এই ছায়াশীতল ব্রহ্মগাছা নদীর তীরের এই গ্রামে-
জলবতী মায়াবতী এই মেয়ে আমার জন্যই জন্মেছে।
আবার মনটা এই ভেবে বিষন্ন হলো শোভা'র জন্য । ওতো কোনো অন্যায় করে নাই। আমি রাজি হলেই শোভা'ও তো আমার বউ হতে পারে। ওতো স্বপ্ন দেখতে পারে এই রকম-
এ কোন্ ধ্রুবতারার ঔজ্জাল্য নিয়ে আমার আকাশে তুমি আবির্ভূত হলে
তুমি কি দেখতে পাচ্ছো তোমার পাশে একটি নিষ্প্রভ স্বাতি জ্বলে আছে
তুমি অরুন্ধতিকে কেনো খুঁজে বেড়াও-
এতো অথৈ জলে নৌকা ভাসিয়ে তুমি আমাকেই দেখতে এলে
তুমি আছো আমার চোখে, আমার চোখের তারায়-
তুমি দেখেছো ব্রহ্মগাছা নদীতে এখন কতো জল,
সে জলে ভেসে ভেসে এক রাজপুত্রের বাড়ী আমার যেতে ইচ্ছা করে।
একবার মনে হলো, মাকে বলে দেই- শোভাকেই আমার পছন্দ হয়েছে। ওর সাথেই আমার বিবাহের ব্যবস্থা করো। কিন্তু তা আর হলোনা। পরের দিন সারাদিন বাল্য বন্ধুদের সাথে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। আমাদের বাড়ীর সাথে ঐ একই নদী বহমান, সেই নদীর তীরে আনন্দেই সারাদিন ঘুরে বেড়ালাম। তাই মাকে আর কোনো কথা বলা হলোনা। মনে করলাম মা যা করে, আমি তাই করবো।
রাতে খেতে বসেছি। মা তখন বললেন- 'আমি আজকে ইউনুস ঘটককে শেখ বাড়ী পাঠিয়াছিলাম। প্রভার সাথেই তোমার বিবাহের তারিখ পাকাপাকি করিয়া আসিয়াছে। আমি বেশী দেরী করিবোনা। আগামী পরশু দিনই বিবাহের তারিখ ধার্য্য করা হইয়াছে।'
বিয়ের দিন সকালবেলা লাহিড়ী মোহনপুর এলাকা থেকে বড়ো বড়ো দু'টি দক্ষিনা পানসি নৌকা বাড়ীর ঘাটে এসে ভিড়লো। নৌকা দুটিকে রঙ্গিন কাগজ দিয়ে সাজানো হলো। সানাই আর ব্যান্ড পার্টি আনা হোলো। শহর থেকে কলের গানও নিয়ে এসেছে। ফেরদৌসি রহমানের একটি গান বাজছে। 'ওকি বন্ধু কাজল ভ্রোমারে,কোন্ দিন আসিবেন বন্ধু কইয়া যাও, কইয়া যাওরে।'
বিয়ের দিন আকাশে নির্মল রোদ ছিলো। আমাকে শেরওয়ানী ও টুপি পরানো হলো। নৌকায় যেয়ে উঠলাম। দখিন দিক থেকে বাতাস বয়ে আসছে। নৌকায় বাদাম টানানো হলো। মাঝি মাল্লারা গান ধরলো। সানাই বাজছে। কলের গান বাজাচ্ছে। ব্যান্ড পার্টির ঢোলের শব্দে আকাশ বাতাশ মুখরিত হয়ে উঠলো।
শেখ বাড়ীতে বিকালের আগেই বরযাত্রীরা যেয়ে পৌঁছে। এখানেও সানাই বাজছে। চারিদিকে হাসি রাশি রাশি, চারিদিকে উৎসবের আনন্দ। কাজী এসে বিবাহ পড়ালেন। সন্ধ্যার সময় আমাকে নিয়ে প্রভার পাশে বসানো হলো। বাড়ীর বৌঝিরা আনন্দ করছে। আয়নাতে প্রভার মুখ দেখানো হলো। এই সেই মুখ যাকে আমি হাজার বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, তাকেই আজ পেয়ে গেলাম এই ব্রহ্মগাছা নদীর তীরে।
রাতেই নতুন বউকে নিয়ে বাড়ীতে ফিরি। ধান দূর্বা সোনা পানি ছিটিয়ে নববধুকে বরন করে ঘরে তোলা হলো। রাত ততোক্ষণে অনেক হয়ে গেছে। সানাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কলের গান আর বাজছেনা। ঢাকের বারিও থেমে গেছে। ভাবী কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন- 'নাও, এখন থেকে আমার কোমড়ের বাঁকের উপর তোমার আর তাকাতে হবেনা। আমার তুলতুলে গালও তোমার আর টিপতে হবেনা। এবার দরজাটা বন্ধ করে দাও।'
সকালবেলা পাখীর ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তার আগে আযানের সুরও ধ্বনিত হয়েছে। প্রভারও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। বাড়ীর ঘাটে লোকজনের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। সবাই বলাবলি করছে কোথা থেকে এক মেয়ের লাশ এসে ঘাটে ঠেকে আছে। আমি এবং প্রভা ঘাটের দিকে এগিয়ে যাই। লাশটি তখন ঘাটের উপর মাটিতে শুয়ে রাখা হয়েছে। আকাশ বাতাশ বিদীর্ণ করে প্রভা চিৎকার করে তখন বুবু বলে লাশটিকে জড়িয়ে ধরে।
এরপরে পঁচিশ বছর চলে গিয়েছে। আমার জীবনটাকে পুরাপুরি সুখী করতে পারি নাই। একটা অপরাধবোধ আমাকে প্র্তিনিয়ত দহন করে। যদি কখনো বাড়ীতে যাই, যদি তখন ভরা বর্ষার দিন থাকে, যদি সারা নদীর বুকে জুড়ে অথৈ জল থাকে, যদি তখন পূর্ণিমার তিথী হয়- ব্রহ্মগাছা নদীর কুলুকুলু জলের শব্দে তখন শোভার কান্নার ধবনি শুনতে পাই।
ডিসক্লেমেয়ার: এই কাহিনী আমার নিজের জীবনের নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন